এই গৃহ এই সন্ন্যাস

রাত গভীর। নিজ্ঝুম। চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন তিনি। তিমিরানন্দ। মহারাজ তিনি। অলকানন্দা মঠের। ভক্তদের কাছে তিনি তিমিরানন্দ পুরী। পূজনীয়। তাঁর সংসারী নাম দেবদুলাল রায়। ভেক নেওয়ার পর তাঁর নাম পালটে যায়। রাত্রির দ্বিতীয় থাম শেষ হতে চলল। তিমিরানন্দ এখনো নিদ্রাবিযুক্ত। এপাশ-ওপাশ করছেন। মনটা কি আজ বিচলিত তাঁর? গুরুদেব বলেছিলেন – মনের চঞ্চলতা দূর করতে চাইলে ললাটের ঠিক মধ্যিখানে দৃষ্টি স্থির করে রাখবে। আসেত্ম আসেত্ম অস্থিরতা কেটে যাবে। দেবদুলালের মন বাঁধ মানে না। সদ্য সংসারধর্ম ত্যাগ করে এসেছেন। মন বড় অশান্ত। গভীর এক ব্যাকুলতা তাঁকে দিগ্শূন্য করে তুলছে বারে বারে। নিদ্রাদেবী তাঁকে একেবারেই ত্যাগ করে গেছেন। এক বিকেলে গুরুদেবের সামনে গিয়ে করজোড়ে দাঁড়ালেন।

বললেন, ‘একটা নিবেদন গুরুদেব।’

স্মিতহাস্যে গুরুদেব বললেন, ‘কী বলতে চাইছো দেবদুলাল?’

‘নিদ্রাদেবী আমাকে ত্যাগ করেছেন গুরুদেব।’

‘কেন? আমার প্রদর্শিত কৌশল কি তুমি অনুসরণ করোনি?’

দেবদুলাল গুরুদেবের পরের প্রশ্নের আগে উত্তর দিলেন। বললেন, ‘অনুসরণ করেছি, নিষ্ঠার সঙ্গেই অনুসরণ করেছি।’

‘তাহলে!’ গুরুদেব কিছুটা বিস্মিত।

‘মন বড় অস্থির গুরুদেব। পেছনজীবন বড় টানছে আমায়।’

‘ফেলে আসা জীবন তোমাকে বিকল করছে, এই তো?’

‘যথার্থ ধরেছেন গুরুদেব। দুর্ভার স্মৃতি থেকে আমি মুক্তি চাই। রাতে নিশ্চিমেত্ম-নির্বিঘ্নে ঘুমাতে চাই।’

‘এত বছরের স্মৃতি থেকে কি সহজে মুক্তি পাওয়া যায়? পাবে একদিন। মনকে শক্ত করতে হবে। ধ্যানমুখী করতে হবে মনকে।’

‘সে কীভাবে গুরুদেব!’

‘বলছি। রাতে শয্যায় চিৎ হয়ে শোবে। শ্বাস-প্রশ্বাসে নিবিষ্ট করবে মন।’

‘তারপর গুরুদেব!’

‘যখন নাসিকা দিয়ে বাতাস টানছো, ভাববে – বেঁচে আছি। যখন বাতাস ত্যাগ করবে, ভাববে – বাতাস আবার আমার দেহাভ্যন্তরে ফিরে না-ও আসতে পারে। মানেটা কী? মানে হলো – তোমার জীবন এবং মৃত্যু বাতাসের এই যাওয়া-আসার ওপর নির্ভরশীল।’

‘তা তো …।’ কিছু একটা বলতে চাইলেন দেবদুলাল।

মুখের কথা কেড়ে নিলেন গুরুদেব। মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘বাতাস ঢুকলে আছো, বেরিয়ে গেলে নাই। অর্থাৎ তোমার জীবন অতি ঠুনকো একটা ব্যাপার। মানে জীবন অনিত্য।’

