ইচ্ছেপূরণ নদী

বড় সেকালের মানুষ ছিল ব্রতীনের পিসি। বড় মান্ধাতার। এমন মান্ধাতার যে, নতুন কিছু নিতে গেলে তাঁর যত আপত্তি। অন্ধকারে গল্প করবে, তবু হ্যারিকেন জ্বালবে না। হ্যারিকেন মানবে, তবু দে লাইট মানবে না।

সেই পিসির ন্যাওটা বলে নাকি, পুরনো প্রীতি ভাইপোরও কম না।

তো পিসিমা, ছোটবেলায় ঘুম পাড়াতে গিয়ে ব্রতীনকে একটা গল্প বলত, কেশবতী কন্যার গল্প। মাঝে মাঝেই বলত গল্পটা।

গল্পটা ঠিক কেশবতী কন্যার, না রাজপুত্রের, নাকি ব্রতীনের, অথবা একটা নদীর, ঠিক ধরতে পারত না ব্রতীন। বিশেষ করে নদী হলে, তার নাম আর অবস্থানটা। তবে, ধরতে পারার বয়স তখন নয়। আর পিসিমারও অত দায় ছিল না বোঝানোর। ঘুম পাড়ানো নিয়ে কথা।

ভাইপো ঘুমিয়ে পড়লে ভাইবউ খুশি। ভাইবউ খুশি হলে বাল্যবিধবা ননদের রাতে ভাতের ব্যাপারটা নিশ্চিত। পিসিমা তাই গল্প বলত, অর্থ বোঝানোর ঝামেলায় যেত না। আর সবকিছুর যে অর্থ থাকতে হবে, এমন কোনো নিয়ম আছে নাকি দুনিয়ায়? তাকে তাহলে ভাতের জন্য ভাইবউয়ের মুখ চেয়ে থাকতে হবে কেন?

অর্থ থাকে না বলেই না কি, দুনিয়ায় কখন কী ঘটবে, কে বলতে পারে?

কেশবতী রাজকন্যা তাই স্নান করতে নদীর ধারে এসে বসে বসে কোনোদিন ঘাটের পাথরে গোড়ালি মাজতে মাজতে, কোনোদিন দীঘল চুলে আঙুল চালিয়ে গিঁট ছাড়াতে ছাড়াতে ভাবে, এ-জন্মে কোনোদিন কি আর কাঞ্চি রাজপুত্রের সঙ্গে দেখা হবে না? সেই যে রাজপুত্র সন্দীপন প–তের পাঠশালায় পড়ার শেষে বলেছিল, কেশবতী কন্যা, আমি তোমাকেই ভালোবাসি। তোমাকেই চাই। একটা বছর অপেক্ষায় থেকো, সপ্তডিঙা মধুকর সাজিয়ে তোমায় আমি নিয়ে যাব কাঞ্চির রানী করে।

সে একটা বছর কেটে গেছে কবে। দেখতে দেখতে আঠারো বছর পেরিয়ে গেছে আরো। আঠারো কিংবা কুড়ি বা বাইশ বছর, সেও পার হয়ে গেছে। রাজকন্যা তো বটে, ব্রতীনের জীবন থেকেও। কাঞ্চি রাজপুত্র আজো এসে পারেনি।

সময় বুঝি এমনি করেই প্রতিশ্রম্নতি গ্রাস করতে করতে যায়; থাকার মধ্যে স্মৃতি।

এর মধ্যে পিসিমার ভাতের সমস্যা মিটে যায় চিরতরে। ভাত দেওয়ার মানুষটাও থাকে না। হাজার সেই না-থাকার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া অজস্রের ডালি থেকে কেবল গল্পটা থেকে যায়, স্মৃতির মতো এবড়ো-খেবড়ো হয়ে। কিংবা গল্পের সেই নদীটা। মাঝে মাঝে স্মৃতি কিংবা ইচ্ছা থেকে নদীটাকে নামিয়ে আনে ব্রতীন, মেয়ের কাছে। ঘুম পাড়ানোর অজুহাত এখন আর নেই। ভাতের ভরসা করেও বসে থাকে না কেউ। কেবল নস্টালজিয়ার বাতাস লাগলে নদীটা সচল হয়। নাম না-জানা সেই নদী।

সেটারই বা অবকাশ কোথায়?

