আদি অকৃত্রিম স্বরূপ

 

সুলতান একটি সত্যের ধারক। বাংলাদেশ তথা এ-উপমহাদেশে বাঙালির জীবন-যাপন, সংগ্রাম, দিনপঞ্জি তাঁর মননে প্রোথিত ছিল। নিরন্তর সংগ্রামমুখর আবহমান বাঙালি কৃষকের প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ সুলতানের সঙ্গী হয়েছিল। নাগরিক হতে চাননি কখনো। তাঁর মগজে প্রতিনিয়ত খেলা করেছে বাঙালির বৈরী পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম, মধ্যযুগের সামন্তপ্রভু, পর্যায়ক্রমে ইংরেজ, পাকিস্তানি এবং পরবর্তীকালে স্বদেশীয় শোষক শ্রেণির উপর্যুপরি শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট কৃষকের শরীরে শুধু অবশিষ্ট মাংসহীন দেহের কথা। সুলতান এ-পীড়নে অতিষ্ঠ কৃষক নিয়ে আস্থা হারাননি। তিনি বিশ্বাস করেছেন, আমার কৃষক লাঙল-কাঁধে মাঠে গিয়ে জমি কর্ষণ করে যে-ফসল ফলায় তাতে আমাদের দেশ ধনধান্যে-পুষ্পে ভরে ওঠে। সুলতান ভাবেন, কৃষকের সংগ্রাম অদম্য। কৃষকরা জীবনের সাধনায় নিমগ্ন। তারা মাটিকে চষে শুধু ফসল ফলায় না। মাংসল পেশির শক্তি দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মায়ায় জড়ায়। স্নেহ, প্রেম আর সঙ্গমে প্রকৃতিকে ফুলে-ফলে ভরে তোলে। ক্যানভাসে প্রত্যয়দীপ্ত বলিষ্ঠ মানুষের উপস্থিতি দর্শককে চমকে দেয়। সুলতান শুধু কি কৃষকের কথা বলেছেন? না, তাঁর বোহেমিয়ান জীবনের নানা বাঁকে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানোর সময়কালে অাঁকা দুটি ছবি এ-প্রদর্শনীতে দেখা যায়। লাহোরে অবস্থানের সময় পাকিস্তানের এ-অঞ্চলের প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে তেলরঙে অাঁকা এ-ছবিদুটিতে বাংলাদেশের বাইরের পরিবেশের চর্চার প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলে। সুলতানের ছবিতে কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ, যোদ্ধা, হাজির হলেও রঙের প্রয়োগে তিনি সাবধানি ছিলেন। অস্পষ্ট, ঝাপসা, কুয়াশাচ্ছন্ন, অবগুণ্ঠিত অতীতের কথা রঙে প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের ছবির দর্শকদের মাধ্যমে সুলতান মনের ভেতরে থাকা ইচ্ছাশক্তিকে প্রকাশ করেছেন। গ্রামবাংলার তন্ময় হয়ে থাকা রূপ-রসে বিভোর সুলতান দর্শকদের মনে করিয়ে দেন ইতিহাস-ঐতিহ্য আর চিরযৌবনা বাংলাকে। আমাদের সভ্যতার মূলে রয়েছে কৃষিজীবী মানুষের লড়াই। এককভাবে সভ্যতাকে নিয়ন্ত্রণ করে কিষান আর কিষানি। সুলতানের ছবিতে বারবার হাজির হয় কৃষক আর আকাশের ধোঁয়াচ্ছন্ন মেঘের সঙ্গে রক্তিম আভা। মর্তলোকের সীমানা ছাড়িয়ে মানুষ কোনো কোনো কাজে ঊর্ধ্বাকাশের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করে। মহাকালের কাছে কৃষিজীবী, সুফলা বাংলার দায় শোধ করে সুলতানের কৃষক আনন্দ উদযাপন করে। মাটি ও মানুষের সঙ্গে এ-সম্পর্ক বাংলার মানুষের প্রাণে প্রোথিত। এ এক শক্তি আর সৃষ্টিশীলতার উদযাপন। সুলতান সৃষ্টি করেন বলশালী মানুষ আর মাটি-কর্ষণে ফেঁপে-ওঠা মাটির ঢেলা, যা থেকে উদ্গারিত হয় বপন করা বীজ। এখানেই বাঙালির সফলতা। সুলতানের ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে শিল্পীজীবনের সমান অগ্রগতি আমরা দেখি না। তাঁর মন-মগজে বড় হতে থাকা মানুষ আর সমাজভাবনা সব ছবিতে দেখা যায়। কোনো ব্যাকরণনির্ভর সৃষ্টিকর্ম তিনি তৈরি করেননি। ছবি অাঁকার প্রতিষ্ঠান ছেড়ে ১৯৪৩ সালে যোগ দেন খাকসার আন্দোলনে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বেরিয়ে পড়েন বিভিন্ন দেশে। সে-সময়কার আঁকা ছবির মাঝে প্রকৃতির ছবি তিনি বেশি এঁকেছেন। সিমলায় প্রথম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালে। ১৯৫৩ সালে নড়াইলে তিনি ফিরে এসে আবার দেশে-বিদেশে আসা-যাওয়ার মাঝে নিজেকে ছবিতে যুক্ত রাখেন। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এ-প্রদর্শনী থেকেই বাংলাদেশের মানুষ সুলতানের ছবি অাঁকার বিষয় ও মাধ্যম সম্পর্কে জানতে পারে।

