আমাদের একাত্তর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আনিস স্যারের সান্নিধ্যে

বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে অর্থাৎ ১৯৫০-এর দশকে বাংলাদেশে যে-রেনেসাঁস বা নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল, সেই রেনেসাঁসের অগ্রণী পুরুষরা ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ড. কাজী মোতাহের হোসেন, ড. এনামুল হক, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবুল ফজল, সরদার ফজলুল করিম, আব্দুর রাজ্জাক, বদরুদ্দীন উমর, রেহমান সোবহান, ড. মাহমুদ, শওকত ওসমান প্রমুখ। পঞ্চাশের দশকেই এই অগ্রণী চিন্তানায়কদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন কয়েকজন নবীন কবি, গবেষক-অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, সিকান্‌দার আবু জাফর, আবু জাফর শামসুদ্দীন, হাসান হাফিজুর রহমান, মুনীর চৌধুরী, আহমদ শরীফ প্রমুখ। এই নবীনদের মধ্যেও নবীন ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান। বাংলাদেশে পঞ্চাশের দশকে ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে যে-নতুন জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়, সেখানে বুদ্ধিজীবীদের একটি বিরাট ভূমিকা ছিল। প্রায় সব দেশের নবজাগরণে, বিপ্লবে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা থাকে। আমরা সবাই জানি, রুশো, ভলতেয়ার, মনতেস্কু, মলিয়ের, দিদারো প্রমুখের লেখাই ফরাসি বিপ্লবের বহ্নিশিখা হিসেবে কাজ করেছে। তাঁরাই জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন নতুন চেতনায়। বাংলাদেশেও উপর্যুক্ত লেখকদের লেখা বাঙালিকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলের স্বরূপ। এই ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল ছিল সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। অবশ্য এই শৃঙ্খল ভাঙার বাণীরূপ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবির মাধ্যমে।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশক বাংলাদেশ ও বাঙালির ইতিহাসে দুটি অসাধারণ দশক, যা হাজার বছর পরেও বাঙালিকে উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত করবে। কারণ এই দুটি দশকে মূর্ত হয়েছিল বাঙালির জাগরণ, যার মূলে সাংস্কৃতিক আন্দোলন একটি বড় ভূমিকা রেখেছিল। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মুখ্য সূতিকাগার ছিল বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। বাঙালি জনগণকে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ করার ভূমিকা নিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের প্রগতিপন্থী শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ (এবং কবি, সাংবাদিক ও সাহিত্যিকরা)। ১৯৫৯ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করি, তখন এঁদের অনেককেই দেখার এবং অনেকেরই কাছে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। ১৯৫৯ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এর আগে এক বছর তিনি শিক্ষকতা করেছিলেন জগন্নাথ কলেজে। আমার মুখ্য বিষয় ছিল সমাজতত্ত্ব। সহকারী বা দুটো সাবসিডিয়ারি বিষয় ছিল অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান। কিন্তু সাহিত্যে আমার ছিল প্রবল আগ্রহ। তাই বন্ধুদের সঙ্গে মুনীর চৌধুরী ও আনিসুজ্জামানের বাংলা ক্লাসে প্রদত্ত লেকচার শুনতে কয়েকবার গেছি। আমার জীবনে যে-কয়েকজন অসাধারণ শিক্ষকের বক্তৃতা শুনেছি, তাঁদের মধ্যে মুনীর চৌধুরী ছিলেন অন্যতম। তাঁর বক্তৃতা বিষয়ের কী গভীরে পৌঁছতো, তা যিনি শোনেননি তিনি কখনো বুঝতে পারবেন না! আমি তাঁর বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী পড়ানো কখনো ভুলব না। তিনি অসাধারণভাবে ছাত্রদের কাছে এই সত্য উন্মোচন করেছিলেন যে, দুর্গেশনন্দিনীর নায়িকা আসলেই দুর্গেশনন্দিনী নন, নায়কও জগৎসিংহ নন; প্রকৃত নায়িকা আয়েশা এবং নায়ক ওসমান। আয়েশার দীর্ঘশ্বাস এই উপন্যাসের মূল বাণী। ড. আনিসুজ্জামানের বক্তৃতা মুনীর চৌধুরীর মতো ঐন্দ্রজালিক ছিল না, তাঁর ভিত্তি ছিল মুখ্যত যুক্তি। তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল এবং চিত্তহারী ভাষায় তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। এই দুজন শিক্ষকই বাঙালিচিত্তকে জাগাতে ও মুক্তির আলোর ইঙ্গিত দিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। এখানে উল্লেখ্য, ড. আনিসুজ্জামান ১৯৬২ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করে তরুণ কিন্তু বিদ্বান শিক্ষক হিসেবে বিদ্বৎসমাজ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল ‘মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য’; তিনি চমৎকারভাবে বাংলা সাহিত্যে মুসলিম-মানসের বিভিন্নমুখী বিবর্তন উদ্ঘাটন করেছিলেন। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদই প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে, বিশেষত আখ্যানকাব্যে (যার একটা বৃহৎ অংশই ছিল সেক্যুলার বা ইহজাগতিক মুখ্যত প্রেমভিত্তিক), মুসলমান কবিদের বিরাট অবদান তুলে ধরেন। তাঁর জীবনব্যাপী সাধনা ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর নেপাল থেকে বৌদ্ধচর্যা ও দোঁহাপদ আবিষ্কার এই সত্য তুলে ধরে যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ সব সম্প্রদায়ের সৃষ্টি; কারো একক অবদানে এই ভাষা ও সাহিত্য সমৃদ্ধ নয়। আনিসুজ্জামানের অভিসন্দর্ভ এই চেতনাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যায়, ঋদ্ধ করে।
১৯৬৬ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি (এর আগে এক বছর বুয়েটে শিক্ষকতা করেছি)। নবীন শিক্ষকদের, আমাদের একটি ছোট্ট দল ছিল। এ-দলের অনেকেই ’৬৫ ও ’৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন শিক্ষক হিসেবে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আহবাব আহমেদ, আবদুস সামাদ, এমএম রেজা, মসিউর রহমান, লতিফুর রেজা, ফরাস উদ্দীন প্রমুখ। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহৎ শিক্ষক লাউঞ্জের এক কোনায় বসে আড্ডা দিতাম। আমাদের থেকে বেশখানিকটা দূরে বসতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বরিষ্ঠ শিক্ষকদের একটি দল। এঁদের মধ্যমণি ছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। তাঁকে ঘিরে থাকতেন মোজাফ্ফর আহমদ, রেহমান সোবহান, ড. খান সারওয়ার মুরশিদ, ড. আবু মাহমুদ, ড. হুদা, মিসেস হুদা প্রমুখ। এঁদের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত তরুণ আনিসুজ্জামানও থাকতেন। আমরা জানতাম, এই অধ্যাপকমণ্ডলী তৎকালীন বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এঁদের অনেকেরই সরাসরি যোগ ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। অবশ্য সেই সময়ে কোনো শিক্ষকই ক্লাসে রাজনীতির চর্চা করতেন না। তাঁদের লেকচার থাকত পাঠ্যতালিকার বিষয়ভিত্তিক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়-জগতের বাইরে অনেক শিক্ষকই দেশের কল্যাণ নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন এবং সেই ভাবনা থেকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে যেমন ছিলেন বামপন্থী, উদারপন্থীরা, তেমনি ছিলেন অত্যন্ত রক্ষণশীলরা। রক্ষণশীল শিক্ষকদের একটি বিরাট অংশ মুসলিম লীগের এবং আইয়ুব খানের রাজনীতির সমর্থক ছিলেন। এঁরা মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তান বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে সহায়তা প্রদান করেছিলেন। