এক

– সত্য! সত্য! ও সত্য!

ঠান্ডা পড়েছে। পৌষ গেছে, বাঘের মতো মাঘের শীত জেঁকে বসেছে। ঠান্ডায় কাতর সত্য; একটা পশমি আলোয়ান গায়ে চাপিয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে ছিল। কেউ তাকে অপ্রত্যাশিতভাবে ডাকছে শুনে ও চমকে উঠলো। যেনবা তার স্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটেছে।

– কী-ই! কীহ! কে! কে! কে ডাকছো?

– তোমার কাঁচা-তন্দ্রা ভাঙালাম বুঝি সত্য? আহা! মনে কিছু করো না। তা কেমন আছো তুমি সত্য?

– তুমি কে! কে-ত্তুমি!

– আহা রে! আমায় তুমি চিনতে পারলে না!

– না তো। সত্যি কইছি। এই ক্ষণে মনেই পড়ছে না, তুমি কে।

– তাই! তা-ই হবে, না-হয়ে পারে না। তোমার সঙ্গে আমার কবেই বা দেখা হয়েছিল, বলো? চিনতে তো বেগ পেতেই হবে। দারুণ বেগ পেতে হবে। আমারো কি বেগ পেতে হয়নি!

– বটে, কিন্তু … তুমি যে কে তা বললে না তো!

– অধীর হলে? হয়ো না বাপু। অধীর হয়ো না। বলছি। আমি হলাম গিয়ে মিথ্যে, সত্য।

– মিথ্যে?

– হ্যাঁ।

– মিথ্যে! ও হ্যাঁ, হ্যাঁ মিথ্যে। চিনতে পারছি। এখন আর কষ্ট হচ্ছে না। আসলে কষ্ট হওয়ার কথাই নয়। তুমি হলে গিয়ে আমার ওপিঠ। … আমার ওপিঠ। হু-হু-হু। ঠিক কিনা বলো?

– ঠিক।

– চিনতে পারার উত্তম উপায় হচ্ছে চাক্ষুষ দেখা। কিন্তু … কিন্তু নিজের ওপিঠ কি দেখা যায় মিথ্যে?

– না, দেখা যায় না সত্য। যদি সমান্তরাল দুটো বিপরীত দিকে দুটো ছোট আকারের আয়না লাগাও, তবে একটা বিম্ব দেখা যেতে পারে বটে। কিন্তু সে-বিম্বকে চেনা দায় হয়ে উঠতে পারে। কারণ তাতে পিঠের কাঙিক্ষত প্রতিফলন সম্পূর্ণ না-ও হতে পারে। খ–ত হওয়াই স্বাভাবিক। আবার, পিঠের নাগাল পেতে হলে বড়জোর হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায় বটে কিন্তু পুরোপুরি ছোঁয়া যায় না; বুলানো তো দূরের কথা। পিঠে যদি কখনো পিড়পিড় করে চুলকানি ওঠে, একটা কাঠি দিয়ে আঁচড়ানোর জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করা যায়, … তবে ওতে জুত হয় না; সুখ লাগে না।  ইদানীং পস্নাস্টিক ব্যবসায়ীরা একটা নকল হাত বানিয়েছে, – চিকন ও আঙুলঅলা। ওতেও সুখ হয় না। বাধ্য হয়ে কাতরস্বরে একজনকে ডাকতে হয় – ‘ওগো শুনছো! পিঠটা একটু চুলকে দাও না গো!’ যদি তেমন কেউ তোমার থাকে তাহলে ভালোই। নইলে ‘আহা রে চুলকানি! উহু রে চুলকানি’ বলে মনে মনে তড়পাতে হবে। আর, আদল? দেখা যখন যায় না, তখন সে তো কেবলমাত্র আন্দাজ করা সম্ভব হয়। সে-আন্দাজ ব্রহ্মা– নেই বাপু। এ মাথাও হয় না, মু-ুও হয় না। গলার স্বরটা অবশ্য শোনা যায়, আর যা যা চেনা দরকার তা স্বরটাই চিনিয়ে দেয়। অন্ধরা যেমন স্বর দিয়ে চিনে নিতে পারে। এখন যেমন আমরা দুজনায় স্বরে-স্বরে আলাপ করছি, তাই না? একজন অপরজনকে চিনতে পারছি।

– ভালো কথা কয়েছো বটে মিথ্যে। তবে তুমি বা আমি কেবল বোবা হলে কী হতো ভেবে দেখেছো? ভেবে দেখেছো, একজন অন্ধ আর অপরজন বোবা হলে কী হতো মিথ্যে?

– বড় পরিতাপের ব্যাপার হতো। এটা প্রকৃতির অসংখ্য নিষ্ঠুরতার একটি নিদর্শন।

– প্রকৃতির নিষ্ঠুরতাই বটে। এ এক দারুণ সত্য। প্রকৃতি বরাবরই নির্বিকার। তার চোখে অশ্রম্ন জমে না। তার স্বরে কান্না ধ্বনিত হয় না। তার হৃদয়ে আবেগ বসত করে না। অথচ যত সৌন্দর্য, যত রূপ-সুষমা, যত কমনীয়তা, যত প্রেম-প্রীতি সবই তো এই প্রকৃতির দান। কী ভয়ংকর বৈপরীত্য! কী না অবিশ্বাস্যজনক!

– জানি, সত্য, জানি। তবে একটা কথা তোমাকে এক্ষুনি বলতে চাই। না বলে পারছি না। তোমাকে পেয়ে, এখন আমার মনের ভেতরে ফুরফুরে একটা বায়ু বইছে। হ্যাঁ, সত্যি বইছে। একটা শিসও ওষ্ঠ-অধরের কোথাও ইতিউতি করছে। অথচ কী জানো, আমি কখনো শিস দিতে পারি না। ওষ্ঠ-অধর দুটো চোখা করে, বাঁশির মতো বানিয়ে, মুখের গহবর থেকে জিহবা দিয়ে দমকা হাওয়া কতশতবার বের করার চেষ্টা করেছি। তবু শিস হয় না, বায়ু বাঁধনহারার মতো বের হয়ে যায়। আকাশ থেকে আমাকে একজন বললো, দুটো আঙুল মুখের মধ্যে সাঁড়াশির মতো পুরে সজোরে বায়ু বের করতে। অমনি আমি তা-ও করলাম; কিন্তু তাতেও ফল হলো না। বাঁধনহারা হাওয়া বের হতে-হতে মুখখানা বিবশ হয়ে গেল যেন।

