আমি আসছি ব্রহ্মময়ী

যন্ত্রণাকাতর স্ত্রীর পাশে শুয়ে গিরিশচন্দ্রও সারারাত ঘুমাতে পারেননি। রাত ত্রিপ্রহর থেকে অস্থির অপেক্ষায় ছিলেন কখন সূর্যের আভাস দেখা যায়। বাইরে কোনোরকমে আলো ফুটে উঠলে তিনি ধুতির ওপর পাতলা নীল ফতুয়া চাপিয়ে পথে বেরিয়ে পড়লেন, বিলম্ব করার কোনো মানে নেই। দু-তিন মিনিট হাঁটতে হাঁটতে দিবালোক আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গ্রীষ্মের আলোকোজ্জ্বল প্রভাতে চারিদিকে শালিক, চড়ুই, শ্যামা, ফিঙের কলকাকলি। কোনো কোনো গাছে বোধহয় কাঁঠাল পেকে আছে, সুবাস ছড়াচ্ছে। আমগাছগুলোর তলায় দু-একটি করে রংধরা পাকা আমও তাকিয়ে আছে। আর খানিক পরেই গ্রামগুলোর ঘুম পুরোপুরি ভাঙবে, দুরন্ত শিশু-কিশোররা এসব আম পেয়ে খুশিতে নেচে উঠবে। টুপি মাথায় দেওয়া দু-তিনজন মুসলিস্ন ফজরের নামাজ শেষে দরুদ শরিফ পড়তে পড়তে মসজিদ থেকে ঘরের পথে। আধ মাইলটাক পথ পেরিয়ে গোপীকৃষ্ণ সেন মশাইয়ের বাড়িতে পৌঁছতে গিরিশের দশ-বারো মিনিটের বেশি সময় লাগল না। গোপীকৃষ্ণের স্ত্রী বাড়ির বাইরে পূজার উদ্দেশে বেতের ঝাঁপিতে বড় একটা গাছ থেকে টকটকে লাল জবা ফুল সংগ্রহ করছিলেন। তার কাছাকাছি গিয়ে গিরিশ সেন বললেন, ‘বউদি নমস্কার, গোপীদা বাড়িতেই তো? এই ভোরবেলা একটা বিপদে পইড়াই বিরক্ত করতে আইলাম।’

তিনি বোধহয় পায়ের আওয়াজ পাননি। তাই ভোরবেলা গিরিশের কণ্ঠ শুনে সামান্য চমকে উঠে ঘুরে তাকিয়ে মাথার কাপড় টেনে হাত উঠিয়ে নমস্কারের ভঙ্গি করে বলেন, ‘ও – গিরিশদা! কী যে কন, এইটুক না হইলে বন্ধু কীসের? ওই তো তিনি ওই ঘরে এহনও ঘুমাইয়া, আপনিই গিয়া ডাক দেন।’

গিরিশ টিনের ছাদ, টিনের বেড়ার ঘরে ঢুকে দেখলেন দক্ষক্ষণের জানালার কাছে সাদা কাপড়ের ওপর সবুজ-কমলা ফুলতোলা কভারের একটা বালিশে মাথা রেখে অন্য একটা ছোট বালিশ বুকের কাছে চেপে ধরে গোপীকৃষ্ণ তখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। গিরিশ তার গায়ে হাত দিয়ে ডাক দেন, ‘ও দাদা, উঠবেন? আমার একটু জরুরি দরকার।’

গোপীকৃষ্ণ ঘুমমাখা লালচে চোখ মেলে তাকে দেখে অবাক হন, সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসেন। ‘কী হইছে গিরিশদা? কোনো খারাপ কিছু?’

‘হুম, আশঙ্কা করতেছি, আপনার বউদির পঙ হইছে। খুব খারাপ অবস্থা। আমি এইখানে একলা মানুষ রোগীরে লইয়া কিছুতেই পাইরা উঠতেছি না। আমি তারে আজকাই দ্যাশে ফিরাইয়া নিয়া যামু, একতিল বিলম্ব করার সময় নাই। পাকা মাঝি দেইখা আপনি একটা নৌকা ভাড়ার ব্যবস্থা কইরা দেন।’

