উৎপলকুমার বসুর কবিতা ও অন্যান্য

পিয়াস মজিদ

কবিতা এবং কবিতা

প্রথম কবিতাগ্রন্থ চৈত্রে রচিত কবিতার (১৯৬১) ‘নবধারাজলে’ কবিতায় উৎপলকুমার বসু (১৯৩৭-২০১৫) বলেন –

মন মানে না বৃষ্টি হলো এত

সমসত্ম রাত ডুবো-নদীর পারে

আমি তোমার স্বপ্নে-পাওয়া আঙুল

স্পর্শ করি জলের অধিকারে।

…   …   …

স্পর্শ করে অন্য নানা ফুল

অন্য দেশ, অন্য কোনো রাজার,

তোমার গ্রামে, রেলব্রিজের তলে,

ভোরবেলার রৌদ্রে বসে বাজার।

এমন নবধারাজলের অঙ্গীকার নিয়ে বাংলা কবিতায় উৎপলকুমার বসুর রাজসিক আবির্ভাব। জন্মেছিলেন কলকাতার ভবানীপুরে, পৈতৃক বাসস্থান বাংলাদেশের বিক্রমপুরের মালখানগরে। চৈত্রে রচিত কবিতা, পুরী সিরিজ, আবার পুরী সিরিজ, লোচনদাস কারিগর, খ-বৈচিত্র্যের দিন, সলমা-জরির কাজ, সুখ-দুঃখের সাথী, কহবতীর নাচ, নাইটস্কুল, টুসু আমার চিমত্মামণি, মীনযুদ্ধ, বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে, পিয়া মন ভাবে, বেলা এগারোটার রোদ, অন্নদাতা যোসেফ, হাঁসচলার পথ ইত্যাদি বিভিন্ন বইয়ে, পুসিত্মকায় ও সংগ্রহে বিসত্মীর্ণ কবিতাগুচ্ছে দৃশ্যমান বস্ত্তপুঞ্জের মর্মে নিহিত শ্বাসমহলকে যেন অক্ষরের অবয়ব দিয়েছেন তিনি। প্রথাজর্জর নন্দনের নিকুচি করে, প্রচল প্রকরণের সীমানা ভেঙে উৎপলকুমার বসু মানবীয় অভিজ্ঞতার অতিচেনা সত্মরকে এক অভাবিত রূপকুশলতায় কবিতা করে তুলেছেন। ধাতুফলক থেকে আকাশশিখর সবই তাঁর কাছে ছিল অনিবার্য কবিতা। প্রথম বই নিয়ে ব্যক্ত এক অনুভূতিতে ধরা দিয়েছে তাঁর কবিতার ঘরসংসারের সদস্যদের নাম খতিয়ান –

দেয়ালে টাঙানো মলিন ম্যাপের কথা স্মরণে আসে। ঝুলছে ছবির ক্যাল-ার। পাতা ছেঁড়া। বহু পুরনো বছরের। এবং আছে স্থিরচিত্র। উনোনের ধোঁয়া-কালো দেওয়ালে কাচ-বাঁধাই কাঠের ফ্রেম। গোল চাকার মতো বৃত্তের ভিতরে বৃত্ত, তারপর একে একে ছোট           হয়ে-আসা, ঘন এবং ধূসর হতে-থাকো, বালি কাগজের সঙ্গে একাত্ম আলেখ্য – কাশী, বিশ্বনাথ, জগন্নাথদেব, শ্রীদ্বারকা, মক্কার কালো পাথর, শশিভূষণ তাজমহল, দূরে আকাশের কোনা ঘেঁসে উর্দু বাক্য, সংস্কৃত সুভাষিত, অক্ষরের শস্য, পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে, হিমালয়ে সুপ্রভাত, বিন্ধ্যের সূর্যাসত্ম, মরম্নভূমির নিদ্রাহীনতা।

ঐ সবই কি আমার প্রথম বই নয়? লিপিকার হয়ে-ওঠার প্রথম সংস্করণ কি ঐসব অনুশীলনী নয়?…

