একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ আমাদের মজুভাই

মতিউর রহমান

বাংলাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ, সেরা স্থপতি মাজহারুল ইসলাম (১৯২৩-২০১২) প্রায় চার বছর ধরে বেশ অসুস্থ ছিলেন। প্রিয় আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুদের চিনতে পারতেন না। কথাও বলতেন না তেমন। কখনো বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাতেন, কখনো আবার তাকাতেন একটু দুষ্টুমিভরা হাসি নিয়ে। শেষ ছয় মাস তো একদমই কথা বলতে পারতেন না।

২০০৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাঁকে দেখতে গুলশানের বাসায় গেলে তিনি খুশি হয়ে বলে উঠেছিলেন, এই যে মাল? একেবারে সেই পুরনো দিনের মতো। দুষ্টুমিভরা কণ্ঠে ঘনিষ্ঠজনদের ‘মাল’ বলে ডাকাটা তাঁর একরকম অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।

কিছুদিন পরই এক সন্ধ্যায় আবার আমরা তাঁর বাসায় খেতে যাই। অনেকটা সময় কাটাই মজুভাই আর বেবী আপার সঙ্গে। তাদের সঙ্গে আরও ছিলেন নাজিয়া আর ফারহাত। বেশ সুন্দর সময় কেটেছিল আমাদের। তিনি কোনো কথা বলেননি। কিন্তু আমাদের প্রতি অন্তরঙ্গতার এতটুকু কমতি ছিল না। আমাদের বিদায় জানাতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে যেতে চাইছিলেন। আমরা চাচ্ছিলাম না। এ নিয়ে একটু টানাটানি চলেছিল আমাদের মধ্যে।

তাঁকে আমরা ডাকতাম ‘মজুভাই’ বলে। আমাদের সেই মজুভাই, দেশের শ্রেষ্ঠতম স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ১৫ জুলাই (২০১২ সাল) গভীর রাতে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর এই প্রস্থান পরিণত বয়সেই হলো। আমাদের সান্ত্বনা এটুকুই যে, সবার জীবনেরই এ এক অমোঘ নিয়তি। কিন্তু আমাদের বেবী আপার তো এখন আর কোনো সান্ত্বনা নেই। মজুভাই কখনো বেবী আপাকে কাছছাড়া করতে চাইতেন না। মজুভাইয়ের মৃত্যুর পরদিন সকালে তাঁদের বাসভবনে দেখা হতেই জড়িয়ে ধরে বেবী আপা বললেন, তোমাদের মজুভাই চলেই গেলেন।

মজুভাই আর বেবী আপাদের সঙ্গে আমাদের বহুদিনের বহু আনন্দ আর উত্তেজনাভরা সময়ের ছবিগুলো বারবার মনে ভেসে ওঠে। কত কিছু যে মনে পড়ে। আবার হারিয়েও গেছে কত না স্মৃতি।

আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মানুষগুলোর একেবারে সামনের দিকে ছিলেন মাজহারুল ইসলাম। তাঁর সেই অপূর্ব সৌন্দর্য যেমন বাইরের, তেমনই অন্তরের। এককথায় যাঁকে বলে সুপুরুষ, তিনি ছিলেন ঠিক তাই। মুখখানা সব সময় স্মিত হাসিতে স্নিগ্ধ; তাতে বুদ্ধির দীপ্তি, অথচ দৃষ্টি একেবারে প্রসন্ন। মনের দিক থেকেও ঠিক একই রকম উদার সুরুচিসম্পন্ন, চিন্তায় সংস্কারমুক্ত। আবার ব্যবহারিক জীবনে দেখেছি পোশাক-আশাক, আহার-বিহার, আচার-আচরণ, কথাবার্তায়, কর্মে-চিন্তায় তিনি কতই না আধুনিক, পরিশীলিত আর অমায়িক। রেগে যেতেন কখনো কখনো। ভয়ও পেতাম। কিন্তু তাতেও ছিল এক সৌন্দর্য। একজন আদর্শ মানুষকে আমরা যেভাবে কল্পনা করি, মজুভাইয়ের মধ্যে সেই সব গুণের এক আশ্চর্য সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাবেশ ঘটেছিল।

