আমাদের শিল্পকলা

জয়নুল আবেদিন

আজ এদেশে সমাজজীবনে চারিদিকেই দৈন্য। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, জীবনের সর্বক্ষেত্রেই সংকটের বোঝা যেন চেপে বসে আছে। এই সর্বাঙ্গীণ দৈন্যের কারণ বহুবিধ হতে পারে, তবে আমার চোখে এর যে একটি কারণ খুব বড় হয়ে ঠেকেছে, তা হচ্ছে রুচির দুর্ভিক্ষ। বিবেকবোধ, মনুষ্যত্ববোধ, প্রাদেশিকতাবোধ, এ সকলই গড়ে ওঠে মৌলিক সৌন্দর্যবোধের ‘ইসথেটিক’ প্রেরণায়। রুচিই বিবেক তৈরি করে। সহজাত সৌন্দর্যবোধের মুক্তির মধ্য দিয়েই বৃহত্তর জীবনবোধ বিকাশ লাভ করে। আমাদের মানসিকতায় যে মরচে ধরেছে, তাকে পরিষ্কার না-করা পর্যন্ত শুধু বৈষয়িকতার পাকা বুদ্ধি দিয়ে আমরা কখনোই জাতির উন্নতি করতে পারব না। প্রাণের তাগিদ না-থাকলে শুধু পরিকল্পনায় কী ফল হবে? ধার-করা মূল্যবোধ নিয়ে আমরা যে-কাজেই হাত দিই না কেন, তাতে সাফল্যের চাইতে বিপত্তি ঘটারই অধিক সম্ভাবনা। তাতে পুরনো সমস্যা ধামাচাপা পড়ে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে মাত্র; কিন্তু সংকটের অবসান হবে না।

সব দেশেই দেখা গেছে, যে-যুগে কারুশিল্প যত বিকাশ লাভ করেছে, চারুশিল্পেরও সে-যুগে তত উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু কী চারুকলা, কিংবা কারুকলা, এ দুয়ের কোনো ক্ষেত্রেই শিল্প-বিকাশ সাধনার দায়িত্ব এককভাবে শিল্পী বা কারিগরের নয়, সামগ্রিকভাবে সমাজ এবং জাতির সক্রিয় অবদান ভিন্ন কোনো দেশেই শিল্পকর্মের ঐতিহ্য গড়ে উঠতে পারে না। বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে সংযোগ না-থাকলে শিল্পপ্রচেষ্টা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়ায় এবং সে-প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয় না। শিল্পী নব-নব রসের সন্ধান দেবেন, কারিগর নব-নব নৈপুণ্যের ছাঁদ রচনা করবেন – কিন্তু  সে-রস, সে-নকশার আভাস তাঁরা আবিষ্কার করবেন এই দেশের মাটি, এই সমাজের প্রাণের মধ্য থেকেই। অপরদিকে দেশবাসীর রসবোধ, রুচি-বৈচিত্র্যের তাগিদ তাঁদের অফুরন্ত প্রেরণা জোগাবে এই কাজে। সম্পর্কটা আপেক্ষিক। শিল্পী-স্রষ্টা। তাঁর সৃজনশীল প্রতিভা রুচি আর রসের প্রচলিত মূল্যবোধের রূপান্তর ঘটিয়েই সার্থকতা লাভ করে। কিন্তু এ-কথাও ঠিক যে, সমাজজীবনে এই প্রচলিত মূল্যবোধের পূর্বধাত্রিত্ব না-পেলে শিল্পীর অভ্যুত্থানই অসম্ভব হয়ে ওঠে। তাই যে-জাতি নিজস্ব মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে, তার মতো দুর্ভাগা জাতি আর নেই। পুরনো নকশার দাম যারা ভুলে গেছে, নতুন নকশার দাম তারা বুঝবে কী করে? আমাদের হয়েছে সেই অবস্থা।