কবিতাজীবনের প্রারম্ভপর্বেই জীর্ণ-পুরনোর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। হাংরি প্রজন্ম আন্দোলনের আভায় নিকষিত ছিল তাঁর কবিতাচিমত্মা ও প্রকাশভঙ্গি। এই আন্দোলনসূত্রে ১৯৬৪-তে তাঁর বিরম্নদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা পর্যমত্ম জারি হয়; ফলে যোগমায়া কলেজের অধ্যাপনা থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হয় তাঁকে। কবিতা লেখা থেকে সাময়িক বিরতি নিয়েছেন বটে কিন্তু কবিতার জন্য কোনো আপসরফায় স্বাক্ষর করেননি। ভূতাত্ত্বিক জরিপ ছিল তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়নের বিষয়। দেশে-বিদেশে এই বিষয়ে নিবিড় অধ্যয়ন তাঁকে উপহার দিয়েছে কবিতাভিজ্ঞতার নতুনতর বলয়। বলা হয় – কবির জন্য কোনো অভিজ্ঞতাই ঊন বা গুরম্নত্বহীন নয়; উৎপল ভূতাত্ত্বিক জরিপের কলাকাঠামো অনুধাবনের গোপন-গহন গভীর নির্জনপথে নিক্ষেপ করলেন তাঁর প্রখর কবিতাদৃষ্টির রঞ্জন। তাই সমসাময়িকের সহস্র ভিড়ে শুরম্ন থেকেই তাঁকে আমরা পাই যেন এক নিরালা-নিঃসঙ্গ দ্বীপের মতো। যুগপৎ আপন অভিশাপে ও মহিমায় যেন ক্রমশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছেন তিনি।

১৯৬৪-তে তিনি সমুপস্থিত তাঁর বিধ্বংসী-স্বর্ণালি পুরী সিরিজ (১৯৭৮-এ প্রকাশিত হয় এর পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণ আবার পুরী সিরিজ) নিয়ে। বইয়ের শেষ প্রচ্ছদে মুদ্রিত বিজ্ঞাপন-ভাষ্যের মতে, এতে ‘সমুদ্র, বামন, তাঁতকল, শিকারি, সতী, নপুংসক, মিসিবাবা, এয়ারোড্রোম, সূঁচ ও আত্মা, রণরক্ত ও সন্ধ্যাবাতাস, কৈবল্য ও ঈশ্বরোপাসনার কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। পাঠকের ব্যক্তিগত আনন্দের জন্য এক নিষিদ্ধ পারমাণবিক চুলিস্ন খুলে দেখানো হল এই গ্রন্থে।’ না, কোনো আলংকারিক বচন নয়, প্রকৃতই এক পারমাণবিক চুলিস্নর প্রসত্মাবনা যেন পুরী সিরিজের এসব কবিতা। এই একটি বইয়েই যেন এক অনন্য প্রভাবরেখা তৈরি হলো বাংলা কবিতায়। কোনো ধারাবাহিকতার ফসল হিসেবে সীমাবদ্ধ করা যাবে না পুরী সিরিজের তাৎপর্য; কারণ পুরী সিরিজ নিজেই হয়ে উঠল এক বলবান ধারা।

দৃশ্যবাসত্মবের অমত্মর্মহলে এমনই এক অতিদৃশ্যের দেখা পেলেন তিনি যেখানে – ‘জলের রং লৌহমরিচার শিকলের মতো লাল।’ আর এই দর্শনের অভিজ্ঞান কবিকে ছুড়ে দেয় আরো গভীর আত্মজিজ্ঞাসায় –

ভিখারির ছলে মিশে আমি কি শুনিনি

জলের গভীরে রম্নদ্ধ শৃঙ্খলের ধ্বনি!