সত্য একটু হাসলো; বললো, দুঃখ কি পেয়েছিলে মিথ্যে? চেষ্টার তো শেষ রাখোনি।

– আরে না, না। দুঃখটুঃখ পাইনি। আমি দুঃখ পাই কী করে, তুমিও নিশ্চয়ই পাও না। দুঃখ পেলে কি সত্য থাকা যায় – মিথ্যে থাকা যায়, সবিশেষ? মিথ্যের বেসাতি বড় কঠিন – বড় দুঃসহ, বড় মর্মামিত্মক, সত্য। তাই আমি হাসিখেলার মাঝে সময় কাটাতে চাই। আমাদের তো আর জীবন নেই, আছে কেবল সময়, যার সীমা রহস্যজনক। সে তো তুমি জানোই। তবে সময় কাটাতে চাই বললেই তো হয় না। বাস্তবে হাসিখেলা করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। তবে যখন সম্ভব হয় তখন তা হয় দুর্লভ। আর তা লুটেপুটে নিতে চেষ্টা করি।

– বটে যেমন এখন, তাই না? তুমি আমাকে পেয়ে এখন সত্যি নন্দ হয়েছো। হবেই তো। সজ্ঞানে দেখা হয়নি বটে; কিন্তু আমি তো তোমার ওপিঠ। তোমাকে ভোলাও কি আমার ঠিক, মিথ্যে?

– যথার্থ বলেছো সত্য, ভোলার কথা নয়। তবে প্রবাদে আছে না, না-দেখাটা হলো অচেনা আর অদেখায়-অদেখায় আসে বিস্মৃতি। যে-জন একদা চোখের মণি ছিল, সে-জন কখনো চোখের সমুখে না থাকলে, একটা কালের অদেখায় কখন যেন তার কথা আর মনে পড়ে না। কী, ঠিক কিনা? যে-দেরাজখানা বর্ষ-বর্ষ ধরে খোলা হয়নি, গৃহকোণে স্বল্পালোকে অবহেলার ধুলোবালি গায়ে মাখা ছিল, ‘দেখি তো কী আছে!’ বলে তাই যদি আকস্মিক কৌতূহলে খোলা হয়, তখন এর ভেতরে বিস্মৃত এমন কিছু চোখে পড়ে যায়, যা দেখে তৎক্ষণাৎ চমক লাগে, রোমাঞ্চ ছড়ায় ধমনিতে, বুক দুরুদুরু করে, ও হায় সোনার কঙ্কণ! মনের ভেতরে ভীরু প্রশ্ন জাগে – কী করে এতকাল একে ভুলে ছিলাম? হঠাৎ কত না সুখস্মৃতি হৃদয় ছেয়ে ফেলে, তখন রাজ্যের অপরাধবোধ মনকে গ্রাস করে ফেলে, আচ্ছন্ন করে। অশ্রম্নতে ভরে ওঠে দু-নয়ন। কী করে এর কথা ভুলে ছিলাম! নিজেকে আড়াল করে ফেলতে পারলে বাঁচা যায় যেন।

– ভেবে দেখো মিথ্যে। তুমি আর আমি তো পরস্পরের ওপিঠই শুধু নই; আমরা হয়তো যমজই। খুব সম্ভবত, পিঠে পিঠ লাগিয়ে আমাদের উদ্ভব হয়েছিল। আমরা পরস্পরের ওপিঠ হলেও, সন্দেহ হয়, আঁতুড়ঘরেও আমরা প্রথমে একে অপরের মুখ দেখতে পারিনি। কে জানে তখন কে বা কারা ধাত্রী ছিলেন, তাঁরাই হয়তো দেখাননি। হয়তো ভেবেছিলেন, ব্যাপারটা হতো অজানা কোনো কুলক্ষণ! ওই যেমন লোকে বলে না, কালো বিড়াল দেখলে ঘর থেকে বের হয়ো না? যদিও কখনো কখনো আবার মনে হয় কি জানো? মনে হয় বুঝি আমাদের মতো যমজ আর নেই। কিন্তু তা-ই বা বলি কী করে! এখনো তো রাত আর দিন আছে। আলো যেমন আছে, অন্ধকারও আছে তেমন। ভালো যেমন আছে, মন্দও তেমন বর্তমান। শুভ-অশুভ আছে। জন্ম-মৃত্যু আছে। প্রেম আছে, ঘৃণাও আছে। সাদা আছে, কালো আছে। এরা সবাই তো একে অপরের ওপিঠ; বিপরীত। কিন্তু তোমার আর আমার মতো এমন যমজ কি আর আছে কোথাও, মিথ্যে? তোমার কী মনে হয়?

কী যেন ভাবছিল মিথ্যে, তাই আনমনা হয়ে পড়েছিল। সত্যের প্রশ্নে চমকে উঠে আমতা-আমতা করে। বলে, হ্যাঁ, ইয়ে, ইয়ে … এখন কেন যেন সঠিক আন্দাজ করতে পারছি না, বাপু! আমি সম্ভবত বিষয়টা অতো ভেবে দেখিনি আগে। তুমি বলায়, তাৎক্ষণিক ভাবায় মনে হচ্ছে, আবার এ-ও হতে পারে, আমাদের মতো যমজ আছে। কোথাও থাকলেও থাকতে পারে। থাকার জায়গার কি অভাব, বলো? আগে শুনতাম আমাদের কেবল একটি ব্রহ্মা- – এখানেই আমাদের আদি ও অনন্ত বসবাস। এখন শুনি সংখ্যায় নাকি ব্রহ্মা- কোটি কোটি! এদের জুড়ে আছে সর্বব্যাপী ব্রহ্মা-; সে নাকি গ্যাসের বেলুনের মতো; নিয়ত আবার ফুলছে। ফুলে-ফুলে কার প্রেমের আকর্ষণে কোনদিকে কোথায় যাচ্ছে তার দিকদিশা রহস্যময়। অনন্ত অসীমের নভোলোক সেই রহস্যের মায়াজালেই দোল খায়।

– আর, ভুলে যেয়ো না, আমাদের যে সূর্য, তার মতো নক্ষত্রের সংখ্যা নাকি গুনে শেষ করা যায় না।

– গোনার যন্ত্র আর বুদ্ধি থাকলেও জ্যোতিষ্কদের অসীম দেশে কে বা কারা যাবে! যাওয়ার মতো আয়ুও হবে না। শেষে নতুন করে একটা গণনকল ভাসতে পাঠিয়ে দেবে আর কী। ওটাই মহাশূন্যতায় জ্যোতির্ময়লোক ঘুরে সব তথ্য আর চিত্র পাঠাবে। তারপর নিজেও ভস্ম হয়ে যেতে পারে।

– যথার্থ কয়েছো মিথ্যে। যথার্থ।

– শোনো সত্য, আমি এ-কথা বড়াই করেই বলতে পারি, তুমি আর আমি যেনতেন প্রকারের যমজ নই। আমাদের ঢের বৈলক্ষণ্য আছে, যা সচরাচর দেখা যায় না।