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে কেন্দ্র করে যে-শিক্ষক গোষ্ঠীটির কথা আগে উল্লেখ করেছি, যার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, তাঁরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ যে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের উপনিবেশ হিসেবে নিবিড়ভাবে নিপীড়িত হচ্ছে – এই উপলব্ধি থেকেই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি সমিতি কর্তৃক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে পাকিস্তান অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল বিভিন্ন প্রদর্শনীর মাধ্যমে। এই সেমিনার থেকে এই সত্য পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে এসেছিল যে, কীভাবে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা নির্মমভাবে শোষিত হচ্ছে। এই সেমিনারটি ছিল সম্পূর্ণ অ্যাকাডেমিক। কিন্তু যাঁরা এই সেমিনারের প্রদর্শনীগুলো দেখেছেন তাঁরাই ব্যথিত না হয়ে পারেননি। পঞ্চাশের দশক থেকে যে-মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাংলাদেশে গড়ে উঠেছিল, তারা বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবির প্রতি তাই স্বাভাবিকভাবেই একাত্ম হয়েছিল। অধ্যাপক রাজ্জাক, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ড. আনিসুজ্জামান এবং উপর্যুক্ত যে-শিক্ষক গোষ্ঠীটির কথা বলেছি, তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থেকে বাঙালির মুক্তি কামনা করেছেন।

দুই
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু লাহোরে সম্মিলিত বিরোধীদলের সভায় ৬ দফা পেশ করলেন। সভাটি ডাকা হয়েছিল ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে, বিশেষভাবে প্রায় লাহোর পর্যন্ত ভারতীয় সৈন্য পৌঁছে যাওয়ায় আইয়ুব খান কেন তাদের ঠেকাতে পারলেন না, সেই ব্যর্থতা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে। বিরোধীদের সমালোচনার আরো লক্ষ্য ছিল, তাসখন্দে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি চুক্তি, এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্য যে লাহোরের কাছাকাছি চলে এসেছিল, তার নিদর্শন আমি দেখেছিলাম ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘অল পাকিস্তান সোশিওলজি অ্যাসোসিয়েশনে’র দ্বিবার্ষিক সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করতে গিয়ে। আমাদের দলনেতা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আফসার উদ্দীন। আমাদের এই পর্যবেক্ষণটি অবশ্য হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা পেশ করার দু-তিন মাস পরে।
পূর্ব পাকিস্তানবাসীর অভিযোগ ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানে ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যরা যুদ্ধ করেছে, ঠেকিয়েছে, কোথাও কোথাও কিছুটা এগিয়েছেও; কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। এখানে তো এক ডিভিশন সৈন্যও ছিল না পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করতে। ভারত আক্রমণ না করায় পূর্ব পাকিস্তান বেঁচে যায়। এই বক্তব্য উপস্থাপন না করে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা উপস্থাপন করলেন, যার মধ্য দিয়ে এই চিত্রটি তিনি পরিষ্কার করলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান বস্তুতপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ ছাড়া কিছুই নয়। সেজন্যই পূর্ব পাকিস্তানে কেবল লোক-দেখানো দু-এক রেজিমেন্ট সৈন্য ছিল। ৬ দফার মাধ্যমে তিনি দাবি করলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক স্বশাসন; কেবল পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়া আর সবক্ষেত্রেই দুই পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সম্পূর্ণভাবে স্বশাসিত হবে। পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বিনিময়যোগ্য দুটি আলাদা মুদ্রা থাকবে অথবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দুটি আলাদা হিসাব থাকবে, যাতে এক অঞ্চলের সম্পদ আরেক অঞ্চলে পাচার করা সম্ভব না হয়। এছাড়াও দু-অঞ্চল আলাদাভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যচুক্তি করতে পারবে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সুরক্ষার জন্য আলাদা একটি মিলিশিয়া বাহিনী গঠনেরও প্রস্তাব করলেন। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর এই ৬ দফায় দুটি রাষ্ট্রের অবয়বই মূর্ত হয়েছিল। এই ৬ দফার প্রস্তাব লাহোরে সম্মিলিত বিরোধীদল বঙ্গবন্ধুকে উত্থাপন করতেই দেয়নি। স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেও তিনি এই ৬ দফা আওয়ামী লীগের অনেক বরিষ্ঠ নেতার বিরোধিতার কারণে পেশ করতে পারেননি। চট্টগ্রামে লালদিঘির ময়দানেই তিনি প্রথম এই ৬ দফা উপস্থাপন করলেন। তাঁর দুই পাশে ছিলেন এমএ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরী। মাঠে ছিলেন চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের সভাপতি মৌলভি সৈয়দ ও সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন চৌধুরী। লালদিঘির পর তিনি এই ৬ দফা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশাল সভা করে উপস্থাপন করতে থাকেন। প্রায় প্রতিটি সভার পরেই তাঁকে গ্রেফতার করা হতো এবং তিনি কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে আবার মুক্ত হয়ে আসতেন। ৬ দফাকে আইয়ুব খান রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবেই দেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, শেখ মুজিব যদি যুক্তির ভাষা না বোঝেন অর্থাৎ ৬ দফা প্রত্যাহার না করেন, তাহলে তাঁকে অস্ত্রের ভাষা দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এই অস্ত্রের ভাষাই নেমে এলো ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে। এই ’৬৮ সালেই আইয়ুব খান পেশ করেছিলেন ‘ডিকেইড অব ডেভেলপমেন্ট’ অর্থাৎ ‘উন্নয়নের এক দশক’ (১৯৫৮-৬৮)। এটি ছিল আইয়ুব খানের জোর করে ক্ষমতা গ্রহণের এক দশক। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আওয়ামী লীগ নেতাদের ছাড়াও আসামি করা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন বাঙালি সচিব ও কয়েকজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তাকে। এঁদের ওপর অত্যাচারের চিত্র তৎকালীন দুই প্রসিদ্ধ পত্রিকা ইত্তেফাক ও সংবাদ প্রচার করত নানা কৌশলে। এইসব সংবাদ পড়ে সেই সময়ে দেশব্যাপী জনগণের মধ্যে একটা ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সবার মধ্যে এই ভয় ছড়িয়ে পড়েছিল যে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও অন্য আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিপন্থী সব শিক্ষকই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের জন্য প্রচণ্ডভাবে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন। একধরনের ভীতিরও সৃষ্টি হয়েছিল শিক্ষকদের মধ্যে – কেউ পাকিস্তানের হয়ে চরবৃত্তি করছে কি না। আমরা শিক্ষকরা নিজেদের গ্রুপের মধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে আলোচনা করলেও, তাঁদের মুক্তির ব্যাপারে কী উপায় অবলম্বন করা যায়, তা নিয়ে ভাবলেও অন্যদের সঙ্গে তা নিয়ে আলোচনা করতাম না। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে কেন্দ্র করে আগে উল্লেখ করা গ্রুপটিও মনে হতো এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে দেখতাম গ্রুপটির মধ্যে অত্যন্ত সক্রিয়। ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আসাদের হত্যার পরে এই আন্দোলন তীব্র গতি সঞ্চার করে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এই অভ্যুত্থান ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে জেলের তালা ভেঙে মুক্ত করে নিয়ে আসে। এই গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের, আব্দুর রাজ্জাক, রেহমান সোবহান, আনিসুজ্জামান প্রমুখের একটি বড় ভূমিকা ছিল, যা খুব অপ্রকাশ্য ছিল না।

তিন
১৯৬৯ সালের জুন মাসে ড. আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে রিডার হিসেবে যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন সহকারী অধ্যাপক। একই বছরের নভেম্বরে আমিও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে সিনিয়র লেকচারার (বর্তমানে যা অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর) হিসেবে যোগদান করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ছিলাম লেকচারার বা প্রভাষক। ১৯৬৮-৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকগুলো নতুন বিভাগ খোলা হয়। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় ২০ জনের মতো শিক্ষক এইসব বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি প্রমোশন নিয়ে। সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের প্রমোশন পাওয়া অত্যন্ত কঠিন ছিল। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র চারজন প্রফেসর ছিলেন। এই থেকেই বোঝা যায়, সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের প্রমোশনপ্রাপ্তি কত কঠিন ছিল।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আগের কয়েক বছরের টালমাটাল পরিস্থিতি থেকে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। মনে হলো, দেশে একটা স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে। আইয়ুব খানের পরিবর্তে ইয়াহিয়া খান তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। দেশে তখন সামরিক আইন, কিন্তু প্রায় সবকিছুই স্বাভাবিক। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে পাকিস্তানের জন্য (জনসংখ্যার ভিত্তিতে, যার ফলে পূর্ব পাকিস্তান পায় ১৬৯ আসন, পশ্চিম পাকিস্তান ১৩১টি) নতুন গণপরিষদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন, যা ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের জনগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, কখন গণপরিষদের অধিবেশন বসবে, একটি নতুন সংবিধান রচিত হবে, যেখানে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবি অনুসারে পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ তার ন্যায্য অধিকারসমূহ ফিরে পাবে, বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানে নিষ্ঠুর ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটবে।
বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ এই অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হলো। প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনেও ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন আওয়ামী লীগের করায়ত্ত হয়। এই জয়ের ফলে পাকিস্তানের গণপরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল। পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র বা শাসকরা কখনো ভাবতে পারেনি পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ এইরকম বিপুলভাবে জয়ী হবে। তারা ভেবেছিল, পূর্ব পাকিস্তানে সেই সময়ে আওয়ামী লীগ ছাড়াও অনেকগুলো দল ছিল। এইসব দলের মধ্যে আসন বণ্টন হয়ে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকচক্রকে বিস্মিত করে আওয়ামী লীগ সারা পাকিস্তানেই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হলো, সংবিধান রচনার একক অধিকারী হলো। পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর পিপল্স পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে দেখা দেয়। দুই অঞ্চলে দুই দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভুট্টো একদিন ঘোষণাই করে বসলেন, পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য দুটি সংবিধান রচিত হবে। অবশ্য পরের দিন তিনি তা অস্বীকার করে বলেন, তিনি এ-ধরনের কোনো ঘোষণা দেননি। কিন্তু তিনি দাবি করলেন, পিপলস পার্টির অনুমোদন ব্যতিরেকে পাকিস্তানের কোনো সংবিধান রচিত হবে না। নির্বাচিত নতুন গণপরিষদের অধিবেশন বসার দিন ধার্য হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান বেতার-ঘোষণার মাধ্যমে সারাদেশকে অবহিত করলেন, গণপরিষদের নির্ধারিত ৩ মার্চের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হলো। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সারা পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল।
বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় হরতাল ঘোষণা করলেন। পাকিস্তানের শাসকচক্র কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবি মেনে নিতে রাজি ছিল না। ২ মার্চ ঢাকা এয়ারপোর্টে যখন পাকিস্তান বাহিনী অস্ত্র খালাস করছিল, তাতে বাধা দেওয়ায় গুলি চলল। অনেক সাধারণ কর্মী নিহত হলেন। বঙ্গবন্ধু দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করলেন। সারাদেশে একমাত্র তাঁর নেতৃত্বে বা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ছাড়া আর কোনো নেতৃত্ব রইল না। একমাত্র ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের পতাকা উড্ডীন ছিল না। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু দেশবাসীকে উদ্দেশ করে এক অসাধারণ কালজয়ী ভাষণ দিলেন, যা ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতারই ঘোষণা। সেই সময়ে বাঙালি জনতার এক বিরাট অংশ, ছাত্র-শিক্ষক সমাজেরও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আশা করেছিল বঙ্গবন্ধু ওইদিন ‘বাংলাদেশ স্বাধীন’ এই ঘোষণা দেবেন। কিন্তু তিনি তা দেননি কৌশলগত কারণে। কারণ, এই ঘোষণা দিলে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হতো যে, তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন না সত্যি, কিন্তু সব বাঙালিকে আহ্বান জানালেন ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে, যাতে বাঙালির দাবির বিরুদ্ধে কোনো আঘাত এলে তা প্রতিহত করা যায়। ১৯ মিনিটের এই ভাষণের শেষ বাক্যে দশ লক্ষ জনতার সামনে তিনি এই বলে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বিশ্বের আর কোনো দেশে কোনো নেতা এইভাবে এক বিশাল জনতার সামনে, দশ লক্ষ লোকের সামনে স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। তাছাড়াও এই ভাষণটি একটি জাতির সহস্র বছরের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দিয়েছিল, সেই জন্য এই ভাষণটি মহাকাব্যিক দ্যোতনা বহন করে। এই জন্য এই ভাষণটি বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বাধীনতার ঘোষণা।
আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকসমাজ অধীর আগ্রহে রেডিওর মাধ্যমে এই ভাষণটি শুনতে চেয়েছিলাম। আমার বন্ধু বাংলার অধ্যাপক জাফর সাহেব আমাকে বলেছিলেন, এই বক্তৃতার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। আমি তাঁর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। আমি বলি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কাছেই ক্যান্টনমেন্টে অসংখ্য পাকিস্তানি সৈন্য অস্ত্র তাক করে বসে রয়েছে। বঙ্গবন্ধু এ-ধরনের ঘোষণা দেবেন না, কারণ তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে তারা সভায় আগত অসংখ্য লোককে ঘিরে ধরে হত্যা করার সুযোগ পাবে। তাছাড়া নাইজেরিয়ার বায়াফ্রার বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনের ইতিহাস বা উদাহরণ তো তাদের সামনে আছে।
৭ মার্চের ভাষণ আমরা চট্টগ্রাম থেকে শুনতে পাইনি, কারণ ঢাকা রেডিও থেকে এই ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করতে দেওয়া হয়নি। পরের দিন এই ভাষণ সম্প্রচারিত হয়েছিল ঢাকা রেডিওর কর্মচারীদের দাবির ফলে। ভাষণ শুনে আমরা মুগ্ধ হই। আমাদের সামনে এই সত্যটি প্রতিভাত হয় যে, ৬ দফা দাবির ভিত্তিতে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু যে-অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছেন, আমাদের শিক্ষক সমাজকে এই দাবির সমর্থনে এগিয়ে আসতে হবে, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আন্দোলনের জন্য, সংগ্রামের জন্য তৈরি হতে হবে।
১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাহী কমিটি গঠনের জন্য যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেই নির্বাচনে ড. শামসুল হক সভাপতি ও আমি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই প্রগতিপন্থী শিক্ষকদের প্রতিনিধি হিসেবে। আমরা স্থির করি, লালদিঘি ময়দানে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে ও গণপরিষদে অধিবেশন আহ্বান করার দাবিতে সাতদিন ধরে প্রতিবাদ সমাবেশ করব। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে ১৭ মার্চ থেকে লালদিঘি ময়দানে এক প্রতিবাদ কর্মসূচির সূচনা হলো ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই প্রত্যয়কে তুলে ধরে। তাই প্রতিদিন সভা আরম্ভ হওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নেতৃত্বে শহরের মুখ্য সড়কগুলোতে ট্রাক-র‌্যালি অনুষ্ঠিত হতো, যেখানে ৬ দফার বিভিন্ন দাবি, অসহযোগের বাণী, স্বাধীনতার বাণীসংবলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শিত হতো। শিক্ষকরা দেশাত্মবোধক গান গাইতেন। তাঁদের সঙ্গে ছাত্ররা যোগ দিত। এই সভা প্রতিদিন বিকেল পাঁচটায় শুরু হয়ে রাত দশটা বা সাড়ে দশটা পর্যন্ত চলত। সভায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাড়াও চাটগাঁর অন্যান্য বুদ্ধিজীবী ও অধ্যাপক-শিক্ষকও যোগ দিতেন। চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের এই সভাগুলোতে যোগ দিয়েছিলেন। এই প্রতিবাদ অনুষ্ঠানমালায় যাঁদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখ্য, তাঁরা হলেন – চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সংস্কৃতিকর্মী এবং ক্রীড়াসংগঠক ডা. কামাল এ খান, চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট নাট্যকার মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, একই কলেজের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট কবি মোহাম্মদ রফিক। প্রগতি মোটরসের ব্যবস্থাপক হাবিব উল্লাহ খানের কাছ থেকে প্রায় ১০টি ট্রাক সংগ্রহ করেছিলেন ডা. কামাল এ খান আমাদের প্রতিদিনের ট্রাক-র‌্যালির জন্য। অবশ্য তাঁকে সাহায্য করেছিলেন হাবিব উল্লাহ খানের স্ত্রী, আমাদের সহকর্মী, অর্থনীতি বিভাগের তৎকালীন সহকারী অধ্যাপিকা সালমা খান। যুদ্ধোত্তর পর্বে তিনি অবশ্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে বাংলাদেশ সচিবালয়ে যোগ দেন, যেরকম যোগ দিয়েছিলেন মাহবুব তালুকদার, যিনি তখন ছিলেন বাংলা বিভাগের প্রভাষক।
লালদিঘি মাঠের এই সভায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই, যাঁরা শহরে থাকতেন, তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিতেন এবং বক্তব্য রাখতেন। সভাটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির তত্ত্বাবধানে হলেও যাঁরা শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকতেন, তাঁদের যোগ দেওয়া সম্ভব হতো না। তাঁদের অনুষ্ঠানগুলো ক্যাম্পাসেই হতো। ড. শামসুল হক শিক্ষক সমিতির সভাপতি হলেও তিনি মাত্র একবার শহরের সভায় যোগ দিয়েছিলেন। সৈয়দ আলী আহসানও একবার বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তৃতার মধ্যে সেই সময়ের জনতার দাবি থেকেও কাব্যিক অলংকারই বেশি ফুটে ওঠায় সমবেত বিশাল সাধারণ জনতা হইচই শুরু করে। কারণ তারা তাঁর বক্তব্য বুঝতে পারছিল না। নাট্যকার ড. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ অবস্থা সামলান জ্বালাময়ী বিপ্লবী বক্তব্য উপস্থাপন করে, জনগণের তৎকালীন স্বাধীনতার স্পৃহাকে রূপ দিয়ে। পরবর্তীকালে আমরা উপলব্ধি করেছিলাম অধ্যাপক আলী আহসান বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবির বা বাঙালির অধিকারের দাবির সঙ্গে একাত্ম ছিলেন না। তিনিই তো ছিলেন আইয়ুব খানের ফ্রেন্ডস, নট মাস্টার্সের বাংলা অনুবাদক। আমার যতদূর মনে পড়ে, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান দুদিন বক্তব্য রেখেছিলেন সহজ-সরল ভাষায় বাঙালির প্রাণের দাবিগুলোকে, অধিকারগুলোকে তুলে ধরে। প্রতিদিন ক্যাম্পাস থেকে না আসতে পারলেও এই সভাটির সঙ্গে তিনি গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন, প্রেরণার উৎস ছিলেন। ক্যাম্পাসের সভাগুলো ড. শামসুল হকের নেতৃত্বে তাঁর প্রত্যক্ষ উদ্যোগেই হতো। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি প্রতিদিন স্বাগত বক্তব্য রাখতাম। এছাড়া দুদিন ৬ দফা ব্যাখ্যা করে, পাকিস্তানি শোষণ ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা দিয়েছিলাম। আমাদের লালদিঘি ময়দানে শুরু হওয়া এই সভাটির সমাপ্তি টানা হয়েছিল প্যারেড ময়দানে অনুষ্ঠান করে, একটি নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে। নাটকটি মঞ্চায়নের আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ.আর. মল্লিক ও ইতিহাসের অধ্যাপক ড. আবদুল করিম ভাষণ দিয়েছিলেন। এঁদের দুজনকে এই সভায় আহ্বান করার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবু জাফর। আমি মনে মনে চাইনি তাঁরা আসুন। কারণ তাঁরা দুজনেই ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের একান্ত সমর্থক। এ.আর. মল্লিককে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজেক্ট ডিরেক্টর ও পরে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান তাঁর একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে। অবশ্য এই সভায় বক্তব্য দেওয়ার পরে ড. মল্লিক বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি এপ্রিলে ভারতে চলে যান এবং মুজিবনগর সরকারকে নানাভাবে সহায়তা শুরু করেন। ড. করিম বাংলাদেশেই থেকে যান। অধ্যাপক আহসানও ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
প্যারেড ময়দানের অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ২৪ মার্চ। বক্তৃতাপর্ব শেষে যখন একটি ড্রামা মঞ্চস্থ হচ্ছিল, সে-সময় খবর আসে পাকিস্তানি জাহাজ ‘সোয়াত’ থেকে বাঙালিদের দমানোর জন্য অস্ত্র খালাস করা হচ্ছে। এ-খবর শুনে হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতা অস্ত্র খালাস বন্ধ করার জন্য পোর্টের দিকে ধাবিত হলো। অবশ্য এর আগে থেকেই বন্দরের শ্রমিকরা অস্ত্র নামানো প্রতিহত করেছিলেন। সেদিন ভোররাতে তাঁদের ওপর গুলি চালানো হলে অনেক শ্রমিক নিহত হন, সংখ্যা জানা যায়নি। মৃতদেহগুলো নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। ২৪-২৫ মার্চ রাতে মেজর জিয়াউর রহমানকে ‘সোয়াত’ থেকে অস্ত্র নামাতে পাঠানো হয়েছিল। ২৫ মার্চ সারাদিন পোর্ট থেকে ক্যান্টনমেন্ট যাওয়ার মুখ্য রাস্তা আগ্রাবাদ রোড বন্ধ রাখা হয়েছিল; এই বন্ধ রাখার উদ্যোগে আমরাও যুক্ত ছিলাম।
২৬ মার্চ সকালে জানতে পারি ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকাবাসীর ওপর, সাধারণ নিরস্ত্র জনতার ওপর এক নির্মম বর্বর গণহত্যা ও নরমেধযজ্ঞ চালিয়ে কয়েক হাজার লোককে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ ভোররাতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। চট্টগ্রাম শহর ৩০ মার্চ পর্যন্ত স্বাধীন থাকে, পরে শহরের পতন ঘটে (এ-বিষয়ে লেখকের অসাম্যের বিশ্বে সাম্যের স্বপ্ন গ্রন্থ, পৃ ৮৯-১০৩ দ্রষ্টব্য)। ২৬ মার্চ থেকেই শহরের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, কারণ ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথেই ছিল ক্যান্টনমেন্টের অবস্থান। আনিস স্যার তাঁর আমার একাত্তর গ্রন্থে লিখেছেন, ‘লালদীঘি’র ময়দানের মিটিং যেটি ‘সোয়াত’ থেকে অস্ত্র খালাসের জন্য শেষ হয়ে যায়, তিনি সেই মিটিং থেকেই ক্যাম্পাসে ফিরে যান ২৪ মার্চ। এরপরে আর চট্টগ্রাম শহরে ফিরতে পারেননি দেশ শত্রুমুক্ত না-হওয়া, স্বাধীন না-হওয়া পর্যন্ত। আসলে তিনি প্যারেড ময়দান থেকেই ক্যাম্পাসে ফিরে যান, ভুলে লালদিঘি ময়দান লিখেছেন।

চার
১৯৭১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় বিশজন শিক্ষক ভারতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এইসব শিক্ষকের অনেকেই এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙা বিল্ডিংয়ে ‘বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তা করতে। এই সহায়ক সমিতির সভাপতি ছিলেন দিলীপ চক্রবর্তী ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অনিল সরকার, সহসভাপতি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. অনিরুদ্ধ রায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো অনেক শিক্ষক সহায়ক সমিতির কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যতটুকু মনে পড়ে, মে মাস থেকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এই সহায়ক সমিতির অফিসে প্রায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত থাকতেন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের নানাবিধ সমস্যা সমাধান করার জন্য, যার মধ্যে একটি মুখ্য সমস্যা ছিল শিক্ষকদের আর্থিক সমস্যা। এই সহায়ক সমিতির সহায়তায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের চাকরিও পেয়েছিলেন। আমিও পেয়েছিলাম রাজস্থানের যোধপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষকের চাকরি। কিন্তু যাইনি। কারণ এই সহায়ক সমিতি আমাকে আরেকটি প্রজেক্ট জোগাড় করে দেয় ফোর্ট ফাউন্ডেশনের সহায়তায়। এই প্রজেক্টটির শিরোনাম ছিল ‘Socio-economic condition of refugees in camps’। এই প্রজেক্টির প্রোপোজাল যা প্রস্তাবনা আমিই লিখেছিলাম, শরণার্থীদের অবস্থা জানতে ও বিশ্বকে জানাতে। এই প্রজেক্টের প্রধান পরিচালক ছিলাম আমি। চেয়ারম্যান ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের বরিষ্ঠ অধ্যাপক ড. বাণী রায়। আমার সহকারী পরিচালক ছিলেন সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক, পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী। কবি অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকও এই প্রজেক্টের গবেষক ছিলেন। গবেষক হিসেবে আরো ছিলেন ড. প্রতিমা পাল (পরবর্তীকালেB.I.D.S-এর গবেষক), কোষাধ্যক্ষ ছিলেন একালের প্রসিদ্ধ শিল্পপতি ও ব্যাংকার কানুতোষ মজুমদার। এছাড়াও আরো প্রায় ৩০ জন কলেজ ও স্কুল-শিক্ষক এই প্রজেক্ট বা গবেষণা সমীক্ষায় সহকারী গবেষক ও তথ্য সংগ্রহকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন সময়ে মুজিবনগর সরকারের হয়ে, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশে অনেক ধরনের কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় তাঁকে পাঠানো হয়েছিল বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করার জন্য। তাঁর আমার একাত্তর গ্রন্থে এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা রয়েছে। এই সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার বিভিন্ন জায়গায় দেখা হলেও আমাদের দুজনের কার্যপরিধি ও বন্ধুমহল ছিল আলাদা, শুধু এক ক্ষেত্র ছাড়া। আমাদের দুজনেরই বন্ধু এবং ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন অনিল সরকার, অনিরুদ্ধ রায় ও দিলীপ চক্রবর্তী। আমাদের মুখ্য কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা এবং যথার্থতা ভারতীয় জনগণ এবং বিশ্বসমাজের সামনে তুলে ধরা ও ব্যাখ্যা করা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমি বেশ কিছু কথিকা পড়েছি। আনিস স্যারও একই কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনিও কয়েকটি কথিকা পড়েছেন। কিন্তু এক পর্যায়ে তাঁর কাজের ক্ষেত্র আমার থেকে আলাদা হয়ে যায়। পঞ্চাশের দশক থেকেই তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পরিচিত ছিলেন, ঘনিষ্ঠ ছিলেন, সেইজন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিভূ হিসেবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়েছিলেন বাংলাদেশ সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছিল তা ব্যাখ্যা করার জন্য। তাঁর সঙ্গে সঙ্গী হয়েছেন বিভিন্ন জায়গায় ড. এ.আর. মল্লিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইংরেজির অধ্যাপক ড. সারওয়ার মুরশিদ। এমনকি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও তিনি দেখা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বার্তা নিয়ে। তাঁকে প্রবাসী সরকার কর্তৃক গঠিত বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য করা হয়েছিল।
আগেই উল্লেখ করেছি, আমার কাজ ছিল বাংলাদেশের শরণার্থীরা কীভাবে আছে এবং তাদের সমস্যাসমূহ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা। আমাদের এই প্রকৃতির কাজের সঙ্গে আরো অনেকে জড়িত ছিলেন। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশের বিশিষ্ট প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সামগ্রিক পটভূমি বাংলা ভাষাভাষী জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্য মে মাসে একটি বিশেষ প্রকাশনা সংস্থা ‘মুক্তধারা’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই ‘মুক্তধারা’ সম্পর্কে ড. আনিসুজ্জামান লিখেছেন : ‘লেখকদের ঠিক আলাদা সংগঠন ছিল না। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ও বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অফ দি ইনটেলিজেনশিয়া মিলিয়েই তাঁরা ছিলেন। … চিত্তরঞ্জন সাহার অনুরোধে মে মাসের শেষে পাম অ্যাভিনিউতে ব্যারিস্টার আবদুস সালামের বাসভবনে বাংলাদেশের লেখকদের এক সভা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আমি সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলাম। (সেখানে) … চিত্তরঞ্জন সাহা বলেছিলেন যে, তিনি বাংলাদেশের লেখকদের একটা সংগঠন গড়ে তুলতে আগ্রহী; এর নাম হবে স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ। এই সংগঠনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে থাকবে মুক্তধারা নামে প্রকাশনা সংস্থা; সেই সংস্থা থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত এবং বাংলাদেশের লেখকদের রচিত বই প্রকাশিত হবে। এর আর্থিক দায়িত্ব তিনিই বহন করবেন। সাহিত্য পরিষদের ব্যাপারে উপস্থিত ব্যক্তিদের খুব আগ্রহ দেখা যায়নি, তবে প্রকাশনার ব্যাপারে সকলেই চিত্তবাবুকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। ওই সভায় বসেই ঠিক হয় যে, মুক্তধারার প্রথম বই হবে রক্তাক্ত বাংলা নামে একটি সংকলন – তাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বাংলাদেশের বিভিন্ন লেখকের রচনা সংকলিত হবে।’
রক্তাক্ত বাংলাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা প্রথম গ্রন্থ। এই গ্রন্থটির ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। এই গ্রন্থে তৎকালীন বাংলাদেশের প্রবাসী বুদ্ধিজীবীদের অনেকের লেখাই স্থান পেয়েছে। আমারও একটি প্রবন্ধ এই গ্রন্থে রয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রায় সমসাময়িক সময়ে একটি প্রসিদ্ধ ইংরেজি জার্নাল Quest বোম্বে থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এই জার্নালটির প্রচার ছিল বিশ্বব্যাপী। এই জার্নালটি লিটন স্ট্র্যাচি- সম্পাদিত Encounter (এনকাউন্টার)-এর সমমর্যাদা সম্পন্ন ছিল। এই জার্নালেও আমি একটি প্রবন্ধ লিখি ‘The social background of Bangladesh movement’ নামে। প্রবন্ধটি ভারতব্যাপী আদৃত হয়েছিল। আনিস স্যার এই প্রবন্ধটি পড়ে খুবই খুশি হয়েছিলেন, বলেছিলেন, আমি একটি বড় কাজ করেছি। তিনি তাঁর সহকর্মীদের ও ছাত্রদের কাজের প্রশংসা করতে কখনো কার্পণ্য করেননি। আমার একাত্তর গ্রন্থে তিনি বিশ্ববাসীর উদ্দেশে বুদ্ধিজীবী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের ‘বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অব দি ইনটেলিজেনশিয়া’ শীর্ষক আবেদনপত্র প্রকাশ করেছেন যত্নসহকারে, যদিও সেখানে আবেদনকারীদের মধ্যে তাঁর নাম নেই। এর থেকেই বোঝা যায়, তিনি দেশের স্বার্থকে কত বড় করে দেখতেন, চিরকাল দেখেছেন। উল্লেখ্য, এই আবেদনপত্রে আবেদনকারী হিসেবে আমার নামও রয়েছে।

পাঁচ
আনিস স্যারের লেখা থেকে বোঝা যায়, ১৯ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ চেয়েছিলেন আনিসুজ্জামান নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যুক্ত থাকুন। কিন্তু তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসেছিলেন রিডার হিসেবে অধ্যাপনার কাজে। বড় কিছু হতে চাননি। শিক্ষকতাকেই তিনি সবচেয়ে বড় মর্যাদা দিয়েছেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ড. এ.আর মল্লিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ফিরে আসেননি উপাচার্য পদে যোগ দিতে। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ‘ভারতে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত’ হিসেবে অর্থাৎ হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগদান করেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে পরে তিনি নিয়োগ পান তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলে। ১৯৭২ সালে আনিস স্যার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে স্বপদে যোগ দিলেও তিনি, আমার যতটুকু মনে পড়ে, প্রায়ই ঢাকায় থাকতেন বাংলাদেশ গণপরিষদ যে-সংবিধান বা Constitution রচনা করছিল তার বাংলা ভাষা তৈরি করতে। উল্লেখ্য, সংবিধানে বাংলা ও ইংরেজি ভাষ্যের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে বাংলা ভাষ্যকেই গ্রহণযোগ্যতা বা বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭২ সালে নভেম্বর মাসে এই সংবিধান গণপরিষদ কর্তৃক গ্রহণ করার সময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এই সংবিধানই বাঙালির ইতিহাসের প্রথম সংবিধান। বস্তুত এই সংবিধান বাংলা ভাষাভাষী বাঙালির প্রথম সংবিধানই নয়, বিশ্বে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম সংবিধান; এই গৌরবের যোগ্য স্রষ্টা ড. আনিসুজ্জামান।