বলে বেশ কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকলেন গুরুদেব। কোমল চোখদুটো দিয়ে দেবদুলালের দিকে তাকালেন। ধীরে ধীরে বললেন, ‘জীবন যে ঠুনকো, কলাপাতায় জলের মতো, বুঝতে পারবে যখন, তোমার চারদিকটা, তোমার অতীত, তোমার বর্তমান – সবকিছুই অর্থহীন হয়ে যাবে তোমার কাছে। নিজেকে ভীষণ হালকা মনে হবে তখন তোমার। মন হয়ে যাবে ফুলের পাপড়ির মতন পবিত্র। তোমার মনে হবে তুমি শয্যায় শুয়ে নেই; মনে হবে বাতাসে ভেসে আছো। বুঝেছো বৎস।’

বিভোর চোখে গুরুদেবের দিকে তাকিয়ে থাকলেন দেবদুলাল।

 

তারপর তো বহু বছর কেটে গেল। আত্মশুদ্ধির সাধনায় মগ্ন হয়ে পড়লেন দেবদুলাল। একটা সময়ে মন এবং দেহ তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে এলো। তাঁর ব্যক্তিত্ব বিকশিত হলো। অলকানন্দ মঠে গুরুদেবের পরেই তিনি গণ্য হতে লাগলেন। বহু আগেই তিনি গৈরিক বসন পরিধান করা শুরু করেছিলেন।

মৃত্যুর আগে সর্বসমক্ষক্ষ গুরুদেব বললেন, ‘আমার পরে দেবদুলালই এই মঠের অধ্যক্ষ হবে। আমি এর নতুন নাম রাখলাম  – তিমিরানন্দ। কষ্ট-দুঃখের রং তো কালো। তিমিরের মতো। কষ্টের মধ্যে যে আনন্দ ছড়াবে, সে-ই তিমিরানন্দ। এ তিমিরানন্দ এই মঠের তিমিরবিনাশী হবে।’ বলে চোখ বুজেছিলেন গুরুদেব।

 

মঠের মহারাজ হওয়ার পরও অনেকটা বছর কেটে গেছে। এখন তিমিরানন্দ কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্যরহিত। নিদ্রা তাঁর আজ্ঞাধীন।

কিন্তু আজ রাতে তন্দ্রাঘোর তিমিরানন্দকে ত্যাগ করেছে। বড় বিস্মিত তিনি, স্তম্ভিতও অনেকটা। গুরু-প্রদর্শিত দুটো কৌশল প্রয়োগ করেও নিদ্রামগ্ন হতে ব্যর্থ তিনি আজ। কেন? ভাবছেন তিনি। ভাবতে ভাবতে একটা সময়ে তাঁর চোখ জুড়ে ঘুম নেমে এলো।

 

হরিবাবু, রাখেন আপনার বয়ান। এতক্ষণ ধরে তো অনেক কথাই বললেন! নিজের বয়ানে আমার কথা বলে গেলেন! এবার আমার কথা আমাকেই বলতে দিন।

গত আঠারো বছর ধরে লিখে যাচ্ছেন আপনি। সবাই বলে – আপনি নাকি প্রান্তজনের লেখক। বাস্তব অভিজ্ঞতা নাকি আপনার লেখার মূলধন। আমি আপনার লেখা খুব বেশি যে পড়েছি, এমন নয়। তবে কমও পড়িনি। ওইটুকু পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি – আপনি সাধারণ মানুষের বাস্তব জীবনকে নিয়ে লেখেন। এটা সত্যি। তবে এটাও আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না, যেখানে আপনার অভিজ্ঞতা খেই হারিয়ে ফেলে, সেখানে কল্পনার আশ্রয় নেন। এই কল্পনার চাপে বাস্তবতা নড়বড়ে হয়ে পড়ে তখন। আপনি আমাকে নিয়ে গল্প লিখতে বসেছেন, বুঝলাম। আমি তো আপনার বিশেষ পরিচিতদের একজন ছিলাম। আমার ভেতর-বাহিরটাও আপনার কম জানা ছিল না। কিন্তু সবটুকুই কি জানতেন আপনি? একজন মানুষের সবটুকু কি অন্য একজন মানুষের জানা সম্ভব! না, কিছুতেই নয়। তাই আমাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে কোথাও না কোথাও কল্পনাকে প্রশ্রয় দিতে বাধ্য হবেন আপনি। তাছাড়া আপনার প্রিয় মানুষ ছিলাম আমি। রূঢ়-রুক্ষ ঘটনায় এসে আপনি এড়িয়ে যাবেন। এতে তো গল্পটা যথাযথ হয়ে উঠবে না!

