ইংরেজি কবিতা, পঞ্চাশের প্রজন্ম

সরকার মাসুদ

বিশ শতকের পঞ্চাশের দশক কালের গর্ভে তলিয়ে গেছে অর্ধশতাব্দী আগে। এ কালপর্বটি শুধু বাংলাদেশের (সে-সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের) শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বেলায় গুরুত্বপূর্ণ নয়, গ্রেট ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও রীতিমতো উল্লেখযোগ্য। এর অন্যতম কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ সর্বাত্মক যুদ্ধ সবকিছু পালটে দিয়েছিল। ওলট-পালট হয়ে গিয়েছিল সাহিত্যের পূর্বতন, প্রায় নিস্তরঙ্গ ভাববিশ্ব। স্বভাবতই কবিতার ক্ষেত্রেও এ নয়া তরঙ্গটি আছড়ে পড়েছে তার সবটুকু শক্তি নিয়ে।

আমাদের এখানে যখন শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমানরা নতুন কবিতা, সমকাল, সওগাত প্রভৃতি কাগজ ঘিরে গড়ে তুলেছিলেন সৃজনশীলতার এক নতুন বলয়, সে-সময়, কিছু আগে বা পরে,  New Lines নামে একটি সাহিত্য ম্যাগাজিন বেরিয়েছিল লন্ডন থেকে। এর প্রকাশকাল ১৯৫৬। এটা কবিতা সংকলন। ব্রিটেনের সমকালীন বিশিষ্ট কবিরা এতে লিখেছেন। কমবেশি সুনামও অর্জন করেছেন। New Lines-এর কবিরা হচ্ছেন কিংসলে এমিস, ফিলিপ লারকিন, টম গান, জন ওয়েন, এলিজাবেথ জেনিংস, ডি জে এনরাইট, ডোনাল্ড ডেভি, জন হলোওয়ে এবং রবার্ট কনকোয়েস্ট। পরবর্তীকালে তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান হয়েছেন দুজন ফিলিপ লারকিন এবং টম গান। এ-কবিদের সিংহভাগই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা গ্রন্থাগারিক। সুতরাং তাঁরা শুধু কবিতাই লেখেননি, কবিতা বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন; আলোচনা-সমালোচনাও লিখেছেন এন্তার। New Lines তিরিশের দশকের সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতিচিন্তাকে অস্বীকার করেছে। উড়িয়ে দিতে চেয়েছে চল্লিশের দশকের ডিলান টমাস, জর্জ বার্কার প্রমুখ কবিকে। মুক্ত অনুষঙ্গ আর খোলামেলা অনুভূতির বিপরীতে অন্যরকম কবিতা রচনার কথা বলেছে এই কাগজ। তাঁদের কাছে অভিজ্ঞতার স্থান অনেক বড়। শুধু অভিজ্ঞতা নয়, ‘প্রকৃত সততা’ও তুলে ধরবে কবিতা – এমনটাই মনে করতেন তাঁরা। তিরিশের দশকে অনাদৃত, অবমূল্যায়িত রবার্ট গ্রেভস, জর্জ অরওয়েল প্রমুখ কবি-সাহিত্যিককে পাঠকমানসে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে New Lines। ডক্টর লিভিস, উইলিয়াম এম্পসন প্রমুখ তাত্ত্বিক ও সমালোচকের বিদগ্ধ আলোচনার মাধ্যমেই তা সম্ভব হয়েছিল। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, New Lines কেবল অরওয়েলের মতো লেখককে তুলেই ধরেনি, তাঁর ব্যবহৃত সাধারণ, আটপৌরে ভাষার সহজতাকেও গ্রহণ করেছে কুণ্ঠাহীন মনে। সংকলনের সম্পাদক কবি রবার্ট কনকোয়েস্ট তাঁর ভূমিকায় এই দশকের কবিতা সম্বন্ধে বলেছেন, ‘এসব কবিতা কোনো মহান রীতির অনুসারী কিংবা মনগড়া ধারণার সমষ্টি নয়। অতীন্দ্রিয় কোনো কিছুর বা ন্যায়শাস্ত্রের বাধ্যবাধকতা থেকেও এরা মুক্ত’ (অনুবাদ : লেখক)।

New Lines-এ অন্তর্ভুক্ত কবিদের লেখা থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার বোঝা যায়, অরওয়েল-কথিত বাস্তবভিত্তিক সততার গভীর প্রভাব আছে তাঁদের ওপর। একই গোষ্ঠীভুক্ত হলেও তাঁরা মতবাদ-ভারাক্রান্ত লেখক নন। অবচেতনের পর্যাপ্ত উপস্থিতি, মরমি ভাব অথবা অকাট্য যুক্তি নয়, সমস্ত কিছুর প্রতি একজন কবির মনোভঙ্গি হবে অভিজ্ঞতাচিহ্নিত – ‘It is free from both mystical and logical compulsions and – like modern philosophy – is empirical in its attitudes to all that comes.’

