আমার দেখা রশীদ করীম

সুস্মিতা ইসলাম

শেষ পর্যন্ত রশীদ করীম চলেই গেল; কিন্তু বড্ড নীরবে গেল, কদিন ধরে ঘুরেফিরে এই কথাটাই খুব মনে লাগছে। কিছুদিন আগে কলকাতার কোনো একজন লেখক সাম্প্রতিককালের উপন্যাস ও ঔপন্যাসিকদের সম্পর্কে আলোচনায় রশীদ করীমকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও অপর আরেকজন ঔপন্যাসিকের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, এই মুহূর্তে তাঁর নামটা ঠিক মনে পড়ছে না; যিনি লিখেছিলেন তাঁর নামটাও নয়। লেখাটি আমি পড়েছিলাম মাসকয়েক আগে রশীদ করীমের কাছে বসেই। তার বিদায়টা তাই আমাকে যেমন কষ্ট দিয়েছে ততোধিক অবাক করেছে।  রশীদ করীমের পুরো নাম রশীদ করীম গোলাম মুরশেদ। আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের সবাই এবং বন্ধু-বান্ধব সকলেই তাকে ডাকতেন শুধু গোলাম মুরশেদ বলে। উত্তম পুরুষ  লেখার সময়ে সে-নামের প্রথম অংশটি নিয়ে শেষের অংশটি বাদ দিয়েছিল। শেষের অংশটি শেষ পর্যন্ত রয়েই গিয়েছিল তার পরিবার ও পরিচিত মহলে।

রশীদ করীমের সঙ্গে আমার দেখা ও পরিচয় কলকাতার পার্ক সার্কাসের ৫নং পার্ল রোডের বাড়িতে। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে স্বামী মুস্তাফা আনোয়ারের সঙ্গে আমি ওই বাড়ির একতলার ডান দিকের ফ্ল্যাটে বসবাস করতে আসি। ৫নং পার্ল রোডের বাড়িটা ছিল তিনতলা এবং প্রতি তলাতেই দুটি করে ফ্ল্যাট ছিল। বিল্ডিংয়ের মালিক ছিলেন একজন রিটায়ার্ড জজ, যাঁর নাম মনে করতে পারছি না। তাঁরই সুযোগ্য পুত্র পদ্মশ্রী হাবিবুর রহমানের (ব্যারাকপুরের গান্ধীঘাটের স্থপতি) ছাত্রাবস্থায় এই ফ্ল্যাটটির নকশা তৈরি হয়। এমন নিখুঁত ফ্ল্যাট বর্তমান যুগেও দুর্লভ।

যাই হোক, এই ভবনের তিনতলার একটি ফ্ল্যাটে বাস করতেন স্বয়ং জজ সাহেব ও তাঁর স্ত্রী এবং পাশের ফ্ল্যাটে তাঁদের বড় ছেলে। দোতলায় ডান দিকের ফ্ল্যাটে থাকতেন তাঁদের বড় মেয়ে শাহ্জাদী বেগম ও তাঁর স্বামী ডা. এ এম ও গণি, যিনি পরবর্তীকালে একজন এম এল এ হয়েছিলেন। আর নিচের তলার দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া হতো। তার একটি নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী ও আমরা ভাগাভাগি করে বাস করতাম। ডা. এ এম ও গণি ও মিসেস গণির চার ছেলেমেয়ে। বড় মেয়ে লিলি, ছোট মেয়ে ডলি এবং বড় ছেলে শহীদ ও ছোট ছেলে শামীম। এই শহীদ ছিল করীমের সহপাঠী এবং তার সঙ্গে সৌহার্দ্যের কারণেই সে গণি পরিবারের অত্যন্ত আপনজন ছিল। শহীদের সূত্র ধরে পরিবারে পরিচিতি ঘটলেও তা ক্রমে বিস্তৃত হয়েছিল শহীদের দুই বোন ও আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে। সে পরিচয় এতই নিবিড় ছিল যে, রশীদের অত্যন্ত ঘনঘন আনাগোনা ছিল ডা. গণি ও মিসেস গণির ফ্ল্যাটে। মিসেস গণির সঙ্গে আমার স্বামী আনোয়ারের আগে থেকেই পরিচয় ছিল। সেই সূত্রে আনোয়ার তাঁকে খালা বলে ডাকত। আমিও সেই ডাকেই তাঁকে সম্বোধন করতাম। তাই ওই বাড়িতে আসার প্রথম থেকেই খালার ছেলেমেয়েরা ও তাদের বয়সী অন্য সবাই আনোয়ারকে ‘আনোয়ার ভাই’, আর আমাকে ‘ভাবি’ বলে ডাকা শুরু করেছিল। মুজতবা আলী আমাদের সঙ্গে ফ্ল্যাট শেয়ার করলেও আহারাদি করতেন ওপরে খালার কাছে; তাঁর বড়ী আপার কাছে। আর আইয়ুব সাহেব (আবু সয়ীদ আইয়ুব) তখনো গৌরীকে বিয়ে করে সংসারী হননি বলে তাঁর ভাবির কাছেই খাওয়া-দাওয়া করতেন।