তাই হরিবাবু, আপনার কাছে অনুরোধ – আমার কথা আমাকেই বলতে দিন। তাতে আপনি অনেকটা স্বসিত্ম পাবেন আর পাঠকরা কাহিনিশেষে যদি একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন, তাহলে আমার বলাটা সার্থক হবে।

আমার পদবি ‘রায়’ ছিল না। ছিল শীল। আমি যখন জন্মাই, তখন আমার সম্প্রদায়ের লোকজন শীলই লিখত। তারপর কী হলো কে জানে, পাড়ার সিনিয়র তরুণরা শীলের জায়গায় সুশীল লেখা শুরু করল। আর নাপিতপাড়াকে বলা শুরু করল নরসুন্দরপাড়া। তারা বলতে চাইল – গোপাল ভাঁড়ের দিন শেষ হয়ে গেছে এখন। যতদিন তিনি ছিলেন আর সমাজে তাঁর মানমর্যাদা ছিল, শীলদের ইজ্জত-সম্মানও ছিল। এখন সেই গোপালও নেই, যশোদাও নেই। এখন হলো গিয়ে বংশমর্যাদার কাল। এ-যুগে যত উঁচু বংশ, তত উঁচু মানগৌরব। জেলে-নাপিত-মেথরের কাল নয় এখন। এখন সময় রায়-রায়য়ান, চৌধুরী-সেনের যুগ। তাই তো সুশীল, তাই তো নরসুন্দরপাড়া!

আমার বেলায় তা এককাঠি বাড়িয়ে দিলাম। নইলে নাম রেজিস্ট্রেশনের সময় যখন এলো, আমি বললাম – আমার পদবি রায়, মানে আমার নাম দেবদুলাল রায়।

হেডম্যান একটু গাঁইগুঁই করলেন। বললেন, ‘এ কী রে! খোলনলচে একেবারে পালটে দিবি নাকি!’

গোঁয়ারের মতো আমি বললাম, ‘স্যার, আমার পদবি রায়ই হবে।’ হেডস্যার হারুন পাশা বললেন, ‘যার ছাগল সে যেভাবেই কাটবে কাটুক, মাথার দিকে বা লেজের দিকে। আমাদের কী!’

সেই থেকে শীলসমাজে আমি রায়। বাবা যেদিন জানতে পারল, বড় ব্যথা পেল। যেদিন মাধ্যমিকের রেজাল্ট দিলো, বাবা জানল – আমি অনেক আগেই পদবি পালটেছি। বাবা ক্ষোভটা ভেতরে চেপে রেখেছিল। আমি গণিত আর সনাতন ধর্মে লেটার মার্ক পেয়েছিলাম। ওই আনন্দের তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল বাবার দুঃখটা।

বাবাকে আরেকবার দুঃখ দিয়েছিলাম আমি; সে আরো বেশ কবছর পরে। সে-দুঃখ বাবা সইতে পারেনি।

আমার পদবি বদলানোয় বাবা গুমরে মরত। আমাকে সরাসরি কিছু বলত না। কিন্তু মাকে বলত। আড়ালে বলত। আসলে বাবা আমাকে কষ্ট দিতে চাইত না। কলেজ থেকে ফিরলাম একদিন। মা বা বাবা বুঝতে পারেনি, আমি ফিরেছি। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বাবার আফসোসের গলা শুনতে পেলাম, ‘বড় ছেলেটা তো পড়ালেখা করল না তেমন। বিঘে কয়েক ফসলি জমি ছিল বলে জগদীশকে কামলাগিরি করতে হচ্ছে না। যেজন লেখাপড়া করল, একেবারে আমার গুষ্টির শেকড় ধরে টান মারল। সে এখন নাপিত নয়, সে এখন উঁচু জাতের। রায় বংশের সে!’ মা কোনো উত্তর দেয়নি। কীই-বা উত্তর দেবে মা! আমার কর্মকা–র যথাযথ উত্তর তো মায়ের জানা নেই!

