আত্মপরিচয় সন্ধানে লোকায়ত জীবনের পর্যবেক্ষণ

সাইমন জাকারিয়া

প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে, আমি কোনো চিত্রশিল্পী নই, এমনকি চিত্র-সমালোচক বা চিত্র-বিশ্লেষকও নই। তারপরও বাংলাদেশের লোকায়ত জীবনের নিবিড় পর্যবেক্ষক হিসেবে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চিত্রকলা নিয়ে কিছু কথা বলবার এক ধরনের বিনয়ী অধিকার আমারও আছে। কারণ, জয়নুল আবেদিনের চিত্রশিল্পকলার বৈচিত্র্যময় ভান্ডারের মধ্যে একদিকে যেমন তাঁর সমসাময়িক কালের প্রতিচিত্র তথা সময়-সমাজ-রাজনীতি ও অর্থনীতির দৃঢ়তায় রচিত দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ ইত্যাদি প্রতিফলিত হয়েছে, অন্যদিকে তারও অধিক আবেগ ও আবেদন নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে স্বদেশের প্রকৃতিবাদী, প্রেমময়, জীবনমুখী কর্মোচ্ছলতার মূর্ত ও বিমূর্ত চালচিত্র, যার ভেতর দিয়ে রূপায়িত হয়েছে বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের চিরায়ত নান্দনিক রূপ। তাছাড়া, জয়নুল আবেদিন নিজেই স্বীকার করেছেন – স্বদেশের প্রকৃতি ও জনজীবনই তাঁকে শিল্পসৃজনের প্রেরণা দিয়েছে। এ-প্রসঙ্গে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি ছবি আঁকতে শিখলাম কী করে? বা, কার কাছ থেকে? তবে উত্তর দিতে পারব না। বলব, আমার এদেশের প্রকৃতি আর পরিবেশ আমাকে ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এদেশের আকাশ, নদী, মাঠ, বন, এখানকার মানুষের চলাফেরা, ওঠা-বসা, হাসি-কান্না আমাকে ছবি আঁকতে বলেছে।’ অর্থাৎ জয়নুল আবেদিন স্বদেশের আত্মপরিচয় নির্মাণের শিল্পচর্চায় নিয়োজিত ও নিমজ্জিত হওয়ার জন্য চেতনার গভীরে এদেশের প্রকৃতি ও মানুষের জীবনাচারের কাছ থেকে আদিষ্ট হয়েছিলেন।

গভীরভাবে জয়নুল আবেদিনের চিত্রকলার দিকে তাকালে গতিশীল মানুষের কর্মতৎপরতা আর মানবসমাজ ও সভ্যতাকেন্দ্রিক প্রাণিজগতের গতিশীল জীবন ও কর্মতৎপরতা পর্যবেক্ষণ করা যায়; অর্থাৎ জয়নুলের মানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতির সবকিছুই যেন এক ধরনের ক্রিয়াশীল অভিব্যক্তি নিয়ে চলমান দেখা যায়। এক্ষেত্রে এ-কথাও অনুভব করা যায় যে, একজন জয়নুল আবেদিন যেন প্রাণী ও প্রকৃতিজগতের এই গতিশীলতাকে আবিষ্কার করেছিলেন প্রকৃতি-প্রদত্ত অন্তর্দৃষ্টি থেকে। জয়নুল আবেদিনের জীবন-ইতিহাস থেকে বোঝা যায়, এ-ধরনের অন্তর্দৃষ্টি তিনি অনিবার্যভাবে অর্জন করেছিলেন ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার ব্রহ্মপুত্র নদতীরে জন্মসূত্রে। শৈশব-কৈশোরে দেখা ব্রহ্মপুত্র নদতীরের জনজীবন, মাঝির বৈঠা-বাওয়া, গুণটানা, তীরবর্তী মানুষের শস্য উৎপাদন, মই দেওয়া, শস্য মাড়াই, গ্রামের ধূলি ও কাদালগ্ন বন্ধুর পথ দিয়ে গরুগাড়িতে শস্য নিয়ে যাওয়ার সময় গরু ও মানুষের সমধর্মী-সমমর্মী গতির একাত্মতা ইত্যাদি কর্মতৎপরতা জয়নুলকে সমগ্র জীবন আবিষ্ট করে রেখেছিল। তাই তিনি চিত্রকলার আধুনিক শিক্ষাগ্রহণের পরও গ্রামীণ জীবনের সৌন্দর্য ও বৈভবকে ঘুরেফিরে রূপরংরেখায় বা চিত্রকলার তুলিতে প্রাণময়তা দান করতে তৎপর থেকেছেন। জয়নুল আবেদিনের এ-ধরনের তৎপরতাকে মহাকাব্যিক অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করা চলে। এবার জয়নুলের সৃজিত বাংলাদেশের লোকায়ত জীবনের দু-একটি দৃষ্টান্তের ব্যাখ্যা প্রদান করা যেতে পারে।