ব্যস্ততার জঙ্গলে কুলকুল ধ্বনি একটা বাজে, কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও সামনে আনার সময়ের বড় আকাল।

হয়তো সারাটা দিনের শেষে সব পাখি ঘরে এলে। ফাল্গুনের সন্ধেবেলা তাদের দক্ষক্ষণের বারান্দা থেকে ঘোড়ানিম গাছটার ওপারে তৃতীয়া তিথির চাঁদটাকে বাসমত্মী-বাতাসে তিরতির করে কাঁপতে দেখে ব্রতীন, সে-কাঁপন এসে লাগে তার মনে। সে-কাঁপনে নাম না-জানা নদীটায় যদি তরঙ্গ ওঠে, পুরনো কথার ঢল নামতে চায়।

কিন্তু সেসব কথা শোনার মন কার এত?

সন্ধে হলে সিরিয়াল চলে, সিরিয়াল শেষে পড়ার আয়োজন, পড়ার ফাঁকে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার ভিড় করে আসে। একটা কলেজে পড়ায় ব্রতীন, স্ত্রী অহনা স্কুলে, মেয়ে ব্রততী আইএসসি পার হলো এবার।

অহনা স্কুল থেকে ফিরে চা নিয়ে বসে সিরিয়াল শেষ করে। তারপর মেয়েকে নিয়ে বসে, তারপর রান্নাবান্না, খেতে দেওয়া, সংসারের হিসাবপত্র সেরে পরের দিনের মতো সবকিছু গুছিয়ে যখন একটু বসে, তখন ব্রতীনের অতীতের গল্প শোনার সময় কোথায় তার? সময় পেলেও ইচ্ছাই করে না। মায়ের মতো মেয়েরও তাই, স্মৃতিকাতরতায় আস্থা নেই। বলে বটে লোকজন, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে, দেখেছে কেউ?

তবু মেয়ের কাছে ব্রতীনকে কোনোদিন যদি পুরনো গল্পের ঝাঁপি একবার খুলতে দেখে, অহনা বিরক্ত হয়। অতীতে কী যে রাগ কে জানে?

– রাখো তো তোমার পুরনো কাসুন্দি, অকাজের কাজ যত। উঠপাখির মতো ফাটা ডিমে তা দিয়েই গেল। ক্যানো, ওসব বসত্মাপুরনো গল্প না বলে মেয়েকে একটু বাংলাটা বলে দেওয়া যায় না? সায়েন্সে না হয় অসুবিধা বুঝলাম। দর্শনের মানুষের বাংলা বলে দিতে কী সমস্যা? আড়া কাজ বাড়া করার তো ওসত্মাদ! পারে না হেলে ধরতে, কেউটে ধরতে যায়, নাও এখন বোঝো ঠ্যালা!

স্বভাবে একটু ঘরকুনো ব্রতীন, লাইট বা ফ্যানের একটা ফিউজ কেটে গেলেও মিস্ত্রি ডাকে। ভরাগরমে সারারাত হাতপাখা টেনে না ঘুমিয়েও সে বসে কাটায়, তবু মিস্ত্রি না এলে হাত দেয় না। এমনকি একটা বাল্ব বা টিউব কেটে গেলেও তাই। কিন্তু ওদিন কী  মনে করে রোববার বাজার সেরে এসে, টুল টেনে ফ্যানের ঝুল ঝাড়তে গিয়ে বাধিয়ে বসল বিপত্তি। কানায় পা পড়ে হাঁটু ভেঙে একাকার।

উঠতে দেখেই অহনা বারণ করেছিল, আদিখ্যেতা দেখে আর পারি না। একটা বাল্ব লাগাতে যদি মিস্ত্রি এসে চল্লিশ টাকা নেয়, তো তার সঙ্গে আরো দশ-বিশটা টাকা দিলে ফ্যানটা সে-ই পরিষ্কার করে দেয়। নাম কিনতে যাওয়ার কী আছে?

– নাহ্, আমি পারছি যখন, খামোকা দশ-বিশটা টাকা বেশি দেব ক্যানো? – বেশ জোরের সঙ্গে দাবি করেছিল ব্রতীন। দাবি পূরণও হয়ে গেছিল, কিন্তু নামতে গিয়েই বিপত্তি।

আর এখন অপারেশন করে বাড়ি এসে ছমাস গৃহবন্দি।

– ছমাসে সারলে তো? মেডিকেলের মেডিকেল যাচ্ছে, টাকার শ্রাদ্ধ।… তা এখন ঘরে যখন বসেই থাকতে হচ্ছে, শুধু শুধু ঘুম না দিয়ে, টিভিটা দেখা শুরু হোক আর মেয়েকে একটু বাংলাটা বলে দিলেই হয়। কলেজ যাওয়া শুরু করলে, তখন তো হাজার অজুহাত।