একটা ঘরোয়া উদাহরণ দিলে হয়তো আমার বক্তব্যটা খোলাসা হবে। প্রায়ই দেখা যায়, আমাদের দেশের বড়লোকেরা ড্রয়িংরুম সাজান বিলাতি ফ্যাশনে – তার কার্পেট আর জানালার পর্দা থেকে আলমারি বা তেপায়ায় সাজানো শখের সামগ্রীগুলো পর্যন্ত বিদেশ থেকে জোটানো, বিদেশি কায়দায় রাখা। বিদেশি জিনিসে আপত্তি নেই – বিদেশের ভালো জিনিসটার কদর বুঝে তার আদর করতে যদি আমরা শিখে থাকি, সে তো ভালো কথা – আপত্তি, বৈদেশিকতার অনুকরণে, আপত্তি আত্মবিস্মৃতিতে, আর আত্মপ্রবঞ্চনায়। অপরের দেখাদেখি যে-ঘর সাজানো হয়, তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। কারণ তার পেছনে তাগিদ প্রাণের নয়, মিথ্যা অভিমানের; তার পেছনে রুচি সংস্কারের নয়, মিথ্যা আভাসের। তাই বিলেতি বাজারের প্রথম শ্রেণির আসবাব দিয়েও আমাদের সাজানো বৈঠকখানা হয়ে ওঠে অসামঞ্জস্যে ভরপুর, প্রাণহীন,  অস্বস্তিকর। অথচ এমন নয় যে, আমরা  ঘর সাজাতে জানি না। এ-দেশের শিল্পী আর কারিগরদের হাতের কাজের যেসব নমুনা আজো পাওয়া যায়, মৌলিকতা আর বিশিষ্টতার জন্য বিদেশিরা তা পেলে লুফে নেন। বিদেশে এমন কাজ যা কিছু পৌঁছেছে, তা সমাদর পেয়েছে। অথচ আত্মবিশ্বাসের অভাবে আমরা যেসব জিনিস ঘরে রাখতে দ্বিধাবোধ করি, নিজের পছন্দকে আগে বিদেশির চোখ দিয়ে যাচাই করে না-নিতে পারলে তাকে পছন্দসই বলে মানতে কুণ্ঠা হয়। ফলে সৃষ্টিধর্ম আমাদের ক্ষুণ্ণ হয়েই চলেছে। এমনি করেই আমরা তাজা মনটাকে পিষে-পিষে মেরে ফেলেছি, আর অনুকরণের চাপরাশ এঁটে সর্বত্র আপন দৈন্যকে জাহির করে বেড়াচ্ছি। শিক্ষার গোড়ায় আমাদের এমনিই গলদ। বিস্তৃত শিল্পনৈপুণ্যের যে-সম্পদশালী ঐতিহ্যের আমরা উত্তরাধিকারী, তাঁকে যে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি – এটাই আমাদের সবচাইতে বড় লজ্জা। এই ব্যর্থতার ঐতিহাসিক যত কৈফিয়তই থাকুক না কেন, সৃজনশীল তৎপরতায় জাতি হিসেবে নতুনভাবে অনুরূপ কৃতিত্ব না-দেখাতে পারলে আমাদের সে-লজ্জা ঘুচবার নয়। একাধারে ব্যক্তিগত সাধনা ও সমষ্টিগত পর্যালোচনার মাধ্যমেই আমরা সে-লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব। তবে শুধু বাছাই করা লোকদের নিয়ে সম্মেলন করলে লাভ হবে না, সাধারণের মধ্যে তার বিস্তার ঘটাতে হবে। প্রখ্যাত গ্রামীণ শিল্পী ও কারুজীবীদের আহবান করে এনে আসরে বসাতে হবে, তাদের কথা শুনতে হবে, বুঝতে হবে, ভাবতে হবে। এভাবে তথাকথিত আধুনিকতায় শিক্ষিত সমাজের সাংস্কৃতিক চিন্তার সঙ্গে দেশের মাটির খাঁটি সংযোগ ঘটাতে হবে।