খালার বাড়িতে সকালের প্রাতরাশ শুরু হতো প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৮টায়, কারণ শহীদ তখন অফিসে রওনা হতো। শহীদ টেবিল থেকে উঠে যেতে না যেতেই ডা. গণি প্রাতরাশ সেরে তাঁর ডিসপেনসারিতে চলে যেতেন। তারপরে একে একে টেবিল অলংকৃত করতেন আইয়ুব, মুজতবা আলী, খালার ছোট ভাই মাহমুদুর রহমান ওরফে কচি ও রশীদ করীম। খালার বড় মেয়ে তখন কোনো এক এয়ারলাইন্সে এয়ার হোস্টেসের কাজ করতেন, কাজেই তিনি কোনোদিনই এই টেবিলে আসর জমাতেন না। আর গণি দম্পতির ছোট মেয়ে ডলি তখন বিয়ে করে পশ্চিম পাকিস্তানবাসী হয়েছে। রশীদ করীম প্রতিদিন সকালে এই টেবিলে আসতে পারত কারণ তখন সে আসন্ন বি এ পরীক্ষার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিল। ও প্রায়ই বেতারে তার স্বরচিত ছোটগল্প পড়ত। আর কখনো কখনো এরই মাঝে                    পত্র-পত্রিকায় কলামও লিখত। তাই তার হাতে সময় ছিল। সে যে আইয়ুব ও মুজতবা আলীর মতন দুর্ধর্ষ লেখকদের সঙ্গে বসে অবলীলাক্রমে সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করে তার নিজস্ব মতামত জানাতে দ্বিধা করত না তার একটি কারণ ছিল, ততদিনে সে নিজেই সাহিত্যজগতে প্রবেশাধিকার পেয়ে স্বীকৃতিও পেয়ে গেছে।

রশীদ করীম মাত্র ষোলো বছর বয়সে তার প্রথম গল্পটি লেখে এবং তা প্রকাশ হয়েছিল সওগাত পত্রিকায়। গল্পটির নাম ছিল ‘আয়েশা’। এই ‘আয়েশা’ গল্পের হাত ধরে তার সাহিত্যজগতে প্রবেশ, যা আহসান হাবীব প্রমুখ বেশ কিছু সাহিত্যিকের নজর কাড়ে। এর পরের লেখা ‘একটি মেয়ের আত্মকাহিনী’ গল্পটি বুদ্ধদেব বসু, আবু সয়ীদ আইয়ুব ও সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মতন প্রথিতযশা লেখকদের প্রশংসা অর্জন করে এবং ওই গল্প পড়েই বুদ্ধদেব বসু তাকে ডেকে পাঠান আলাপ করার জন্যে আর সঞ্জয় ভট্টাচার্য তার পূর্বাশায় গল্প লেখার আমন্ত্রণ জানান। ‘একটি মেয়ের আত্মকাহিনী’ লেখার সময়ে তার বয়স ছিল মাত্র আঠারো বছর। এরপরও আরো কিছু গল্প বের হয় রশীদ করীমের; কিন্তু আইয়ুব সেসব গল্পের প্রতি তেমন আগ্রহ প্রকাশ না করায় রশীদ করীম আর গল্প লেখায় মন দেয়নি; কিন্তু সেই ষোলো থেকে বিশ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যেই সে সাহিত্য পরিমন্ডলে নিজের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিল। তখনই সে ছোটগল্পের লেখক বলে প্রতিষ্ঠিত। এই জন্যেই বেতারের রোববারের সাহিত্যবাসরে যখন প্রবোধ স্যানাল, মোহিতলাল মজুমদার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ও অজিত দত্তের মতো লেখকরা যোগ দিতেন সেখানে প্রায়শই তার ডাক পড়ত।