পাঠ্য বিষয় মানুষের স্বভাব গড়ে দেয়, না, স্বভাব মানুষের বিষয় ঠিক করে দেয়, বুঝে পায় না ব্রতীন। সংসারে থেকেও মাঝে মাঝে কোনো এক মন কেমনের বাতাস বড় উদাস করে তোলে ব্রতীনকে। একটু আনমনা হয়ে পড়ে, সে ঠিক তাল মেলাতে পারে না সংসারের সঙ্গে। চুপচাপ বসে থাকে একা। এটুকু বাদ দিলে সব দায়িত্বই তো পালন করে সে। তাহলে মেলাতে পারে না কেন, কে জানে?

অঙ্কের দিদিমণি অহনা। হিসাব কষা ছাড়া আর জানল না কিছুই। মেয়েটাও তাই। ম্যাথ নিয়েই পড়ার ইচ্ছা।

টিভিতে একবার তপন সিংহের ক্ষণিকের অতিথি সিনেমা দেখতে চেয়ে মা-মেয়ের যা মুখ শুনেছিল সে, সেই টিভি দেখা ব্রতীনের ঘুচে গেছে চিরদিন। মুখে কিছু বলেনি, দিনদশেক পর ফিলিপসের একটা রেডিও কিনে এনেছিল মাত্র।

রেডিও শোনা ব্রতীনের পুরনো অভ্যাস। তাদের গ্রামের বাড়িতে একটা কাঠের রেডিও ছিল। সারাবছর ঠুকে-ঠেকে চললেও, মহালয়ার আগে সারানো ছিল বাধ্যতামূলক। দাদারা চাকরি পাওয়ার পর নতুন রেডিও কিনলে, সেটা ছিল ব্রতীনের প্রায় নিত্যসঙ্গী। শহরে এসে অভ্যাসটা আর টানতে পারেনি ব্রতীন। সাংসারিক ঘেরাটোপে নাগরিক অভ্যাসে রেডিও কি মানায় নাকি? টিভিই একমাত্র মানানসই। কিন্তু ওদিনের পর অভিমানই তাকে জেদি করে তুলেছিল, রেডিও-ই এনেছিল কিনে। এনেছিল বটে, কিন্তু বাড়িতে যে সহ্য করানো কঠিন।

– কী যে পুরনো নিয়ে পড়ে থাকো? সামনে তাকাতে হয় বাবা, সামনে। রেডিও শোনার স্বভাব ছাড়ো। পুরনো নকিয়ার ওই হ্যান্ডসেটটা ফেলে দিয়ে একটা অ্যান্ড্রয়েড কেন। টাচ সেট। ওয়ার্ল্ড কোথায় এগোচ্ছে ভাবতে পারবে না। ওল্ড ছেড়ে নতুনকে মানতে শেখো। সাদা-কালোর যুগ আর নেই। বাংলা সিনেমাই এখন অনেক এগিয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকেই ব্রতীন চেহারায় যেমন পলকা, মনের দিক থেকে তেমনি দুর্বল। পাড়ায় মারদাঙ্গা দেখলে কোনোদিন তাকে এগোতে দেখেনি কেউ। পিসিমা ওর নাম দিয়েছিল ফঙ্গপেনে। ঘুম পাড়াতে গেলে পিসিমার অভিযোগ, এক গল্প প্রতিদিন কী যে শুনিস হতচ্ছাড়া! কোনো কিছু অাঁকড়ে ধরলে ছাড়তে চাস না।

সাত ভাইবোনের ছোট ব্রতীন, মা বলত, তা কুড়ানো বাছা তো আমার, অভিমানটা একটু বেশি।

কেবলই কি অভিমান? পুরনোকে কিছুতেই ফেলতে পারে না সে। বাড়ির পাশের নদী, গরু চরানো মাঠ, খোলা আকাশ, সবুজ ধানক্ষিত, মাঠজোড়া সর্ষের ফুল, ঘুড়ি ওড়ানো দুপুর আর দাদা-দাদিদের স্নেহে বেড়ে ওঠা জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত তাকে টানে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে টানার আরো কিছু বিষয় জমেছে মনে, কিন্তু সংসার এত সহিষ্ণু নয়। গাণিতিক সংসার। তাই নদীর কথা, সর্ষে ফুলের কথার মতো অকপটে ব্যক্ত করা যায় নাকি সব? ব্রতীন জানে।

তবু গোপন ইচ্ছার মতো একটা ভাবনা মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে মুখ বাড়ায়, একটা টাইমমেশিন যদি থাকত, তাহলে নিজেকে অতীতে নিয়ে গিয়ে বা অতীতকে সামনে এনে দেখত সে।

ভাইপোর এমন ভাবনা শুনলে হেসেই ফেলত হয়তো পিসিমা, হতচ্ছাড়া শুয়ে শুয়ে গল্প শুনতে গেলে পাঁচবারের বেশি সাড়া দিতে পারে না যে, সে আবার ম্যাশিন চেপে পেছনে যাবে, তা হলি কিনা হয়েছে!

