ইতিহাসের ছবি

সাগর চৌধুরী

দক্ষিণ কলকাতায় আমাদের আবাসের  যে-ঘরটিতে বসে মাঝেমধ্যে আমি লেখালেখির খেলা খেলি, তার একটা দেয়ালে একটা ছবি টানানো আছে। পেইন্টিং বা হাতে-অাঁকা ছবি নয়, ফটোগ্রাফ, আলোকচিত্র। ছবিটা অনেকদিন ধরেই আমাদের কাছে রয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে আমাদের এক আমেরিকান বন্ধু লন্ডনে আমাদের অতিথি হয়েছিলেন সপ্তাহ দুয়েকের জন্য। তিনিই কোনো একটা পুরনো জিনিসপত্রের দোকানে এ-ছবিটা দেখতে পেয়ে কিনে এনে আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। হালকা বাদামি রঙের কাঠের ফ্রেমে কাচে বাঁধানো এ-ছবিটা সত্যিই যথেষ্ট প্রাচীন, এবং দুর্লভও। সম্ভবত সময়ের প্রকোপেই সামান্য হলদেটে হয়ে আসা সিপিয়া রঙের ব্রোমাইড প্রিন্টের আলোকচিত্রটিতে দেখা যাচ্ছে গ্রামবাংলার কোনো এক জায়গায় একটা খোড়ো চালের মাটির বাড়ি। তার চারদিকে ঘিরে কয়েকটা তাল আর খেজুর গাছ। সামনে ছোট্ট উঠোনের পর একটা মাঝারি আকারের পুকুর। বাড়ির দাওয়ার সামনে দাঁড়িয়ে খাটো ধুতি পরা গায়ে সাদা চাদর জড়ানো জনাতিনেক পুরুষ। তাদের কিছুটা পেছনে পরনে শাড়ি আর মাথায়  আধ-ঘোমটা টানা একজন মহিলা। কারো মুখচোখই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। তবে গাত্রবর্ণ ময়লা বা শ্যামলা। পুকুরের জলে তাদের, গাছপালার ও বাড়ির প্রতিবিম্বও দেখা যাচ্ছে। ছবির পেছনদিকে ফ্রেমের গায়ে সাঁটা একটা ছোট স্টিকারে কোনো ধরনের অনপনেয় কালি দিয়ে ইংরেজিতে প্রথমে লেখা আলোকচিত্রীর নাম ও একটা তারিখ – ঠিক তারিখ নয়, কেবলমাত্র সাল – তার নিচে ছবির নাম : Village Life in Bengal. এ-পর্যন্ত ঠিকই আছে। অবাক হওয়ার মতো কিছুই নেই। এমন চেহারার গ্রাম্য কুটির বা গ্রামবাসী আজো এপার-ওপার দুই বাংলারই গ্রামীণ অঞ্চলে প্রচুর দেখতে পাওয়া যায়। অবাক করে দেওয়ার মতো আসল জিনিস হলো, আলোকচিত্রীর নাম ও তার পাশে লেখা সাল : Samuel Bourne, 1865. চিন্তা করে দেখুন, স্টিকারের গায়ে লেখা অতি সংক্ষিপ্ত তথ্য যদি সত্যি হয় – এবং তা না হওয়ার কোনো কারণ নেই – তাহলে এই আলোকচিত্রটি তোলা হয়েছিল আজ থেকে ১৪৯ বছর আগে, আধুনিক ক্যামেরার আদি সংস্করণ ‘ক্যামেরা অবস্কিউরা’ (camera obcura) নামক যন্ত্রটির সাহায্যে প্রথম ছবি তোলার ৪৩ বছর পর। ওই সময়ে অবশ্য আলোকচিত্রকে ‘ফটোগ্রাফ’ বলা হতো না। তখন তার একটা নাম ছিল ‘ফটোগ্রেভিওর’ (photogravure)। সে-যুগের কারিগরি দক্ষতার নিরিখে এটা ছিল বেশ জটিল একটা প্রক্রিয়া। খুব সহজভাবে বলতে গেলে, কাচের বা ধাতুর পাতলা, প্রায় স্বচ্ছ পাতের ওপরে ‘এচিং’ বা ‘এনগ্রেভিং’য়ের অর্থাৎ খোদাই করা নকশার ছবি তুলে ছাপানো। যে-ব্যক্তিকে এই পদ্ধতির জনক হিসেবে আজকাল ইতিহাসবিদরা মনে করেন, তিনি হলেন ফরাসি বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক যোসেফ নিসেফোর নিপ্সে (Joseph Nicephore Niepce)। ছবি তোলার জন্য নিপ্সে ক্যামেরা অবস্কিউরা যন্ত্রটির সামান্য অদলবদল করে নিয়েছিলেন এবং ১৮২২ সালে তাঁর তোলা পোপ সপ্তম পায়াসের (Pope Pius