গোপীকৃষ্ণ পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে এক ঝটকায় উঠে বসেন, কুয়োতলায় গিয়ে মাটির কলস থেকে ঘটিতে জল ঢেলে চোখেমুখে জল দিয়ে দ্রম্নত গিরিশকে নিয়ে গোবিন্দচন্দ্রের বাড়িতে রওনা হন। গোবিন্দচন্দ্র গিরিশের শিক্ষক ছিলেন, তিনি বৃত্তান্ত শুনে বললেন, ‘ঘাবড়ানোর কিছু নাই, তুমি ঘরে যাওগা আমি আসতেছি।’ গিরিশ ঘরে ফেরার খানিক বাদে গোবিন্দচন্দ্র স্বয়ং হন্তদন্ত হয়ে দুজন চিকিৎসক নিয়ে হাজির হলেন। অ্যালোপ্যাথি আর কবিরাজি বিদ্যায় অভিজ্ঞ চিকিৎসক দুজন দেখেশুনে রোগীর বসন্তরোগ হয়েছে বলে নিশ্চিত করলেন। দুজনের মধ্যে আলোচনা করে আবশ্যক ওষুধপথ্যের পরামর্শ দিলেন। গিরিশ দ্রম্নত কাপড়চোপড়, ওষুধপথ্য, পথের খাদ্যখাবার, বাসনপত্র ইত্যাদি গুছিয়ে নিলেন। চার দিন চার রাতের পথ, সময়টা কম নয়, আর দুর্যোগের কাল এমনিতেই দীর্ঘ বোধ হয়, সে-কথা কার অজানা। পথে কী হয় ভগবানই মালুম। গোবিন্দবাবু গিরিশের হাতের অবস্থা জানতেন, তিনি কিছু টাকা ধার করে তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘ব্রহ্মপুত্রের ঘাটে দুই দাঁড়ের নাও বাঁধা আছে, বউমারে লইয়া অক্ষণই রওনা হইয়া যাও। তুমাগো লাইগা আমার আশীর্বাদ রইল।’

ততক্ষণে গিরিশের এক বন্ধু বেহারাসহ পালকি পাঠিয়ে দিয়েছেন। কয়েক বছরের মধ্যেই ময়মনসিংহে গিরিশের অনেক বন্ধু আর শুভাকাঙক্ষী তৈরি হয়েছে। গত দু-তিন বছরে তাঁর জীবনবোধেও কম উথালপাথাল ঘটেনি। তিনি চৌদ্দো বছর বয়সে মূলপাড়ার কুলগুরু বিশ্বনাথ পঞ্চানন মশাইয়ের কাছে শিবমন্ত্র গ্রহণ করেন। এরপর প্রতিদিন স্নানশেষে বিশেষ নিষ্ঠার সঙ্গে পুষ্পচন্দন দিয়ে পূজা করতেন। তা দেখে গিরিশের জেঠাতো দাদা দেবীপ্রসাদ রায় বলেছিলেন, ‘এর যেরকম হিন্দুধর্মে নিষ্ঠা, বাস্তবিক এ আমাগো কুলের গৌরব রক্ষা করতে পারব।’ অথচ শিবপূজায় এই ভক্তি তাঁর বেশিদিন থাকেনি। নিয়মবাঁধা পূজা ত্যাগ করে তিনি কেবল ত্রিসন্ধ্যা সংক্ষক্ষপ্ত আহ্নিক করতে থাকেন। আর ময়মনসিংহে ছোড়দার কাছে যাওয়ার পরে স্নানশেষে মূলমন্ত্র ‘নমঃ শিবায়’ জপ করতে থাকেন। গিরিশের পরিবারের রীতি হলো, শিবমন্ত্র গ্রহণের কিছুকাল পরে শক্তিমন্ত্রে ধাতস্থ হওয়া। অথচ তাঁর গতি হলো উলটো ধারায়। তিনি মূলমন্ত্র জপ করাও বাদ দিলেন, হিন্দুধর্মের পূজা-অর্চনায় আস্থা হারিয়ে কেবল এক ঈশ্বরের অস্তিত্বেই তাঁর বিশ্বাস রইল। তবে ময়মনসিংহে অবস্থানের প্রথম দিকে ব্রাহ্মধর্ম সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত বিরূপ ছিলেন। তাঁর ভগ্নিপতি কালীনাথ গুপ্ত ময়মনসিংহের ব্রাহ্মসভার সদস্য হয়েছেন শুনে তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হন, ব্রাহ্মসমাজ-সংশিস্নষ্ট হওয়ায় এমনকি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতিও গিরিশের অশ্রদ্ধা জন্মে। ময়মনসিংহে ব্রাহ্মসমাজের বেশিরভাগ সভ্য চরিত্রহীন ছিলেন বলে শোনা যায়। এদের অনেকেই পানাসক্ত ছিলেন। একদিন কলকাতা থেকে আসা এক বৃদ্ধ ওখানকার সভায় আম্রফলে ঈশ্বরের মহিমা বিষয়ে বক্তৃতা দিতে দিতে দু-চার কথা বলেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান। লোকটি আসলে মাতাল অবস্থায় সভায় এসেছিলেন। ১৭৮৭ শতাব্দের অঘ্রান মাসে ময়মনসিংহ শহরে একটা কৃষি-প্রদর্শনী মেলা বসে। সে-সময় সেখানে কেশবচন্দ্র সেন সাধু অঘোরনাথকে সঙ্গে করে হাজির হন। জাত যাওয়ার ভয়ে ওই শহরের কেউ ওই দুজনকে তাদের নিজের বাড়িতে জায়গা দেননি। তাই সমাজগৃহের পাশে তাঁবু গেড়ে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। যাই হোক, কেশবচন্দ্র, অঘোরনাথ প্রমুখের সান্নিধ্যে ব্রাহ্মসমাজ সম্পর্কে গিরিশের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়। একসময় ব্রাহ্মরাই ময়মনসিংহে তাঁর প্রধান হিতাকাঙক্ষীতে পরিণত হন।

