সৌভিক রেজা
জার্মান কবি রিলকে-সম্পর্কে উৎপলকুমার বসুর শ্রদ্ধার কথা অনেকেরই জানা আছে। সেই রিলকে তাঁর মালটে লরিডস ব্রিগের নোটবুকে (The Notebooks of Malte Laurids Brigge) বলেছিলেন, ‘শুধু আবেগ নয়, কবিতা আমাদের অভিজ্ঞতা। একটি কবিতা লেখার জন্য তোমাকে দেখতে হবে অনেক শহর, মানুষ আর বস্ত্ত, জানতে হবে কোন ইশারায় ফোটে ভোরের ফুল; অপরিচিত স্থান সব, অচেনা পথ, অপ্রত্যাশিত বিরোধ আর বিদায়ের মুহূর্তগুলি − তুমি জানো একদিন বিদায় জানাতে হবে তাদের।’ উৎপলকুমার বসু, তাঁর মতো আরো অনেকের, বিশেষ করে যাঁদের বলছি গত শতাব্দীর পাঁচের দশকের কবি, তাঁদের অভিজ্ঞতায় কী ছিল? ছিল ‘দেশ খ–ত, উদ্বাস্ত্ত আগমন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীরা স্বাধীনতা নামে এক অনিশ্চিত অবস্থার সঙ্গে বোঝাপড়ায় উদ্যত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে মধ্যবিত্তের জীবনযুদ্ধ, গ্রাম ও শহরের বিরোধিতা, বহুকণ্ঠে অর্জিত স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বিধা-সংশয়-দুঃস্বপ্ন।’ এই কথাগুলো উৎপলের নিজের। তাঁর প্রথম কাব্য চৈত্রে রচিত কবিতার প্রথম কবিতায় পাচ্ছি এরকম পঙ্ক্তি – ‘তবুও ফোটে না ফুল। বুঝি সূর্য/ যথেষ্ট উজ্জ্বল নয়। বুঝি চিরজাগরূক/ আকাশশিখরে আমি ধাতুফলকের শব্দ শুনে -/ সূর্যের ঘড়ির দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছি।’ তিনিও ছিলেন সেই গোষ্ঠীর কবি, যাঁদের বলা হতো ‘কৃত্তিবাস’ সম্প্রদায়। এঁদের কবিতার প্রধান প্রবণতা ছিল ‘আত্মস্বীকারোক্তি’। তাঁরা মনেও করতেন যে, কবিতা লেখা মানেই একধরনের স্বীকারোক্তি। কার কাছে এই স্বীকারোক্তি? কখনো নিজের কাছে নিজের, কখনো-বা পাঠকের কাছে। উৎপলের ‘পুরী সিরিজে’র কবিতাগুলি তো সেই আত্মস্বীকারোক্তিরই নানান অভিব্যক্তির প্রকাশ। ‘এখন আকাশ নীল। অর্জুনগাছের মতো সমুদ্রছায়ায়/ বসে আছি। বহু সিগারেট টিন নিয়ে উড়োপাতা, বালি/ ছেঁড়া খবরকাগজ সমেত তোমাদের হৃদয়বত্তা নেড়ে/ লাখো লাখো গুণ্ঠনমিছিল এই নীল ঢেউ।/ ও শ্বেত বৈধব্য, পাখি, তুমি কারাগার/ রৌদ্র থেকে ফেলে দাও গরাদের ক্রমপরম্পরা/ গরাদের মধ্যে থেকে মাল্যবান পাহাড়ের ব্যাকুল লাক্ষাবনে/ আমারো মসিত্মষ্ক, নেশা, চৈতন্য, সমাধি/ পাদ্রীদের, সন্ন্যাসিনীদের হাতে চলে গেছে।’ এই কবিতাগুলিতে আত্মস্বীকারোক্তি যেমন আছে, তেমনি আছে একরকমের আত্মোন্মোচন। রিলকের পাশাপাশি কবি জীবনানন্দ দাশের কথাও আমাদের মনে পড়ে যায়। জীবনানন্দের কাছে নিজেদের ঋণ স্বীকার করে উৎপলকুমার বসুও বলেছিলেন, ‘কৃত্তিবাস-নামক একটি অনিয়মিত কবিতা পত্রিকার মাধ্যমে… তরম্নণ কিছু কবি আত্মউন্মোচনের… যে ভাষা তৈরি করলেন তাতে জীবনানন্দের অবদান অনেকখানি।’ উৎপলের এই পর্যায়ের কবিতায় জীবনানন্দের প্রভাব ছিল ঠিকই, আবার এ-ও সত্যি যে, ‘পুরী সিরিজ’ থেকেই তিনি সেই প্রভাব কাটিয়ে উঠতে শুরম্ন করেছিলেন : ‘সবুজ রহস্যময় আত্মা, তুমি বাছা, চাও নাকি সশব্দ প্রস্থান তৃণবেহালার মতো – ধুনুরীর/ তাঁতের ভিতর থেকে তুলার ভিতরে তুমি চাও নাকি চলে যেতে – আমাকে কি ছেড়ে/ যেতে চাও তুমি, সবুজ রহস্যময় আত্মা, আমি তোমাকেই খুঁজে ফিরি মাঠে – আমি/ শ্যাওলায় মাখা কূট প্রদীপের বাটিগুলি খুঁজে পাই এখানে-সেখানে – আজ সকালেই/ বৃষ্টি শুরম্ন হল -’। এখানে জীবনকে খ–খ- করে দেখার প্রয়াস যেমন আছে, তেমনি আছে স্বপ্ন আর জাগরণের মাঝামাঝি এক অবস্থান। ফ্রেডরিক নিৎশে যেমনটি বলেছিলেন – ‘দৈনন্দিন জীবনের খ-তা ও দুর্বোধ্যতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে এই জগৎ, যেখানে সব কিছু নিখুঁত, এক গভীর সচেতনতার মহান সত্যে বিধৃত, ঘুমে ও স্বপ্নে আরোগ্যদায়ক এবং সেইসঙ্গে ভবিষ্যৎ বাণীর প্রতীকরূপে তার অবস্থান, যা সাধারণ অর্থে শিল্প, যা আমাদের বেঁচে-থাকাকে সম্ভব আর মূল্যবান করে তোলে।’ জীবনকে সামগ্রিকভাবে দেখবার আকাঙ্ক্ষা থেকেই উৎপলের কবিতা যেন দূর-এক ব্যাকুলতাকে ডেকে নিয়ে আসে – ‘শূন্যতা এমন করে তোমাকে বোঝার দায় ছড়িয়ে রেখেছ।/ তোমাকে বোঝার দায় মারণাস্ত্রের মতো সঙ্গোপন ফুলের কোরকে/ নির্জীব রেণুর পুঞ্জে পালিত রেখেছ।/ রৌদ্রকে দিয়েছ তাপ, ততখানি, প্রয়োজন যত।/ বৈকুণ্ঠকে, কিছু দূরে, নরকের আয়ত্তের বাইরে রেখেছ।/ স্বপ্নকে যথার্থ থেকে বঞ্চনা করেছ।’
দুই
যে-কোনো আত্মসচেতন কবির মধ্যেই এই বঞ্চনার বোধ থেকে যা আসে – তার নাম অতৃপ্তি। উৎপলও তার হাত থেকে রেহাই পাননি। রেহাই তিনি নিতেও চাননি। বরং শিল্পের প্রত্যেহের মুখোমুখি হতে চেয়েছেন। সেই সাহস, সেই সততা তাঁর মধ্যে ছিল। নিজের কবিতায়, অনেকটা বুদ্ধদেব বসুর মতো, তিনিও চেয়েছেন, শিল্পের সামঞ্জস্য, সম্পূর্ণতা। কেমন সেটি? বুদ্ধদেব বসু তাঁর মতো করে, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, ‘যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই মাঠ, আর মাঠের শেষে গাছপালার রেখা; যে কোনো জানালা দিয়ে তাকাই, বড়ো-বড়ো চওড়া আকাশ চোখে পড়ে। আর এই সব উপকরণগুলো শুধু বিচ্ছিন্নভাবে তালিকাভুক্ত হয়ে নেই, একটা সামঞ্জস্য রচনা করেছে – আর সামঞ্জস্য মানেই সম্পূর্ণতা, তৃপ্তি।’ আবার স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, এই যে সামঞ্জস্যের কথা বলা হচ্ছে, এই সম্পূর্ণতার – তাতে কি উৎপলকুমার বসুর পুরোপুরি সায় ছিল? বরং তার বিপরীতটি হওয়ার সম্ভাবনাই তো বেশি। উৎপল খুব ভালো করেই জানতেন – তাঁর নিজের ভাষায় – ‘আমরা একটি অত্যমত্ম জটিল সময়ে বাস করছি। লাভ-ক্ষতি, ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায় বিচারের মানদ-গুলি একালে সার্থকভাবে ব্যবহার করা চলবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে।’ আর এই সন্দেহের মধ্যে দাঁড়িয়ে একজন কবির কর্তব্য কী? ‘পুরী সিরিজের শেষ কবিতা’য় উৎপল সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন: ‘তারপর ঘাসের জঙ্গলে পড়ে আছে তোমার ব্যক্তিগত বসমত্মদিনের চটি। এবং/ আকাশ আজ দেবতার ছেলেমেয়েদের নীল শার্টপাজামার মতো বাসত্মবিক।/… এবার বসমত্ম আসছে সম্ভাবনাহীন পাহাড়ে জঙ্গলে এবার বসমত্ম আসছে/ প্রতিশ্রম্নতিহীন নদীর খাঁড়ির ভিতরে নেমে দু’জন মানুষ তামা ও অভ্র খুঁজছে।/ তোমার ব্যক্তিগত বসমত্মদিনের চটি হারিয়েছ বাদামপাহাড়ে।/ আমার ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা আমি হারিয়েছি বাদামপাহাড়ে।’ যে-কোনো কবিরই বড়ো সম্পদ তাঁর ব্যক্তিগত ‘লিখনভঙ্গিমা’। সেই ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা হারিয়ে ফেললে একজন কবির আর কী থাকে? কবিকে তাই এবার আরো অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্যে বাইরে বেরোতে হয়। কখনো-কখনো-বা তাঁর নিজের ব্যক্তিগত সীমানারও বাইরে।
তিন
তারপর দীর্ঘ বিরতি। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দেশ থেকে ফ্রান্স, সেখান থেকে ইংল্যান্ড – এইভাবে নিজেকে নিয়ে ছুটতে থাকেন উৎপল। লন্ডনে উৎপলের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে পঞ্চাশের আরেক কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত খেয়াল করলেন, ‘সেই আড্ডা থেকে বেরিয়ে এসে তবু ছমছমে একটা বিষাদ আমায় গ্রসত্ম করে নিয়েছিল : উৎপল কতো কথাই তো বললেন, একবারও কবিতা নিয়ে একটি কথাও বললেন না।’ শুধু তা-ই নয়, লন্ডন থেকেই তিনি অলোকরঞ্জনকে যে-চিঠি (২৮ অক্টোবর, ১৯৭১) লিখলেন, অলোকের ভাষায় তার পরতে-পরতে ছিলো এক ‘নিষ্ঠুর নির্বেদ’। সেই চিঠি থেকেই খানিকটা উদ্ধৃত করি : ‘বাংলা কবিতার প্রতি আমার উৎসাহ বর্তমানে খুবই কম – প্রায় নেই বললেই চলে। এটা আজকের ঘটনা নয়। অনেক বছর আগে, আমি যখন কলকাতা ছাড়ি, তার আগে থেকেই বাংলা কবিতা বলতে যা বোঝায় তার ভেজালতা ও অসারতা লক্ষ করেছি। ঐ কবিতার সঙ্গে, দেশের সমাজের এবং বৃহৎ অর্থে মানসিকতার কোনোই যোগাযোগ নেই।’ শুধু এইটুকুই নয়; সেইসঙ্গে তিনি খেয়াল করেন তথাকথিত উন্নত দেশগুলোর হাতে ‘দূরের গরিব দেশগুলির শোষণ বা নিজেদের দেশের মধ্যেই, দরিদ্রের শোষণ, অসমর্থকে নিষ্পেষণ।’ আর তার প্রতিক্রিয়ায় উৎপলের ‘মনে প্রশ্ন জাগে যে, তাহলে কি মঙ্গলজনক, সুষ্ঠু, নতুন সমাজব্যবস্থা আমরা তৈরি করতে পারি না? নিশ্চয়ই পারি – কেননা মানুষের অসাধ্য কিছু নয়। কিন্তু সেখানে ঐ প্রাচীন কবিতার আর কোনো স্থান নেই এবং অনিবার্য বলেই আমার ব্যক্তিগত ‘লিখনভঙ্গিমা’ পথের মধ্যে হারিয়ে গেল।’
অভিজ্ঞতা থেকে, আমরা পাঠকেরাও জানি যে, একজন কবি সবসময় সত্য কথা বলেন না। শিল্পের খাতিরে তাঁকে ছদ্মবেশ নিতে হয়, মুখে পরতে হয় মুখোশ। চিঠিতে যে-কথাগুলো উৎপল বলেছিলেন সেগুলো সম্ভবত তাঁর প্রবাসজীবনের তাৎক্ষণিক উপলব্ধি; কিন্তু ভেতরে-ভেতরে তিনি কবিতার জন্যেই নিজেকে প্রস্ত্তত করেছিলেন। এবং সেটি দীর্ঘসময় নিয়েই। কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না তাঁর। একটি ভালো কবিতার জন্যে ধৈর্যধারণে রিলকের মতো উৎপলেরও আপত্তি ছিল না। প্রবাস থেকে ফিরে এসে প্রকাশ করেন – আবার পুরী সিরিজ। নিজের কবিতার সঙ্গে দেশের, সমাজের মানুষের চেতনার একটা যোগাযোগ ঘটাতে যেন প্রাণামত্মকর চেষ্টা করলেন : ‘আমি স্বেচ্ছায় এ-সব লেখার দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে রাজি নই। আমি/ প্রতিশ্রম্নত নই লেখার জন্য। আমার লেখা শেষ পর্যমত্ম সেই সব ঠগবাজ পড়বে যারা/ হেঁসেলে মদের বোতল লুকিয়ে রাখে। যমুনাতীরে, কামানের ছায়ার নীচে বসে আমি/ হাঁস ও শকুনদের মাংসখ- খাওয়াব একদিন। সভ্যতা কি ততদূর বিসত্মৃত হয়ে পড়বে?/ কিন্তু, আমি ভীত নই। তাঁরাই ধন্য যাঁরা নিজ সাহিত্যকে নিখুঁত বলে জানেন। আমার/ স্বপ্ন আমাকে ঘৃণা শিখিয়েছে। হয়তো আমি মানুষ বলে এ-যাত্রা বেঁচে গেলাম এবং/ আমার চারপাশের আত্মীয়-স্বজন, কলকারখানা তারাও যে ক্ষতিগ্রসত্ম হল না তার কারণ/ আমি আসলে স্বপ্নবিস্মৃত পুরম্নষ। কিছু কি ঘটেছে কোথাও? তুমি কি ব্যবহারিক মিথ্যে/ কথাগুলো সহজে বলতে পারছ – নাকি অন্ধকার খাটের তলে হামাগুড়ি দিয়ে নিশিদিন/ অমিত্রাক্ষর মার্বেল খুঁজছ?’
