আমার দেখা জয়নুল

রফিকুন নবী

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে একটা দিক প্রধান হয়ে মনে আসে। তা হলো তাঁর শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও ছবি আঁকার নান্দনিক ভাবনার পাশাপাশি আরো অনেক দিকে মনোযোগী হওয়া। মানবিক অনুভূতি, এবং ভাবনা-চিন্তাপ্রসূত বিষয়াদিকে ছবিতে উপস্থিত করা, সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া, নান্দনিকভাবে দেশের মানুষকে রুচিবান করে তোলা, দেশের কল্যাণের প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, শিল্পকলার প্রসারে শিল্পীদের সংগঠিত করার মতো বহুবিধ দিকে তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।

শিল্পী হিসেবে প্রচন্ড জনপ্রিয়তা এসব ক্ষেত্রে অত্যন্ত ফলপ্রসূ হতে পেয়েছিল। সমাজের সর্বস্তরে তাঁর গুণগ্রাহী থাকায় তিনি যেদিকেই উন্নয়নের জন্যে হাত বাড়িয়েছিলেন – সহযোগিতা-সহায়তা পেতে অসুবিধে হয়নি কখনো। সরকার, প্রশাসন, বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ মানুষও ছিলেন তাঁর ভক্ত। এই ভক্তি ছিল তাঁর ভাবনাগুলিকে রূপ দেওয়ার প্রধান শক্তি। তিনি ঢাকায় সেই শক্তিবলে শিল্পকলা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান সুরম্য রুচিশীল দালানে স্থাপন করেছিলেন তাঁর সহকর্মী অন্যান্য খ্যাতিমান শিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে। একইভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শিল্পীপল্লী, লোকশিল্প সংগ্রহশালাসহ লোকশিল্প রক্ষার প্রতিষ্ঠান। শিল্পকলাকে এবং শিল্পীদেরকে সমাজে উচ্চস্থানে অধিষ্ঠিত থাকার শিক্ষাও দিয়েছেন।

শিল্পী হিসেবে জীবদ্দশায় সর্বস্তরে অসাধারণ জনপ্রিয়তা প্রাপ্তি বিশ্বে আর কেউ আছেন কি না – শুনিনি। এমনকি ব্রুখেল, গইয়া, হোগার্থ প্রমুখ বিভিন্ন সময়ের বিখ্যাত শিল্পী যাঁরা সামাজিক অবক্ষয়, অনাচার, অত্যাচার-নিপীড়ন এবং অসুস্থ-দুস্থ মানুষদের নিয়ে, বিষয় করে প্রতিবাদী ছবি এঁকে জনপ্রিয় হয়েছিলেন তাঁদেরও কর্মকান্ডে অন্তত জনগণকে রুচিবান করে তোলা। শিল্পকলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা লোকশিল্প রক্ষার কথা ভেবে প্রতিষ্ঠান তৈরির দায়িত্ব তাঁদের নিতে হয়নি। জয়নুল সেই ক্ষেত্রে ব্যত্যয়।

ভিন্ন মানসিকতা এবং ভাবনা ধারণ করা শিল্পী তিনি। এভাবে মূল্যায়ন করলেও তিনি অনন্য। সেইসঙ্গে অসাধারণ দক্ষ এবং শিল্পিত মননের একজন চূড়ান্ত খ্যাতির অধিকারী শিল্পী তো ছিলেনই। আমাদের মতো পিছিয়ে থাকা দেশের জন্যে তাঁকে এসব ভাবতে হয়েছিল। তাঁর খ্যাতি অর্জনের ক্ষেত্রে মন্বন্তরের ১৯৪৩ সালটি অত্যন্ত গুরুত্ববাহী যে, তা এখন সর্বজনবিদিত। বলা যেতে পারে, চিত্রকর হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠার পরিচিতির প্রথম সোপান এই বছরটিতে সৃষ্ট চিত্রমালা। অর্থাৎ দুর্ভিক্ষকে বিষয় করে আঁকা ড্রইং। যদিও ইতোমধ্যে কলকাতা সরকারি আর্ট কলেজের শ্রেষ্ঠ ছাত্র, শিক্ষানবিশ থাকাকালীনই শিক্ষক পদে যোগদানের বিরল সুযোগপ্রাপ্তি এবং সর্বভারতীয় পর্যায়ে পদক লাভসহ নানাবিধ অর্জনে ঋদ্ধ হয়ে শিল্পকলার জগতে অত্যন্ত পরিচিত নাম ছিলেন তিনি।

এসবকে পাথেয় করে তখন উজ্জীবিত তরুণ শিল্পী তিনি। সে-সময়ে ছবি আঁকার বিভিন্ন মাধ্যমে অঢেল কাজ করছেন। কাজের ধরন তৈরি কিংবা কোনো ‘ইজম’কে ধারণ করায় তখনো মনোযোগী তেমন নন। যদিও তাঁর কথায় ইম্প্রেশনিজমে ভালোলাগা ছিল কিছুটা। কিন্তু নিজে চারুকলায় শিক্ষা সমাপ্তির পরও অ্যাকাডেমিক ধরন-ধারণকে তখনো ত্যাগ করেননি। তবে পূর্বসূরি বিখ্যাত ভারতীয় শিল্পীদের ধরন-ধারণের প্রতি আসক্তিটা অনুভব করতেন। বিশেষ করে ড্রইং এবং জলরঙের ক্ষেত্রে। সেভাবে কিছু ভিন্ন ধরনের আঁকার দিকেও ঝুঁকেছিলেন।  নন্দলাল, যামিনী রায়, বিনোদবিহারী, রামকিঙ্কর, অবনীন্দ্রনাথ প্রমুখের কাজের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। তাঁদের রং ও রেখার ব্যবহারের প্রতি টান অনুভব করতেন। কিন্তু পুরোপুরি অনুসারীও হওয়ার যে-চেষ্টা করছিলেন, তাও নয়।