তখন আমি অনার্স থার্ড ইয়ারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, গণিত বিভাগে। দাদাকে বিয়ে করাল বাবা। বউদিটি আমার লক্ষ্মী। কিন্তু বউদির ছোট বোন গীতালি আরো বড় লক্ষ্মী।

সেই ছোটবেলা থেকেই আমার চেহারাটা ভালো নয়। কী রকম পাটকাঠির মতো হাত, বগার মতন ঠ্যাং দুটো। চোখগুলো গর্ত গর্ত। কোঁকড়ানো চুল! কোঁকড়ানো চুল আমার মোটেই পছন্দের নয়! বন্ধুদের কী লম্বা চুল, ঘাড় পর্যন্ত! তাদের পকেটে ছোট চিরুনি। সুযোগ পেলে লম্বা চুলে চিরুনি বোলায় তারা। পাড়ার সুখলাল তো বাহারি চুল ঝাঁকিয়েই অনন্ত কাকার মেয়ে সীমাকে বাগিয়ে নিল।

আর আমার চুল! যত লম্বা হয়, তত বেশি কুঁকড়ে যায়। বটানো চাটাইয়ের মতো মাথায় লেপটে থাকে। চুলগুলোকে আফ্রিকানদের চুলের মতো দেখায়। ওই চুলে যতই চিরুনি ঘষি, চুলগুলো তত বেশি লজ্জাবতীর পাতার মতো গুটিয়ে যায়। বন্ধুদের দেখে দেখে কত চেষ্টা করেছি জুঁই, শ্যামলী, রঞ্জনাদের মন ভোলাবার জন্য। কিন্তু কেউ ফিরে তাকায়নি। আড়ালে আওয়াজ দিয়েছে – ‘লম্বা ঠ্যাঙের বগাটা প্রেম খেতে চায়। ওকে বল না, ঠ্যাংগুলো বাঁইট্যা করতে, আর দুধসাগু খেয়ে মোটা হতে।’ মেয়েদের মন্তব্য আমাকে পাগল করে তোলে।

এই লজ্জা মাথায় নিয়ে আমি কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে গেছি। কত বন্ধুকে দেখি হাতে হাত রেখে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ আবডাল খুঁজে ঠোঁটে ঠোঁটও রাখছে। কিন্তু আমার ভাগ্যে অমাবস্যার কালোরাত। আমার দিকে কেউ সেরকম চোখে তাকায় না। জটিল গণিতে আটকে গেলে কেউ কেউ এসে বলে, ‘দেখেন তো দুলালদা, অংকটা মিলাতে পারছি না। আপনি তো গণিতবিদ। আপনার হাতে না মিলে যাবে কোথায়!’ আমি মনে মনে বলি – দাদা! আমি তো দাদা হতে চাই না! আমি তো প্রেমিক হতে চাই। মনের কথা মনেই চেপে রাখি। মুখ ফুটে বলতে পারি না। নিজের ঠোঁট নিজেই কামড়াই।

আমার আফসোসের কলি একদিন শেষ হলো। আমার তৃষ্ণা মিটাল গীতালি। গীতালি আমার দাদার শ্যালিকা।

দাদার শ্বশুরবাড়িতে কী একটা নিমন্ত্রণ ছিল। গোটা পরিবারের। আমি তখন এমএসসি ফাইনাল ইয়ারে। কাকতালীয়ভাবে আগের দিন আমি বাড়িতে গেছি। দুদিন থাকব বলেই গেছি। হোস্টেলেই থাকি আমি। ছুটিছাটায় বাড়িতে যাই। সাবিবর আর সোলতানের মধ্যে মারপিট হলো ইউনিভার্সিটির কদমতলায়। দুজন আবার বড় দুই রাজনৈতিক দলের পান্ডা। ব্যস, যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে। ক্লাসটস্নাস গোলস্নায় গেল। আগের দিন সন্ধেয় বাবা বলল, ‘কাল দুপুরে জগদীশের শ্বশুরবাড়িতে নেমন্তন্ন। সবাইকে যেতে হবে।’