VII) প্রতিকৃতিটিই বিশ্বের সর্বপ্রথম ফটোগ্রেভিওর এচিং হিসেবে স্বীকৃত। ছবি ছাপানোর জন্য নিপ্সে যে-প্রক্রিয়া ব্যবহার করতেন তাকে তিনি বলতেন ‘হিলিওগ্রাফি’ (heliography), যার আক্ষরিক অর্থ হলো ‘সূর্যালোকের সাহায্যে লেখা’ (helio = সৌর বা সূর্য, graphy = নকশা বা চিত্রলেখ প্রক্রিয়া)। অর্থাৎ যার ওপরে ছবি ছাপানো হবে, তার গায়ে কোনো রাসায়নিকের (নিপ্সে ব্যবহার করতেন সিলভার ক্লোরাইড কিংবা বিটুমেন আর ল্যাভেন্ডার তেলের একটা মিশ্রণ) প্রলেপ লাগিয়ে নকশাকে তার ওপরে রেখে বেশ কিছুক্ষণ প্রখর রোদে ধরে রাখতে হতো। এভাবে ছবি ছাপাতে সময় লেগে যেত প্রায় সাত-আট ঘণ্টা।

ফটোগ্রাফির দুনিয়ায় স্যামুয়েল বোর্নের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে যে কারণে তা হলো, তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ফটোগ্রাফিক স্টুডিওগুলোর একটার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। কেবল তাই নয়, তাঁর এই স্টুডিও বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ফটোগ্রাফি ব্যবসাও – ১৮৬৩ সালে প্রথম খোলার পর থেকে আজ পর্যন্ত এটা চালু রয়েছে। মধ্য কলকাতার এসপ্ল্যানেড রোতে অবস্থিত এই স্টুডিওর নাম ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’ (Bourne & Shepherd)। দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে এ-প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এই সময়ের মধ্যে তার ঠিকানা একাধিকবার বদলেছে। কলকাতার স্টুডিও প্রথম খোলা হয় ১৮৬৫ সালে যখন তার ঠিকানা ছিল ৮ নং চৌরঙ্গী রোড, তার কিছুদিন পর একই রাস্তায় ১১ নং বাড়ি, তারও পর ১৮৬৭ সাল থেকে শুরু করে আজ অবধি ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’ কোম্পানির ঠিকানা ১৪১ নং সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোড (সাবেক করপোরেশন স্ট্রিট), কলকাতা ৭০০  ০১৩। একটা সময়ে, যখন স্টুডিওর ব্যবসা খুব ভালো চলছে তখন, এটা ছিল ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের গোড়ার দিকের ভারতে বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে সফল প্রতিষ্ঠান। দেশের সব অঞ্চল ছাড়াও লন্ডন ও প্যারিসেও এ-প্রতিষ্ঠানের শাখা ছিল এবং ‘মেইল অর্ডার সার্ভিস’ বা ডাকযোগে গ্রাহক পরিসেবার ব্যবস্থাও ছিল। স্যামুয়েল বোর্ন এবং তাঁর সহযোগীদের কাজকর্মের বেশকিছু নিদর্শন সংরক্ষিত আছে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে, লন্ডনের ন্যাশনাল পোর্ট্রেট গ্যালারিতে, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির ‘ইমেজ কালেকশন’ সংগ্রহে এবং ওয়াশিংটন ডিসির স্মিথসনিয়ান ইনস্টিটিউশনে।