এই রকমের ক্রান্তিকালে পুরো দেশ হঠাৎ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ-আক্রান্ত হলো। মর্মান্তিক সে-সময়টিতে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে খাবারের অন্বেষণে শয়ে শয়ে মানুষ শহরমুখী হয়। আসে কলকাতায়। ফুটপাতবাসী তাদের হাহাকার আর আহাজারি সুবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের ব্যথিত করে। বিশেষ করে সৃষ্টিশীল জগতের মানুষদের। কবি-সাহিত্যিকরা এই দুরবস্থা নিরসনের জন্যে লিখতে থাকেন।

শিল্পী জয়নুলও প্রচন্ড আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং ফুটপাত থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের পাশে এসে দাঁড়ান তাঁর কালি-তুলি নিয়ে। বিশ্বের এই ভয়াবহতাকে সর্বত্র জানান দেওয়ার জন্যে তাঁর দক্ষ হাতের ড্রইংকে সঙ্গী করেন। আঁকেন দুর্ভিক্ষের করুণ দৃশ্যাবলিকে বিষয় করে। বলা বাহুল্য, নামি শিল্পী হওয়ার আশা নিয়ে নয়, ব্যথিত হয়ে এই বিষয়াদিকে ছবিতে ধরে রাখার পাশাপাশি দুঃসহ এই সময়টিকে ধরে রাখাকেও কর্তব্য ভেবে এসব আঁকতে শুরু করেন। বড়ো শিল্পী হওয়ার বাসনা থেকে যে নয় – তা তিনিই বলতেন।

কিন্তু তাঁর সেই দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা কালজয়ী সৃষ্টি হিসেবে গণ্য তো হলোই, সেই দুঃসময়ের সাক্ষীও হয়ে থাকল।

সাধারণভাবে ছবিগুলিতে বিষয়ের দিকটির আবেদনকেই সরল দর্শকবৃন্দ প্রধান করে দেখেন। আঁকার পদ্ধতিগত দিকের শৈল্পিক রসোত্তীর্ণতা নিয়ে তেমন ভাবা হয় না। আমরা জানি কী অসাধারণ পদ্ধতিকে ব্যবহার করে তিনি অভূতপূর্ব দক্ষতায় ছবিগুলি এঁকেছিলেন। অতিমাত্রায় ‘ক্রুড’ বিষয়কে রসগ্রাহী করে বলিষ্ঠ ‘ব্রাশ-লাইন’ এবং অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এক ধরনের পদ্ধতি আবিষ্কার করে ড্রইংগুলি এঁকেছেন, যাতে চিত্রকলার আধুনিক ভাবনাগুলিও দৃশ্যমান। বেদনাবিধুর বিষয়-হেতু কালো কালির ব্যবহার, কম্পোজিশনকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করতে স্পেসকে প্রাধান্য দেওয়া, ড্রইংয়ে ডিটেইল পরিহার করা, অথচ ফিগারগুলির ভঙ্গি, অভিব্যক্তি ইত্যাদিকে ঠিক রাখার যে-ধরন তা একান্তই তাঁর নিজের একটি নতুন স্টাইলে যাওয়া। কিন্তু সব মিলিয়ে রসোত্তীর্ণতা বিদ্যমান। অমনসব বিষয়ের হলেও তাঁর এই পর্বের ছবিও প্রকারান্তরে নান্দনিক রসেরই।

যাহোক, এ-পর্বটি পরবর্তীকালে মুখ্য থাকেনি। ভারত ভাগের পর ঢাকায় চলে এসে নতুনভাবে নিজেকে সাজাতে গিয়ে ধরন পালটান। পঞ্চাশের দশকে লোকশিল্পের মোটিফ নিয়ে ছবি আঁকা শুরু করেন। পাশাপাশি পূর্ববাংলার মানুষ, পশুপাখি এবং প্রকৃতিকে নিয়ে তেলরং, জলরং এবং টেম্পেরায় নিজস্ব একটি ভিন্ন স্টাইল তৈরি করে কাজ করেন। লোকশিল্পের প্রভাবে আঁকার দিক এবং বাস্তবধর্মী অন্য ধরনটিতে ভিন্নতা থাকলেও একই শিল্পীর আঁকা ব্যাপারটি ঠিকই প্রতিষ্ঠিত ছিল। অসাধারণ দক্ষতায় তিনি দুটি ঢংকে একই সময়ে পাশাপাশি এঁকে গেছেন। দুদিকেই সমান দক্ষতায় সার্থক চিত্র সৃষ্টি করেছেন। এটি বিরল একটি ঘটনা বলে আমার ধারণা। দারুণ দক্ষতা না থাকলে দুদিকে দুভাবের ছবিতে রস সৃষ্টি এবং ধরন দুটিকে প্রতিষ্ঠিত করে, পছন্দনীয় করে একই রকম খ্যাতিপ্রাপ্তি বোধহয় সবার পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে তিনি একক এবং অনন্য।