– ঠিক, তুমি ঠিক মিথ্যে। সত্য বলতে কী বোঝায়, তার পরিচয় কী? মোদ্দা কথায়, যা অতীতে উপস্থিত ছিল ও এখন আছে তা-ই সত্য। যেমন – ব্রহ্মা-, সূর্য, চন্দ্র ও তারারা সত্য। বৃক্ষ, নদী, শিলাশৃঙ্গ, অগ্নিগিরি, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, তুফান, পস্নাবন,      ভ্রাতৃহত্যা, গণহত্যা সত্য। যেমন – সৃষ্টি ও বিলয় সত্য। জীবকে
জীব খায়; মাংসাশী উদ্ভিদও আছে – সত্য। যা ঘটে, যা ঘটনা
তা সত্য। আবার মনে যা ভাবা যায়, কল্পনার লোকে যা যা আসে;  যেমন কেউ মনে মনে যা আঁকলো সেটাও সত্য। ধরো, কেউ কাউকে দূর থেকে ভালোবাসলো, সেই প্রেম যে-দূরবর্তী বা অদেখাজনকে নিয়ে সে-জন ওই পিরিতির বিন্দুবিসর্গ না জানলেও এটা তার কাছে প্রেম। একতরফা হলেও তা কিন্তু ভালোবাসা, নিখাদও হতে পারে।
যে-জন প্রেম করেছে তার কাছে নিরেট সত্য বলে সে কখনো উন্মাদ; উন্মাদনায় নিজের প্রাণের মায়াও বেমালুম ভুলে যায় – নিজেকে কেউ কেউ হত্যাও করে। অথচ যাকে সে মনে মনে ভালোবেসেছে, তার কাছে সকলই নিছক মিথ্যে ও অলীক, – তার কাছে গিয়ে খবরটা দিলে সে সবিস্ময়ে – এমনকি আতঙ্কিত হয়ে বলবে, ‘কী সর্বনাশা কথা! আমাকে ও ভালোবাসে! ওকে তো আমি চিনিই না! আর … আর ও দেখতে যে কী বিদ্ঘুটে! ছ্যাঁ!’

– এরকম অর্বুদ-অর্বুদ প্রমাণ আছে বটে।

– সত্য সবসময় অবিচল নয়, চিরস্থায়ীও হয় না। সত্য ক্ষণস্থায়ীও বটে। বিজলি-চমকানো পলকের জন্য ঘটে। সকালে পুবদিকে সূর্য দেখা যায়। পৃথিবী আপন বলয়ে ঘুরতে থাকলে দুপুর, বিকেল আর সন্ধ্যা আসে। অন্ধকার ঘনালে আকাশভরা তারা আর চাঁদ দেখা যায়। মেঘ তো পৃথিবীকে ঘিরেই বেড়ায়। সবই ক্ষণস্থায়ী। জীবন ক্ষণস্থায়ী তো বটেই। সৃষ্টিও তা-ই। মহান ভূলোকে প্রতিনিয়ত নক্ষত্ররাজি বিস্ফোরিত হয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। লোকে বলে, উল্কারা ছিটকে পড়ছে। সে যে কোটি কোটি বছরে গড়া কাহিনি।

– জানো, আমি ভাবছি, বিষয়টা গবেষণা করে দেখা যেতে পারে। গবেষণায় মজার মজার কথা বের হয়ে আসতে পারে। রূঢ় সত্যও ধরা পড়তে পারে, যা কেউ জানে না। আবার রোমাঞ্চকর তথ্যও উদ্ঘাটিত হতে পারে। তা জেনে মুগ্ধ হওয়া যাবে।

– এ তো ভালো কথা কয়েছো মিথ্যে। অজানাকে জানতে আমার বড্ড ভালো লাগে। মূর্খ হয়ে চলে যাওয়ায় কোনো সার্থকতা নেই। আয়ু বড্ড দুর্লভ, এর সদ্ব্যবহার করাই শ্রেয়। জেনেশুনে প্রস্থান করাই ভালো।

– আবার শোনো! আমরা কিন্তু নিছক সত্য অথবা মিথ্যে নই। সত্য আর মিথ্যে হিসেবে আমাদের একটা করে গতানুগতিক পরিচয় তো আছেই। তবে এর বাইরেও নানা রকমের রূপ আছে। তোমাকে নিয়ে যেমন হরেক রকমের কথা আছে, আমাকে নিয়েও আছে।

– কেমন, বলোই না।

– যেমন … যেমন তোমাকে দিয়েই শুরু করা যাক। কী বলো?

– আহা! সে কী কথা! আমাকে নিয়ে কেন? নিজেদের মধ্যে ভদ্রতা করার দরকার নেই! মিথ্যে, তোমাকে দিয়েই আরম্ভ করো।

– ঠিক আছে। তুমি যখন বলছোই, চলবে।

– বলো। বিশেষ্য আর বিশেষণ যা আছে সকলই বলো। তাই বলে ব্যাকরণ বেশি ঘাঁটতে যেয়ো না। ব্যাকরণের গন্ধে আমার মাথা ধরে যাবে।

দুজনই একসঙ্গে হেসে ওঠে।

মিথ্যে বলে, নিজেদের পরিচয় নিজেদের জেনে রাখাটা ভালো।

সত্য বলে, আলবৎ।

মিথ্যে বলে, যা মিথ্যে তা-ই মিথ্যা। উচ্চারণের তারতম্যে বানানের হেরফের আর কী। মিছেও তা বটে। ভাষাটাই এমন। মুখের ভাষা জনে জনে পালটায় উচ্চারণে; শিক্ষায়-অশিক্ষায় এর হেরফের হয়, এক গ্রাম ছেড়ে পরের গ্রামে এটা বদলে যায়, – অঞ্চল থেকে অঞ্চলে, দেশ থেকে দেশে পালটে যায়; এমন হয় যে, পড়শির কথা পড়শি বুঝতে পারে না; তবেই না পৃথিবীময় মানুষের বুলি আর ভাষার ছড়াছড়ি; আবার কালে কালেও তা পালটে যায়। আর লেখ্য ভাষা? সে তো ভিন্ন জিনিস : মকশো করে শিখতে হয়, পাখির পালক, শেস্নট-চক বা খাতা-কলম লাগে এ-বিদ্যা অর্জনে, যা একসময় ছিল গুরুপ্রদত্ত : বানান জানতে হয়, ব্যাকরণ মনে রাখতে হয়, অর্থ-ব্যুৎপত্তি সকলই রপ্ত করতে হয়; না হলে নিজের মাতৃভাষার লেখা বইপত্র পড়া যায় না। লেখাপড়া জানা লোকেরা এককালে বগলে একটা করে অভিধান রাখতো। আজকাল অবশ্য মুঠোফোনের মধ্যেই অভিধান ঢুকিয়ে রাখে। শোনো! আমার নাম মিথ্যে বলে ভেবো না, আমি মিছে বলছি; বড় অভিধান খুললে এই শব্দটা পাবে – সসেমিরা।

– সসেমিরা! ওটা আবার কী!

