আমাদের কবিতাধারা ও শামসুর রাহমান

শহীদ ইকবাল

হুমায়ুন আজাদ বলেছেন : ‘১৯৬০ বাঙালি মুসলমানের আধুনিক হয়ে ওঠার বছর; তাঁদের কবিতার আধুনিকতা আয়ত্তের বছর।’ কেন? কারণ, শামসুর রাহমানের প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে বের হয় ১৯৬০ সালে। ‘বইটির নামই বিকিরণ ক’রে নতুন চেতনা, এবং কল্পনাকে সরল রোমান্টিকতা-আশাউচ্ছ্বাস থেকে বিরত করে এক জটিল গভীর নিঃসীম আলোড়নের মধ্যে প্রবিষ্ট করে দেয়।’ এরপর দ্বিতীয় কাব্য ‘রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩) পরিয়ে দেয় তাঁকে বাংলাদেশের অস্বীকৃত প্রধান, আধুনিক, কবির শিরোপা।’ রৌদ্র করোটিতের কবিতাসমূহ ১৯৬০-৬৩ পর্যন্ত রচিত। উৎসর্গ বাবা-মা, প্রচ্ছদ কাইয়ুম চৌধুরী। বাংলাদেশের কবিতায় এরূপে শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) পরিচিতি পান, পরে অনেকের কাছে, মৃত্যুর পরও, অদ্যাবধি। তাঁর শব্দে অভিজ্ঞতা-আলোর সূক্ষ্ম ও গভীর রেখা বসিয়ে দেয় – চেতন-অবচেতন প্রবাহে। ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আমার জন্ম; কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে আমি এক নবীন যুবক। বিশ্বযুদ্ধের সেই ভয়াবহতা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। দেখেছি অগণন মানুষের অসহায় মুখ। দুর্ভিক্ষের বিভীষিকাও আমার অভিজ্ঞতার বাইরে নয়। দেখেছি ক্ষুধার্ত মানুষের গগনবিদারী হাহাকার। চোখের সামনেই ঘটেছে ভারতবিভাগ। দেখেছি রাজনৈতিক বিভাজনে নিজ দেশে পরবাসী হয়ে যাওয়া জনতাকে। দেখেছি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হিংস্র ছোবলও। বাংলা ভাষার ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের আক্রমণ – আর তার প্রতিবাদে বাঙালির প্রত্যয়দীপ্ত ভূমিকারও সাক্ষী আমার চোখ।’ (‘কিছু কথা’, শামসুর রাহমান রচনাবলী-১) ত্রিশের পরে কবিতাকে এ-ভূখন্ডে এক থেকে বহু আলোয়, ব্যক্তি থেকে সমষ্টির সমগ্রতায়, বিকাশমান সমাজের বিচিত্র রেখায় চর্চিত ও বন্দিত করে তোলে। এক একটি কাব্যের ভেতর দিয়ে শামসুর রাহমান এগোলেও মুক্তিযুদ্ধের আগে, একাত্তরের ভেতরে এবং পরবর্তীকালে বিপুল অভিনিবেশে ব্যাপ্ত কালখন্ডের রূপকার হিসেবে পরিগণিত হন। এক্ষেত্রে প্রথম থেকেই তাঁর ভিন্নতা (আধার ও আধেয়) স্পষ্ট, দৈশিক সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বময়, এক থেকে উত্তীর্ণ সত্তায়। তাতে দায় শিল্পের পরে বৃহত্তর সমাজের – যেখানে অর্থ-সংস্কৃতি ও রাজনীতি যুক্ত, ব্যক্তি-আত্মমগ্নতা-আত্মমুগ্ধতা-আত্মমুখিনতা ধরে ভেতরের তটরেখা বেয়ে অসীমান্ত-অলৌকিক মহাবিশ্বের অফুরান আয়োজনে পরিকীর্ণ। এজন্য শামসুর রাহমান শব্দে, পুরাণে, উপমা-উপমানপ্রতিমায় অবধারিত অনুরাগে নিবেদিত। ক্রমাগত তা চেতনস্তর ছাড়িয়ে অর্ধচেতন-অবচেতনে-সামষ্টিক অবচেতন বা স্বপ্নময়রূপে পর্যাপ্ততায় পৌঁছায়, এজন্য মূলীভূত আধুনিকতার সন্দিগ্ধ বাতাবরণ। জীবনের প্রতিবিম্বিক প্রত্যয়সমূহ উপরিতলে এবং এর বিপরীতে ভেতরতলের অধঃক্ষেপ প্রকাশিত। দ্বন্দ্বময় ও বৈপরীত্যের আভায়, রং ও রেখার প্রদীপ্ত কবিতা, যেখানে কবির নিজস্ব স্টেটমেন্ট : ‘সচেতন সাহিত্যকর্মী মাত্রই হৃদয়বৃত্তির দোসর হিসেবে পেতে চান বুদ্ধিবৃত্তিকে।’ হৃদয় ও বুদ্ধির যোগ, আবেগ ও মেধার যোগ – ‘প্রকৃত ভালো কবিকে হতেই হয় মেধাবী।’ সামগ্রিকভাবে এরূপ উচ্চারণে তাঁর কাব্য-গুরুত্ব চিনে নেওয়া যায়।

 

দুই

যে সূক্ষ্ম বোধে প্রেম-বিষণ্ণতার অবগাহন প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগেতে, তা পরে অস্তিত্বকে আরো আহৃত করে, নেমে আসে প্রতিবেশ-পৃথিবীর পরাক্রান্ত ক্রুদ্ধ মর্মদাহনে। রৌদ্র করোটিতে তা স্পষ্ট। এ-উত্তরণটি বাংলাদেশের কবিতায় যুক্ত করে ব্যতিক্রমী বোধ ও উপভোগের। যেটি বিভাগ-পূর্বকালে তিরিশের কবিরা পাশ্চাত্যমুখী ইন্ধনে প্রলুব্ধ ছিলেন, যা বিপুলভাবে এদেশীয় কবিতাকাঠামোকে অনিঃশেষ উদ্যাপনে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয় – শামসুর রাহমানের কবিতা প্রথম থেকেই তা অস্থিমজ্জায় গ্রহণে সমর্থ হয়। প্রথম ক্যাব্যটিতে একরকম আবেগে মৃত্যু-উত্তর জেগে ওঠা কবি স্বপ্ন-সৌন্দর্যে আপ��ত; কিন্তু সেটি সরল শুদ্ধ নয়, তাতে আছে বিষাদ, অসদ্ভাবী ব্যাকুল মন। অতৃপ্তিদায়ক মর্ত্য তাঁকে অনিরাপদ সংকেত দেয়, নিষ্পাপ মন হয়ে পড়ে অরক্ষণীয়, অপ্রতিষ্ঠার সংকুলতা :

