আধুনিক কবিতা ও বিষ্ণু দে

মামুনুর রহমান

বিষ্ণু দে আধুনিক বাঙালি কবি, গদ্যলেখক, অনুবাদক, আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা যুগ অ্যাকাডেমিক এবং শিল্প-সমালোচক। তিনি আধুনিক বাঙালি কবিদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও চিমত্মাশীল ব্যক্তিত্ব। তিরিশের আধুনিক বাঙালি কবিদের অন্যতম। বিষ্ণু দে-র কবিতায় পাওয়া যায় মনীষা ও আবেগের সহজ সমন্বয়জাত দেশজ ঐতিহ্য ও বিশ্বসাহিত্যের বিচিত্র ভাবনার  ঐতিহ্যকে, যা তিনি আত্মস্থ করেছেন নিজের গভীর ভাবনাবোধ ও ব্যাপক বিশেস্নষণাত্মক কোনো এক অনুভূতি দ্বারা। তাঁর কাব্যচিমত্মার মূলগঠনে যেমন ইউরোপীয় আধুনিক কবিদের চিহ্ন অতি সুস্পষ্ট, তেমনি রয়েছে প্রভাবশীল মার্কসীয় দর্শন।

বিষ্ণু দে জীবনের কোনো এক সময়ে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীনতার প্রবাহিত ধারার মধ্যে দিয়েও সময় কাটিয়েছেন; যা আমরা দেখতে পাই তাঁর রচিত বেশ কিছু কবিতায়। রাজনীতি ও সামাজিক আন্দোলনের প্রতি সচেতনতা; বাংলাদেশের লৌকিক যাপিত জীবনচর্চার প্রতি অনুরাগ, গভীর অনুভূতিপ্রিয়, পুরাণ এবং ইতিহাস জাগ্রতবোধ, ছন্দের সুচারু সার্থক ব্যবহার, বিচিত্র বিন্যাসে কবিতায় মিলের চমক, শব্দ প্রয়োগে নৈপুণ্যের ব্যবহার এবং সর্বোপরি এক বিরাট বিশ্ব ও মানবিক বোধে নিমগ্ন আধুনিক কবি বিষ্ণু দে। তিনি বামপন্থী দর্শন দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন প্রথম জীবনে। এছাড়া তিনি কবি টি.এস. এলিয়টের রচনাশৈলী এবং ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

বিষ্ণু দে-র মধ্যে নতুন এক পথ দেখতে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিষ্ণু দে-র কবিতা কাঠামোগত নতুন কোনো কবিতা নয়; সেই কবিতায় দেখা দেয় আমাদের ব্যক্তিত্ব প্রকাশের এক অভূত সমন্বয়। তিনি কি ফুরিয়ে যান আমাদের মনের স্থান থেকে খুব কম সময়ে? তাঁর কবিতায় যেমন রয়েছে আপাতপ্রচ্ছন্ন বৈচিত্র্যময় শব্দের খেলা, তেমনি রয়েছে শব্দের ঝঙ্কার। তাঁর ছন্দ যান্ত্রিক নয়; অনুভূতির সঙ্গে ছন্দের সম্পর্কে তিনি সর্বদা সচেতন। কিন্তু বিষ্ণু দে-র কবিতা দেখা দেয়নি সম্পূর্ণভাবে দুর্বোধ্য হয়ে। কখনো কখনো তা কেবল উঁকি মেরেছে। বিষ্ণু দে-র কাব্যভাবনায় জেগে উঠেছে ছন্দ ও শব্দের এক অসামান্য অধিকার। যা আমরা তাঁর একক কোনো কাব্যের মাঝে পাই না; বরং পাই সম্পূর্ণ কাব্য জুড়ে।