রম্নদ্ধ জলগভীরের ধ্বনিমালা ভাঙতে ভাঙতে অতঃপর – চাঁদ দেখে তাঁর মনে পড়ে যায় কেন্দ্রীয় কৃষি সমবায়, শামিত্ম বেগমকে একা উঠে যেতে দেখেন নভবাথরম্নমে, প্রিয়তমার চুলের ভিতরে দেখলেন ভারতীয় ভূমিজরিপের যন্ত্রগুলো শুয়ে থাকে, তাজমহলের গায়ে বসে থাকতে দেখেন শকুন। শুনলেন গাছে গাছে কোকিল ‘কোকেইন কোকেইন’ বলে ডাকছে আর তাঁর স্বপ্নের ভিতর দিয়ে চলে যেতে থাকে আরোহীবিহীন পদ্মাবোট। জীবন ও কবিতা উৎপল বসুর কাছে অভেদার্থে ধরা দেয়। তাই পুরী সিরিজের শেষ কবিতায় আমরা পড়ে থাকি –

তোমার ব্যক্তিগত বসমত্মদিনের চটি হারিয়েছ বাদামপাহাড়ে।

আমার ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা আমি হারিয়েছি বাদামপাহাড়ে।

জীবন ও লেখনভঙ্গি উভয়ের ভেতর অবলুপ্ত বসমেত্মর আশঙ্কা দেখেও কবিপ্রত্যয় –

প্রিয় হে, সবুজ ফল

তোমাকে কঠিন হতে

দেব না…

বসমেত্ম ব্যাপক কোনো লতার আড়াল থেকে গোপন পলস্নবজাল সরিয়ে নির্ভয়ে ‘কুহু’ ডাক দিতে যিনি একদা ‘মূর্খ’র ভূষণ চেয়েছেন সেই কবি উৎপলকুমার বসু লোচনদাস কারিগর, খ-বৈচিত্র্যের দিনে উপনিবেশ সময়ে রাজপুরম্নষের ছায়া ক্রমশ লম্বা হতে দেখে হৃদয়কে করেছেন রণনিমিত্ত। প্রসূতিশালায় দেখেছেন ধাত্রী-প্রেতের আনাগোনা, ফরাসি বিপস্নবের প্রশ্নোত্তর খাতার পাতায় পাতায় লেগে থাকতে দেখেছেন অমোচ্য রক্তের দাগ, ত্যক্ত খোলসকে চলতে দেখেছেন এঁকেবেঁকে সাপের সন্ধানে আর আত্মার মাঝে বারবার বেঁচে উঠতে দেখেছেন সহস্র সূচ।

উৎপলকুমার বসু ছন্দে-নির্ছন্দে কবিতাকে সৃজনশ্রী দিয়ে প্রমাণ করেছেন প্রথামান্য প্রকরণসমূহেই বাংলা কবিতার সম্ভাবনা নিঃশেষ হতে পারে না। কবিতা বরং ইতিহাস-ভূগোল-শব্দ-কল্পনা-রক্ত-ঘাম-উলস্নাস আর রোদনের হ্রদমাখা পূর্বোক্ত সেই পারমাণবিক চুলিস্ন – তাই কহবতীর নাচের কুড়ি নং কবিতায় রম্নটির গুঁড়ো থেকে ব্রিটিশ ভারতের উত্তাল ‘রশীদ আলি দিবস’ সব একাকার কবিতা হয়ে যায় এক অভূত আলকেমিতে –

…ঝরে পড়ে রম্নটির গুঁড়ো, গোলমরিচ, মোটা দানার চিনি, কালো কালো পিঁপড়ে আর একের পর এক নববই সাল, আশি, ঊনসত্তরের শেষ কয়েকটা মাস, এপ্রিল বাষট্টি, সাতান্নর শীত ঋতু, ধুবুলিয়া উনিশশো পঞ্চাশ, রশীদ আলি দিবস, বেয়ালিস্নশের ক্ষেতখামার।

তমসা নদীর তীরে বসে কবিতার আলো জ্বালতে গিয়ে কবি দেখেছেন চারপাশে ধুধু মহাভারতের মাঠ, হোমারের উপকূল আর অনমত্ম        এজিদ-কামত্মার। এমন রণক্ষেত্র-বাসত্মবতায় এক জীবন যাপন করে কবির কণ্ঠে যেন সমকালীন মানুষেরই উপলব্ধ স্বর –