– একটি শব্দ তো বটেই। অর্থ বলা হয়েছে – বাহ্যজ্ঞানশূন্য, কিংকর্তব্যবিমূঢ় বা হতভম্ব। তবে এটা কোনো মৌলিক শব্দ নয়, – বানানো বা বলতে পারো বানোয়াট। কবি কালিদাসের দ্বাত্রিংশৎ পুত্তলিকা নাটকের চারটি রহস্যময় শেস্নাকের প্রতিটির আদ্যক্ষর দিয়ে গঠিত এই সসেমিরা!

– বেশ তো! আচ্ছা, প্রবাদে কয়, মহাকবি কালিদাস নাকি প্রথমে নিরক্ষর ছিলেন। বিয়ে করার পরে নিজের রাজকন্যা-স্ত্রীর অনুপ্রেরণা ও আপন চেষ্টায় তিনি সাক্ষর হন এবং কালক্রমে সংস্কৃত সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ কবি ও নাট্যকারের আসন লাভ করেন; আনুমানিক সর্ববাদী চতুর্থ-পঞ্চম শতকে।

– সর্ববাদী শতক! ওটা আবার কী?

– ইউরোপীয় অব্দ বা সালের পরিচয়ের জন্য আগে তো বলা হতো খ্রিষ্টপূর্ব অব্দ অথবা খ্রিষ্টাব্দ; – যিশুখ্রিষ্টের কথিত জন্মের সাল ধরে এর গণনা হতো।

– এখন এর জায়গায় বলা হচ্ছে – প্রাক-সর্ববাদী সাল আর সর্ববাদী সাল। তারিখগুলো আগের মতোই থাকছে, শুধু নাম বদলে যাচ্ছে। এখন খ্রিষ্টপূর্ব অব্দকে বলা হচ্ছে ‘বিফোর দ্য কমন এরা’ বা বাংলায় ‘প্রাক-সর্ববাদী সাল’ (প্রা. স. সা.)। আর খ্রিষ্টাব্দকে বলা হচ্ছে ‘কমন এরা’ – বাংলায় ‘সর্ববাদী সাল’ (স. সা.)।

– বেশ তো! তবে নিরক্ষর কে? – নিরক্ষর অর্থ মূর্খ বা নির্জ্ঞান নয়। কেবল কালিদাস নন। কত মহাগুণী নিরক্ষর ছিলেন। কোনো কোনো ভাষার অক্ষরও থাকে না, বর্তমানের হিসাবে সাত হাজার সাতানববইটি জীবন্ত ভাষার মধ্যে তিন হাজার নয়শো তিনটির লেখ্যরূপ আছে। বাকি চার হাজার নয়শো তিয়াত্তরটি ভাষার বর্ণপরিচয়ই নেই; এগুলো মৌখিক ভাষা; – এগুলোর ভাষাভাষীরা সবাই তো এক অর্থে নিরক্ষর, তা-ই না? তবে যেখানে একটি ভাষার বর্ণপরিচয় রয়েছে, সেখানে সেই ভাষাভাষী কেউ নিজের লিখিত ভাষাটা পড়তে কিংবা লিখতে না পারলে – তাকেই নিরক্ষর বলা যায়। ১৮২০ সালে পৃথিবীর ৮৮ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর ছিল; প্রায় দুশো বছর পরে – ২০১৫ সালে নিরক্ষরের হার কমে দাঁড়ায় মাত্র ১৪ শতাংশ। তবু সাতশো কোটির ১৮ শতাংশ, এও কম নাকি! ঢের বেশি, তাই না?

মিথ্যে বলে, সে যাক, এখন মিথ্যার ফিরিস্তিতে ফিরে যাই। – বর্ণ অনুসারে বলছি কিন্তু অকারণ অচল অতথ্য অতিরঞ্জন অপলাপ অবাস্তব অলীক অশ্বডিম্ব অসত্য অসার আষাঢ়ে আজগুবি উদ্ভাবনা ওছিলা কপট কাষ্ঠহাসি কুম্ভীরাশ্রম্ন কৈতব কৃত্রিম গাঁজাখুরি গুজব গুল চাটুকারিতা ছলছুতা ছদ্ম ছলনা জাল-জালিয়াতি ঝুটা ঝতা ঝুট ঝুটা ধাপ্পা নকল পট্টি পাতানো প্রপঞ্চ ফাঁকি বানানো বানোয়াট বিকৃত বিতথ্য ভ-ামি ভান ভুয়া ভেলকি ভোল মায়া মিছামিছি মেকিমুখোশ লুকোচুরি সাজানো ও শুধু শুধু।

সত্য বলে, তোমারটা শেষ হলে, আমারটা আরম্ভ করতে পারো, মিথ্যে।

– বটেই। শোনো তবে। অকৃত্রিম অনুমোদিত অবধারিত অবিসংবাদী অস্তিত্ব আদর্শ আপ্ত আসল খাঁটি ঠিক তত্ত্ব তথ্য ধ্রম্নব ন্যায় ন্যায্য যথাযথ যথার্থঝৃত পাকাপ্রকৃতির নিয়ম নিখুঁুত নির্ভেজাল  নির্ভুল যথার্থ বাস্তব বাস্তবতা মোক্ষম শুদ্ধ সঠিক সহি সত্যতা সত্তা সরকারি বৈজ্ঞানিক গাণিতিক সাচ্চা সুষ্ঠু স্বতঃসিদ্ধ স্বাভাবিক হক ও হকিকত। আপাতত এ-ই।

– আপাতত। আরো তো আছে।

– নিশ্চয়ই আছে।

– আমিও তা-ই বলি। কেন জানো? তোমার ও আমার যেসব নাম বললে, এগুলোর আরো বৈচিত্র্য আছে, রূপ-রূপান্তর আছে। ছল কথাটাই ধরা যাক। এটা শুনলেই মনে হয়, কথাটা মেয়েলি, তাই না? এর পেছনে ‘না’ যোগ করার জন্য নিশপিশ লাগে; আর সেইসঙ্গে ছলনাময়ী কথাটা এসে যায়। কল্প থেকে কল্পনাটাও একইরকম শব্দ। তা-ই না?

– বটে। এবার আমারটা শোনো। সত্যের আগে ‘অ’ লাগালেই অসত্য হয়ে যায়, তা থেকেই অসতী। অসৎ বললে নর-নারী উভয়কে বোঝায়। কিন্তু অসতী হয় শুধু নারী; এর কোনো পুং রূপ নেই। আর যৌন আচরণের বিধি যে লঙ্ঘন করেছে, তাকে বলে অসতী; আর সে নারী তো বটেই। বেশ্যাও তা-ই। যুগযুগান্ত ধরে মানুষের ভাষা যে কী করে নারীকে একতরফাভাবে পীড়ন করে আসছে, এটাও তার একটা প্রমাণ। আচ্ছা, তুমি কি নারীবিদ্বেষী, সত্য?