অতল গহবরে সেই আছে শুধু পাঁক, পুঞ্জীভূত

আবর্তিত ক্রুদ্ধে স্ফীত ক্রূর অন্ধ পাঁক, শুধু পাঁক।

আকাঙ্ক্ষিত ফুলদল, লতাগুল্ম, পদ্মের মৃণাল

অথবা অপ্রতিরোধ্য পিচ্ছিল শৈবাল, এমনকি

গলিত শবের কীট,

ব্যক্তিমনের সৌন্দর্যরঙের বিপরীতে এ-প্রতিবেশচিত্র অগ্রহণীয়। অনুভবে তা ভয়াবহ, অপ্রার্থিত। এ রূপরেখা আধুনিক এবং অভিনব; বলা যায় তা ক্রমশ উজ্জবল সৌন্দর্যবিভা নিয়ে পথ পেরিয়েছে, পূর্বজের (তিরিশের কবিকুল) ধারায় এগিয়েছে। তা আরো প্রমাণিত হয় ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ কবিতাটিতে, যেখানে তিনি অপরূপ স্বপ্নভারাতুর, ভালোবাসাকাতর, দিগ্বিজয়ী সুদৃশ্যময় :

দেখেছি সমুদ্রের অস্তরাগে একদা হাওয়ায়

নর্তকী-শিখার মতো সফেদ তরুণ ঘোড়া এক

মেতেছে খেলায় –

কিংবা,

যেখানে সূর্যের তলে আকাঙ্ক্ষিত সূর্যের গাথা

নিসর্গে মধুর মতো, ফুলের পাপড়ির মতো ঝরে

এসব পঙ্ক্তির ভেতরে বৈশ্বিক প্রবাহটি বিদ্যমান, তা তিরিশ-প্রভাবিত, কিন্তু বাসযোগ্য ভূমিটুকু শামসুর রাহমানের, মৃত্যু-অন্ধকার প্রত্যাবর্তিত মন যে অপহৃত অপার্থিব প্রতিবেশ দেখে তা খাদে, পঙ্কিলতায়, নর্দমায়, কুৎসিত-কদর্য ও কালিমাময়। সেখানে অসুস্থতার সহাবস্থান তাঁকে দীর্ণ করে। এতে বিভাগোত্তর কবিতাধারার রূপও মেলে, বোদলেয়ার-রিল্কে বা স্যাড জেনারেশন যে-পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কবিরা এরূপ বিলুপ্ত-মুখরিত আর্তিতে মুখ ডোবান বা স্বপ্ন ও কদর্যতার সহাবস্থান গ্রহণ করেন, তাতে শামসুর রাহমান আত্মস্থ করে ফেলেন সমকাল-সংলগ্নতাকে – তাঁর ভাষায়-ধ্বনিতে-চিত্রকল্পে, যেটি চকিত নয়, বা বিদ্রোহের প্রলয়ধ্বজা উড়িয়ে নয়, শান্ত ও প্রখর বিষণ্ণতাড়নায়, কট্টর-নৈরাজ্যময় নয়, গভীর সুপ্ত ও মৌনতার পুঞ্জে দ্রবীভূত। রৌদ্র করোটিতে হয়ে বিধ্বস্ত নীালিমার যে-সূক্ষ্ম পথরেখা তা অনেক উজ্জ্বল-উদ্যত পরিক্রমা। পরে নিরালোকে দিব্যরথ হয়ে সে-রেখাচিত্র আরো স্বচিহ্নিত, এবং বিষয়-প্রকরণে অপ্রতিরোধ্য।

 

তিন

ফিরে আসি, প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগেতে। এখানে কবির মৃত্যুর পরে প্রত্যাবর্তন পৃথিবীর স্বপ্ন, আর কদর্য পৃথিবীর রূপ, এতে প্রকাশিত মন ও পার্থিব পৃথিবী। তাতে স্বপ্ন-আবেগ এক সমগ্রতায় সহাবস্থানে আসীন। সেটি রৌদ্র করোটিতে এগিয়ে গেল আরো। কবির মর্ত্যবীক্ষা এবারে স্থির। মিটে গেছে উন্মেষকালের স্বপ্ন আর উতরোল বিষাদরূপ পেয়ে যায় তাঁর শহর। আত্মচিহ্নিত ব্যক্তিত্ব, যা চিহ্নিত শহরে (নিশ্চয়ই ঢাকা) ও ‘আমি’ রূপে রচিত। ‘ভিখিরির চিৎকার, মাতালের প্রলাপ, পানের দোকানের অশ��ল রঙিন জটলা, অন্ধগলির বিমর্ষতা, শাহরিক কোলাহল এবং সর্বস্পর্শী  নিজস্ব রোদন’ নিয়ে রক্তমাংসরম্য কবি। এখানে তাঁর কবিতা গ্রহণ করেছে পূর্বের প্রতিরোধ-পরাক্রান্ত পৃথিবীকে, যে-পৃথিবী তাঁকে ক্রমাগত রক্তাক্ত করে, ক্ষত সৃষ্টি করে। স্বর্গভ্রষ্ট কবির সব সুখ বা ভয়-বিষাদগুণ্ঠন ছিঁড়ে ফেলে তাঁকে দংশন করে :

