আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর দশ প্রবন্ধের দশদিক

শাহাবুদ্দীন নাগরী

‘কবি’ হিসেবেই থেকে যেতে পারতেন আমৃত্যু, কিন্তু যাঁর স্বভাব সব দরোজা-জানালা খুলে খুলে দেখা, তিনি কি শুধু কবিতার ঘোরের ভেতরেই মগ্ন থাকতে পারেন? অথবা এমনও হতে পারে তাঁর ভেতরে ‘কবি’ হিসেবে বেঁচে থাকবার আতমবিশ্বাস ক্রমেই খর্ব হয়ে যাচ্ছিল! জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) সম্পর্কিত অনুসন্ধান করতে গিয়ে এমন একজন বিশিষ্ট কবির শেষ জীবনের রাশি রাশি অশ্রুকণার ভেতর হয়তো তিনি দেখেছিলেন নিজের প্রতিবিম্ব। জীবনের শেষ কটি বছরে জীবনানন্দের অনেক কবিতা আর কথাসাহিত্য ফেরত এসেছে নামিদামি পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তর থেকে। আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০১০) একটু একটু করে জেনেছিলেন সব। হয়তো-বা এ-কারণেই তিনি আচ্ছন্নতার ভেতর থেকে নিজেকে টেনে তুলেছিলেন মননশীল পৃথিবীতে। কবিতা লেখার চেয়ে অন্যের কবিতা নিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর বহুমাত্রিক-বহুরৈখিক কর্মকান্ড। ১৯৭২ সালে জীবনানন্দ-বিষয়ক প্রথম গবেষণাগ্রন্থ শুদ্ধতম কবি প্রকাশিত হলে আবদুল মান্নান সৈয়দ খুঁজে পান তাঁর পদচারণার জগৎ। গল্প-উপন্যাস বা কথাসাহিত্য নিয়েও তাঁর নিজস্ব একটা জগৎ হতে পারত, ১৯৬৮ সালে সত্যের মতো বদমাশ প্রকাশিত হলে সমসাময়িক সাহিত্য-পরিমন্ডলে ব্যতিক্রমী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। পরাবাস্তববাদের ছোবল এখানেও তাঁকে নীলকণ্ঠী বিষে অনন্য করে তুলেছিল। কিন্তু তিনি বারবার ফিরে এলেন তাঁর প্রিয় জগতেই। গবেষণা-প্রবন্ধ লেখায় তিনি এতোই মগ্ন হয়েছিলেন যে, তাঁর পরিচিতির ডানা বাড়তে লাগল ওদিকেই। তাঁর বড়ো পরিচয় হয়ে উঠলো ‘গবেষক-প্রাবন্ধিক’ হিসেবে।

 

দুই

দেশ-বিদেশের সাহিত্য-সমালোচনা পড়ে বাংলার অধ্যাপক মান্নান সৈয়দ নিজেই নেমে এসেছিলেন এই জটিল গ্রন্থি উন্মোচনের দায় নিয়ে। বাংলা কবিতার অন্তরের নির্যাস নিংড়ে পান করে তিনি এর ব্যবচ্ছেদে মগ্ন হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১), নজরুল (১৮৯৯-১৯৭৬), মোহিতলাল (১৮৮৮-১৯৫২) থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬), আল মাহমুদ (জন্ম ১৯৩৬), এমনকী শহীদ কাদরীর (জন্ম ১৯৪২) কাব্যচর্চাও বাদ গেল না তাঁর গবেষণার অঙ্গন থেকে। গত শতাব্দীর বিখ্যাত কবি ও কথাশিল্পী ফররুখ আহমদ (১৯১৮-৭৪), শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩), সৈয়দ মুর্তাজা আলী (১৯০২-৮১) প্রমুখের সাহিত্যকর্ম নিয়ে কাজ করলেন অনেক। বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-৬০), অজিত দত্ত (১৯০৭-৭৯), সমর সেন (১৯১৬-৮৭), আর তার সঙ্গে ইউরোপীয় ও লাতিন আমেরিকার জগদ্বিখ্যাত কবিদের কাব্যদর্শন, কাব্যচেতনা, কাব্যরূপ, কাব্যকৌশল নিয়ে মজার মজার খেলায় মেতে উঠেছিলেন তিনি। তথ্য-তত্ত্ব,  সন-তারিখ, সূত্র-নির্দেশিকা, উদ্ধৃতি ইত্যাদির নানা উপচারে তাঁর একেকটি প্রবন্ধ-গবেষণা হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশি পাঠকের কাছে মহার্ঘ্যের মতো। মান্নান সৈয়দ বাংলা সাহিত্যের টেবিলে এমনসব খাবার সাজিয়ে দিচ্ছিলেন যার রেসিপি ছিল শুধু তাঁরই মেধায়-মজ্জায়-মননে। তবে শেষ পর্যন্ত বলতেই হবে, তিনি সবচেয়ে বেশি খুঁজেছিলেন জীবনানন্দ দাশকে।

তিরিশের এই কবির মাত্র সাতটি কবিতার বই তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছে – এর কারণ খুঁজতে গিয়েই অপ্রকাশিত জীবনানন্দের বিশাল ভান্ডারকে মান্নান সৈয়দ তুলে আনেন বাঙালি পাঠকের কাছে। ১৯৭২ সালে তাঁর জীবনানন্দ-বিষয়ক রচনা শিল্পকলা ও কণ্ঠস্বর পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। শুধু জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে লেখা মান্নান সৈয়দের প্রবন্ধ-সংকলন ও সম্পাদিত পত্রিকাগুলোর একটি বিবরণ এখানে দেওয়া যায় :

ক. শুদ্ধতম কবি (১৯৭২), খ. জীবনানন্দ দাশের কবিতা (১৯৭৪), গ. সমালোচনা সমগ্র : জীবনানন্দ দাশ (১৯৮৩, সম্পাদিত), ঘ. জীবনানন্দ (১৯৮৪), ঙ. জীবনানন্দ ১ (১৯৮৪, সম্পাদিত পত্রিকা), চ. জীবনানন্দ ২ (১৯৮৫, সম্পাদিত পত্রিকা), ছ. কিছুধ্বনি (জীবনানন্দ সংখ্যা, ১৯৯৩, সম্পাদিত), জ. সমগ্র কবিতা : জীবনানন্দ দাশ (১৯৯৩, সংকলিত ও সম্পাদিত), ঝ. জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৮৬, সম্পাদিত), ঞ. জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলি (কবির স্বহস্তে লিখিত ৪৮টি পত্র ও তাঁকে লেখা ৫টি পত্রের সংকলন, ১৯৮৭, সম্পাদিত), ট. জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৮৯, সম্পাদিত), ঠ. প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র : জীবনানন্দ দাশ (১৯৯৪, সম্পাদিত), ড. বনলতা সেন : জীবনানন্দ দাশ (১৯৯৬, সম্পাদিত), ঢ. রূপসী বাংলা : জীবনানন্দ দাশ (১৯৯৬, সম্পাদিত) ইত্যাদি।