বলে মিথ্যে হাসে। সত্যও হেসে ওঠে : বলে, কী যে কও তুমি, মিথ্যে! আমি আবার নারীবৈরী হতে যাবো কেন?

– ভালো কথা, সত্য। বলো তো তোমার লিঙ্গ কী? তুমি নারী, না পুরুষ?

– যথার্থ প্রশ্নই করেছো, মিথ্যে। তাই তুমিই আগে বলো, তুমি পুংলিঙ্গ, না স্ত্রীলিঙ্গ?

– আবারো আমার পালা দেখছি! তবে বলি। আমার প্রতিভূ আছে। তোমারও প্রতিভূ রয়েছে। তাই না? এরা আমাদেরই অবিকল স্বরূপ। তবে এরা আমাদের সন্তান নয়; আমাদের প্রজন্ম তো কক্ষনো নয়।

– আমাদের কখনো জনক-জননী ছিল কিনা আমরা জানি না। থেকে থাকলেও তারা কে বা কারা আমরা জানি না। হয়তো আমাদের জন্ম হয়নি – উদ্ভব হয়েছে; হয়তো আমরা প্রাকৃতিক নই, তাই আমাদের জন্ম হয়নি। জন্ম হলো গিয়ে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য এক রূপান্তর পালা। জন্ম হচ্ছে দৈহিক, শারীরিক। জন্ম হচ্ছে মূল সৃজন। জন্ম আছে বলেই প্রকৃতি আছে। চন্দ্রের জন্ম হয়েছে, ধরিত্রীর জন্ম হয়েছে, সৌরম-লের জন্ম হয়েছে, সূর্যের জন্ম হয়েছে, ব্রহ্মা–র জন্ম হয়েছে – ছিটকেপড়া মহাস্ফুলিঙ্গ সব : অখিল চরাচরের জন্ম হয়েছে; শূন্যের জন্ম হয়েছে – শূন্যতা ছাড়া কী আছে –
এ-মহামায়ায় যাকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না – যার কোনো দেহ নেই। জন্ম আদি ও অনন্ত কা-; জন্ম অশেষ। জন্ম বড় অদ্ভুত বিচিত্র – ভ্রূণ থেকে জন্ম, ডিম থেকে জন্ম, বীজ থেকে জন্ম হয়। কখনো মায়ের গর্ভে, কখনো পিতার গর্ভ থেকে জন্ম হয়; কখনো ডিমে তা দিয়ে ফুটাতে হয়, কখনো ডিম মা-বাবা ছাড়াই ফোটে মাটি বা জলে। কখনো কোনো কোনো প্রাণী নিজেই নিজের লিঙ্গান্তর ঘটাতে পারে, তাতেই পুং বা স্ত্রীলিঙ্গ হয়। তাতে প্রজনন ঘটে। উদ্ভিদের প্রজনন হয় যৌন ও অযৌন – দুভাবেই; অচল বলে ওরা বিচি, শিকড় ও রেণুর মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে। মানুষ এমন অদ্ভুত প্রাণী যে, সে নতুন নতুন গাছপালা ও ফুলই তৈরি করে; সে-গবেষণাগারে বসে প্রাণীর অনুকরণ তৈরি করে। ডলি মেষ ছিল এর প্রথম দৃষ্টান্ত। অথচ তোমার বা আমার জন্ম হয়নি। আমাদের বংশ নেই। সহজাত নই আমরা। আমরা কারো মনগড়া। সে-কারণেই আমাদের লিঙ্গ না পুং, না স্ত্রী। আমরা ক্লীব। তবে ভুলে যেও না, ক্লীবজগতে বৈচিত্র্য কিন্তু ঢের।

বলে সহসা চুপ করে যায় সত্য। হয়তো তার মধ্যে কোনো আবেগ সঞ্চারিত হয়েছে। সেটা ফুলস্ন না বিষাদ তা সে ধরতে পারে না। তবু যেন অহেতুক একটা দীর্ঘশাস ফেলে সে বলে, জানো মিথ্যে, এর অবশ্য একটা বড় সুবিধা আছে।

মিথ্যে যেন সহসা জেগে ওঠে। বলে, সুবিধা! কেমন, বলো তো শুনি?

– পক্ষপাতিত্বের সুযোগটা নেই বললেই বলা চলে।

– হ্যাঁ, হ্যাঁ, পক্ষপাতিত্বের সুযোগটা নেই বললেই বলা চলে। খুশি হয়ে হাসে মিথ্যে। হাসি থামিয়ে সে বলে – এটা একটা ভালো বৈশিষ্ট্য। কে না জানে, নিরপেক্ষতা ক্রমসম্প্রসারমান-সর্বব্রহ্মা- ম-লে শক্ত বটে কিন্তু অপরিহার্য চরিত্র। মাধ্যাকর্ষণের মতো সে ঠেকা দিয়ে রাখে মহাশূন্যে ভাসমান ঘূর্ণমান চলমান যতসব অগ্নিকু-ময় গ্যাসময় গোলককে, ওদের ঘেঁষতে দেয় না, সংঘর্ষ ঘটতে দেয় না। দিলেই দিগচক্রবাল জুড়ে ঘটবে মহাজাগতিক বিস্ফোরণ। আর, যখন মতবিরোধ হয়, যখন দ্বন্দ্ব লাগে, যখন হানাহানি লাগতে যায়, যখন বিলয়ের নিনাদ বাজে, তখন নিরপেক্ষতাই বাঁচোয়া। রক্ত হাড় মাংস ছড়ানো রণাঙ্গন হননের হল্লা আর আর্তনাদে উপচে পড়ে; তারস্বর উঁচিয়ে নিরপেক্ষতা বলে, ‘থামো! থামো! করছো কী তোমরা! একবার নিজেদের দিকে তাকাও! দেখো, কী অবিমৃষ্য দেখতে তোমরা!’

– বাহ্। – দেখো কী অবিমৃষ্য দেখতে তোমরা! বাহ্! বাহ্!