তিরিশের প্রধান কবিদের একটি দিক খুব স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়; আর তা হলো, তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ এবং নিজস্বতার পরিচয়। যে-দৃষ্টিকোণ আর নিজস্বতা থেকে বাদ যাননি বিষ্ণু দে-ও। কখনো সেটাই দেখা দিয়েছে কবিতার শব্দের রুচি আর অভিরুচির ব্যাপার হয়ে। বিষ্ণু দে; ব্যক্তিগত শোক, দুঃখ, অনুতাপ, আবেগ আর অনুশোচনাকে নিয়ে আসেননি তাঁর কবিতার মধ্যখানে। কিন্তু তাঁর কবিতা থেকে গেছে ভাষা সংহত এক কবিতা হয়ে, যা হয়ে ওঠে এক বিশুদ্ধ কবিতারূপে। যে-ভাষা তিনি নির্বাচন করেছেন তা হয়ে উঠেছে একামত্মভাবে বিষ্ণু দে-র ভাষা হয়ে; যে-ভাষা প্রসারিত রূপ পেয়েছে তাঁর-ই কবিতায়। সেই ভাষা বহুরূপী না হয়ে বরং হয়ে ওঠে কবিতার নাগরিক ভাষায়। বিষ্ণু দে-রচিত ভাষা একামত্মরূপে তাঁর নাগরিক ভাষা। যে-ভাষা নিয়ে খেলা করেননি অন্য কেউ; অন্যের ভাষা নিয়ে যেমন মেতে ওঠেননি তিনি নিজেও।

তিরিশের কবিদের ভাষার একামত্ম পাল উড়িয়েছেন দুজন। একজন জীবনানন্দ দাশ, অপরজন বিষ্ণু দে। জীবনানন্দ দাশ  যেমন বেছে নিয়েছেন প্রকৃতি আর তার নিঃসঙ্গতাকে; তদ্রূপ বিষ্ণু দে বেছে নিয়েছেন নগরজীবনের নাগরিক শব্দমালাকে, যে-শব্দমালা তাঁর কবিতায় আমরা পাবো প্রথম থেকে শেষ পর্যমত্ম। গীতিধর্মী বোধের সঙ্গে তিনি সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন লিরিক্যাল অনুভূতির; যার ফলে তাঁর কবিতা পেল সার্থকতার রূপ। তিনি চেয়েছিলেন পূর্বের কবিদের থেকে ভাব ও ভঙ্গিগত বৈচিত্র্যময় পরিবর্তন; যা আমরা স্পষ্টভাবে লক্ষ করি তাঁরই রচিত  কবিতায়। পৃথিবীর সকল ভাষা হয়তো তাঁর একামত্ম ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি; তার ভাষা কি হয়ে উঠেছিল কবিতাপ্রিয়দের কাছে প্রিয় ভাষারূপে? সেই সব কবিতার ভাষা নিয়ে তিনি খেলেছেন সকাল, বিকেল আর সন্ধ্যায়।

