উদয়শঙ্কর ও তাঁর নৃত্য-ঘরানা

মানব সমাজে যত রকমের শিল্পকর্ম আছে, তার মধ্যে নৃত্যকলা প্রাচীনতম এবং একটি গুরুমুখী বিদ্যা। এ-বিদ্যার ঔপপত্তিক (theoretical) দিকের চেয়ে ফলিত চর্চার (Applied) গুরুত্ব অনেক বেশি। বর্তমানে এ-বিদ্যা প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়লেও উদয়শঙ্কর (১৯০০-৭৭) কখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষিত ছিলেন না এবং কদাচিৎ ‘গুরুমুখী’ হয়েছিলেন। জন্ম হয়েছিল রাজপুতনার মেওয়ার অঞ্চলে উদয়পুরে ১৯০০ সালের ৮ ডিসেম্বর।১ তাঁর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়া হয়েছিল কখনো কালিয়া গ্রামের স্কুলে, কখনো মাতামহের নিবাস গাজীপুরে, কখনো কাশীর বাঙালিটোলা হাইস্কুলে এবং কিছুদিন বোম্বাই জে. জে. আর্ট স্কুলে। তাঁর আঁকার হাত দেখে ঝারওয়ারের মহারাজা খরচ দিয়ে বিলেত পাঠান।২ সেখানে তিনি ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনের ‘রয়েল কলেজ অব আর্টসে’ ভর্তি হন এবং পাঁচ বছরের কোর্স তিন বছরে শেষ করেন এবং অর্জন করেন এ.আর.সি.এ. ডিগ্রি। এ-প্রতিষ্ঠানে কম্পোজিশনে ডিপ্লোমা এবং আর্টে স্নাতক হন। তিনি Spencer I George Clausen-এর নামে প্রচলিত দুটি পুরস্কার পান ও লাভ করেন ‘প্রিক্স রোমা’ নামে সর্বোচ্চ বৃত্তি। তিনি যখন লন্ডনের রয়েল কলেজ অব আর্টসের ছাত্র তখন এ-প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী রোদেনস্টাইন; রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) যাঁকে তাঁর গীতাঞ্জলি উৎসর্গ করেন।৩

নৃত্যজগতে প্রবেশ

রাশিয়ার নৃত্যশিল্পী আনা পাভলোভা ভারতের অজন্তার দেয়ালচিত্রে (Mural Painting) ও ইলোরা মন্দিরে পাথরের ভাস্কর্যের মধ্যে নৃত্যের গ্রীবাভঙ্গি দেখে সেগুলো কপি করাতে চান। সেজন্যে রোদেনস্টাইনের দ্বারস্থ হলে তিনি উদয়শঙ্করকে এ-দায়িত্ব দেন। উদয়শঙ্করের হাতে এই নৃত্যভঙ্গিযুক্ত দেয়ালচিত্র ও পাথরখোদাই জীবন্ত হয়ে ওঠে। পাভলোভা উদয়শঙ্করকে ওই নৃত্যভঙ্গির অনুসরণে নাচের মুদ্রা সৃষ্টি করতে প্রাণিত করেন। এরকম প্রেরণা থেকে সৃষ্টি হয় হিন্দু বিবাহ ও রাধাকৃষ্ণ নৃত্যনাট্যদ্বয়। রাধাকৃষ্ণ নৃত্যে উদয়শঙ্কর কৃষ্ণ আর পাভলোভা রাধার ভূমিকায় নৃত্য পরিবেশন করেন। ইতোমধ্যে উদয়শঙ্কর, তাঁর বাবা ব্যারিস্টার ড. শ্যামশঙ্করের রচিত The Great Mughal’s Chamber of Dreams-এ নৃত্য পরিবেশন করেন। ১৯২৩ সালে পরিবেশিত এ-অনুষ্ঠানের পরামর্শক ছিলেন রোদেনস্টাইন আর মঞ্চায়নের দায়িত্বে ছিলেন শ্যামশঙ্কর নিজে। এটি ছিল উদয়শঙ্করের প্রথম পরিবেশনা। এরপর পাভলোভার দলে যোগ দিয়ে তিনি কানাডা ও আমেরিকা ভ্রমণ করেন। এভাবে শুরু হয় উদয়শঙ্করের নৃত্যচর্চা ও নৃত্য নিয়ে পৃথিবী পরিক্রমা। উদয়শঙ্কর উপলব্ধি করেন, অংকনবিদ্যার পাশাপাশি নৃত্যেও তাঁর প্রতিভা বিকশিত হতে পারে। এ-বোধ থেকে তিনি ১৯২৪ সালে আনা পাভলোভাকে ছেড়ে ভারতে চলে আসেন। উদ্দেশ্য নাচের দল গঠন। কিন্তু তাঁর কোনো প্রথাগত নৃত্যশিক্ষা না থাকলেও সুইস ভাস্কর এরিস বোনারের সাহায্যে তিনি নাচের দল গঠন করেননি শুধু, ভবিষ্যতের একজন বিশ্ববন্দিত নৃত্যশিল্পী হিসেবে যিনি ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব করবেন এবং ভারতের নানাবিধ বিষয় নৃত্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করবেন, সেই মানুষটি দল গঠনের পরপরই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্য, গান, শাস্ত্রীয় ও লোকনৃত্য, ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র ও পোশাকের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত হন। এসব বিষয়ের ধারণা উদয়শঙ্করকে একজন নৃত্যশিল্পী হয়ে উঠতে যে কতখানি সাহায্য করেছিল, সে-সম্পর্কে রবিশঙ্করের মন্তব্য :

এত অল্প জেনে – কারণ উনি তো বেশি শেখেননি, জ্ঞান ছিল না। কিন্তু ওঁর এমন দূরদৃষ্টি ছিল যে, Painting দেখে, অজন্তা, ইলোরা, মহাবলীপুরমের Sculpture দেখে, কথাকলি দেখে, folk dances দেখে, tribal dances দেখে, মনিপুরী দেখে – he assimilated everything and created a style of his own.4