সম্পাদক-কবির এসব কথা কিন্তু আজ মোটামুটি স্বীকৃত। সমকালীন কবিদের অগ্রসর অংশের কাছে এর বেশি আর কী আশা করা যায়? তাঁরা শেষ পর্যন্ত কবিতার যুক্তিগ্রাহী কাঠামো এবং বোধগম্য ভাষা ত্যাগ করতে চাননি, করেনওনি। সব ধরনের আতিশয্যের বিরুদ্ধে এবং কবিতাকে রূপকাশ্রিত হতে হবে এমন সংকীর্ণ ধারণার বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এই কবি সম্প্রদায়। চল্লিশ দশকীয় রোমান্টিসিজমের একটা রহস্যোন্মোচক ভূমিকা ছিল। এবং রোমান্টিসিজম, আমরা জানি, নানারকম অতিরেকেরও প্রশ্রয়দাতা। এই ধরনের কবিতা যেহেতু নিম্নমানের, কাজেই সেগুলো পরিত্যাজ্য। তাহলে অবশ্য ডিলান টমাসের মতো কবিকেও খারিজ করে দিতে হয়। সেটা কতখানি যুক্তিসম্মত এবং কবি হিসেবে ডিলানের কোন কোন বিচ্যুতিতে অভিযোগটির সমর্থন খুঁজে পাওয়া যাবে তা বিচারসাপেক্ষ। কবিদের ওইসব মতামত যুদ্ধোত্তর যুগের প্রতিক্রিয়া বলেই মনে হয়। পঞ্চাশের অগ্রণী কবিরা ভাবোচ্ছ্বাসের ও পেলবতার পরিবর্তে কঠিনতার ও বুদ্ধিমত্তার যে কল্পনাদীপ্ত অনুশীলনের ওপর জোর দিয়েছেন তা এই প্রতিক্রিয়ারই  অংশ। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী কবিতা রূপরেখা ঠিক কেমন হবে সে-ব্যাপারে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে New Lines। তার কারণ এর কবিদের ভেতর দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণা সম্পর্কিত স্বচ্ছতার অভাব ছিল। তাঁরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাঁদের উদ্দেশ্য প্রকাশ করতে পারেননি, যেমনটা পেরেছিলেন ওয়ার্সওয়ার্থ কিংবা এজরা পাউন্ডের মতো কবিরা, তাঁদের সমকালে।

New Lines-এর বিরোধিতা করে একই দশকে অন্য একটি কবিগোষ্ঠী দেখা দেয়। নতুন এই দলটির নাম ‘মভেরিকস’ (Mavericks)। শব্দটির অর্থ বাঁধনহারার দল। এই দলে ছিলেন ড্যানি অ্যাবস, জন স্মিথ, ডেভিড রাইট, মাইকেল হ্যামবার্গার, জন সিলকিন, অ্যান্টনি ক্রোনিন, ডব্লিউ প্রাইস টার্নার, ভারনন স্ক্যানেল এবং জে.সি. হল। তাঁদের মধ্যে খ্যাতিমান হচ্ছেন জন সিলকিন, মাইকেল হ্যামবার্গার ও জে.সি. হল। ‘মভেরিকসে’র কবিরা সবাই আত্মকেন্দ্রিক। প্রায় সকলেই ব্যক্তিগত লিরিক লিখেছেন। এবং এগুলোর অধিকাংশই দক্ষ হাতের সৃষ্টি বলে মনে হয়। টমাস ব্ল্যাকবার্ন নামে আরো একজন কবি আছেন এ-দলে। তিনি এবং জে.সি. হল কবিতায় পৌরাণিক কাহিনি ব্যবহার করেছেন। দৃষ্টিভঙ্গি এবং অ্যাপ্রোচের বেলায় ‘মভেরিকস’ ঘরানার কবিদের ভেতর পার্থক্য অবশ্যই ছিল। কিন্তু একটি ব্যাপারে মিল ছিল। তা হচ্ছে, মহৎ বা বড় থিমের পরিবর্তে ছোটখাটো, এমনকি তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাঁরা কাব্যরচনা করেছেন।

New Lines-এর নয়জন কবির মধ্যে দুজনই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, দুজন লাইব্রেরিয়ান এবং একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। সেজন্য তাঁদের কবিতায় বিদ্রোহী ভাব পাওয়া যায় না। কিন্তু তাহলেও যেহেতু তাঁরা উচ্চশিক্ষিত ও মার্জিত, তাঁদের লেখায় বুদ্ধিদীপ্ত সৃজনশীলতার স্বাক্ষর স্পষ্ট। বলা চলে, অসংযত আবেগ ও অশিষ্ট আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ায় তাঁদের এসব কবিতা। জন ওয়েন এবং কিংসলে এমিস অবশ্য ঔপন্যাসিক ও সমালোচক হিসেবেই বেশি খ্যাতিমান। গ্রন্থাগারিকের পেশায় সম্পৃক্ত ফিলিপ লারকিন এই দলের মধ্যে প্রকৃত শক্তিশালী কবি। এই কবিগোষ্ঠীর সদস্যদের ভেতর একাধিক বিষয়ে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁরা সকলই অক্সফোর্ডের অধীন একই কলেজে পড়াশোনা করেছেন। প্রত্যেকেই প্রতিনিধিত্ব করছেন মধ্যবিত্তশ্রেণির। ফলে কবি হিসেবে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈশিষ্ট্য ওই মধ্যবিত্ত ভাবনার আদলেই নির্মিত হয়েছে। সৃজনশীলতার দিক থেকে বিচার করলে বলতে হয়, এই কবিরা রোমান্টিসিজমের কট্টর সমালোচক এবং সহজ-সাধারণ বুদ্ধির বিরোধী। দার্শনিকসুলভ বড় বড় চিন্তা ও গভীরতার সব ধ্যান-ধারণার আধার নয় তাঁদের কবিতা। তাঁরা বরং নিজেদের সাধ্যমতো যা কিছু জেনেছেন এবং একান্ত ব্যক্তিগতভাবে যা কিছু অনুভব করেছেন সেগুলোরই প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবিতার মাধ্যমে। এতে করে প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিপরীতে অনেক মতও সহ্য করে নিতে হয়েছে পাঠককে। ভাবাবেগের ও আদর্শের প্রতি বিতৃষ্ণা এই লেখক সম্প্রদায়কে ভিন্নধর্মী কবিতা লিখতে প্ররোচিত করেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কট্টর মনোভাব পোষণ করার ফলে কবিতার মতো হৃদয়শিল্পে প্রয়োজনীয় আবেগটুকু সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছেন তাঁরা।

