ইও নলো সো

মাহবুব রেজা
কয়েকদিন ধরে ব্যাপারটা হয়ে আসছিল। ও আমাকে সহ্য করতে পারত না। আমার জায়গায় ওর দেশের এক ছেলেকে ঢোকানোর জন্য শেফ নাশা আমার ওপর বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। আমার কাজে-কর্মে সামান্য ভুল হলে ওটাই বড় করে মালিকের সামনে তুলে ধরত আর যাচ্ছেতাই ভাষায় আমাকে গালাগাল করত। ইতালিয়ান মালিক অ্যান্তোনিও তখন শেফের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে আমাকে সাবধান করে দিয়ে বলতেন, পল আতেন্তো (পল সাবধান)। উচ্চারণের সুবিধার জন্য এখানে সবাই আমাকে চপল না ডেকে পল বলে ডাকে।
আজ কাজে একটু দেরি করে যাওয়ায় নাশা বিড়বিড় করে বকছিল আমাকে। পেরফাভোরে, স্কুজা (স্যরি, আর এরকম হবে না) বলে আমি নাশার কাছে ক্ষমা চাইলাম। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হলো না।
ও আমাকে বকেই যাচ্ছিল। আমি সহ্য করে যাচ্ছিলাম। ও ওর মতো গালাগাল করেই যাচ্ছে। এক পর্যায়ে নাশা যখন আমাকে ‘মের্দা বাঙ্গালেজে’ বলে একটা জঘন্য বাজে গালি দিলো, তখন আমার মাথায় আগুন চড়ে গেল – আমি দেরি না করে হাতের সামনে ‘পাদেল্লা’ (হাতলঅলা ফ্রাইপেন) ছিল, তা দিয়েই ওর মাথায় বসিয়ে দিলাম এক ঘা। পাদেল্লার বাড়ি খেয়ে নাশার মাথার একদিক ফুলে ঢোল হয়ে গেল। মাথায় বাড়ি খেয়ে নাশা জোরে একটা চিৎকার দিলো। পাস্তারিতো পিজ্জারিতো রেস্টুরেন্টের মালিক অ্যান্তোনিও নেপোলির মানুষ। নাশার চিৎকার শুনে অ্যান্তোনিও ক্যাশ থেকে ছুটে এলো কিচেনে। নাশা তখনো মাটিতে পড়ে আছে। আমার হাতে পাদেল্লা দেখে অ্যান্তোনিও রেগে আগুন। কিচেনের বাকি চারজন চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে ওভাবে পাদেল্লা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওরা হয়তো ভাবছে – আরে, ছেলেটার হলো কী! যে-ছেলে কাজের আগে এসে ড্রেস চেঞ্জ করে দশ-পনেরো মিনিট হোটেলের বাইরের বেঞ্চিতে বসে একা একা সিগারেট খায়, তারপর সময় হলে কিচেনে ঢুকে কাজে লেগে যায়, কাজের সময় কারো সঙ্গে কথা বলে না – সেই ছেলেই কি-না কিচেনের শেফ নাশার মাথায় পাদেল্লা দিয়ে বারি মেরে দিলো! বিশেষ করে রোমেনা নামের ইউক্রেনের যে-মেয়েটি তিন সপ্তাহ ধরে কিচেনে আমার পাশে কাজ করত, ওর চোখ সবার চেয়ে বড়। বোঝাই যাচ্ছে, আমার এই কর্মযজ্ঞে এদের মধ্যে রোমেনা অবাক হয়েছে বেশি।
অ্যান্তোনিও সেকেন্ড শেফ ইন্দোনেশিয়ার একোকে জিজ্ঞেস করল, সত্যি করে বল, কী হয়েছিল?