স্ত্রীর এই মুমূর্ষু অবস্থায় ময়মনসিংহবাসীর সহানুভূতি ও তৎপরতায় গিরিশের মন কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হয়। রোগীকে কিছু পথ্য করিয়ে বেলা দশটার দিকে তাকে গিরিশ পালকিতে উঠিয়ে দিয়ে নিজে পিছু পিছু হাঁটতে থাকলেন। মিনিট পনেরোর পথ পেরিয়ে ব্রহ্মপুত্রের ঘাটে ভেড়ানো নৌকায় ওঠা হলো। তাঁরা দুজন ছাড়া নৌকাযাত্রার সঙ্গী হলো হিন্দিভাষী ভৃত্য গোপাল। বর্ষাকাল হলে ভরা গাঙে স্রোতের টানে নৌকা বেশ দ্রম্নতই এগোয়। কিন্তু এখন কেবল জ্যৈষ্ঠের প্রথম ভাগ, ব্রহ্মপুত্র নদে স্রোত প্রখর হয়নি। গিরিশ জানেন, এ-রোগীকে নিয়ে পথে বিলম্ব করবার কোনো সুযোগ নেই। তিনি মাঝি ও দাঁড়িদের বললেন, ‘সারা দিনরাত একটানা দ্রম্নত নৌকা চালাইয়া যাও। যদি কাইল দুপুরের মইদ্যে ঘোড়াশাল ঘাটে পৌঁছাইতে পার তাইলে সবাইকে একটা করে টাকা বকশিশ দিব।’

অনুকূল আবহাওয়ায় নাবিকেরা যথাশক্তি নৌকা চালাতে লাগল। রাত নয়টা বাজতে বাজতে নৌকা ব্রহ্মপুত্র নদ পেরিয়ে বানার নদের সঙ্গমস্থলে ঘোড়াশালের অর্ধেক পথে টোক নামক গ্রামে পৌঁছল। ততক্ষণে আকাশে ঘন কালো মেঘ, বাতাসে নদীর জল উথালপাথাল করছে। বিদ্যুৎ চমক আর বজ্রপাতের সঙ্গে প্রচ- বৃষ্টি শুরু হলো। ছইয়ের ভেতর সামান্য বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছিল। তখন ব্রহ্মময়ী গিরিশকে দু-বাহুতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমার ভয় করতেছে।’

গিরিশ বললেন, ‘ভয় নাই। এ-সময় বৃষ্টি বেশিক্ষণ হয় না। আমরা আর তিনদিনের মইদ্যে বাড়ি পৌঁছাইয়া যামু।’

‘আমার জন্য তোমার এতো কষ্ট, এতো টাকা-পয়সা ব্যয়। আমি তো মরবই, যাওয়ার সময় তোমারেও মাইরা যাইতাছি।’

‘তোমার এমনে কথা বলাডা বড় অন্যায়। আমার অর্থসম্পত্তি আর এই আমার জীবনের সার্থকতা আর কী? একটা কন্যাসন্তান ভগবান দিছিলেন, তাও আবার দু-সপ্তাহের মইদ্যে ফিরাইয়া লইলেন। এখন তুমিই তো আমার সব।’