মরে গেলে হবে? তারও পরে খরচাপাতি আছে।

(‘টুসু আমার চিমত্মামণি ৩’)

শুরম্নতে বলেছিলাম হাংরি প্রজন্ম আন্দোলনে তাঁর সবিশেষ যুক্ততার কথা। সত্যিই ক্ষুধার্ত আগুন তিনি যেন ধিকিধিকি জ্বালিয়ে রেখেছেন কবিজীবনের সক্রিয় শেষ অবধি। তাই পরিবর্তনের মনোরঞ্জন মচ্ছব সবলে প্রত্যাখ্যান করে যে বাংলা ভাষা তাঁর ‘মুখ আদরে মোছায়, সিঁথি কেটে দেয়’ তার কাছে নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দি করে একে একে মুক্ত করতে চাইলেন রম্নদ্ধ শৃঙ্খলের ধ্বনিসকল। উৎপলকুমার বসুর বিষয় আর বিভূতি নিয়ে তাই আলাদা বাগ্বিসত্মারের সুযোগ নেই কোনো। প্রেমের কবিতা কিংবা রাজনীতির কবিতা বলে তাঁর কবিতার পৃথক বর্গীকরণও সম্ভব নয়। তাঁর কবিতাবিশ্বে প্রেম ও রাজনীতি সবই এক অভিন্ন রসায়নে জারিত।

উৎপলকুমার বসু অর্ধশতকের অধিককাল ধরে কবিতাভাবনা-ভাষা ও ভঙ্গিতে নবীনতাকে স্বভাবমুদ্রা করে নিয়েছিলেন। কবি জয় গোস্বামী উৎপল মূল্যায়নমূলক গ্রন্থ পুরী সিরিজের কবির (দে’জ পাবলিশিং, জানুয়ারি ২০১৪)-এর ছয়টি লেখায় নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বিষয়টি। ‘সময় থেকে এগিয়ে’, ‘আশ্চর্যের মুখোমুখি’, ‘ঘুম আর অনমত্ম সকাল’, ‘শিল্প, প্রাণী, বৃক্ষ’, ‘নতুন চিমত্মা’, ‘দিন আর জ্যোৎস্না’ শীর্ষক প্রবন্ধগুচ্ছে জয় দেখাচ্ছেন সময় থেকে অগ্রগামী কবির বিজয়ী কেশরেখার নিশানা কবিতার আকাশে কেমন পতপত করে। দেখান, বহির্পৃথিবীতে বসবাসের তাপ ও হিম কী করে অনায়াসে উৎপলকুমার বসুর কবিতা হয়ে যায়। কিংবা কোন প্রক্রিয়ায় শিল্প, প্রাণী, বৃক্ষ কথা কয়ে ওঠে উৎপলীয় ভুবনে। জয়ের যথার্থ পর্যবেক্ষণ এই যে, চিমত্মার নতুনতাই সামান্যের অমত্মর্গতে অসামান্য আবিষ্কারণের অস্ত্র অর্পণ করেছে উৎপলের অব্যর্থ হাতে। উৎপল বসুর সত্তর পেরোনো মুহূর্তে জয় গোস্বামীর কবিমূল্যায়ন বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য –

এ হল সেই বয়েস, যেখানে পৌঁছে কবিরা অবসন্ন হয়ে পড়েন, নতুনত্বের অভাব জীর্ণ করে তাঁদের লেখাকে, কেবলই পুরাতন খ্যাতি নির্ভর করে বাঁচতে হয় তাঁদের। অথচ উৎপল, তাঁর কবিতায় কেবলই, একের পর এক আশ্চর্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন আমাদের।

 