এইটুকু ভূমিকা না করলে যে-সময়ে যেভাবে আমি রশীদ করীমের সঙ্গে পরিচিত হই, তা স্পষ্ট হয় না। আমার স্বামী পাইলট ছিল বলে তাকে প্রতিদিনই প্রায় ফ্লাইটে বাইরে থাকতে হতো। বাড়ি ফিরতে ফিরতে কোনোদিন সন্ধ্যা বা রাত হতো। এটুকু সময় আমি একাই থাকতাম। তাই খালা একদিন সকালে আমার খোঁজখবর নিতে এসে আমাকে একলা বসে বই পড়তে দেখে তাঁর সঙ্গে ওপরে ধরে নিয়ে গেলেন, বললেন, ‘একলা একলা বসে কী করছ? আমার ওখানে চলো। ওখানে সকলে আছে। তোমার সময় কাটবে।’ – বলে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময়ে রশীদ করীমের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলেন। তখন কোনো কথাবার্তা হয়নি। রশীদ করীম, আইয়ুব ও মুজতবা আলী যে-বিষয় নিয়ে আলাপ করছিলেন, মুগ্ধ হয়ে তাই শুনছিলাম আর মনে মনে একটু অবাকও হচ্ছিলাম ওই তরুণ ছেলেটির প্রাঞ্জল বক্তব্য ও প্রজ্ঞার পরিচয় পেয়ে। সেদিনের পর থেকে খালার আহবানে সাড়া দিয়ে আমি প্রত্যহই ৯টার সময়ে দোতলায় গিয়ে প্রাতরাশের টেবিলে বসি ও আসর ভাঙলে সাড়ে ১০টা-১১টার সময় নিচে নেমে আসি। মুজতবা সাহেব ও রশীদ করীমও প্রায় একই সময় উঠে যে যাঁর মতো চলে যান। তাই প্রায়ই সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে রশীদ করীমকে চোখে পড়ে, বিশেষ করে তার পায়জামা পরার ঢঙের ওপর, আর হাসি পায়। রশীদ করীমরা পরিবারসুদ্ধ তালতলার পিরসাহেবের মুরিদ। তাই গোড়ালির ওপর পায়জামা পরাই তাদের রেওয়াজ। আমি যে তাকে দেখে মুচকি হাসি, তা রশীদ করীমের বোধহয় নজরে পড়েছিল। একদিন দোতলা থেকে নেমে এসে আমার ফ্ল্যাটের দরজায় যখন বেল টিপেছি, তখন সে হঠাৎ বলল, ‘শুনুন, আপনি আমাকে দেখে অমন হাসেন কেন?’ আমি হাসি গোপন করে বললাম, ‘এমনিই’। সে বলল, ‘এমনি নয়, আপনাকে বলতেই হবে আপনি আমাকে দেখলেই হাসেন কেন?’ তখন আমি প্রাণ খুলে হেসে বললাম, ‘আপনার পায়ের দিকে তাকিয়ে।’ তারপরে সে কিছু না বলেই বলল, ‘শুনুন, সবাই আপনাকে ‘ভাবি’ বলে, কিন্তু আমি আপনাকে ‘দিদি’ বলে ডাকব।’ সেই আমার ‘দিদি’ ডাকের অভিষেক হলো এবং সেই ডাক প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল তিনটি পরিবারের মধ্যে – আমার বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়িতে এবং রশীদ করীমের পরিবারের মধ্যে। তাছাড়া রশীদ করীম যার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিত, সকলেই আমাকে ওই একই সম্বোধন করত। রশীদ করীমের বাবা-মা এবং বড় ভাই ও ভাবিরা সকলেই ‘দিদি’ বলে ডাকতেন আমাকে। আমার দুই বোনও ভাইফোঁটার দিন রশীদ করীমকে ফোঁটা দিত ও ডাকত মুরশেদ ভাই বলে। রশীদ করীম তখন থেকেই আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করত আর প্রথম পরিচয়েই ‘দিদি’ হয়ে ওঠার সৌভাগ্যের জন্যে আমি তাকে ‘তুমি’ বলেই সম্বোধন করে গেছি এ শেষের দিন অবধি।

যে রশীদ করীম চলে গেল আর আমার সেই চৌষট্টি বছর আগেকার রশীদ করীমের চেহারার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য ছিল। বয়স তার চিহ্ন এঁকে যায় সকলের ওপরেই; কিন্তু রশীদ করীমের বার্ধক্যের চেহারায় বয়স যেন একটু বেশিই অবিচার করেছিল। আমার সঙ্গে যখন তার প্রথম আলাপ হলো তখন সে গৌরবর্ণ, সুঠাম সুদর্শন এক উদীয়মান তরুণ, দৃষ্টিতে গভীরতা ও সততা সমানভাবে সমান্তরাল। মাথার চুল ছিল ঈষৎ ঢেউ খেলানো ঘন কালো। এক কথায় নির্দ্বিধায় সে সুপুরুষ ছিল। এইটুকু লিখেই খুব মন খারাপ লাগছে। এত বছরের মধ্যে কোনোদিনই তার চেহারা নিয়ে কিছু বলিনি। কিন্তু আমি জানি সে নিজের সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন ছিল এবং নিজের প্রশংসা শুনতে খুবই পছন্দ করত; কিন্তু কখনো তা প্রকাশ পেত না।