লোকশিল্পের আদলে ছবি আঁকতে গিয়ে তিনি লোকজ মোটিফগুলিকে হুবহু ব্যবহার করেননি। রঙের ব্যাপারেও লোকজ ছবির কাঁচা রংকে পরিহার করেছেন। সেইসঙ্গে ‘টোনাল’ তারতম্যও ব্যবহার করেছেন প্রয়োজনে। অনুকরণকেও প্রশ্রয় দেননি বরং ফর্মগুলিকে সহজ করে এক ধরনের আধুনিক রূপ এনেছিলেন। এই আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় আঁকা বিশেষ মাধ্যম ছিল মূলত গোয়াশ, তেলরং, টেম্পেরা। বিষয় বাছাইয়ে পূর্ব বাংলার বৈশিষ্ট্য রক্ষিত হয় এমনসব পরিচিত দিককে গ্রহণ করেছিলেন। এসবের মধ্যে গুণটানা, প্রসাধন, দুই মহিলা, পাইন্যার মা, চারটি মুখ ইত্যাদি ছবি তাঁর নিজের প্রিয় ছিল। আমার বিশ্বাস যে, তাঁর এ-পর্বের কাজ অসাধারণ রসসঞ্চারী এবং নৈপুণ্যের। মোটা দাগের সাহসী রেখা ব্যবহার করেছেন অবলীলায় নিপুণভাবে।

পাশাপাশি প্রায় একই সময় কালি-তুলি আর খাগের কলমে এঁকেছেন ভিন্নধর্মী চরিত্র। বলা বাহুল্য, এ-আঙ্গিকটি তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। একইসব রং এবং কালি ব্যবহার করলেও ধরনটি ভিন্ন। এমন ছবির মধ্যে সাঁওতাল দম্পতি, সাঁওতাল রমণীদ্বয়, সাঁওতাল পরিবার, বিদ্রোহী, মই দেওয়া এবং সংগ্রাম বা কাদায় পড়া কাঠবোঝাই গরুর গাড়ি ঠেলা উল্লেখযোগ্য। শেষোক্ত ছবিটি এতই জনপ্রিয় যে, হরেক মাধ্যমে এটিকে কারুশিল্পীরা অনুকরণ করে থাকেন।

তাঁর বেশকিছু স্কেচধর্মী ছবিও রয়েছে। এগুলো ভ্রমণজনিত কারণে করা স্টাডি গোছের। পঞ্চাশের দশকে তিনি প্রচুর বিদেশ ভ্রমণ করেছিলেন। সে-সময়ে যখন যেখানে বা যে-দেশে গিয়েছিলেন সেখানকার স্কেচ করেছিলেন। তবে একটা দিক নিয়ে তিনি নিজেও আক্ষেপ করে বলতেন যে, ‘দেশ-বিদেশ ঘোরা আর হরেকরকম অন্যান্য কাজ করতে গিয়া সময় নষ্ট হইছে অনেক। পুরোদমে ছবি নিয়া থাকা হইলো না।’

এসব কথার সঙ্গে অন্য দিকটাও বলতেন। যেমন, ‘কাউরে না কাউরে তো দেশের নানাকিছু প্রয়োজনের দিক দেখতে হইবোই। তো সেইগুলার কিছু আমার ঘাড়ে পড়ছে। দরকার ছিল। করলাম। সময় আসুক তখন শুধুই ছবি আঁকুম।’

একনাগাড়ে ছবি আঁকার আকুতিটা তিনি চিরকালই পোষণ করতেন। কিন্তু সময়াভাবে তা করে উঠতে পারতেন না।              এ-ব্যাপারে শেষ জীবনেও আক্ষেপটা রয়েই গিয়েছিল। মনে আছে, নতুন বাড়িতে স্টুডিও বানিয়েছিলেন বড়সড় করে। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘এইবার শুধু ছবি আঁকুম।’ শুরুও করেছিলেন বিশাল একটি ছবি দিয়ে। নামকরণ করেছিলেন ‘স্নানরতা’। বিষয়টি গ্রামীণ মেয়েদের নিয়ে।

এই সময় বিমূর্ত ধরনে ঝোঁকার প্রতি আগ্রহ থেকে একটি ছবি শুরু করেন। প্রকৃতিকে বিষয় করে ছবি হলেও বিমূর্ত ঢঙে সাজানো। ফর্মকে গুচ্ছবদ্ধ করে প্রকাশের প্রয়াস, যা পরিচিত প্রকৃতিকে ভেঙে বিমূর্তে রূপান্তরিত। তিনি ছবিটিকে অসমাপ্তই বলতেন। পুরোপুরি শেষ করতে পারেননি সময়াভাবে।

মনে পড়ে, এর পরেই তিনি হঠাৎ করে কর্ণফুলী পেপার মিল থেকে তাদের নতুন প্রোডাক্ট কার্টিজ কাগজের একটি বড় রোল পেয়ে পুরো কাগজজুড়ে কালো রঙের ওয়াশে ড্রইংপ্রধান ছবি এঁকে ফেলেন ‘নবান্ন’ উৎসবকে বিষয় করে। অসাধারণ দক্ষতায় করা কাজটি দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। দেশের সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবনভিত্তিক বিষয়াদির সার্থক উপস্থাপন বিস্ময়কর বলে মনে হয়েছিল। বলেছিলেন, – ‘চীন-জাপানের স্ক্রলচিত্রের মতো কিছু করার ইচ্ছা হইতো। বড় কাগজের অভাবে পারি নাই। কর্ণফুলীর কাগজটা পাইয়া কাজটা চেষ্টা করলাম।’ বলা বাহুল্য, জাপানের শিল্পী হকুসাই, মোনাকাতা প্রমুখের ছবি দেখে তিনি অভিভূত হয়েছিলেন। প্রায়শই তাঁদের ড্রইংয়ের অসাধারণত্ব নিয়ে প্রশংসা করতেন।