সুলতান তাঁর ছবি-অাঁকা নিয়ে কথাশিল্পী শাহাদুজ্জামানের সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘না, শুধু প্রকৃতি নয়, প্রকৃতির বিচিত্র রূপ আমি North Western Front-এও দেখেছি। তবে কাশ্মিরে আমাকে টানল কাশ্মিরি জীবনটা। পরিশ্রমী জীবন। আমার মনে হলো, তাদের এই hardship-টা বাঙালিরাও করে। খুব ভালো লাগত আমার ওই কাজের মানুষগুলোকে আর মানুষগুলো খুবই সরল। তাছাড়া প্রকৃতি তো আছেই।’ সরকারি ব্যবস্থাপনায় সুলতানের ঢাকায় বসবাস করার আয়োজন হয়েছিল। আবাসিক শিল্পী ঘোষণা করলেন তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার – এসব কিছুই সুলতানকে প্রকৃতির কাছ থেকে ফেরাতে পারেনি। তাঁর পোষা প্রাণী, ষড়ঋতুর দেখা পাওয়া যায় এমন প্রকৃতির সন্ধান পেতে নড়াইলের চিত্রা নদীর তীরে তিনি ফিরে এলেন। নাগরিক হতে সুলতানের ভালো লাগেনি।

ফুল, বৃক্ষ, নদী-পরিবেষ্টিত প্রাকৃতিক মানুষটির সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে পশুপাখির। আদিম ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলে যায় সুলতানের পশুপাখির সম্পর্ক। জীবন-যাপনের ব্যতিক্রমী ধরন দেখে মানুষের মাঝে কৌতূহল জাগত বটে, কিন্তু সুলতানের ধ্যান তো ছবির ক্যানভাসে। রঙের নিরীক্ষা আর মানুষের দেহভঙ্গির ভাঁজে। আধুনিক আবার ঐতিহ্যিক – এ দুইয়ের মিশেলে সুলতান গড়েছেন তাঁর সৃষ্টিভান্ডার। এ-প্রদর্শনীটি বেঙ্গল আর্ট প্রিসিঙ্কট-ডেইলি স্টার গ্যালারিতে শুরু হয় গত ২৩ মে। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘পরাদৃষ্টি’। প্রদর্শিত ছবিগুলো ক্যানভাস ও চটে তেলরং, কাগজে কালি-কলম, জলরং, চারকোলসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আঁকা। মোট কাজের সংখ্যা ৩৬। বেশকিছু শিল্পকর্ম দর্শক এর আগে দেখেননি। বড়মাপের ক্যানভাসগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য ছবি ‘শিরোনামহীন’ – ১৯৯১ সালে অাঁকা। সংঘবদ্ধ হালচাষ বলা যায় এ-ছবিকে। সাতজোড়া গরুর সাহায্যে সারিবদ্ধভাবে হালচাষ করছে কৃষক। মেঘলা আকাশ বলে দেয় এ-ছবির বিষয়ের কথা। চষাক্ষেতে বৃত্তাকার মাটির ঢেলা এক কেন্দ্রবিন্দু তৈরি করেছে। ছবির কেন্দ্র নির্ধারণ করে অন্য বিষয়গুলো উপস্থাপিত হয়েছে মনে হলেও দৃষ্টিকে ক্যানভাসের কেন্দ্র থেকে বাইরে ছড়িয়ে দেওয়া ছিল এ-শিল্পকর্মের মূল লক্ষ্য। অন্য একটি ছবির শিরোনাম – ‘আনটাইটেলড’ – ১৯৮৯ সালে ছবিটি আঁকা। আশির দশক-পরবর্তীকালে সুলতানের ছবির বিষয়ে কর্মচঞ্চল মানুষ ঘরবাড়ি, গাছপালা সমানভাবে গুরুত্ব পেতে শুরু করে। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে-ওঠা জনপদের দিনযাপন সমতলে থাকা মানুষের চেয়ে ভিন্ন। এ-ছবিতে আকাশ আর নদীর নীল জল একাকার হয়েছে।