ধূসর আতাগাছ ও অন্যান্য : গল্পকার উৎপল

কৌরব প্রকাশনী থেকে ১৯৯৪-তে প্রকাশিত হয় উৎপলকুমার বসুর প্রথম গল্পগ্রন্থ ধূসর আতাগাছ। এরপর প্রতিবিম্ব প্রকাশনী থেকে বের হয় তাঁর কয়েকটি গল্প। উৎপলের গল্প পড়তে গিয়ে ভীষণভাবে মনে পড়ে হোর্হে লুই বোর্হেসের কথা, যিনি মনে করতেন সময়ের রূপামত্মরণে শিল্পমাধ্যমের সংজ্ঞাগত ভিন্নার্থক অসিত্মত্ব অর্থহীন হতে বাধ্য। তখন গল্পই হয়ে যাবে কবিতা, কবিতাই হয়ে যাবে গল্প, উপন্যাস হয়ে যাবে নাটক। ‘জয়মলস্নার প্রসন্ন’, ‘বাবুরাম প্রচারশিল্প’, ‘সরলতা মিরর হাউস’, ‘ধূসর আতাগাছ’, ‘বড়দিন’, ‘ঘড়ি’, ‘নরখাদক’, ‘টোকিও লন্ড্রি’, ‘একদিন’, ‘শীতের সকালে’, ‘রত্নাকর দেখেছিল’ এমন দশটি গল্পে উৎপল বসু খুলেছেন সাহিত্যের আরেকটি জোরালো ফ্রন্ট, যেখানে বিধিবদ্ধ আখ্যানের মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হয়েছে আর মানুষী অভিজ্ঞতা ও অনুভবের চোরাকুঠুরির দেখা পেয়েছি আমরা। এক পাতার ‘সরলতা মিরর হাউস’ থেকে ‘রত্নাকর দেখেছিল’র মতো দীর্ঘ গল্প লিখেছেন তিনি। দু-একটি উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যাবে উৎপল বসুর গল্পগদ্যের ধার –

তোমাদের লেখালেখিতে দেখি, কমলবাবু, মৃত্যু সম্বন্ধে অনেক দু-চার কথা বলে থাকো। অপরের মৃত্যুশয্যার পাশে দাঁড়িয়ে যে দেহাবসানগুলি দেখেছি, সেগুলিকেই আমি যথার্থ মৃত্যু বলে জানি। বুঝেছি, মৃত্যু দুই প্রকারের। এক : ভালোবাসার সমর্থনে মৃত্যু। অপরটি : পার্থিব ভালোবাসার বিরোধী। ভালোবাসার সমর্থনে যে-মৃত্যু অর্থাৎ দেশপ্রেমীর আত্মত্যাগ, প্রেমাস্পদের আত্মহনন, প্রিয়জনের বিরহে মরণোন্মুখতা – সবই বহুলাংশে অ্যাবস্ট্রাক্ট এবং তার বাসত্মব আমাদের তৈরি করে নিতে হয় এবং আমরা তখন আবেগকে ‘টুল’ হিসেবে ব্যবহার করি, অ্যাবস্ট্রাকশনকে কংক্রিটহাউস করার জন্য আলস্যপ্রিয় বাঙালি এই ভোঁতা হাতিয়ারটি কাজে লাগায়, কারণ ওই আমাদের রোমান্টিকতা, নাটুকেপনা, জহরব্রত, ফাঁসির মঞ্চে তথাকথিত জীবনের জয়গান।

                                            (‘ধূসর আতাগাছ’)

বলার বিষয় এই যে, স্বয়ং উৎপল বসু তাঁর গল্পের তীক্ষ্ণ ফলা থেকে অবিদ্ধ থাকেন না। উলিস্নখিত গল্পের শেষাংশে দেখি গল্পকার এক ‘আলস্য আশ্রম’ গড়বেন বলে স্থির করেছেন; সেখানে পাঠককে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলা হয় এই আশ্রমে গেলে বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া এরিয়ার চেক,  উচ্চ মাধ্যমিকের জাল মার্কশিট এবং উৎপলকুমার বসুর বাড়ির ঠিকানা-লেখা কাগজটিও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। উৎপল বসুর বিধ্বংসী গল্প বোধ করি ‘নরখাদক’। প্রতিবেদনের ঢঙে লেখা এ-গল্পে মানুষের মৃত্যু-উত্তর মিশরীয় সমাজে মৃতদেহ সংরক্ষণের রোমহর্ষক বিবরণ ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে নরখাদক চরিত্রের বিনির্মাণ; জ্যামত্ম মুরগির ছাল-মাংস-তন্ত্র-পিত্ত-রক্ত-চর্বি-হাড় খাওয়ার নৃশংস বর্ণনার সমামত্মরালে নরখাদকের করম্নণ জীবনকে জাজ্বল্য করেন উৎপল; স্বাভাবিক মানুষের মতোই ‘ক্ষুধা যার অভিন্ন মাতৃভাষা’।