এই স্ক্রলের সফলতায় কর্ণফুলী থেকে আরো রোল এনে তিনি পরবর্তীকালে ‘মনপুরা’ স্ক্রলটি আঁকেন। সত্তরের সাইক্লোন আর জলোচ্ছ্বাসের পর উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণকর্মীদের সঙ্গে সশরীরে উপস্থিত হয়েছিলেন মানুষের  দুঃখ-দুর্দশা, ক্ষয়ক্ষতি, অসংখ্য মানুষের লাশের পাশাপাশি মৃত পশুপাখি আর ধ্বংসলীলা দেখে মর্মাহত হয়ে ঠিক করেন, সেসবকে নিয়ে ছবি আঁকবেন। বিসৃতত এলাকা জোড়া উপকূলের মানুষের দুর্গতিকে ছোট পরিসরে আঁকলে সম্পূর্ণতা পাবে না ভেবে তিনি আবার স্ক্রল আঁকার চিন্তা করেন এবং তা এক সময় অতি দ্রুততায় এঁকেও ফেলেন। এই ছবি আঁকতে দেখে আমার মনে হয়েছিল, তাঁর মনটা আবার তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময়টিতে চলে যাওয়া যেন। সে-সময়ের মানবিক চিন্তা আর অনুভূতিগুলো যেন ফিরে এসেছে। তাঁর আঁকার সাবলীলতা দেখে মনে হয়েছে, তখনকার উদ্দীপনাই যেন পুনরায় ধারণ করছেন। অভিভূত হয়ে দেখেছিলাম তাঁর আঁকা।

আমার গর্ব যে, তাঁর এই স্ক্রল আঁকার সময় প্রতিদিন উপস্থিত থেকে টুকটাক সহায়তা দিতে পেরেছিলাম। খুবই নিভৃতে বাড়ির লম্বা-দীর্ঘ বারান্দায় বসে উপুড় হয়ে তিনি ছবিটি এঁকেছিলেন কয়েকদিন ধরে। এবং এই পুরো সময়টায় তাঁর আঁকার প্রতিটি ধাপ, প্রতিটি পর্যায় এবং খুঁটিনাটি কী দারুণ সাবলীলতায় আর অবলীলায় একটার পর একটা বিষয়কে ওভারল্যাপ করে আঁকছিলেন; সেই অভাবনীয় ব্যাপারের সাক্ষী হতে পারার অভিজ্ঞতা আজো স্মরণীয় হয়ে আছে। এই অভূতপূর্ব ঘটনাটিতে যে শুধু আমিই উপস্থিত থাকতাম প্রতিদিন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, তাই নয়, উপস্থিত থাকতেন শিল্পী আবদুর রাজ্জাক, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এবং আমার সহপাঠী কেরামত মওলা।

আঁকার প্রক্রিয়াটি ছিল এই রকমের – প্রতিদিন পুরো বারান্দায় রোল গড়িয়ে যতখানি সংকুলান হয় ততটা কাগজ বিছিয়ে নিয়ে প্রথমে পুরো কাগজ মোম দিয়ে ড্রয়িং করে গেছেন খাপছাড়াভাবে। দুই রকমভাবে মোম ব্যবহার করেছেন ড্রয়িংয়ে স্টিক এবং গলানো মোম। মোম গলানোর জন্য সব সময় একটি ছোট চুল্লির ব্যবস্থা ছিল। মজাটা ছিল এই যে, সেই মোমের দ্রুত রেখা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। শুধু তিনিই জানতেন, কোথায় কেমন এফেক্ট সৃষ্টি হচ্ছে আর রেখার ব্যাপারে কোথায় কী ঘটছে। মোম পর্ব শেষে পুরো কাগজে জলরং ওয়াশ দিতেই মোমের সাদা রেখা আর টোনের উদ্ভাসন ঘটলে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে সবাইকে বলেন, ‘এফেক্টটা ভালোই আসছে। দেখি বাকিটা কী হয়।’

তখনো ছবির মাত্র দুই ধাপ পার হয়েছে। বাকিটা কী হবে বা স্যার কেমন করে শেষ করবেন, তা জানার উপায় ছিল না। অবশেষে সেই অপেক্ষাও শেষ হয়। তৃতীয় এবং চতুর্থ দিনে তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ দক্ষতা আর শৈলীতে কালো রেখার ড্রয়িং দিয়ে অসাধারণ ছবিটি শেষ করেন। এই ঐতিহাসিক ছবিটির করণকৌশল আদ্যোপান্ত চাক্ষুষ করার ব্যাপারটি নিয়ে ভাবতে বসলে এখনো আমি অভিভূত বোধ করি।

তবে সরাসরি তাঁকে ছবি আঁকতে দেখার ব্যাপারটি সেই প্রথম, তা নয়। যেহেতু শিক্ষক ছিলেন অতএব মাঝেমধ্যে ক্লাসে এলেই সে-সুযোগটি ঘটত। অধ্যক্ষ ছিলেন বলে ক্লাস নেওয়ার সময় পেতেন না। কিন্তু মাঝে মাঝে চলে আসতেন। কখনো কখনো ড্রয়িং করে দেখাতেন আবার কখনো বা ছবি নিয়ে গল্প করতেন। বা বলা যায়, গল্পের ভাবটি রেখে পড়াতেন। পড়ানোটা পুস্তকি ঢঙের হতো না। স্বভাবজ্ঞানী ভাবের কথা দিয়ে বোঝাতেন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এবং মাইকেল অ্যাঞ্জেলো তো তাঁর প্রিয় ছিলই, সবচাইতে পছন্দের ছিল বতিচেল্লি, রেমব্রান্ট, ভারমিয়ের, ভ্যান গঘ এবং পল সেজান। তাঁদের কাজ সম্পর্কে প্রায় ব্যাখ্যাসহকারে অনেক কথাই বলতেন। ক্লাসে কোনো ড্রয়িং যখন দেখাতেন, তখন অ্যাকাডেমিকতাকেই প্রশ্রয় দিতেন। কিন্তু নিজের ক্যানভাসের সামনে ছিলেন অন্য ধাতের শিল্পী। তখন আর ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিকতার পক্ষের যেন কেউ নন, একজন বদলে যাওয়া শিল্পী। ভিন্ন ধরনের ভিন্ন রস সৃষ্টির সৃজনশীল জগতের জয়নুল হয়ে যেতেন। জলরঙের ল্যান্ডস্কেপই হোক, তেলরঙে আলোছায়ামাখা রমণীদের নিয়ে কম্পোজিশনই হোক অথবা কালো কালি আর তুলি বা খাগের কলমে আঁকা ড্রয়িংই হোক, তিনি তখন আর তাঁর সেই পছন্দের শিল্পীকুলের দলভুক্ত কেউ নন, একান্তই দেশজ এক মহাশিল্পীর উপস্থিতি ঘটে যেত সেসবে।