জীবনানন্দের পর মান্নান সৈয়দ আর যাঁকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা করেছেন তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর নজরুল ইসলাম : কবি ও কবিতা (১৯৭৭), নজরুল ইসলাম : কালজ কালোত্তর (১৯৮৭) এবং নজরুল ইসলামের কবিতা (২০০৩) গ্রন্থ তিনটি নজরুল ইসলামের লেখালেখির নানা দিক অনুসন্ধানে বাংলাসাহিত্যে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে বলে গবেষকেরা মনে করেন। এছাড়া তাঁর নজরুল-বিষয়ক সম্পাদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে  তোরা সব জয়ধ্বনি কর (১৯৮৯), নজরুল-রচনাবলী (যৌথভাবে প্রথম-চতুর্থ খন্ড, ১৯৯৩), শ্রেষ্ঠ নজরুল (১৯৯৬), লেখায় রেখায় রইল আড়াল : নজরুল ইসলাম (১৯৯৮), অতীত দিনের স্মৃতি (২০০৪), কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ক সাক্ষাৎকার (২০০৪), পান্ডুলিপি : নজরুল সংগীত (২০০৫), কাজী নজরুল ইসলাম : তিন অধ্যায় (২০০৭), নজরুল রচনাবলী (যৌথভাবে জন্মশতবর্ষ সংস্করণ, ২০১০) ইত্যাদি। নবপর্যায়ের নজরুল একাডেমী পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন অনেকদিন। নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্বপালনের সময়েও নজরুলের অনেক অনালোকিত বিষয় তুলে এনেছিলেন পাঠক-শ্রোতার সামনে নজরুল ইন্সটিটিউট বুলেটিন (২০০২-০৫) এবং নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকায় (২০০২-০৫)। নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্কলার-ইন-রেসিডেন্স হিসেবে তিনি দু-বছর (২০০৬-০৭) নজরুল-গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, সে-গবেষণার ফল কাজী নজরুল ইসলাম : তিন অধ্যায় শীর্ষক সম্পাদিত প্রবন্ধগ্রন্থটি।

 

তিন

বাংলা একাডেমীর আহবানে তিনি আটজন খ্যাতিমান ব্যক্তির জীবনী  রচনা করেছিলেন। এছাড়া তাঁর প্রকাশিত প্রায় ২৫টি  প্রবন্ধ-গবেষণামূলক গ্রন্থের তালিকায় রয়েছে কবি ও কবিতা (১৯৭৭), দশ দিগন্তের দ্রষ্টা (১৯৮০), আমার বিশ্বাস (১৯৮৪), ছন্দ (১৯৮৫), চেতনায় জল পড়ে শিল্পের পাতা নড়ে (১৯৮৯), পুনর্বিবেচনা (১৯৯০), দরোজার পর দরোজা (১৯৯১), বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা (১৯৯৪), রবীন্দ্রনাথ (২০০১), ঈশ্বর গুপ্ত থেকে শহীদ কাদরী (২০০৭), বিংশ শতাব্দীর শিল্প আন্দোলন (২০০৮) ইত্যাদি।

প্রায় ৭০টি সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৭৫), ফররুখ রচনাবলী (প্রথম খন্ড, ১৯৭৯), ইসলামী কবিতা : শাহাদাৎ হোসেন (১৯৮৩), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯৮৬), ছন্দ (১৯৮৬), শাহাদাৎ হোসেন (১৯৮৭), বাংলাদেশের ছড়া (১৯৮৭, যৌথভাবে), সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সুনির্বাচিত কবিতা (১৯৯০), বুদ্ধদেব বসুর সুনির্বাচিত কবিতা (১৯৯০), শ্রেষ্ঠ কবিতা : মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৯৯২), প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯৪), যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯৫), রোকেয়া-রচনাবলী (১৯৯৯), বাংলাদেশের ছোটগল্প (২০০০), গল্পসমগ্র : হাসান হাফিজুর রহমান (২০০১), শ্রেষ্ঠ কবিতা : ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (২০০২), শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ : সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (২০০২), কাব্যসমগ্র : আবু হেনা মোস্তফা কামাল (২০০২), সম্পাদকের কলমে (২০০৫), কবি আবিদ আজাদ স্মারকগ্রন্থ (২০০৬), চিঠিপত্রে চিত্তরঞ্জন সাহা (২০০৯) ইত্যাদি। এসব সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকাগুলোয় সংশ্লিষ্ট কবি ও বিষয়কে তিনি নির্মেদ-খরদৃষ্টি দিয়ে বিশ্লেষণ করে ঋদ্ধ করেছেন। সম্পাদনা করেছিলেন সাম্প্রতিক (১৯৬৪), আসন্ন (১৯৬৯), শব্দশিল্প (১৯৭০), শিল্পকলা (১৯৭০), চারিত্র্য (১৯৭৯), এখন (১৯৮৬), শিল্পতরু (১৯৮৮) ইত্যাদি নানা মৌসুমি ও মাসিক সাহিত্যপত্রিকা। স্মৃতি নোটবুক (২০০০) এবং ডায়েরি : ১৯৭৮-২০০৮ (২০০৯) তাঁর ব্যক্তিজীবনের দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ, যা মান্নান সৈয়দের অন্তর্গত ভাবনা ও দিনানুদৈনিক জীবনযাপনের টুকিটাকি জানতে পাঠককে সহায়তা করবে।

 