মজুভাইয়ের স্ত্রী হোসনে আরা ইসলাম, আমাদের বেবী আপা একটু বেশি বয়সে ষাটের দশকের মাঝামাঝি স্নাতক পর্যায়ের পাঠ শুরু করেছিলেন ইডেন কলেজে। ইডেন কলেজের সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের হয়ে বেবী আপা সহসভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁকে পড়ালেখায় সাহায্য করতে যেতেন সে-সময়ের ছাত্রনেত্রী মালেকা বেগম, গৃহশিক্ষক হিসেবে। আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রাজনীতি আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রামে দিন-রাত জড়িয়ে আছি ভীষণভাবে। এক বিকেলে মালেকা আমাকে এসে জানাল তাঁর বিস্ময়ের কথা। বেবী আপাকে পড়াতে গেছে তাঁদের বাড়িতে। দরজায় কড়া নাড়তেই এক অসম্ভব সুদর্শন পুরুষ এসে দরজা খুলে দিলেন। তাঁর সৌন্দর্যে মালেকা এতটাই বিস্মিত হয়ে পড়ল যে, ফিরে এসে আমাকে মজুভাইয়ের বর্ণনা না দিয়ে পারেনি।

 

গ্রামের নাম সুন্দরপুর

মাজহারুল ইসলামের জন্ম ১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর। মুর্শিদাবাদের সুন্দরপুর গ্রামে, নানার বাড়িতে। তাঁর দাদার বাড়ি চট্টগ্রামের কুয়েপাড়ায়। শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত, সচ্ছল পরিবার। দাদা ছিলেন সাব-রেজিস্ট্রার। বাবা-চাচারা সবাই শিক্ষিত। ঢাকা ও কলকাতায় চাকরি করতেন। বাবা উমদাতুল ইসলাম সরকারি কলেজের অঙ্কের অধ্যাপক। মা জাকিয়া খাতুন। বাবার চাকরির সুবাদে তাঁর স্কুল ও কলেজজীবন কেটেছে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরে। ১৯৪২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে আবারও পুরকৌশলবিদ্যায় স্নাতক, ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক, ১৯৫৭ সালে যুক্তরাজ্যের আর্কিটেকচারাল অ্যাসোসিয়েশন স্কুল অব আর্কিটেকচার থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন ১৯৬১ সালে। এখানে শিক্ষকতা করতেন বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি লুই আই কান। সেই সুবাদেই লুই কানের কাজ সম্পর্কে জেনেছিলেন তিনি।

বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেমিনারে অভিসন্দর্ভ উপস্থাপন করেছেন। সদস্য ছিলেন প্রথম আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার জুরি বোর্ডে। দেশ-বিদেশে অনেক মর্যাদাপূর্ণ পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে আছে দেশের সবচেয়ে বড়ো জাতীয় স্বীকৃতি ‘স্বাধীনতা পদক’। বিদেশেও পেয়েছেন অনেক স্বীকৃতি-সম্মান।

 

মজুভাইয়ের বাস্ত্তকলাবিদ

আমার সঙ্গে মজুভাইয়ের প্রথম দেখা কোথায় হয়েছিল, স্মৃতি হাতড়েও আর উদ্ধার করতে পারছি না। ষাটের দশকের মাঝামাঝি কোনো সময়ে হবে। আগেই বলেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কাজে কর্মচঞ্চল দিন কাটছিল আমাদের। মজুভাইও এসব কর্মকান্ডের সঙ্গে নানাভাবে জড়িত ছিলেন। কখনো নেপথ্যে, কখনো সামনে থেকে সক্রিয় ভূমিকায়।