ল্যান্ডস্কেপের ব্যাপারে বলতেন, পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট, ইম্প্রেশনিস্টদের ভাবসাব ভালো লাগে, খুব প্রিয় ‘ইজম’। কিন্তু আঁকার সময় তাঁকে দেখেছি, আলোছায়া, রং, টোন, ড্রয়িং, পরিবেশ, স্পেস ইত্যাদিকে নিজের মতো করে মনে পশিয়ে একধরনের নিজস্ব ছন্দ, ভঙ্গি আর গতিকে প্রশ্রয় দিয়ে প্রচন্ড দক্ষতায় ছবির কাজ শেষ করতেন। সবটা গড়িয়ে-পড়িয়ে তাঁরই আবিষ্কৃত স্টাইল ধারণ করত। ইউরোপীয় কোনো ইজম তখন আর অনুসৃত হতো না।

ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নিজস্বতা ছিল। ইউরোপীয় রং-তুলি-কাগজ-ক্যানভাসই ব্যবহার করতেন কিন্তু ব্যবহারের চলতি নিয়মকে গ্রাহ্য করে নয়। যেমন জলরঙের ক্ষেত্রে। ‘ডেভিড-কক্স’ তাঁর অত্যন্ত প্রিয় কাগজ ছিল। হালকা বিস্কুট-ব্রাউন এই কাগজটিতে নামিদামি ব্রিটিশ শিল্পীরা জলরঙে কাজ করতে পছন্দ করতেন। এই কাগজে আঁকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা বিখ্যাত ল্যান্ডস্কেপ-শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন একজন ইংরেজ শিল্পী। নাম ফ্রাঙ্ক শেরউইন। কাগজজুড়ে তিনি ভরাট কম্পোজিশনে কাজ করতেন। কাগজের মজাদার টিন্টটিকে খুব বেশি ছাড়তেন না রোদ হিসেবে। হয়তো সে-দেশের আবহাওয়াগত কারণে রোদের ব্যাপারটি তেমন প্রখর হতে পারে না বলে তাঁর ছবিতে সে-পরিবেশটিই তিনি বজায় রাখতেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রখর সূর্যালোককে জয়নুল ব্যবহার করতে গিয়ে সেই কাগজের হালকা ব্রাউন টিন্টকে এমন দক্ষতায় কোনো রং না লাগিয়ে ছেড়ে যেতেন যে, তাতে ভিন্ন মাত্রা সৃষ্টি হতো। রোদের রং-সম্পর্কিত চিরাচরিত ধারণাটি একেবারে বদলে দেওয়ার দিকটা অর্থাৎ হলুদকে বদলে ব্রাউনে আনার ব্যাপারটি এমন বুদ্ধিদীপ্ত আর মজাদার করে প্রয়োগ করার যে তফাৎ, সেটা বোঝারও উপায় থাকত না।

যা-ই হোক, শিল্পাচার্য জয়নুলকে আমি প্রথম অত্যন্ত কাছে থেকে ছবি আঁকতে দেখেছিলাম ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। তখন মাত্র কমাস হয়, আর্ট কলেজের ছাত্র আমি। বার্ষিক বনভোজনে গিয়েছিলাম মিরপুরের বিল এলাকার একটি উঁচু পাহাড়ি মতন টেকে। সম্ভবত মাজারের পেছনের কোনো জায়গা হবে। তখন ওদিকটায় জঙ্গল ছিল। মাজারেও তখন এখনকার মতো বড় দালানকোঠা ছিল না। শুনেছিলাম, মাজারের খাদেমদের পোষা কুমির ছিল। ডাঙায় কুমিরের গর্তও দেখেছিলাম। অত্যন্ত নিরিবিলি স্থান। সেখানে সহপাঠীরা ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম কুমির দেখার আশায়। হঠাৎ কেউ এসে বলল, ‘আবেদিন স্যার ছবি আঁকতে বসেছেন। সবাইকে উপস্থিত থাকতে বলেছেন স্যারেরা। আঁকা শেষে সই করতে হবে সবাইকে।’

ব্যাপারটি নতুন বটে। অন্যের ছবিতে সই? কী করে সম্ভব? তাও আবার আবেদিন স্যারের ছবিতে! ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র-হেতু নিজের আঁকা ছবিতেও সই করি না। তবু ছুটলাম। বেশ পাহাড় মতন উঁচু টিলা। তার ওপরেই বনভোজনের মূল আসর। একদিকে একটি মরা কাঁঠালগাছ। তার গায়ে স্যারদের কারো করো শার্ট, কোট, চাদর, ব্যাগ ইত্যাদি ঝোলানো। নিচে বিরিয়ানির জন্য রাখা বিরাট কয়েকটি ডেকচি। ডেকচির কাছাকাছি বেশ সাহসী এবং চতুর চেহারার কয়েকটি পাতিকাক। তাদের কেউ কিছু বলছে না বলে বেশ নির্বিঘ্ন ভেবে পরম আশকারায় হাঁটাহাঁটি করছে, উড়ছে, চলছে-ফিরছে।