মার্কসীয় দীক্ষা তাঁর কবিতাকে উজ্জীবিত করেছে; পরাস্ত করেনি। সেটা বিষ্ণু দে-র কবিতার অভ্যমত্মরে প্রবেশ করলে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই। বিষ্ণু দে লিখেছেন বিচিত্রাকলেস্নালে; যদিও কবিতার মধ্যভাগে তাঁর লেখা বেশি এসেছে প্রগতিধূপছায়ায়ধূপছায়া সম্পাদনাতেও ছিল তাঁর হাত। পরবর্তী সময়ে প্রগতির একামত্ম সম্পর্কে মিশে যান বুদ্ধদেবের সঙ্গে। তারও পরবর্তী সময়ে আরো গভীরভাবে মিশে যান কবিতা পত্রিকার সঙ্গে। ১৯৩১-এ পরিচয় পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণু দে-র কবিতাজগতের এক ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যায়। প্রকাশিত হতে থাকে কবিতার পর কবিতা। পরিচয়-সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে হালকা সম্পর্ক এবার এগিয়ে যায় বন্ধুত্বের দিকে। এখানে এসে শুধু সুধীন্দ্রনাথ দত্ত নয়; পরিচয় ঘটে আরো অনেকের সঙ্গে, যে-সম্পর্ক অটুট ছিল জীবনের দীর্ঘ সময়। পরিচয়ের প্রথম সংখ্যাতেই বিষ্ণু দে প্রকাশ করেন প্রম্নস্ত অনুবাদ। কবিতা লিখেছেন দুটি, ‘পরিচয়ের প্রথম সংখ্যার শ্রেষ্ঠ কবিতা।’ দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশ করেন লরেন্সের সমালোচনা। পরিচয়ে প্রকাশিত হয় বিষ্ণু দে-র বিখ্যাত কিছু কবিতা। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘ওফেলিয়া’, ‘জিজীবিষা’, ‘ঘোড়সওয়ার’ ইত্যাদি। ১৯৩৬ সময় পর্যমত্ম রচনা তালিকায় শুধু দুটি বাংলা বইয়ের সমালোচনার খোঁজ পাওয়া যায়। সে-দুটি হলো  –  অচিমত্ম্যকুমার ও বুদ্ধদেব বসুর কাব্যগ্রন্থ। পরিচয়ের বড় একটা উদ্দেশ্যই ছিল সমালোচনার মানোন্নয়ন এবং বিদেশি গ্রন্থের পরিচয় প্রদান করা। সে-উদ্দেশ্য সফলে তাঁর সহায়ক ছিলেন বিষ্ণু দে। ১৯৩৩-এ যখন বিষ্ণু দে-র উর্বশী ও আর্টেমিস প্রকাশিত হয়; তখন প্রকাশক হিসেবে নাম থাকে বুদ্ধদেব বসুর। এর দুবছর পরেই বুদ্ধদেব বসু বের করেন সেই বিখ্যাত  পত্রিকা। প্রথম থেকেই তাঁর একামত্ম সহযোগী হিসেবে নাম থাকে বিষ্ণু দে-র। শুধু কবিতাতেই নয়; তাঁর কর্মসূচির ব্যাপ্তি ছিল অন্যান্য কর্মকাণ্ডও। কবিতা এবং পরিচয় – এ দুই পত্রিকাতেই সমানভাবে লিখেছেন বিষ্ণু দে। তিনি নিজ থেকেই প্রয়োজনীয়তা বোধ করছিলেন এই দুটি পত্রিকার।

বিষ্ণু দে তাঁর জীবনব্যাপী একামত্মভাবে বেছে নিয়েছিলেন দুজন ব্যক্তিকে। তাঁদের কথা তিনি প্রকাশ করেছেন বহু স্থানে; বিভিন্নভাবে। একজন টি. এস. এলিয়ট এবং অপরজন শিল্পী যামিনী রায়। দুজনই খুব প্রয়োজনীয় ছিলেন কবি বিষ্ণু দে-র জন্য। বিষ্ণু দে-র সব রচনার মধ্য থেকে ১৯৫০-৫১ এবং ১৯৬০-৬১ – এই সময়কালকে তাঁর সৃজনশীলতার উজ্জ্বল সময় বলে বিবেচনা করা হয়। তিনি তাঁর চিমত্মাকে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেছেন; আর মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন কবিতাকে, যার মাধ্যমে তিনি স্বপ্ন আর বাস্তবতার সমন্বয় করেছিলেন একই সূত্রে। স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত, তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ প্রভৃতি কাব্যের প্রকাশকাল ১৯৫৮। এ-বছর শুধু এ-কাব্যগুলোই প্রকাশ পায়নি; বাংলা প্রবন্ধ, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লেখা, অনুবাদ এবং ইংরেজি প্রবন্ধ ইত্যাদি লেখা প্রকাশ পায়। রবীন্দ্রনাথের কাব্য সম্পর্কে বিষ্ণু দে-র ভাবনা ছিল তীব্র, গভীর; তাই তাঁর কাব্য সম্পর্কে করতে পেরেছিলেন এরকম একটি মমত্মব্য, ‘রবীন্দ্রনাথের কাব্যে উৎপ্রেক্ষার ব্যঞ্জনার চেয়ে উপমার ব্যাখ্যানে প্রবণতা’। যদিও পরবর্তী সময়ে এর গভীরতা বেশিদিন বিরাজ করেনি।