সম্ভবত এ ধরনেরই কোনো কর্মকান্ডের সূত্র ধরে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। পরীবাগে তাঁর প্রতিষ্ঠান বাস্ত্তকলাবিদের বিশাল কার্যালয়, একই সঙ্গে বাসভবন। সামনে সবুজ ঘাসে ছেয়ে থাকা মাঠ, পাশেই পুকুর। হরেকরকমের গাছ আর লতাগুল্মের সমারোহ। সেই সময়ের সব প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের একটি প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল তাঁর এই বসতবাড়ি। দেশের প্রধান কবি, লেখক, শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীদের মধ্যে কে যাননি সেখানে? ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন শওকত ওসমান, কামরুল হাসান, এমদাদ হোসেন এবং ওয়াহিদুল হকসহ অনেকে।

মনে পড়ছে, প্যারিস থেকে ফেরার পর শিল্পী রশিদ চৌধুরীর প্রথম প্রদর্শনীটি হয়েছিল বাস্ত্তকলাবিদেই। কামরুল হাসানের চিত্রকলার একটি প্রদর্শনীও কি হয়েছিল সেখানে? ছায়ানটের অনুষ্ঠানের গানের মহড়া শুধু নয়, ছায়ানটের অনুষ্ঠানও হতে দেখেছি বাস্ত্তকলাবিদের ওই সবুজ মাঠে, মঞ্চ করে। দেখেছি, তিনি ব্যস্ত হয়ে আছেন অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে, এমনকি মঞ্চ নির্মাণেও।

আমরা তখন তাঁর কাজের তাৎপর্য সম্পর্কে খুব গভীর কিছু জানতাম না। এ-কথা জানতাম যে, তিনি আর্ট কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় পাঠাগার, নিপা ভবনের মতো বেশ কিছু আধুনিক স্থাপত্য সৃষ্টি করেছেন। এদেশের প্রথম সুউচ্চ ইমারত ‘জীবন বীমা ভবনে’র স্থপতিও ছিলেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে আছে জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রূপপুর আণবিক শক্তি প্রকল্প, সড়ক ও জনপথ প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ইত্যাদি। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশ কিছু আবাসিক বাড়ির অনুপম নকশাও তিনি করেছিলেন।

জানতাম, তিনি সর্বজনস্বীকৃত অত্যন্ত বড় একজন স্থপতি। কিন্তু তাঁর ভেতরে কখনো কোনো অহমিকা কাজ করতে দেখিনি। সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত ছিল তাঁর জীবনযাত্রা। অভিজাত কিন্তু আড়ম্বরহীন। পরতেন সাধারণত মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি-পাজামা, কখনো হাওয়াই শার্ট-প্যান্ট, পায়ে স্যান্ডেল শু। গাড়ি চালাতেন নিজেই।

মজুভাইয়ের মধ্যে প্রাণশক্তির যে অপূর্ব স্ফূরণ ঘটত, তা আমরা সবসময় বিস্মিত হয়ে দেখতাম। তাঁর সে প্রাণশক্তি আমাদের ভেতরেও দারুণ প্রেরণা ও উদ্দীপনা সঞ্চার করত। এত বিচিত্র বিষয়ে, এত পরিশ্রমের সঙ্গে করতে পারতেন, এত গভীর নিষ্ঠায় তিনি কাজ করতেন যে, সত্যিই তার কোনো তুলনা মেলে না। যেকোনো ভালো কাজের সঙ্গে থাকতেন নির্দ্বিধায়, নির্ভয়ে। কতবার যে কত অনুরোধ নিয়ে গেছি তাঁর কাছে। মজুভাই আর বেবী আপা হাসিমুখে আমাদের সেসব অনুরোধ রক্ষা করেছেন।