কথা শুনে এতক্ষণ নীরবে অশ্রম্নপাত করতে থাকা ব্রহ্মময়ী

ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেঁপে-কেঁপে কেঁদে ওঠেন। আর বলেন, ‘তুমি জানো, মরতে আমার কোনো দুঃখ নাই। কিন্তু আমি তোমারে ছাইড়া চইলা যামু এই কথাডাই মানা খুব কঠিন।’

মাঝিরা নৌকা চালাতে না পেরে ঘাটে ভিড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রাতও গভীর। ব্রহ্মময়ী ঘুমের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ জেগে মাঝে ‘আমি যামু না, ও মা, তুমি অগো মানা করো; এই তোরা কাছে আসবি না কইলাম’ – এসব প্রলাপ বকছে। গিরিশের ক্লান্ত চোখে কোনো ঘুম নেই। বাতাসের প্রবল বেগের কারণে নৌকার মধ্যে কোনো প্রদীপ থাকছে না বলে চারপাশে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। রাত্রির শেষ প্রহরে বৃষ্টিটা বোধহয় ধরে এলো, তখন দূর থেকে শেয়ালের হাঁক, পেঁচা আর তক্ষকের ডাক শোনা যায়। বেশ খানিকটা সময় বাদে মসজিদ থেকে আজানের আওয়াজ ভেসে এলে গিরিশ নিজের চোখেমুখে জলের ঝাপটা নিলেন, তারপর নৌকা চালানোর জন্য নাবিকদের ডেকে তুললেন। মাঝিরা টের পাওয়া মাত্র চোখ কচলে সবাই প্রায় একযোগে উঠে বসে। নোঙর তুলে

লগি-বৈঠা নিয়ে দ্রম্নতই যে যার অবস্থান নেয়। নৌকা খানিক এগোবার পরই বোঝা গেল প্রতিকূল বাতাসের কারণে লক্ষ্যার বুকে এগিয়ে যাওয়া খুব কষ্ট হচ্ছে। তবু নাবিকরা প্রাণপণে তাদের দায়িত্ব পালন করায় সন্ধের খানিক আগেই নৌকা ঘোড়াশাল পৌঁছে গেল। লক্ষ্যা নদীর পুবকূলে ঘোড়াশাল গাঁয়ের পাশে ঘাঘড়ার খাল নামে যে ছোট খালটি আছে সেই খালের মুখেই নৌকা ভেড়ানো হলো। সেখান থেকে ভাটপাড়া গ্রাম অন্তত তিন মাইল দূর। খানিক এগোলে ঘাঘড়ার খালের কোথাও হাঁটুজল, কোথাও প্রায় শুষ্ক বলে জলপথে যাওয়া সম্ভব নয়। গিরিশচন্দ্র তার সম্বন্ধী জগচ্চন্দ্র রায়ের নামে একটি চিঠি লিখে চাকর গোপালের হাতে দিলেন। তাতে ব্রহ্মময়ীর অবস্থা বর্ণনা করে পালকির বেহারা আর চিকিৎসক মাণিক আচার্য্যকে পাঠানোর অনুরোধ করলেন। গোপাল পথে চিঠিটি হারিয়ে ফেললেও গিরিশের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বলল, ‘মাইজি ঘাটপর পঁহুছি, ওনকো চিচক্কি বিমারি হুয়ি।’ তাতে ও-বাড়ির লোকজন বৃত্তান্ত বুঝতে পারলেও ডাক্তার কিংবা বেহারা পাঠানো তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তখন বেহারা পাওয়া দুষ্কর ছিল। সামনে বর্ষাকাল আসছে তাই বিদেশি বেহারারা প্রায় সকলেই দেশে ফিরে গিয়েছে। জগচ্চন্দ্র অনেক চেষ্টা করেও বোনকে আনার জন্য বেহারা পাঠাতে পারছেন না। গোপালের দেরি দেখে গিরিশ ভাবলেন, সে বোধহয় ওই বাড়িতেই রাত কাটিয়ে দিচ্ছে। এদিকে পালকির জন্য অপেক্ষা করে করে গিরিশ একসময় নিরাশ হয়ে পড়লেন। সন্ধের খানিক আগে ব্রহ্মময়ী নৌকার ছাউনির ভেতর থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে এসে বসলেন। লক্ষ্যা নদীতে সূর্য ডুবুডুবু, পাখিরা ঘরে ফিরছে, অস্তায়মান সূর্যের লালিমা প্রতিফলিত হচ্ছে নদীর জলে। মৃদুমন্দ বাতাসে নদীতীরের ফসলক্ষেতের পাট, আখ প্রভৃতি উদ্ভিদরাজি দুলছে। এই পরিবেশে ব্রহ্মময়ীর শরীর ও মন সামান্য হলেও প্রফুলস্ন হয়ে উঠল। গিরিশ স্ত্রীকে বললেন, ‘এখন কি তোমার একটু ভালো লাগতাছে?’

