একটি মেয়ে

আফসার আমেদ
\ ২০ \

বিছানায় বালিশের আড়ালে গুটিসুটি মেরে শুয়ে লুকিয়ে পড়েছে সেঁজুতি, হৃদয় তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। হৃদয়ের সঙ্গে সে লুকোচুরি খেলছে তার ফ্ল্যাটে। হৃদয় খুঁজছে তো খুঁজছে, খুঁজে খুঁজে সারা হচ্ছে। সে অথচ হৃদয়কে দেখতে পায়, হৃদয় তাকে দেখতে পায় না। বাথরুমে আরশোলারা ওড়াউড়ি করে। রান্নাঘরে মশলার কৌটোগুলো পড়ে যায়। তার মধ্যে কীভাবে যেন লুকিয়ে পড়ছে। হৃদয় যেন তার সঙ্গী-সাথি, বড়ো মেয়ে, তারই খানিকটা কাছাকাছি বয়সী, এমনটা মনে হয়। আর
হৃদয় যেন শাড়ি পরেছে। ঠিক যেন সরস্বতী পুজোর দিন বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছে। চুল এলো করা। তরতাজা সাজগোজ নিয়ে তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। এমনটা সে গ্রামে খেলত। গ্রামে কত লুকোবার জায়গা। গোয়ালঘর, ধানঘর, বসার ঘর, শোবার ঘর, অ্যাঁদাল-ক্যাঁদালের আড়াল, শানবাঁধানো ঘাটেও অদ্ভুত আড়াল। তক্তপোশের নিচে, বাক্স-প্যাঁটরার গায়ে, মই ঠেকিয়ে মাঠগুদমেও লুকিয়ে পড়া যায়। যেন সে গ্রামেই আছে। হৃদয় তাকে খুঁজে চলেছে।
দরজার শব্দ।
ঘুম ভেঙে যায় সেঁজুতির। এবার বুঝতে পারে, ঘুমের ভেতর সে হৃদয়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিল। কেউ এসেছে। সকাল এখন আটটা। কড়া নেড়ে কেউ তার ঘুম ভাঙিয়েছে।
ঘুমচোখে উঠে গিয়ে দরজা খোলে সেঁজুতি।
সুচরিতা বউদির মুখ। ‘কি, যাবে তো?’
‘সেঁজুতি ধরতে পারে না, বলে, ‘কোথায়’?’
‘ও মা, তোমার সঙ্গে রাতেই কথা হলো যে?’
‘ও হ্যাঁ, রবিদাকে নার্সিংহোম থেকে নিয়ে আসতে?’
‘হ্যাঁ, তুমি তো রাজি হলে।’
‘আমি পারব না বউদি, আমি আরো একটু ঘুমোব।’
‘এতো সকাল হলো, আরো ঘুমোবে?’
‘প্লিজ বউদি প্লিজ।’
‘তুমি গেলে -’
‘আমি তো আছিই।’
অসন্তুষ্ট হয়েই ফিরে গেলেন সুচরিতা বউদি। তাদের এই অসন্তোষ সম্পর্কের ভেতর সেঁজুতিকে সুচরিতা বউদি কাছে পেতে চায়। তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার তারাই মিটিয়ে নিক না। ঘুম তার ভেঙেই গিয়েছিল। আর ঘুমোবে না। যাওয়াতে তার অনিচ্ছা। এসব ব্যাপারে নিজেকে জড়াতে পছন্দ করছে না। এড়িয়েই গেল। মনে একটু শান্তি এলো। যাক গে, ওরা ওদের মতো করে বাঁচুন। বরং স্বপ্নের ভেতর হৃদয়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার অবান্তরতা তার বেঁচে থাকায় অনেক কাজ দেয়। এই যেমন সেই স্বপ্নের ভাবনায় আছে। তাতে মনটা মজে আছে। গ্রামের কত কী কথা তার ভাবতে ভালো লাগছে। বিশেষত শৈশবের কথা। বাবা-মা-দাদা, পিসি, মামা, জ্যাঠা কত মানুষ। এই ভাবনা এলে স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে তার মন। একরকম শ্বাস-প্রশ্বাসে আরাম তৈরি হয়। রবিদা, সুচরিতা বউদি বড়ো জটিল মানুষ, তাদের জীবনও জটিল।
তাদের বিরোধের উত্তেজনায় সে থাকবে না। কিন্তু হৃদয়কে তো বাঁচাতে হবে। তেমন সংকট এলে হৃদয়কে তো বাঁচাবেই। হৃদয় আর তার অস্তিত্ব যেন এখানে সমার্থক।