১৯৬৯ সালে ডেমরায় প্রবল ঘূর্ণিঝড় হলো। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল বিপুল। বরাবরের মতোই আমরা গিয়ে ধরলাম মজুভাই-বেবী আপাকে। বলা মাত্র আমাদের প্রস্তাবে তাঁরা রাজি। আর্থিক সহায়তা তো বেবী আপা করলেনই, তাঁর গাঢ় নীল রঙের ফক্সওয়াগন গাড়িটিও সারাদিনের জন্য দিয়ে দিলেন ত্রাণকাজে।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পরপর সোভিয়েত ইউনিয়নের যুব নেতা বোরিস ল্যাভসভ এসেছিলেন ঢাকায়। আমরা তাঁকে খাওয়াতে চাই কোনো বাসায়। ভেবে ঠিক করলাম, মজুভাইকেই বলি। বলামাত্রই সম্মত। তাঁর ধানমন্ডির বাসায় সুন্দর এক খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন হলো।

মজুভাইয়ের সেই ধানমন্ডির বাসার কথা এখনো মনে পড়ে। আমার ধারণা, স্থাপত্যসৌকর্যে সে-বাড়িটি এখনো সেরা। মনে পড়ে, লাল রঙের নারকেল গাছের দুটি চারা এনে দিয়েছিলাম আমাদের নানাবাড়ি কাপাসিয়া থেকে। নারকেল গাছ দুটি বড়ও হয়েছিল। এখনো আছে কি সেই গাছ দুটি?

এরকম নানা কাজে, নানা যোগাযোগের মধ্যে দিয়েই একসময় তাঁদের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা নিবিড় ও প্রীতিময় হয়ে উঠেছিল। আমাদের সামনেই বেড়ে উঠছিল তাঁদের ছেলে রফিক, তান্না ও মেয়ে ডালিয়া। আরেক মেয়ে নাজিয়া তখন গুটিগুটি পায়ে সারাবাড়িতে হেঁটে বেড়াত (বেবী আপার বোন অধ্যাপিকা নূরুন্নেসা ফয়জুন্নেসার মেয়ে, কিন্তু মজুভাই আর বেবী আপার ভালোবাসার ছায়াতলেই তাকে বড় হতে দেখেছি)। ক্রমেই আমরা তাঁর পরিবার, তাঁর বৃহৎ স্বজনদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। কাছে থেকে তাঁকে দেখাজানার সুযোগ হয়েছিল এভাবেই।

 

রাজনৈতিক জীবন

মজুভাইকে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতেই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে পেয়েছিলাম নানা ঘটনাপ্রবাহে সংশ্লিষ্ট থাকার সুবাদে। দুটো স্মৃতির কথা বলা যায়।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির বহু গোপন সভা হয়েছিল তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে। তখন সেটি ছিল ঢাকার অত্যন্ত আধুনিক মনোমুগ্ধকর স্থাপত্যের বসতবাড়ি। মজুভাইয়ের নিজের নকশায় করা গাছগাছালিঘেরা লাল ইটের সুন্দর আধুনিক একটি বাড়ি। সেই বাড়িতে কমিউনিস্ট পার্টির এক গোপন সভা হবে রাতে। সময়টা ১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি কোনো একসময় হবে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় দুই নেতা কমরেড বারীণ দত্ত (আবদুস সালাম) আর খোকা রায়কে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মাঝামাঝি একটি স্থান থেকে তাঁর মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে করে দুজনকে নিয়ে ধানমন্ডির বাড়িতে গিয়ে আমি বিস্মিত হয়ে পড়ি। পার্টির সম্পাদকমন্ডলীর সব সদস্য সেখানে উপস্থিত। তারপর বৈঠক চলল গভীর রাত পর্যন্ত। তিনি নিজে গাড়ি চালিয়ে আবার পৌঁছে দিয়েছিলেন তাদের।