উজ্জ্বল মাছের

রূপালি আঁশের মতো ধ্বনি ঝরে ঝরে ধ্বনি

ঝরে পৃথিবীতে

তবে বস্ত্ত-পৃথিবীতে তাঁর এ-অবস্থান এক অর্থে সমকাল-সংলগ্নতাই। কারণ, ওই আমি বা স্থানিক প্রক্রিয়াটি এক বস্ত্ত-বাস্তব উপাদানের আকর। বোঝা যায়, আগের কাব্যের ওই মনোচেতনা এখানে নেই। গৃহীত বস্ত্তবিশ্বে জীবন-সমাজ-সংবেদ সংক্রমিত, অতঃপর তা পেয়ে যাচ্ছে সংহত রূপ। প্রসঙ্গত, কবিতা আঙ্গিকটিতেও কবিরুচি ও উদ্দিষ্ট প্রকাশবিভাটি ধরা পড়ে। ‘দুঃখ’, ‘আত্মহত্যার আগে’, ‘আত্মপ্রতিকৃতি’র উপমানচিত্র, শব্দপুঞ্জ, চিত্রলতা, ভাবস্তবক ও তার পরম্পরা তুমুলভাবে পরিব্যাপ্ত। কবির এ-লগ্নতা মর্ত্যের, নশ্বর পৃথিবীর। প্রাত্যহিকতার প্রাঞ্জলতায় তা ভরপুর। কবিতার যে-স্বপ্নলোকে কবি পৃথিবীর মুখ খোঁজেন, বিপুলায়তন সৌন্দর্যকে অনুরাগে অনুভব্য করে তোলেন – তা জরাজীর্ণ-পঙ্কিলতা ছাড়া যেমন নয়, তেমনি মৃত্যুর ভেতর থেকে প্রস্ত্ততিময় জীবনের নৈরাশ্যও নয়, এক স্থায়ী মোহনীয়তার সর্বব্যাপী সর্বভেদী নিঃশ্বাসবায়ু। এক্ষেত্রে শামসুর রাহমান ক্রমাগত সত্তাসন্নধ্য ও স্থানিক। বাহির-ভেতরের দ্বন্দ্বময় আবেগে স্থির বস্ত্তচিন্তাকে মণিময় করে তোলেন। এক্ষেত্রে ঐতিহ্যের দ্বারস্থ হয়ে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের চিন্তামালা তাঁর ভেতরে জায়গা করে নেয়, সমকালে পৌঁছান, অন্য মাত্রায়। ‘কপালের টিপে,/ শয্যার প্রবাল দ্বীপে,/ জুতোর গুহায় আর দুধের বাটির সরোবরে/ বাসনার মণিকণ্ঠে পাখিডাকা চরে/ দুঃখ তার লেখে নাম’ – এ ছন্দোময়তায় ‘দুঃখ’ সাধারণ ও প্রাত্যহিকতায় থাকলেও ‘জুতোর গুহা’, ‘দুধের বাটি’, ‘কপালের টিপ’ উপমাময় চিত্রমালায় প্রভূত আকর্ষণীয়। ‘দুঃখ’কে বাস্তবে পরিণতি দেওয়া, তাতে আত্মার-প্রাণের যোগ, বিধৃত প্রতিবেশ পৃথিবী, রক্তমাংসরম্যময়। এভাবে মর্ত্যের প্রবাহটি ভিন্নতার দ্যোতনা পেলে, কবিব্যক্তিত্ব একরূপে দাঁড়ায়, সৌন্দর্যবিশ্ব ছড়ায় সৌরলোক পর্যন্ত :

নখ দিয়ে কুটি কুটি পারি না ছিঁড়তে আকাশের

ছড়ানো ত্রিপল কিংবা সাধ্য নেই পাহাড়ের চূড়া

নিমিষে গুঁড়িয়ে দেই

বা,

পূর্ণিমা চাঁদের দিকে পিঠ দিয়ে, অস্তিত্বকে মুড়ে

খবরের কাগজে ছড়াই দৃষ্টি যত্রতত্র, নড়ি,

মাঝে-মাঝে ন’ড়ে বসি, সত্তার স্থাপত্যে অবিরল

উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিদ্বয় আত্মচিত্রের আত্মপ্রকাশ। ব্যক্তি ও কবি বিলীন। নেতি-নাস্তিকতা শব্দগ্রাহ্য হয় ‘ত্রিপল’, ‘খবরের কাগজে’।

প্রথম কাব্য থেকে তা প্রবলভাবে সত্য ও সুনির্দিষ্ট। বাস্তব বিশ্বাসে স্থাপিত। ‘যন্ত্রণার অগ্নিকুন্ডে, বিরক্তির মাছির জ্বালায়’, ‘লিপস্টিক ঘষে মুছে-ফেলা ঠোঁটের মতন আত্মা’, ‘ভালুক বাজায় ব্যান্ড, বাঁকা শিং হরিণের পাশে’ উন্মেষিত-উত্তর রাহমানের এ-অভিষেক কাব্য রৌদ্র করোটিতে, যা পরে আরো দীঘল বিধ্বস্ত নীলিমায়। বিধ্বস্ত নীলিমা বের হয় বইঘর চট্টগ্রাম থেকে। উৎসর্গ জোহরা। রূপকপ্রতীক ছাড়া এতে বিবরণময়, আগের ওই মৃত্যু-উত্তর পথ ছাড়িয়ে যে মর্ত্যে তার প্রবেশ, এবং সেখানে বাধা খাদ-খন্দকে হোঁচট, ভয়াবহ অন্ধকার, ঘৃণা ও পঙ্কিলতায় আচ্ছন্ন, তবু ‘শামসুর রাহমান এ-নর্দমাকে রূপান্তরিত করার শ্রমিক নন, তাই তিনি উড্ডীন নীলিমায়’ :

নীচে নর্দমার গন্ধ। অজস্র পিচ্ছিল কেঁচো বিষাক্ত জঞ্জাল

ভালবেসে কেবলি বর্ধিত করে অস্তিত্বের ঢিবি, চতুর্দিকে

অস্থিচর্মসার মানুষের ভিড় আর পথে পথে অধঃপাত

দাঁত বের করে হাসে।

আরো একটি বিষয় এ-পর্বে লক্ষণীয়, ব্যক্তির ভেতর থেকে সামষ্টিক-সমাজভূমে দাঁড়ানো, সময়খন্ডের সেই ঘোড়া অর্থাৎ যৌথায়ন – তাতেই সমকাললগ্নতার স্থিররেখা বিন্যস্ত, এতে ফিরে আসে হারানো স্মৃতি, কোনো অতীত সময়, সমাজ-রাজনীতির মোটা দাগের দ্বন্দ্ব, বাইরের দ্বন্দ্বে ভেতরের ছিঁড়ে যাওয়া সূক্ষ্ম সূত্র – আর সে-পথেই নৈরাশ্য-নৈঃসঙ্গ্য মধ্যবিত্তের লগ্ন-অসংলগ্ন মুহূর্তের বয়ান পুনর্গঠিত। তাতেই চৈতন্যের বদল হয়। ষাটের ভেতরে তা নির্মিত, নির্মাণপ্রায় পাদবীক্ষেপ। তবে তাতে পূর্বরূপ নিশ্চিহ্ন নয়, প্রথম কাব্যেরই বিকাশমান চেতনা পরিস্রুত :

যৌবন দুর্ভিক্ষ-বিদ্ধ, দাঙ্গাহাঙ্গামায় ভাঙে দেশ,

এদিকে নেতার কণ্ঠে নির্ভেজাল স্বদেশী আকুতি

ভাষা খোঁজে। আদর্শের ভরাডুবি, মহাযুদ্ধ শেষ,

…             …             …

স্বপ্নে শুধু হাঁসের ঝাপট দেখি কসাইখানায়

মনে হয় স্ট্রেচারের ক্যানভাসে প’ড়ে আছি একা,

ভিন্ন ভাষা, বস্ত্তবিশ্ব মিথময়, ‘ভিয়েতনাম’, ‘সিসিফস-শ্রয়’, ‘পিকাসোর গর্নিকা ম্যুরাল’।