মিথ্যে বলে, জানো সত্য, মানুষজীব কিন্তু বড় নির্মম ও বেসামাল হতে পারে। ষড়রিপু – যাকে বলে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য্য এগুলোর কোনো একটির পাল্লায় পড়লে সে নিজেকে সামলাতে পারে না; যাচ্ছেতাই অঘটন ঘটিয়ে বসে। কলঙ্কিত করে ফেলে নিজের সকল সৃষ্টি। করে তা-ব, করে ল-ভ-, করে অনাসৃষ্টি।

 

 

দুই

কখন ভোরের লালচে আভা ফুটতে শুরু করেছে পুব দিগমেত্ম। নদীর জলে কিছু মাছ ঘাই দেয়। সহসা ব্যাঙ ডাকে। দিঘির এক নিরালা কোণে পোনামাছ জটলা করে। চারদিকে ফড়িং ওড়ে আর বসে। ঝিঁঝিঁ ডাকে; কোথায় গেল ঝিঁঝিঁ! বাড়ির আবডালে দুটো টুনটুনি বাতাবিলেবুর ঝোপ থেকে ফুরুত করে ছুটে বের হয়ে আসে। গাছে গাছে সবুজ পাতার বাহার; পাখপাখালির কাকলি শোনা যায়। উঁচু ডালে কোথাও তক্ষক ডাকে। উঠোনে উঠোনে মোরগ হেঁকে ওঠে।  কাকেরা রব করে। কালো বিড়ালটা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসে। উঠোনে কুকুরটা কু-লী পাকিয়ে রোদে ওম পোহায়। একটি বালক মুঠোয় লাটিম হাতে হনহন করে কোথায় যায়, কে জানে! ভাবখানা হলো, দিগ্বিজয়ে যাচ্ছে। একটি বালিকা আদুরে স্বরে বলে, ‘মা শোনো! আমি সখির বাড়ি যাই, ওর পুতুলটা ফেরত দিয়ে আসি, হ্যাঁ!’ সাতসকালের রান্নাঘর থেকে এর জবাব আসে না; আসে             হাঁড়ি-পাতিলের শব্দ। বসন্ত দেখা দিচ্ছে।

মিথ্যে বলে, আহা! এখন আবহাওয়াটা মেশ মেদুর, তাই না, সত্য?

– তুমি যথার্থ কয়েছো। জলবায়ু খুব মোলায়েম। আলোটা মিঠা, মাখনের মতো তাকে গায়ে মাখানো যায়। মাতাল সুবাস হাওয়ায় ঘুরঘুর করছে। তবে কী জানো, আমার কাছে বর্ষাটাই বেশি সুখকর লাগে। আহা বহুরূপী জল! আহা বহুরূপী পানি! বাষ্প বলো, মেঘ বলো, শিলা বলো, বৃষ্টি বলো, নদী-খাল-বিল আর সাগর বলো, ঝর্ণা বলো কি তুষার কি হিম বলো সবই অভিন্ন ঐন্দ্রজালিক জল, জাদুকরী পানি। তার রূপের কী বাহার! একে-র নানান
রূপ-রূপান্তর। প্রজ্বলন্ত অগ্নিকু- হয়ে জন্ম নিলেও, পানি ছাড়া এ-ব্রহ্মা– ধরিত্রীকে কল্পনাই করা যায় না। পানি অর্থই হলো প্রাণ।

– ভালো বলেছো তো সত্য। আমি মনে করতাম পৃথিবীতে বুঝি আগুন, হাওয়া, রোদ, খনিজ আর জল খাটিয়ে মানুষ তার সভ্যতা গড়ছে। তবে জলের যে এতো রূপান্তর ও রূপ তা কেন আগে গুনে দেখিনি, তা বুঝতে পারছি না।

– আগে পারোনি সেটা নয়, এখন যে পারছো, সেটাই বড় কথা। জ্ঞান কখনো একসঙ্গে ধুম করে হুড়মুড়িয়ে আসে না। আসে ধীরে ধীরে অল্পে অল্পে। সে যাক এখন। চলো ফিরে যাই
সত্য- মিথ্যের নামজারিতে।

– হ্যাঁ, চলো ফিরে যাই। মিথ্যে হলো কল্পিত অমূলক; আর আছে মিথ্যে আশা মিথ্যে কথা মিথ্যে মামলা মিথ্যে খবর …।

– আচ্ছা, আচ্ছা, ওই যে তুমি বললে যা কল্পিত তা-ও মিথ্যে। তাহলে কি কবিতাও মিথ্যে? পৃথিবীর বড় বড় সব কবি বাল্মীকি, রুমি, খৈয়াম, শেক্সপিয়র, লালন, রবিঠাকুর, নজরুল – এঁদের যত মহান কাব্য সবই কি মিথ্যে? ভাবতে খুবই খারাপ লাগছে।

-আ – হা সত্য! এ-মিথ্যে সে-মিথ্যে নয়। অর্থাৎ অমূলক নয়। কবিতা বা যে-কোনো ললিতকলাই বলো, তা মানুষের সৃজনশীলতার ফসল, তাই এদের কল্পনাপ্রসূত বলা হয়। কল্পনা তো হাওয়ায় ভাসে, তাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, দেখা তো যায়-ই না। তাই না? তবে সেই কল্পনার ফসল হিসেবে একবার যখন কোনো কবিতা রচিত হয়ে যায়, কোনো গল্প বর্ণনায় রূপ নেয়, একটি ছবি আঁকা হয়ে যায়, কোনো ভাস্কর্য গড়ে ওঠে, একটি সুর জন্ম নেয়, কোনো গান সৃষ্টি হয়, একটা ভাব জেগে ওঠে তখন তা সকলি সত্য; নিরেট সত্য হয়ে ওঠে। কবির কথা শোনো! কবি বলেন, লাখ লাখ যুগ হিয়ার উপরে হিয়া রেখেছি, তবু হিয়া জোড়া গেলো না।

– আহা, আহা কী অমর কাব্য! কে যেন লিখেছেন!

– কেন, বিদ্যাপতি। তাঁর নিজের পঙ্ক্তি ছিল : ‘লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু \ তবু হিয়া জুড়ন না গেল \’

– মিথ্যেও একসময় সত্য হয়ে যায়। মনে হবে তা বিস্ময়কর।

– আবার সত্যও একদিন মিথ্যে হয়ে যায়। একদিন এ-পৃথিবী চষে বেড়িয়েছে ডায়নোসর প্রজাতি – সুবিশাল জীব; তবে ওরা কিন্তু জলজীব নীল তিমির চেয়ে আকারে-আয়তনে ছোট ছিল। কোটি কোটি বছর ছিল ডায়নোসররা এ-ধরায়। দোর্দ- প্রতাপে চষে বেড়িয়েছে। তারপর সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে হঠাৎ কী ঘটল ওরা সব মরে গেল! অতো বিপুল প্রাণী, তারা নেই হয়ে গেল! এখন আছে কেবল ওদের হাড়-কংকাল, জীবাশ্ম।

– তবে সত্য একটা নয়, একক নয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্যকে নানাভাবে ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে ধর্মের বেলায়, এর নানা প্রয়োগ আছে। যথা – সত্যত্যাগ সত্যনারায়ণ সত্যপথ সত্যপির সত্যযুগ। ধর্মের অবিচল রূপকে ধরা হয় সত্য। তা থেকে যে সরে যায় সে হয়ে যায় বেপথু, বৈরী ও শত্রম্ন – কখনো হত্যাযোগ্য হয়। তবে ধর্ম এক নয় বরং নানা; আর তাই সদা
দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত। ধর্মের যুদ্ধ সংখ্যায় অগণিত। আবার বিজ্ঞানের সত্য ভিন্ন। সে অজানাকে খুঁজে বেড়ায়। বিজ্ঞান সবজান্তা নয়। বরং যা লুকিয়ে আছে, আবডালে-অন্ধকারে থাকে, যা অজানা, যা প্রয়োজন, যা ধরা-ছোঁয়া-দর্শনের বাইরে থাকে সকলি উদ্ঘাটিত করে বিজ্ঞান। কখনো উদ্ভাবন করে বিজ্ঞান।

– শোনো সত্য! আমি কি ভাবছি জানো?