চার

মান্নান সৈয়দের রচিত ও সম্পাদিত দেড় শতের অধিক গ্রন্থের গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং বহু বিচিত্র ধরনের বিষয়-আশয় নিয়ে নানা জ্যোতির্ময় মননশীল-সৃজনশীল-আত্মজৈবনিক লেখা পড়তে গিয়ে তাঁর কিছু প্রবন্ধ আমাকে আলোড়িত এবং সম্মোহিত করেছে বিভিন্ন সময়ে। তাঁর ভাষার কারুকাজ, বর্ণনার গতিময়তা, ব্যাখ্যার কৌশল এবং তথ্য-উপস্থাপনের ভিন্নতর রীতি আমাকে শুধু অবাকই করেনি, বাংলাদেশের গবেষণার ধারাকে বিচিত্রতায় সমৃদ্ধ করার যে-গুরুভার স্বউদ্যোগেই তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, সেই মনের কাছে নতজানু হয়েছি। তাঁর অজস্র-অসংখ্য প্রবন্ধে সাহিত্যের মর্মমূলের গভীরতা নির্ণয় করে তুলনামূলক সাহিত্যবিচার আমাকে বিমুগ্ধ-তন্ময় করেছে, অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানীর মতো নামিয়ে দিয়েছে সাহিত্যের জলরাশিতে। কিছু প্রবন্ধ আমার কাছে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে সবসময়ে, পুনর্বার পাঠে আগ্রহী করে। এমনই কিছু নির্বাচিত প্রবন্ধের অন্তর্গত বিশ্বাস ও বিচার নিয়ে এখানে সীমিত আকারে আলোচনা করেছি পাঠক-গবেষকদের দৃষ্টি পুনরায় আকর্ষণের জন্য। বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ কবিদের গদ্য এবং কবিতার রূপ ও নির্যাসকে কীভাবে মান্নান সৈয়দ ফ্রেমে বন্দি করেছিলেন এবং একই সঙ্গে দেশি ও বিদেশি কবিতা তথা সাহিত্য নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার পরিধি কত বিস্তৃত ছিল তা জানার চিন্তা থেকেই এই লেখাগুলোর ওপর কিঞ্চিৎ আলো ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।

গ্রন্থপ্রকাশকালের ক্রম-অনুযায়ী নির্বাচিত প্রবন্ধসমূহ নিম্নরূপ :

১. ‘ইংরেজি কবিতা ও জীবনানন্দ দাশ’, শুদ্ধতম কবি, ১৯৭২

২. ‘উত্তররৈবিক ক্যারাভান’, নির্বাচিত প্রবন্ধ, ১৯৭৬

৩. ‘পরাবাস্তব কবি ও কবিতা’, করতলে মহাদেশ, ১৯৭৯

৪. ‘চোখও অনুভব করে যেন ছন্দবিদ্যুৎ’, করতলে মহাদেশ,

১৯৭৯

৫. ‘শামসুর রাহমান’, করতলে মহাদেশ, ১৯৭৯

৬. ‘কবিতা’, নজরুল ইসলাম : কালজ কালোত্তর, ১৯৮৭

৭. ‘বিভিন্ন দৃষ্টি’, নজরুল ইসলাম : কালজ কালোত্তর, ১৯৮৭

৮. ‘রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক সাহিত্য’, নির্বাচিত প্রবন্ধ, ১৯৮৭

৯. ‘আল মাহমুদের সাম্প্রতিক কবিতা’, পুনর্বিবেচনা, ১৯৯০

১০. ‘সম্পাদকীয়’, কিছুধ্বনি, সম্পাদকের কলমে, ২০০৫

‘শুদ্ধতম কবি’র প্রথম অধ্যায়ের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদটির শিরোনাম ‘ইংরেজি কবিতা ও জীবনানন্দ দাশ’। জীবনানন্দ নিজে ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র এবং অধ্যাপক। বিদেশি সাহিত্য পড়তে গিয়ে বিদেশি কাব্যভূমি থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে বাংলার জলাভূমি আর সবুজ শস্যক্ষেতে ছড়িয়ে দেওয়া তাঁর পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। গত শতকের তিরিশি কবিদের কবিতার খোলনলচে পালটে ফরাসি, স্পেনীয় ও ব্রিটিশ কবিদের অনুকরণে, কখনো কখনো অনুশাসনে আবদ্ধ হয়ে যাওয়ার ইতিহাস আমাদের চোখের সামনেই স্পষ্ট। মান্নান সৈয়দের বিশ্লেষণে প্রবন্ধটিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, (যদিও তিনি গ্রন্থের প্রাসঙ্গিকীতে বলেছেন : ‘বারোটি নিবন্ধ-বৃত্তে আমি জীবনানন্দ দাশের কবিতার শারীরবৃত্তিক আলোচনা করেছি। বিশদ আলোচনায় না-নেমে আমি কবির বিশিষ্টতাটিই ছেঁকে তুলতে চেয়েছি’) ইংরেজি-ফরাসি-স্পেনীয় কবিতার সঙ্গে জীবনানন্দের ঘনিষ্ঠতার মেলবন্ধ থাকলেও শেষাবধি কবি ‘বিস্তীর্ণ এই প্রভাবপ্রচয় তাঁর নিজের ভিতরে পরিপাক ক’রে নিয়েছিলেন।’

মান্নান সৈয়দের ‘উত্তররৈবিক ক্যারাভান’ প্রবন্ধটি রবীন্দ্র-পরবর্তী সমালোচক ও প্রবন্ধকারদের ওপর আলো প্রক্ষেপণের একটি চেষ্টা। এই ক্যারাভানে আসন নিয়েছেন অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০৪-২০০২), ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৬-১৯৬০), বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-৮৬), বিষ্ণু দে (১৯০৯-৮২), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং জীবনানন্দ দাশ। তিনি বলেছেন : ‘এই সাতজন লেখক পরস্পরের অজ্ঞাতসারে যেন হাত ধরাধরি ক’রে উত্তররৈবিক প্রবন্ধ-ধারাটি ব’য়ে নিয়ে এসেছেন সমকাল অবধি। তদানীন্তন কবিতার মতো হয়তো সমালোচনা অতিরৈবিকতায় জর্জরিত হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তা’হলেও সমালোচনা খুঁজছিল নতুন দৃষ্টির কোণ, পুরোনো ফাটিয়ে নবীনের আবির্ভাব, সমগ্র বঙ্গসাহিত্যই তখন একটা মোড় ফেরার জন্য প্রাণপণ প্রতীক্ষা করছিল।’ এই প্রবন্ধটির রচনাকাল ১৯৬৫, প্রথম প্রকাশিত হয় পরিক্রম, মার্চ-জুন, ১৯৬৬ সংখ্যায়। ১৯৭৬ সালে গ্রন্থভুক্ত করার সময় মান্নান সৈয়দ গ্রন্থের ‘প্রবেশক’ শিরোনামের ভূমিকাংশে প্রবন্ধটি সম্পর্কে বলেছিলেন : ‘স্বাভাবিকভাবেই এই প্রবন্ধের কোনো কোনো মন্তব্য আজ আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না; তবু তা অবিকল রেখেছি কেবল আমার তৎকালীন ভাবনার পরিচিহ্ন ধারণ ক’রে রাখবার জন্যে।’