দাঁতে ব্রাশ করে। রান্নাঘরে গিয়ে কী রাঁধবে, তার আয়োজন দেখে। আলু আছে, ডিমও আছে। সবজি কিছুই নেই। ডিম-আলু ভাতে দেবে, একটু ডাল করে নেবে। এতেই চলে যাবে বেশ। রাতে বাজারের দোকান থেকে তড়কা রুটি আনবে। আজও কোথাও বেরোবে না। সহসা ফুটপাথের শিশুদের মুখগুলো তার মনে ভিড় করল। ওদের কদিন না দেখার বেদনা জমছে। হয়তো কালই সময় করে নিতে পারবে। কাটবে তাদের সঙ্গে। তাদের কথায় খাতা ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। সেই কাজই তো এই কদিন করছে সে। কারো সঙ্গে দেখা করা নেই, আড্ডা নেই।
গ্যাস জ্বালিয়ে চায়ের জল বসাল। তারপর চানাচুরের কৌটোটা বের করল। তাতে আঙুল ডোবাল। ডান তর্জনীটা। মুখে পুরে স্বাদ নিল। অদ্ভুত এক নুন-নুন স্বাদ। শৈশবের কোনো এক স্বাদের সঙ্গে এর মিল আছে। হাতড়ালো, খুঁজে পেল না। তখন গান কণ্ঠে নেওয়া ছাড়া আর কিছু উপায় থাকল না। একটু পরেই ঘর ঝাড় দেবে, বিছানা ঝাড়বে। খাতা, ডায়েরি, কলম, পেনসিল বিছানায় ছড়িয়ে- ছিটিয়ে পড়ে আছে। একটা কম্পিউটারের খুব প্রয়োজন। আগামী মাসেই ইনস্টলমেন্টে কিনবে। পাড়ার দোকানদারের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। তখন কাজ অনেকটা সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছে দিতে পারবে। কম্পিউটার টেবিল কিনতে হবে। স্কুল সার্ভিস কমিশনে পরীক্ষাও তো দিলো। যদি পাশ করে! এখন প্রোজেক্ট নিয়ে মশগুল। ওসব কথা ভাববে না। যাবে না মেমারিতেও। কোথাও যাওয়ার তার জায়গাও নেই। এই নিরুদ্দেশ আত্মগোপন সে স্বেচ্ছায় তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে।
দরজায় আবার কড়া নাড়াচ্ছে কেউ। আবার সুচরিতা বউদি জ্বালাতে এলেন নির্ঘাৎ। সে যেতে পারবে না। এই ঘ্যানঘ্যানানি তার পছন্দ নয়। চা ছাঁকার সময় হয়ে গেছে। তা না করে কড়া নাড়ার সময় জুড়ে চুপ করে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থাকল সেঁজুতি। সে যেন হাতের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, কড়া নাড়াচ্ছে যে, তাকে বোঝাল। তারপর কিছুটা সময় ব্যয় করে দাঁড়াল সে দরজার কাছে। ছিটকিনিতে হাত দেয়। খুলে দেয় দরজা।
সামনে দাঁড়িয়ে আছে আলম, মাথা নিচু করে, অপরাধীর মতো।
‘তুই এসেছিস কেন? ঘরে ঢুকবি না।’
‘দিদি।’
‘আমাকে তুই কি পেয়েছিস? তোর মুখদর্শন করতে আমার ঘেন্না করে।’
মাথা নিচু করে আলম দরজার চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু বলে না। ভেতরে ঢোকার অনুমতি পায়নি। কিছুক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর প্যান্টের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেয়। একটা মোবাইল বের করে। ‘আপ ছোড়কে আয়া’।
চমকে ওঠে সেঁজুতি। মোবাইলটা তার ঘরে কোথাও লুকিয়ে থাকেনি, আলমদের ঘরেই ফেলে এসেছিল? আলম সেটা দিতে এসেছে। তাহলেও আলমের ওপর রাগ তার যাচ্ছে না। সে অপরাধী, ঘোরতর অপরাধী। বলে, ‘আয় ভেতরে এসে বোস, বেশিক্ষণ থাকা চলবে না, এখুনি চলে যাবি।’
আলম ঘরের মধ্যে ঢুকতেই ছোঁ মেরে মোবালইটা নিয়ে নেয়। তারপর নীরবে মোবাইলটা একটু ওলটে-পালটে দেখে বিছানায় ছুড়ে দেয়। চা ছাঁকতে চলে যায় রান্নাঘরে। অনেকটাই চা করেছিল, আলমেরও হয়ে যেত; কিন্তু আলমকে সে চা দেবে না ঠিক করল। একটা বড়ো কাপে সবটা চা ঢেলে নিয়ে ফিরে এলো। আর বিছানায় বসে পা দোলাতে দোলাতে চা খেতে লাগল। ভাঙা চেয়ারটায় আলম নীরবে বসে আছে।
‘কী দরকার ছিল, মোবাইলটা থাকত না-হয় ওখানে। আর কক্ষনো কোনোদিন আমার কাছে আসবি না।’
‘দিদি, হামার কসুর কি আপনার কাছে?’