‘হুম। শোনো তোমারে একটা কথা বলি।’

‘কও।’

‘তুমি তো অন্য লোকের বিপদে চিরকাল পাশে গিয়ে দাঁড়াও, সান্তবনা দেও।’

‘তাতে কী হইছে?’

‘আমি চাই এখনকার এই ব্যাপারে তুমি অটল থাকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবা। আমি চাই না কেউ তোমারে সান্তবনা দিতে আসুক। আমি জানি তোমার মনডা নরম হইলেও তোমার জ্ঞান অনেক গভীর, তুমি আর দশটা লোকের মতো না। সেই বিশেষ জ্ঞানশক্তিই তোমারে স্থির থাকতে সাহায্য করব।’

স্ত্রীর কথা শুনে ডুবন্ত নিস্তেজ সূর্যের দিকে খানিক অপলক তাকিয়ে থাকেন গিরিশ। তিনি চোখের কোনায় জল জমতে দিতে চান না। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কেবল বলেন, ‘তুমিও যে এমন কইরা কথা কইতে পারো তা তো আগে বুঝি নাই।’

সন্ধে নামার খানিক বাদে দক্ষিণ-পূর্ব আকাশটা আবার কালো মেঘে ছেয়ে গেল। বিদ্যুতের তীব্র আলোর সঙ্গে ভীষণভাবে মেঘ গুড়গুড় করতে থাকল। প্রবল বাতাসের সঙ্গে আবার মুষলধারে বৃষ্টি। আজকের বাতাসটা বরং আরো শীতল। চারিদিক ঘন অন্ধকারে ছাওয়া, দৃষ্টিসীমার মধ্যে কিছুই ধরা দিচ্ছে না, তারা যেন সকলে শায়িত আছে

মৃত্তিকা-সমাধির অন্ধকারে। গিরিশ একজন মাঝিকে বললেন, ‘দেখো তো মধু-পিদিম জ্বালো। বাতাসের আড়াল করে খানিক রাখা যায় কিনা।’ চার-পাঁচ দফা চেষ্টা করেও মধুর পক্ষে প্রদীপ জ্বালানো সম্ভব হলো না, কিংবা জ্বললেও দু-এক পলকের বেশি সে দীপশিখার আয়ু স্থায়ী হলো না।

রাতের অন্ধকারেই গিরিশ রোগীর পাশে বসে সেবাশুশ্রূষা চালিয়ে গেলেন। ব্রহ্মময়ী কখনো ঘুমে কখনো জাগরণে। হঠাৎ যেন গিরিশের সান্তবনার বাঁধ ভাঙল, তার চিত্ত অসম্ভব ব্যাকুল-উচাটন হয়ে উঠল। সন্ধের খানিক আগেই ব্রহ্মময়ী তাকে যে অটল থাকার কথা বলেছিলেন তা যে অসম্ভব সে-কথা তিলে তিলে এখনই বুঝতে পারছেন গিরিশ। মনের ক্লেশ-যাতনার কথা বলবেন, এমন একটি মানুষ পাশে নেই।