একটু খেয়াল করতেই বুঝলাম, এই পুরো দৃশ্যটিই স্যারের ছবির বিষয়। স্যার বেশখানেক দূরে একটি ফোল্ডিং টুলে বসে বোর্ডে ফুলশিট কাগজ সেঁটে সরাসরি খাগের কলম চায়নিজ ইংকে ডুবিয়ে ডুবিয়ে দৃশ্যটি আঁকছেন। পরে জেনেছিলাম কাগজটি ছিল কেন্ট। পেছনে দাঁড়িয়ে শিক্ষকবৃন্দ, কয়েকজন লেখক, কবি, সংগীতশিল্পী এবং ওপরের ক্লাসের বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী। যতদূর মনে পড়ছে – মুনীর চৌধুরী, সংগীতশিল্পী মমতাজউদ্দীন এবং আবদুল আলীম ও অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকও ছিলেন সেই ভিড়ে।

দেখতে দেখতে কমিনিটেই ছবি শেষ। কাঁচা চোখে ছবির বিচারের ক্ষমতা তো ছিলই না, শুধু দেখলাম সবাই থ বনে গেছেন। কারো মুখে কথা নেই। ছবিটির দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক আকর্ষণবোধ হলো। তা যে কী ছিল, সে-মুহূর্তে বিশ্লেষণের ভাষা জানা ছিল না। স্যার ছবিটি একজনকে গাছের কাছাকাছি একটি ঝোপে দাঁড় করিয়ে রাখতে বললেন। পরে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘দূর ভালা হইল না। সময় পাইলে আর একটা আঁকুম। এখন সবাই সই করেন।’ পেছন থেকে সম্ভবত শিল্পী শফিকুল আমীন স্যার শুধু বলেছিলেন, ‘আরেকটি দুর্ভিক্ষের ছবি হইলো। বহুদিন পর একই ধরনের একটা ছবি আঁকলেন।’ সেই ছবিতে এক কোনায় আমারও সই আছে।

বেশ কিছুকাল সে-ছবিটি আর্ট কলেজে তাঁর কক্ষে ছিল আগের বছর মুন্সীগঞ্জে বনভোজনে গিয়ে চরে বসে আঁকা নৌকার ছবির পাশে (এই ছবিটি এখনো রয়েছে চারুকলা ইনস্টিটিউটের সংগ্রহে। কিন্তু সে-ছবিটি যে কোথায় উধাও হলো –  আর দেখিনি।) তবে পরে যখন তাঁর দুর্ভিক্ষের ছবিগুলি সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা জন্মাল, তখন বুঝেছিলাম – কী অসাধারণ পটুতায় একটি অবিষয়কে বিষয় করে কাজটি তিনি মাত্র ওই কমিনিটে করেছিলেন ছবির মজাদার নির্যাসকে তারিয়ে তারিয়ে ব্যবহার করে।

বড় ক্যানভাসে তেলরঙে ভিন্ন ধাঁচের ছবি আঁকতে দেখেছি আর্ট কলেজে মাস্টার হওয়ার বছরতিনেক পর। সময়টা ’৬৭-৬৮-র দিকে। আমার সহপাঠী (বর্তমানে খ্যাতিমান নাট্যশিল্পী) কেরামত মওলা এক বিকেলে খবর দিলেন, আবেদিন স্যার ডেকে পাঠিয়েছেন জরুরিভাবে। সেদিনই সন্ধ্যায় যেতে হবে ইডেন বিল্ডিংয়ে। হঠাৎ ইডেন বিল্ডিংয়ে কেন যেতে বলা, বুঝতে পারিনি। মওলা নিজেও জানতেন না। ইডেন বিল্ডিং মানে এখনকার সেক্রেটারিয়েট।

ইডেন বিল্ডিংয়ে এর আগে কখনো কোনো কাজ পড়েনি, অতএব যাওয়াও হয়নি। ওখানে প্রাদেশিক প্রশাসনের হরেক দপ্তরের সঙ্গে কিছু কিছু কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরও ছিল। এত সুউচ্চ দালানের সেক্রেটারিয়েট তখন ছিল না। বেশ কিছু লম্বা লম্বা টিনশেড ছিল। সেসবের একটিতে ছিল প্রেস ইনফরমেশন দপ্তর। সেখানে আমাদের যেতে হবে। আবেদিন স্যার সেখানে থাকবেন।

সন্ধ্যায় গিয়ে হাজির হলাম। আবেদিন স্যারের জরুরি ডাক, অতএব ঠিক সময়মতো পৌঁছালাম। কয়েকটি কম আলোর বাতি জ্বলছিল ঘরে। সেই আলোতে ঘরের এক কোণে আবেদিন স্যার বসে চা খাচ্ছেন। তাঁকে ঘিরে বসে আছেন শিল্পী কামরুল হাসান, শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, খ্যাতিমান অভিনেতা আবুল খয়ের, (মহীবুবুর রহমান) ক্যামেরাম্যান মবিনসহ আরো অনেকে। ঘরময় ছবি আঁকার কাগজ          ছড়ানো-ছিটানো। একটি দেয়ালের পাশে কয়েকটি ইজেল, অদূরে স্ট্যান্ডে ১৬ মিলিমিটারের চলচ্চিত্র-ক্যামেরা এবং কয়েকটি চলচ্চিত্রের জন্য ব্যবহারোপযোগী ‘ডলি ফ্লাড’ লাইট।