‘ফসল মাড়াই’ শিরোনামে জয়নুল আবেদিন-অঙ্কিত চিত্রকর্মের দিকে নিবিষ্টতার সঙ্গে তাকালে বাংলাদেশের লোকায়ত জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আমাদের চোখে ভেসে ওঠে – ১. বাংলাদেশের ফসল উৎপাদনকেন্দ্রিক জনজীবনে নর-নারীর সমান্তরাল কর্মতৎপরতা (জয়নুলের এ-চিত্রকর্মে দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ জীবনের নর-নারীর কর্ম বণ্টনের চিরায়ত রূপ, যেখানে নর অংশ নিচ্ছে অধিক শারীরিক শ্রমসংলগ্ন কাজে, আর নারীকে দেখা যাচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম শ্রমের শারীরিক কাজে অংশ নিতে), ২. ফসল মাড়াইয়ের সময় গৃহপালিত প্রাণীর সহাবস্থান (বিশেষ করে গৃহপালিত মোরগ-মুরগি গভীরভাবে ফসল মাড়াইয়ের উৎসবের মধ্যে অবস্থান নিয়েছে, এমনকি একটি কবুতরও জয়নুলের অন্তর্দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি), ৩. ফসল মাড়াইয়ের সময় বৃদ্ধ ও শিশুদের সহাবস্থান, ৪. ফসল মাড়াইয়ের স্থানটি যে-বাড়ির বাইরের উঠান তা উপলব্ধি করা যায়, স্থানটির সঙ্গে দূরের মাঠ ও আকাশের বিস্তীর্ণ অবস্থান, কয়েকটি খড়ের পালা এবং একজন নারীর কলসি-কাঁখে নদীর দিকে যাওয়া ও একজন ভার বাওয়া লোকের গ্রামের দিকে ভার নিয়ে হেঁটে যাওয়া দেখে। পর্যবেক্ষণ করার বিষয়, এখানে শুধু গ্রামীণ জীবনের ফসল মাড়াইয়ের বাস্তবচিত্র অঙ্কিত হয়নি, তা একই সঙ্গে প্রাণবন্ত ও গতিশীল, জয়নুল আবেদিনের ফসল মাড়াইয়ের চিত্রকলার নানাবিধ চরিত্র সে মানুষ হোক বা প্রাণী হোক, প্রকৃতি হোক, সকলেই প্রাণবন্ত, গতিশীল এবং নিজের নিজের ভূমিকায় কর্মতৎপর, পাশেই রয়েছে বাড়ির সীমানা নির্ধারণকারী একটি মাটির দেয়াল, তার ওপরেও একটি কবুতরকে গতিশীল দেখা যাচ্ছে, ফসল মাড়াইয়ের মধ্যে একজন নারী তো ফসলগুলো অনেক যত্নে কুলায় ঝেড়ে ঝেড়ে ধামায় ভরে তুলছেন। এই চিত্রকলার মধ্যে চিরায়ত বাংলার গ্রামীণ সমাজের আদি অনুষঙ্গ একটি ফসলের গোলাও স্থান করে নিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, কেন জয়নুল আবেদিনের ‘ফসল মাড়াই’ চিত্রকলাটির এমন বর্ণনা দেওয়া হলো? তার বদলে জয়নুল আবেদিনের চিত্রকলাটি দেখার কথা বলে দিয়ে সেই ছবিটি প্রদর্শন করলেই তো হয়, তা হয়, কিন্তু এখানে এই বর্ণনা দেওয়ার অন্য উদ্দেশ্য আছে, তা হলো – বাংলাদেশের লোকায়ত জীবনের ইতিহাস রচনার জন্যে জয়নুল আবেদিনের এ-ধরনের চিত্রকলার একটি অসামান্য গুরুত্ব আছে। আমরা যারা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সমীক্ষা করি বা কালচারাল স্টাডি করি, তারা জানি যে, খুব দ্রুতই এদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন থেকে চিরায়ত বাংলার আদিম সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে বসেছে। যদিও আমরা নৈরাশ্যবাদী নই, তার পরও জয়নুল আবেদিনের ‘ফসল মাড়াই’য়ের এ-ধরনের চিত্রকলা-দৃষ্টে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের লোকায়ত জীবনের অনেক কিছুই হয়তো মেলানো যাবে না। কারণ, আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কৃষি ব্যবস্থা, ফসল মাড়াই ইত্যাদি সকল কিছুতেই বিস্তর পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এক্ষেত্রে জয়নুল আবেদিনের এ-ধরনের চিত্রকলা বাংলাদেশের লোকায়ত জীবনের ইতিহাসের অবলম্বন হিসেবে গৃহীত হতে পারে। কেননা, জয়নুল আবেদিন এখানে পুরোপুরি কল্পনার আশ্রয় নিয়ে কিছু আঁকেননি, আবার বাস্তবচিত্রকে জড় চিত্রকর্মেও রূপান্তর করেননি, বরং বাস্তবতার সঙ্গে অন্তর্দৃষ্টি আরোপ করে তিনি নিজের সমকালের সঙ্গে ভবিষ্যতের সেতুবন্ধ রচনার এক ধরনের অভীপ্সা ছড়িয়ে দিয়েছেন। আসলে, জয়নুল আবেদিনের এ-ধরনের চিত্রকর্ম প্রত্যক্ষ চিরায়ত বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবনাচারের প্রতি এমন এক ধরনের মমত্ববোধ সৃষ্টি হয় যে, কারো কারো মনে হতে পারে, বিবর্তনের সেই চিত্রই স্বাভাবিক ছিল, যেখানে জয়নুল আবেদিন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও গ্রামীণ জীবনের উৎপাদন ও স্বতঃস্ফূর্ততাকে সমর্থন করেছেন।