ভৃত্যটি ছিল, সে-ও এই রাতের বেলা আর ফিরে এলো না। গিরিশের অন্যদিকে ক্লান্ত নাবিকেরা মৃতের মতো গভীর ঘুমে অভিভূত হয়ে পড়ে আছে। একাকী রোগীর সেবা করে তিনি ক্লান্ত-অবসন্ন। ক্ষুধা-তৃষ্ণার কথা সর্বদা প্রায় ভুলেই থাকেন, তবে এ-মুহূর্তে হঠাৎ খিদের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে শূন্য পাকস্থলি। নৌকায় শুকনো মুড়ি, চিড়ে আর গুড় ছাড়া খাওয়ার কিছু নেই। ওই একই জিনিস বারবার চিবোতে আর অভিরুচি হয় না। তখন মনে পড়ে, আধপোয়ামতো দুধও রয়েছে একটা মাটির হাঁড়িতে। বিকেলের দিকে যখন আবহাওয়া ভালো ছিল গিরিশ ডাঙায় উঠে তিন-চার গৃহস্থের বাড়ি ঘুরে শেষে দু-পয়সায় আধা সের গোদুগ্ধ জোগাড় করতে পেরেছিলেন। সেই দুধ জ্বাল দেওয়া, অন্ন-পথ্য প্রস্ত্তত করা, হলুদ-জলে রোগীকে স্নান করানো, তাকে বীজন করা – এসব কর্তব্য ঠিকঠাকমতোই করেছেন। রোগীর আবার কখন প্রয়োজন হয় তাই দুধের হাঁড়িতে হাত না দিয়ে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে কিছু চিড়া ভিজিয়ে নুন আর পাটালি দিয়ে উদর পূর্তি করার পর শরীরে ক্লান্তি আসে। চোখ বন্ধ করে মনে হয় সারা বছরের সকল রাত্রি এক হয়ে তাঁকে গভীর অন্ধকারে ফেলে নির্যাতন করছে, এই আঁধারের কোনো কূলকিনারা নেই। এমন অন্ধকার তিনি জীবনে কখনো দেখেননি। তার মতো অসহায় স্বজনহীন-বন্ধুহীন এই পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর কেউ নেই। এভাবে ভাবনার সাগরে নিমজ্জিত হতে হতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎ ক্ষুদ্র কী-সব আওয়াজ পেয়ে মনে হলো রাত বুঝি শেষ। কিন্তু ভালো করে চোখ মেলে দেখেন, তখনো পুবাকাশে আলোকরেখার কোনো আভাস নেই। হঠাৎ মনে পড়ল নদীর তীরে একজন বিকেলবেলা বলেছিল মুদিদোকানের পাশে একটা খুপরিতে দুজন বেহারা থাকে। তাড়া ছিল না, সোয়ারি রেখে রাতে হয়তো ফিরে আসবে। কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গিরিশ নৌকা থেকে ডাঙায় নেমে এলেন। মুদিদোকানটার পাশে কুঁড়েঘরে গিয়ে বেহারাদের খুঁজতে লাগলেন। ‘কেউ আছো ভাই ঘরের ভেতর?’ বলার পর খেয়াল করলেন অন্ধকারে ছায়ার মতো কে একজন এগিয়ে আসছে। মুদিদোকানের ছোট্ট দরজাটা খোলা। তার ভেতর টিমটিম করে বাতি জ্বলছে দেখে গিরিশ অনুমান করলেন এই লোকটাই দোকানি, রাতে এখানেই ঘুমায়। হয়তো প্রাকৃতিক কর্ম সারতে বাইরে বেরিয়েছে।

লোকটা পালটা জিজ্ঞেস করল, ‘কারে চান এই আন্ধারে? আপনারে তো ঠিক চিনতে পারলাম না?’

‘ভাই, আমি খুব বিপদে, ঘাটে আমাগো নৌকো বাঁধা, তাতে আমার স্ত্রী মুমূর্ষু রোগী। দুজন বেহারার খুব প্রয়োজন।’

‘একজন বেহারা তো আমার মুদিখানায় শুইয়া আছে। অন্যজনও আছে কাছাকাছি কোনোখানে। ওগো আজকাই সকালে দেশে রওনা হওনের কথা।’

দোকানি বেহারাকে ডেকে তুললেন। ‘এই বাবু তোমার সাথে কথা কইতে চান।’

আলো-আঁধারিতে বেহারার তাগড়া শরীর দেখে ভালো লাগল গিরিশের। তিনি বললেন, ‘একজন রোগীরে ভাটপাড়া পৌঁছাইয়া দিতে হইব। রোগী ডুলিতে বসতে অপারগ। ভাটপাড়ার তন পালকি আইনা তারে লইয়া যাইতে হইব। এই কাজটা সাইরাই তোমরা দেশের পথে রওনা হইয়ো।’

বেহারা কাজের জন্য পাঁচ সিকি দাবি করলে গিরিশ সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হলেন। বললেন, ‘এই লও অগ্রিম এক টাকা, বাকি চার আনা পৌঁছনোর পর পাইবা।’

টাকা হাতে নিতে নিতে বেহারা জিজ্ঞেস করল, ‘বাবু, এ-গাঁয়েই একখানা মহাফা আছে, রোগী তাতে বসতে পারবেন?’