স্যুররিয়ালিস্টিক বা পরাবাস্তববাদী কবিতা মান্নান সৈয়দের জীবনে একটি বিশাল ছায়া ফেলে রেখেছিল। ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছে’র (১৯৬৮) কবিতাগুলো তিনি লিখেছিলেন টানাগদ্যে, শহীদ কাদরী যাকে উল্লেখ করেছিলেন বিশ্বব্যাপী পরিচিত ‘কন্টিনেন্টাল প্রোজ পোয়েম’ নামে। কবিতার এই প্যাটার্ন গত শতাব্দীর তিরিশের বাংলা কবিতা থেকে যেমন ভিন্ন ছিল, তেমনি ভিন্ন ছিল চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের সমবায়ী কাব্যান্দোলনের ধারা থেকেও। মান্নান সৈয়দ এই কবিতাগুলো যখন লিখেছিলেন (তাঁর ভাষ্যমতে ১৯৬১ সালের দিকে), তখন বাংলাদেশের বা বাংলা ভাষার কবিতা এমন বিমূর্ত সুযোগ বা আঙ্গিক ধারণ তো দূরের কথা, প্রতীক-উপমায় এমন ভিন্নতা তাকে আপাদমস্তক গ্রাস করেছিল যে, পূর্বসূরি ইংরেজিতে পন্ডিত বুদ্ধদেব বসু এবং তাঁর সঙ্গীরাও এমন উপমা-উৎপ্রেক্ষা-প্রতীক-আঙ্গিক নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ পাননি। ষাট-দশকে যাঁদের সহযাত্রী-সহগামী ছিলেন মান্নান সৈয়দ তাঁরাও এরূপ রূপকধর্মী আশ্চর্য কুশলতার কাছে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কেউ কি তখন ভেবেছিলেন, আপোলিনেআর (১৮৮০-১৯১৮), জাঁ আর্তুর র‌্যাবো (১৮৫৪-৯১), সালভাদর দালি (১৯০৪-৮৯) প্রমুখ ইউরোপীয় কবি ও চিত্রশিল্পী শিল্প ও কবিতার জগতে যে প্রতীক ও প্রতিমার দ্বারা চিত্রকলা, চিত্রশিল্প ও কবিতার উদ্ভাস ঘটিয়েছিলেন বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, অনালোকিত সেই সৌন্দর্যের দুয়ার খুলে গেছে মান্নান সৈয়দের টানাগদ্যে লেখা কবিতাগুলোর ভেতর! এর সবই পরাবাস্তব কবিতা! এখন পত্র-পত্রিকা যত সহজলভ্য, ইন্টারনেটের কল্যাণে পুরো পৃথিবী হতের মুঠোয় এসে যায়, কিন্তু পরাবাস্তব নিয়ে পাঠযোগ্য কোনো পত্রিকা বা গ্রন্থ ১৯৬০-৭০-এ ছিল দুর্লভ, হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো ঘটনা। সেই সময়ে দীর্ঘসময় ধরে (১৯৭০-৭৮) ‘পরাবাস্তব কবি ও কবিতা’ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন মান্নান সৈয়দ, অনেক তথ্যের আকরে সমৃদ্ধ এমন প্রবন্ধের জন্মকাহিনি সম্পর্কে তিনি বলেছেন : ‘প্রবন্ধটি ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে অনেকদিন ধ’রে বিভিন্ন পত্রিকায় বেরিয়েছিল’ বোঝাই যায়, তথ্য-সূত্র উদ্ধারে ব্যয় হয়েছিল তাঁর অনেকগুলো দিন।

জীবনানন্দ দাশের কাব্যছন্দ নিয়ে ১৯৭৯ সালে লেখা ‘চোখও অনুভব করে যেন ছন্দবিদ্যুৎ’ প্রবন্ধটি করতলে মহাদেশ গ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতার কথা (১৯৫৫, জীবনানন্দের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত) গ্রন্থে ছন্দ নিয়ে যে-মতামত দিয়েছিলেন তা এখানে তুলে ধরা যেতে পারে : ‘…পয়ার ছন্দ যে বাংলা কবিতার প্রাণ ও আত্মা (আজ পর্যন্ত), অন্য কোনো ছন্দ যে পয়ারের এই শীর্ষদেশী মাহাত্ম্য ও গহনতার স্থান নিতে পরে না, রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ প্রধান কবিদের রচনায় তা স্বতঃপ্রমাণিত হয়ে রয়েছে। … আধুনিক বাংলা কবিতায় পয়ার প্রায় সর্বব্যাপী।’ এই উদ্ধৃতির উল্লেখ করে মান্নান সৈয়দ বলেছেন : ‘আবহমান বাংলা কবিতায় অক্ষরবৃত্তের এই প্রায়-সর্বব্যাপী রাজত্ব যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি জীবনানন্দের রচনাতেও। … কবি সারাজীবন সর্বাধিক কবিতা লিখেছেন এই অক্ষরবৃত্তেই।’ জীবনানন্দের বিভিন্ন কবিতার উদাহরণ টেনে তাঁর ছন্দ বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। সমসাময়িক অন্য কবিদের সঙ্গে মুক্তক ছন্দের ব্যবহারিক তুলনাও ভেঙেচুরে দেখিয়েছেন। শুদ্ধতম কবি গ্রন্থে ‘বাংলা ছন্দোমুক্তির জীবনানন্দীয় সূত্র’ শিরোনামের একটি পরিচ্ছেদেও জীবনানন্দের ছন্দ-ব্যবহার নিয়ে আলোচনা সন্নিবেশিত হয়েছে। সেখানে মান্নান সৈয়দ বলেছেন : ‘পংক্তিস্বাধীন তথা অসমান অক্ষরবৃত্তে জীবনানন্দের প্রিয়তা।’

শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদ – বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিদের দুজন। একজন নগরকেন্দ্রিক জীবনধারা, সমকালীনতা এবং নগরচিত্রের কবিতা নিয়ে আবর্তিত হয়েছিলেন, অন্যজন গ্রামীণ বাংলার রূপকল্প, ঐতিহ্য আর জীবনঘন মুহূর্তের ব্রাশে এঁকেছেন কবিতার সুন্দরতা। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের কবি হিসেবে দুজনের আত্মপ্রকাশ, দুজনেই তাঁদের স্বকীয়তার পুরস্কারস্বরূপ পেয়েছেন অভূতপূর্ব আনুকূল্য, বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতা পত্রিকায় উভয়ের কবিতা প্রকাশ করে কবি হিসেবে তাঁদের আত্মপ্রকাশকে উজ্জ্বল ও বিশ্বাসী করে তুলেছিলেন।