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে দল গঠন করেন। তার আগে তিনি কলকাতায় প্রথম একক (Solo Dance) নৃত্য পরিবেশন করেন। এ-সময় তিনি পরিচিত হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৭১-১৯৫১) সঙ্গে।

তিনি Uday Shankar Troupe of Hindu Dancers and Musicians নামে দল গঠন করলে সেখানে যোগ দেন তিমিরবরণ, বিষ্ণুদাস শিরালী, কেলকার, কারেন্দিকার প্রমুখ সংগীত গুণিজন। আর নৃত্যশিল্পী হিসেবে ছিলেন তাঁর বোন কনকলতা৫, অপরাজিতা নন্দী (?), অমলা নন্দী (পরে শঙ্কর), ফরাসি নৃত্যশিল্পী সিমকি, জোহরা সেগাল, সহোদর রাজেন্দ্রশঙ্কর ও রবিশঙ্কর, পিতৃব্য ভবানীশঙ্কর প্রমুখ। এছাড়া, স্টেজ ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন মাতুল ব্রজবিহারী চক্রবর্তী, অন্যজন চিরঞ্জীলাল দাস।৬

 

সমসাময়িক নৃত্যশিল্পী ও পৈতৃক জন্মভিটা কালিয়ায় আগমন

উদয়শঙ্কর যখন নৃত্য বিষয়ে কাজ শুরু করেন তখন স্বদেশে ও বিদেশে তাঁর সমসাময়িক শিল্পী ছিলেন রুক্সিনী (রুক্ষ্মিণী) দেবী৭,  অরুণ ডেল (১৯০৪-৮৬), মদন মেনকা (১৮৯৯-১৯৪৭), ই. কৃষ্ণ আয়ার (১৮৯৭-১৯৬৮), রামগোপাল (১৯১২-?), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবি বল্লাঠন নারায়ণ মেনন (১৮৭৫-১৯৫৭)। আর পাশ্চাত্যে ছিলেন রুথ সেল্ট ডেনিস, টেড শোয়াল, লা মেরি, ইনোকা, মেরি উইংম্যান, রজনী দেবী প্রমুখ। এঁদের নৃত্যধারার পাশাপাশি থেকে উদয়শঙ্কর সমসাময়িক নৃত্যশিল্পীদের চিরায়ত বা ধ্রুপদী নৃত্যের প্রতি আগ্রহী না হয়ে নতুন শাস্ত্রীয় ধারায় পাশ্চাত্যের দৃষ্টি ভারতের চিরায়ত নৃত্যের দিকে ফেরাতে চেষ্টা করেন। কেননা তাঁর ভারতবোধ এত গভীর ছিল যে, ভিনদেশি কোনো কিছু তাঁর নাচের বিষয় হয়ে ওঠেনি। দেশি পোশাকের প্রতি তাঁর আগ্রহ থাকায় তিনি

ধুতি-পাঞ্জাবি পরে Grand Hotel বা অন্য কোনো প্রথম শ্রেণির হোটেলে যেতে এতটুকু সংকোচ বোধ করতেন না। এ-ব্যাপারে কোনো বাধা, বিশেষ করে পুলিশি বাধা তিনি কদাচিৎ গ্রাহ্য করতেন। এই Anti-British বোধ আসলে Anti ছিল না; বরং দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন বলে অনেক বেশি ভারতীয় হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।৮

১৯৩০-৩১ সালে তিনি পারী গিয়ে বিষ্ণুদাস শিরালী ও তিমিরবরণের সহায়তায় নাচের কয়েকটি নতুন বিষয় সৃষ্টি করেন। তাঁর এ-কাজ ভীষণ সাড়া জাগিয়েছিল। তিনি নতুন নৃত্য সৃষ্টির পাশাপাশি যন্ত্রী ও বাদ্যকারদের জন্য তৈরি করেন নজরকাড়া পোশাক। তিনি ও এলিস বোনার মিলে অজন্তা ও ইলোরার ভাস্কর্য নিয়ে তৈরি করেন অন্যরকম Costume। নবগঠিত দল নিয়ে তিনি পরিভ্রমণ করেন গোটা ইউরোপ, অর্থাৎ ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশ। এছাড়া ভারতের প্রধান প্রধান সব শহরে তিনি নৃত্য পরিবেশন করেন। একবার সদলবলে তিনি প্রমোদ পরিবেশক (Impresario) হরেন ঘোষের (১৮৯৫-১৯৪৭)৯ সহায়তায় যশোরে হাজির হন। তখন যশোরের জজ ছিলেন শৈবাল গুপ্ত, আইসিএস। তিনি উদয়শঙ্করের ১৯৩৯ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে কালিয়ায় তথা যশোরে আগমন সম্পর্কে লিখেছেন :

ওই সময়েই কিছুদিন পরেই কালিয়া গ্রামে উদয়শঙ্করের পিতামহের ভিটা দেখার জন্য Impressario হরেন ঘোষ উদয়শঙ্করের পুরো দলকে নিয়ে যশোহরে আসেন এবং আমাদের বাড়িতে ওঠেন। দলে ছিলেন – উদয়শঙ্কর, তিমিরবরণ,১০  রবিশঙ্কর ও আরো কয়েকজন শিল্পী, মেয়েদের মধ্যে সিমকি, ইজরা, জোহরা ও অন্যান্য দু-একজন। তখনও অমলা নন্দী ওই দলে যুক্ত হননি এবং কনকলতাকে ওইবারেই কালিয়া গ্রাম থেকে আনা হয়। যশোহরে তখন মহাধুমধাম করে আড়ম্বরের সঙ্গে তাঁদের দেশের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং যশোহর বার অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে এবং জনসাধারণের সহযোগিতায় তাঁদের সংবর্ধনা জানানো হয়। বার লাইব্রেরির প্রেসিডেন্ট কেশব রায়চৌধুরি মাল্যদান করে উদয়শঙ্করকে স্বাগত জানান এবং সুললিত ভাষায় মানপত্র প্রদান করে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন। যশোহরের টাউন হলে উদয়শঙ্করের টিম তাঁদের ‘ব্যালে’ যখন জনসাধারণের সমক্ষে প্রদর্শিত করেন, তখন দর্শক সাধারণের উল্লাস ও আনন্দের সীমা ছিল না।১১

