ইতিহাস ও সময়ের ধারক

লিটন চক্রবর্তী মিঠুন

পথচারী ঐতিহাসিক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত  উত্তরা চক্রবর্তী  সম্পর্ক  কলকাতা, ২০১৮  ২৫০ টাকা

বাঙালির কোনো ইতিহাস নেই বলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে-আক্ষেপ করেছিলেন, উত্তরকালে বোধহয় তারই জবাব দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত তাঁর নিজের মতো করে। কোনো বিদ্যায়তনের লাইব্রেরি-সেমিনারে বসে হেভিওয়েট প-িতের মতো নয়, বরং খেটে-খাওয়া আম-মানুষের আটপৌরে জীবন ও
সংস্কৃতির গভীর থেকে তিনি নিংড়ে এনেছেন ইতিহাস রচনার কাঁচামাল। জীবনকে দেখেছেন হাতের পিঠের মতো ঘনিষ্ঠভাবে। মানুষকে বুঝেছেন মানুষেরই ভেতর থেকে। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুঝেছেন আজীবন। কিন্তু, ইতিহাস ও সাহিত্যের প্রেম তাঁকে মৃত্তিকালগ্ন রেখেছে, তাঁর কলমকে রেখেছে ক্ষুরধার। এই যে মহাজীবন,
যে-জীবন যোগেন গুপ্তর, তাকে আমরা বিস্মৃতিপ্রবণ বাঙালি ভুলেই গিয়েছিলাম। আমাদের সে বিস¥রণ-বিলাসের মধ্যে বাদ সাধলেন উত্তরা চক্রবর্তী, সম্পর্কে যিনি যোগেন্দ্রনাথের সুযোগ্য দৌহিত্রী। তাঁর পথচারী ঐতিহাসিক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত আমাদের নিয়ে যায় বিংশ শতকের শুরুর দিককার সময়ে যখন ভারতবর্ষের ইতিহাস নানাবিধ ভাঙচুর ও ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দানা বাঁধছিল আর শুরু হয়েছিল শেকড়-সন্ধানের পালা। সে উপযুক্ত মুহূর্তেই দৃশ্যপটে হাজির হন যোগেন গুপ্ত তাঁর পিতৃভূমি বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার দুঃসাহসী মিশন নিয়ে। তাঁর রচনার ফোকাস হয়ে দাঁড়ায় এ-অঞ্চলের অন্ত্যজ
শ্রেণি-পেশার মানুষ, লোকগাথা, স্থানীয় কিংবদন্তি, মসজিদ-মন্দিরের ভগ্নাবশেষ, দেব-দেবীর বিগ্রহ ইত্যাদি। সাব-অল্টার্ন মানুষের ইতিহাস লেখার যে-উত্তরাধুনিক প্রবণতা এখন আমরা দেখতে পাই, আজ থেকে এক শতাব্দী আগে কোনো রকম অ্যাকাডেমিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাতে শামিল হয়েছিলেন যোগেন্দ্রনাথ। বইয়ের ফ্ল্যাপে যথার্থই বলা হয়েছে : ‘তাঁর শাণিত কলম ব্রিটিশ শাসনকালে অবিভক্ত বাংলার আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা চেনায়, আবার সেই সাথে বাংলার অতীত সময়ের লুপ্ত গৌরবের চিহ্ন, জীর্ণ মন্দির, ভগ্নমূর্তিগুলির সযতœ উদ্ধারের কাহিনী বলেন। সে বলার মধ্যে দিয়ে ইতিহাস ধরা হয়ে থাকে।’ বাঙালি হিসেবে সেটা আমাদের জন্য বড়ই গর্বের ও আনন্দের।
শুধু তাই নয়, বাংলার পূর্বাংশে মুসলিম সংখ্যাধিক্যের যেসব কারণ পরবর্তীকালে বরেণ্য গবেষক রিচার্ড ইটন উপস্থাপন করেন, দুর্দান্ত বিশ্লেষণ ক্ষমতার অধিকারী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত সেই সময়েই অনুরূপ ধারণা নিয়ে হাজির হন। ব্যাপারটা বিস্ময়করই বটে। উত্তরা চক্রবর্তী আমাদের আরো জানান, কীভাবে বিক্রমপুরের পথে-প্রান্তরে, আনাচে-কানাচে ঘুরে পুরাতাত্ত্বিক বস্তু সংগ্রহে নিজেকে ব্যাপৃত রাখতেন যোগেন গুপ্ত। বরেন্দ্র সংগ্রহশালা, আশুতোষ মিউজিয়াম, ঢাকা মিউজিয়াম তাঁর দানে ঋদ্ধ। তাঁর ইতিহাসপ্রীতির সুলুকসন্ধান করে উত্তরা দেবী আরো জানান : ‘যোগেন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক প্যাশন ছিল পুরাকীর্তির নমুনা সংগ্রহ। এরও একটা আদর্শগত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ছিল। অতীতকালের ‘পাথুরে’ প্রমাণ জোগাড় করে পরাধীন ভারতের জাতীয় গৌরব উপস্থাপন করা – বিদেশি শাসকদের কাছে প্রতিপন্ন করা ভারতীয়/ বাঙালি সভ্যতা সংস্কৃতির উৎকৃষ্টতা।’