আমাদের দেখে স্যার খুশি হলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন অপরিচিতদের সঙ্গে। সেখানে ছিলেন ঝাঁকড়া চুলধারী বেশ লম্বা-চওড়া ফরসা মতন একজন। ভদ্রলোককে দেখিয়ে আবেদিন স্যার বেশ স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘এই যে ইনি, ইনারে নিয়া একটা সিনেমা হবে। ইনার নাম কাজী নজরুল ইসলাম।’ এ-কথা শুনে ভদ্রলোকসহ সবাই হো-হো করে হেসে উঠলেন। সবার হাসি শুনে বুঝলাম স্যার রসিকতা করছেন। কিন্তু সবটাই হেঁয়ালি মনে হলো। পরে খয়ের সাহেবকে বুঝিয়ে দিলেন যে, বিদ্রোহী কবি নজরুলকে নিয়ে একটি ছবি হবে। ওই ভদ্রলোক নজরুলের ভূমিকায় অভিনয় করবেন। ছবিটি নজরুলের ওপর হলেও ইংরেজবিরোধী নানান গণআন্দোলনের দিকগুলো রাখা হবে তাঁর সারা জীবনের কর্মকান্ডের পরম্পরাকে ধরতে।

স্যার বুঝিয়ে দিলেন – এই পর্বের জন্য তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও কিছু ড্রয়িং করতে হবে চলচ্চিত্রটিতে ব্যবহারের জন্য। শুনে উজ্জীবিত বোধ করলাম। অবশেষে শুরু হয় কাজ। দিন পনেরো ধরে চলে সেই দুরূহ কাজের পালা। একদিকে রিমকে রিম কার্টিজ কাগজে ড্রয়িং, সেইসঙ্গে স্যারের বড় বড় ক্যানভাসে ছবি আঁকার ধুম।

তিনি বড় ছবি শুরু করেন পলাশীর যুদ্ধ দিয়ে। কিন্তু শুরুর আগে ড্রয়িংয়ের পর ড্রইং করেন বিভিন্নভাবে। চমৎকার সব ড্রয়িং। মেমোরি ড্রয়িং যে এত মজাদার এবং সঠিক হতে পারে, তা দেখাই আমার মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায়। কামানের ড্রয়িং, ইংরেজ ও দেশি সৈনিকদের চেহারা এবং চরিত্রগুলির ভাবভঙ্গির ড্রয়িং, আমবাগানের খসড়া-ড্রয়িংসহ অসংখ্য ড্রয়িং তিনি পলাশীর যুদ্ধের পেইন্টিংটি শুরুর সহায়ক হিসেবে এঁকে ফেললেন এই কদিনে। সেটি শেষ করে আঁকলেন তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা। তবে শুরুর আগে রসিকতা করে বললেন, ‘কেল্লা তো দেখছি, মেলা – বাঁশের কেল্লা তো দেখি নাই। এখন করিটা কী?’ স্যার ছিলেন আসরি মানুষ। রসিকতা আর গল্প করতে করতেই বসে বসে ছবির পুরো ব্যাপারটিকে নিজের মনে সেই মুহূর্তগুলোতে ঠিকই সাজিয়ে নিচ্ছেন। কী করে শুরু করবেন আর কী আঁকবেন তার লে-আউটটি মনে তৈরি করতেন। তারপর এক সময় হঠাৎই শুরু করতেন কাজ তার স্বভাবসুলভ দ্রুততার সঙ্গে বলিষ্ঠ ড্রয়িং দিয়ে। যতদূর মনে পড়ে, পলাশীর যুদ্ধ, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, সিপাহি বিদ্রোহ ইত্যাদিসহ মোট আটটি পেইন্টিং তিনি ওই কদিনে আঁকেন। সেইসঙ্গে নজরুলের জীবন-সম্পর্কিত বেশকিছু ইলাস্ট্রেশনধর্মী ছবিও আঁকেন ফুলশিট কাগজে। ভাবতাম, অত বড় ক্যানভাসের ছবি আর ওই অতগুলি ড্রইং শেষ করবেন কদিনে, কীভাবে! কিন্তু এক ধরনের স্কেচিং ঢঙে দিব্যি নিজের ধরনকে বজায় রেখে ঠিক সময়মতো শেষ করেছিলেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওই দপ্তরে উপস্থিত হয়েই খয়ের সাহেবকে ঠাট্টার ছলে জানিয়ে দিতেন কী কী না খেলে ছবি এগোবে না। সেসব রসিকতাপূর্ণ কথার জন্য সবাই বেশ অপেক্ষাতেই থাকতেন বলে মনে হতো। কয়েকটি এখনো কানে লেগে আছে। যেমন একদিনের কথা – ‘খয়ের সাহেব, আজকে তো রেক্স-এর কাবাব-পারোটা না হলে পলাশীতে যুদ্ধ লাগানোই যাইব না মনে হয়।’ এই রেস্তোরাঁর কাবাব-পরোটার প্রতি আবেদিন স্যারের বিশেষ আকর্ষণ ছিল বলে ধারণা হতো। তবে স্টেডিয়ামের কোনো একটি রেস্তোরাঁর মাংসের চাপ আর চাপাতিও মাঝে মাঝে আনাতেন।

তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা পেইন্টিংটা শুরু করার সময় আরো একটি রসিকতার কথা মনে আছে। এ-সময় পরপর কয়েকদিন একই ধরনের খাবার খাওয়ার কারণে সম্ভবত শিল্পী কামরুল হাসান কিংবা খয়ের সাহেবের পছন্দ অনুযায়ী গুলিস্তানের বিখ্যাত চায়নিজ রেস্টুরেন্ট ‘চৌ-চিন-চৌ’ থেকে খাবার আনা হলো। স্যার বলতেন, ‘বাহ্! আমি তো বাঁশের দেশি কেল্লা নিয়া ভাবতাছি। চীনা ‘ব্যাম্বু শুট’-এ না গোলমাল বাধে!’