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রখ্যাত অধ্যাপক ড. ইন্নাস আলি। শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ড. শামসুল হক ও আমি বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান করি, স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের করণীয় কী, শিক্ষকদের করণীয় কী – এইসব বিষয় নিয়ে। এইসব সভায় ঢাকা থেকে অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তি এসে আমাদের সভাকে অলংকৃত করেছেন, যেমন কবীর চৌধুরী, ড. সারওয়ার মুরশিদ প্রমুখ। যেসব সভায় আনিস স্যার উপস্থিত থাকতেন তিনিই মুখ্য বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। তিনি এই সময় বাংলাদেশ সরকার যে-শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিল তারও সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি এবং এই শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নিজস্ব Act বা আইন তৈরি করে দেন। পরবর্তীকালে এই স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহার দেখে আনিস স্যারকে অত্যন্ত ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হতে দেখেছি; এই স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছিল ষাটের দশকে পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে-সম্পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তা থেকে তাদের মুক্তি দিতে।
১৯৭৩ সালে আমি কানাডায় চলে যাই পিএইচ.ডি করতে। প্রায় সাত বছর পরে ১৯৭৯ সালের শেষদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আবার যখন যোগ দিই, তখন স্যারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিবিড়তর হয়েছিল। এর প্রধান কারণ তখন দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রতিক্রিয়াশীল ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পরিবেশ বিরাজ করছিল। বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন প্রায় পাঁচ বছর। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আবার সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চার মূল আদর্শের মুখ্য দুটি ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দেওয়া হয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। সমাজে ও রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। রাজধানীতে রাত বারোটা থেকে সকাল পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন উপাচার্যের আসনে অধিষ্ঠিত ড. আবদুল করিম। ১৯৭৩-এ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে অভিষিক্ত, আমার কলেজজীবনের শিক্ষক আবুল ফজল ‘জিয়াউর রহমান সরকারে’ কিছুদিন আগে পর্যন্ত উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করে সবেমাত্র চট্টগ্রামে ফিরে এসেছেন; লিখেছেন মৃতের আত্মহত্যা। উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ড. করিমকে ‘উপাচার্যের দায়িত্ব’ দিয়ে গিয়েছিলেন, পরে সেই পদে তাঁকে স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়। অধ্যাপক আবুল ফজলের সঙ্গে দেখা করলাম; দেখলাম তিনি অত্যন্ত ম্রিয়মাণ। মনে হলো, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত। আমার অনেক বন্ধু, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, তাঁদের অবশ্য আমি ততটা হতাশ দেখিনি। বেশ কয়েকজনের মধ্যে পরিবেশকে মোকাবিলা করার মনোভাব দেখে ভালো লাগল। এর কিছুদিন পরেই জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে নিহত হলেন আরেকটি সামরিক ক্যুর মাধ্যমে। এরশাদ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বিরাট অংশই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষক সমাজের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে আনিসুজ্জামানই ছিলেন মুখ্য। আমরা ছিলাম তাঁর সঙ্গে। এই সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নানাবিধ দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে তখন দুটি গ্রুপ বা দল সুস্পষ্ট রূপ গ্রহণ করেছিল। একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল গ্রুপ, আরেকটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গ্রুপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা এ-কারণে অবশ্য ব্যাহত হয়নি। প্রগতিশীল গ্রুপ সবসময় সচেষ্ট ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ যেন কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন, বাংলাদেশ যেন আবার একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রের চরিত্র ফিরে পায়, যেখানে প্রত্যেকটি মানুষকেই মানুষের মর্যাদা দেওয়া হবে। কিন্তু পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো শৈথিল্যই এই গ্রুপের ছিল না। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে আমি যে-সময় কানাডায় পিএইচ.ডি গবেষণা করছি, ১৯৭৩-১৯৭৯ সালে প্রায় একই কালের একটা সময়ে ড. আনিসুজ্জামান ইংল্যান্ডের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে গবেষণা করে প্রমাণ করছিলেন বাংলা গদ্যের ইতিহাস ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে শুরু হয়নি, এই গদ্য শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে, তার একটি বড় প্রমাণ রয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে, অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বাংলার বিভিন্ন জায়গা থেকে বস্ত্র (মসলিন) ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের মসলা ও অন্যান্য পণ্য সংগ্রহ করে ইউরোপে রফতানি করতে যেসব ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেছিল সেখানে। এইসব ফ্যাক্টরির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পণ্য সংগ্রহ করতে ও অন্যান্য প্রয়োজনে বাংলা গদ্যেই নিজেদের মধ্যে বার্তাবিনিময় করতেন। এই বিষয়ে তাঁর গবেষণাটি প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে Factory Correspondence and other Bengali Documents in the India office Library and Records শিরোনামে। বাংলা গদ্যের বিকাশ যে ষোড়শ-সপ্তদশ শতক থেকেই শুরু হয়েছিল সে-বিষয়ে তাঁর আরো দুটি মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে। ড. আনিসুজ্জামান বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বাংলা গদ্যের আদি ইতিহাসের এক অসাধারণ গবেষক হিসেবে।