New Lines-এর অন্তর্ভুক্ত জনাচারেক কবি অগ্রসর কল্পনা-ভাবনা উপহার দিয়েছেন যাদের মধ্যে  ফিলিপ লারকিন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। পক্ষান্তরে ‘মভেরিকস’ গ্রুপে সত্যিকার কবিত্বসম্পন্ন লেখক দুজন যাঁদের কথা আগেই বলা হয়েছে। জন সিলকিন কবিতার ওপর কিছু গদ্যও লিখেছেন। পরন্তু Poetry of the committed individual নামে বিশ্বের আধুনিক কবিতার একটি উঁচুমানের, বৈচিত্র্যময় কবিতা সংকলন সম্পাদনাও করেছেন। সবদিক চিন্তা করলে বলতে হবে, ‘মভেরিকসে’র কবিদের তুলনায় New Lines-এর কবিরা আমাদের অনেক বেশি আকর্ষণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে বৈচিত্র্যও বেশি বলে মনে হয়।

কবিত্বশক্তি ও সূক্ষ্ম অনুভূতির বিচারে টম গান, ফিলিপ লারকিন, জন হলওয়ে রীতিমতো বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। এলিজাবেথ জেনিংস এবং ডি. জে. এনরাইটের কবিতায় একধরনের গাম্ভীর্য আছে। কিন্তু ভাবগাম্ভীর্য নিয়েও তাঁরা যথেষ্ট প্রাণবন্ত। জন ওয়েনের এবং কিংসলে এমিসের মধ্যে পাওয়া যায় নাট্যগুণ। লক্ষণীয় যে, তাঁরা একইসঙ্গে যুক্তিবাদী ও জীবনরসিক। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপেও ওস্তাদ। সমাজে চালু থাকা অনেক রীতিনীতিকেই শ্লেষবিদ্ধ করেছেন। উপস্থাপনের গুণে ঠাট্টা-মশকরাও হয়ে উঠেছে উপভোগ্য।

এখন উভয় দলেরই কয়েকজন কবির কিছু কবিতার আলোকে তাঁদের কাব্যরুচি নির্ণয় করার চেষ্টা করছি। এই বিশেষ  অধ্যায়ের সর্বাধিক খ্যাতিসম্পন্ন নাম ফিলিপ লারকিন। তাঁর কবিতায় উদ্দীপনার সুর দুর্লভ, বরং সংশয়ের ও নির্লিপ্ততার ভাব চোখে পড়ে বেশি। ঠাট্টা-বিদ্রূপের সুরও শোনা যায়। লারকিন বাস্তবপন্থী এবং কাব্যরচনার প্রশ্নে বিশুদ্ধতার আদর্শে বিশ্বাসী। সংশয় ও নির্লিপ্তির কারণে তাঁর কবিতা নিচুকণ্ঠের। কাব্যশরীর নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি অনেকটাই প্রথাগত। অসংখ্য কবিতার প্রতিটি স্তবক চার-পাঁচ-ছয় লাইনের। অজস্র সমিল পদ রচনা করেছেন, যেমন ‘I see a girl dragged by the wrists/ Across a dazzling field of snow,/ And there is nothing in me that resists/ Once it would not be so’ (‘Ugly sister’, The North ship)। তবে নিখাদ গদ্যময়তাও লারকিনের একটি বিশেষত্ব যা তাঁর বহু কবিতায় প্রযুক্ত হয়েছে। অবশ্য সেই গদ্যের ভেতরেও কাব্যিক বর্ণচ্ছটা ঠিকই অনুভব করা যায়। সেরকম কয়েকটি লাইন – ‘What do they think has happened, the old fools,/ To make them like this? Do they somehow suppose/ Its more grown-up when your mouth hangs open and drools,/ And you keep on pissing yourself, and cant remember/ Who called this morning?’ (‘The old fools’, High Windows)।

লারকিনের আছে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর প্রগাঢ় অনুভবের পৃথিবী। বিখ্যাত কবিতা ‘Church Going’ (The Less Deceived)-এর উদাহরণ উল্লেখযোগ্য। এই লেখায় তিনি গির্জার অভ্যন্তরের বাস্তবধর্মী অন্তরঙ্গ বর্ণনা দিয়েছেন – ‘…matting, seats, and stone,/ And little books; sprawlings, of flowers, cut/ For Sunday, brownish now;/ Some brass and stuff/ Up at the holy end;…’। তৃতীয় স্তবকে এসে কবিতাটি বিশেষ মাত্রা অর্জন করেছে যখন লেখক তাঁর হতভম্ব অবস্থার কথা ব্যক্ত করছেন, বলছেন যে, কীসের খোঁজে তিনি নির্লিপ্ত ঘুরে বেড়াচ্ছেন সেখানে। এই প্রশ্নও তুলেছেন যে, গির্জাগুলো যখন আর ব্যবহ্নত হবে না তখন আমরা সেগুলোকে কিসে রূপান্তরিত করব – ‘When churches fall completely out of use/ What we shall turn them into…’ কিন্তু লারকিন আবার যখন বলেন, ‘Hatless, I take off my cycle-clips in awkward reverence’ তখন তা যুদ্ধ-পরবর্তী ব্রিটিশ নাগরিকের ছবি ফুটিয়ে তোলে। এই নাগরিক বিত্তবান নয়। তার গাড়ি নেই, বাইসাইকেল আছে।