উৎপলকুমার বসুর গল্প এমন ধারণার জন্ম দিতে থাকে যে, হ্যাঁ, এই সময়ে প্রকৃত গল্প ও কবিতার ফারাক ফুরিয়েছে।

 

ননফিকশনাল গদ্য, অনুবাদ ও সম্পাদনা

উৎপলকুমার বসুর ননফিকশনাল গদ্যে যুক্তি ও রম্যতার একত্র-সমাবেশ ঘটেছে। নানান রচনা ও সাক্ষাৎকারে বলেছেন তিনি ধ্রম্নপদী বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহের কথা। নিজের গদ্যেও এই ধ্রম্নপদিয়ানার রং-ছাপ গুরম্নভার বিষয়কে সাবলীল সৌন্দর্যের ছটায় করে তুলেছে পাঠ-সাবলীল। ‘প্রিয় পাঠ’ লেখায় তিনি বলেন, কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে পড়া সতীনাথ ভাদুড়ীর জাগরী তাঁকে প্রাপ্তবয়স্ক করে তুলেছিল – ‘ছিলুম হিউম্যানিস্ট। হয়ে গেলুম এগজিস্টিয়েন-শিয়ালিস্ট।’

গদ্যসংগ্রহ-১ (নান্দীমুখ সংসদ, ২০০৬) বইয়ের ‘সমালোচনা সাহিত্য’ অংশ উল্টে দেখা যায়, কত বিচিত্র বইয়ের দিকে ছিল তাঁর বিচরণ ব্যাপ্ত। ভবতোষ দত্তের তামসী, পরিমল গোস্বামীর দ্বিতীয় স্মৃতি, অজয় হোমের চেনা-অচেনা পাখি, কেতকী কুশারী ডাইসনের ভাবনার ভাস্কর্য, জীবনানন্দ দাশের কাব্যসংগ্রহ, যতীন্দ্রমোহন রচনাবলী, জাহিরম্নল হাসানের উর্দু ভাষা ও সাহিত্য, সৌরীন ভট্টাচার্যের উন্নয়ন : অন্য বিচার, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণের রূপরেখা, হিরণ মিত্রের আমার  ছবি-লেখা, গোল্ডেন বুক অফ বিদ্যাসাগর, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদ্রোহে বাঙালী, জয়মত্ম গোস্বামীর মৌখিক সাহিত্য গবেষণা : পদ্ধতি ও প্রয়োগ, দিব্যজ্যোতি মজুমদারের বাঙলা লোককথার টাইপ ও মোটিফ ইনডেক্স, বিষ্ণু দে-র এলোমেলো জীবন ও শিল্প সাহিত্য, উইলিয়াম রাঁদিচির সিলেকটেড পোয়েমস অফ রবীন্দ্রনাথ, সুরভি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাশিল্পী সত্যজিৎ, কমলকুমার মজুমদারের লুপ্ত পূজাবিধি ইত্যাদি বিচিত্র বইপত্রের পাশাপাশি ক্যানভাসারের হাতে বিক্রি করা ফুলবালা রায়ের আড়াই টাকা মূল্যের ভূতের পালস্নায়, ভূতের জলসাঘর, জাহাজে আজব খুনের মতো বই নিয়েও তিনি কলম ধরেছেন। কারণ তিনি মনে করতেন, বটতলাপ্রতিম ইত্যাকার লেখাকে ‘আগাছা’ বলে উপেক্ষার সুযোগ নেই বরং এরা অতিসাধারণ মানুষের কথা শৈল্পিক প্রসাধন ছাড়া যে প্রাণদায়িনী ভঙ্গিতে সংকলন করে থাকে, সাহিত্যের ক্যানভাসে কোনো না কোনোভাবে এর মূল্য রচিত হয় বটে।