‘শামসুর রাহমান’ শিরোনামের প্রবন্ধটি করতলে মহাদেশ এবং ‘আল মাহমুদের সাম্প্রতিক কবিতা’ প্রবন্ধটি পুনর্বিবেচনা প্রবন্ধগ্রন্থে রয়েছে। শামসুর রাহমান বিষয়ক লেখাটি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধের অংশবিশেষ বলে মান্নান সৈয়দ উল্লেখ করেছেন, রচনাকাল ১৯৭৬, পত্রিকায় প্রকাশকালে এর আদি শিরোনাম ছিল ‘শামসুর রাহমানের কবিতার কলাকুশলতা’। প্রবন্ধটি শামসুর রাহমানের কবিতার ছন্দ দিয়ে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর শব্দপ্রয়োগ, ধ্বনি, চিত্রকল্প ইত্যাদি নানা অনুষঙ্গ। সমর সেনের (১৯১৬-৮৭) নাগরিক চেতনায় কবিতার ব্যাপ্তি ক্রমে বিস্তৃতি লাভ করেছে; শামসুর রাহমান সমগোত্রজাত কবি হয়েও তাঁর কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তি জন্ম দিয়েছে একটি চিত্র, একটি চিত্রকল্প ও নগরকেন্দ্রিক জীবনধারার ফ্লাশকাট স্থিরতা, যা বাংলাদেশের কবিতায় অনন্য বিশিষ্টতা এনে দিয়েছে। কবি আল মাহমুদ-সম্পর্কিত প্রবন্ধটি মান্নান সৈয়দ লিখেছিলেন ১৯৮৯ সালে, মোট তিন খন্ডে তিনটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, পরে অন্তর্ভুক্ত হয় পুনর্বিবেচনা প্রবন্ধগ্রন্থে। আল মাহমুদ শুরু থেকেই গ্রামীণ আধুনিকতায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন, যখন গ্রামের ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছেনি, তখনই তিনি জোছনা, চাঁদ আর কাব্যিক জ্যোতির্ময় আলোয় চিত্রিত করেন গ্রামীণ পরিবেশ। প্রবন্ধটি আল মাহমুদের কবিতার পূর্ণ মূল্যায়ন নয়, তবে  যে-বিষয়টি মান্নান সৈয়দ তুলে এনেছেন তা তাঁর কবিতার অন্তর্গত বিশ্বাসের প্রবহমানতাকে লক্ষ রেখেই। দৈনিক পত্রিকার প্রুফ রিডার থেকে রিপোর্টার, ১৯৭১-এ কলকাতায় পরবাসী, স্বাধীনতার পর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অনুসারী এবং দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক, তারপর জেলজীবন, সেখান থেকে ফিরে ‘মায়াবি পর্দা দুলে ওঠো’ বলে আধ্যাত্মিক জগতের খুঁটিনাটি বিশ্বাস মননে গুঁজে নিয়ে নতুন কবিতায় সমর্পিত হওয়া – এ এক চলিষ্ণু আল মাহমুদ। সুউচ্চ অট্টালিকাকেও নাড়িয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু বিশ্বাসের খুঁটি, আয়তনে-উচ্চতায় যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তাকে নাড়ানো কঠিন, যদি না খুঁটির মালিক তা নাড়াতে চান। কবি আল মাহমুদকে নিয়ে সমসাময়িক পাঠকসমাজে নানা মত বর্তমান, নানাভাবে তাঁকে চিত্রিত করার প্রয়াসও লক্ষ করা যায়। কিন্তু সত্য কথাটা এই যে, তাঁর বহিরঙ্গের বিশ্বাস নিয়ে যত আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, কবিতার অন্তরঙ্গ নিয়ে ঠিক ততটা হয়নি। প্রেমই যে আল মাহমুদের কবিতার প্রধান এবং প্রধানতম অনুষঙ্গ – এই বিষয়টিই বিশ্লেষিত ও প্রচারিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। মান্নান সৈয়দ কবি আল মাহমুদের মনোলোক এবং অন্তর্লোকের কিছু খুঁটিনাটি তুলে ধরে বলেছেন : ‘আল মাহমুদ প্রকৃতার্থে রোমান্টিক – সর্ব সময়েই রোমান্টিক – রোমান্টিকতা তাঁর ঢাল এবং একই সঙ্গে রোমান্টিকতা তাঁর তলোয়ার।’ এমন নির্বিরোধ উক্তির বিস্তৃত মূল্যায়ন প্রয়োজন আজ, ভিন্নমতাদর্শী গবেষকরা আল মাহমুদকে নতুনভাবে ভেবে দেখতে পারেন এই প্রবন্ধ পাঠের মধ্য দিয়ে।