গেলাম পরদিন। দেখি প্রচুর রান্নাবান্নার আয়োজন। বাবার বেয়াইয়ের বাপের বাৎসরিক শ্রাদ্ধ নাকি! অতিথি-অভ্যাগতও কম নয়। সবার সঙ্গে যে কথা হলো, শুভেচ্ছা বিনিময় হলো, এমন নয়। কিন্তু একজনের সঙ্গে আমার ভালো রকমেরই মোলাকাত হলো। সে গীতালি। গীতালির সঙ্গে আমার আগে বারকয়েক হ্যালো-হাই হয়েছে। দাদার শ্যালিকা। আমার সঙ্গে তো তার মিষ্টিমধুর সম্পর্ক থাকারই কথা। তবে সেরকম কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি আগে।

সেদিন যাওয়ার পর থেকে গীতালি আমার দিকে আড়েঠাড়ে তাকাচ্ছিল বেশ। প্রথমে খেয়াল করিনি। পরে যখন খেয়াল করলাম, ভাবলাম – ধুর ধুর, এ আমার চোখেরই ভুল!

খাওয়ার পর মুখ মোছার কিছু পাচ্ছিলাম না। বউদি তা খেয়াল করল। গীতালিকে বলল, ‘গীতা, দেবুকে তোমার ঘর থেকে তোয়ালেটা এনে দাও তো।’ বলে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল বউদি। গীতালি তোয়ালে আনতে তার ঘরে ঢুকল। কেন জানি, আমিও গেলাম তার পিছু পিছু। সেদিন আমি বেশ দুঃসাহসী হয়ে উঠেছিলাম। তোয়ালেটা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই জাপটে ধরেছিলাম গীতাকে। তারপর চুমু। সে কী চুমু! দীর্ঘ, গাঢ়, লালাময়। প্রথমে একটু মোচড়ামুচড়ি করলেও শেষ পর্যন্ত চুমুতে মজে গিয়েছিল গীতালি। যখন আমরা বিচ্ছিন্ন হলাম, মাতাল অবস্থা আমার! চোখ আঁধার আঁধার। মাথাটা টলছে। দেয়াল ধরে দাঁড়ালাম আমি। গীতালি কিন্তু নিজেকে সামলে নিল মুহূর্তেই। স্বাভাবিক পায়ে বেরিয়ে গেল সে। মেয়েরা বোধহয় পারে। নইলে কেন গোটাটা দুপুর-বিকেল এমন স্থির আর স্বাভাবিক থাকতে পারল গীতালি!

এমএসসি শেষে চাকরিও একটা পেয়ে গেলাম আমি। প্রাইভেট কলেজে অধ্যাপনার। সোনাগাজী কলেজে। বাবা ঠিক করল, আমাকে বিয়ে করাবে। বাবা তখন ন্যুব্জ হয়ে গেছে। বলল, ‘তোমাকে বিয়ে করিয়ে আমি চোখ বুজতে চাই।’

আমি জানিয়ে দিলাম – ‘বিয়ে যদি করাতেই চাও, গীতালিকেই করাও। গীতালি ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না আমি।’

আমার কথায় সবার মাথায় বাজ পড়ল। দাদা নীরব, বউদি অভিমানী। মা আর্তনাদ করতে থাকল। বাবার এক কথা – ‘গীতালির সাথে কিছুতেই দেবদুলালের বিয়ে দেবো না আমি। চাই তো আমার প্রাণ যাক।’

গীতালিকেই বিয়ে করেছিলাম আমি। কোর্ট ম্যারেজ। চট্টগ্রাম শহরে বাসা নিয়েছি। পরিবার-আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সকল সম্পর্ক গুটিয়ে নিয়েছি। আমি ভীষণ উৎফুলস্ন থাকলেও গীতালি নিজেকে নিজের খোলসে ভরে রাখত। আমার সামনে হাসিখুশি থাকবার অভিনয় করত। অন্যসময় কীরকম যেন মনমরা।