ব্যক্তিত্ব মূল্যায়নেও ব্রতী হয়েছিলেন উৎপলকুমার বসু। বঙ্কিমচন্দ্র, মহাত্মা গান্ধী, কমলকুমার মজুমদার, সমর সেন, সমরেশ বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, পিকাসোকন্যা পালোমা পিকাসো, এডওয়ার্ড জন টমসনের মতো ব্যক্তিত্বদের নিয়ে লিখেছেন তিনি। উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে ছাপিয়ে তাঁর এসব মূল্যায়ন হয়ে ওঠে মহার্ঘ্য রচনা। তাই চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে তাঁর লেখায় উঠে আসে কমেডির সমাজতত্ত্ব। নষ্ট আত্মার টেলিভিশনের অকালগত কবি ফাল্গুনী রায়ের খোলা চিতায় – অবহেলিত দাহে উৎপল বসু সময়ের সৎকার হতে দেখেছেন যে-সময়ে তাঁর ভাষায় ‘সমুদ্রও জং ধরা’; সে সময়ভস্মের ইতিউতি ছাইয়ে অতঃপর যেন মুদ্রিত হতে থাকি আমরা পাঠকসকল। ফাল্গুনী রায়ের বই আমাদের প্রতারক জীবন ও শিল্পচর্চার মুখে আততায়ী হাসি নিক্ষেপ করে যাবে বলে  উৎপলের বিশ্বাস।

১৭৮৪ সালে একটি জার্মান পত্রিকা পাঠকের কাছে  ‘এনলাইটেনমেন্ট’ বা ‘জ্ঞানদীপ্তি’ নিয়ে মতামত জানতে চায়। উত্তরে ইমানুয়েল কান্ট পাঠক হিসেবে একটি পত্র প্রেরণ করেন। এই পত্রপ্রবন্ধটি ‘জ্ঞানদীপ্তি কাকে বলে’ শিরোনামে ক্যাথরিন পোর্টারের ইংরেজি তর্জমা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন উৎপল। এর মধ্য দিয়ে যেমন তাঁর দার্শনিক আগ্রহের পরিচয় আমরা পাই, তেমনি এর দীর্ঘ ও যৌগিক বাক্যভাঙা পাঠস্বাচ্ছন্দ্যশীল সাবলীলতা অনুবাদক উৎপলের স্বাতন্ত্র্যের সাক্ষ্য দেয়।

আলোক সরকার, কালীকৃষ্ণ গুহ, প্রকাশ কর্মকার এবং ভূমেন্দ্র গুহের সঙ্গে যুক্তভাবে উৎপলকুমার বসু এক সময় সম্পাদনা করেছেন কবিতা ও কবিতাবিষয়ক ভাবনার পত্রিকা দরগারোড। মার্চ ১৯৯৫-এ  প্রকাশিত এর প্রথম খ–র চতুর্থ সংখ্যা হাতে নিয়ে দেখা যায়, কবিতা বিষয়ে নবীন-প্রবীণ কবিদের নতুনতর কণ্ঠস্বরকে ধারণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল কবিতাকেন্দ্রিক ওই লিটলম্যাগে।

 