অ্যান্তোনিওর কথায় এক্কো আমার দিকে তাকাল। তারপর অ্যান্তোনিওকে বলল, আমরা কাজ করছিলাম। কথা নেই, বার্তা নেই হঠাৎ করে পল পাদেল্লা নিয়ে এসে নাশার মাথায় বারি মেরে বসল। নাশার কোনো দোষ নেই বলে একো আমার ওপর একতরফাভাবে দোষ চাপানোর চেষ্টা করল।
ছ’মাস হলো মিকেলে কিচেনে ঢুকেছে। ওর বাড়ি মিলানে। একেবারে রেস্টুরেন্টের পাশে। বয়স একেবারেই কম। সতেরো-আঠারোর বেশি হবে না। দু-এক মাসের মধ্যে মিকেলে কিচেনের কাজে বেশ হাত পাকিয়ে ফেলেছে। কিচেনে কাজ কম থাকলে মিকেলে আমার এখানে এসে আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করে। কখনো কখনো আমি কোনো কিছু না পারলে বা না বুঝলে মিকেলে এগিয়ে আসে আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বলে, পল লাভোরো ননে মানো, লাভোরো কন তেস্তা (পল, হাত দিয়ে কাজ নয়, মাথা দিয়ে কাজ কর)। তারপর বিজ্ঞের মতো হেসে দেয়, আই কাপিতো (তুই বুঝছস)?
মিকেলে এতক্ষণ দেয়ালের সঙ্গে ঠ্যাস দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। এক্কোর পর অ্যান্তোনিও এবার মিকেলেকে জিজ্ঞেস করল, মিকেলে, কজা প্রবলেমা (সমস্যা কোথায়)?
মিকেলে অ্যান্তোনিওকে বলল, নাশা আইদেত্তো পল, তু ছেই উনো মের্দা বাঙ্গালেজে, পের কুজি পল ফারে কোয়েস্তো (নাশা বলল, পল তুই একটা হারামি বাঙালি – এর জন্য পল নাশাকে মেরেছে)।
মিকেলের কথা শুনে অ্যান্তোনিও রোমেনার মতো এক্কোর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল – এক্কো, কোয়েস্তো, ননে বেনে (এক্কো, তুই মিথ্যা বলেছিস, এটা ঠিক না)।
নাশা এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে মেঝেতে পড়ে থেকে সবার কথা শুনছিল আর গোঙাচ্ছিল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে অ্যান্তোনিওকে বলল, মিও তেস্তা তানতো দোলোরে, অজ্জি নন পোসো লাভোরো পের মে (আমার মাথা খুব ব্যথা করছে, আজ আমার পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়।)। ফোরসে দোমানি ইও দেবে আরিবো (সম্ভবত কাল আমি কাজে আসব।)।
নাশা আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে পোশাক পাল্টানোর ছোট ঘরে চলে গেল। আমি কিছু বললাম না। আমি কিচেনের ভেতরে যেখানে প্লেট, ডিশ, হাঁড়ি-পাতিল, চামচ, বাটি রাখার জায়গা, সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম নাশা ক্যাশে দাঁড়ানো রোমানিয়ান মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে দরোজা ঠেলে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল।
নাশা চলে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে হোটেলে লোকজন আসা শুরু হলো। নাশার অবর্তমানে এক্কোর শেফ হওয়ার কথা থাকলেও মিথ্যে বলার অপরাধে অ্যান্তোনিও ওকে বাদ দিয়ে মিকেলেকে ওই দায়িত্ব দিলো। দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার ধাক্কাটা শুরু হয় সোয়া বারোটা-একটা থেকে দুইটা-আড়াইটা পর্যন্ত। লোকজনের খাওয়া শেষ হলে হোটেলের কামিরিয়ারিরা (বেয়ারা) দুহাত বোঝাই করে রাজ্যির পিরিচ, হাফ প্লেট, ফুল প্লেট, বড় প্লেট, চামচ, ছুরি নিয়ে এসে আমার হাতের বাঁয়ে খোলা যে একটা তাক আছে, সেটা ভরে ফেলে। আমার প্রথম কাজ ওসব