সময়ের বিবরণ অতুল্য, সামষ্টিক ও সামাজিক সত্তায় বিবরণ-কাঠামোতে কবিতা, তাবৎ যন্ত্রণার পিকেটিং ‘আত্মজৈবনিকে’। এমনিই ‘বামুনের দেশে’, ‘বন্ধুদের প্রতি’, ‘সেই কণ্ঠস্বর’, ‘বাইরে এখন বড় অন্ধকার, … দাঁড়া দরজাটা ভেজিয়ে দি’, ‘সে পৃথিবী পুড়ে হয়ে গেছে ছাই আর সে-বালক অনেক আগেই!’ – এসবে তো সমকালের বিবরণই প্রকাশিত – একাধারে তা দৈশিক ও বিদেশি ভাবনায় আহৃত।

চার

‘বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে প্রথম কাব্যগ্রন্থ তিনটিতে যা পাওয়া গিয়েছিল, নিরালোকে দিব্যরথে পাওয়া যায় তাই। স্বতঃস্ফূর্ত স্বপ্ন ও তার ধ্বংসোৎসব, বস্ত্তবাস্তবগ্রস্ত করাল প্রতিবেশ পৃথিবী, হিংস্র সময়-সমকাল, ব্যক্তিগত অসহায় হাহাকার – এসব পাওয়া যায় নিরালোকে দিব্যরথের (১৯৬৮) আত্মকেন্দ্রিক কবিতাগুচ্ছে, যেমন পাওয়া গিয়েছিল পূর্ববর্তী তিনটি কবিতাগুচ্ছে।’ পরের কাব্য নিজ বাসভূমেতে (১৯৭০) পরিবর্তন আসে, বস্ত্তবিশ্বের কাল্পনিক ভূমা থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন। এর কারণ কী? কবিতানামে ধরা পড়ে ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’, ‘আসাদের শার্ট’ নাম্নী উত্তেজক মিছিল-রাজপথগন্ধী কবিতা। এসবের ভেতর দিয়ে কাল্পনিক সত্তাটি অভিজ্ঞ ও দ্বন্দ্বময় হয়ে ওঠে। জীবনের ভেতর দিয়ে সমাজ ও ঐতিহ্যিক ভূমি নতুনতর নামাঙ্কন পায়। তাঁর কবিতা বাঁক নেয়। ‘সমকালের সভাকবি’ হন নিরালোকে দিব্যলোকের সৌগন্ধ ধারণ করে। তাঁর চিরকালীন রূপময় মুগ্ধতার ভেতর-পাটাতনে বাস্তব ও বিক্ষুব্ধ রূপ উঠে আসতে থাকে। বস্ত্তত এটি গণমানুষের আর্থ-রাজনীতির ভেতরের শ্রেণিদ্বন্দ্বের স্বরূপ। বিশুদ্ধ ন্যায় ও সত্য প্রত্যয় কবিতার রঙে বর্ণিল। বহন করে তা পূর্বের তুমুল প্রকৃতিসঞ্জাত মুখশ্রী, যা এখন প্রতিরোধী। নির্ধারিত সময়খন্ডের বাংলা ও তার আসন্ন সার্বভৌম বাংলা-রাষ্ট্র। তবে এখানে স্বদেশমূলক কবিতায় স্বদেশ প্রতীতির বিষয়টি এক কালপরিসরে যেমন অনিবার্য হয়ে ওঠে, কবিলেখনীতে তেমনি পূর্বতন বিষণ্ণ ও প্রেমচেতনাও বিবিধ কয়েকটি কবিতাগুচ্ছে প্রদীপ্তময় হয়। কবির নিজ বাসভূমের ধারাটি পরের কয়েকটি কাব্যে প্রবহমান। এবার বস্ত্তত সমাজভূমের বসতি। অসাম্য, ব্যক্তি দুঃখ-দ্রোহ-বিষণ্ণতা-ক্লান্তি কিংবা আর্থ-রাজনীতির ভেতরে শুদ্ধ ‘স্বাধীনতা’র সন্ধান। নিজ বাসভূমের ‘বর্ণমালা’ আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ পেরিয়ে ‘বন্দী শিবির থেকে’তে (মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন) রাষ্ট্রে ‘বাজেয়াপ্ত’ স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার প্রত্যয় – ‘স্বাধীনতা’ নামক শব্দটি/ ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ করে বারবার/ তৃপ্তি পেতে চাই’, এমন ‘শব্দে’ শহর পেরিয়ে চিরায়ত গ্রামে পৌঁছান কবি। তাবৎ প্রাত্যহিকতা স্বপ্ন-স্মৃতিময়তা আর কম্পিত কথনে গণমানুষের কাতারে শামিল হন, ‘হরিদাসীর সিঁদুর’, ‘সকিনা বিবির কপাল’, ‘বাগানের ঘর, কোকিলের গান’ ‘নগ্ন রৌদ্রের চতুর্দিক’ পেরিয়ে কবি ‘মর্ত্যে’ নেমে আসেন, কবিতার শব্দকে ‘উদ্ধার’বার্তা ঘোষণা করেন :

