আনিসুজ্জামান স্মরণ

আনিসুজ্জামানের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় শিকাগোর ইন্টারন্যাশনাল হাউজে, ১৯৬৫-তে। আমার বন্ধু কে.এল. কৃষ্ণ তখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পিএইচ.ডি করছেন; আমি ব্লুমিংটন, ইন্ডিয়ানা থেকে তাঁর কাছে বেড়াতে এসেছি। আনিসুজ্জামান ‘দক্ষিণ-এশীয় ভাষা ও সভ্যতা’ বিভাগে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো। কৃষ্ণই বোধহয় আলাপ করিয়ে দিলেন। ঢাকার মানুষ। নম্র। তাঁর বিদ্যাবত্তার কথা তখন কিছুই জানি না। কিন্তু পরে যখন ১৯৭০-এ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের দি ওয়ার্ল্ড অব টোয়াইলাইট বেরোয়, তখন বুঝলাম তাঁর শিকাগো প্রবাসেই তিনি এডওয়ার্ড ডিমকের সঙ্গে একযোগে সুধীন্দ্রনাথের দুটি প্রবন্ধের ইংরেজি করেন, ‘কাব্যের মুক্তি’ ও ‘ডব্ল্যু বি. য়েট্‌স্‌ ও কলাকৈবল্য’। ওই অনুবাদের গল্প তাঁর প্রথম আত্মজীবনী কাল নিরবধির ‘প্রথম প্রবাস’ অধ্যায়ে তিনি অনেক পরে নিজেই করেছেন : কী করে দি ওয়ার্ল্ড অব টোয়াইলাইটের সম্পাদক এডওয়ার্ড শিল্‌স ডিমককে সুধীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ তরজমার কথা বলেন এবং ডিমক বলেন সুধীন্দ্রনাথের বাংলা তাঁর পক্ষে অতি দুরূহ, তবে আনিসুজ্জামানের সাহায্য পেলে চেষ্টা করতে পারেন, আর তারপর কী করে শিল্‌স তখন শিকাগোস্থিত রাজেশ্বরী দত্তকে দিয়ে আনিসুজ্জামানকে অনুরোধ করান। বস্তুত, যাঁরা বাংলা জানেন না তাঁদের কাছে সুধীন্দ্রনাথের তথাকথিত ‘দুর্বোধ্য’ গদ্যের অমন নির্ভরযোগ্য ইংরেজি পাঠ সহজে মেলে না।
আবার একসময় শুনলাম, তিনি ১৯৭৪-৭৫-এ লন্ডনে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি ও অভিলেখাগার ঘেঁটে কিছু আঠারো শতকের বাংলা চিঠি খুঁজে পেয়েছেন – নিতান্তই কেজো চিঠি, ভাঙাচোরা, তবু হয়তো তাতে পুরনো বাংলা গদ্যের এক নজির রয়ে গেছে। গবেষক হিসেবে এটা মস্ত কাজ। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করে, বাংলা গদ্যের অন্য প্রান্ত ঘেঁটে এসে এই প্রথম প্রান্তের পরিচয় পেয়ে তাঁর কেমন লেগেছিল? তাঁকে একান্তই গবেষক বলতে আমার একটু বাধে, কেননা তিনি যে লেখকও তার মন্দ প্রমাণ তো আগে দেননি। গল্প লিখেছিলেন, কবিতা লিখেছিলেন, অনুবাদ করেছিলেন, গানও বেঁধেছিলেন (একবার তো তাঁর সলিল চৌধুরীর ছাদে বাঁধা এক গানের জন্য তাঁকে, তিনি নিজেই মজা করে বলেছেন, কেউ কেউ ‘পানি চৌধুরী’ আখ্যাও দিয়েছিলেন), এবং প্রবন্ধ তো অনেক আর তার সবটাই গুরুভার নয়। অল্প বয়স থেকেই তিনি উদ্যোগপ্রবণ, সভা-সমিতিতে উদীয়মান, কোনো আন্দোলনের প্রচারপত্র বা সম্মেলনের উপক্রমণিকা রচনায় তৎপর, যুক্তিবাদী কিন্তু যুক্তিসর্বস্ব নন, আধুনিকমনা। লেখক মহলেও তাঁর অবাধ চলাফেরা। হয়তো বংশাণু হিসেবে তাঁর পিতামহ শেখ আবদুর রহিম তাঁর লেখকসত্তায় কাজ করছিলেন। তবে ধর্ম নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি তাঁর ছিল না। একসময়ে সেই বিশ্বাসেই তিনি আস্থা হারালেন। ‘ইহজাগতিকতা’ই হয়ে উঠল তাঁর ধর্ম।
তাঁর শেষ আত্মজীবনী বিপুলা পৃথিবীর পরিশিষ্টে একঘর আলোকচিত্র আছে। শেষ ছবি রাজেশ্বরী দত্তের। যখন ’৭৪-৭৫-এ তিনি লন্ডনের সোয়াসে, তখন রাজেশ্বরী দত্তের সঙ্গে এক স্নেহের সম্পর্ক তাঁর গড়ে ওঠে (দশ বছর আগে শিকাগোতে তাঁর আহূত এক রবীন্দ্র-নজরুল সভায় যেমন অতিথি বুদ্ধদেব বসু ও প্রতিভা বসু বক্তৃতা করেছিলেন, তেমনি সুধীন্দ্রনাথের মৃত্যুপরবর্তী নীরবতা ভেঙে রাজেশ্বরী দত্ত তাঁরই অনুরোধে গান গেয়েছিলেন), যদিও এক দুর্ভাগ্যজনক ভুল-বোঝাবুঝিতে তা টেকেনি। তবে তাঁর বিপুলা পৃথিবী সত্যিই বিপুল – তাঁর দেশের হয়ে তিনি কোথায় না গেছেন, কত বিষয়েই না কথা বলেছেন, আর কত লোকেরই না বন্ধুতা অর্জন করেছেন! আবার, দেশেও কি তিনি কম করেছেন! দেশের এ-তাবৎ ইতিহাসের কোন ক্ষণে তিনি হাজির নেই, কর্মপ্রাণ, হিত-অহিতজ্ঞানী! ব্যক্তি হয়েও তিনি সমাজচেতন (দক্ষিণের চেয়ে তিনি বামেই বেশি ঝুঁকতেন), কিন্তু সমাজের যূপে ব্যক্তি-বলির বিরোধী।