দ্রুত ওখান থেকে সরিয়ে ফেলা। তারপর প্লেট থেকে এঁটো খাবার ড্রামে ফেলে পানির পাইপ দিয়ে দ্রুত পরিষ্কার করে প্লেটগুলোকে একটা সারবাঁধা বক্সে দাঁড় করিয়ে মেশিনের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া। তারপর মেশিনের ডালাটা বন্ধ করে মেশিনের সুইচ অন করে চালু করে দেওয়া। মেশিনের ভেতর কেমিক্যালের প্লেট, চামচ সব পরিষ্কার হয়ে যায়। এক মিনিটের মধ্যে মেশিন বন্ধ হয়ে গেলে টান দিয়ে তা খুলে দিলে শেষ প্রান্ত দিয়ে প্লেটগুলো বেরিয়ে আসে। সাজানো প্লেটের বক্সে তখন চায়ের কাপে যেমন ধোঁয়া ওড়ে, তার চেয়েও ঢের বেশি ধোঁয়ার পসরা।
দুপুরের মধ্যভাগে কাজের গতি একটু কমে এলে দেখলাম রোমেনা আমার পাশে দাঁড়িয়ে চামচ, ছুরি, কাপড় দিয়ে মুছে ট্রেতে সাজিয়ে রাখছে, যদিও আমি জানি এটা ওর কাজ না। চামচ, ছুরি ট্রেতে ছুড়ে ফেলার সময় ঝনঝন করে শব্দ হচ্ছে। এই শব্দটা আমার ভালো লাগে। কেন ভালো লাগে জানি না। আমি রোমেনাকে কিছু বললাম না। নাশাকে হঠাৎ করে অমনভাবে পাদেল্লা দিয়ে মারার পর থেকে এমনিতেই আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে আছে। এর মধ্যে ঘণ্টাদেড়েক আগে দেশ থেকে বুলবুলি মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়েছে, ‘আমাকে আজ ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে, কী করব?’
বুলবুলির মেসেজ পেয়ে মন-মেজাজটা আমার আরো একপ্রস্থ খারাপ হয়ে গেল। আমি দেরি না করে বুলবলিকে এসএমএস পাঠালাম – ‘ইও নলো সো’ (আমি জানি না)।
বুলবুলি ‘ইও নলো সো’র অর্থ বোঝে।
আমার এসএমএসের পর ও পাল্টা লিখল – ‘চার বছর ধরে তোমার শুধু এক ডায়ালগ, ‘ইও নলো সো’, ‘ইও নলো সো’।’
হাতের কাজ কমে এলে রোমেনাকে কিছু বলতে যাব, তার আগে সে-ই আমাকে বলে উঠল, তু ছেই উনো ব্রাভো রাগাৎসো (তুই একজন বীরপুরুষ)। মি পিয়াসে কুজি (আমি তোর এই গুণকে পছন্দ করি)। বোঝা যাচ্ছে, নাশাকে পাদেল্লা দিয়ে মারার ব্যাপারটা রোমেনার পছন্দ হয়েছে। কাজে ঢোকার পর নাশা রোমেনার পেছনে কয়েকদিন ‘ছোক-ছোক’ করেছিল। রোমেনা নাশাকে পাত্তা দেয়নি বরং ছোক ছোক করার বিষয়টা ও অ্যান্তোনিওকে বলে দিয়েছে। রোমেনার প্রতি অ্যান্তোনিওরও একটা ঝোঁক আছে। রোমেনার কথা শুনে নাশার প্রতি অ্যান্তোনিওও ক্ষেপে আছে।
ব্রাভো রাগাৎসো! বীরপুরুষ! রোমেনার কথা শুনে আমার মনে হলো বুলবুলির ঘটনাটা ওকে খুলে বলি; কিন্তু চেপে গেলাম। আমি আর ওদিকে গেলাম না। দেহাতি গড়নের রোমেনা আমার গা-ঘেঁষে কামিরিয়ারিরা যেখানে এসে প্লেট রেখে চলে যায় সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। ইরিনা নামে একজন কামিরিয়ারিকে দেখে রোমেনা ওকে ডেকে আমাদের দুজনকে দুকাপ কাফফে দিতে বলল। কাফফের মেশিন ক্যাশ কাউন্টারের ভেতর।
অনেকক্ষণ ধরে আমারও কাফফে খেতে ইচ্ছে করছিল। সকালে বাসা থেকে বের হয়ে নিচের বারে এক কাপ কাফফে মারোক্কো আর একটা ব্রিয়স (ছোট ক্রিমযুক্ত রুটি বিশেষ) খেয়ে কাজে এসেছি। কাজে ঢুকে একটা কাফফে খেয়েছি – এর মধ্যে সিগ্রেট খাওয়া হয়েছে চারটা। আমি রোমেনাকে গ্রাৎসে (ধন্যবাদ) জানালাম। আমার কথায় রোমেনা মাথা নেড়ে বলল, পেরকে গ্রাৎসে? তু ননে মিও আমিকো (কেন ধন্যবাদ? তুই কি আমার বন্ধু!)