পিসিমার গল্প বলার ওই এক ধরন, শুনলে হবে না, ‘হুঁ’ দিতে হবে। একটা করে বাক্য শেষে ‘হুঁ’ না দিলে, গল্প বলা বন্ধ। যতই ঘুম-পাড়ানো লক্ষ্য হোক, শ্রোতা ঘুমিয়ে পড়লে কথকের কি আর ভালো লাগে? পাশে বসে যাত্রী ঘুমালে কাঁহাতক আর ভালো লাগে ড্রাইভারের! ব্রতীন তবু ঘুমিয়ে পড়ত বেশিরভাগ। পিসিমা ডেকে দিলে আবার শুনত বটে, তবে তার সেই ঘুমের ফাঁক গলে শোনা কাহিনিতে আজকাল মাঝে মাঝেই কেশবতী কন্যার স্থানে জায়গা করে নেয় দর্শনের তমালিকা সেন।

সন্দীপন প–তের পাঠশালায় নয়, চন্দননগর কলেজেই ফার্স্ট ইয়ারের অনার্সের ক্লাসে প্রথম দেখা তমালিকার।

মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে-পরে, কোথা থেকে মনের মধ্যে তখন ঝাঁক ঝাঁক রঙিন প্রজাপতির আনাগোনা। পরে বুঝেছে ব্রতীন, দোষটা মাধ্যমিক পরীক্ষার নয়, ওই ষোলো ছুঁইছুঁই বয়সটার। বাড়ির পেছনের বিশাল কলাবাগানে তখন যখন-তখন যেন ঝড় হয়, নদীর ওপার থেকে দখিনা বাতাস এসে দাপিয়ে বেড়ায়। দুপুরে উদাস তো বিকেলে মনের বিষণ্ণতা আর কাটে না! এ-সময়ই, দাদার আনা দেশ পত্রিকার পুরনো কোনো পাতায় দেখা কেয়োকার্পিনের বিজ্ঞাপনের ছবিটা মনের কোথাও যেন গেঁথে গেছিল তার। দীঘল বিনুনি আর পানপাতা মুখ। দুটো চোখ যেন বুদ্ধিতে মুখর। সে যে এমন তমালিকা সেন বুঝবে কী করে ব্রতীন!

কিন্তু কিছু কিছু মুখ থেকে যায় মানুষের মনে। কিছু কিছু চোখ প্রথম দেখায় মনে হয় অনেককালের চেনা। ভালো না বেসে থাকা যায় না বুঝি। তমালিকাকে দেখে তেমনি কিছু মনে হয়েছিল তার।

তবু সে-কথাটা জানাতে যার দু-দুটো বছর লেগে গেল, সে-কথাটা পুরনো গল্প বলে হিসাবের সংসারে আজ ব্যক্ত করবে, এমন বেহিসাবি অন্তত নয় ব্রতীন।

পুরনো ক্ষতের মতো মনের গোপন দীর্ঘশ্বাসটুকু তাই নিজেই বহন করে সে। সংসারের দৈনন্দিনতায় ওই দীর্ঘশ্বাসটাই তার লালিত অহং। বাস্তবের মুখোমুখি হতে হতে সে-অহংয়ে চিড় ধরে, ক্ষয় আসে; তবু পেতে পেতে লক্ষ্মীর ভা-ারের শেষ মুদ্রাটার মতো থেকে যায় কিছু।

ওদিকে শেষ কথা-কটা অতন্দ্রপ্রহরীর মতো বুকে আগলে বসে থাকে কেশবতী কন্যা। জানে সপ্তডিঙা মধুকর আর আসবে না কোনোদিন, কিন্তু জগদ্দল স্টেশন দিয়ে দিনের পর দিন, একটার পর একটা চলে যাবে কল্যাণী সীমান্ত, অথচ ব্রতীন আসবে না, সেটাই যেন বিশ্বাস হয় না তমালিকার।

কেবল কি আর সীমান্ত লোকাল? এর মধ্যে জীবনের গল্পও যে কিছুটা পার হয়ে গেছে, জানে না ব্রতীন।

পিসিমা বিরক্ত হয়, অমন ঘুমিয়ে পড়লে আর জানবি কী করে মাঝখানের গল্প? তুই যে হতচ্ছাড়া ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ‘হুঁ’ দিস, বুঝব কীভাবে?