উপার্জন বা খাদ্যের প্রাচুর্য নেই, বৈচিত্র্য নেই, কিন্তু একটু আশা আছে। আশা – এই রাষ্ট্র একদিন কল্যাণরাষ্ট্র হবে। এটা কল্পনাবিলাস নয়, বাস্তবজ্ঞান থেকে উৎসারিত জীবনধারণা। লারকিনের কাছে একজন কবি, তাই, কোনো স্বপ্নলোকের বাসিন্দা নয়। তিনি আমাদের প্রতিবেশীর মতোই।

‘At Grass’ (তৃণভূমিতে) কবিতায় বর্ণিত ঘোড়াদুটির কথা মনে পড়ে। তাদের গৌরবের দিন আজ গত। ঘোড়দৌড়ের বাজির মোহ উত্তেজনা মায়া সব আজ অবলুপ্ত। পনেরো বছর আগের সেই চাঞ্চল্য, কোলাহল, রোমাঞ্চ স্তব্ধ হয়ে গেছে। সব পরিণত হয়েছে স্মৃতিতে। তারা এখন অচেনা-অজানা ছায়াপ্রান্তরে-বিলীনপ্রায়। সেই স্মৃতিও কি মাছির মতো তাদের কানে জ্বালাতন করে? ‘Do memories plague their ears like flies?/ They shake their heads. Dusk brims the shadows./ Summer by summer all stole away,/ The starting-gates, the crowds and cries’ -। লারকিনের কবিত্বশক্তি যথাযথভাবে প্রমাণিত হয়েছে এরকম আরো অনেক কবিতার কথা বলা যেতে পারে। আপাতত ‘I remember, I remember’ কবিতাটির মাধ্যমে তাঁর সম্বন্ধে আলোচনা শেষ করব। এও এক অসাধারণ কাব্য যেখানে স্মৃতিচারণের সহজ ভঙ্গির মধ্যে সূক্ষ্ম বেদনাবোধ লুকিয়ে আছে। আর সেই বিষয়টিই কবিতাটিকে করে তোলে তাৎপর্যপূর্ণ। লেখক তাঁর শৈশবের শহরের ওপর দিয়ে ট্রেনে করে যেতে যেতে স্মৃতি রোমন্থন করেছেন; বলছেন সেই কথা – ‘I leant far out, and squinted for a sign/ that this was still the town that had been mine’। ‘আমার শৈশব অব্যয়িত রয়ে গেছে সেইখানে’ এধরনের বেদনাময় উপলব্ধি (‘No, only where my childhood was unspent’) কবিতাটিকে দান করেছে উচ্চমাত্রা।

রসগ্রাহিতা, বিচক্ষণতা পঞ্চাশের সকল প্রধান কবিরই বৈশিষ্ট্য। কিন্তু কিংসলে এমিসের বেলায় এসব গুণের ব্যবহার বিশেষভাবে চোখে পড়ে। তাঁর কৌতুকবোধও আমোদিত করে। কেননা, তিনি ‘বিরক্তিপ্রদ মজার জিনিস’গুলো লক্ষ করেন এবং ‘বইয়ের দোকানে জঘন্য কিছু’ খুঁজে পেয়েছেন। একটি কবিতায় এমিস বলেছেন যে, কবিতাবইয়ের জায়গা হচ্ছে উদ্যানশিল্প এবং রন্ধনশিল্পের মাঝখানে। ‘তোমাকে মনে রাখি’, ‘ভালোবাসা আমার ধর্ম’ শিরোনামের কবিতাগুলো প্রগাঢ় কৌতুকবোধ ও আরো নানা কারণে নারীপাঠকদের বেশি আকর্ষণ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লর্ড বায়রনের কবিতার ছায়া অবলম্বনেও এমিসের কটাক্ষ তীর নিক্ষিপ্ত হয়েছে – ‘Should poets bicycle-pump the human heart/ Or squash it flat?/ Man’s love is of man’s life a thing apart;/ Girls aren’t like that.’ অন্যদিকে দেখতে পাচ্ছি, ভাষাতত্ত্বের ও সাহিত্যের জ্ঞানকেও তিনি প্রয়োগ করেছেন বিশুদ্ধ হাস্যকৌতুক সৃষ্টির কাজে। কিংসলে এমিসই শুধু নন, সুন্দরী ললনাদের নিয়ে স্বপ্নে বিভোর হয়েছেন অসংখ্য ইংরেজ কবি। কিন্তু নারীগণ আধুনিক কবির ওপর যেভাবে সশরীরে ভেঙে পড়েছেন, লেখকের ভাষায় ‘দেহের অটোগ্রাফ খাতায় স্বাক্ষর করানোর উদ্দেশ্যে’, তা এককথায় তুলনারহিত।