যুদ্ধের আগুনে

মারীয় তান্ডবে

প্রবল বর্ষায়

…   …       …

সৃষ্টির ফাল্গুনে

হে আমার অাঁখিতারা তুমি উন্মীলিত সর্বক্ষণ জাগরণে।

অবরুদ্ধতা পেরোনোর, আশার পথ উন্মোচনের, ন্যায়ের-অসাম্যের-আইনি স্বাধীনতার জন্য কবি হয়ে ওঠেন। কবিতার প্রকরণ অন্তঃপুর ছাড়ে, ব্যাষ্টি ছেড়ে সমষ্টি, সামগ্রিক, শপথদৃপ্ত হয়ে ওঠে। একসঙ্গে তাতে কবিতা বহন করে অনেক নতুন কিছু – বস্ত্তত তাই নগরের, রাজনীতির, মিছিলের, মিটিংয়ের – আরো অনেকান্ত প্রেমময় প্রকৃতিমগ্নতায় ছেয়ে যায় ওই নগরকে ঘিরেই, ভিন্নতর পদ্যকাঠামোতে আটকায় রাহমানের কবিবিশ্বাস। সেটি অবলম্বন পায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বা রমেশ শীল নাম্নী ব্যক্তিত্বে। সেখানে তাঁর আত্মমুখ প্রবল হয়ে ওঠে, যা সমষ্টিতে ছড়ায়, আত্মগ��নিসমূহ অনেকের হয়ে যায় বিবৃত পঙ্ক্তিমালার অনুভবে – সেটি ‘পদার্থময়’ থাকে না, কেবলই আঁচ লাগা কষ্ট আর সদর্থক ইচ্ছা-জিজ্ঞাসার প্রলাপনে পরিবেষ্টিত হয়, পার্থক্য পাওয়া যায় – আগের চেয়ে পরের ‘নিজ বাসভূমে’ (ফেব্রুয়ারি ১৯৭০), ‘বন্দী শিবির থেকে’ (জানুয়ারি ১৯৭২), ‘দুঃসময়ের মুখোমুখি’ (১৯৭৩), ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’ (১৯৭৪), ‘আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি’ (ডিসেম্বর ১৯৭৪), ‘এক ধরনের অহংকার’ (১৯৭৫), ‘আমি অনাহারী’ (১৯৭০), ‘শূন্যতায় তুমি শোকসভা’ (১৯৭৭), ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’ (১৯৭৭), ‘প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে’ (১৯৭৮), ‘ইকারুসের আকাশ’ (১৯৮২), ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ (১৯৮২), ‘মাতাল ঋত্বিক’ (১৯৮২), ‘কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি’ (১৯৮৩), ‘নায়কের ছায়া’ (১৯৮৩), ‘আমার কোনো তাড়া নেই’ (১৯৮৪), ‘যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে’ (১৯৮৪), ‘অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই’ (১৯৮৫), ‘হোমারের স্বপ্নময় হাত’ (১৯৮৫), ‘ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই’ (১৯৮৫), ‘ধূলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ’ (১৯৮৫), ‘এক ফোঁটা কেমন অনল’ (১৯৮৬), ‘টেবিলে আপেলগুলো হেসে ওঠে’ (১৯৮৬), ‘দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে’ (১৯৮৬), ‘অবিরল জলভ্রমি’ (১৯৮৬), ‘আমরা ক’জন সঙ্গী’ (১৯৮৬), ‘ঝর্ণা আমার আঙ্গুলে’ (১৯৮৭), ‘খুব বেশি ভালো থাকতে নেই’ (১৯৮৭), ‘স্বপ্নেরা ডুকরে ওঠে বারবার’ (১৯৮৭), ‘মঞ্চের মাঝখানে’ (১৯৮৮), ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ (১৯৮৮), ‘হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো’ (১৯৮৯), ‘সে এক পরবাসে’ (১৯৯০), ‘গৃহযুদ্ধের আগে’ (১৯৯০) ইত্যাকার আরো কবিতায়। কবির শ্রেষ্ঠ কবিতা বের হয় সেপ্টেম্বর ১৯৭৬-এ। প্রসঙ্গত তাঁর কবিবুদ্ধি যাচাইয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ কবিতায় লিখিত ভূমিকাটুকু পাঠে আনা যায় : ‘প্রায় পঁচিশ বছর ধ’রে বাগ্দেবীর পেছনে পেছনে ছুটে চলেছি। কখনো তিনি আমাকে নিয়ে যান স্নিগ্ধ উপত্যকায়, প্রাচীন উদ্যানে, ঝরনাতলায়, সূর্যোদয়ের ঝলমলে টিলায়, কখনোবা তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে পৌঁছে যাই চোরাবালিতে।… কবিতা লেখার সময়, কোনো এক রহস্যময় কারণে, আমি শুনতে পাই চাবুকের তুখোড় শব্দ, কোনো নারীর আর্তনাদ; একটি মোরগের দৃপ্ত ভঙ্গিমা, কিছু পেয়ারা গাছ, বাগানঘেরা একতলা বাড়ি, একটি মুখচ্ছবি, তুঁত গাছের ডালের কম্পন, ধিকিয়ে চলা ঘোড়ার গাড়ি, ঘুমন্ত সহিস ভেসে ওঠে দৃষ্টিপথে বারবার। কিছুতেই এগুলো দূরে সরিয়ে দিতে পারি না। যা-কিছু মানুষের প্রিয়-অপ্রিয়, যা কিছু জড়িত মানব নিয়তির সঙ্গে, সেসব কিছু আকর্ষণ করে আমাকে। …এসবের বন্দনাই কি আমার কবিতা?’ এ প্রশ্নশীল কবির প্রশ্ন – পঙ্ক্তিমালায়  আরো স্পষ্ট :

ক) উল্রকের বিশদ বিধানে বিদ্বানেরা চোখ-বাঁধা বলদের মতো ঘানি টানে। (‘কবন্ধের এলোমেলো পোঁচে’, বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়)

খ) আমার কবিতা ভাষা কস্মিনকালেও

বিজ্ঞাপনের ন্যাকা বুলির মতো হবে না, এমন শব্দাবলি

তাতে থাকবে না যাতে বারবার তাক থেকে

নামাতে হয় স্ফীতোদর অভিধান।

(‘শুচি হয়’, মঞ্চের মাঝখানে)

গ) সেইদিন আজও জ্বলজ্বল স্মৃতি, যেদিন মহান

বিজয়ী সে বীর দূর দেশ থেকে স্বদেশে এলেন ফিরে।

শুনেছি সেদিন জয়ঢাক আর জন-উল��স;

পথে-প্রান্তরে তাঁরই কীর্তন, তিনিই মুক্তিদূত।

নিহত জনক, এ্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।

ঘ) আকাশের নীলিমা এখনো

হয়নি ফেরারী, শুদ্ধাচারী গাছপালা

আজো সবুজের

পতাকা ওড়ায়, ভরা নদী

কোমর বাঁকায় তন্বী বেদিনীর মতো।

এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও

পরাজিত সৈনিকের মতো

সুধাংশু যাবে না।

(‘সুধাংশু যাবে না’, ধ্বংসের কিনারে বসে)

ঙ) হাসপাতালের বেডে একা। শ্বাপদের অাঁচড়ে, কামড়ে

ছেঁড়াখোঁড়া বাবুই পাখির বাসা আমি

খুব ফিকে জামরঙা শাড়ি, রোদ-চশ্মা-পরা তুমি

আস্তে সুস্থে হেঁটে

আমার তন্দ্রায় তীরে এলে। মৃদু কণ্ঠস্বর শুনে

জেগে উঠি। তোমার চুলের গন্ধে সুরভিত স্বপ্নেরা আমার।

(‘হাসপাতালের বেড থেকে’, হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো)

চ)   গোড়াতেই নিষেধের তর্জনী উদ্যত ছিলো, ছিলো

সুপ্রাচীন শকুনের কর্কশ আওয়াজে

নিশ্চিত মুদ্রিত

আমার নিজস্ব পরিণাম। যেন ধু-ধু মরুভূমি

কিংবা কোনো পানা পুকুরে কি জন্মান্ধ ডোবায়

অস্তিত্ব বিলীন হবে কিংবা হবো সেই জলমগ্ন ভুল প্রত্ন

পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল, উদ্যমপ্রবণ ধীবরের জাল যাকে