এক গভীর রাতে বলল, ‘আমরা বোধহয় ঠিক করিনি। আমার তোমার পরিবারের কেউই খুশি না আমাদের বিয়েতে।’ আমি গলায় জোর ঢেলে বলি, ‘ওসব ঠিক হয়ে যাবে একদিন। কতদিন আর অভিমান করে থাকতে পারবে ওরা।’

‘অভিমান নয়, রাগ। ভীষণ রেগে আছেন তোমার বাবা।’ গীতালি বলেছিল সে-রাতে।

আমি গীতালিকে কাছে টেনে নিয়েছিলাম। সেদিন আমার আবদারে গায়ে কিছু রাখেনি। তাকে মথিত করতে করতে বলেছিলাম, ‘আমরা বাবাকে একটা নাতি দিলেই সকল রাগ জল হয়ে যাবে।’

কিন্তু রাগ জল করার মতো সময় বাবা আমাদের দেয়নি। মারা গিয়েছিল। নাতি হয়েছিল বটে একটা তার, কিন্তু সেই নাতিটি দাদাঠাকুরের সান্নিধ্য পায়নি।

জগদীশদা জমিজমা, পরিবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকল। দিন গড়িয়ে গেল। মা-ও মারা গেল একদিন। আমি গেলাম না। পুকুরঘাটে পা পিছলে ডুবে গিয়েছিল মা। গীতালির শত অনুরোধ আর কান্নাকাটিতেও আমি গ্রামে গেলাম না। যে-মা আমার সুখকে পছন্দ করেনি, আমার বিয়েকে মেনে নেয়নি, যাব না আমি তার মরামুখ দেখতে। আমার অনেকগুলো অপরাধের সঙ্গে আরেকটি অপরাধ যুক্ত হলো। এ-অপরাধ অমার্জনীয়। এ যে মস্ত বড় একটা পাপ, ক্রোধের বশে আমলে নিইনি সেদিন।

ঈশ্বর বুঝি আমায় শাসিত্ম দিলেন। হ্যাঁ, আমাকেই দিলেন শাসিত্ম। গীতাকে নয়। গীতা তো দোষী নয়, সকল দোষ তো আমারই। সান্টু যখন একটু মাথা তোলা হতে লাগল। দেখলাম – পাদুটো সে ঠিকঠাক মতন ফেলতে পারছে না। গীতা একদিন বলল, ‘সান্টুর মুখ থেকে বের হওয়া শব্দগুলো যেন কীরকম এলোমেলো, খেয়াল করেছো?’

কদিন ধরে সান্টুর দিকে গভীরভাবে নজর রাখলাম। সত্যি তো! কীরকম এবড়োখেবড়ো কথাবার্তা। ডান হাতটা কি একটু বাঁকানো! আরে ও তো অন্য দশটা ছেলের মতো হাঁটছে না! দু-কদম এগিয়ে গোত্তা খেয়ে পড়ে যাচ্ছে!

সান্টু অটিস্টিক হলো।

এরপর আমি উতলা হয়ে উঠলাম। গীতালিকে বললাম, ‘আমি সমন্তান চাই, আমি আরো একটি বাচ্চা চাই।’ গীতালি বলল, ‘তা কেন! একটা যে হয়েছে! সান্টু স্বাভাবিক নয়। ওকে নিয়ে আমাদের গোটা জীবন কাটাতে হবে। পরেরটা যে স্বাভাবিক হবে, তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে!’

আমার কলেজ ততদিনে সরকারি হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া সরকারি কলেজে বদলি হয়ে এসেছি। আমি এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর।

আমি দম্ভের সঙ্গে বললাম, ‘আমার পাঁচটা বাচ্চা হলেও আমি কি খাওয়াতে পারব না? এখন আমার বেতন কত জানো?’

গীতালি মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমি তার ওপর বারবার উপগত হই। সে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। আমি আমার প্রয়োজন সেরে পাশ ফিরে শুই।

দীপা জন্মাল। হায় ঈশ্বর, এ কী হলো আমার! আমি কি তোমার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবো না বাবা!