গিরিশ নৌকায় গিয়ে ব্রহ্মময়ীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি সম্মতি জানান, তখন বেহারা মহাফা আনতে গেল, ফিরে আসতেও খুব বেশি সময় নিল না। রোগী মহাফায় চড়ে যাত্রা করল। গিরিশ নাবিকদের সমুদয় নৌকাভাড়া আর প্রত্যেক নাবিককে এক টাকা করে পুরস্কার দিয়ে হেঁটে ভাটপাড়া রওনা হলেন। চলতে চলতে গিরিশের সামান্য নির্ভার লাগছিল, যাক তবু বেহারা পাওয়া গেল, না হলে এই তিন মাইল পথ পেরিয়ে রোগীকে পিত্রালয়ে নেওয়া মহাসংকট হতো।

ব্রহ্মময়ী সকাল সাতটার দিকে যখন পিত্রালয়ে পৌঁছলেন, বাড়িতে একটা শোরগোল পড়ে গেল। চিকিৎসক আগেই এসেছেন। তিনি রোগীকে পরীক্ষা করে তার আরোগ্যলাভ বিষয়ে এক প্রকার নৈরাশ্যই প্রকাশ করলেন।  বললেন, ‘আমি এই জাতীয় রোগী প্রায় একশ দেখছি, তারা সকলেই ভগবানের ইচ্ছায় ভালো হইছে। কিন্তু এমন সংকটাপন্ন আর কাউরে দেখি নাই।’

তবু তিনি ওষুধপথ্য বাতলে দিলেন। আট-নয় দিন সযত্নে চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রূষা চলল। তবে গিরিশের আর রোগীর কাছে যাওয়ার প্রয়োজন বা সুযোগ ছিল না। তিনি আবারো নতুন করে মাতৃস্নেহের অকৃত্রিম রূপ প্রত্যক্ষ করলেন। তার শাশুড়িমা বসন্তরোগে আক্রান্ত কন্যার গলিতপ্রায় শরীরটা আগলে শুয়ে থাকেন, যেন তিনি কিছুতেই যমকে নিতে দেবেন না তার এই সন্তান। গিরিশ রোগীর অবস্থা দেখে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। ব্রহ্মময়ীর এই যন্ত্রণা নিজ চোখে দেখা তার আর সহ্য হচ্ছিল না। তাই তিনি সে-রাতে গ্রামের অন্য পাড়ায় তার ভগ্নিপতির বাড়িতে থাকার জন্য চলে গেলেন। ঘটনার খানিক বাদেই চাকর গোপাল এসে খবর দিলো, ‘মাইজিকো রাম হুয়া।’ অর্থাৎ মায়ের এই সেবাযত্ন সবই বিফল হলো। উনিশ জ্যৈষ্ঠ ভোরবেলা মায়ের বুকে মাথা রেখে ব্রহ্মময়ী অমরধামে পাড়ি জমালেন।

এতদিন ক্রমাগত বেদনা আর শোকের আগুনে পুড়েছেন গিরিশ। তাই এই মৃত্যুসংবাদ তাকে খুব বেশি বিচলিত করতে পারল না। বরং তিনি আত্মীয়দের সঙ্গে নিয়ে দ্রম্নত অমেত্ম্যষ্টিক্রিয়ার জন্য প্রস্ত্তত হলেন। যথানিয়মে তাকে চিতাশয্যায় স্থাপন করা হলো। গিরিশ প্রিয়তমা সহধর্মিণীর সঙ্গে সাংসারিক সকল সুখ ও আশাভরসা চিরকালের জন্য বিসর্জন দিলেন। শবদাহশেষে স্নান করে সূর্যাস্তের আগেই সকলের ঘরে ফেরা হলো।