শৈবাল গুপ্তের বয়ান অনুসারে উদয়শঙ্কর জুলাই ১৯৩৯ সাল থেকে মার্চ ১৯৪১ সালের মধ্যে কালিয়া গ্রামে এসে থাকবেন। উদয়শঙ্করের কালিয়ায় আগমন সম্পর্কে চণ্ডী সেনগুপ্ত (এখন ভারতীয়) তাঁর পিতা হেমন্তকুমার সেনগুপ্ত, সিভিল সার্জন ডা. হেমেশচন্দ্র দাশগুপ্ত, ডা. প্রফুল্লচন্দ্র দাশগুপ্ত প্রমুখের উপস্থিতিযুক্ত একটি ছবির (Photograph) সাহায্যে অনুমান করেন যে, সেবারই কালিয়ায় উদয়শঙ্করকে সংবর্ধনা দেওয়ার পরে এ-ছবি তোলা হয়। চণ্ডী সেনগুপ্ত একটি চিঠিতে বর্তমান নিবন্ধকারকে সে-রকমই জানিয়েছেন।১২

রবিশঙ্কর অন্নপূর্ণাকে ১৯৪১ সালের পনেরো এপ্রিল যখন বিয়ে করেন, তখন অন্নপূর্ণার বয়স ছিল পনেরো, আর রবিশঙ্করের একুশ বছর। এ-ছবিতে রবিশঙ্করকে দেখে মনে হয় না যে, তখন তাঁর বয়স উনিশ, বিশ কিংবা একুশ বছর ছিল। অতএব, চণ্ডী সেনগুপ্ত

ছবিতে চিহ্নিত কালিয়ার বিশিষ্টজন ও গলায় মাল্যপরিহিত উদয়শঙ্করকে দেখে যে বিষয় অনুমান করেন, সেটি ঠিক নয়। কেননা ১৯৩৯-৪১ সালের মধ্যে উদয়শঙ্কর তাঁর দল নিয়ে যশোরে, এমনকি কালিয়ায় এলেও, এ-ছবিটি সেবার তোলা হয়নি। তাঁরা কতবার কালিয়ায় এসেছেন সে-বিষয়ে কোনো প্রমাণ নেই। রবিশঙ্কর তাঁর

রাগ-অনুরাগ ও স্মৃতি গ্রন্থের কোথাও তাঁর পিতৃভূমি ‘কালিয়া’ প্রসঙ্গে একটি কথা তো দূরের কথা, কালিয়া নামটি কোথাও উল্লেখই করেননি। শুধু মতিউর রহমানকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তাঁর পিতার জন্মস্থান হিসেবে কালিয়ার নাম উল্লেখ করে বলেন : ‘১৯৪০ সালে দাদার (উদয়শঙ্করের) সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামে অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলাম। নদীপথে যাওয়ার সময় কালিয়ায় নেমে মাথায় মাটির ছোঁয়া নিয়েছিলাম।’১৩ এ সুবাদে বলা যায়, এ-ছবিটি যে ১৯৩৯-৪১ সালের মধ্যে তোলা হয়নি সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কালিয়া গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে এ-ছবি অন্য কোথাও তোলা হতে পারে।

 

শান্তিনিকেতনে নৃত্যপরিবেশন ও রবীন্দ্রনাথের অভিনন্দনপত্র

উদয়শঙ্কর ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে যান। তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন মিস ব্রোনার ও খ্যাতনামা অনুষ্ঠান পরিচালক হরেন ঘোষ। সে-যাত্রায় রবীন্দ্রনাথ আশ্রমে না থাকায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে দেখা হয়েছিল ১৯৩৩ সালের ৫ থেকে ৭ জুলাইয়ের মধ্যে। এ-সময় হরেন ঘোষের ব্যবস্থাপনায় কলকাতা মাদান থিয়েটারে উদয়শঙ্করের নৃত্য দেখতে আসা কবিকে প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষ মালা পরিয়ে বরণ করে। উদয়শঙ্করের নৃত্য দেখে বিমুগ্ধ কবি তাঁর গলার মালাটি উদয়শঙ্করের গলায় পরিয়ে দেন। এরপর বর্ষামঙ্গল উৎসবের চারদিন পর ১২ জুলাই উদয়শঙ্কর শান্তিনিকেতনে যান। সেখানে তিনি ইন্দ্রনৃত্য পরিবেশন করে কবির আশীর্বাদ লাভ করেননি শুধু, কবি উদয়শঙ্করের উদ্দেশে একটি অভিনন্দনপত্র রচনা করেন। অভিনন্দনপত্রটি পরে প্রবাসীতে (ভাদ্র ১৩৪০ সংখ্যায়) প্রকাশিত হয়। অভিনন্দনপত্রটি পাঠকবর্গের অবহিতির জন্য উদ্ধৃত করা হলো।

উদয়শঙ্কর,

তুমি নৃত্যকলাকে সঙ্গিনী করে পশ্চিম মহাদেশের জয়মাল্য নিয়ে বহুদিন পরে ফিরে এসেছ মাতৃভূমিতে।