এমিসের ঝোঁক যদিও হাস্যরস, পরিহাস কিংবা উদ্ভট রসের দিকে, তা সত্ত্বেও তাঁকে শুধু হালকাভাবের কবিতার কারিগর ভাবলে ভুল করা হবে। তার কারণ গভীর কিংবা নাতিগভীর বিষয়েও তিনি গাম্ভীর্যপূর্ণ কবিতা লিখেছেন সাফল্যের সঙ্গে। এ-ধরনের কবিতার সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। ‘Masters’ নামে কবিতা থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি অনুবাদ করে দিচ্ছি – ‘যে ঘোড়ার আরোহী উল্লস্ফনে ভীত তার পতন নিশ্চিত,/ বন্দুকবাজ লক্ষ্যভ্রষ্ট হবেই যদি আদেশে অনিশ্চয়তা ঝরে,/ নিরাপদ শুধু তারাই থাকবে যারা নিজেদের নিরাপদ মনে করে;/ যারা কণ্ঠস্বর হারিয়ে ফেলে তারা সবকিছুই হারাবে’… (অনুবাদ : লেখক)। লঘু কবিতা এবং গুরু কবিতা – দুধরনের রচনাকর্মেই সিদ্ধহস্ত এমন কবি সমগ্র বিশ্বসাহিত্যেই বিরল।

এলিজাবেথ জেনিংস হাস্য পরিহাসের দিকে ঝোঁকেননি। তাঁর মানসগঠন বরং গভীর বিষয়ে কবিতা লেখার কাজে সমর্থন জুগিয়েছে। তাঁর কাব্যে সারল্য আছে; আছে ভাষার লালিত্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থিম বা রচনাবস্ত্ত একান্ত নিজস্ব হলেও সবাই তা শেয়ার করতে পারে। প্রকাশরীতির প্রাতিস্বিকতাই এর আসল কারণ। এলিজাবেথের  কবিতা মর্মস্পর্শী হওয়ার পেছনে আছে বিস্ময়কর সংবেদনশীলতা আর অনবদ্য সূক্ষ্মতা। ভাবের কিংবা ভাষার জটিলতা তিনি যথাসাধ্য এড়িয়ে গেছেন। এসব কারণে তাঁকে পঞ্চাশের প্রথম সারির একজন কবি বলে মনে হয়। নিসর্গনিমগ্নতাও তাঁর আরেক উল্লেখযোগ্য  বৈশিষ্ট্য। ‘Autumn Song’ কবিতায় আমরা দেখতে পাবো তাঁর প্রকৃতিমনস্কতা এবং সংবেদনশীলতার কাব্যরূপ – ‘এখন দ্যাখো শরতের এই লুকিয়ে থাকা/ সুরভি, আর ভাবো গ্রীষ্মকাল ফুরোয়নি;/ রঙের কোথাও কোনো বদল হয়নি/ বাতাস শান্ত ধারায় সবুজে-শাদায় বেঁধেছে বাসা।/ গাছপালাগুলো আজ নুয়ে আছে বিকাশের ভাবে, আর/ প্রান্তরের সব দিক পূর্ণতা। সব দিক ফুলে-ফুলে ভরা।’ (অনুবাদ : লেখক)

‘Absence’ নামে তাঁর একটি বিরহের কবিতা আছে। এই লেখায় বিচ্ছেদ বেদনার অভিনবত্ব লক্ষণীয়। প্রিয়তমার সঙ্গে সর্বশেষ যেখানে দেখা হয়েছে, লেখক সেই জায়গায় এসেছেন। যত্নে সাজানো বাগান,  অবিশ্রান্ত ফোয়ারাজল, অনিন্দ্য পাতাবাহার  – সবকিছুই ঠিক আছে। কিন্তু  কিছু একটা যে শেষ হয়ে গেছে তার চিহ্ন কোথাও নেই। মুলমুলে হাওয়া আর কাকলিময় পাখিরাও তাকে আনন্দ দিতে পারছে না যেহেতু তার মন এখন বিক্ষিপ্ত। কবিতাটির বিশেষত্ব এখানেই যে, লেখক একপর্যায়ে ভাবছেন আনন্দময় প্রাকৃতিক পরিবেশে দুঃখ সহ্য করার মতো কোনো কিছু থাকতে পারে না। পরন্তু কবিকে ভুলে যাওয়া শেখানোরও কিছু নেই। বিস্মরণের উলটোদিকেই আছে দগদগে স্মরণ। সাক্ষাতের জায়গাটি আগের মতো আছে বলেই বিচ্ছেদের অনুভূতিকে লেখকের কাছে খুব সতেজ ও শক্তিমন্ত মনে হয়েছে। প্রিয়তমার নাম মনে পড়ার সময় জেগে উঠছে ফোয়ারা, ফুল, তৃণভূমি। নিখাদ কবিত্বের ভেতরেও সমালোচনাবুদ্ধি সক্রিয় থাকতে পারে। এলিজাবেথের কিছু কিছু কবিতায় তার দেখা পাওয়া যায়। এলিজাবেথ জেনিংস একজন ক্যাথলিক। তাঁর কাব্যে পার্থিব রূপ-রস-রঙের পাশাপাশি অধ্যাত্ম আবহ ও সুর লক্ষণীয়। ধর্মের প্রথা ও আচার-আচরণের সঙ্গে শিল্পীমনের হৃদয়বৃত্তি এবং বিচার-বুদ্ধি মেলাতে চেয়েছেন তিনি। সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করে দিয়েছেন প্রথাসম্মত জীবনভাবনার গভীরে।

‘At a mass’ নামের কবিতায় এলিজাবেথ, তাই, বলছেন – ‘Waiting restlessly the coming event,/ Hearing the three bells ringing the loud warning,/ I look for the lifted moment, the lifted cup,/ Feeling upon my skin the Roman morning./ I watch with a critical eye the bread raised up/ And confuse aesthetics now with a sacrament.’