তারপর কতবার সূর্য ওঠে, সূর্য ডোবে। গিরিশের সময় যেন থেকে থেকে থমকে যায়। তবু কালাকাল এক জায়গায় বসে থাকার বস্ত্ত নয়। কিছুদিন ভবঘুরের মতো জীবনযাপন করে নতুন পথের সন্ধানে তিনি ১৮৭৬ সালে লক্ষেনŠ গিয়ে বৃদ্ধ মৌলভি এহসান আলির সাক্ষাৎ পেলেন। পঁচাত্তর বছর বয়স হলেও এহসান আলি ছিলেন দীর্ঘ, ঋজু, তাগড়া শরীরের অধিকারী। প্রতিদিন সাত-আট মাইল পথ হেঁটে গ্রামে গ্রামে গিয়ে যে আরবি ও ধর্ম শিক্ষা দিতেন, তা তো গিরিশ নিজেই দেখেছেন। লোকে বলত তিনি নাকি এক বেলায় এক সের আটার রুটি আর আধা সের মাংস খেতেন। মৌলভি সাহেবের জ্ঞান আর জীবনবোধ গিরিশের মনের ওপর দারুণ প্রভাব বিস্তার করে। লক্ষেনŠ থেকে ফিরে গিরিশ পুনরায় কলকাতা হয়ে ঢাকায় এসে মৌলভি আলিমদ্দিনের কাছে কিছুকাল আরবি সাহিত্য ও আরবের ইতিহাস বিষয়ে পাঠগ্রহণ করেন। কোরানের প্রতি তাঁর আগ্রহ বহুদিনের। হিন্দুর কাছে এ পবিত্র গ্রন্থ বিক্রি করবে না এই আশঙ্কায় ঢাকার বন্ধু জালালুদ্দিনের সঙ্গে পুস্তক বিপণিতে গিয়ে কোরান শরিফ কিনতে পেরে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। কিছুকাল পর ১৮৮১ সালে ময়মনসিংহ শহরে খানিকটা থিতু হয়ে গিরিশ কোরান শরিফ অনুবাদে বুঁদ হয়ে পড়লেন। এক রাতে মূল আরবি পুস্তকে পুনরুত্থান সম্পর্কিত একটি বিশেষ চরণ পড়তে পড়তে তাঁর চোখের কোনায় জল জমে ওঠে। পরে আরো একটি পঙ্ক্তির তরজমা করলেন এভাবে – ‘আর পার্থিব জীবন তো ক্রীড়াকৌতুক ব্যতীত কিছুই নহে; সতর্কজনের পক্ষে পারলৌকিক আবাসই শ্রেয়; তোমরা কি তাহা উপলব্ধি করো না?’  তখন নতুন করে মনে হয় – তাহলে তো ব্রহ্মময়ীর অস্থিমজ্জা,

কোষ-দেহাণু পুড়লেও সে পঞ্চভূতে একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি। স্বর্গে বসে সে কী করছে এখন? সাগরজলে আপনমনে মাছেদের সঙ্গে খেলা? নাকি সেখানে গোলাপি জ্যোৎস্নায় নেয়ে আনমনে গান গাইছে সে। মনে আছে আমার কথা তার? নাকি কোনো ঘনিষ্ঠ সুপুরুষ সঙ্গীর নিবিড়তায় ভুলে আছে সমস্ত পার্থিব স্মৃতি?

রাত-গভীরে গিরিশের নিস্তব্ধ ঘরের ভেতর তেল শেষ-হয়ে-আসা প্রদীপের সলতে পুড়ে আলো কমে আসছে। প্রৌঢ় গিরিশ খুকখুক করে কাশতে কাশতে হঠাৎ লেখার খাতার দিকে তাকিয়ে দেখেন একফোঁটা চোখের জল পড়ে সদ্য লেখা কয়েকটি কালো অক্ষর লেপ্টে গিয়েছে। একটা বাতাসের ঝটকায় ক্ষীণ প্রদীপটা নিভে যাওয়ার মুহূর্তে গিরিশের ভেতরটা গুমরে কেঁদে উঠতে চাইল। তিনি মনে মনে বললেন, ‘আমি আসছি প্রভু, ব্রহ্মময়ী আমি আসছি!’ গুমরে কাঁদতে কাঁদতে মনে হলো তার চারিপাশের বাতাসে এক অপার্থিব সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি যেন একটু ভয় পান, আবার নিমেষেই কয়েক পলকে আপনা-আপনি উধাও সে-ভয়। কে যেন নির্ভয় দিয়ে বলে, তোমার ব্রহ্মময়ী আজো আছে তোমারই অপেক্ষায়। তখন চোখ মুছে বুকভরে শ্বাস নিয়ে বাতাসের সুগন্ধ উপভোগে নিমগ্ন হয়ে পড়েন তিনি।

খানিক পর সম্বিত ফিরে পেয়ে গিরিশ বুঝতে পারেন, এতকাল পর এই ক্রন্দন কেবল স্ত্রী-বিরহজাত নয়, বিমূর্ত রাতে এ-কান্নার আরো গভীর অর্থ আছে। তিনি আজ অশ্রম্নপাতের আনন্দ – অব্যক্ত এক অনুভব খুঁজে পেয়েছেন। অন্ধকারে তিনি যে-আলো দেখছেন তা নিছক জোনাকি নয় – নয় আলেয়াও। এক জীবনে একজন মানুষ কী আর চাইতে পারে!