মাতৃভূমি তোমার জন্য রচনা করে রেখেছেন জয়মাল্য নয়, – আশীর্বাদপূতঃ বরণডালা। বাংলার কবির হাত থেকে আজ তুমি তা গ্রহণ করো।

… তুমি দেশ-বিদেশের নৃত্যরসিকদের কাছ থেকে প্রভূত সম্মান পেয়েছ, কিন্তু আমি জানি তুমি মনে মনে  অনুভব করেছ যে, তোমার সামনে সাধনার পথ এখনো দূরে প্রসারিত, এখনো তোমাকে নতুন প্রেরণা নিতে হবে; উদ্ভাবনা করতে হবে নব নব কল্পমূর্তি। আমাদের দেশে নব নব উন্মেষশালিনী বৃত্তিকেই প্রতিভা বলে। তোমার প্রতিভা আছে, সেই কারণেই আমরা আশা করতে পারি যে তোমার সৃষ্টি কোন অতীত যুগের অনুভূতিকেই বা প্রাদেশিক অভ্যস্ত সংস্কারে জড়িত হয়ে থাকবে না; অসন্তোষেই তার জয়যাত্রা পথের সারথি। সেই পথে যে সব তোরণ তা থামার জন্য নয়, পেরিয়ে যাবার জন্য।

একদিন আমাদের দেশের চিত্তে নৃত্যের প্রভাব ছিল উদ্বেল। সেই উৎসের পথ কালক্রমে অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। অবসাদগ্রস্ত দেশে আনন্দের সেই ভাষা আজ শুষ্ক। তার শুষ্ক স্রোতঃপথে মাঝে মাঝে যেখানে তার অবশেষ আছে, সে যে পঙ্কিল এবং ধারাবিহীন। তুমি নিরাশ্বাস দেশে নৃত্যকলাকে উদ্বাহিত ক’রে আনন্দের এই বাণীতে আবার একবার ছাপিয়ে তুলেছ।

নৃত্যহারা দেশ অনেক সময় এ কথা ভুলে যায় যে, নৃত্যকলা ভোগের উপকরণ মাত্র নয়। মানবসমাজে নৃত্য সেইখানে বেগবান, গতিশীল, সেইখানে বিশুদ্ধ, যেখানে মানুষের বীর্য আছে। …

… বসন্তের বাতাস অরণ্যের প্রাণশক্তিকে বিচিত্র সৌন্দর্য ও সফলতায় সমুৎসুক করে তোলে, তোমার নৃত্যে মøানপ্রাণ দেশে সেই বসন্তের বাতাস জাগুক, তার সুপ্ত শক্তির উৎসাহের উল্লাসের ভাষায় সতেজে আত্মপ্রকাশ করতে উদ্যত হয়ে উঠুক, এই কামনা করি। ইতি ২৯শে আষাঢ়, ১৩৪০ সাল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর১৪

 

নৃত্যে উজ্জীবন

রবীন্দ্রনাথের কামনা উদয়শঙ্করের জীবনে বাস্তবায়িত হয়েছিল। আর তাঁর জীবনের দ্বার খুলে দিয়েছিলেন উইলিয়াম রোদেনস্টাইন১৫ ও আনা পাভলোভা। এই পাভলোভাই তাঁকে শুধু চিত্রশিল্পী থেকে নৃত্যশিল্পীতে রূপান্তর করেননি, উদয়শঙ্করের মাধ্যমে ভারতীয় নৃত্যকে তিনিই প্রথম বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন করেন। পাভলোভা তাঁর জীবনে যে-পরিবর্তন এনে দিয়েছিলেন, সেই পরিবর্তনের পরিসমাপ্তি হয়েছিল মাদাম সিমকি (গধফধস ঝরসশরব) ও অমলাশঙ্করের হাতে। এ-বিষয়ে শিল্পতাত্ত্বিক জি ভেঙ্কটচালমের উক্তি তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন : ÔLike Tagore, he was discovered first in Europe, Rothenstein spotted his genius, Pavlova fanned it to bursting flame, Simkie shared his first triumphs.’১৬ তাঁর সম্পর্কে ড. সর্বপল্লী

রাধাকৃষ্ণান (১৮৮৮-১৯৭৫) ও ড. জাকির হোসেন অনেক মন্তব্য করেন। এঁরা দুজনই ছিলেন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। ড. হোসেন বলেন : ÔUdayshankar is our cultural Ambassador|Õ ড. হোসেনের বক্তব্যকে একটু বাড়িয়ে রাধাকৃষ্ণান বলেন :

Among those successful children of India who have been established the culture of the Motherland to world’s Durbar, the names of Swami Vivekananda, Rabindra Nath Tagore and Udayshankar, are worth mentioning.১৭

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু অভিনন্দনপত্র প্রদান করেননি; তাঁর নৃত্য সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরীকে একটি পত্রে লেখেন (২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩) : ‘উদয়শঙ্করের নাচের প্রধান গুণ হচ্ছে তার আত্মশক্তি ও তার শিক্ষা – দুইই এ নাচে মিলেছে। আঙ্গিক দিকে উৎকর্ষপ্রাপ্ত এ জিনিসটা – ভাবিক দিকে ক্ষুন্ন। … যে-কল্পনাবৃত্তির উৎকর্ষ থেকে সৌন্দর্যসৃষ্টি হয় উদয়শঙ্করের নাচে এখনো তার অপেক্ষা আছে।’১৮

 

উদয়শঙ্কর কালচার সেন্টার ও উদয়শঙ্করের সৃষ্টিকর্ম

রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদধন্য উদয়শঙ্কর আলমোড়ায় সিমতোলার পাহাড়ে ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘উদয়শঙ্কর কালচার সেন্টার’। সেখানে জড়ো হন ভারতের শ্রেষ্ঠ সংগীত গুণিজন। জায়গাটি স্থানীয় বাঙালি বি সেনের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া হয়। অতঃপর নির্মিত হলো শান্তিনিকেতন আশ্রমের সঙ্গে মিলিয়ে ইংল্যান্ডের ডারটিংটন হলের আদর্শে বিল্ডিং। ফলে –