আমার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হওয়ার পর ১৯৪৮ সালের ১৮ মার্চ আমার ছেলে প্রদীপের জন্ম হলে আমার মেজ ননদ হাস্না এলো আমাদের সঙ্গে থাকতে। তখন সে তার হবু স্বামী প্রখ্যাত ব্যবসায়ী লুৎফর রহমানের বাগদত্তা। সেইসঙ্গে আমার দেবর মুস্তাফা মনোয়ার ওরফে মন্টুও তার স্কুলের সব ছুটিছাটায় আমাদের কাছে থাকত এবং বড় ননদ জ্যোৎস্নাদিও (মিসেস ফিরোজা মজিদ) তাঁর দুটি শিশুকন্যা ফরিদা ও মঞ্জুকে নিয়ে আমার কাছে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে যেতেন। এরা সবাই আসার পরে আমার শূন্য বাড়ি ভরে উঠল আর খালার প্রাতরাশের টেবিলের মতন আমার খাওয়ার টেবিল ও ড্রইংরুম নানান ধরনের গল্প-গুজব ও গানে ভরপুর হয়ে থাকত। রশীদ করীম এইসব আড্ডা ও আসরের নিত্যসঙ্গী ছিল। ওই সময়েই সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর দেশে বিদেশে লিখতে শুরু করেন ও আমার ড্রইংরুমে এসে আমার বাবুর্চিকে ভালো করে চা করার নির্দেশ দিয়ে আমাকে তাঁর লেখা পড়ে শোনাতে বলতেন। আমার পড়াশেষে বলতেন, ‘তুমি বেশ পড়ো কিন্তু তোমার মায়ের উচ্চারণ তোমার চাইতেও সুন্দর।’ আমি অভিমান করে বলতাম, ‘তাহলে মাকেই পড়তে বলবেন।’

এইসব আড্ডায় রশীদ করীমের সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত ও সাহিত্যের বিচার নিয়ে খুবই তর্কাতর্কি হতো। রবীন্দ্রসংগীত ছিল রশীদ করীমের প্রাণ – মুজতবা সাহেবেরও তার ব্যতিক্রম ছিল না। তবু কার কণ্ঠে কোন গান কীভাবে সার্থক হয়েছে এসব নিয়ে প্রবল তর্ক হতো। দোতলার প্রাতরাশের টেবিলেও সংগীত, সাহিত্য ও সাম্প্রতিক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হতো; কিন্তু সেসব আলোচনায় রাজনীতি কমই প্রাধান্য পেত। কারণ গৃহস্বামী ডা. গণি ছিলেন বামপন্থী, পরবর্তীকালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির টিকিটে এম এল এও হয়েছিলেন; আইয়ুব ও মুজতবা ছিলেন সম্পূর্ণ বঙ্গভাগের বিরোধী, কট্টর ন্যাশনালিস্ট; আর রশীদ করীমের আস্থা ছিল পাকিস্তানের প্রতি; কিন্তু যে পাকিস্তান সে পেয়েছিল, সেই পাকিস্তান সে কামনা করেনি। সে চেয়েছিল এক অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ পাকিস্তান, যেখানে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকলে নির্বিঘ্নে যার যার ধর্মাচরণ করে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।