নান্দনিকতার প্রশ্নে ধর্মীয় রীতিনীতি বা উৎসবের ব্যাপারে লেখক দ্বিধা বা সংশয় প্রকাশ করেছেন। এই যে তিনি বললেন, ‘And confuse aesthetics now with a sacrament’ এটাই হচ্ছে আসল জায়গা যেখানে কবিতাটি উত্তীর্ণ হয়েছে ভিন্নমাত্রায়।

কবি-ঔপন্যাসিক জন ওয়েনের Mixed feelings এবং ডি. জে. এনরাইটের The Laughing Hyena কাব্যগ্রন্থ দুটি বেরোয় একই বছরে – ১৯৫৩ সালে! জন ওয়েনের প্রসঙ্গে পরে আসছি। আপাতত এনরাইটকে নিয়ে দু-চার কথা বলা যাক। শব্দ দিয়ে ছবি অাঁকতে সিদ্ধহস্ত এই কবি। ‘Exams at an Egyptian University’ কবিতার কিছু অংশ অনুবাদ করছি – ‘বাতাস ভারি হয়ে আছে ধোঁয়ায়, উত্তেজনায় :/ কলম কাঁপছে ঘামে ভেজা হাতে/ লবণ-এসপিরিন হাতে পুলিশ দ্রুত পা’য়/ আসে আর যায়/ আর চাপরাশিগণ; ভারি মুখ, ফ্যাকাশে মুখ, থামে ঘেরা জায়গায়/ খালি পায়চারি করে কফি-সিগারেট, কোকাকোলা নিয়ে।’ শুধু ধোঁয়া নয়, উত্তেজনাও বাতাসকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে – এই কল্পচিত্র সাধারণ নয়। কবিতাটিতে যে ভাবগম্ভীর পরিবেশের কথা বলা হয়েছে, উপহার দেওয়া হয়েছে যে-চিত্র তা পটু হাতেই অঙ্কিত।  The Laughing Hyena কাব্যগ্রন্থে বারবার লিখিত হয়েছে প্রবাসী জীবনের অভিজ্ঞতা। ‘মিশরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা’ শিরোনামের কবিতাটিও, মূলত, বিদেশবাসের  অনুভূতিসঞ্জাত। বইয়ের নামকবিতা থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করবো। শিল্পী হকু-সাইয়ের অাঁকা ‘হায়েনার হাসি’ কবিতাটির উৎসস্থল। কবি হায়েনাকে বর্ণনা করেছেন ‘বাকচতুর ভূত’ (Sententious phantoms) রূপে। সে অনিশ্চয়তার বোধে ও ক্রোধে আপ্লুত, লেখকের ভাষায় ‘Choked with rage and uncertainty’। কবিতাটি আরো মজাদার এবং অর্থবহ হয়ে ওঠে, যখন এনরাইট বলেন, ‘হায়েনা অন্তত এটা জানে যে সে কেন হাসে’, ‘It, at least, / Knows exactly why it laughs.’। প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এনরাইট আরেকটি কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। Bread rather than blossom (১৯৫৬) নামের এই বই লেখকের জাপানে অবস্থানকালে রচিত। এর মূলসুর হচ্ছে, প্রতীচ্যের মানুষ  হিসেবে প্রাচ্যকে অনুধাবন করার চেষ্টা। অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও সূক্ষ্ম রসানুভূতি এই বইয়ের প্রাণ যা বিষয়বস্ত্তর সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে গেছে।

ওই একই বছরে বেরিয়েছিল জন ওয়েনের কাব্যগ্রন্থ A Word Curved on a Seal। বইটি সম্বন্ধে অতিসংক্ষেপে এটুকু বলা যায় যে, লক্ষযোগ্য রচনাশৈলী ও সুপ্রযুক্ত শব্দসম্ভার একে সমকালীন অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ থেকে স্পষ্টত আলাদা করেছে।

‘The bad things’ নামে একটি কবিতা আছে এই বইয়ে, যা তাঁর সেরা কাব্যসমূহের একটি বলে মনে হয়েছে আমার। গভীর জীবনভাবনা কবিতাটিকে মহার্ঘ্য করে তুলেছে – ‘কখনো কখনো মনে হয় একলা থাকা খারাপ জিনিস।/ নিঃসঙ্গতা ফুলে-ফেঁপে উঠে সূর্যকেও আড়াল করতে পারে।/ এর কষ্ট এতটাই যে, ভয়ও চাপা পড়ে যায়,/ চাপা পড়ে অতীত ও আগামী নিয়ে উদ্বেগও।/ …তুমি যখন ভাবো খারাপ জিনিসের বাস নিজের মধ্যেই/ শুধু একা থাকা এমন কিছু নয়; প্রদাহ না, প্রলেপ না/ নিষ্কৃতি কবিতায় অথবা পানশালায়,/ বন্ধুর জন্য প্রতীক্ষার মধ্যেও কি এড়ানো যায় খারাপ জিনিস! তাকে যে উঁচু তাকে রেখেছিলে/ তা প্রশান্তির আশাসহ ভেঙে গেছে।/ গড়িয়ে পড়েছে।/ তা শেষ পর্যন্ত তোমার পিছু নেবে।’ কাব্যে ভাষাজনিত দুর্বোধ্যতার বিরোধী ছিলেন জন ওয়েন, কিন্তু তিনি ঠিক সাদামাটা ভাবের অতিমাত্রিক সারল্যের পক্ষেও ছিলেন না। ‘দুর্বোধ্যতার অষ্টম রূপ’ নামে ওয়েনের একটি কবিতা আছে যেখানে গভীর রসবোধ এবং বাকচাতুর্যের অদৃষ্টপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। ওয়েন বেশ কিছু প্রেমের কবিতাও লিখেছেন। এসব লেখায় ভিন্ন এক ওয়েনকে আমরা পাই। ‘Above all precious and remarkable’ কবিতার কয়েকটি লাইন সাক্ষ্য দিচ্ছে প্রেমের কবি হিসেবে তিনি কেমন – ‘Why should this chain of miracles be easier to/ believe/ Than  that my darling should come to me as naturally/ As she trusts a restaurant not to poison her?’