সবশেষে একটি সত্য ঘটনার উল্লেখ করে আমি আমার বক্তব্য শেষ করতে চাই। মনমতো জামদানি শাড়ির খোঁজে আমি একবার কয়েকজন তাঁতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তাদের সকলকে আমি প্রশ্ন করি, তোমাদের পুরনো নকশা, তার বৈচিত্র্য, সেসব কোথায় গেল? তারা কেবলই বলে, ‘আমরা মুখ্যসুখ্য মানুষ, আমাদের নকশা আবার নকশা নাকি? আমাদের বাপ-দাদারা গাছের পাতা দেখে, পাখির ডাক শুনে, পানিতে মাছের খেলা থেকে এই সব চেনা জিনিসের নকশা করত চোখের দেখা থেকে। কিন্তু সেরকম নকশা আজকাল চলে না, আমাদের হাতেও আসে না। বিলাতি ডিজাইন বইয়ের নকশাই আজকাল চলে বেশি।’ অবশেষে একজনের কথায় এই অধঃপতনের আসল কারণ জানা গেল। কথায়-কথায় সে স্বীকার করল – ‘আগে আমরা সুতা ইচ্ছামতো রঙাইয়া নকশা করতাম। দেশি রঙে বোধ করি আপনাদের মন উঠবে না। কিন্তু আমরা তারে দিয়া মনের কথা কওয়াইতে পারতাম। জায়গামতো চড়া কিংবা ফিকা করতে পারতাম। এমন রং পাওয়া যায় না। আমদানি করা বিদেশি রঙিন সুতায় আমাদের কাজ করতে হয়। বিদেশি রঙিন সুতার জিল্লা ভারি চমৎকার ঠিকই। কিন্তু তার সবই তো বান্ধা রং, দরকারমতো সে-রঙের মেজাজ চড়াইবার-ফিরাইবার উপায় নাই। আগে আমাদের সুতায় কথা কইত, যেমন বাঁকাইতাম তেমন বেঁকত। এখনকার সুতায় কথা কয় না, একদম সিধা চলে। বিদেশি সুতার যত জিল্লাই থাক না কেন, তার রং তো আমাদের চেনা রং না। তা দিয়া মনের মতন নকশা হয় না, রঙের মতে নকশা করতে হয়।’

তাঁতির এই সাদাসিধে অথচ মূল্যবান কথাকটি এখানে উল্লেখ করার পেছনে আমার উদ্দেশ্য এ-কথাই তুলে ধরা যে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিদেশ থেকে ঐশ্বর্যের উপকরণ আমদানি করে আর বিদেশের অন্ধ অনুকরণ করে শিগগির ফল পাওয়ার আশায় আমরা বস্ত্তত পদে-পদে ঠকেই চলেছি। বিদেশের ভালো জিনিস থেকে শিক্ষা নিতে হবে বইকি। কিন্তু তার জন্য প্রথমে নিজেকেই ভালো করে জানা দরকার। নিজেদের যত দিন না আমরা ভালো করে চিনব, ততদিন বিদেশের আমদানি করা মালমশলায় পশুশ্রমই অধিক ঘটবে, বিদেশি পাঠ আয়ত্ত করে তা নিজের কাজে লাগাতে পারব না। অনুভূতিই সকল সৃষ্টির প্রাণ, অনুকরণ নয়। অনুকরণ দ্বারা কখনো ‘কালচার’ গড়ে ওঠে না। ‘কালচার’ অর্জন করার জিনিস নয়, সৃজন করার জিনিস। এ-কথাটা যেদিন আমরা বাস্তবিক হৃদয়ঙ্গম করব, সেদিন আমাদের অনেক সমস্যারই নৈতিক সমাধানের পথ খোলাসা হয়ে যাবে।

The pleasure which ought to go with every place of handicraft has for its basis the keen interest which every healthy man takes in healthy life and is compounded. It seems to me, chiefly of three elements : variety, hope of creation, and the self-respect which comes of a sense of usefulness; to which must be added that mysterious sense of bodily pleasure which goes with the exercise of the bodily powers …  As to the pleasures of variety, any of you who have ever made anything. I don’t care what, will well remember the pleasure that went with the tuming out of the first specimen …  As to the hope of creation, the hope of producing something worthy or even excellent work which without you, the craftsman, would not have existed at all, a thing which needs you and can have no substitute for you in the making of it – can we, any of us fail to understand the pleasure of this? No less easy, surely, it is to see how much self-respect born of the consciousness of usefulness must sweeten labour. To feel you have to do a thing not to satisfy the whim of a fool or a set of fools, but because it is really good in itself, that it is useful, would surely be a great help in getting through the day’s work…

William Morris, ‘Art under Plutocracy’