– বলো।

– ভাবছি, এ-বিষয়টা নিয়ে হয়তো একটা চমৎকার রম্যরচনা খাড়া করা যায়। যায় না?

– অবশ্যই যায়। সেটা একটা মজার ব্যাপার হবে। তুমি নিশ্চয়ই অঢেল বইটই ঘেঁটে রচনা করবে। রচনাটি তৈরি হওয়ার পর, আমি তো পড়বোই। আমাদের প্রতিভূরাও পড়বে।

মিথ্যে খুনখুনিয়ে হাসে। বলে – আমি লিখবো! হুঁ হুঁ হুঁ! কে বললো তোমায়, সত্য? আমি বরং ভাবছিলাম তুমি লিখবে। আর তোমার লেখার জন্যে আমি তোমায় একটা গণনকল এনে দেবো। লিখবে না?

– কী যে কও, মিথ্যে! ওসব আমার দ্বারা হয় না। কক্ষনো হয় না। যখন মাটির ফলকে দাগ কাটা হতো, যখন কালি লাগিয়ে পালক কলম দিয়ে লেখা হতো, তখনো কিন্তু আমি লিখতে পারিনি। লিখতে যে পারি না তা তো নয়। আদত কথা হচ্ছে, লেখার জন্যে বসতেই ইচ্ছে করে না। অনেককাল অনভ্যাস বহাল থাকলে, ভীতি মনের মধ্যে বাবুইয়ের মতন একটা বাসা তৈরি করে নেয়। আমারও মনে হয় সেই দশা।

– ও … আচ্ছা, আচ্ছা। এখন বলো তো সত্য, তুমি কি একা একা বসে বসে কেবল ভাবো? আকাশ-পাতাল ভাবো, না কী ভাবো না?

– ভাবি তো বটেই। তবে একা থাকি বলে কি বেশি বেশি ভাবি? হুম! না, না, সেটা কইতে পারবো না। তবে একজনের একার কথা কি অন্য কেউ দূর থেকে শুনতে পারে, বলো? এই যে তুমি এলে, এসে তিষ্ঠ হলে বলেই না আমার মনের ভাবটা তুমি শুনতে পারলে। এমন তো কেউ আসে না আজকাল। সত্যের খোঁজ কে নেয়, কও! আমি তো নানা কিছুর আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকি। আমাকে খুঁজে পাওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়। বহু সাধ্য-সাধনা লাগে; অনেক খড়কুটো পোড়াতে হয়। সবাই কি এ-খোঁজ করতে পারে? বেঁচেবর্তে থাকতেই তো বেসুমারজনের জীবন কাবার হয়ে যায়। যায় না?

– যায়; ‘দিন ফুরায়ে যায় রে আমার দিন ফুরায়ে যায়!’ ঠিকই বলেছো। মিথ্যের আবডালে লুকিয়ে-ছাপিয়ে থাকে সত্য। সত্য যাচাই করলেই কিন্তু মিথ্যে ধরা পড়ে যায়। তবে সত্যের মধ্যে মিথ্যে থাকে না। চিরসত্য কোনটা অথবা কাকে বলে জানি না। তাৎক্ষণিকভাবে চোখে দেখে, কানে শুনে বা স্পর্শ করে, জনরবে, লোকমুখে শুনে কি ঘুমের মধ্যে কোনো একটা বিষয় বা কোনো একটা বস্ত্ত যদি সত্য প্রতীয়মান হয়, সেটা আপাত-সত্য। যখন নির্মোহ তদন্ত হবে, তখন মিথ্যের সকল আবর্জনা আবিলতা কুহকতা গুজব ছলনা খসে খসে পড়বে; তখন অমোঘ সত্য উদ্ভাসিত হবে। নইলে অন্তরীক্ষক্ষ কি প্রত্যক্ষক্ষ কি পরোক্ষক্ষ যা দেখা যায় তা খ–তমু-ু কুক্কুট। ক্ক! ক্ক! করে কিন্তু কথা বলে না। আমি জানি সত্য, তোমার চারপাশে সত্য প্রতিভূদের তেমন দেখা যায় না; বরং আমার মিথ্যে প্রতিভূরাই বেশি ঘোরাফেরা ও চলাচল করে। ওদের বাড়িঘর হাটবাজার পথঘাট নদীখাল পাহাড়-পর্বত বনজঙ্গল তোমাকে আকীর্ণ করে রাখে। এদের হল্লায় তুমি হয়তো নির্বিঘ্নে ঘুমাতেও পারো না।

সত্য হাসতে শুরু করে। হাসি থামিয়ে বলে, কথাটা মন্দ বলোনি মিথ্যে। বিশেষ করে তোমার মুখ থেকে শুনে অনেকেরই কেমন কেমন লাগবে।

– মন্দের কথা বলছো, সত্য। তবে মিথ্যে আর মন্দকে কি অভিন্ন ভাবতে পারো? না, না, সত্য, এ দুটো হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মিথ্যে হচ্ছে অসত্য, যা হওয়া উচিত নয়, যার অস্তিত্ব নেই, যা খুঁজে পাওয়া যায় না। আর মন্দ হলো একটি খারাপ কাজ, অনাচার, অবাঞ্ছিত বিষয়, একটি হানিকর ঘটনা – যা ছিল, আছে বা
থাকবে। মানুষ তো সত্য; তার আচরণও সত্য, সেই আচরণে ভালোও যেমন আছে, মন্দও তেমন আছে। মিথ্যেকে মুছে ফেলা যায়; মন্দকে নির্মূল করা যায় না। আবার শেক্সপিয়র বলেছেন, ‘ভালো বা মন্দ বলে কোনোটাই নেই বটে; কিন্তু ভাবনার মধ্যেই যতকিছু।’ তা-ই কি? তবে যত অসত্য তা অনেকটাই বোধহয় মন্দের উঠোনে হাঁটে। অশুভের হাত ধরে নাচে। মানুষের ইতিহাস অনেক বড় বড় মন্দশক্তির সঙ্গে সহবাস করেছে। এবং এখনো করছে। তারা বই পোড়ায়; কবিকে সত্য বলতে দেয় না, নিরীহ মানুষ মারে, জনবসতি উচ্ছেদ করে। আরেক দল আছে যারা রং দিয়ে জাত বানায় : তাদের দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে বাণিজ্য করে; ধর্মের অজুহাতে অচ্ছুত বানিয়ে নিজেদের স্বর্গের পথ খোলে; তাদের অনাবাদি ভূমি বেদখল করে, লুণ্ঠন করে তাদের সম্পদ; আর বড়াই করে বলে, আমরাই সভ্য।