এলিয়টের সঙ্গে বিষ্ণু দে-র সম্পর্কের কথা আমাদের অজানা নয়। তিনি বারবার ফিরে গেছেন এলিয়টের কাছে, দেখিয়েছেন কবিতা ও তাঁর ভাবনার বহির্বিশ্বের দিকটি। শুধু এলিয়টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে এলুয়ার এবং আরাগর কবিতার মধ্যে বিচরণ করেছেন নিজের মতো করে। বিষ্ণু দে-র কবিতার আর একটি দিক আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই, আর তা হলো, প্রথম দিকের ফ্রয়েডের ছায়া যত বেশি, ঠিক ক্ষণিক পরে দেখতে পাই মার্কসের প্রভাব তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

বিষ্ণু দে সম্পর্কে আরো জানা যায় আধুনিক বাংলা কবিতার গ্রন্থগুলোতে। দীপ্তি ত্রিপাঠি তাঁর আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয় শিরোনামের গ্রন্থটিতে বিষ্ণু দে সম্পর্কে বলেন : ‘শুধু সাহিত্য নয় – চিত্র, সংগীত, নৃত্য, নাট্য, শিল্পের বিভিন্ন বিভাগের নব নব আন্দোলন থেকে রস আহরণ করে বিষ্ণু দে-র কবিমানস সমৃদ্ধ। সেজান থেকে পিকাসো, মনে থেকে মাতিস, যামিনী রায় থেকে গোপাল ঘোষ, বালা সরস্বতী ও রুক্সিনি অ্যারুন্ডেল, আইজেনস্টাইন ও সত্মানিসস্নাভস্কি – সকলের সম্বন্ধেই বিষ্ণু দে-র চৈতন্য জাগর।  বিজ্ঞানে, বিশেষ করে আধুনিক মনোবিজ্ঞান এবং নৃতত্ত্বে, বিষ্ণু দে-র দখল বিস্ময়কর। সুধীন্দ্রনাথের কবিতার মতো তাঁর কবিতা শুধু বিদগ্ধই নয়, তা বিচিত্র, এলিয়টের ভাষায় বলা চলে – Variety and complexity, playing upon a refined sensibility. কাব্যে জীবনের জটিলতা ও বৈচিত্র্যের স্বাদ এসেছে বলে তাঁর প্রথম দিকের কাব্যে কিছু অনাবশ্যক পা–ত্য প্রদর্শনের প্রমাণ মেলে; কিন্তু অধিকাংশ স্থলেই তিনি কাব্যের উপাদান সংগ্রহে এবং সে-উপাদানের ব্যবহারে ও কবি-কৌশলের প্রয়োগে দিশাহারা হয়ে পড়েননি। জীবনের অভিজ্ঞতা এবং সাহিত্য পাঠলব্ধ অনুভূতির সুষ্ঠু সমন্বয় যে তিনি করতে পেরেছিলেন, কাব্যসাধনার প্রথম পর্বেই যে-আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন ‘emotional equivalent of thought’, তার প্রমাণ ‘চোরাবালি’, ‘ওফেলিয়া’, ‘পদধ্বনি’, ‘জন্মষ্টমী’ ইত্যাদি কবিতা। তবে ঐতিহ্যের টুকিটাকি দিয়ে তিনি সভ্যতার জাদুঘর সাজাতে চাননি। বিভিন্ন যন্ত্রের বি-সম সুরের মধ্য দিয়ে যেন সৃষ্টি করতে চেয়েছেন একটি ঐকতান। r