ছয়
আমি ফিরে আসার পর সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষকদের বেশ একটি বড় অংশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলে যান উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে। একপর্যায়ে আমার বিভাগে কেবল পাঁচজন শিক্ষক ছিলেন। ’৮১ সালের শেষে আমি বিভাগের চেয়ারম্যানের পদে অধিষ্ঠিত হই। এর কিছুদিন পরে নির্বাচিত হই সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন। এরও পরে নির্বাচিত হই শিক্ষক সমিতির সভাপতি; তার কিছুদিন পরে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি। এই সময়ে এরশাদের সামরিক শাসন চলছিল। এর আগে ১৯৮১-এর মে মাসে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে আসীন হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম শুরু হয়। একপর্যায়ে, আমি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ক্লাবে স্থির হলো, আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার নিয়ে একটি সেমিনার করব। দুদিনব্যাপী সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয় শিল্পকলা একাডেমীতে। আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা শিক্ষকরা। প্রায় প্রত্যেকেই নানাভাবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য তাঁদের বক্তব্য পেশ করেন। এর কিছুদিন আগে বা পরে (সময়টা আমার ঠিক মনে নেই) শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এরশাদের সামরিক আইন ভেঙে কাজির দেউড়িতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব থেকে শহিদ মিনার পর্যন্ত একটি দীর্ঘ মিছিল পরিচালনা করেন, যেখানে অনেক ছাত্রও যোগ দেয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন শুরু হয়। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এক ফরমানবলে সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এই ঘোষণা মানেনি। ক্লাস চলমান থাকে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে এরশাদ বলেছিলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র। আমরা অবশ্য তাঁর থেকে যে দমন-পীড়ন আশা করেছিলাম, সে-ধরনের দমন-পীড়ন হয়নি, যদিও আমাদের কয়েকজন শিক্ষক আমাদের অনুরোধ করেছিলেন গা-ঢাকা দিতে। আমরা অবশ্য তা করিনি।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে একটি সাংস্কৃতিক ক্লাব মুসলিম হলে একটি নৃত্যনাট্য উপস্থাপন করেছিল। আমি সেই সভায় একজন বক্তা ছিলাম। বক্তৃতা শেষে কিছুক্ষণ নৃত্যনাট্য দেখে আমি ঘরে ফিরে আসি। রাত একটার দিকে আমার দরজার কলিংবেল বেজে উঠলে আমি বিস্মিত হই, এত রাতে কে এলেন? দরজা খুলে বিস্মিত হয়ে গেলাম। আনিসুজ্জামান স্যার ও তাঁর বন্ধু রেলওয়ের উচ্চপদস্থ অফিসার জনাব আলী। আমাকে দেখে স্যারও বিস্মিত। কারণ তিনি শুনেছেন আমাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। স্যার আমাকে দেখে খুবই তৃপ্ত হলেন যে, আমাকে অ্যারেস্ট করা হয়নি। আমি বললাম, ‘এত প্রচণ্ড ঠান্ডায় আপনি কেন কষ্ট করে এলেন’ (মাসটা ছিল জানুয়ারি)?’ স্যার বললেন, ‘আপনি অ্যারেস্টেড হলে আমি কি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি (আমি স্যারের ছাত্রতুল্য হলেও স্যার আমাকে আপনি সম্বোধন করতেন)?’ আমার চোখে জল এলো। স্যার বিব্রত বোধ করলেন, বললেন, ‘আমরা তো প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য। আমি অ্যারেস্টেড হলে আপনিও কি স্থির থাকতে পারতেন?’
ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন একজন বৃহৎ প্রাণের মানুষ। স্বাধীনতা-উত্তর যুগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিপন্থী শিক্ষক গ্রুপের তিনিই ছিলেন আহ্বায়ক। ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাওয়ার পর তাঁর অভাবে আমাদের মধ্যে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এর পরে আহ্বায়ক হয়েছিলেন ব্যবসায় অনুষদের ডিন অধ্যাপক আলী ইমদাদ খান। তাঁর অবসর গ্রহণের পর এই গ্রুপের আহ্বায়ক হই আমি। ড. আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাওয়ার ফলে আমরা এমন একজনকে হারাই, যিনি ছিলেন অত্যন্ত স্থিতধী। খুব কম ক্ষেত্রেই তাঁকে বিচলিত হতে দেখেছি। তাঁর সিদ্ধান্ত প্রায়শই সব পক্ষ মেনে নিত। এর পরেও অবশ্য তিনি বিরোধিতার সম্মুখীন হননি, তা নয়। আমাদের গ্রুপ থেকে যে-বছর তিনি আর্টস ফ্যাকাল্টির ডিন মনোনীত হন, সেই বছর আমাদের গ্রুপেরই দুজন বরিষ্ঠ শিক্ষক খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, কারণ, তাঁরাই ডিন হতে চেয়েছিলেন। গ্রুপে তাঁদের প্রায় কোনো অনুসারীই ছিল না। আমি তাঁদের এই ব্যবহারে বিস্মিত হই। ভাবতেই পারিনি কোনো শিক্ষক অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ওপর রুষ্ট হতে পারেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শব্দটি ব্যবহার করলে মনের মধ্যে যে-ভাবের উদ্ভব হওয়া স্বাভাবিক, ড. আনিসুজ্জামান সেই ভাবকেই মূর্ত করতেন। তিনি ছিলেন শিক্ষকের শিক্ষক, ধীর-স্থির, অত্যন্ত যুক্তিবাদী একজন ব্যক্তি। তাঁর প্রতিটি বাক্যগঠন যেমন ছিল চমৎকার, তেমনি ছিল তা যৌক্তিক ও প্রেরণাদায়ী। তিনি ছাত্রদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন। কারণ তিনি নিজের মধ্যেই ‘শিক্ষকের আদর্শকে’ ধারণ করতেন। অনেকে তাঁর মধ্যে কিছুটা আপসকামিতা দেখেছেন, যেমন, তিনি আলী আহসানকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। এটা অনেকেই মানতে চাইতেন না। কারণ আলী আহসান ছিলেন প্রতিক্রিয়ার প্রতীক। তিনি একসময় রবীন্দ্রনাথকেও পাকিস্তানি আদর্শের জন্য পরিত্যাজ্য ভেবেছিলেন। বস্তুত যথার্থ সময়ে আনিসুজ্জামান আলী আহসানের সংশ্রব ত্যাগ করেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে যা আপসকামিতা মনে হতো, তা ছিল প্রকৃতপক্ষে অহেতুক সংঘাত এড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। তিনি কোনো মানুষকে আঘাত দিতে চাইতেন না, নিজে কিছুটা আঘাত পেলেও। সব ছাত্রকেই তিনি ভালোবাসতেন। আমি কখনো ভুলতে পারব না আমার প্রতি বর্ষিত তাঁর স্নেহ, তাঁর স্ত্রী বেবী ভাবির স্নেহ। চট্টগ্রাম একাডেমি যখন আমার ৭৫তম জন্মবার্ষিকী উদ্‌যাপন করল, তখন তারা স্যারকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। স্যার বেশ কিছুটা অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও আসতে দ্বিধা করেননি। ঢাকা থেকে কষ্ট করেই চাটগাঁয় এসেছিলেন। তাঁর এ-ধরনের স্নেহ আরো অনেকেই পেয়েছেন, তাঁর অল্পদিনের ছাত্রছাত্রীরাও পেয়েছেন। মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসার ভাণ্ডার ছিল অক্ষয়।