ব্যাকুল আনবে টেনে নৌকোর গলুইয়ে।

অ্যাগামেমনন, ইকারুস শুধু গ্রিক পুরাণের নয়; অ্যাগামেমনন নিহত জাতির জনক আর ইকারুস স্বপ্নজীবী; স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের টেলেমেকাস, হ্যামলেট, আফ্রোদিতি, নূহের জাহাজ, একিলিস কবিতার চরিত্র হয়। কবিতায় আবার ইংরেজি শব্দ অহরহ ছন্দপ্রবাহে যুক্ত। আরগঁ, সেঁজা, হোমার, মান, পাস্তারনাক, রবীন্দ্রনাথ আছেন কাব্যগ্রন্থিতে। কারণটি শ্রেয়োবোধের প্রেরণায়। আত্ম আত্মাকে যুক্ত করার প্রলুব্ধতাটুকু আসে উচ্চতার প্রশ্নে। সে-উচ্চতা পৃথিবীপ্রতিম, অধিকতর বিশ্ববিশ্রুত। বিকার, বিকৃতির বিপরীতে। পেরুনোর স্থির প্রতিজ্ঞা।

 

পাঁচ

বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে বনপোড়া একটি হরিণী

ছোটে দিগ্বিদিক, তীব্র তৃষ্ণায় কাতর, জলাশয়ে মুখ রেখে

মরুর দুরন্ত দাহ মেখে নেয় বুকে এবং আপনকার

মাংস আর হাড়ের ভেতরে

সে ঘুমায় নিরিবিলি। …

…             …             …

বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে মৃত শিশু মেঘে ভাসমান ক্ষমাহীন,

কার্পেটের তলা থেকে, জানালার পুরু পর্দা থেকে, …

এর এক দশক পরে লেখা ‘ওদের ঘুমোতে দাও’ থেকে :

ওরা ঘুমিয়ে আছে, ওদের ঘুমোতে দাও।

ওদের কবরে এখন গজিয়ে উঠেছে ঘাস,

যেমন যুবকের বুকে ঘন রোমরাজি।

ওরা ঘুমিয়ে আছে আমরা জেগে থাকবো ব’লে।

দুটোই স্বদেশ প্রসঙ্গ, নষ্ট-গর্বিত দেশের পরিণতি নিয়ে। কাতর বাংলাদেশ একছন্দে, একতালে রচিত। কবি-ব্যক্তিত্ব সেখানে প্রবল, তপ্তমুখর, চাঞ্চল্যময় ও উচ্চমুখী।

জাতিগত নিপীড়ন, ভাষা-আন্দোলন, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের আগ্রাসন কবিতায় দাঁড়ায়। ‘নিজেরই সত্তা দিয়ে বুঝতে হলে তাঁর কবিতা দিয়েই … তিনি শামসুর রাহমান। তাঁর কবিতা পড়লে মনে পড়ে – poetry of earth is never dead. তবু পৃথিবীকে আরো ভালবাসতে হয় – আবারও।’ চিত্রকল্প-পুরাণ-উপমা-উৎপ্রেক্ষায় বর্ণনাময়। শামসুর রাহমান-নির্মিত গদ্যকবিতায়, কখনো অক্ষরবৃত্তের অমিল প্রবহমান ছন্দে। খন্ডিত গৌরব (১৯৯২), ধ্বংসের কিনারে বসে (১৯৯২), হরিণের হাড় (১৯৯৩), আকাশ আসবে নেমে (১৯৯৪), উজাড় বাগানে (১৯৯৫), এসো কোকিল এসো স্বর্ণচাঁপা (১৯৯৫), মানব হৃদয়ে নৈবেদ্য সাজাই (১৯৯৬), তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃদস্পন্দন (১৯৯৬), তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি (১৯৯৭), হেমন্ত, সন্ধ্যায় কিছুকাল (১৯৯৭), ছায়াগণের সঙ্গে কিছুক্ষণ (১৯৯৭), মেঘলোকে মনোজ্ঞ নিবাস (১৯৯৮), সৌন্দর্য আমার ঘরে (১৯৯৮), রূপক প্রবালে দগ্ধ সন্ধ্যারাত (১৯৯৯), টুকরো কিছু সংলাপের সাঁকো (১৯৯৯), স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নে বেঁচে আছি (২০০০), নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে (২০০০), শুনি হৃদয়ের ধ্বনি (২০০১), হৃদপদ্মে জ্যোৎস্না দোলে (২০০১), ভস্মস্তূপে গোলাপের হাসি (২০০২),  ভাঙাচোরা চাঁদমুখ কালো করে ধুঁকছে (২০০৩), গন্তব্য নাইবা থাকুক (২০০৪), কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমার দিকে (২০০৪), গোরস্তানে কোকিলের করুণ আহবান (২০০৫), নির্বাচিত ১০০ কবিতা (২০০৫), না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন (২০০৬), প্রেম ও ভালোবাসার কবিতা (২০০৬) ও অন্ধকার থেকে আলোয় (২০০৬)।

কবির রচনা সংকলন নিয়ে রচনাবলী ১ (২০০৪), রচনাবলী ২ (২০০৬) তাঁর সম্পূর্ণায়ত বাংলাদেশে। তখন এ-সাংস্কৃতিক রূপরেখা প্রশ্নশীল কাব্যপ্রবাহে সুদৃঢ় ও মজবুত।

 