তো, এরকমের সব রসিকতার মধ্য দিয়ে তিনি কাজের সময়টিতে আসর জমিয়ে রাখতেন। সবাই তাঁর নানান কথা শুনতে অপেক্ষা করতাম কখন পেইন্টিংটি শুরু করবেন। তিনি বিশাল শূন্য ক্যানভাসটির কাছে বসে গল্পের পর গল্প বলে যেতে ঠিকই; কিন্তু কাজের সময় কাজ ঠিকই করে ফেলতেন। সেসব ড্রয়িং আর পেইনিটং, এখন কোথায় আছে জানি না। মাত্র গোটা দুয়েক পেইন্টিং বোধহয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। নজরুলের বেশকিছু প্রতিকৃতিও তিনি ওই দপ্তরে বসেই এঁকেছিলেন। সেগুলোই বা কোথায় গেল? পরবর্তীকালে আর কোনোদিন দেখিনি। চলচ্চিত্রটাই বা কী পর্যায়ে আছে, কেমন  হয়েছিল, তাও জানা নেই, দেখিওনি কোনোদিন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, তারপর মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা প্রাপ্তির বিশাল অর্জনে দেশের সবকিছুকে নতুন করে নির্মাণ আর সাজানোর ব্যস্ততায় সে-তথ্যচিত্রটি নিয়ে আর ভাবা হয়নি বলে আমার ধারণা।

তিনি আড্ডা খুব ভালোবাসতেন। তবে অন্যত্র গিয়ে আড্ডায় যোগ দিতে কখনো দেখিনি। নিজ বাসাতেই প্রতি সন্ধ্যায় বসতেন। এই আড্ডার আসর এমনি কাটাবার জন্যে ছিল না। প্রতিদিন কিছু না কিছু নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কথা হতো। আর তা চলতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। সমাজের বহুক্ষেত্রের পরিচিত-অপরিচিত নামিদামি ব্যক্তিবর্গও জড়ো হতেন তাঁর বৈঠকখানায়।

এটা ছিল প্রতিদিনের নিয়ম। আমাদেরও হাজির থাকতে হতো। সপ্তাহে দু-এক দিন আমরা কয়েক বন্ধু উপস্থিত থাকতাম। আমরা ছিলাম মূলত শ্রোতা। কখনোই শুধু অহেতুক আড্ডার ধরনটি চোখে পড়েনি। অত্যন্ত আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। গল্প করতে ভালোবাসতেন। এক ধরনের পরিশীলিত রসিকতাপ্রবণ স্বভাব ছিল তাঁর। সে-কারণে হাস্যরসের মধ্য দিয়ে আসর শুরু হলেও ধীরে ধীরে সিরিয়াস সব আলোচনায় চলে যেতেন। তাতে কোনো-না-কোনো পরিকল্পনার কথাই থাকত বেশি। থাকত করণীয় সংক্রান্ত পরামর্শ, আদেশ-উপদেশও।

মোট কথা, দেশের সর্বক্ষেত্রের মানুষের মধ্যে শিল্পকলার বোধ তৈরির ব্যাপারটিকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছিলেন বেশি। অতএব শুধু ছবি আঁকাই নয়, শিল্পকলা চর্চার সুষ্ঠু পরিবেশ কী কী ভাবে করা যায়, তা নিয়েও ভাবতেন। বিদেশে গেলে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন যেসব দেশের শিল্পাঙ্গন এবং সেখানে থেকে গ্রহণ করতেন প্রয়োজনীয় রসদ।

যাই হোক, শিল্পকলার ছাত্র হিসেবে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবি এবং তা নিয়ে গর্ববোধও করে থাকি। আরো বড় করে বললে অহমিকাই পোষণ করি বলা যায়। এ সবকিছুই আসলে আমার শিক্ষকবৃন্দকে নিয়ে। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম শিল্পী তাঁরা। দেশে কলাশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং এর একটি বিশাল অঙ্গন সৃষ্টি করে তার বাস্তব রূপ তাঁরা দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা অঙ্গনটির প্রকাশ ঘটিয়ে রুচিশীল একটি জগৎ নির্মাণ করে গেছেন। সুন্দর-অসুন্দর, সৃজনশীল এবং সৃজনহীনতার তারতম্য বোঝার পাঠ দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের আলোকিত করেছেন, সেইসঙ্গে সমাজের সংস্কৃতিমনা মানুষদেরও অনুপ্রাণিত করে গেছেন।

সেসব মহান শিক্ষক-শিল্পী হলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ, পটুয়া কামরুল হাসান, শিল্পী আনোয়ারুল হক, শফিকুল আমিন, খাজা শফিক আহমেদ, হাবিবুর রহমান, মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, রশিদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, কাইয়ুম চৌধুরী, কাজী আবদুল বাসেত, মুস্তাফা মনোয়ার। এঁরা শুধু নিজেদের চিত্রকলা চর্চা নয়, তাঁদের কর্মযজ্ঞকে

নানাভাবে নানাদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন।

এঁদের সবার প্রধান অনুপ্রেরক যিনি, তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। আমার এ-লেখাটি তাঁকে নিয়ে। আর্ট কলেজে পড়ার সময় তাঁকে অধ্যক্ষ এবং শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই সীমাটুকু দিয়ে তাঁর পুরো মূল্যায়ন সম্ভব নয়। শিল্পকলার জগতে নিজের শিল্পীজীবন গড়ার যে নানাবিধ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসা, সেখানেও তাঁর উপস্থিতি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষে উপলব্ধি করি। ঘনিষ্ঠ হওয়ার যে-সুযোগ হয়েছিল, তা থেকে যে বোধ প্রাপ্তি তা পাথেয় হয়ে আছে।