ছি, কমে নো (অবশ্যই, কেন না) বলে আমি ভালো করে রোমেনাকে দেখলাম। এমনিতেই ও দেখতে বেশ সুন্দরী। ইউক্রেন, রোমানিয়ার মানুষরা ভারতীয় সংস্কৃতির অন্ধভক্ত। ওরা এখনো রাজকাপুর-নার্গিস, অমিতাভ-রেখা, শাহরুখ খান-কাজল, সালমান খান-কারিনা কাপুর বলতে অজ্ঞান। হিন্দি গানও গায় বেশ – ‘মেরা জুতা হায় জাপানি’, ‘সোলজার সোলজার’, ‘ছাইয়া ছাইয়া’। রোমেনাও এর বাইরে না।
এ কি! রোমেনার নাকে নাকফুল ঝুলছে!
কী বেল্লা কারিনা! মাম্মামিয়া! কমে ইন্ডিয়ানো (কী সুন্দর! এ যে দেখছি একেবারে ভারতীয়!) – আমি রোমেনার নাকে নাকফুল দেখে বিস্ময় চেপে রাখতে পারি না।
সিকুরো! (সত্যি!) রোমেনা আমার মতো বিস্ময় প্রকাশ করে ওর প্রেমিক আন্দ্রের কথা বলল, মাগারে মিও ফুতুরো মারিতো নন পিয়াসেরে কোয়েস্তো (কিন্তু আমার হবু স্বামী এটা পছন্দ করে না)।
রোমেনা বলে কি! ফুতুরো মারিতো! ননে রাগাৎসো? (হবু স্বামী! প্রেমিক না?)
রাগাৎসো কমে মারিতো (প্রেমিকই স্বামী)।
ব্রাভিসসিমো (চমৎকার) আমি বললাম।
আমি আর রোমেনা যখন দাঁড়িয়ে কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা বলছিলাম, তখন কিচেন থেকে মিকেলে আমাদের কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে মৃদু হাসতে হাসতে বলল পল, ফাই ব্রাভো (দারুণ করেছিস)।
মিকেলে বয়সে আমার আট-দশ বছরের ছোট হবে। কিচেনে কাজ কম থাকলে মিকেলে কখনো মি. বিন, কখনো চার্লি চ্যাপলিন সেজে অভিনয় করে আমাদের হাসায়। একদিন অ্যান্তোনিও মিকেলের এরকম অভিনয় দেখে ফেলে হাসি সামলে রাখতে না পেরে হি-হি করে হেসে ফেলল।

দুই
সেই ঘটনার পর থেকে নাশা প্রয়োজন ছাড়া আমার সঙ্গে কথা বলে না। অ্যান্তোনিওর নির্দেশ, পলকে এখন থেকে কিচেনে যা বলার মিকেলে বলবে। অ্যান্তোনিওর এই ফরমানে আমিও বেঁচে গেলাম। কিচেনে এক্কো আর নাশা একজোট। আমি, মিকেলে আর রোমেনা একজোট।
দুপুরের পর আড়াই ঘণ্টার রিপোজো (বিশ্রাম)। এই সময়টায় আমি কষ্ট করে বাস-মেট্রো-ট্রামে করে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে বাসায় ফিরি না। রেস্টুরেন্টের পাশেই বড় এক পার্ক। পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে-বসে সময় কাটাই। সিগারেট খাই। দেশ থেকে আনা বই, ম্যাগাজিন ব্যাগেই থাকে – ওগুলো বের করে নামতা শেখার মতো করে পড়ি। এক জিনিস বারবার।