আমাদের ওই ফ্ল্যাটে যাওয়ার পরে রশীদ করীমের বি এ ফাইনাল পরীক্ষার দিন এসে গেল। প্রথম পরীক্ষার দিন হলে যাওয়ার পথে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে আমার শেফার্স কলমটা নিয়ে গেল। এই পরীক্ষায় সে ডিস্টিংশন পেয়েছিল। সেজন্যে সে-কলম আমি আর ফেরত নিইনি। পরীক্ষার পরে নিয়মিত কিছু একটা করার জন্যে জাহাঙ্গীর কবীরের আহবানে সাড়া দিয়ে সে ইত্তেহাদ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেয়; পরে সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করত। তখন ওর অনুরোধে আমাকেও কিছুদিনের জন্যে সম্পৃক্ত হতে হয়েছিল ওই পত্রিকার ‘মহিলা’ পৃষ্ঠার সম্পাদিকা হিসেবে। কয়েকটি কলামও লিখেছিলাম। পরে পত্রিকাটি উঠেই গেল। সে-সময়ে মূলত বেতারের রবিবাসরীয় সাহিত্যালোচনায় যোগ দেওয়া ও বেতারে ছোটগল্প পড়ার বাবদে প্রতিবারের সেই ১৫টি টাকাই ছিল ওর অন্যতম উপার্জন। যেদিন এ-টাকা ওর হাতে আসত আমরা টের পেতাম। একগাল হাসি নিয়ে এক হাতে শিককাবাব-পরোটা ও অপর হাতের ঠোঙায় হয় Pears না হয় Yardley-র ল্যাভেন্ডার সাবান ও এক প্যাকেট দামি সিগারেট নিয়ে ও এসে ঢুকত, ঢুকেই খাবার টেবিলের ওপর কাবাবের ঠোঙা নিয়ে ডাক দিত, মন্টু, চলে এসো। আমার হাতে দিত সাবানটি আর সিগারেট ঢোকাত ওর পকেটে। এভাবে একদিনেই ফুরিয়ে দিত উপার্জনের টাকাটা। এই খরচ করার স্বভাবটা ছিল জীবনের শেষ অবধি। কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েছিল Caltex-এর Sales Representative হয়ে। রিটায়ার করার আগে যুগপৎ পদ্মা ও মেঘনার এমডির পদে ছিল; কিন্তু রিটায়ার করার প্রাক্কালে আবিষ্কার করেছিল,  গুলশান-১-এর লেকের পাড়ে ২৯ নম্বর রোডের ১০ কাঠা জমির ওপরে যে দোতলা বাড়িটি আছে, সেটুকু আর কিছু টাকা ছাড়া অন্য কোনো সঞ্চয় নেই। তাই হঠাৎ মনস্থ করেছিল ওই বাড়িটি বিক্রি করে অর্থ সঞ্চয় করতে হবে।

এ-ব্যাপারে ও একবার ওর স্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা না করে অফিসেই অন্য কর্মচারীদের সামনে নিজের ইচ্ছাটা প্রকাশ করেছিল। সেখানেই এক চতুর কর্মচারী ছিল যে রশীদ করীমের ন্যায়নিষ্ঠা ও নীতিবোধের সঙ্গে ভালোভাবেই পরিচিত ছিল, সে বলে উঠল, ‘রশীদভাই বাড়িটা তাহলে আমাকেই দিয়ে দিন, আমি ১০ লাখ টাকা দাম দেব।’ আর স্ত্রীর সঙ্গে কোনো আলাপ না করেই রশীদ করীম এক কথায় সেই স্বল্পমূল্যে বাড়িটি বিক্রির কথা দিয়ে দিলো। বাড়ি এসে যখন সে-কথা তার স্ত্রীর কাছে প্রকাশ করেছিল সে অবাক হয়ে বলেছিল তার কোনো একজন পরিচিত নাকি তাকে নিজের থেকেই ১৫ লাখ টাকা দিতে চেয়েছিল ওই বাড়ির জন্যে। সেটা ছিল ১৯৮৪ সাল। আফগান এমব্যাসির Charge de’ affairs ভাড়া থাকতেন মাসিক ১৬ হাজার টাকায়। রশীদ করীমের স্ত্রী ফুল এই বিক্রির ব্যাপারে মন খারাপ করলে তাকে ধমক দিয়ে রশীদ করীম বলেছিল, ‘আমি অমুককে কথা দিয়ে দিয়েছি এখন আর আমি তা ফিরিয়ে নিতে পারবো না।’ এই ছিল রশীদ করীম। কোনোদিন কোনো কারণেই তার সততা থেকে এক পাও সরে আসেনি।