এ-ও একরকম আত্মোন্মোচন। নিজের কাছে যেন নিজেরই স্বীকারোক্তি। আর এখানে মিশে রয়েছে এক আকাশসমান হতাশা। কবি বুঝতে পেরেছেন : আধুনিক কবিতা মানেই একধরনের সংযোগহীনতা। এইটি সকলের জন্যে নয়। অমত্মত এই সমাজব্যবস্থায়, যেখানে মানুষ নানা বর্গে বিভক্ত, মানুষের চেতনা নানাভাবে খ–ত, সেখানে কবিতাকে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়াটা এক অসম্ভব ব্যাপার। এ থেকে আরেকটি বিষয় আমরা বুঝে নিই, তাঁর কবিতায় যতো বাঁকই থাকুক না কেন, শেষ পর্যমত্ম উৎপল ছিলেন কৃত্তিবাস-সম্প্রদায়েরই কবি। কারণ, কবিতায় নিজের এই স্বীকারোক্তির বাইরে তিনি খুব কমই এসে দাঁড়িয়েছেন। যেখান থেকে মানুষের সঙ্গে সংযোগ-স্থাপন করা কঠিন। আর যাঁদের সঙ্গে তিনি সংযোগ-স্থাপন করতে পেরেছেন তাঁদের সংখ্যাও নগণ্য। আধুনিক কবি ও কবিতার এটাই হয়তো নিয়তি। খুব কম মানুষের কাছেই তা সংযোগ স্থাপন করতে পারে। এজন্যে শুধু কবিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ‘লোচনদাস কারিগরে’ এসেও দেখি, সংযোগ আর সংযোগহীনতার মধ্যে কবি যেন একটি আপসরফা করতে চাইছেন : ‘আমার দিকে তাকিয়ে দ্যাখো, যোগিন্দর, সময় আমার সময় তা কি গাছের মতো, বলতে/ চাই গাছের আছে আলাদা এক সময় যেমন নদীর আছে আলাদা এক সময়রেখা যা-/কেবলই পারাপারের, যাত্রী জানে, জানে শ্মশানঘাটের ফটোগ্রাফার, আমার দিকে/ তাকিয়ে দ্যাখো, আমার সময় মাঝবয়েসী, ক্লামত্ম কিছু, চমকে উঠছে নানান ডাকে,/ সমাজপতি বলছে এসো দু’কথা বলো না-হয় কিছু পাঠ করে যাও, এমনিভাবে সময়/ আমার মাঝামাঝি সরল একটা পথ চিনে নিক।’
এ-প্রসঙ্গে আবারো রিলকের কথায় আসতে হচ্ছে। তিনিও মনে করতেন : কবিদের ‘একটিই মাত্র প্রয়োজনীয় কাজ : সব বস্ত্তর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, সব বস্ত্ত নিজস্ব অসিত্মত্বের অসীম শক্তিতে উজ্জ্বল। দ্বিধাহীন প্রত্যয়ে আমাদের পৌঁছতে হবে সেই অসিত্মত্বের কাছে – এই প্রত্যয়ই আমাদের সমসত্ম কাজের, এমনকি যা তুচ্ছতম, সেসবেরই প্রেরণা।’ সেই প্রেরণার বশেই খ-বৈচিত্র্যের দিন কাব্যে উৎপলকুমার বসু এমন-এক উপলব্ধিতে এসে পৌঁছান, যেখান থেকে তাঁকে বলতে শুনি : ‘ও-সবুজ খ- হতে পারে – তাই উড়ে আসে ধর্মবক/ ঠোঁটে যার মৃতের স্ফটিকমাংস – ধানক্ষেতে এদিক-ওদিক/ ছড়িয়ে পড়েছে শিরা – জাল যেন – ভোরবেলা ফাঁসি-বোনা-বাঁধো/ শস্যের সবুজ তার হাহাকার – তার বীভৎসৎতা – তার রক্ত-ঝরে-পড়া/ ঐ উপহার – আজ জন্মদিনে – এই পঞ্চাশ বছরে।’ সাহিত্যজীবনের প্রথম পর্যায়ের ‘সবুজ রহস্যময় আত্মা’ থেকে ‘শস্যের সবুজে’ এসে পৌঁছান এই কবি। এমন কঠিন-এক আয়াসসাধ্য পরিভ্রমণ কেবল উৎপলকুমার বসুর পক্ষেই সম্ভব। সেই শক্তি তাঁর ছিল। ছিল কঠিনতম শিল্পের মুখোমুখি হওয়ার সামর্থ্য। তিনি মনে করতেন : ‘দৃশ্যজগৎ ও বস্ত্ত জগৎ, মনোজগৎ ও কর্মজগৎ দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত… একটি অংশ সংগঠিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও নিয়মানুবর্তী, যেমন দিন-মাস-বৎসর, জন্ম-মৃত্যু, ঋতু-পরম্পরা… অপরটি অনির্দিষ্ট, কল্পনাতীত… সদা অপূর্ণ। আমাদের ভাষায় অসীম ও অনমত্ম।’ এই দুই অবস্থানের কোনো একটিতে তিনি থিতু থাকেননি। সবসময় একটি থেকে আরেকটিতে যাতায়াত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রসঙ্গে তিনি যা-ই বলুন না কেন, ওই কবির সঙ্গে উৎপলের কাব্যিক-চেতনাগত একটি সাদৃশ্য ছিল।
চার
সংযোগের সূত্র ধরেই তিনি কবিতার ভাষায় এনেছিলেন বহুমাত্রিক বহুবাচনিকতার একটি ধারা, যেখানে নিশ্চেতনার জগৎ, অনুভবের সৌন্দর্য, এক রহস্যময়তা আর অমত্মর্লীন আর্তি মিশে ছিল। যেমন দেখি সুখ-দুঃখের সাথী কাব্যের একটি কবিতায় : ‘খাই প্রচ- খিদের মুখে, শীতকালের রোদ চা ভিজিয়ে।/ খাই কুয়াশা-মাখানো মুড়ি, ধোঁয়াগন্ধ গাছপালা, স্মৃতি নাম্নী ফেনাভাত,/ এমনকি মাংসের দোকানে বেঁধে রাখা ছাগলগুলিও খেতে ইচ্ছে হয় -/ কিন্তু বাহানা করি – হয়ত খাবো না – খাওয়া কি উচিত হবে -/হায় কুম্ভকর্ণ জেগে উঠেছে এই মাত্র – তারও খাদ্যাধিকার নিয়ে ইতসত্মত আছে।’ উৎপল শুধু এইখানে কবিতা লিখেই ক্ষামত্ম হন না। পাঠককেও তাঁর কবিতার সঙ্গে যুক্ত করে নেন। বলা যায়, কবিতার তন্নিষ্ঠ পাঠক তাঁর কবিতার সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য হন। কীভাবে সেটি সম্ভব হয়েছে? এ-সম্পর্কে উৎপল বলেছেন : ‘আমি মূলত যেটা করি, অনেক সময় আমি কবিতায় খ- ইমেজারি ব্যবহার করি। একটা ইমেজকে আমি কমপিস্নট করি না। এর কারণ হল, আমার পাঠকের ওপর গভীর বিশ্বাস। আমার ধারণা, বাকি অর্ধেকটা পাঠক নিজেই পূর্ণ করে নেবে। আমার লেখা পড়ে কেউ মানসিকভাবে সক্রিয় হবে না, এটা হয় না, পাঠককে কিছু না কিছু দিতে হবে।’ এইভাবেই উৎপলকুমার বসু তাঁর সংযোগের হাতিয়ারকে নানাভাবে ব্যবহার করেছেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ‘এই সত্যকে আজ অস্বীকার না করে উপায় নেই যে কবিরাই শুধু কাব্য সৃষ্টি করেন না; পাঠকদেরও সেখানে একটি মুখ্য ভূমিকা থাকে।’ এই হলেন কবি উৎপলকুমার বসু, সমসত্ম রকমের রহস্য নিয়েও যাঁর কবিতা এক স্থিতি আর অস্থিরতাসহ দাঁড়িয়ে থাকে। দাঁড়িয়ে থাকবে। নিজের কবিতা-সম্পর্কে একটি কবিতায় তিনি লিখেছিলেন : ‘কিছুটা রহস্য থাকে; কিছু অব্যয় আর দু-একটা প্রশ্নের চিহ্ন,/ ছিটে-ফোঁটা ভাঙা শব্দ যা-দিয়ে সহজে, সমাস বানানো যায়,/ আর একমুঠো ক্রিয়াপদ; সিঁদ কাটা হয়েছিল – সেই দাগ;/ ফাঁক ও ফোকর, আকাশ দেখার জন্য, বটগাছ/ জন্মিয়ে ওঠার জন্য হাঘরে ফাটল -/ আমার কবিতা হয় ঐ মতো। ও-রকম বাবু সেজে থাকে।’ বাবু তো বটেই, এক ছদ্মবেশী বাবু-কবিতা, যে-কবিতার কাছে কিছুই অপ্রধান নয়, কিছুই গৌণ নয়। সেই কবিতারই এক আশ্চর্য সমুদ্রে চিরকালের জন্যে যাত্রা করলেন কবি – ‘চুল যেন পলব, তার দেহস্পর্শ – তারপর মৃত্যুর বিহার, উৎস জল।’
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.