একদিন। পার্কের বেঞ্চিতে বই পড়তে পড়তে চোখটা ঘুমে প্রায় লেগে এসেছিল, এমন সময় আমি আমার কপালে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করি। চোখ খুলে দেখি রোমেনা আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাত আমার কপালে। রোমেনা একটা হালকা জলপাই রঙের পাতলা টি-শার্ট পরেছে। টি-শার্টের ভেতরে উজ্জ্বল হয়ে আছে সাদা রঙের ব্রা। ছাইরঙা ট্রাউজারের সঙ্গে ম্যাচ করে জুতো। গরমের সময় সূর্য অনেকক্ষণ থাকে বলে পার্কের সবুজ ঘাসগুলো জ্বলে গিয়ে পাকা গমের মতো হয়ে যায়।
আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে থাকি। রোমেনা প্রভাব খাটানো গলায় আমাকে বলল, নন বাই কাজা? পেরকে স্তারে কোয়া সেমপ্রে (বাড়ি যাস না? সবসময় এখানে বসে থাকিস কেন?)
আমি রোমেনার দিকে ভালো করে তাকালাম। রোমেনা দুপুরের রিপোজোর এ-সময়টা নিয়ম করে অ্যান্তোনিওর সঙ্গে কাটায়। অ্যান্তোনিওর আরেকটা পাস্তারিতো পিজ্জারিতোর রেস্টুরেন্ট রয়েছে পাশের শহর ভেরোনায়। অ্যান্তোনিওর বউ সিলভানো ছেলেমেয়ে নিয়ে ভেরোনাতেই থাকে। মিলানে অ্যান্তোনিও একা থাকে। অ্যান্তোনিয়ও একা থাকার সুযোগটা দেদারসে কাজে লাগায়।
রোমেনা পেছন থেকে ঘুরে এসে আমার পাশে বসল। গাছপালা ভেদ করে দুপুরের প্রখর রোদ যতটা সম্ভব আমাদের ওপরে এসে পড়ছে। এই রোদটা আমার ভালো লাগে। গা জ্বালা করে, তার পরও একধরনের অনুভূতি কাজ করে। রোমেনা আমার কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে নিল। ধরাল। তারপর গলগল করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, পল, তু ছেই মুলতো জেনতিলে (পল, তুই অনেক ভালো মানুষ)।
আমি রোমেনার কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করি না। আমি ভাবি, অ্যান্তোনিওর সঙ্গে রোমেনার সম্পর্ক – এই সম্পর্ক কি ওর হবু স্বামী আন্দ্রে জানে? এসব আমি রোমেনার কাছে জানতে চাইলে ও আমাকে বেশ স্বাভাবিক গলায় বলল, আমি আর আন্দ্রে এই মিলান শহরে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার তার সবই করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি – বলে রোমেনা বেশ তৃপ্তির ভঙ্গিতে সিগারেটে লম্বা একটা টান দিলো। রোমেনার মুখ থেকে সিগারেটের ধোঁয়া এঁকে-বেঁকে শূন্যে মিলিয়ে যেতে থাকল।
আমি রোমেনার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে থেকে বললাম, পেরকে (কেন)?
রোমেনা চুপ করে থাকল বেশ খানিকটা সময়। তারপর আমার দিকে মুখ করে অসহায়ের মতো বলল, পল, ইও নলো সো (আমি জানি না), ইও নলো সো (আমি জানি না) – বলতে বলতে রোমেনা আমার দিকে ওর হাত বাড়িয়ে চুপ মেরে গেল। রোমেনা কোনো কথা বলছে না।
আমি টের পেলাম, রোমেনা ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড কাঁপছে।