শুধু পুরাতাত্ত্বিক গবেষণা নয়, তাঁর লেখায় তৎকালীন জনজীবন, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, জাতিভেদ-জর্জরিত হিন্দু সমাজ, পালা-পার্বণ, খেলাধুলা ইত্যাদির বিষয় ছবির মতো ফুটে ওঠে, যা ইতিহাসনির্ভর সাহিত্য রচনার জন্য লোভনীয় রিসোর্স। তাছাড়া, পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকার (আজকের পুরান ঢাকা) সাংস্কৃতিক পরিম-লে যোগেন গুপ্তর যে সক্রিয় পদচারণা – উত্তরা চক্রবর্তীর সৌজন্যে আমরা তারও একটা নির্যাস পাই। নিঃসন্দেহে, ঢাকাপ্রেমী যে-কারো জন্য তা আগ্রহের বিষয় হতে বাধ্য। যাহোক, কেবল একজন ইতিহাসকার যোগেন গুপ্তই নন, সাহিত্যিক যোগেন গুপ্তও আমাদের সামনে হাজির হন উত্তরা

চক্রবর্তীর স্বাদু গদ্যে। মাকে উৎসর্গ করে লেখা তাঁর বঙ্গের মহিলা কবি উত্তরা চক্রবর্তীর ভাষায় তাঁকে নারীবাদী সাহিত্যে ‘পথিকৃৎ ভূমিকা’ তৈরি করে দেয়। সাহিত্য-সাধনার একটি বিশিষ্ট দিক হচ্ছে নারীশিক্ষা ও নারীজাগরণের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস। তাঁর গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে তিনি মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিয়েছেন। সে-সময়কার অনেক নারীবাদী ব্যক্তিত্বের সঙ্গেও তাঁর ছিল নিবিড় সম্পর্ক ও পত্র-যোগাযোগ। এমনকি বেগম রোকেয়ার জীবদ্দশায় তাঁর জীবন সম্পর্কে পরিচিতিমূলক লেখা বা জীবনী লেখার প্রথম কৃতিত্বও যোগেন্দ্রনাথকেই দেওয়া যায় বলে উত্তরা চক্রবর্তী তথ্যনিষ্ঠ দাবি তোলেন। শুধু লেখালেখিই নয়, নিজের কন্যাদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তিনি নারীশিক্ষার সপক্ষে আন্দোলনে তাঁর নিষ্ঠার পরিচয় রেখে গেছেন।
তাঁর সাহিত্য-সাধনার আরেকটি উজ্জ্বল দিক শিশুসাহিত্য। তাঁরই সম্পাদনায় শিশুভারতী নামে একটি বিশ্বকোষ প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়, যার গুণমুগ্ধ ছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বইটির প্রাসঙ্গিকতা এখনো রয়েছে বলে দাবি করে উত্তরা চক্রবর্তী মন্তব্য করেন : ‘শিশুভারতী বিপুল এবং বহুবিচিত্র রচনাসম্ভারে পুষ্ট একটি অভিনব সংকলনে পরিণত হয়েছিল, সন্দেহ নেই। নানা বিষয়ের রচনাগুলি, সচিত্র গল্প ও কবিতা এবং অন্যান্য চিত্রাবলী আজকের একুশ শতকের পাঠমনস্ক বালক বালিকাদের আকর্ষণ করতে পারবে বলেই মনে হয়।’ (পৃ ৬৯)
এছাড়া, তিনি রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, ইতিহাস ও মহাপুরুষদের জীবনীনির্ভর বই লিখেছেন শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশের কথা মাথায় রেখে। একটি কথা না বললেই নয় যে, যোগেন গুপ্ত বৃত্তি হিসেবে সর্বতোভাবে লেখালেখিকেই বেছে নিয়েছিলেন, যে-সাহসটা দেখানো অনেকের পক্ষেই অসম্ভব। মননশীল ও সৃজনশীল লেখার পাশাপাশি তিনি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেছেন দেদার। আমরা পত্রিকা-সম্পাদক যোগেন গুপ্তর পরিচয়ও পাই উত্তরা চক্রবর্তীর বদৌলতে। মনের দিক থেকে উদার যোগেন গুপ্ত অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ছিলেন। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজন অনুভব করে নিয়মিত কলাম লিখেছেন সৈয়দ এমদাদ