উদয়শঙ্করের গুণগ্রাহী এলহার্স্ট বংশীয় এলমো ও তাঁর কন্যা বিয়েত্রিচের বদান্যতায় শিল্পীর স্বপ্ন রূপ পেল কাঠ, পাথর আর সিমেন্টের ইমারতে। সূচনা হলো এক বিশাল কর্মকা-ের। সুদূর দাক্ষিণাত্যের সমতল থেকে আর সারা ভারত থেকে সংগীত, নৃত্যের শ্রেষ্ঠ গুণিজনের সমাবেশ ঘটানো হলো। আলমোড়ায় চাঁদের হাট বসল যেন। ভরতনাট্যমের গুরু ক-পন পিল্লেই, কথাকলির গুরু শঙ্করণ নাম্বুদরি আর মণিপুরীর গুরু আমোবি সিংহ এলেন। যন্ত্রসংগীতের গুণী … বিষ্ণুদাস শিরালি ও আলাউদ্দীন খাঁ এলেন। গানের অংশের ভার পড়ল লক্ষ্মীশঙ্করের ওপর।১৯

এ-কর্মযজ্ঞে আরো শামিল হয়েছিলেন নরেন্দ্র শর্মা, শচীনশঙ্কর, শান্তিবর্ধন, প্রভাত গঙ্গোপাধ্যায়, সিমকি প্রমুখ। একসময় লক্ষ্মীশঙ্করের সঙ্গে রাজেন্দ্রশঙ্করের (১৯০৫-৮২) বিয়ে হয়। লক্ষ্মী ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর হরিজন পত্রিকার প্রথম সম্পাদক আর. ভি. শাস্ত্রীর মেয়ে।২০ অর্থাভাবে কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পূর্বপর্যন্ত এখানে নৃত্য, সংগীত ও নাটকের অনুশীলন হতো। এখানে থিতু হওয়ার আগে উদয়শঙ্কর রবীন্দ্রনাথের ভাবশিষ্য ও শ্রীনিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা এলহার্স্টের আমন্ত্রণে ১৯৩৬ সালে ডারটিংটন, টাটনি, ডোভেন প্রভৃতি স্থানে প্রায় ছয় মাস অবস্থান করেন। এ-সময় তিনি রুশ নাট্যকার আন্তন চেখভের ভাইপো মাইকেল চেখভের সঙ্গেও পরিচিত হন ও তাঁর পদ্ধতিগত শিক্ষাগ্রহণ করেন।

আলমোড়ায় উদয়শঙ্কর কালচার সেন্টার নৃত্য, গীতের জন্য প্রতিষ্ঠিত হলেও এখানে যুগপৎ বিবাহও অনুষ্ঠিত হয়েছে রবিশঙ্কর-অন্নপূর্ণার (১৯৪১) ও উদয়শঙ্কর-অমলা নন্দীর (১৯৪২)। অমলা নন্দীর সঙ্গে বিয়ের পর রামায়ণ-অবলম্বনে নির্মিত হয় রামলীলা ছায়ানৃত্য। গৌতমবুদ্ধের আড়াই হাজার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রচিত হয় ‘মহাভিনিষ্ক্রমণ’ (The Great Renunciation)। সমসাময়িক ঘটনা অবলম্বনে রচনা করেন প্লাবন। এছাড়া ‘অনন্ত সুর মাধুর্য’, ‘গান্ধর্ব্য’, ‘কার্তিকেয়’, ‘বর্ণম’ (ভরতনাট্যম), ‘গজাসুরবধ’, ‘তিলোত্তমা’, ‘উর্বশী’, ‘অস্ত্রপূজা’, ‘শিবতা-ব’, ‘নাগানৃত্য’, ‘রাজপুতবঁধু’, ‘পুংচলম’, ‘ইয়ং ফাদার’, ‘মণিপুরী রাস’, ‘নিরীক্ষণ’, ‘ভরতনাট্যম’, ‘মন্দিরা’, ‘সূর্যপূজা’, ‘স্নানম্’, ‘গ্রাম্য-উৎসব’, ‘বিলাস’, ‘ভিলনাচ’, ‘বিদায়’, ‘নিরাশা’, ‘রাসলীলা’, ‘শিব-পার্বতী নৃত্যদ্বন্দ্ব’ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৭ সালে মানুষের মধ্যে তাঁর নৃত্যশৈলী পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ থেকে নির্মিত হয় কল্পনা চলচ্চিত্রটি। ব্রাসেলস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এটি শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্রের স্বীকৃতি ও সম্মান পায়। রবীন্দ্র শতবর্ষে সামান্য ক্ষতি আর ১৯৬৬ সালে চণ্ডালিকা নৃত্যনাট্যের কাহিনি কিছু পরিবর্তন করে রচনা করেন প্রকৃতি আনন্দ নৃত্যনাট্য। এছাড়া Labour and Machinery, Eternal Melody নৃত্যনাট্য তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি।

১৯৬৮ সালে শেষবারের মতো নতুন ও পুরনো শিল্পীদের নিয়ে দু-মাসের জন্য কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। সানদিয়াগোতে থাকার সময় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের জন্য দেশে ফিরে আসেন। ১৯৬৯-৭০ সালে ‘শঙ্করস্কোপ’ নির্মাণের মাধ্যমে তিনি নতুন পরিচয়ে আবির্ভূত হন। এটি তাঁর শেষ বয়সের অমর কীর্তি। মঞ্চ ও দৃশ্যের সমন্বয়ে এটি এক অভিনব শিল্পকলা। এর মধ্যে প্রযুক্তি বিজ্ঞানের চমৎকারিত্ব অধিক। শুধু তাই নয়, এটি যেন Reality ও Fantacy- র যুগলবন্দি।২১ এরপর তাঁর বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘উদয়শঙ্কর সেন্টার অব ডান্স’। উদয়শঙ্কর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে নৃত্যশাখার ‘ডিন’ নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করে। এ-ছাড়া তিনি ছিলেন সংগীত-নাটক আকাদেমির ফেলো ও আকাশবাণীতে প্রডিউসর এমেরিটাস।