তার আভিজাত্য, তার বৈদগ্ধ ও শৈল্পিক সত্তার সঙ্গে কোনো কারণেই কোনো সময়ে আপস করেনি।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরে অন্য অনেক মুসলমান পরিবারের মতো রশীদ করীমের পরিবারের সবাই পাকিস্তানে চলে যান, শুধু রশীদ করীমই রয়ে গিয়েছিল পারিবারিক কারণে। ১৯৪৮ সালে বি এ পরীক্ষার পরে সে বেশ ভালোভাবেই সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ফলে তার অবসর সময়ের খুব একটা খামতি পড়েনি। ছাত্রাবস্থার মতোই সে নিয়মিত খালার প্রাতরাশের টেবিলে ও আমার বাসায় যাওয়া-আসা করত এবং আমার দেবর-ননদদের আহবানে সাড়া দিয়ে দুপুর বেলাটাতে আমাদের সবার সঙ্গে খেত। আমার রান্না ওর খুব পছন্দ ছিল। দুর্ভাগ্য আমার, সেই ’৯২ সালে স্ট্রোক করার পরে অনেক অনুনয়-বিনয় করে কেবল একটিবারই ওকে বাড়িতে এনে খাওয়াতে পেরেছিলাম। তাও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারবে না বলে একতলাতেই মুস্তাফা মনোয়ারের (মন্টু) ফ্ল্যাটেই বসার ও খাবারের আয়োজন করেছিলাম। আজো মনে আছে, ও কী খুশি হয়েই খেয়েছিল সেদিন! সব রান্নার মধ্যে সবচাইতে পছন্দ করেছিল নারকেল-দুধ দিয়ে রান্না করা ছোলার ডাল। পরে অনেকবার সে-ডালের কথা উল্লেখ করেছে। পরে আর কিছুতেই বের হতে রাজি হতো না বলে যখনই পেরেছি মাঝে মাঝে ওর জন্যে কিছু না কিছু রান্না করে নিয়ে গেছি। আর ও প্রতিবারই বলেছে, শামসুর রাহমানকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। এই ছিল ওর স্বভাব। সকলে মিলে খাওয়া, সৎ-সাহিত্য আলোচনা এবং অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে বন্ধু-বান্ধব সমভিব্যাহারে দামি মদ্যপান। ওর বাড়ির এসব আড্ডায় একসময়ে যাঁরা সঙ্গ দিতেন, ও অসুস্থ হয়ে পড়ার পরে তাঁদের খুব কম জনই ওর খবর নিয়েছেন। এতে ও বেশ ব্যথিত হতো। মুখে কিছু না বললেও ওর কষ্ট আমি বুঝতাম। অসম্ভব আত্মাভিমানের জন্যে স্ট্রোক হওয়ার পরে কিছুতেই ফিজিওথেরাপি করালো না, এমনকি চোখের চিকিৎসাটাও করালো না। না করে নিজের অনমনীয় জেদ নিয়ে সেই ’৯২ সাল থেকে আমৃত্যু একইভাবে জীবন কাটিয়ে দিলো। এর মধ্যে কত প্রকাশক, কত সম্পাদক এবং আমরা ওকে বারবার মিনতি করেছি ডিক্টেশন দিয়ে, না হয় রেকর্ড করে, লেখার জন্যে। কিন্তু কিছুতেই রাজি করাতে পারিনি। অথচ স্ট্রোকে শরীর অসুস্থ হলেও মননে, চিন্তায় শেষের দিনটি পর্যন্ত ও খুবই সজাগ ছিল। যখনই ওর কাছে গেছি তখনই সাহিত্যের যে-কোনো বিষয়েই কী সহজভাবেই না বলে যেত। ওর সঙ্গে সাহিত্য আলোচনা করতাম না আমি, বসে থাকতাম উন্মুখ শ্রোতা হয়ে। সেই ১৯৪৭ সালে যেদিন আমায় ‘দিদি’ বলে ডেকেছিল সেদিন থেকেই ইংরেজি, বাংলা কত যে বই আমাকে পড়িয়েছে তার ঠিক সেই। সেই মানুষ, সাহিত্যই যার প্রাণ ছিল, সে যে কী করে এমন নীরব হয়ে থাকতে পারল সে-সম্বন্ধে ভাবতে গিয়ে বারবার একটি কথাই মনে হয় আমার – এ বোধহয় ছিল খোদার ওপর তার অভিমান। রশীদ করীম প্রথাগতভাবে ধর্মাচরণ না করলেও অসম্ভব ধার্মিক ছিল। তাই মনে হয় এর কারণ ছিল আল্লাহর ওপর তার অভিমান। তার ডান হাতটিই তিনি অবশ করে দেওয়ায় তার তীব্র অভিমান হয়েছিল। তাই সে ডিক্টেশন দিয়ে অথবা টেপ করে কিছুই লিখতে চায়নি। অথচ প্রায়ই বলত ‘দুটো উপন্যাসের উপাদান’ তার মনে ছিল। যে রবীন্দ্রসংগীত তার এত প্রিয় ছিল সে-গানও শুনতে চাইত না। খালি স্ত্রী ফুলের পীড়াপীড়িতে শেষের দিকে তারা মিউজিক ও দেশি চ্যানেলে রবীন্দ্রসংগীত একটু শুনত।

