একটি মহান ধারার প্রতি শ্রদ্ধা

রোখসানা সাঈদা পপি
এক বিশালতার অনেক কাছে গিয়ে তাঁর সঙ্গে বসে মনের ভাব আদান-প্রদান করার এক অপূর্ব সুযোগ পেয়েছিলাম আমি। শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ এক দন্ডায়মান হিমালয়, শুধুই যে একজন শিল্পী তা নন, একটি অধ্যায়। অপূর্ব এক শিশুমন তাঁর সরলতা ও বিশালতাকে দখল করে ছিল। কেন জানি না, আমার পরিবারকে স্যার খুব পছন্দ করতেন। আমার ছেলেমেয়ে দুটোর সঙ্গে অনেক সময় বন্ধুর মতো মনের কথা অকপটে আদান-প্রদান করতেন। আমি শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ সম্বন্ধে আলোচনায় যাব না। এই মহান ব্যক্তিত্বের নিকটসান্নিধ্য নিয়ে দু-একটি কথা শুধুই ভাগাভাগি করে নিতে চাই। নানা ছুতোয় প্রায়ই স্যারের বাসায় যেতাম, কথা বলতাম; তিনিও জীবনের অনেক কথা বলতেন। একবার মনের অজান্তে বললেন, ‘জীবনে অনেক কিছুই পেয়েছি কিন্তু ভোগ করতে পারিনি।’ আবার বললেন, ‘নীরবে ছবি এঁকেছি, কখনো ওরকমভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে ইচ্ছা হতো না – এখন মনে হচ্ছে অনেক ভুল করেছি। অনেকভাবে নিজেকে দিয়ে যেতে পারতাম, কিছুই রেখে যেতে পারিনি।’ এই মহান মানুষটি নিজের মনের অজান্তে পৃথিবীকে অনেক কিছুই দিয়ে গেছেন – তিনি তা বুঝতেও পারেননি। আমি বললাম, ‘কী বলেন স্যার, আপনি একটি ধারার আধার – শিল্পজগতের অহংকার।’ ঘন ঘন প্রদর্শনী করেননি তো কী হয়েছে, একটি বিশাল জগৎ তৈরি করেছেন শুনে স্বভাবসুলভভাবে মুচকি হাসলেন। বলতেন, ‘এই হাসিমাখা মধুর স্মৃতিটি আজীবন বুকে লালন করে রাখব।’
আমি ছোটবেলা থেকে ডায়েরি লিখতাম। একবার মাথায় এলো, বই হিসেবে প্রকাশ করব। অনেক সাহস করে বেশকিছু কবিতা লিখে আমি আমার স্বামীকে নিয়ে স্যারের স্বামীবাগের বাসায় গেলাম। কবিতার পান্ডুলিপিটি স্যারের হাতে দিয়ে বললাম, একটি বুক কভারের জন্য স্যারের একটি ছবি ব্যবহার করতে চাই। অনেকদিন আগে ঈদের উপহার হিসেবে স্যার আমাদের কিছু পেন-স্কেচ উপহার দিয়েছিলেন। সেখান থেকে একটি পেন-স্কেচ নিয়ে প্রচ্ছদ করার অনুমতি চাইলাম। তিনি খুব খুশি হয়ে ভুবন-ভোলানো হাসি দিয়ে রাজি হয়ে গেলেন। স্যারের দোয়া নিয়ে চলে এলাম। যথারীতি বইটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পেল। প্রথম কপিটি নিয়েই স্যারকে দেখাতে গেলাম। তিনি খুবই খুশি হন, বললেন ‘তুমি এত ভালো লিখো জানলে আমি সামনাসামনি একটি ছবি এঁকে দিতাম।’ কেননা, আমার বইয়ের নারীমুখটি ছিল একদিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকা, যা আমার কবিতার বই ‘অকপটে বলা’ বইটির সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। প্রকাশনী উৎসব হলো। স্যার এসেছিলেন। আমি আমার ক্ষুদ্র পরিসরে ধন্য হলাম। পরে জানতে পারলাম আমিই একমাত্র ভাগ্যবান যে, এই মহান শিল্পীর অাঁকা ছবি দিয়ে বই প্রকাশ করছি, শত শত আশীর্বাদে পূর্ণ হলাম। লেখা প্রসঙ্গেই একবার কথা বললেন – ‘এখন তো সুযোগ হয়েছে, আগে আমরা বিভিন্ন মানুষের কাছে ঘুরে বেড়াতাম, বই প্রকাশকদের কাছেও। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও প্রকাশকদের মন পাওয়া যেত না।’

Shafiuddin Ahmed
Safiuddin Ahmed

একবার ক্যানভাসের সাইজ নিয়ে আলাপ শুরু করলাম। স্যার বললেন, ‘দুই ফুট বাই তিন ফুট সাইজটিই খুব সুন্দর।’ ছবিগুলোকে মনে হতো নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি আদর করতেন, ‘আজকাল ক্যানভাসকে পেরেক দিয়ে ফ্রেমের সঙ্গে আটকে দেয়’, কথাটি বলার সময় মনে হলো স্যার মনের গভীরে কোথাও ব্যথা পাচ্ছেন। আমি বললাম, ‘তাহলে ফ্রেমের গায়ে আটকে থাকবে কীভাবে?’ তিনি বললেন, ‘ফ্রেমের চারটি কর্নারে কেঁচির মতো আটটি কাঠের টুকরো ব্যবহার করলে আলতো করে চারপাশ দিয়ে ক্যানভাসটিকে আটকে ধরে রাখবে। ছবিটি তাহলে আঘাত পাবে না রঙের সঙ্গে ক্যানভাসের স্থায়িত্ব টিকে থাকবে।’ এই যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভালোবাসা ছবির জন্য, এর তুলনা নেই। প্রতিটি ছবিকেই তিনি অনেক ভালোবাসতেন।
স্যারের কাছে অনেক পুরনো একটি ছোট ঘড়ি ছিল, স্যারের খুব প্রিয়। এটি যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। কাকে দেবেন চিন্তা করছিলেন। কথায় কথায় আমার খুব লোভ হচ্ছিল যে সাহস করে বলি, শত লজ্জার পাহাড় এসে ভিড় জমাল। চাইতে পারলাম না।
এই মহান ব্যক্তিত্ব একটি শিল্পধারা, একটি এনসাইক্লোপিডিয়া, একটি ইনস্টিটিউশন। আমরা যেন সযতনে তাঁর সমস্ত শিল্পকর্ম সংগ্রহ করে রাখতে পারি এতটুকু আশা করে সুন্দর হাসিমাখা মুখটির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে চাই। 