১৯৫৪ সালে বেরোয় টম গানের কবিতাবই Fighting Terms। টম যে বহুপাঠি লেখক তার স্বাক্ষর এই গ্রন্থের পাতায় পাতায় ছড়ানো আছে। লক্ষণীয় যে, রূপকের ব্যবহার তাঁর কবিতায় খুবই কম। ছন্দের ক্ষেত্রে নতুনত্ব নেই, সে-চেষ্টাও তিনি করেননি। উচ্চতর অর্থে বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োগ নিয়ে টম মাথা ঘামাননি, বরং সাধারণ বিচারবুদ্ধিকেই অসাধারণ দক্ষতায় ব্যবহার করেছেন। The Sense of Movement (১৯৫৭) কাব্যগ্রন্থে তাঁর সৃজনপ্রতিভা ধরা পড়েছে উজ্জ্বলতরভাবে। টম প্রধানত নাগরিক কবি। এজন্য শহুরে জীবনের অনুষঙ্গ তাঁর কাব্যে চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। যেমন এ-বইয়ের উদ্বোধনী কবিতা ‘On the Move’ পশ্চিমা দেশের মোটরসাইকেল চালক যুবকদের নিয়ে লেখা। এই যুবকদের গায়ে চামড়ার জ্যাকেট, মাথায় হেলমেট, চোখে সানগ্লাস, চেহারা সন্ত্রাসীর মতো। টম গান লিখেছেন, ‘মোটরবাইকে করে তারা আসে রাস্তা ধরে :/ গ্রীষ্মকালের ছোট ছোট মাছির মতো/ দূরত্ব তাদের সামনে নিক্ষেপ করে/ আর তাদের গুঞ্জন ধ্বনি ফেঁপে ওঠে ঊরু ও পায়ের স্থূল পেশির মাঝখানে’…  তিন-চার লাইন পরেই তিনি বলছেন, ‘পরিচিত জায়গায় থেকে রওনা দিয়ে তারা উড়ে চলেছে যেদিকে ‘টায়ার’ নিয়ে যায়।’ শেষের দিকে লিখেছেন, ‘প্রাকৃতিক সবকিছুকেই ইচ্ছাশক্তির কাছে নত হতে হবে।’ (অনুবাদ : লেখক)।

নাগরিক টমের নগরবন্দনা ‘In Praise of Cities’ কবিতায় কীভাবে বিধৃত হয়েছে দেখুন – ‘She wonders lewdly, whispering her given name,/ Charing Cross Road, or Forty-second street :/ The longest streets, desire that never ends,/ Familiar and inexplicable, wearing/ Cosmetic light a fool could penetrate.’

তার আরেকটি গভীর কবিতা হচ্ছে ‘Human Condition’। এখানে ওভারকোট পরা এক লোক কুয়াশার ভেতর হেঁটে যায়। এই লোক এবং তার হেঁটে যাওয়া মানবজীবনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। রাস্তার বাতিগুলো যেন আলো ফেলে না, শুধু একগজ কুয়াশার মধ্যে খুব কষ্টে একধরনের রশ্মি নিক্ষেপ করে। এই পরিস্থিতিতে লেখকের উপলব্ধি – ‘I am condemned to be/ An individual’। টম গানের নায়ক কিংবা টম নিজেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ দ্বারা চালিত। সে বহির্বিশ্বের সঙ্গে ব্যক্তিমনের বোঝাপড়ায় লিপ্ত। উদ্বেগি ও সংবেদী মন নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায় অনুমান-নির্ভর জ্ঞানের পথে – ‘I born to fog, to waste,/ Walk through hypothesis,/ An individual’.  তাঁর অন্যান্য বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে ‘Jesus and his Mother’, ‘Elvis Presley’, ‘Thoughts on Unpacking’, ‘The unsettled Motor-cyclist’s Vision of his Death’, ‘A Mirror for Poets’, ‘St Martin and the Beggar’ প্রভৃতি।