জয়নুল আবেদিন সংগ্রামকে ব্যাখ্যা করেছেন উৎপাদনের ভার দিয়ে প্রাণী ও মানুষের এগিয়ে যাবার একাত্মতায়। হার্ডবোর্ডে তেলরঙে আঁকা জয়নুল আবেদিনের ‘সংগ্রাম’ শীর্ষক শিল্পকলায় সে-রকম নিদর্শন প্রত্যক্ষ করা যায়। শিল্পকলাটিতে আছে – উৎপাদিত শস্যের বোঝা নিয়ে একটি গরুগাড়ি কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দিচ্ছে, কিন্তু গাড়ির চাকাটি হয়তো আটকে গেছে, গাড়ির কান্ডারি বা বাহক গরুদুটি প্রাণান্ত চেষ্টা করেছে এগিয়ে যেতে। হয়তো তাদের পক্ষে তা অসম্ভব হচ্ছিল ভেবে অনুভূতিপরায়ণ বলিষ্ঠ চালক বা কৃষক মানুষটি গাড়ি থেকে নেমে চাকাতে গতি আরোপ করার জন্য লেগে পড়েছেন, আর গরুর গতির সঙ্গে গতি যোগ করে গাড়িটিকে চলতে সাহায্য করছেন। জয়নুল আবেদিনের এই শিল্পকলা চিরায়ত বাংলার যে-প্রকাশ ঘটিয়েছে, তাতে সর্বপ্রাণবাদী-অনুভূতিসম্পন্ন গ্রামীণ মানুষের জীবনযুদ্ধের গভীরতম সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। কিন্তু কোথায় পেলেন জয়নুল এমন দৃশ্যের চিরায়ত সত্য, নিশ্চয় তা গ্রাম থেকে আহরিত এবং তা তাঁর অনুভূতিসম্পন্ন হৃদয়ের নিবিষ্টতম পাঠ। জয়নুলের আগে কোনো চিত্রশিল্পী এমন দৃশ্যকে অঙ্কন করতে পেরেছেন কি-না তা আমার জানা নেই, কিন্তু জয়নুলের পরে বহু শিল্পী ও শিক্ষার্থীর রং-তুলি বা পেনসিলে তো এ-ধরনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এক্ষেত্রে কাউকে তো জয়নুল আবেদিনকে অতিক্রম করতে দেখা যায়নি। কিন্তু কেন? কারণ, জয়নুল তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে গ্রামীণ জীবনের চিরায়ত যে-মাধুর্যকে ‘সংগ্রাম’ চিত্রকলায় রূপায়ণ করতে পেরেছিলেন, তা কোনো সাধারণ শিল্পী, ব্যক্তি বা শিক্ষার্থীর পক্ষে অবলম্বন করা সম্ভব নয়। জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের নিত্যতার ভেতর ‘সংগ্রাম’কে প্রত্যক্ষ করছেন, এখানে শিল্পী হিসেবে এক ধরনের নবতর ব্যাখ্যা আরোপ করেছেন ঘটমানতায়, যে-কারণে শিল্পকর্মটি মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে। এখানেও বাংলাদেশের লোকায়ত জীবনের সামাজিক ইতিহাস রচনার জন্য জয়নুলের সৃষ্টিকর্ম অন্যতম উপাদান হিসেবে গৃহীত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে বইকি।