সত্যি জেগে থাকলেও কি বুঝত না কি? জেগে থেকেই-বা কতটা বুঝেছে সে? রাজপুত্র তো কথা দিয়ে ঘরে গেল। – সে-কথার অর্থ হারিয়ে গেল কোথায়! – বাবা-মা তো তার আগে পাশের দেশের রাজাকে কথা দিয়েছে, তাঁর কন্যাকে পুত্রবধূ করে আনবে। কাঞ্চি রাজপুত্রের অবস্থা যেন খাঁচায় পোরা পাখি।

ওদিকে গঙ্গা দিয়ে কত জল যে গড়াল, দিনের পর দিন কত ট্রেন এলো আর গেল। কেশবতী তমালিকার দীর্ঘশ্বাসই সার। অথচ দেখা হওয়ার দুবছরের মাথায় ব্রতীন যেদিন তার হৃদয়ের গোপন ভারটি নামাল, সেদিন ভরা বসন্ত। শনিবারের বারবেলা, স্টেশনের রেডিওতে শ্রাবমত্মী মজুমদারের ‘মনে রাখা গান, মনে রাখা কথা’।

ব্রতীন তো ভয়ে মরে, রাগ করবে নিশ্চয়, তবে সব শুনে তমালিকা বলেছিল, ঠিক আছে, অস্বীকার করি না হৃদয়ের কথা, কিন্তু সে-বয়স যে পেরিয়ে এসেছি কবে!

– বোঝা গেল না, ভালোবাসার বয়স থাকে না কি?

– আমি যে সঞ্জয়কে ভালোবাসি ব্রতীন, সঞ্জয়ও…

সঞ্জয়ের নাম তমালিকার মুখে আগেও যে শোনেনি, বা তাকে যে দেখেনি ব্রতীন, এমন নয়। কিন্তু এতই নিরীহ সে-সহাবস্থান, কিংবা এতই নির্বোধ সে, যে, কল্পনায় কুলায়নি তার।

গঙ্গার ধার বরাবর রাসত্মাটাতে সেদিন কৃষ্ণচূড়ার মাথায় মাথায় আগুন ধরেছে। মেহগনির পাতায় পাতায় লালিত্যের ঢল। চারদিকে ফরাসি উপনিবেশের ভগ্নাংশ, বেশ বাঁধানো একটা ব্যাকগ্রাউন্ডে হৃদয়টা উন্মুক্ত করেছিল ব্রতীন, কিন্তু প্রতিক্রিয়া যা পেল, তাতে ধরণি দ্বিধা হও বললেও, পায়ের তলার পথটা খোয়া-বাঁধানো বলে নাকি, দুভাগ হলো না।

পাতাল প্রবেশ স্থগিত থাকায়, নাকি কিসের যে-মায়ায়, ব্যক্ত করা অনুরাগ ধাক্কা খেয়ে থমকে গেলেও, বন্ধ হলো না পুরো। প্রথম দেখার পর থেকে মনের মধ্যে তিলতিল করে যে-আশা, যে-অনুরাগ সে জমিয়েছিল, তারই রেশ ধরে নাকি, দুবছর বাড়ির পাশের দিগন্ত প্রসারিত মাঠটাকে সারাবছর কেবল সবুজই দেখল ব্রতীন। মাঠের পাশের নদীটাকেও তেমন, ক্ষামিত্ম নেই তার একমুখী প্রবাহে। আর সবকিছু জেনেও তবু মাস্টার্সের দুটো বছর প্রায় একমুখী প্রবাহই চলল। বই থেকে ক্লাস নোটস, তৈরি নোটস সব একমুখী প্রবাহে ছুটে চলল। এ-কদিনে মায়ার শিকড় যে বহুদূর বিসত্মৃত।

পরিচিত বন্ধুরা বলল, অন্তহীন। এর কোনো মানে হয় না, যা কোনোদিন সম্ভব নয়, তার পেছনে ছুটে কী লাভ?