কবি শামসুর রাহমানের মৃত্যুতে ও খুবই শোকাহত হয়েছিল। বলতে গেলে তারপর থেকেই আরো নিঃসঙ্গ বোধ করত। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরে ১৯৮০ পর্যন্ত আমি দেশের বাইরে ছিলাম। দেশে ফিরে ২/সি সেন্ট্রাল রোডে আমার বাড়িতে বসবাস শুরু করলে তখন খুব ঘন ঘন যেতাম ওর কাছে। তখন ও বলেছিল, ‘শামসুর রাহমানের কাছে তো গাড়ি নেই, আপনি যখনই আসবেন তখন ওকে সঙ্গে করে আনবেন।’ সেসব  দিনে ও যেন অন্য মানুষ হয়ে যেত। ভারি খুশি হয়ে আমাদের না খেয়ে আসতে দিত না। পরে ২০০০ সালে আমি যখন সেন্ট্রাল রোডে বসবাস ছেড়ে গুলশান চলে আসি, তখন থেকে পথের দূরত্ব ও যানজটের কারণে খুব কমই যেতে পেরেছি। তবে ফোনে প্রায় রোজই আলাপ হতো। কোনো পত্র-পত্রিকায় বা ম্যাগাজিনে ওর সম্পর্কে কোনো লেখা বের হলে তক্ষুনি আমাকে ফোন করে জানাত ও, ওর কাছে গিয়ে সেসব লেখা পড়ে শোনাতে বলত। সব সময়ে তক্ষুনি যেতে না পারলে কত লেখা ফোনেও পড়ে শুনিয়েছি। অনেক সময়ই আমাকে প্রশ্ন করত, ‘লোকেরা আমার লেখা সম্পর্কে কী বলে?’ আমি সব সময়েই ঠিক উত্তর দিতাম, বলতাম ‘গোলাম মুরশেদ, তোমার লেখা আমজনতার জন্যে নয়, তোমার লেখার মর্মে পৌঁছতে হলে যতটুকু শিক্ষার দরকার দুঃখবশত তা খুব কম লোকেরই আছে; তাই তোমার উপন্যাস ও প্রবন্ধের পাঠক বেশ সীমিত।’ বলা বাহুল্য, আমার এ-উক্তি ওর পছন্দ হতো না; কিন্তু মনে মনে ঠিকই বুঝত।

লিখতে লিখতে কতদূর চলে এসেছি। ওর প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ সম্বন্ধে বলা হয়নি। ১৯৪৯ সালে কোন মাসে যেন একদিন Statesman-এ Caltex-এর একটি বিজ্ঞাপনে Sales Representative-এর একটি চাকরির বিজ্ঞাপন দেখিয়ে বলল, ‘এই চাকরিটায় দরখাস্ত করব।’ যথা ইচ্ছা, তথা কাজ। দরখাস্ত পাঠাবার দু-চারদিনের মধ্যেই ইন্টারভিউর চিঠি এসে গেল। তার আগের দিন আমি বললাম, ‘গোলাম মুরশেদ, তুমি যেন পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ইন্টারভিউ দিতে যেও না।’ কারণ ও সবসময়ই পাজামা-পাঞ্জাবি পরত। তখনকার দিনে ওকে শার্ট-প্যান্ট পরা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ও জবাব দিয়েছিল, ‘ধুত ব্যাটারা চাকরি দিতে হলে দেবে, আমি তার জন্য শার্ট-প্যান্ট পরে যাব না।’ ওমা পরের দিন ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার আগে যখন এলো দেখি সত্যিই পাজামা-পাঞ্জাবি পরে এসেছে। তখন আর বদলের সময় ছিল না। তাই ‘Goodluck’ বলেই ওকে বিদায় দিলাম। মনটা একটু বিষণ্ণ হয়ে গেল, কারণ আমেরিকান কোম্পানি। তারপরে দুপুরে একগাল হাসি নিয়ে ফিরল। ইন্টারভিউ সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে বলল, ‘ঘরে যখন প্রথম ঢুকলাম, তখন সাহেব আমার দিকে চোখ মেলে তাকাতেই আমি বললাম ‘If you give me the job, I promise, I’ll be better dressed then you. Can I take my seat?’ সাহেব তখন উত্তর দিলেন, ‘Oh yes, of course, take your seat.।’ ব্যস হলো রশীদ করীম ও তার জীবনের একমাত্র ইন্টারভিউ ও তাতেই কিস্তিমাত। ও Caltex-এর চাকরি নেওয়ার পরে মাঝে মাঝেই ওকে কলকাতার বাইরে যেতে হতো। তখনো দেশ থেকে বিগত দাঙ্গার রেশ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, তাই ও আমার পিতৃপরিচয়ে আমার বড়ভাই দীপক রায়ের পরিচয়ে ট্রেনে যাতায়াত করত। ওদের পরিবারের সবাই ঢাকায় চলে গেলে ও একই সময়ে মুজতবা সাহেব তাঁর ঘর খালি করে ঢাকায় গেলে রশীদ করীম ঢাকায় স্থায়ীভাবে যাওয়ার আগে ওই ঘরেই থাকত। তখন প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে তার প্রাণের অধিক প্রিয় কলকাতা শহর ছেড়ে চিরকালের মতো ঢাকা চলে যেতে হবে – এ-চিন্তায় খুবই মন খারাপ করত। শেষে ১৯৫০ সালের ১৫ মার্চ ঢাকায় যাওয়া স্থির হলে তার আগের রাতে অর্থাৎ ১৪ মার্চ সারারাত শুধু কেঁদেছিল কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার দুঃখে।