বাংলাদেশে উৎপল বসু

উৎপলকুমার বসু বাংলাদেশে তরম্নণ কবিদের কাছে এক প্রিয়-প্রণম্য নাম। অনিকেত শামীম-সম্পাদিত বাংলাদেশের লিটলম্যাগ লোকের ‘উৎপলকুমার বসু সংখ্যা’ দুই বাংলাতেই পেয়েছে সমান পাঠকপ্রিয়তা। বলা চলে, এ-সংকলন উৎপল-চর্চার এক উলেস্নখযোগ্য স্মারকও বটে। ২০০৫-এর ফেব্রম্নয়ারিতে জাতীয় কবিতা উৎসবে যোগ দিতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসেছিলেন কবি উৎপলকুমার বসু। এ-উৎসবে তিনি কবিতা পড়েছেন, বলেছেন – এমন বিপুল শ্রোতাসমাগমে কবিতাপাঠ তাঁর জন্য এক আনন্দজনক অভিজ্ঞতা। ঢাকায় অবস্থানকালে জহির হাসান ও জাহিদ হাসান মাহমুদ তাঁর যে সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন কলকাতা সপ্তর্ষি প্রকাশন ২০০৬-এ কথাবার্তা শিরোনামে তা বই আকারে প্রকাশ করে। ৩ অক্টোবর ২০১৫ উৎপলকুমার বসুর প্রয়াণ-সংবাদে এদেশের তরম্নণ কবি-লেখকেরা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে-শোকার্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এবং তাঁর কবিতা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরম্ন করেছেন, তাতে বুঝতে পারি গোটা বাংলা কবিতাঞ্চলেই অনুভূত হবে কবি উৎপলকুমার বসুর শূন্যতা। আবার এই শূন্যতারই শিক্ষা হোক  – উৎপল বসুর নির্বিচার অনুকরণ না করে বরং তাঁর নবীনতার দর্শনকে আত্মস্থ করে আত্মপ্রকরণ আবিষ্কারই হতে পারে তাঁর প্রতি উত্তরপ্রজন্মের কবিদের শ্রেষ্ঠতম শ্রদ্ধা।

 

স্বাগতবিদায় উৎপলকুমার বসু

কথাশিল্পী সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় উৎপলকুমার বসুর লন্ডন প্রবাসকালে তাঁর ‘মিনিবুক’ সিরিজে প্রকাশ করেন উৎপলের গদ্যপুসিত্মকা নরখাদক। সন্দীপন এই পুসিত্মকার পেছন-মলাটে লেখকের যে পরিচিতি জ্ঞাপন করেন তা তাৎপর্যপূর্ণ –

…পলাতক আর্তুর র্যাঁবো ছাড়া অপর কোনো কবির    অনুপস্থিতি ও নীরবতা তাঁর ভাষা ও সাহিত্যের পক্ষে দিনে দিনে এমন বাঙ্ময় ও প্রভাবশালী হয়ে উঠতে দেখা যায় নি।

কথাশিল্পীর এ-কথায় কবিত্ব ছিল নিঃসন্দেহে কিন্তু সমসময়ে উৎপলের অসিত্মত্ব কতটা বলবান ছিল সন্দীপন বাক্যসমুচ্চয়ের মধ্য দিয়ে তা সুস্পষ্ট। সেই সন্দীপনেরই মৃত্যু-উত্তর ‘স্মরণ, সন্দীপন’ কবিতায় বন্ধুর স্মৃতি তর্পণ করে উৎপলকুমার বসু লিখেছিলেন –

মৃত্যুর পরে আর উড়ে যেতে বিঘ্ন কোথায়?

বিশাল আকাশ আছে, আছে নীল রৌদ্ররেখা বিষুবের,

আছে স্থাপত্য ও রাজপুরম্নষের মূর্তি, অঙ্গুলিনির্দেশকারী, সত্মম্ভিত মরণ, ঐ দিকে যাওয়া যেতে পারে, ঐ সম্ভাবনা

নতুন বিহগ-পথ খুলে দেয় যা আসলে আকৃতির,

আহ্লাদের, পুনরম্নজ্জীবনের।

এভাবে মৃত্যুকেও এক সম্ভাবনা-শাশ্বতরূপে যিনি আবিষ্কার করেন, বাংলা কবিতার বহুবিসত্মারী পথমালা আবিষ্কারণ বোধ করি তাঁকেই সাজে। শুভ বিদায় কবি উৎপলকুমার বসু।