ভারতে স্যামুয়েল বোর্নের প্রথম আগমন ১৮৬৩ সালে। আসার পর তাঁর পরিচয় হয় কলকাতার একজন প্রতিষ্ঠিত আলোকচিত্রী উইলিয়াম হাওয়ার্ডের সঙ্গে এবং তাঁরা দুজনে মিলে হিমাচল প্রদেশের শিমলা শহরে ‘হাওয়ার্ড অ্যান্ড বোর্ন’ (Howard & Bourne) নামে একটি নতুন স্টুডিও খোলেন। এর বছরখানেক আগেই চার্লস শেফার্ড ও আর্থার রবার্টসন নামে অন্য দুজন ফটোগ্রাফার উত্তর প্রদেশের আগ্রা শহরে ‘শেফার্ড অ্যান্ড রবার্টসন’ (Shepherd & Robertson) নামে একটা স্টুডিও খুলেছিলেন। কিছুদিন পরে রবার্টসন স্টুডিও ব্যবসা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার মনস্থ করলে চার্লস শেফার্ডও শিমলা শহরে চলে আসেন এবং উইলিয়াম হাওয়ার্ড ও স্যামুয়েল বোর্নের সঙ্গে যোগ দেন। তাঁদের নতুন স্টুডিওর নাম হয় ‘হাওয়ার্ড, বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’ (Howard, Bourne & Shepherd)। মোটামুটি ওই সময়েই, ১৮৬৪ থেকে ১৮৬৬ সালের মধ্যে, স্যামুয়েল বোর্ন কাশ্মিরে এবং হিমালয় পর্বতমালার অন্য কয়েকটি এলাকায় ছবি তোলার গোটা চারেক অভিযান চালিয়েছিলেন। এসব অভিযানে তাঁর সঙ্গে প্রচুর মালপত্র থাকত। চল্লিশ-বিয়াল্লিশজন মালবাহক বেশ কয়েকটা ভারী ক্যামেরা, আলোকচিত্র ডেভেলপ করার জন্য ডার্করুম তাঁবু, নানা ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ও কাচের পাত ভরা বড় বড় বাক্স ইত্যাদি নিয়ে তাঁকে অনুসরণ করত। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ভারতের একজন নামজাদা আলোকচিত্রী হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত হতে শুরু করলেন। অন্যদিকে চার্লস শেফার্ড ইতোমধ্যে একজন ‘মাস্টার প্রিন্টার’ – প্রথম শ্রেণির মুদ্রণশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি শিমলাতেই থাকতেন এবং তাঁদের ব্যবসার হয়ে ছবি ছাপার ও বাণিজ্যিক বণ্টন সংক্রান্ত কাজকর্মের তত্ত্বাবধান করতেন। এই সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় বোর্নের তোলা আলোকচিত্রের বেশ কয়েকটা প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। ১৮৬৭ সালে ‘প্যারিস ইউনিভার্সাল এক্সপোজিশন’ (Paris Universal Exposition) নামে বিখ্যাত আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতেও তিনি যোগ দেন। ‘দ্য ব্রিটিশ জার্নাল অব ফটোগ্রাফি’ (The British Journal of Photography) পত্রিকাতেও তিনি নিয়মিত সচিত্র নিবন্ধ লিখতে থাকেন এবং তাঁদের স্টুডিও ভারত ভ্রমণে আসা ইউরোপীয় পর্যটকদের জন্য, সেইসঙ্গে ব্রিটেনের অধিবাসীদের জন্যেও, ভারতীয় নিসর্গদৃশ্যের দৃষ্টিনন্দন আলোকচিত্র সরবরাহের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ফলে ওই সময়ের আরো বহু বাণিজ্যিক আলোকচিত্রীর সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখেও ‘হাওয়ার্ড, বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’ উত্তরোত্তর প্রসিদ্ধি লাভ করতে থাকে।

১৮৬৬ সালে উইলিয়াম হাওয়ার্ড ব্যবসা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের নাম হয় ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’। এই সময়েই বোর্ন ইংল্যান্ডে যান বিয়ে করতে এবং ফিরে আসার পর তিনি কলকাতায় খোলা নতুন শাখার দায়িত্ব নেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতার এ-শাখাই হয়ে দাঁড়ায় প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর ও ভারতের অন্যতম প্রধান ফটোগ্রাফিক স্টুডিও। শিমলার স্টুডিওর কাজকর্মও একই সঙ্গে চালু থাকে। করিৎকর্মা প্রতিনিধিদের মাধ্যমে উপমহাদেশের সর্বত্র কোম্পানির কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এমনকি ব্রিটেনে ও ইউরোপের অন্যত্রও হোলসেল ডিস্ট্রিবিউটররা ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’কে অচিরেই একটি অতিপরিচিত নামে পরিণত করে তোলে। ভারত সফরে আসা ব্রিটেনের রাজপরিবারের সদস্যদের, বিভিন্ন ভাইসরয় ও গভর্নরসহ ‘ব্রিটিশ রাজে’র সর্বোচ্চ পদাধিকারীদের এবং ভারতীয় রাজন্যবর্গের ও অভিজাত সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ডে’র আলোকচিত্রীদের সক্রিয়  উপস্থিতি ছাড়া তখন কোনোরকম সরকারি অনুষ্ঠান-উৎসব-অভিষেক-দরবার সম্পূর্ণ বিবেচিত হতো না। বস্ত্তত, ব্রিটিশ ভারতে তখন এমন কোনো ভিআইপি ছিলেন না বললেই চলে, যাঁর প্রতিকৃতি ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ডে’র ক্যামেরায় কখনো না কখনো ধরা পড়েনি। সে-সময়ে এই আলোকচিত্রীদের সকলেই হতেন ইউরোপীয়।

১৮৭০ সালে নিতান্তই ব্যক্তিগত কারণে স্যামুয়েল বোর্ন ফটোগ্রাফিক স্টুডিওর ব্যবসা থেকে অবসরগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এবং ইংল্যান্ডে ফিরে যান। তারপর ছবি তোলার এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক কাজকর্ম পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন চার্লস শেফার্ড এবং তাঁর পনেরো-ষোলোজন ইউরোপীয় সহকারী। ১৮৭৫ সালে বোম্বেতে (মুম্বাইয়ে) কোম্পানির আরেকটি শাখা খোলা হয়। এছাড়া বছরের বিভিন্ন সময়ে ভারতের নানা শহরে, যেমন লাহোর বা দিল্লিতে, যখন যেমন প্রয়োজন অস্থায়ী বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড স্টুডিও খোলা হতো। মুম্বাইয়ের স্টুডিও অবশ্য কয়েক বছর পর বন্ধ হয়ে যায়। শিমলার স্টুডিও চালু থাকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত। তারপর থেকে কলকাতাতেই কোম্পানির স্থায়ী ও একমাত্র ঠিকানা। যাই হোক, স্যামুয়েল বোর্ন স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পর আরো চার-পাঁচ বছর চার্লস শেফার্ড কোম্পানির সার্বিক দায়িত্ব সামলান। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন কলিন মারে নামে একজন অভিজ্ঞ আলোকচিত্রী। ১৯৭৯ সাল নাগাদ শেফার্ডও ভারত ছেড়ে চলে যান। কলিন মারের পরিচালনায় স্টুডিওর ব্যবসা অবশ্য চলতে থাকে বেশ ভালোভাবেই। ১৮৭০ থেকে ১৯১১ সালের মধ্যে কোম্পানির আলোকচিত্রীদের সিংহল (শ্রীলঙ্কা), আফগানিস্তান, বর্মা (মিয়ানমার), নেপাল, সিঙ্গাপুর, সেইসঙ্গে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জেও পাঠানো হয় ওইসব অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও শাসক সম্প্রদায়ের লোকজনের ছবি তোলার জন্য। শিল্পকলাবিষয়ক প্রকাশনার কাজও শুরু করে কোম্পানি – তাদের উল্লেখযোগ্য প্রকাশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে Photographs of Architecture of Gujarat and Rajputana (গুজরাত ও রাজপুতনার স্থাপত্যশিল্পের আলোকচিত্র) এবং The Architecture of Ancient Delhi (প্রাচীন দিল্লির স্থাপত্যশিল্প)। স্টুডিওর ১৯২০-এর দশকের ক্যাটালগে সাড়ে চার হাজারেরও বেশি কাজের নিদর্শনের ছবি ও তালিকা পাওয়া যায়। এই সময় থেকেই ইউরোপীয় ছাড়াও ভারতীয় আলোকচিত্রীদের নিয়োগ করার প্রথাও শুরু হয় এ-প্রতিষ্ঠানে।

