একটি অভিনব গবেষণা

রবিউল হোসেন

বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রগতিশীলতা ও রক্ষণশীলতার দ্বন্দ্ব

হাবিব রহমান

 

কথাপ্রকাশ

ঢাকা, ২০১২

 

৪০০ টাকা

বাঙালি মুসলমানের সামাজিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা ও মূল্যায়ন-পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে যে-স্বল্প কজন গবেষক তাঁদের বর্তমান আত্মকেন্দ্রিক সমাজকে সচেতন করার আন্তরিক প্রয়াসে কাজ করে যাচ্ছেন, হাবিব রহমান তাঁদের অন্যতম। ব্রিটিশ যুগের বাংলা ও  দেশবিভাগ-পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাস ও চিন্তাশীল মুসলিম লেখক-বুদ্ধিজীবীদের ভাবনা ও কর্মকান্ড তাঁর অধ্যয়ন-অনুশীলনের প্রধান ক্ষেত্র। মোতাহের হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ প্রমুখ লেখকের সাহিত্যসাধনা ও চিন্তাধারা সম্পর্কে গ্রন্থ এবং সমাজের বিবিধ প্রসঙ্গ নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রবন্ধ তিনি রচনা করেছেন। বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত এসব প্রবন্ধের বাছাইকৃত সংকলন বেরিয়েছে ঢাকা ও কলকাতা থেকে। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের ১০ বছরের বার্ষিক অধিবেশনসমূহের সভাপতির ভাষণ ও শিখা পত্রিকার সহযোগী মাসিক জাগরণের একটি নির্বাচিত সংকলন তিনি সম্পাদনা করেছেন। দুটি সংকলনই সুসম্পাদিত ও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর শেষ প্রকাশিত গ্রন্থ, যেটি আমার আলোচ্য, বাংলা ভাষার অভিনব একটি গবেষণা বলে মনে করি। যদি বিশেষ কোনো নামে চিহ্নিত করতে চাওয়া হয়, তাহলে একে ডকুমেন্টারি গবেষণা বলা যেতে পারে।

গ্রন্থটির মূল অধ্যায় চারটি। এগুলোর শিরোনাম : ‘সওগাত-মোহাম্মদীর দ্বন্দ্ব : কর্তৃত্বে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে’, ‘কাজী নজরুল ইসলাম : বিতর্কের বিস্তার’, ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন : ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া’ এবং ‘প্রগতির পন্থা : পত্র বিতর্ক’। এছাড়া আছে উপক্রমণিকা ও উপসংহার। একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, মুসলমান সমাজে প্রগতিশীলতা ও রক্ষণশীলতার প্রশ্নে যেসব দ্বন্দ্ব ব্রিটিশ শাসনকালে সংঘটিত হয়েছিল তা কি কেবল ওই তিন-চারটি ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল? না, তা ছিল না। শিক্ষা, অর্থনীতি, নারী সমাজ প্রভৃতি ক্ষেত্রেও নানা প্রশ্নে দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু গবেষক ঘটনাবহুল দ্বন্দ্বগুলো বেছে নিয়েছেন এবং সময়ের অনুক্রম অনুযায়ী বহু জ্ঞাত-অজ্ঞাত দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। এগুলোর ভেতর দিয়েই সমকালীন মুসলিম-মানসের জগৎ ও জীবনদৃষ্টি অনুধাবন করা যায়।

ইতিহাসের কোনো ঘটনাই বোধকরি আকস্মিকভাবে ঘটে না, তার একটি পরম্পরা থাকে। সেজন্যে হাবিব রহমান সর্বাধিক ঘটনাবহুল সওগাত-মোহাম্মদী পত্রিকার দ্বন্দ্বের পরিচয় দেওয়ার আগে উপক্রমণিকায় মীর মশাররফ হোসেনের ‘গো-জীবন’ ও বেগম রোকেয়ার ‘আমাদের অবনতি’ প্রবন্ধ দুটিকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজে যে-প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন। মুক্তচিন্তা ও সত্যপ্রকাশের কারণে দ্বন্দ্বের প্রথম স্মারক হিসেবে রচনাদুটির গুরুত্ব তুলে ধরে গবেষক সংগতভাবেই এই অংশকে তুলনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কথিত ‘সন্ধ্যাবেলা প্রদীপ জ্বালানোর আগে সকালবেলা সলতে পাকানো’র সঙ্গে। উল্লেখ্য, মীর মশাররফ হোসেনের ‘গো-জীবন’ উনিশ শতকের শেষ দশকে আর বেগম রোকেয়ার ‘আমাদের অবনতি’ বিশ শতকের প্রথম দশকে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

এ-গ্রন্থের মূল চারটি অধ্যায়ের বর্ণিত বিষয়সমূহের সংঘটন কাল বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশক। গবেষকের মতে, মুসলিম সমাজে প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল চিন্তার দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির উত্তুঙ্গ সময়পর্ব এই দুই দশক। সওগাত ও মোহাম্মদী পত্রিকার দ্বন্দ্ব, নজরুলকে কেন্দ্র করে একপক্ষের মুগ্ধ-প্রীতি ও অন্যপক্ষের প্রবল বিরূপতা, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া, প্রগতির পথের সন্ধানে সাপ্তাহিক সওগাত ও বুলবুল পত্রিকায় অনুষ্ঠিত দুটি পত্রবিতর্ক উপর্যুক্ত মতেরই মুদ্রিত প্রতিফলন। এই কালপর্বে             লেখক-নির্ধারিত বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে কত ঘটনা যে সংঘটিত হয়েছিল তা পড়লে অবাক না হয়ে পারা যায় না। দীর্ঘ সময়জুড়ে বহু পরিশ্রমে গবেষক সেসব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। এর অনেক কিছুই আমাদের কাছে এতদিন অজ্ঞাত ছিল।

আগেই বলা হয়েছে, এটি একটি ডকুমেন্টারি গবেষণা। লেখকের ভূমিকা এখানে একাধিক। ঘটনাসমূহের কালানুক্রমিক সূত্র ধরিয়ে দিয়ে একদিকে তিনি দলিল উপস্থাপন করছেন, অন্যদিকে বিচার-বিশ্লেষণের আশ্রয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছেন। তাছাড়া পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টমাত্রকেই তিনি সত্য বলে গ্রহণ করেননি, সন্দেহযুক্ত হলে সেগুলো যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে যাচাই করেছেন। গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ, উদার ও যৌক্তিক।

শেষে গ্রন্থটির একটি অপূর্ণতার কথা বলব। এ-ধরনের গবেষণায় নির্ঘণ্ট থাকা খুবই জরুরি। গবেষকের কাছে ভবিষ্যতে এ-প্রত্যাশা জানিয়ে রাখছি।