ভবভূতির ‘কালো হি অয়ং নিরবধিঃ বিপুলা চ পৃথ্বী’কে তাঁর দুই মুখ্য আত্মজীবনীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন আনিসুজ্জামান, যেন-বা এক সাধারণীকরণের ঈপ্সায়। এর মাঝখানে আছে আমার একাত্তর। যে-সুতো ‘অপারেশন সার্চলাইটে’র উল্লেখে পাকাতে থাকে, তা খুলতে খুলতেই একাত্তর। ২৫ মার্চের পাশবিক হত্যালীলায় (যাতে আনিসুজ্জামান তাঁর নিকট মানুষ অনেককেই হারান) বিচলিত হয়ে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২৮’ নামের যে-কবিতা লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু তা কি আনিসুজ্জামানের চোখে পড়েছিল? আর আমার বাড়িতে যে-শিক্ষক আশ্রয় নিয়েছিলেন একাত্তরে, কবি শামসুল আলম সাইদ (নামে ভুল করছি না তো?), সাকিন চট্টগ্রাম, তাঁর পত্নী-সন্তানের বিচ্ছেদে ব্যাকুল, তাঁকে কি চিনতেন আনিসুজ্জামান? জিগ্যেস করা হয়নি। অথচ কতবারই তো দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে, আমাদের এই শহরে, তাঁর জন্মভূমিতে, অবশ্য একাত্তরের অনেক পরে। আমারই মতো এক বাঙালি, তবে আমার মতো অলস নন। প্রজ্ঞাচঞ্চল। নবনীতা (দেবসেন) যে তাঁকে একবার রাধারানী দেবীর উপস্থিতিতে ভাইফোঁটা দিয়েছিলেন – সঙ্গে নিত্যকার ভ্রাতৃপ্রতিম তারাপদ রায়কেও – তা শুনে আমার আনন্দ হয়েছিল। কারণ নবনীতা আমার ভগ্নিপ্রতিম, ও তাঁর কাছে ভাইফোঁটা ছিল আমার নিত্যপ্রাপ্য। সেবারে শহরে না থেকে সেই ভাইফোঁটা থেকে বঞ্চিত হয়ে, আনিসুজ্জামানের এক দোসর ভাই হবার সুযোগ হারিয়েছিলাম। আর এই তো সেদিন – বাড়িতে এক কঠিন অসুস্থতা চলছে – গেছি তাঁর ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য প্রকাশে, দেখা হতেই প্রথম জিজ্ঞাসা : অসুস্থ ব্যক্তিটি কেমন আছেন? কারো কাছে, হয়তো স্বপন মজুমদারের কাছে, শুনেছেন। তার আগে, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ রবীন্দ্র-সার্ধশতবর্ষ উদ্‌যাপনে কলকাতায় এক আলোচনা সভায় দেখা। তাঁর প্রবন্ধপাঠে দৈবাৎ আমিই ছিলাম সভামুখ্য। আবার, তাঁরই অভিভাবকত্বে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্র-সার্ধশতবর্ষ উৎসবে, দৈবাৎই বোধ করি, ঢাকা গেছি – ১৯৫১-তে সিলেট ছাড়ার পরে ওই প্রথম ও-বঙ্গে। ২০১৫-তে দেখা টোকিওয়, ক্যোকো নিউয়াদের আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা সম্মেলনে, আমি যে-অধিবেশনে প্রবন্ধ পড়লাম তাতে সভামুখ্য তিনি। সমাপ্তি অধিবেশনের এক ছবিতে দেখছি আমি স্বেচ্ছাক্রমী বক্তা আর তিনি সভাপতিমণ্ডলীতে আসীন, আশ্চর্য স্বস্থ। ২০১৭-তে যখন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে সিলেট যাই (ছেষট্টি বছর পর আমার জন্মশহরে) তখন তিনি অন্যত্র, বোধহয় শরীর সারাচ্ছেন। দেখা হলো বছর দুই পর, কলকাতায় দুই বাংলার সম্মিলিত ‘বাংলা উৎসবে’র উদ্বোধনে। যখন উঠে আসি তখন আনিসুজ্জামানের কাছে বিদায় নিয়ে বলেছিলাম, এ-যাত্রায় আর বোধহয় দেখা হবে না। সেই শেষ দেখা।
পুনশ্চ
আনিসুজ্জামান নিয়ে আমার চেয়ে ঢের বেশি করে যাঁর লেখার কথা ছিল তিনি স্বপন মজুমদার। কিন্তু তিনি তো কবে থেকেই তাঁর লেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর স্ট্রোকের পর যতবার আনিসুজ্জামান কলকাতা এসেছেন তাঁকে দেখে গেছেন। এমনকি শেষবারও এয়ারপোর্টের পথে। তাঁর মন নিশ্চয়ই আনিসুজ্জামানকে স্মরণ করছে।