‘একদম চুপ করে থাকবি, একটাও কথা বলবি না। তোর শুধু শোনার কথা, বলার কথা নয়। যা বলার আমি বলব।’
আবার মাথা নিচু করে আলম।
তারিয়ে-তারিয়ে চা খায় সেঁজুতি, আর ক্রুদ্ধ দৃষ্টি বুলিয়ে দেখতে থাকে আলমকে। আলমের প্রতি রাগ তার পড়ছে না। ‘কী হলো, দেওয়া তো হয়ে গেল, এবার যাচ্ছিস না কেন?’
‘না, তোমার যদি আরো কথা থাকে?’
‘মানে, আর কী কথা তোকে বলব? চা খাওয়া হয়ে যায় সেঁজুতির।
‘না, কোনো উপকারে যদি লাগি!’
‘তোর কোনো উপকার আমার দরকার নেই। চা খাবি তো? চা খেয়ে যা।’ কথাটা বলে রান্নাঘরে ছুটে যায় সেঁজুতি। আবার চায়ের জল বসায়। ঘরে ফিরে এসে আলমকে আর দেখতে পায় না। চলে গেল নাকি? বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে বেরোবার পথে দাঁড়িয়ে আছে আলম। আর তখন প্রবল ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। ‘এখানে কেন, আয় ঘরে আয়, চা খাবি।’
আলমের ম্লান মুখ।
‘এই বৃষ্টিতে যাবি কী করে? বৃষ্টি থামলে যাবি।’
ফিরে আসে আলম সেই চেয়ারে।
তাকে জল দেয় সেঁজুতি। ‘খাবি কিছু?’
‘খেয়ে এসেছি।’
‘রাগও তো আছে দেখছি।’
আলম কিছু বলে না।
‘বাবা-মা কেমন আছেন?’
‘ভালো।’
‘বোন?’
‘ঠিকই আছে।’
‘তোর ব্যথা-বেদনা সেরেছে?’
‘দর্দ?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওসব চলা গয়া।’
‘বমি করিসনি তো?’
‘না।’
‘এক্স-রে করেছিলি।’
‘হ্যাঁ। কুছু ভাঙেনি।’
‘বেশ।’
চা ছেঁকে এনে দেয় আলমকে। বিস্কুট দেয়। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। নিজেকে দেখে, বুঝতে চায় নিজেকে সেঁজুতি। একটু তার রাগ পড়ে আলমের ওপর থেকে। আলমের চা খাওয়া দেখে। আলম তাকে এতো আনুগত্য দেখাচ্ছে, একে নিয়ে করবে কী সে? একে পরিত্যাগ করতে পারলে বাঁচে যেন। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে এর প্রতি সহসা স্নেহ তাকে বশীভূত করছে। ছেলেটার কত কম বয়স! এমন দেবদূতের মতো ছেলেটা কি পকেটমার হতে পারে? মনে হয় ঈশ্বরের কোথাও কোনোখানে কিছু ভুল হয়েছে। একেই তো বাঁচিয়েছে সে। যত একে নিয়ে ভাবে, ততো এর প্রতি স্নেহপরবশ হয়ে পড়তে থাকে। একটু আগে তাড়াচ্ছিল, এখন তা করছে না। চা খেতে দিয়ে তার চা খাওয়ার ভেতর তাকে দেখছে।
এসব কথায়, এসব ভাবনায় কেমন ঘুম-ঘুম ধরে সেঁজুতির। দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে যেতে পারে। কোনো সংকট তখন তার থাকে না। আলম এসেছে, ভালো হয়েছে, বেশ ভলো হয়েছে। ‘কী রে, বৃষ্টি থামল, এখনই চলে যাবি নাকি?’
‘হ্যাঁ চলে যাব।’
‘চলে যাবি?’
‘তোমার কী কাজ আছে বলো না।’
‘কাজ আবার কী?’
‘কুনু কাজ নেই?’
মনে পড়ে সেঁজুতির। ‘তক্তপোশটা একটু ঘুরিয়ে দিবি? রোজ একভাবে শুতে ভালো লাগে না? তুই বল না, ভালো লাগবার কথা কি?’