তখনো পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কলকাতার ফোন লাইন সেভাবে চালু হয়নি বলে আমরা খবরাখবরের জন্যে চিঠিরই আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেই সময়ে লেখা রশীদ করীমের চিঠিগুলো ছোটগল্প হিসেবে বাংলা সাহিত্যের এক অপূর্ব সম্পদ হতে পারত; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার দু-একটি ছাড়া আমার কাছে আর একটিও নেই। ১৯৬৪ সালে আমার কলোরাডো যাওয়া ও ওর নিজের করাচিতে বদলি হওয়ার সময় একদিন এসে ও সবগুলো চিঠি চেয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেই চিঠিগুলোতে ওর অকপট মনের সব কথা লেখা থাকত বলে ও হয়তো চায়নি তার কোনো স্মৃতি রাখতে। আজ ভাবি, কেনইবা দিয়েছিলাম সেদিন। কিন্তু ওই যে ওকে কোনো ব্যাপারেই ‘না’ বলার উপায় ছিল না। কারণ ও সে-নিষেধ কোনোমতেই  মানত না।

চাকরি পাওয়ার পর থেকেই বিয়ের কথা হচ্ছিল। শেষে ১৯৫৬ সালের ২০ জুলাই মরহুম সিরাজদ্দীন আহমদ সাহেবের মেয়ে সেলিনা আহমদ ওরফে ফুলের সঙ্গে বিয়ে হলো। এই বিয়ের সম্বন্ধ করেছিলেন তাহেরা কবীর। তাহেরা কবীরের ছোট বোন ফুলের বড় ভাবি, সে-সুবাদেই সম্বন্ধ। বিয়ের তারিখ ঠিক হলেই রশীদ করীম ফুলের ছবির সঙ্গে বিয়ের নিমন্ত্রণ পাঠাল আনোয়ারের কাছে। ছবি দেখে তো আমরা খুব খুশি। সবাইকে বললাম, খুবই সুন্দরী বউ হচ্ছে গোলাম মুরশেদের। বিয়ের আসরে বউ দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। ছবিতে যতটা সুন্দর দেখেছিলাম, ফুল তার চাইতেও সুন্দরী। আমার মেয়ে বাবলি তখন মাত্র এক বছর কয়েক মাসের। তারপর ছেলে প্রদীপেরও স্কুল ছিল। তাই আমি মাত্র চার দিনের জন্যে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিয়েতে যোগ দিতে এসেছিলাম। কাজের জন্যে আনোয়ার আসতে পারেনি। রশীদ করীম তখন বিয়ের জন্যে তার চাচাতো ভাই ইনতু ভাইয়ের বাসায় ছিল। বউ ওই বাসাতেই তোলা হয়েছিল। আমার ননদ জ্যোৎস্নাদির বান্ধবী ওই বাসারই খুব কাছে ছিল। বৌভাতের পরের দিন খাওয়া-দাওয়ার পরে আমরা সবাই বসে গল্প করছি এমন সময়ে দেখি পেছনের দরজা দিয়ে নতুন বউকে সঙ্গে করে গোলাম মুরশেদ এসে হাজির। আমরা তো সবাই অবাক। এভাবে কেউ নতুন বউকে আনে। খাওয়া-দাওয়ার পরে ওদের ঘরে বিশ্রাম করতে পাঠিয়েছে, সেই অবসরে ফুলকে কাপড় পর্যন্ত বদলানোর সুযোগ না দিয়ে আমার সঙ্গে গল্প করার জন্যে নিয়ে এসেছে। এমনি ছিল আমাদের সম্পর্ক।

এই চৌষট্টি বছরের মধ্যে সব সময়েই যে আমরা কাছাকাছি থেকেছি, তা নয়; কিন্তু মনের সংযোগ কখনো বিন্দুমাত্র ছিন্ন হয়নি। আজ সকাল থেকে যখন লিখতে বসেছি তার মধ্যে কতবার যে ওর ফোন আসত। বেশি কিছু বলত না ইদানীং। ফোন ধরেই বলত, ‘কেমন আছেন, কী করছেন, কী খাবেন, খোকন কেমন আছে? – এই নিন ফুলের সঙ্গে কথা বলুন।’ লিখছি আর ভাবছি আর কোনোদিন তো এমনভাবে আর দিদি বলে ডাকবে না – ফুলও আমেরিকায় চলে যাবে মেয়ে নাবিলার কাছে – শুধু আমিই একা পড়ে থাকব চৌষট্টি বছরের একরাশ টুকরো স্মৃতি নিয়ে।