১৯১১ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানী মেরির ভারতের সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী হিসেবে অভিষিক্ত হওয়া উপলক্ষে আয়োজিত ‘দিল্লি দরবার’ অনুষ্ঠানে আলোকচিত্র গ্রহণের দায়িত্ব সরকারিভাবে অর্পণ করা হয় বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড কোম্পানিকে। দুই বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয়, ব্রিটিশ ও আমেরিকান সেনাবাহিনীর কার্যকলাপের ফটোগ্রাফিক রেকর্ড তৈরি করার অতীব লাভজনক বরাতও পেয়েছিল এ-স্টুডিও। এর পরের কয়েক বছরে স্টুডিওর মালিকানা বদল হয়েছে অনেকবারই। সর্বশেষ ইউরোপীয় মালিক হয়েছিলেন আর্থার মাসেলহোয়াইট ১৯৩০-এর দশকের গোড়ার দিকে। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর ব্যবসার অবস্থা কিছুটা সঙ্গিন হয়ে পড়ে। একই সময়ে ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের লোকজন দলে দলে ভারত ত্যাগ করতে শুরু করে। রাজন্যপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার ফলেও পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। অবশেষে ১৯৫৫ সালে আর্থার স্টুডিও নিলামে বিক্রি করে দেন। বর্তমান মালিকরাও লাভজনকভাবে স্টুডিও চালু রাখা নিয়ে বেশ খানিকটা অসুবিধার মধ্যে রয়েছেন। তাঁদের মালিকানাধীন সময়েই, ১৯৯১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এক বিধ্বংসী অগ্নিকান্ডে কলকাতায় বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড স্টুডিওর প্রচুর সরঞ্জাম, দুর্লভ নথিপত্র ও আলোকচিত্র পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এই ক্ষতি তো অবশ্যই অপূরণীয়। তবে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িটির উপযুক্ত সংস্কার করে তাকে হয়তো কিছুটা হলেও আগের চেহারায় ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব। কয়েক বছর আগেই বাড়িটিকে ‘heritage building’, অর্থাৎ সংরক্ষণযোগ্য ঐতিহ্যশালী ভবন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। স্টুডিও মালিকরা কিন্তু বাড়ির মালিক নন, অতএব সংস্কারের সরাসরি দায়িত্ব তাঁদের নয়। তাঁদের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে সেটা করা হয়তো সম্ভবও নয়। এ-ধরনের বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত ঘরবাড়ির সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সাধারণত কোনো সরকারি সংস্থার ওপরই বর্তায়। তবে সে-সংস্থা, অথবা বাড়ির প্রকৃত মালিকানা ও দায়িত্ব যাদের, তারা কবে ওই দায়িত্ব পালন করবে, কিংবা আদৌ করবে কি-না, সেটাই তো কোটি টাকার প্রশ্ন।