 

উদয়শঙ্করের নৃত্যঘরানা

উদয়শঙ্করের নৃত্যধারাকে সমসাময়িক সমালোচকেরা ÔOriental DanceÕ বা প্রাচ্য নৃত্য বলতে চাইলেও আসলে তাঁর নৃত্যধারা গড়ে উঠেছে ÔOrientalÕ ও ÔOccidentalÕ ধারার সমন্বয়ে। যাকে বলা হয় Neo-Classical বা নব-উচ্চাঙ্গধারা। এই Neo শব্দটি বাংলা ও ইংরেজি অভিধান অনুসারে বহু অর্থবাচক। যেমন – নতুন, New  আধুনিক, Modern; এছাড়া ÔNeoÕ উপসর্গেরও অনেক মানে। যেমন – New, Later, ÔRevived in modified formÕ, ÔBased uponÕ ইত্যাদি। এখানে ÔModified formÕ ও ÔBased uponÕ শব্দদুটি খুবই অর্থবহ।

ওপরের শব্দার্থগত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, Neo-Classical এমন একটি নৃত্যধারা, যাতে ভারতবর্ষের উচ্চাঙ্গনৃত্যের সঙ্গে লোকনৃত্য ও অন্যান্য দেশীয় নৃত্যের ঘটেছে অপূর্ব মিশ্রণ। নৃত্যের এই প্রকরণের সঙ্গে উদয়শঙ্করের নৃত্যধারার রূপটি বিধৃত। বিভিন্ন নৃত্যের বিভিন্ন ধরনের সমবায়ে তাঁর নৃত্যধারা গঠিত হলেও তাঁর নিজস্ব প্রতিভার বলে নৃত্যগুলোকে Modify করে রূপান্তর ঘটিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তাঁর ‘কার্তিকেয়’ নৃত্য। এ-নৃত্যটি কথাকলি ঘরানার হলেও তিনি সরাসরি কথাকলিকে অনুসরণ করেননি। অর্থাৎ ঐতিহ্যের পরম্পরায় নতুন কিছু সৃষ্টির মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মুন্শিয়ানা।২২ এভাবে এ-ধারার সঙ্গে লোকনৃত্য বা দেশীয় নৃত্যের মিশ্রণে হয়ে উঠেছে উদয়শঙ্করের নিজস্ব ধারা, যাকে বলা হয়, ÔUdayshankar School of DanceÕ । তিনি এ-নৃত্যধারায় :

একদিকে যেমন Traditional বা ঐতিহ্যবাহী পৌরাণিক কাহিনীকে নৃত্যের উপজীব্য বা বিষয়সূচীতে (Item) স্থান দিয়েছেন, তেমনি অতি আধুনিক যান্ত্রিক ও প্রযুক্তি বিজ্ঞানের যুগের বিষয়বস্তুও তাঁকে ভাবিত করেছে। আবার এ-ও দেখা গেছে যে, দেশে নতুন কোন কিছু ঘটেছে বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়েছে, তার উপরও তিনি নৃত্য পরিকল্পনা করেছেন। …

উদয়শঙ্করের আঙ্গিক অভিনয়ের Modification-এ [কেন্দ্রাতিগ (Centrifugal) ও কেন্দ্রাভিগ (Centripetal)] কেন্দ্রাভিগ গমনশীলতা, যে গতি ভঙ্গির সৃষ্টি করেছে তাকে ঠিক নাট্যশাস্ত্রে উল্লেখিত অন্তভ্রমরী ও বাহ্যভ্রমরীর কার্বন কপি বলা যায় না। এই অন্তভ্রমরী ও বাহ্যভ্রমরীর স্বরূপকে তিনি নিজের মতো করে modify করে নিয়েছেন। … এই Modification – এর ব্যাপারটা তিনি আহার্য-অভিনয়ের ব্যাপারেও করে নিয়েছেন। যেমন – তাঁর শিবের পোশাক, ট্রাডিশনাল শিবের জটাজুটধারী বাঘছাল পরিহিত নয়, তা সম্পূর্ণ অজন্তা ইলোরার ধরনের অলঙ্করণ-সমৃদ্ধ এক অপরূপ  হ্রস্ব পোশাক, যা পরে তিনি শিবনৃত্যে অংশগ্রহণ করতেন।২৩

উদয়শঙ্করের নৃত্যকলা ভারতীয় ক্লাসিক্যাল ও লোকনৃত্যের সমন্বয়ে গঠিত এক অভিনব নৃত্যকলা, যার সঙ্গে যোগ হয়েছে পশ্চিমা ব্যালে, জাপানের নো (Noh) ও কাবুকি (Kabuki), জাভা-বালির নাচ, সিংহলের ক্যান্ডি নাচ প্রভৃতি। এখানেই উদয়শঙ্করের সার্থকতা। উদয়শঙ্কর তাঁর নৃত্যানুষ্ঠান সম্পর্কে লিখেছেন :

For the artiste the whole universe is a source unending inspiration. The truth hidden is the depths of your heart finds expression through our efforts in dance, music and poetry; Today I feel I should give more to the public; there is so much for the artiste to give, so much for him to take from the people. I fervently believe that we can come closer and unite through art, for does it not bring out the subtle bond that deep down unites us?