পরিপ্রেক্ষিতের শেষ বিন্দুতে গিয়ে মিলে যায় আকাশ আর নদী। কৃষক তার হালের গরু গোসল করাচ্ছে। কৃষকের মাংসপেশি    টান-টান। নদীর ঘাটে অন্য পাশে স্নান করছে নারী ও শিশুরা। শিশুরা নগ্ন। নারীরা স্বল্পবসনা। সুলতান মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাখঢাক ছবিতে প্রকাশ করেননি। আদিম মানব শরীরের গড়ন তুলে আনেন ছবির বিষয়ে। তাই তো ছবি হয়ে যায় প্রাগৈতিহাসিক কথন। কাগজে জলরঙে আঁকা আরেকটি উল্লেখযোগ্য ছবি হচ্ছে হার্ভেস্টিং – হালচাষের গরু নিয়ে কৃষক লাঙল-কাঁধে মাঠে যাচ্ছে। পাশে লাজুক গাঁয়ের বধূ নদীতে জল আনতে যাচ্ছে। নদীর নীল জল থেকে ফসল তুলছে আরো দুজন কৃষক। সুলতানের এ-ছবিও জৌলুসপূর্ণ আবেদন জাগায় না। দ্রোহ কিন্তু শক্তি আর সামর্থ্যের ঘোষণা দেয় বারবার।

১৯৮৭ সালে অাঁকা ‘শিরোনামহীন’ ছবিতে ঘরের দাওয়ায় বসে একজন নারীর আরেক নারীর চুল অাঁচড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বৈচিত্র্য আছে। নারীর দেহ সুঠাম, হাত ও পায়ে মোটা ধাতব চুড়ি পরা। শরীরে পেঁচানো শাড়ি অনেকটা অগোছালো। ঘরের চালায় ত্রিভুজাকৃতির উপস্থিতি। ছবির সম্মুখভাগে বড় স্পেসে মেটে হলুদ রঙের উঠান। বাঁদিকে গাভির কাছে কিষানি দুধ দোহন কাজে ব্যস্ত। গরু, কিষানি ও দুই নারী প্রত্যেকের চাহনিতে শক্তি আর নিশ্চয়তা খেলা করে। সুলতানের অাঁকা ছবির এ-প্রদর্শনীতে দেখা নতুন কাজের মাঝে দর্শক ভিন্নতা খুঁজে পান এভাবে। রেখাচিত্রে অাঁকা ছবিগুলোতে কৃষকের মুখের আকৃতি প্রায় একই ধাঁচের। ধারণা করা যেতে পারে, হয়তো ওই আদলের পুরুষ মডেল দেখে তিনি ছবিগুলো এঁকেছেন।

শিরোনামহীন – ১৯৮৬ ছবিতে বাড়ির আঙিনায় ধানের গোলার আকৃতি অনেকটা জ্যামিতিক ত্রিভুজাকৃতির। বাড়ির আঙিনায় কিষানিরা দল বেঁধে ধান ঝাড়ছে। গোলায় ভরে সারা বছরের শস্য মজুদ করছে। ক্যানভাসের এককোণে গরু গামলা থেকে খাবার খাচ্ছে। পুকুরে সদ্য গজিয়ে-ওঠা সবুজ ঘাসের ডগা উঁকি দিয়ে জানান দেয়, প্রকৃতি মাত্র সবুজে ভরে উঠছে। সুলতান এ-ছবিতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের জ্যামিতিনির্ভর ক্যানভাস গড়েছেন। এক দেখায় ছবির জমিনে সারি সারি ধানের গোলাকে জ্যামিতিক আকৃতিতে বিন্যস্ত নির্বস্ত্তক ক্যানভাস মনে হয়। সুলতান বিশুদ্ধ বিমূর্ত কথা ও প্রথার বিপক্ষে। তাঁর ক্যানভাসে প্রাণের উপস্থিতি অনিবার্য। রং, রেখা, রূপ, রস, ছন্দ ছবির মৌলিক উপাদানের মাঝে থেকেই মূর্ত করেছেন তাঁর সৃষ্টিকর্ম।

স্বদেশ, অধিকার, প্রকৃতি, দ্রোহ, সংগ্রাম, তৃণমূল মানুষের দিনযাপনের মুহূর্তকে ছবির বিষয় করে নিয়ে এস এম সুলতান আমাদের জানিয়ে দেন, আমরা আমাদের ঐতিহ্য আর ইতিহাসের পথ বেয়ে আজকের আধুনিক বাঙালি সমাজ নির্মাণ করেছি। জঙ্গম জীবনের দেবদূতরূপী মানুষের অবয়ব ক্যানভাসে তুলে এনে    শস্য-শ্যামল, সুফলা, বাংলাদেশের কথা ঘোষণা করেছেন। সুলতানের আঁকা ছবির প্রদর্শনী ‘পরাদৃষ্টি’ শেষ হবে ১৩ জুলাই ২০১৪।