জয়নুল আবেদিন শুধু মানুষের চিত্রকর্ম আঁকতে চাননি, বরং প্রাণিজগতের মধ্যে সংস্থাপন করেছেন মানবিক গুণাবলি বা বৈশিষ্ট্য। যেমন বাংলাদেশের লোকায়ত জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত পশুপাখি সকল কিছুর মধ্যে গ্রামীণ মানুষ মানবিক গুণাবলি প্রত্যক্ষ করেন, যে-কারণে বহুকাল আগে থেকেই এদেশের গ্রামীণ মানুষ তাদের গৃহপালিত গরু-বাছুর, মোরগ-মুরগি, পাখি ইত্যাদি সকল প্রাণীর সঙ্গে মানবিক একটা সম্পর্কসূত্র অনুভব করে, আবার এদেশের নানা ধরনের লোকগল্প, রূপকথা, উপকথায় প্রাণিজগতের অন্যরাও মানবিকতার বোধে মানুষের সমান্তরালে বিচরণ করেন। জয়নুল আবেদিন সম্ভবত সেই বোধ থেকে বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রাণীর মধ্যে মানবিক গুণাবলি আরোপ করতে পছন্দ করেছেন। যেমন – জয়নুল আবেদিনের জলরঙে আঁকা ‘বিদ্রোহী’ চিত্রকলাটিতে একটি রশিবদ্ধ গরুর বন্ধন ছিন্ন করার প্রচেষ্টাকে রূপায়িত করেছেন। জয়নুল আবেদিনের মানুষ যেমন বিদ্রোহী, তার গরুও একই রকম বিদ্রোহ প্রকাশরত। উদ্দেশ্য একটাই – বন্ধন ছিন্ন করে স্বাধীন চিত্ত অর্জন করা। গ্রামীণ মানুষের জীবনসংলগ্ন প্রাণিজগতের মধ্যে জয়নুল আবেদিনের প্রিয় প্রাণী ছিল গরু, তিনি গরুর চিত্রায়ণে – রং-তুলিতে হোক, কালি-তুলিতে হোক অথবা জলরঙে সর্বত্রই গরুকে চিত্রায়ণ করেছেন গতিময়, বিপ্লবী, কর্মোচ্ছল চরিত্র হিসেবে, তাঁর একটি গরু প্রায় অধিকাংশ সময় সামনের দুই পায়ের মাঝখানের দিকে মাথা বাঁকিয়ে অদ্ভুত গতি ও জীবনসংগ্রামের প্রাণময় রূপের প্রকাশ ঘটায়। এক্ষেত্রে জয়নুলের অনন্যতা প্রকাশ করে তাঁর গরুর গতিময় ভঙ্গিমা।

জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের লোকায়ত জীবনের সবচেয়ে মহিমান্বিত ইতিহাস রচনা করেছেন তাঁর ‘নবান্ন’ শীর্ষক চিত্রকলায়। জানা যায়, বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদ থেকে বিলুপ্তপ্রায় নবান্ন উৎসবকে স্মরণ করে এবং ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় নবান্ন উৎসব উদ্যাপন উপলক্ষে জয়নুল আবেদিন পঁয়ষট্টি ফুট দীর্ঘ ও পাঁচ ফুট প্রস্থ এ-চিত্রটি অঙ্কন করেন। একই ক্যানভাসে কয়েকটি পর্বে এ-চিত্রে জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের সুখ-দুঃখকে স্থান দেন; চিত্রটির ডানদিক থেকে নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবনের গতিশীল জীবনের প্রতীকী রূপ গুণটানা, চাষবাস তথা মাঠ থেকে ফসল কাটা, ফসল তোলা, ফসল মাড়াই, ঢেঁকিতে ধান ভানা, বিবাহ যাত্রা এবং সর্ব শেষে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহাজনি ঋণের দায়ে সর্বহারা নিঃস্ব গ্রামীণ মানুষের শহরমুখী অভিযাত্রা নিষ্করুণ ইতিহাস রচনাকারের তুলিতে রূপায়িত হয়েছে। লোকায়ত জীবন পর্যবেক্ষণ এবং সমকালের অভিজ্ঞতা থেকে জয়নুল আবেদিন এভাবেই এ-চিত্রটিতে বাংলাদেশের গ্রামীণ উৎপাদনশীল মানুষের জীবনযাত্রার ইতিহাস ও সকরুণ পরিণতিকে তুলে ধরেছেন। আসলে, লোকায়ত জীবন ও পরিপূর্ণ ইতিহাসজ্ঞান ছাড়া এ-ধরনের চিত্রায়ণ ও বিশ্লেষণ কোনো শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব নয়।

জয়নুল আবেদিনের শিল্পকলার ভুবনে বাংলাদেশের লোকায়ত জীবনের প্রতিফলন নানাভাবেই প্রত্যক্ষ করা যায়, বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের দৈনন্দিন জীবনের নান্দনিকতাকে নিয়ে রূপায়ণ করেছেন অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে। এক্ষেত্রে জয়নুলের ক্যানভাসে জলরঙে আঁকা ‘স্নানরতা’ রমণীদের চিত্রটির প্রাণময়তার সঙ্গে নদী, প্রকৃতি ও কর্মজীবন তথা কলসির পানি নেওয়া সম্পর্ককেও তিনি সূচিত করেছেন বেশ দক্ষতার সঙ্গে। এছাড়া, ‘কেশ বিন্যাসরত নারী’, ‘মা ও শিশু’, ‘বধূ ও আয়না’ ইত্যাদিকে জয়নুল আবেদিনের লোকায়ত জীবনের নারীকেন্দ্রিক শ্রেষ্ঠ চিত্রকলা হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