দীপা বড় হলো। তার বুদ্ধির কোনো বিকাশ নেই। জড়বুদ্ধি হলো দীপা। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সব ঠিকঠাক। কিন্তু মনটা-বুদ্ধিটা একেবারেই এক-দুই বছরের শিশুর মতো।

তারপর! তারপর আমার জীবননদীর জল একেবারেই বুড়িগঙ্গার দূষিত জলের মতো হয়ে গেল। বাড়িতে ঢুকলেই অসুস্থ একটা পরিবেশ। দু-দুটো অর্বাচীন আমার চারপাশে হাউকাউ করছে। আমার পাগল পাগল ভাব। দিশেহারা আমি। যতক্ষণ কলেজে থাকি, ভালো থাকি। ওই কলেজেই আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হরিবাবু। পিসি কলেজ না নরসিংদী কলেজ থেকে বদলি হয়ে এসেছেন আপনি। দুদিনেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল আপনার সঙ্গে। সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি হলো। একটা-দুটো করে আমার কথা বলতে শুরু করলাম আপনাকে। সবকিছু কি বলেছি? না বলিনি। দীপাকে যে একদিন পাশের ফ্ল্যাটের তরুণবাবু নিজের বেডরুমে ঢুকিয়ে নিয়েছিল, বলিনি। কেন বেকুব-অথর্ব হলো এই অজুহাতে যে সান্টুকে পিটিয়ে মাথা-হাত-গা ফাটিয়ে দিয়েছি বলিনি। বছর দুয়েক ধরে যে গীতালির সঙ্গে আমার কোনো দৈহিক সম্পর্ক নেই, বলিনি। আমার যে মাঝে মাঝে কর্ণফুলীতে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করে, বলিনি। প্রায় সময় যে সংসার ত্যাগ করে বিবাগী হয়ে যেতে ইচ্ছে করে বলিনি। আপনিই বলুন হরিবাবু, জীবনের সবকিছু কি কারো সঙ্গে শেয়ার করা যায়! এমন কী স্ত্রীর সঙ্গেও!

একদিন গীতালি দীপাকে বিয়ে দেওয়ার মনস্থ করল। মেয়েটা যে গা-গতরে অনেকটা বড় হয়ে গেছে তখন। আমি ‘হ্যাঁ না’-এর দোলাচলে দুললাম। আমাদের গ্রাম থেকে পাঁচ গ্রাম উত্তরে খানখানাবাদ গ্রাম। ওই গ্রামের শুকদেবের সঙ্গেই বিয়ে হলো দীপার। বিয়ের পর জানতে পারলাম – শুকদেবের মা দজ্জাল প্রকৃতির। গোটাদিন গঞ্জের বাজারে দর্জির কাজ করে শুকদেব। রাতে ফেরে। একদিন ফিরে দেখল – দীপা চাটাইয়ে চিৎ হয়ে আছে। মুখে তার সাদাটে ফেনা। পাড়ার লোকজন বলল, শাশুড়ির অত্যাচারে মারা গেছে মেয়েটা।

গীতালি বিহবল হয়ে পড়ল। আমি মনে মনে ভাবলাম – যাক, বাঁচা গেল। মরে যখন গেছেই, কীভাবে মরল, তা নিয়ে গ্যাঞ্জামে যাওয়ার দরকার নেই। মেয়ে তো আর ফিরে আসবে না? এরকম ভাবনা আমার আর একটা পাপ।

গীতালি বলল, ‘মেয়েটাকে এভাবে হত্যা করল ওরা। তুমি এর কোনো বিহিত করবে না? থানা পুলিশে খবর দেবে না!’

আমি গীতালির কথাকে এড়িয়ে গেলাম। বললাম, ‘যে গেছে গেছে। যেটা আছে, ওটাকে নিয়ে থাকো।’ গীতালির বিদীর্ণ             মাতৃহৃদয়ের খোঁজ নিলাম না আমি।

এর দিন সাতেক পরে গীতালির গায়ে আগুন লাগল। আমি তখন কলেজে। রিটায়ারমেন্টের বছর। ঘরে শান্তি নেই। কলেজেই সময় কাটাই বেশি।

ফিরে দেখি – গীতালির দেহটি কয়লা হয়ে গেছে। পাশের বাসার সুজাতার মা বলল, অন্যমনস্ক ছিল বোধহয় বেচারী। যা দুঃখ! আঁচলে আগুন লেগেছিল হয়তো!