‘রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক সাহিত্য’ প্রবন্ধটির রচনাকাল ১৯৮৬, দুই পর্বে প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক সংবাদের ‘সাহিত্য সাময়িকী’ এবং ভারত বিচিত্রায় সেই বছরই। রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলা একাডেমীর ধারাবাহিক বক্তৃতামালার লিখিত প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক সাহিত্য’, যেটি পরে বাংলা একাডেমী প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ সংকলনে মুদ্রিত হয় ১৯৮৬)। ১৯৮৭ সালে মুক্তধারা-প্রকাশিত মান্নান সৈয়দের নির্বাচিত প্রবন্ধ (প্রকৃতপক্ষে নির্বাচিত প্রবন্ধ ২) গ্রন্থে প্রবন্ধটি অন্তর্ভুক্ত হয়। এই প্রবন্ধটিতে মান্নান সৈয়দ রবীন্দ্র-পরবর্তী সাহিত্যের যে-ধারাটি ক্রমশ ফলবতী হয়ে গত শতাব্দীর তিরিশি সাহিত্যের সৌরভে বাংলা সাহিত্যকে প্রাণচঞ্চল করেছিল, যাঁকে রবীন্দ্রনাথ নিজেও স্বাগত জানিয়েছিলেন, বিশেষত বিষ্ণু দে-র উর্বশী ও আর্টেমিস (১৯৩২) কাব্যগ্রন্থটি পড়ে, সেই আধুনিক নবভাষাশৈলী ও চিন্তার বিকাশকে সুচিহ্নিত করেছেন। এই প্রবন্ধে মান্নান সৈয়দ তথ্যসূত্র উল্লেখ করে বলেছেন যে, ‘আধুনিক সাহিত্য চলিষ্ণু’, ফলে, আজ যা আধুনিক, কাল তা অচল-মুদ্রার মতো জাদুঘরে চলে যায়। তাঁর মতে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময়ে আধুনিক ছিলেন, কিন্তু এখন আধুনিক বাংলা কবিতা সংগ্রহ করতে চাইলে বিষ্ণু দে-জীবনানন্দ থেকে শুরু করতে হবে। এটিও তাঁর বক্তব্য। কিন্তু চলমান-প্রবহমান আধুনিকতার মাস্ত্তল ধরে যাঁরা বসে থাকেন, তাঁরা যে কখনো চান না এই মাস্ত্তলের কর্ণধার অন্য কেউ হোক, অন্য হাতে সমর্পিত হোক নৌকোর মালিকানা, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তাঁর প্রমাণ। নইলে কবিতা থেকে বেরিয়ে নিরুক্ত প্রকাশের উদ্যোগ নিলে প্রেমেন্দ্র মিত্রকে (১৯০৪-৮৮) তিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন এই বলে যে, রুগ্ণ সাহিত্য টেকে না, আপনাআপনি ধ্বংস হয়ে যায়, এ যে কবিতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেই তা বলা বাহুল্য। আধুনিক সাহিত্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এবং পরবর্তী কবি-সাহিত্যিকদের এই খন্ড-অখন্ড বিশ্বাস ও দোলাচল নিয়ে সুলিখিত প্রবন্ধটি তিরিশি আধুনিকতার সৃজনশীল বিপুল কর্মকান্ডের একটি অংশ হিসেবে আধুনিক পাঠক বারবার পাঠ করতে পারেন।

জীবনানন্দ দাশের পরে কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি মগ্ন ছিলেন মান্নান সৈয়দ। উল্লেখ করেছি আগেই, শুধু নজরুলকে নিয়েই রয়েছে তাঁর তিনটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। এখানে নজরুল ইসলাম : কালজ কালোত্তর গ্রন্থ থেকে ‘কবিতা’ এবং ‘বিভিন্ন দৃষ্টি’ প্রবন্ধ দুটোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ‘কবিতা’ মানে নজরুলের কবিতা, আর তার ব্যাখ্যার পরিধি ও কৌশল ছোট ছোট শিরোনামে আলোচিত হয়েছে এই প্রবন্ধে। ১৯৭২ থেকে ৮২ সালের মধ্যে প্রবন্ধটির বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন শিরোনামে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, গ্রন্থভুক্ত করার সময়ে কিছু পরিমার্জনা-সংশোধন করে এটিকে এক শিরোনামের মধ্যে আনা হয়েছে। নজরুলের কবিতা নিয়ে তৎকালীন কবি-সমালোচকদের ভেতর নানা মত প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাঁর communicative poem তিরিশি কবিদের মনঃপুত হয়নি, পাশ্চাত্যের ফরম্যাট তিনি অনুসরণ করেননি, অনুকরণ করেননি ফ্রয়েডীয় ভাব-ভাষা ও নগ্নতার প্রতিমাঙ্কিত কাব্যশৈলী।

নজরুল কবিতা লিখেছেন বিষয়কে ভর করে, নব নব ছন্দ এবং দেশি-বিদেশি ভাষার প্রাঞ্জল মিশেল তাঁর কবিতাকে করে তুলেছিল শ্রেণি-সচেতন এবং জনতার পাঠযোগ্য। নজরুল তাঁর কবিতাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, সে-সময়ে তার প্রয়োজনও ছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এমন দীপিত ও উজ্জ্বল-আবেগী কবিতা লিখে রাজরোষে পড়ার ইতিহাসও তাঁরই। কবিতা যখন ক্রমশ সরে যাচ্ছিল সাধারণ পাঠকের কাছ থেকে, তখন নজরুলই ফিরিয়ে এনেছিলেন কবিতাকে, আবার করে তুলেছিলেন সাধারণের। মান্নান সৈয়দ তাঁর ‘কবিতা’ প্রবন্ধে নানা যুক্তি-তর্ক-তথ্য ও উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন, নজরুল ‘আধুনিক কবি’; নানা ছন্দে, নতুন ছন্দে, তিনি তিরিশি কবিতার ‘ঘোরলাগা স্বপ্নে’র ভেতর থেকে বিপ্লবী কবিতার স্রোত সৃষ্টি করেছিলেন। মান্নান সৈয়দ বলছেন, যে নজরুল ইসলামকে ‘Topical poet’ বা সাময়িক কবি বলে বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসবেত্তারা (সুকুমার সেনের বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস দ্রষ্টব্য) চিহ্নিত করেছিলেন, তাঁদের হিসাবে গরমিল ছিল, কেননা তাঁর মতে : ‘শিল্পের কোনো বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই। কবিতারও নেই ওরকম কোনো যান্ত্রিক সংজ্ঞা। পৃথিবীতে নতুন কবিতা যতোদিন লেখা হবে ততোদিন তার জন্যে নতুন নিয়মও সৃষ্টি হবে। রবীন্দ্রনাথের পর নজরুল সৃষ্টি করেছিলেন নতুন কবিতা এবং একই সঙ্গে নতুন কবিতার নিয়ম। বাংলা কবিতার স্বভাব ও জগৎ সম্প্রসারিত হ’লো। ‘সাময়িক কবিতা’ও যে ‘চিরন্তন কবিতা’ হ’তে পারে বাংলা ভাষায় তা প্রমাণ করলেন নজরুল। তাঁর কালজ কবিতা এমনিভাবে হ’য়ে উঠেছে কালোত্তর কবিতা।’ হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭-২০০৪) তাঁর আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৯৪) সংকলনে নজরুলের কবিতা ‘আধুনিক’ নয় বলে সংকলনভুক্ত করেননি, আজ প্রশ্ন জাগে, শিক্ষা-দীক্ষায় হুমায়ুন আজাদ তো কম ছিলেন না, কিন্তু মান্নান সৈয়দের এই আণুবীক্ষণিক বিশ্লেষণের কোনো জবাব কি তিনি দিয়েছিলেন? এই প্রবন্ধে মান্নান সৈয়দ ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সংজ্ঞা নির্ণয় করে রবীন্দ্রনাথের কতিপয় শ্রেষ্ঠ কবিতার উল্লেখ করে নজরুলের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তুলে দিতে কার্পণ্য করেননি।