জয়নুল আবেদিন প্রথম থেকেই জানতেন – পৃথিবীর প্রতিটি দেশের চিত্রশিল্পীদের শিল্পকলায় তাঁদের নিজ নিজ দেশের পরিচয় ধরা পড়ে। জয়নুল আবেদিন তাই খুব সচেতনভাবে নিজ দেশের পরিচয়কেই নিজের চিত্রকলায় ধারণ করতে তৎপর ছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি এও জানতেন যে, ‘আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি অনেক পুরোনো – বহু শতাব্দীপ্রাচীন এ-সংস্কৃতি। এবং আমাদের সংস্কৃতিকে যথার্থ অর্থে সমৃদ্ধ করে তোলার জন্য প্রয়োজন নিজ দেশে ও মাটির সত্যিকারের চেতনার সাথে একাত্ম হওয়া।’ (শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, ‘আমাদের ঐতিহ্যের স্বরূপ’, দৈনিক ইত্তেফাক, নববর্ষ সংখ্যা, ১৩৮৮ বঙ্গাব্দ)। জয়নুল আবেদিনের শিল্পকলা পর্যবেক্ষণ করলে তাঁর এ-কথাটির প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করা যায়।

প্রসঙ্গক্রমে এ-কথাও মনে আসে, বাংলাদেশ মানে তো শুধু বাঙালিদের দেশ নয়, বাঙালিদের জীবনাচার ও সংস্কৃতি নয়। কেননা, এদেশে অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস, তাঁদের ভূখন্ডগত বৈচিত্র্যের সঙ্গে আকার, গঠন, সংস্কৃতি, ভাষা, কৃষি-পদ্ধতি, জীবনাচার সকল কিছুতেই স্বতন্ত্র পরিচয় প্রত্যক্ষ করা যায়। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে জয়নুল আবেদিনের চিত্রকলায় বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আবাসিক এলাকার ভূপ্রকৃতি ও তাদের লোকায়ত জীবনের নানা গতিশীল চিত্রমালা প্রত্যক্ষ করি। জয়নুল আবেদিনের চিত্রকলার মধ্যে তেলরঙে আঁকা ‘সাঁওতাল মেয়ে’র খোঁপায় ফুল গোঁজার গতিশীল চিত্র যেমন আছে, তেমনি জলরঙে আঁকা বনের প্রান্তরে ঝুড়ি কাঁখে হেঁটে যাওয়া ‘সাঁওতাল রমণী’, ‘সাঁওতাল দম্পতি’ ও ‘সাঁওতাল পরিবারে’র সুঠাম দেহ, কাপড় পরার ভিন্নতা, প্রকৃতির অনুষঙ্গ আদিবাসী জীবনের রূপায়ণ ঘটায়। এ ছাড়া, জয়নুল আবেদিনের জলরং ও খাগ ড্রইংয়ের পার্বত্য চট্টগ্রামের নৈসর্গিক দৃশ্যাবলি পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রাকৃতিক আবাসভূমিকে নির্দেশ করে।

সামগ্রিক বিচারে জয়নুল আবেদিন স্বদেশের ‘মাটির সত্যিকারের চেতনার সঙ্গে’ এতটাই ‘একাত্ম’ হতে সমর্থ হয়েছিলেন যে, তিনি বাংলাদেশের লোকায়ত জীবনের পরিচয় নির্ধারণে বাঙালি ও অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর চেতনাকে রূপায়ণ করতে সফল হয়েছেন। জয়নুল আবেদিনের কাছে স্বদেশের ভূগোল মানেই গ্রামীণ জীবনাচার এবং তাও আবার কেবলই সমতল নয়, কেবলই বাঙালি নয়, পাহাড়, নদী, সমতল ইত্যাদি সকল স্থানে যেমন তাঁর সমান দৃষ্টি ছিল, তেমনি বাঙালিদের সঙ্গে অপরাপর নৃগোষ্ঠীর প্রতিও তাঁর সমানুভূতি কার্যকর ছিল। জয়নুল আবেদিনের লোকায়ত মানসব্যাখ্যায় এ-বিষয়টির ভিন্নতর গুরুত্ব আছে। নিশ্চয় জয়নুল আবেদিনের জন্মশতবর্ষের আয়োজনের মধ্যে এ-প্রসঙ্গটিও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হবে  –  এ-কামনা করি।