কিন্তু এত বড় দুনিয়ায় সবই যদি অর্থহীন; অপেক্ষা, ত্যাগ, ধৈর্য শব্দগুলোর মূল্য থাকে না।

অর্থটা বোধ করি প্রকট হলো একদিন, অস্থির সঞ্জয় উচ্চশিক্ষার অজুহাতকে যেদিন হাতিয়ার করল।

সে তো তখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কোনো এক শাখায় হিসাবরক্ষক। অর্থের পালস্নায় জীবনকে মাপে। ধৈর্যের চেয়ে ভাত ছড়িয়ে কাকডাকার দিকে তখন তার ঝোঁক। কবে তমালিকা পড়া শেষ করবে, ততদিন অপেক্ষা তার পোষায় না। এমনিতেই এমফিলের বায়না দেওয়া আছে, বিএড চলবে পাশাপাশি, তারপর আসবে পিএইচ.ডির আবদার। বোগাস যত্তসব!

– বাবা-মায়ের পছন্দের চেয়ে তোমার নিজের পছন্দ এত বড় হয়ে গেল? কেশবতীর ভূত, মাথা থেকে নামাও। সাতদিনের মাথায় তোমার বিয়ে। পাশের রাজ্যের রাজকন্যার সঙ্গে।

রাজপুত্রের গল্প বলতে বলতে পিসিমা খোঁচায় ব্রতীনকে। শুনচিস হতচ্ছাড়া, নাকি ঘুম?

– হুঁ – ঘুমিয়েই পড়েছিল ব্রতীন।

ঘুম ভাঙল আলিপুর ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথে সেদিন গোপালনগরের মোড়ে সঞ্জয়ের সঙ্গে তমালিকাকে কথা বলতে দেখে। কাঞ্চিরাজের অধৈর্য বুঝি ব্রতীনকে ছোঁয়। পিসিমার গল্প তো ঘুমের মধ্যে শোনা, আর এ-দেখা তো দূর চোখে, অভিমানী মনে।  – দুটোই ঝাপসা, অস্পষ্ট। – তাই কোন কথার যে কোন অর্থ করে! বিচ্ছেদকে মিলনভাবে। – এতদিন অহেতুক মিথ্যার জাল বোনা! – ব্রতীন ভাবল বন্ধুরাই ঠিক, ঠিক আছে, সুখী হোক ওরা, বলে, নোঙর-ছেঁড়া নৌকো, ভাসিয়ে দেয় স্রোতে। যে পারে ধরুক!

ধরুক তো বটে! জীবন যে একটা মুদ্রার দুটো পিঠ। মুখোমুখি বসা অসম্ভব। ভুলগুলো সব নিজের মতো খেলে।

সেদিন সাক্ষাতে সঞ্জয়ের পুরুষতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসছিল তমালিকা, ভরসা একটা ব্রতীনের পাগলামো।

কিন্তু ঘুমের ঘোরে শোনা পিসিমার গল্পের মতো দূর থেকে দেখা দৃশ্যে ব্রতীনের মধ্যে তখন তো কেবল ব্যর্থ প্রেমিকের হতাশা আর অনুমাননির্ভর সন্দেহ। সঞ্জয়ের থেকে তমালিকার সরে আসা ব্রতীন জানল না, তমালিকা থেকে ব্রতীনের সরে যাওয়া তমালিকাও না। অথচ অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার অসিত্মবাদে ছিল দুজনের অগাধ আস্থা।

কবিতা হারালে পথ, কোন গদ্য যে লেখে জীবন-কথাকার! জল পড়ে, পাতা নড়ে। সূর্য ওঠে, ডুবে যায়। ষোলোকলায় চাঁদের    হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। নীরব অভিমানে অখ- পৃথিবীটা হয়ে যায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। মাঝখানে বিরহের অতলস্পর্শী সাগর। সাগরের তলা থেকে মুক্তো খুঁজে আনা যায়; মানুষের মনের কথাটি খুঁজে আনা ডুবুরির অসাধ্য।

সঞ্জয়ের সঙ্গে তমালিকা সুখে আছে ভেবে পিএসসি দিয়ে সরকারি স্কুলে চাকরি নিয়ে জলপাইগুড়ি চলে গেল ব্রতীন। অহনাও সমান্তরাল প্যানেলে আগের মাসে জয়েন করেছিল মেয়েদের বিভাগে। নোঙর-ছেঁড়া নৌকোটা সে-চড়ায় ঠেকে গেল।

আর তারপর সংসারের অভ্যস্ত দৈনন্দিনতায় প্রতিদিন যে-মরু তৈরি হয় মনের মধ্যে, তার মাঝে এক টুকরো প্রাণের আশ্বাসের মতো বিকেলের পড়ন্ত আলোয় জগদ্দল স্টেশনটা বুঝি খুঁজতে থাকে কেউ। কল্যাণীতে বিএডে ভর্তি হয়ে কেশবর্তী তমালিকা রোজ ভাবে ব্রতীন একদিন না একদিন আসবেই। অমন পাগল না এসে কি পারে?