No living artiste can help being swayed by the rising forces of the age. The ancient class art, with all its sophistry, its refinement and its ideology is there; but then there is also, and more evident today than ever, the life of the masses with its vigour, vitality, simplicity and the generative progressive spirit into some aspects of which I have striven to best of my ability to give some glimpses.

While you watch the programme unfolding, you may possibly feel confused. You may not find a meaning to each moment or note. But if you take it in its entirety, you will find it welded together by the ever present vein that pulsates in life with unabated vigour.

In the programme we try to voice our cultural aspirations, our dreams, where strife is subordinated to the demands of the spirit of beauty in life. That is our humble contribution, our loving offering to you.

Udayshankar24

 

উদয়শঙ্করের নৃত্য-বৈশিষ্ট্য

আধুনিক শিল্পকলার ইতিহাসে নৃত্য একটি বিশেষ ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও এ-ধারার সূত্রপাত হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। সেই সময় থেকে কালের বিবর্তনে বর্তমান ধারায় এসে পৌঁছেছে। ভারতীয় নৃত্যধারার গতি-প্রকৃতি নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রধানত তিনটি ধারার মধ্যে আদিবাসী নৃত্য, লোকনৃত্য ও শাস্ত্রীয়/ ধ্রুপদী/ উচ্চাঙ্গনৃত্য। লোকনৃত্যকে মাঝখানে রেখে কমপক্ষে পাঁচ হাজার বছর ধরে বহমান নৃত্যধারার গতিপ্রকৃতি হবে অনেকটা এরকম : Tribal Dance > Quasi-Folk Dance > Folk Dance > Classico-Folk Dance > Classical Dance > Neo-Classical Dance > Modern, Creative and Innovative Dance। যদিও আদিবাসী নৃত্য, লোকনৃত্য ও উচ্চাঙ্গনৃত্যের মধ্যে পার্থক্য ও সাযুজ্য থাকলেও ভারতীয় ক্লাসিক্যাল নাচের উৎপত্তির মূলে লোকনৃত্য যে বিশেষভাবে সক্রিয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ-লোকধারা মণিপুরি, কথাকলি, ভরতনাট্যম, কুচিপুরি, ওড়িশি, কথক প্রভৃতির মধ্যে একান্তভাবে বর্তমান। এই লোকধারা ও ক্লাসিক্যাল ধারার সমন্বয়ে প্রবর্তিত উদয়শঙ্করীয় ধারাকে রবীন্দ্রনাথ ঘবড়-ঈষধংংরপধষ আখ্যা দিলেও তাঁর নৃত্যধারার আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন – তাঁর নৃত্যে দেহভঙ্গিমায় ভাস্কর্যের প্রাধান্য। যাকে এখন কোরিওগ্রাফি বলা হয়, তার সূচনাকারী উদয়শঙ্কর হলেও পাশ্চাত্যের কোরিওগ্রাফির চিত্রধর্মিতার সঙ্গে ভারতীয় নৃত্যের সমন্বয় ঘটিয়েছেন তিনি।২৫ তাঁর নৃত্যে আছে দেশজ ধারার প্রাধান্য। তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যে আছে পাশ্চাত্যের Showmanship প্রাচ্যের ‘পরিমিতিবোধ’। ঠিক এজন্যেই তাঁর নৃত্যের এত খ্যাতি। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে তাঁর নৃত্যে ইউরোপীয় Expressionist ও Impressionist নৃত্যের সূক্ষ্ম প্রভাব বিদ্যমান। বিশুদ্ধ যন্ত্র-সংগীতের ওপর তাঁর নৃত্য প্রতিষ্ঠিত। তাঁর নৃত্যে বালি ও জাভার ছায়ানৃত্যের প্রভাব আছে। আছে ওজঃগুণ ও প্রসাদগুণ, যা ভারতীয় শিল্পকলার প্রধান দুটি বিষয়। নৃত্য সৃষ্টিতে তিনি যে ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তাকে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব বলতে হবে।২৬

এসব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত উদয়শঙ্করের নৃত্য নৃত্য-সমালোচকদের কাছে সমালোচনার বদলে পেয়েছে পূজা, আলোচনার বদলে মুগ্ধতা, আর দর্শনমাত্রেই অনুপ্রাণিত মানুষেরা তাঁর বিরাটত্ব ও মহত্ত্বে অভিভূত হয়েছেন। তাঁর নাচ দেখে সম্মোহিত কবি জেমস জয়েস তাঁর মেয়েকে লেখেন :

I send you the programme of the Indian dancer Udayshankar. If he ever performs at Geneva don’t miss going there. He leaves the best of the Russians far behind. I have never seen anything like it. He moves on the stage floor like a
semi-divine being. Altogether, believe me, there still some beautiful things in poor old world.২৭

উদয়শঙ্করের নাচের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ কবি জেমস জয়েসের ংবসর-ফরারহব শব্দের প্রয়োগ জানিয়ে দেয় তিনি কোন মাপের শিল্পী ছিলেন। ১৯৭৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি কলকাতায় মাত্র ৭৭ বছর বয়সে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

বর্তমান শতাব্দীতে উদয়শঙ্করসহ রবীন্দ্রনাথ ও গুরুসদয় দত্ত (১৮৮২-১৯৪১) নৃত্যে যে-পরিবর্তন এনেছেন এবং নৃত্যের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করেছেন, তা শ্রদ্ধার সঙ্গে চিরস্মরণীয় হলেও তাঁর এ-সার্থকতা ধরা আছে তাঁর স্ত্রী অমলাশঙ্কর, কন্যা মমতাশঙ্কর ও পুত্রবধূ তনুশ্রীশঙ্করের মধ্যে। অমলাশঙ্করের নৃত্যনাট্যগুলোর মধ্যে বাসবদত্তা ও সীতা স্বয়ম্বরা, মমতাশঙ্করের আজকের একলব্য উল্লে­খের দাবি রাখে।

 

তথ্যসূত্র

১.            সেলিনা হোসেন ও নূরুল ইসলামসম্পাদিত, বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান, ঢাকা, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৭, পৃ ৯৪। এ-গ্রন্থে বলা হয়েছে উদয়শঙ্করের জন্ম হয়েছিল কালিয়ায়ে।

২.           স্বপনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘অন্নপূর্ণা’, শারদীয় দেশ, ১৪০৪, পৃ ২০৪।

৩. দ্রষ্টব্য : Rabindranath Tagore, GITANJALI, Distributors, J. N. Ghose & Sons, To William Rothenstein.