‘বিভিন্ন দৃষ্টি’ প্রবন্ধটি মান্নান সৈয়দ লিখেছিলেন ১৯৮৬ সালে। এই প্রবন্ধে তিনি জীবনানন্দ দাশ, কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০), মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী (১৮৯৬-১৯৫৪), মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-৫৬) প্রমুখ সমসাময়িক  লেখক-কবির চোখে নজরুলকে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁদের দেখার ভঙ্গি, বিচার-পদ্ধতি এবং রুচি ও বোধের আলোকে তাঁরা যেসব মন্তব্য করেছিলেন, তার ব্যাখ্যা মান্নান সৈয়দ একজন বিশ্লেষকের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তুলে ধরেছেন। নজরুলকে নিয়ে দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। প্রথম প্রবন্ধে নজরুল সম্পর্কে তাঁর হতাশা থাকলেও দ্বিতীয় প্রবন্ধে তাঁর কবিতায় ‘বিশ্বাসের আশ্চর্য যৌবন রয়ে গেছে’ বলে মতামত দিয়েছিলেন এবং বোধকরি এই বাক্যে মান্নান সৈয়দ সন্তুষ্ট না হয়ে বলেছিলেন যে, ‘জীবনানন্দের সব মতামতে আমরা বিশ্বাসী নই।’ বাংলা রেনেসাঁস নিয়ে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ তথা ‘শিখা’ গোষ্ঠীর লেখকগণ নজরুলের বিপরীতমুখী অবস্থান নিলেও শেষ পর্যন্ত তাঁরা যে নজরুলের রচনাকে রেনেসাঁসধর্মী বলেছেন তা কাজী আবদুল ওদুদের রচনা থেকেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এ-প্রসঙ্গে মান্নান সৈয়দ তাঁর এই প্রবন্ধে ‘শিখা’ গোষ্ঠীর কার্যাবলি, আদর্শ ও ধ্যান-ধারণা এবং ব্রিটিশ-নিপীড়িত মুসলমান জনগোষ্ঠীর উত্থানপর্বের সঙ্গে নজরুলের সাহিত্যের যে-সাযুজ্য পরিলক্ষিত হয় তার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন, ‘নজরুল বিষয়ে প্রথম গ্রন্থ রচনার গৌরব কাজী আবদুল ওদুদের। তাঁর নজরুল প্রতিভা ১৯৪৯ সালে যখন বেরোয়, তখন নজরুলের জীবন ও সাহিত্যকর্মের উপরে ঘনান্ধকার নেমে এসেছে। কাজী আবদুল ওদুদের নজরুল-বিচার তাঁর চরিত্রশোভনভাবেই পরিশুদ্ধ, ধীমান, উজ্জ্বল এবং একান্তভাবেই আত্মমুদ্রায় স্বাক্ষরিত।’

‘মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর চোখে’ উপ-শিরোনামে মান্নান সৈয়দ বিলুপ্ত খনি থেকে তুলে এনেছেন স্বেচ্ছানির্বাসিত ওয়াজেদ আলীর নজরুল-সম্পর্কিত লেখালেখির খন্ড খন্ড স্বর্ণপিন্ড। মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী বাঙালি মুসলমান সাহিত্যসমাজে তাঁর সময়ে নানা প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে অন্যদের আস্থা অর্জন করে নিয়েছিলেন। তাঁর সন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে তিনি কবি ও সাহিত্যিকদের বিভিন্ন লেখালেখির ওপর বস্ত্তনিষ্ঠ মতামত প্রদান করে বাঙালি-মুসলিম রেনেসাঁসের অনিবার্য সত্তা হয়ে উঠেছিলেন। অথচ ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন নিরাসক্ত, প্রচারবিমুখ। একবিংশ শতাব্দীর এই বিজ্ঞানচর্চিত যুগে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর মতো বিশিষ্টজনেরা পুরোপুরি আমাদের অগোচরে চলে গেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে তাঁর বেশ কটি মূল্যবান প্রবন্ধে (ইংরেজি ও বাংলায়), নজরুল সম্পর্কে তৎকালীন প্রচারণায় যে-বিরূপ ও বিদ্বেষী হুংকার দিয়েছিলেন কেউ কেউ, তাদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন : কবিতায় নতুন যুগ সূচিত হয়েছে এবং তার ‘সূচনা করেছেন এমন একটি প্রতিভা, যার যাদুকরী শক্তির নবীনতা, সজীবতা ও প্রগাঢ়তা আমাদের কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে অভূতপূর্ব বলেই মনে হয়’। মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর এসব মন্তব্য-মতামত নানাভাবে-নানা প্রচেষ্টায় তুলে আনার কৃতিত্ব মান্নান সৈয়দের। তিনি যেন খনন করে চলেছিলেন চাপাপড়া ঐতিহ্য আর ইতিহাসের নানারূপ, নানা বর্ণ, নানা যুক্তি-তর্কের খাপবদ্ধ তরবারি।

এই প্রবন্ধের আরেকটি উপ-শিরোনাম ‘মোতাহের হোসেন চৌধুরীর চোখে’ যে-কোনো পাঠককে তৎকালীন নজরুল সম্পর্কে নতুন-ভাবে ভাবতে সাহায্য করবে। তিরিশি আধুনিকতার ডামাডোলে সবাই যখন ‘ঘোরলাগা অন্ধকার’ নিয়ে আপন পৃথিবী রচনায় ব্যস্ত, রবীন্দ্রনাথের আকাশ ছিন্ন করে নতুন আকাশ খোঁজার নেশায় মত্ত, তখন কাজী নজরুল ইসলামের মতো সমাজমনস্ক ও রাজনীতিতাপিত মানুষটি যে নির্বাসনে বসে ভারতের উত্তর-প্রদেশের লালিত্যময় সংগীতে মগ্ন হয়ে যাননি, মোতাহের হোসেন চৌধুরী প্রমুখের লেখালেখির ভেতর দিয়ে তা স্পষ্ট এবং গাঢ় হয়েছে। মান্নান সৈয়দের কৃতিত্ব এখানেই, তিনি এইসব অনালোকিত অথচ পার্থিব বিষয়কে নানাভাবে নানা ভঙ্গিমায় ও কৌশলে তুলে এনেছেন। তিনি নজরুলের সমসাময়িকদের বেছে নিয়েছেন এই কারণে যে, রবীন্দ্রনাথ বা মোহিতলালের ওপরে যাঁরা রূঢ় থেকেও তুষ্ট ছিলেন, নানা কারণে তাঁরা নজরুলকে সহ্য করতে পারেননি। পারেননি এই কারণে যে, নজরুল মুসলমান সমাজকে ব্রিটিশের গোলামি থেকে মুক্ত হওয়ার উদাত্ত আহবান জানিয়েছিলেন, বলেছিলেন হিন্দু-সম্প্রদায়ের মতো শিক্ষায় শিক্ষিত হতে, পিছিয়ে গেলে ভবিষ্যতে মুসলমান জনগোষ্ঠী এই উপমহাদেশে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কোনো স্তরেই ঠাঁই পাবে না। অথচ নজরুল ইসলাম ছিলেন পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক, স্বগোত্রীয়দের তিনি যেমন ঠাঁই দিয়েছিলেন নিজের পাশে, অন্য ধর্মাবলম্বীদের তার চেয়ে বেশি আপন করে নিয়েছিলেন। মান্নান সৈয়দ এই অংশে এসে বলেছেন যে, বাঙালি-মুসলমানের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নজরুলকে তাঁর (অর্থাৎ মোতাহের হোসেন চৌধুরীর) মনে হয়েছে শীতের দেশে বসন্তের মত্ততা।