হায় রে অমিয় চক্রবর্তীর অসিত্মবাদ! ঝোড়ো হাওয়ায় ভাঙা দরজার পালস্নাটা কেবল কল্পনার ডানা ঝাপটে গেল!

অনেক হয়েছে ডানা ঝাপটানো, আর না। বাবা-মা জোর করেই পালস্নাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিলো সংসারের গরাদে। ঝাপটা থামতেই পৃথিবীটা হয়ে গেল নিয়মের দাস। জীবনটাও নিয়মের সাব-অর্ডিনেট। বিরহ, কর্তব্য আর অভ্যাসের চড়ায় ফল্গুধারা।

সেইমতো বাজার করে, ক্লাস নেয়, দায়িত্বে কোনো ফাঁক রাখে না ব্রতীন। কেবল স্কুল পালটে কলেজ হয়, অবতরণ ঘটে সমতলে। অহনাও সরকারি ছেড়ে স্পনসর্ডে নেমে আসে। তা করতেই কত কাঠখড় পোড়ে। মাথার কত ঘাম ঝরে। মেয়ে আসে সংসারে। তাকে লালন-পালনে কেটে যায় আরো আঠারোটা বছর।

তবু ছিঁড়ে আসা নোঙরের মায়া, যে আনমনা তৈরি করে, তা কি আর আটকানো যায়? স্থান-মাহাত্ম্য যে ঘনীভূত, কলেজ তো ব্যারাকপুর। তাই চন্দননগরের গঙ্গার ওপর মেঘ জমে, বৃষ্টি হয়। কখনো কখনো মনে হয়, কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলাধারে।

তার মাঝে আনমনাতেই টুল থেকে পড়ে গিয়ে পা ভাঙতেই অহনার ঝাঁজ ওঠে, টিভি তো দেখ না, কেবল রেডিওতে কান গুঁজে ছমাসের বন্দিদশা কাটবে কী করে?

– কেটে যাবে। – নতুনকে কিছুতে সে নিতে পারে না যে।

আপত্তি টেকে না তার।

তারপর মেয়েই জোর করে কিনে দেয় স্যামসাংয়ের জে-সেভেন। সঙ্গে জিওর ফোরজি সিম। মেয়ের কম্পিউটারে অ্যালায়েন্স নেট, ওয়াইফাই।

– পুরনো দিনের গান আর সিনেমা এখানে প্রচুর পাবে বাবা। শুনে শেষ করতে পারবে না। যা গান শুনতে ইচ্ছা করবে, যে-সিনেমা দেখতে, ইউটিউবে লিখে সার্চ করলেই পাবে। ফেসবুক খুলে দিচ্ছি, হোয়াটসআপও। সময় কোথা থেকে কেটে যাবে, বুঝতেই পারবে না। দেখবে এ-তোমার ইচ্ছেপূরণ নদী।

চারপাশে মানুষজনের নিজস্বী তোলার হিড়িক, মোবাইলে ডুবে থাকা, সোশ্যাল মিডিয়ায় পারস্পরিক আত্মকু-য়ন কিছুতেই মানতে পারে না ব্রতীন। তবু মেয়ের দেওয়া এমন কামরূপী বস্ত্তটা নেব না নেব না করে খারাপ লাগে না। সাতদিনেই প্রায় সব ব্যবহার শিখিয়ে দেয় মেয়ে। কেমন যেন জাদুদণ্ডেরমতো মনে হয় মোবাইলটাকে। মনে হয় পিসিমার রূপকথার সোনারকাঠি। হাতে নিয়ে ঘোরালেই ইচ্ছামতো ফল দেয় সে।

দিন পনেরো পর, মা-মেয়ে বেরিয়ে গেলে, ইচ্ছাকাঠি-হাতে হঠাৎ একদিন ঘোরের মধ্যে পড়ে যায় ব্রতীন। ওয়াইফাই অন।

মনে হয় চারপাশে ঘরভরা ইথারের নদী, ইথারের তরঙ্গ। কত কথা ভাসে তাতে। কত ছবি, কত গান! সেই ছবি, গান আর কথার তরঙ্গে কটা কথা খুঁজতে বের হয় সে, পরীক্ষা শেষের দিনে তমালিকার শেষকটা কথা, কল্যাণীতে বিএড পড়ব। আশা করি দেখা হবে। বন্ধুত্বটা রাখবি।