অন্য ঘটনাটি আমার মনে আরও গভীর দাগ কেটে আছে। সেটিও ওই বছরই। মে দিবস উপলক্ষে ছাত্রদের মধ্যে যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের নিয়ে একটি গোপন বড় সভা হয়েছিল তাঁর ওই ধানমন্ডির বাড়িতে। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ। দেশে সামরিক শাসন চলছে। আত্মগোপনকারী কমরেড মণি সিংহ এসেছিলেন সে-সভায়। তিনি সেখানে সোভিয়েত বিপ্লবের কাহিনি বলে একটি উদ্দীপনাময় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। চলমান ঊনসত্তরের ফেব্রুয়ারির গণঅভ্যুত্থানকে তিনি সে-বক্তৃতায় আরো এক বড়ো বিপ্লবের ‘ড্রেস রিহার্সাল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁর সেই আশাবাদ সফল হয়েছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন ও স্বাধীনতাপ্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে।

মজুভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর মতো একজন মানুষের জন্য খুবই স্বাভাবিক ছিল সেটি। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন সর্বাত্মকভাবে। কলকাতায় গিয়ে বহুভাবে অংশ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক কাজে।

রাজনীতির ব্যাপারে তিনি সবসময়ই সচেতন ছিলেন। সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া তাঁর জন্য স্বাভাবিক ছিল। স্বাধীনতার আগেই অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে কোষাধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। স্বাধীনতার পরও ওই পদে সক্রিয় ছিলেন। ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক পংকজ ভট্টাচার্যের এক বড়ো আশ্রয় ছিলেন আমাদের মজুভাই। সেই চুয়াত্তরে তাঁর বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হয়েছিল বাস্ত্তকলাবিদেই।

আবার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাকশাল গঠনের সময়ও তাঁর বিশেষ সক্রিয়তা লক্ষ করা গেছে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সমবায় বিষয়ে আলোচনা-পরামর্শ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত তিনি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবি নিয়ে সক্রিয় ছিলেন। এরপর ফিরে এসে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হন ধীরে ধীরে। পরে মহিউদ্দিন আহমদ-আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে গঠিত বাকশালে তিনি উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। পরবর্তীকালে সেই বাকশালকে আওয়ামী লীগে আত্তীকরণের কাজেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন দীর্ঘদিন।

গোটা সত্তর-আশির দশকে রাজনীতির উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে আমাদের মজুভাই যেমন সক্রিয় ছিলেন, তেমনি স্থাপত্যকলা ও সংস্কৃতিচর্চাও সমান তালে অব্যাহত রেখেছিলেন। যদিও স্থপতি হিসেবে কাজ তাঁর কমে গিয়েছিল। কবি, সাহিত্যিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ ও ভূগোলবিদদের নিয়ে ‘চেতনা’ নামে একটি পাঠচক্র করেছিলেন। নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন তরুণ প্রজন্মের স্থপতি ও সংস্কৃতিসেবীদের।

মজুভাই গান ভালোবাসতেন। কন্যা ডালিয়া নওশিনকে সংগীতশিল্পী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন অনেক প্রযত্ন নিয়ে। বই আর ম্যাগাজিন পড়তেন অনেক। প্রিয় লেখকদের একজন ছিলেন আগাথা ক্রিস্টি।

 

স্থাপত্যের পথিকৃৎ

গত শতকের পঞ্চাশের দশকে যখন তিনি স্থাপত্যের চর্চা শুরু করেন, তখন এদেশে অন্যান্য শিল্পের তুলনায় স্থাপত্যশিল্প বেশ পিছিয়ে ছিল, অপরিচিত ছিল। একাগ্রচিত্তে নিরবচ্ছিন্ন স্থাপত্যচর্চার মধ্য দিয়ে তিনি একাধারে যেমন এদেশে আধুনিক স্থাপত্যের বুনিয়াদ রচনা করেছেন, তেমনি এ-পেশাকে একটি আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতেও বড় ভূমিকা রেখেছিলেন।