আমি তো জানি, এ গীতালির আত্মহত্যা। স্বামীর অবহেলা, কন্যার খুন, সান্টুর অস্বাভাবিকতা তাকে বেদিশা করে তুলেছিল। তাই মরণকে বেছে নিয়েছে গীতালি। আমিও যে মরতে চাইনি, এমন নয়। কিন্তু সাহসে কুলায়নি।

রিটায়ারমেন্টের পরে দাদা জগদীশ এসেছিল বাসায়। বউদিও সঙ্গে ছিল। আমি মাথা নিচু করে বসে ছিলাম। কীভাবে, কোন দাবিতে আমি মাথা তুলি বলুন!

দাদা বলেছিল, ‘তুই তো একেবারে একলা হয়ে গেলি রে! তোকে দুবেলা রেঁধে দেওয়ারও কেউ থাকল না!’ আমি তখন হাপুস-হুপুস কাঁদছি।

দাদা আবার বলল, ‘তুই এক কাজ কর। সান্টুকে আমাদের সঙ্গে দিয়ে দে। গ্রামের পরিবেশে ও অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠবে। আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশলে ওর ভালো লাগবে।’

বউদি বলেছিল, ‘তাই করো দেবদুলাল। সান্টুকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাই। আপত্তি করো না তুমি।’

আমি আপত্তি করিনি। কী আপত্তি করব আমি! আমি তো গীতালির দেহ দেখে লোভাতুর হয়েছিলাম। তাকে তো তেমন করে ভালোবাসিনি! সমন্তানদেরও তো কোনোদিন ভালোবাসিনি। যদি ওদের ভালোবাসতাম, তাহলে গীতা এমন করে প্রাণ দিত না।

রিটায়ারমেন্টের সব টাকা দাদার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ‘সান্টুকে দেখো দাদা।’

বউদিকে বলেছিলাম, ‘তোমার আপন বোনেরই তো ছেলে সান্টু। নিজের সমন্তানের মতো করে রেখো।’ ঝরঝর করে কেঁদে দিয়েছিল বউদি।

 

আমি সব ছেড়েছুড়ে এই মঠে এসে উঠেছিলাম। মঠে রাখতে গুরুদেব প্রথম দিকে রাজি হননি। বলেছিলেন, ‘গৃহী মানুষ তুমি দেবদুলাল। সংসারের প্রতি সাময়িক বিতৃষ্ণা জেগেছে তোমার মনে। একদিন ওই বিরাগ কেটে যাবে। সংসারের জন্য লালায়িত হয়ে উঠবে একদিন।’ একটু থেমে বলেছিলেন, ‘যা হোক এসেছো যখন থাকো কদিন। মন সুস্থির হলে ফিরে যেয়ো।’

গুরুদেবের সঙ্গে তর্ক করিনি সেদিন। বলিনি – ‘গুরুদেব, আপনার ধারণা ভুল। আমি আর কখনো সংসারে ফিরে যাবো না। এইখানেই আমি শেষ জীবনটা কাটিয়ে দেবো।’

থেকে গিয়েছিলাম আমি অলকানন্দা মঠে। এক দুই তিন করে করে অনেকটা বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। একদিন আমি দেবদুলাল থেকে তিমিরানন্দ হয়ে গেছি। যে-পদবির জন্য বাবাকে প্রথম কষ্টটা দিয়েছিলাম, তার সবটাই পালটে গেল। সংসারজীবনের সবকিছুকে অতিশয় ঠুনকো বলে মনে হয় এখন আমার। এখন যে আমার কেউ নেই, কিছুই নেই।

নিদ্রা টুটে গেল মহারাজ তিমিরানন্দের। হঠাৎ প্রাতঃপ্রার্থনার শঙ্খঘণ্টা বেজে উঠল মঠে। ধড়মড় করে শয্যার ওপর উঠে বসলেন তিমিরানন্দ।