আলি-সম্পাদিত নবনূর পত্রিকায়। এভাবে সারাজীবন মানুষের কল্যাণে নিজের কলমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কোনোরকম স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা তিনি পরিচালিত হননি।
মুসাফির স্বভাবের মানুষ যোগেন গুপ্ত জীবন ও জীবিকার খাতিরে ভারতবর্ষ চষে বেড়িয়েছেন। কিন্তু বুকে একটুকরো বিক্রমপুরকে সব সময়ই ধারণ করেছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দৌড় বেশি না হলেও তৎকালীন বড় মনীষী ও উদীয়মান প্রতিভাদের সঙ্গে ছিল তাঁর প্রশংসনীয় ঘনিষ্ঠতা। এতে প্রৌঢ় রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে নবীন বুদ্ধদেব বসুও অন্তর্গত ছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, হাল জমানায় বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলন তাঁর একটি গল্পে যোগেন গুপ্তকে উল্লেখ করেছেন চমৎকারভাবে। তাঁকে নিয়ে গবেষণাও হয়েছে দেশে-বিদেশে, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায়। উত্তরা চক্রবর্তী খুবই মুন্্শিয়ানার সঙ্গে তথ্যগুলো সন্নিবেশিত করেছেন বইটিতে।
যাহোক, প্রথম যখন পথচারী ঐতিহাসিক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত বইটি হাতে পাই বিশিষ্ট নারীবাদী লেখক মালেকা বেগমের সৌজন্যে, শিরোনামটিই আমাকে বিশেষভাবে আলোড়িত করে। আর যতই পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ধরে এগোই, একজন মহামানবের কীর্তিমুখর জীবন চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মতো ভাসতে থাকে। যেন যোগেন গুপ্ত ইতিহাসের মণিমানিক্য কুড়োবার জন্য পথে নেমেছেন, আমিও হয়েছি তাঁর সফরসঙ্গী। উত্তরা চক্রবর্তীর তারিফ করতেই হয়। কী বিপুল পরিশ্রম করেছেন তিনি ১৭২ পৃষ্ঠার বইয়ে যোগেন গুপ্তর অসামান্য জীবন ও কীর্তির নির্যাস পরিবেশন করার জন্য। বইটাকে আমার কাছে মনে হয়েছে guided tour । বলা অসমীচীন হবে না যে, ইতিহাসের ডাকসাইটে শিক্ষক উত্তরা চক্রবর্তীর এ-গবেষণাসুলভ প্রয়াস ও মনোবৃত্তি যোগেন গুপ্তরই সার্থক উত্তরাধিকার। তাঁর রচিত প্রবন্ধাদি ও সম্পাদিত গ্রন্থ পাঠকমহলে সমাদৃত এবং বিদ্যায়তনিক বলয়ে স্বীকৃত। এ-সমৃদ্ধ বইটিও সে-ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। তথ্যবহুল বইটিকে বিশিষ্ট মাত্রা দিয়েছে যথাস্থানে উপযুক্ত চিত্র সংযোজন এবং শেষের দিকে যোগেন গুপ্তের গ্রন্থতালিকা প্রদান। তথ্য, তত্ত্ব ও বিষয়ের সরস পরিবেশনায় বইটি হয়ে উঠেছে একটি আনন্দপাঠ। একজন গবেষকের কাছে যেমন, একজন সাধারণ পাঠকের কাছেও বইটি আবেদন সৃষ্টি করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। ইতিহাস ভুলে যাওয়ার যে একটি জাতিগত রোগ আমাদের হাড়ে-মজ্জায় জাঁকিয়ে ধরেছে, তার জন্যও টনিকের মতো কাজ করবে আলোচ্য বইটি। বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলাভাষী লেখকগণ আরো বেশি করে এ-জাতীয় গ্রন্থ রচনায় ব্রতী হলে সীমান্তের দুপারের বাঙালি ব্যাপকভাবে উপকৃত হবেন। আমাদের কাঁটাতার ছাপানো যৌথ ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিকভাবে অখণ্ড জাতিসত্তা নির্মাণের নায়কদের পাঠকের সামনে তুলে ধরা বলতে গেলে যুগেরই দাবি। পরিশেষে, পথচারী ঐতিহাসিক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত বইটির যোগ্য মূল্যায়ন ও পাঠকপ্রিয়তা কামনা করছি।