তিনি বলতেন, ‘আমাদের এই ছোট্ট দেশটি আসলে খুব সুন্দর। প্রকৃতি ও মানুষের মেলবন্ধ ও ভারসাম্য রক্ষা করা স্থাপত্যপেশার মূল লক্ষ্য।’ সেই লক্ষ্যেই তিনি পশ্চিমা আধুনিকতার পাশাপাশি দেশীয় ঐতিহ্যের যোগ ঘটিয়েছিলেন। স্থানীয় উপকরণের ব্যবহার, চারুশিল্পের বিভিন্ন মাধ্যম – বিশেষ করে ম্যুরাল ও ভাস্কর্য সংযোজন এবং পরিবেশের সমন্বয়ের মাধ্যমে তিনি একটি স্বকীয় স্থাপত্যরীতিও প্রবর্তন করেছিলেন। এজন্যেই তাঁকে বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যের পথিকৃৎ হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছে।

এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক স্থাপত্যচর্চার ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদ প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য।

১৯৬৪ সালে স্থপতি হিসেবে তাঁকে ঢাকায় একটি ‘দ্বিতীয় রাজধানী কমপ্লেক্স’ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একটি আধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শন ঢাকায় নির্মিত হোক, যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটি প্রেরণাস্থল হয়ে থাকবে। তিনিই লুই আই কানের নাম প্রস্তাব করেন ও কাজটি করতে তাঁকে রাজি করান। শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সংসদসহ অন্যান্য স্থাপত্য আজ পৃথিবীর একটি অন্যতম স্থাপত্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

 

মনে পড়ে সেই হাসিমুখ

নববইয়ের দশকে ক্রমে স্থাপত্যকলার চর্চা কমে গেলেও তিনি কর্মময় ছিলেন তাঁর প্রিয় সব ক্ষেত্রে। নববইয়ের দশকে এসে মজুভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কিছুটা কমে এসেছিল। নিজেও তখন জড়িয়ে গেছি সংবাদপত্রসহ নানা প্রাতিষ্ঠানিক কাজে। তবে যখনই মজুভাই-বেবী আপার সঙ্গে দেখা বা যোগাযোগ হয়েছে কিংবা মাঝেমধ্যে হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হয়েছি – কিছু গালমন্দসহ ভালোবাসা পেয়েছি অনেক। অনুভব করেছি তাঁদের হূদয়ের গভীর উষ্ণতা।

মনে পড়ে, ২০০৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর সকালে পরীবাগের বাস্ত্তকলাবিদে তাঁর জন্মদিন উদযাপিত হয়েছিল পারিবারিক উদ্যোগে। সুন্দর সময় কেটেছিল সেদিন। আমাদের আলোকচিত্রী জিয়া ইসলাম দারুণ সব ছবি তুলেছিল। অ্যালবামে সেই ছবিগুলো পেয়ে দারুণ খুশি হয়েছিলেন মজুভাই আর তাঁর পরিবার।

২০০৯ সালে আমরা ধানমন্ডির বেঙ্গল ক্যাফেতে মজুভাইয়ের ৮৭তম জন্মদিনে স্বজন ও সুহূদদের নিয়ে একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠান করেছিলাম। অনেকেই এসেছিলেন। তাঁর শরীর তখন বেশ দুর্বল, স্মৃতিও খানিকটা ঝাপসা। কিন্তু মুখে সেই স্নিগ্ধ স্মিত হাসিটি আগের মতোই অম্লান। বেশ মনে পড়ে, অধ্যাপক রেহমান সোবহান যখন শুভেচ্ছা জানিয়ে করমর্দন করলেন তাঁর সঙ্গে তখনো তাঁর চোখে-মুখে সেই হাসি। কয়েকজন স্থপতি যখন তাঁর সম্পর্কে বলছেন, তখনো সেই স্মিত হাসি। সেই সব দিনের ঘটনা-পরম্পরা, তাঁর সুদর্শন হাসিমুখ, উদার অন্তরঙ্গতা – চোখ বুজলে মনের পর্দায় কত কিছু যে এখনো ভেসে ওঠে বারবার। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।