ডোনাল্ড ডেভির কাব্যগ্রন্থ আমাদের এখানে দুষ্প্রাপ্য। ইংরেজি কবিতার একটি সংকলনগ্রন্থ থেকে তাঁর পাঁচ-ছয়টি কবিতা পড়ার সুযোগ হয়েছিল। ডেভির উল্লেখযোগ্য কবিতাবই Brides of Reason বেরোয় ১৯৫৫ সালে। জন হলওয়ের মতো তাঁর কবিতাও বৈদগ্ধ্যমন্ডিত। অতীতের এজরা পাউন্ড কিংবা সমকালের এ. আর. অ্যামন্সের মতো কবিদের বেলায় দেখা গেছে বৈদগ্ধ্য অনেক সময় কাব্যের রসগ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডোনাল্ড ডেভির ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োগ অতটা পীড়াদায়ক মনে হয়নি। ধৈর্য নিয়ে সন্ধিৎসু মন নিয়ে পড়তে আরম্ভ করলে তাঁর কবিতার ভেতরেও মজা আবিষ্কার করা সম্ভব। প্রেমের কবিতা ‘Memories of Love’ থেকে একটি স্তবক – ‘Time passing, and the memories of love/ Coming back to me, carissma, no more mockingly/ Than ever before; time passing, unslackening,/ Unhastening, steadily; and no more/ Bitterly, beloved, the memories of love/ Coming into the shore.’ এবার ‘মভেরিকস’ গ্রুপের কয়েকজন কবির কথা আলোচনা করবো। ড্যানি অ্যাবস, মাইকেল হ্যামবার্গার, জন সিলকিন – তাঁরা সবাই মোটামুটি সহজবোধ্য ভাষায় কবিতা লিখেছেন। বৃহৎ বিষয়ের (Great theme) জন্য তাঁদের হা-পিত্যেস ছিল না। আত্মকেন্দ্রিকতা তাঁদের সকলেরই  কুলধর্ম। আশি ও নববইয়ের দশকে ব্রিটেনে একান্ত ব্যক্তিক অনুভূতির কবিতা যাঁরা লিখেছেন, এখনো যাঁরা লিখছেন তাঁদের পূর্বসূরি তাঁরা। ড্যানি অ্যাবস, অ্যান্টনি ক্রোনিনরা মনে করেন, উদাত্ত কণ্ঠের নয়, বরং নিচু কণ্ঠের কবিতার যুগ এটা। গাট্রুড স্টেইন তাঁদের সম্বন্ধে লিখেছিলেন ‘All belong to similiar types of ideas, despite, all are different from one another’। ড্যানি অ্যাবসের ‘Hunt the thimble’ কবিতা থেকে কয়েকটি লাইন – ‘Cold cold. Too domestic, too/ Temperate, too devoid of history./ Is it like a dark windowed street at night,/ The houses uncurtained the street deserted?/ Colder, you are getting colder,/ And too romantic, too dream-like./ You cannot describe it.’ পাঠক, নিশ্চয় খেয়াল করেছেন ড্যানির সহজ, ব্যক্তিগত লিখন ভঙ্গিমা। জন সিলকিনের কবিতাও রীতিমতো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত। তাঁর বিশিষ্ট কাব্যসংকলন Poems New and Selected বেরোয় ১৯৬৬ সালে। এই গ্রন্থের  অন্তর্ভুক্ত ‘Worm’ লেখকের একটি প্রতিনিধিস্থানীয় কবিতা। কৃমির মতো ঘৃণ্য জীব নিয়েও যে কবিতা লেখা যায় তা প্রমাণ করেছেন এই ভিন্নপথের যাত্রীরা। ‘Worm’ -এর প্রথম সাত পঙ্ক্তি এরকম – ‘Look out, they say, for yourself./ The worm doesnt./ It is blind as a sloe; its death by cutting,/ Bitter. Its oozed length is ringed,/ With parts swollen. Cold and blind/ It is graspable, and writhes/ In your hot hand; a small snake, unvenomous.’ স্তবকবিহীন এই কবিতার শেষ পাঁচ লাইন ভিন্ন রকম অর্থের দ্যোতনায় সমৃদ্ধ হয়েছে – ‘Made by a dead snail./ It has a life, which is virtuous/ As a farmer’s making his own food./ Passionless as a hoe, sometimes, persistent./ Does not want to kill a thing.’

সারল্যের চর্চা করেছেন মাইকেল হ্যামবার্গারও। তিনি শুধু কবি নন, সমালোচক এবং অনুবাদকও। তিনি বারোটি কাব্যগ্রন্থের জনক। Travelling নামে ১৯৬৯ সালে তাঁর একটি কবিতার বই বেরিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আধুনিক কবিদের ভাবপরিমন্ডল ও রচনারীতি নানাবিধ কারণে বহুস্তরান্বিত ও জটিল হয়ে ওঠে। কেউ কেউ এই অবাঞ্ছিত জটিলতার বিপরীতে সহজ গভীর শৈলীর পথ অনুসরণ করেছেন, অন্তত করার চেষ্টা করেছেন সাধ্যমতো। হ্যামবার্গার তেমনি একজন কবি। তাঁর অনেক কবিতাই কাব্যিক বর্ণনা ও কল্পনাবৈভব ফুটিয়ে তুলেছে নির্ভারভঙ্গিতে। সেজন্য তাঁর কাব্যে দেয়াল কেবলই দেয়াল নয়, তা নৈঃশব্দ্যের ধারকও। ‘Goldfish pond’ কিংবা ‘মৌমাছির স্থিরদৃশ্য’ও সেখানে লক্ষ করা যাবে – ‘Flowering tree or shrub in any Weathered city,/ Walls to contain a quietness, a quiver,/ fulfilment of the year, bees to be stilled./ Between two gusts, cold waves, the golden tide.’ (‘Homage to the Weather’)

পঞ্চাশের প্রজন্মের এই কবিদের রচনায়, সমূহ ভাবকল্পনা ও হৃদয়-বিক্ষোভের বৈচিত্র্য সত্ত্বেও সেই মানের সৃজনশীলতা আমরা পাই না যেমনটা দেখা গেছে এলিয়ট, অডেন, স্পেন্ডার বা ডিলান টমাসের বেলায়। ব্যতিক্রম বোধহয় একমাত্র ফিলিপ লারকিন। কিন্তু তাঁরা সকলে মিলে যে-বর্ণাঢ্য সৃষ্টিশীল বৃত্ত নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছেন তার মূল্যও একেবারে কম নয়। ব্রিটেনের ষাটের দশকের কবিতাও মোটামুটি এই ধারারই। পঞ্চাশের একাধিক কবি তাঁদের ওপর প্রভাব ফেলেছেন। ক্রেগ রেইন, ডম মোরেস, রবার্ট ওয়েলস প্রমুখের কবিতাই তার প্রমাণ।