– হিঃ হিঃ হিঃ! করে ওরা দুজনাই হাসে। একসঙ্গে বলে, বুজরুকি! ভান! কপটতা! হাঃ হাঃ হাঃ!

 

তিন

‘প্রখর তপনতাপে আকাশ তৃষায় কাঁপে’।

গ্রীষ্ম। তাপদাহ। প্রকা- মাঠের মধ্যে একটা বড় নারকেলগাছ, তায় পাতা অল্প। তারই তলায় উদোম হয়ে বসে আছে দুজন। সত্য ও মিথ্যে। কোনো বায়ু চলাচল নেই। সূর্য সটান খাড়া হয়ে আছে।

সত্য বলে, তাপে তুমি কি খুব কাতর, মিথ্যে? কষ্ট হচ্ছে?

– আমাদের ব্রহ্মা– অগ্নি-উৎস হচ্ছে নক্ষত্র রবি। আমাদের শক্তির আকর সূর্য। সূর্য অগণন তরল অগ্নি-গ্যাসে ভরা সদা দুর্মর একটি গোলক। সে আছে নয় কোটি ত্রিশ লাখ মাইল দূরে। সেখান থেকে তার কিরণ আর তাপে জগতের কত না কল্যাণ হয় কিন্তু তাতে আমার বড় যাতনা লাগে। মনে হয় সব পুড়ে যাবে। দাউদাউ করে জ্বলবে। তারপর সব ভস্ম ছাই হয়ে যাবে।

– তবে রক্ষক্ষ, বছরে কেবল দুটো মাস বড় তাপ পড়ে। বৈশাখ আর জ্যৈষ্ঠ। নইলে তোমাকে বোধহয় পাওয়া যেতো না।

– সে-কথা আর বলতে! পরিহাসের হাসি মিথ্যের মুখে ফোটে।

– তবে ভাবছি মিথ্যে, তুমি না থাকলে আমারই বা কী গতি হতো!

মিথ্যে গমগম স্বরে হেসে ওঠে। সে-হাসি আর থামে না। ধরিত্রীর সকল প্রাণী তার হাসির স্বর শুনতে পায়। সে বলে, তবেই বোঝো! মিথ্যে নেই, অলীক নেই, গুজব নেই … আমার প্রতিভূ যতো … ওরা কেউ নেই। শুধু তুমি আছো। সত্য, কেবল তুমি আছো। সত্য ছাড়া কিছু নেই। কেবল সত্য আছে। ভেবে দেখেছো? দেখোনি! একবার ভেবে দেখো পরিস্থিতিটা! ভাবো, সত্য!

– ভাবছি। ভাবছি। হ্যাঁ, ভাবছি তো বটেই।

– কোনো কল্পনা নেই, কোনো ভাব নেই, কোনো সৃজনশীলতা নেই; কাব্য সুর সংগীত নৃত্য চিত্রকলা ভাস্কর্যের কোনো উৎস নেই! এরা তো সকলি মিথ্যে। কারণ আমি নেই। আমার কোনো প্রতিভূ নেই। একমাত্র তুমি আছো, সত্য। আমার ওপিঠ। তুমিই একচ্ছত্র। আপন সিংহাসনে তুমিই একাকী অনন্য। তুমি সর্বতো বিরাজমান। তোমার ওঙ্কারধনি ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। ভেবেছো, সত্য?

– ভেবেছি, মিথ্যে। ভেবেছি। তুমি যতদূর বলছো তারও অধিকতরো, ব্যাপকতরো, গভীরতরোভাবে আকাশ-পাতাল ভেবেছি।

– চমৎকার! চমৎকার! তবে কোনো কূলকিনারা করতে পারলে কি, ওপিঠ!

– ও আমার ওপিঠ! আমার সুখবোধ হচ্ছে কিনা দুঃখবোধ হচ্ছে, তা আমি ঠাহর করতে পারছি না। আমার মধ্যে কান্না-হাসির ঊর্ধ্বে একটা চেতনা দেখা দিচ্ছে।

– তা-ই! কী তা? কী তা?

– প্রকৃতির মধ্যে সত্য বা মিথ্যে বলে কিছু নেই। একদম কিছু নেই। প্রকৃতি নির্বিকার; সে বিচার করে না। মানুষের ধর্মচিন্তার একটা ফসল হচ্ছে নৈতিকতা। উলটোভাবে বলা যায়, মানুষের নৈতিকতার ফসল হচ্ছে ধর্মচিন্তা। এ থেকে আসে বিচার। ভালো ও মন্দের বিচার। যুক্তিবিদ্যার ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকলেও বলা যায় দর্শনকে ধর্মবোধ অপহরণ করে নিয়েছে।

সত্য ও মিথ্যে দুজনাই হো-হো করে হাসে। প্রাণহরা হাসি ওদের। মধুমাখা ধ্বনি।

এই হাসির ধ্বনি শুনে সত্য ও মিথ্যের প্রতিভূরা ধেই ধেই করে জগৎ জুড়ে নাচতে শুরু করলো। বেসুমার বাঁশিও বেজে উঠলো দিগদিগমেত্ম। ঢোলের বোল ফুটলো পুবে পশ্চিমে উত্তরে দক্ষিণে ঊর্ধ্বে অধে ঈশানে নৈর্ঋতে।

ধা! ধা!! ধা!!!

অনেক পরে শোনা গেল ওই মনোরম কোমল হাসির সঙ্গে সংগত রেখে জলে ও স্থলে বৃক্ষ, তৃণ, পত্র, পশু, পক্ষী, মৎস্য, কীটপতঙ্গ – স্থলচর, খেচর, জলচর, উভচর – এক সর্বতোসুখী ঐকতানে জেগে উঠেছে। তিমির জলদগম্ভীর ডাক যেন এর কাছে তুচ্ছ।

 

চার

এভাবে সমাপ্ত হলো ঋতানৃতের (ঋত + অনৃত = সত্য + মিথ্যার) প্রথম আলাপ।