ছয়

কবিতাধারায় কবি উপর্যুক্ত বিষয়বৈচিত্র্যে বৈচিত্র্যময় শব্দরাজি গ্রহণ করেন। এতে তাঁর ভাষিক জগৎ দুলে উঠেছে, আধুনিকতার ক্ষেত্রটি হয়েছে সমৃদ্ধ। বিশ্বময়তায় উত্তীর্ণ তাঁর ভাবসম্পদ। কবিতায় সংগ্রহ করেছেন প্রাচুর্যময় উপকরণ। ইতিহাস-ঐতিহ্য-পুরাণকাঠামোটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যময়, স্বদেশ-সমাজ-রাজনীতি এবং বস্ত্তবিশ্বের অমোঘ উপাদান বিশিষ্টতায় কবিতারূপ ধারণ করতে সমর্থ হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও মুক্তিযুদ্ধ, প্রান্তিক জনতা ও স্বাধীনতা এবং তৎসংলগ্ন সংগ্রামের ইতিহাস-অভিজ্ঞতা কবিতাগ্রন্থিতে আটকায়। উপমানচিত্র, উপমা, চিত্রকল্প বিন্যস্ত এবম্বিধ প্রেরণায়। কবিতার টেকনিক বা প্রকৌশলটি কবি চেতন-অবচেতনের সমগ্রতায় বা রহস্যের আবরণে প্রতিশ্রুত হন, প্রবহমান দ্বন্দ্ব সেখানে নিশ্চিত হয়, বিধৃত কবিতা-কাঠামো আধুনিক প্রশ্নশীল ব্যক্তির ভেতর দিয়ে উত্তরণ প্রয়াসের পথ খুঁজে নেয়। এখানে কবি ব্যাষ্টিক হলেও সমষ্টিতে পৌঁছান। এক পর্যায়ে খন্ড  খন্ড  অনুভূতি কিংবা তুচ্ছ জীবনবোধও তাঁকে প্রতিশ্রুত পথ নির্মাণ করে দেয়। প্রথম কাব্য থেকে কবির মুক্তিযুদ্ধপর্বের কবিতা একটি পূর্ণাঙ্গ প্রয়াস বিবেচনা করলে পরের পর্বে বস্ত্তবিশ্বের তাড়নাই তাঁর কবিতা-প্রকরণ গ্রন্থিত করে। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের পরের হতাশা, অ্যাগামেমনন (সিভিল রাষ্ট্রনেতা মুজিব হত্যার প্রতীকী), সামরিক শাসন ও তার ভেতরে মৌলবাদী তৎপরতা, শঙ্কিত সাম্প্রদায়িকতা কবিতাশিল্পকে গ্রাস করে। প্রেমিক কবি, প্রেমকে রাষ্ট্রীয় আর্থ-ব্যবস্থার বাইরে দেখার সুযোগ পান না। ব্যক্তিও এরূপ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান শ্রেণি এ পরিকাঠামোতে তাঁর মনস্তত্ত্ব, ভোগ-সুবিধা, হতাশা-দুঃস্বপ্ন বা বৈশ্বিক আদান-প্রদানের সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। শামসুর রাহমান নিজেও স্মৃতি-নস্টালজিয়ায় বা বস্ত্তবাদী দৃষ্টিতে কিংবা সংযুক্ত মেধায় আবাল্যের ইঙ্গিত কবিতার প্রকরণকেই উৎসবিন্দু করে তোলেন। বিবৃতময়তায় গঠিত তাঁর সময়খন্ড। অলৌকিক অধীশ্বর নয়, বাস্তবতার অাঁচে তাঁর কবিতা তরল-কথন ও পদ্যময়। এক পর্যায়ে তা পুনরাবৃত্তিময়। রুচি বদলে অনুবাদ, কথাসহিত্য লিখলেও অনন্য তিনি কবিতায়। সে-কারণে শামসুর রাহমান নাগরিক কবির অভিধা, প্রধান কবির অভিধা অর্জিত। উপর্যুক্ত উদাহরণে বা দীর্ঘ সময়ে যে প্রাচুর্যময় কবিতালেখা – সেখানে দিকপবী উপমাময় নিম্নের পঙ্ক্তিরেখামালা :

ক) পিরিচ চামচ আর চায়ের বাটিতে

      রোদ্দুরের উল্কি-অাঁকা উঠোনের আপন মাটিতে

দুঃখ তার লেখে নাম।

খ)   গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের

      জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট

উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।

গ)   ঘোড়ার নালের মতো চাঁদ

ঝুলে আছে আকাশের বিশাল কপাটে, আমি একা

      খড়ের গাদায় শুয়ে ভাবি

মুমূর্ষু পিতার কথা…

ঘ)   এ-শহর টুরিস্টের কাছে পাতে শীর্ণ হাত যখন তখন,

এ-শহর তালিমারা জামা পরে, নগ্ন হাঁটে খোঁড়ায় ভীষণ।

এ-শহর রেস খেলে, তাড়ি গেলে হাঁড়ি হাঁড়ি, ছায়ার গহবরে

পা মেলে রগড় ক’রে আত্মার উঁকুন বাছে, ঝাড়ে ছারপোকা

কখনো-বা গাঁট কাটে, পুলিশ দেখলে

মারে কাট। টকটকে চাঁদের মতো তাকায় চৌদিকে,

এ-শহর বেজায় প্রলাপ বকে, আওড়ায় শে­াক,

গলা ছেড়ে গান গায়, ক্ষিপ্র কারখানায়

ঝরায় মাথার ঘাম পায়ে।

কবিতা সমগ্রে অপার সৌন্দর্যমন্ডিত সহস্র পঙ্ক্তিতে যে সহস্রাধার বিন্যস্ত তা বিভাগোত্তর কাব্যধারায় ভাবনা ও অনুভাব্য শব্দে উত্তর-প্রজন্মরহিত আখ্যা পেয়ে যায়। তাঁর সমসাময়িক বা অগ্রজ কবিদের কবিতাপাঠে শামসুর রাহমানের সঙ্গে কবিতা-অকবিতার প্রশ্নময় দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে কিন্তু কয়েক দশকে শব্দ-কারিগর নিরিখে যে মৌল সংস্কৃতির পরিখাটি তিনি খনন করেন এবং তাঁর যে পঠন বা অভিপ্রেত রূপ তা অপ্রতিরোধ্য বললে অত্যুক্তি হয় না। হয়তো কবির সাদামাটা চিন্তার বাইরেই অবচেতনে তা এগিয়ে যায়, এক্ষেত্রে প্রভূত ফুল-পাখি-সমুদ্র-আকাশ-নারী-নক্ষত্ররূপী উপকরণ উদ্দিষ্ট হয়ে ওঠে, প্রেমময় বা শ্রেয়োরূপটিও তাতে থাকে, কোনো সময় প্যাস্টোরাল অনুভবও যুক্ততা পায় কিন্তু সর্বোপরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত স্বদেশের একটি পূর্ণায়ত মুখশ্রীই তাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেটি সমগ্র জাতিকে পেছনে নয়, সম্মুখে এগোনোর অনুপ্রেরণা দেয়, শুভপ্রদ করে; ভেতরের বিকার বা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে সচেষ্ট হয়। তাঁর প্রধান কবি অভিধাটি সে-কারণেই এড়ানো যায় না। কারণ, এতে বিপুলতার ভার অনেক, প্রতিকূলতাকে পেরিয়ে যাওয়ার সাহসও কম নয়। এখন কবিতা ভেতরে-বাইরে যে-কাজটি করে বা করতে সে সমর্থ, সেটি সব কবির হাতে সে-মাপে প্রতিষ্ঠা পায় না, সে-রহস্যজালও সবার হাতে ধরা পড়ে না, শামসুর রাহমান যেটা একের পর এক কবিতায় প্রকাশ ঘটাতে সমর্থ হন এবং এক পর্যায়ে নির্ধারিত মৌনতার-শুভ্রতার-নির্বিকারতার ভেতর দিয়ে এগোন, পিছপা হন না কোনো সময়েই – না স্বার্থবুদ্ধি বা ধর্মবুদ্ধির কাছে – সেখানে বড়মাপের পরিসরটি গঠিত হয়। কাব্যের নামেও (স্বপ্নে ও দুঃস্বপ্নে বেঁচে আছি, নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে, শুনি হৃদয়ের ধ্বনি, হৃদপদ্মে জ্যোৎস্না দোলে, ভস্মস্তূপে গোলাপের হাসি, ভাঙাচোরা চাঁদমুখ কালো করে ধুঁকছে, গন্তব্য নাইবা থাকুক, কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমার দিকে, গোরস্তানে কোকিলের করুণ আহবান) তা অস্পষ্ট থাকে না। এখানে পুরাণ ব্যবহার বা চিত্রকল্পের প্রয়োগ কীরূপে হয়েছে, সেক্ষেত্রে সাফল্য বা ব্যর্থতা কতোটুকু তা মুখ্য নয়, বস্ত্তত তার ভেতরে টিকে যাওয়া বৈভবটুকু গুরুত্বপূর্ণ, যেটি আমাদের আন্তঃদৈশিক সংস্কৃতি বা স্ফুরিত মানবতার অবিনাশী রূপটি চিহ্নিত করে। শব্দের প্রহরায় যা উত্তরপ্রজন্মের জয়টিকা। রাহমানের কবিতার এ গুরুত্বটুকু কমবে না কোনোকালেই।