সম্পাদকের কলমে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে। এটি মান্নান সৈয়দের একটি ভিন্নধর্মী প্রকাশনা। এই গ্রন্থে মান্নান সৈয়দ তাঁর সম্পাদিত কয়েকটি পত্রিকায় লেখা সম্পাদকীয়গুলো সংকলিত করেছেন। সাহিত্য সাময়িকী কিছুধ্বনি (জীবনানন্দ সংখ্যা, ১৯৯৩) পত্রিকার আমন্ত্রিত সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছিলেন মান্নান সৈয়দ (সম্পাদক ছিলেন কবি আন্ওয়ার আহমদ)। কবিতার কাগজ হিসেবে কিছুধ্বনি ছিল তৎকালীন অন্যতম সেরা লিট্ল ম্যাগাজিন। এই সংখ্যা সম্পাদনার সূত্র ধরে তিনি সম্পাদকের কলমে গ্রন্থের ‘এই বই নিয়ে কথা’ ভূমিকার একাংশে বলেছেন : ‘আন্ওয়ার এবং সালাহউদ্দিন আইয়ুব (সালাহউদ্দিন তখন আন্ওয়ারের পত্রিকাগুলোর দেখভাল করছে, বর্তমানে মার্কিন প্রবাসী)-এর প্রণোদনায় কিছুধ্বনি পত্রিকার জীবনানন্দ-সংখ্যা সম্পাদনা করি আমন্ত্রিত সম্পাদক রূপে। পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৯৯৩-এর ডিসেম্বর মাসে। এই পত্রিকার সম্পাদকীয় তৎকালীন উপচারের সঙ্গে ১৯৭৮-এ কলকাতা থেকে সংগৃহীত উপকরণও কাজে লাগিয়েছিলাম।’ প্রায় পনেরো-ষোল পৃষ্ঠার এই সম্পাদকীয় সত্যিকার অর্থে শুধু একটি সম্পাদকীয়ই ছিল না, হয়ে উঠেছিল জীবনানন্দ          দাশ-সম্পর্কিত একটি অমূল্য তথ্যভান্ডার।

এই রচনাটিতে জীবনানন্দের সাহিত্যকথা নিয়ে বিশ্লেষণ আছে, বাংলাদেশে জীবনানন্দ-উদযাপনে কিছুধ্বনির বিভিন্ন উৎসবের কথা আছে, কবি জীবনানন্দ কীভাবে বিগত শতাব্দীর সত্তর-আশির দশকে এসে গাল্পিক-ঔপন্যাসিকে পরিচিত হয়ে উঠলেন তার কথা আছে, জীবনানন্দের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের প্রস্ত্ততি ও প্রত্যাশার কথা আছে, আরো অনেক তথ্যে পরিপূর্ণ এই সম্পাদকীয়টি তাই জীবনানন্দকে নতুনভাবে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। যাঁরা জীবনানন্দে-আগ্রহী তাঁরা মান্নান সৈয়দের এই সম্পাদকীয় থেকে খুঁজে পাবেন অনেক পথের সন্ধান, অনেক ইঙ্গিতে প্রাপ্তি ও পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস। তবে শুধু জীবনানন্দীয়-তথ্যকণিকায় সমৃদ্ধ এই সম্পাদকীয়র আড়ালে, বলা  প্রয়োজন, রয়ে গেছে মান্নান সৈয়দের নিবিষ্টচিত্তের অসাধারণ আঙ্গিক-কুশলতা। তথ্য উপস্থাপনের কৌশলও অনেক সময় বিমুগ্ধ করে পাঠককে। আমার কাছে মনে হয়, জীবনানন্দ ও মান্নান সৈয়দ – একে অপরের পরিপূরক বলে যদি বিশ্বাস করি – তবে এই সম্পাদকীয়টি আমাদের আবার, কিংবা বারবার, পড়া দরকার।

 পাঁচ

পরিশেষে বলতে হয়, প্রায় দেড় শতাধিক গ্রন্থের অধিকারী একজন মানুষ, মহাবিচিত্র যাঁর সাহিত্যের পরিধি, নানা  বিষয়ে-বৈভবে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের সাহিত্য, তাঁর মাত্র ১০টি প্রবন্ধ নির্বাচন করা এক অজেয় কাজ। তবু তা করলাম একধরনের দায়বদ্ধতা থেকে। তাঁর সঙ্গে প্রায় দুই-তিন বছর একসঙ্গে শিল্পতরু সম্পাদনা করেছি, খুব কাছে থেকে দেখা মানুষটিকে তবু চিনতে পারিনি। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ চেতনায় জল পড়ে শিল্পের পাতা নড়ে (১৯৮৯) আমাকে উৎসর্গ করেছিলেন। আমিও তাঁর বই এবং লেখালেখি নিয়ে বেশকিছু প্রবন্ধ লিখেছিলাম একসময়ে। কালের নিয়মেই আবার দূরে সরে গেছি, মানসিক দূরত্ব যদিও এক ইঞ্চিও বাড়েনি আমাদের দুজনের। আজ তাঁর অবর্তমানে খুব বেশি করে অনুভূত হচ্ছে তাঁর প্রয়োজন। আর একজন মান্নান সৈয়দের জন্য বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হবে কতদিন, জানি না।