মেয়ের খুলে দেওয়া ফেসবুকের সার্চ বাটন খুলে ব্রতীনের মনে হলো, ঘরের মধ্যে ঠিক যেন পিসিমার গল্পের নদী, গল্পের নয় পুরোপুরি, গ্রামের বাড়ির রান্নাঘরের পেছন থেকে বয়ে যাওয়া নাম না থাকা নদীটির পাড়ে সে বসে। গ্রামের নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ওপারের বন্ধু রতন রথীর চিন্ময়দের নাম ধরে ডাকলে, ওপার থেকে ওরা সাড়া দিত, ওরা ডাকলে ব্রতীনও। সে-ভরসায় ইথারের এই নদীর পাড়ে, আজ নাম ধরে ডাকে ব্রতীন, তমালিকা সেন, এমএ দর্শন। উনিশশো নববই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

সত্যিই জাদু!

ডাকতেই, লহমায় তমালিকা সেনের একটা সিরিজ চলে আসে ফেসবুকের সার্চ অপশনে।

বনলতা তমালিকাকে চিনতে দেরি হয় না, হোক না যতই সে দত্ত, চোখদুটো কি আর ভোলার নাকি?

দ্বিধা থরথর মনে, রিকোয়েস্টে ক্লিক করে তর যেন আর সয় না তার।

সারাদিন, দিনের পর দিন সংশয়ের অতলান্ত অন্ধকার। চাকরির পরপরই তার বিয়ের খবরটা আর কানাঘুষো হয়ে যায়নি নাকি তমালিকার কানে? অনেক পরে, তাদের বন্ধু বন্দনা বলেছিল, তোর পিকনিকের ছবিটা কিন্তু তমালিকাই রেখেছে যত্ন করে।

হায় রে জীবন! পালে তখন বাতাস লেগেছে জোর।

বাতাস শান্ত হতে কানে যেন ভেসে আসে পিসিমার গলা – এত তাড়াহুড়োর কী আছে রে হতচ্ছাড়া? বলছি শোন, তারপর স্নানের সময় মাথার একটা উঠে যাওয়া চুল মরা শামুকে জড়িয়ে ছেড়ে দিলে কন্যা, সে-শামুক একদিন ভাসতে ভাসতে গিয়ে পড়বি তো পড়, কাঞ্চি রাজপুত্রের হাতে। যে-নদীতে কন্যা স্নান করে,
সে-নদীর কাঞ্চির ঘাটে স্নান করছিল কাঞ্চিরাজপুত্র।

– নদীর নামটা কী পিসিমা? কোন নদীতে কেশবতী ভাসালো শামুক, বলো বলো পিসিমা, কী নাম নদীটার? একবার বলো – অত কি আর মনে আছে ছাই। যা ভাববি তাই।… দাঁড়া বাবা, আমারই আজ ঘুম পাচ্ছে খুব।

পিসিমার সে-ঘুম আর ভাঙেনি কোনোদিন, গ্রামের সে-নদীটাও মজে গেছে প্রায়। তবু ঠিক ছমাস পর, ডাক্তারের লিখে দেওয়া ডেটে, যেদিন আর জয়েন না করলেই নয়, সেদিন বের হতে যাওয়ার মুখে হঠাৎ ফোনে একটা বার্তা এলো ব্রতীনের। রিকোয়েস্ট আকসেপ্টেড। ইউ আর নাউ ফ্রেন্ড উইথ তমালিকা সেন দত্ত।

রাসত্মার পাশে কৃষ্ণচূড়া ফুটল নাকি থোকা ভরে? জগদ্দল স্টেশনটা উঠল বুঝি দুলে? অনেকদিন পর বের হচ্ছে বলে নাকি, সারাশরীরে এক অদ্ভুত কাঁপন। মনে সংশয়, পারবে তো বের হতে?

তবু আজ কলেজ যেতে, ব্যারাকপুরে না নেমে, জগদ্দলে কখন যেন চলে গেল ব্রতীন। স্টেশনে নামতেই, বাসমত্মী-বাতাসে আজ শ্রাবমত্মীর গলা, মনে রাখা কথা, মনে রাখা গান।

আর তারপর, ট্রেনটা বেরিয়ে যেতে, ভিড়টা একটু পাতলা হতে, পিসিমার গল্পের নদীর নামটা হঠাৎ যেন জেনে গেল ব্রতীন।

না। আজ আর কিছুতেই কলেজ যাবে না সে।