এবারে উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিটুকুর দাগাঙ্কিত অংশটি আমলে নিলে তার ভাবের বা ধারণার পেরিয়ে যাওয়ার উপায়সমূহ এবং সেখানে অভিনবত্বের বিস্তারটুকু ধরা পড়ে। চলি�শ বা পঞ্চাশের বাংলাদেশের কবিরা অমোঘতাকে বা সময়ের চলতি নাগরিক বিকার বা সুযোগ-স্বপ্নকে যেভাবে চিত্রকল্পে আনেন তাতে প্রবহমান সময়ের কারণেই হোক বা বিদ্যমান শ্রেণিস্তরের কারণে হোক, খুব বেশি মর্মরিত হয়ে ধরা পড়ে না, বরং এক ধরনের ধর্মীয় পরোক্ষতা বা চলতি সংস্কার থাকে। নদী-পাখি-বৃক্ষ টোটেম বা শুভপ্রদ কিছু উপস্থাপিত হলেও জীবনবীক্ষণ বা কালখন্ড-চাঞ্চল্য বিমুখতা দুর্লক্ষ নয়। শামসুর রাহমানের প্রথম দিকের রচনায় তা হয়তো উড়িয়েও দেওয়া যায় না। বিশেষত জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তো সর্বগ্রাসী অধিকারে থাকেন, পাশ্চাত্যের কবিকুলও বাদ যান না, কিন্তু এর সদর্থক দিকও ছিল। শামসুর রাহমান তা যথোচিত কাজে লাগিয়েই ক্রমশ নিজের পথটি তৈরি করে নেন সময়মতোই এবং ক্রমশ তা স্বতন্ত্র হয়ে নিরীক্ষায় বিপুলতা পায়, স্বদেশ ও অন্যান্য বাস্তবতায় তার প্রকরণের কাঠামো বদলায়, যেটি আগে উলে�খ হয়েছে। যা হোক, এভাবে পথ করে নেওয়া এবং সেটি প্রাত্যহিকতায় গেঁথে ফেলা, পৌঁছে দেওয়া এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে – শুধু উপাদানগত অর্থে নয়, কাব্যকৌশলে – কবিতার চিন্ময় করণ-কাঠামোয়, বলা যায় প্রেমময় প্রতিজ্ঞাটি যেখানে হীরকদীপ্তি পায়, স্ফটিক-স্বচ্ছতায় যা ইন্দ্রিয়-আলোড়ন তোলে, তা-ই কবিতা। সেই শব্দচিত্রেরই অনেককালের বড় কারিগর শামসুর রাহমান।

ছয়

রাহমানের ইত্যাকার পরিবেশনায় শব্দদেবতা কবিকণ্ঠের ব্রতে কূলে পৌঁছায়। ছন্দের ভেতরে নিষ্পাপ প্রতিশ্রুতি স্থায়ী হয়। উপর্যুক্ত উদ্ধৃতি নমুনামাত্র। প্রচুর তাঁর কবিতা-আয়ু। সহজাতরূপে তা গ্রথিত। চিত্রকল্প-ইমেজ-অলঙ্কার-প্রতিবেশচিত্র যে সময়খন্ড বা বিবৃত ভাষ্য গ্রন্থন করে তা ‘শব্দে’ তথা প্রকরণ-সীমানায় অভিনব-অভিপ্রেত :

ক) বুকের নক্ষত্র ছিঁড়ে নিয়ে গেছে দুর্জয় শয়তান

খ) দেখবো অঢেল রৌদ্রে ঝলসে উঠে ঝরায় চুম্বন

ওষ্ঠহীন করোটিতে

গ) ফিরিয়ে দাও ঘাতক কাঁটা, এবার আমি

গোলাপ নেবো।

ঘ) অন্ধকার জীবনের বাগানে নিগ্রোর মতো শুধু

আর্তনাদ ক’রে ওঠে, মহত্ত্ব পিছল নর্দমায়

ভেসে যায়

এগুলো সময়ের ভেতর দিয়ে অগ্রসরমান কবির করোটির মাত্রা। চেতন-অবচেতনে তিনি আমাদের কবিতার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেন; মাত্রাবৃত্ত-স্বরবৃত্ত-গদ্যছন্দ ছাড়াও অক্ষরবৃত্তের  লয়টিই প্রধানত তাঁকে মিলে-অন্ত্যমিলে প্রবহমানে প্রসারিত করে। বাক্যও দাঁড়ায় তাতে। ঘোড়া, জীবন, নীলিমা, গোলাপ প্রভৃতি চিরজীবিতের বাক্ছায়ায় মেলে ধরে শিষ্ট-অবশিষ্টের বাস্তব সরণিসমূহ। কবি-প্রণয়নের এ-প্রতিজ্ঞাই বাংলাদেশের কবিতায় তাঁকে প্রতিষ্ঠা দেয়, দান করে বিশ শতকের ঘনীভূত শ্রেষ্ঠত্বের মহিমা।