৪.           রবিশঙ্কর, স্মৃতি, সম্পাদনা : শঙ্করলাল ভট্টাচার্য, কলকাতা, সাহিত্যম্, ১৯৯২, পৃ ২৬।

৫.          কনকলতার ডাক নাম ‘মীনা’ হতে পারে। তিনি কেদারশঙ্করের মেয়ে। স্মৃতি, প্রাগুক্ত, পৃ ২৬।

৬.          স্বপনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘অন্নপূর্ণা’, প্রাগুক্ত, পৃ ১৮৯।

৭.   রুক্সিণী দেবী সম্পর্কে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সেতারশিল্পী রবিশঙ্কর A Great Indian আখ্যা দিয়ে বলেন : ‘All I can say about Srimati Rukshmini Devi, restraining myself from becoming emotional, is that she was a very special person! Though I have known her for about 40 years, I came into close contact with her within the last ten years of her life. Her creation of ‘Kalakshetra’ and contribution to Indian dance, music and  allied cultural tradition is well known.

She is the only other great personality after Rabindranath Tagore (who created Shantiniketan), to have achieved and contributed to her country and people so much in her own life time. Though I know that it is meant for political Stalwarts only, still how I wish she had got the recognition ÔBharat RatnaÕ from our government before she died.’

      Kalakshetra Quarterly, vol. viii No. 3-4, page 95.

 

শঙ্করলাল মুখোপাধ্যায়, ভারতীয় নৃত্যধারার সমীক্ষা, কলকাতা, ফার্মাকেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৯৭, পৃ ৫৪৬।

৮.          স্মৃতি, প্রাগুক্ত, পৃ ২৬।

৯.           অঞ্জলি বসু-সম্পাদিত সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, কলকাতা, সাহিত্য সংসদ, ২০০২, পৃ ৬২৩-২৪।

১০. তিমিরবরণ ছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্য। তিনি উদয়শঙ্করের দলে থাকার আগে কলকাতায় অর্কেস্ট্রার দল করেন। তিনি আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সরোদ বাজানো শিখে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কলকাতায় একটি ব্যান্ড গঠন করেন। অতঃপর উদয়শঙ্করের দলে যোগদান।

গোলাম মুরশিদ, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, ঢাকা, অবসর ২০০৬, পৃ ৩৫০।

১১.         শৈবাল গুপ্ত, কিছু স্মৃতি কিছু কথা, কলকাতা।

১২.        চণ্ডী সেনগুপ্তের চিঠি, তারিখ : ১৫.০৩.২০১২।

১৩.        মতিউর রহমান, ‘রবিশঙ্করের অনুপম সান্নিধ্য’, প্রথম আলো, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১২।

১৪.         শঙ্করলাল মুখোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ ৫২২-২৩।

১৫. রোদেনস্টাইনের প্রভাব ও ভূমিকা প্রসঙ্গে উদয়শঙ্কর বলেন : ‘William Rothenstein had a perfect understanding of what I was doing. He was the first to open my eyes to the culture and beauty of India and her arts.’

তদেব, প্রাগুক্ত, পৃ ৫৩৩।

১৬.        তদেব, প্রাগুক্ত, পৃ ৫২৪।

১৭.         তদেব, প্রাগুক্ত, পৃ ৫২৪।

১৮. প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য প্রবেশক, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, পুনর্মুদ্রণ ১৪০৬, পৃ ৫২৪।

১৯. স্বপনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘অন্নপূর্ণা’, প্রাগুক্ত, পৃ ১৮৯।

২০. সুরঞ্জন রায়, কালিয়া জনপদের ইতিহাস, ঢাকা, র‌্যামন পাবলিশার্স, ২০১৬, পৃ ৩২৯।

২১. শঙ্করলাল মুখোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ ৫৩২।

২২. তদেব, প্রাগুক্ত, পৃ ৫২৮-২৯।

২৩. তদেব, প্রাগুক্ত, পৃ ৫২৯।

২৪. পঞ্চাশের দশকে কলকাতার নিউ এম্পায়ার মঞ্চে অনুষ্ঠিত উদয়শঙ্করের নৃত্যানুষ্ঠানের ‘সুভেনির’ থেকে উদ্ধৃত। তদেব, প্রাগুক্ত, পৃ ৫৩২-৩৩।

২৫. বিশ শতকে রবীন্দ্রনাথ ও উদয়শঙ্করের হাতে নৃত্যের বিকাশ হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজে না নেচে মণিপুরি ও কথক নাচের ওপর ভিত্তি করে নতুন নৃত্যঘরানা গড়ে তুলেছিলেন। আর উদয়শঙ্কর পাশ্চাত্য নৃত্য দেখে ভারতীয় নাচের সঙ্গে সমন্বয় করে নতুন ধরনের নাচের সৃষ্টি করেন, যাকে বর্তমানকালে বলা হয় কোরিওগ্রাফি। ভারতবর্ষে উদয়শঙ্কর এ-রীতির সূচনাকারী।

গোলাম মুরশিদ, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, প্রাগুক্ত, পৃ ৩৫০।

২৬.       তদেব, প্রাগুক্ত, পৃ ৫৩৩-৩৪।

২৭.        তদেব, প্রাগুক্ত, পৃ ৫২৬।