আলম বলল, ‘হ্যাঁ, তাই তো, এখুনি করে দিচ্ছি।’
‘কতদিনের সাধ, লোক নেই বলে করতে পারি না।’
‘আমাকে আগে বলবে তো।’
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আলম ঝাঁপিয়ে পড়ল তক্তপোশে। একাই টানাটানি করে তক্তপোশটাকে ঘুরিয়ে দিলো। তক্তপোশটার বারান্দার দিকটা অনেকটা বেড়ে গেল। বেশ, বারান্দার দিকে মাথা করে শোবে।
তক্তপোশটা সরে যেতে, তার নিচের অনেক জিনিসপত্র বেরিয়ে এলো। একটা টেবিল ফ্যান আর একটা ইমারজেন্সি লাইটের বাক্স। টেবিল ফ্যানটা মৌরি সেনের কাছ থেকে কিনেছিল। সেকেন্ড হ্যান্ড। ওটা বাবার লাগবে বলে। বাবাকে পাঠানোই হয়নি। সে একা মেয়ে, কীভাবে নিয়ে যাবে মেমারিতে? ইমারজেন্সি লাইটটা কিনেছিল মা- বাবার জন্য। গ্রামে প্রায়শই লোডশেডিং হয়, মা-বাবার খুব অসুবিধে। কতদিন কিনে ফেলে রেখেছে। দাদাও সময় করে নিয়ে যায়নি। অথচ বাবা-মায়ের ঘরে পাখা নেই। সেই অসুবিধার কথা ভেবেই তো মৌরি সেনের কাছ থেকে ফ্যানটা কিনে নিয়েছিল। এখন তক্তপোশ সরাতেই সেসব বেরিয়ে এসেছে, সব মনে পড়েছে। আলমকে যদি বলে?
‘কী রে আলম, তোকে ঠিকানা দিলে কোথাও যেতে পারবি?’
‘কোথায়?’
‘গ্রামে।’
‘বর্ধমানে।’
‘বর্ধমানের কোথায়?’
‘মেমারিতে।’
‘আমি চিনি।’
‘পাখা আর লাইটটা নিয়ে যেতে পারবি?’
‘খুব।’ এগিয়ে গিয়ে পাখা-লাইটটা নিয়ে টানাটানি করে।
‘এখুনি যাবি নাকি?’
‘কথাটা বললে এখনই করতে হবে। কাজ ফেলে রাখতে নেই। পরশু থেকে আমি কারখানায় যাব। মালিকের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে।’
‘মালিকের সঙ্গে?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওয়েল্ডিংয়ের সেই কারখানা? কোথায় যেন?’
‘বাগবাজার।’
‘ভালো খবর। তার মানে মেমারিতে আজ গেলে তোর সুবিধে হবে?’
‘হ্যাঁ, আর তো সময় পাব না।’
‘এখনই নয়, রান্না চড়াচ্ছি, খেয়ে যাবি।’
‘না।’
‘কী পাগলামি করছিস?’
‘আমি খেয়েছি, এখনই যাব।’
‘তাহলে তোকে যেতে হবে না।’
‘ঠিকানা লিখে দাও।’
‘না না।’
‘আমার টাকা আছে, রাস্তায় খেয়ে নেব।’
‘ফের জেদ করছিস আলম? জেদ ভালো নয়।’
‘আমাকে তো আবার ফিরতে হবে।’
‘আমার মা-বাবার কাছে একটা রাত থাকতে পারবি না?’
‘দেরি করাচ্ছ কেন?’
‘ভাবছি।’
‘কী ভাবছ?’
‘মা-বাবার জন্য মন কেমন করছে, আমিও যদি যেতাম।’
‘চলো। তাহলে রান্না করো।’
হেসে ফেলে সেঁজুতি। ‘ভাবছি, যাব কি-না?’
‘তোমার যেতে মন করছে।’
‘তুই কিন্তু স্নান করে নিবি আমার এখানে। দেখে মনে হচ্ছে তোর আজ স্নান হয়নি।’
‘পানি চলে গেল, গোসল হয়নি।’
‘অসুবিধে নেই, এখানেই করে নিবি। ডিমের ঝোল খেতে তোর অসুবিধে হবে?’
‘ভালো খাবার।’
‘দে তো, একবার পাখাটা পরিষ্কার করে দে তো!’
কাজে লেগে পড়ে আলম।
সেঁজুতির মনটা কেমন প্রসন্ন হয়ে ওঠে। মেমারিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভেতর সে আনন্দিত হচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত আগেও এ-সিদ্ধান্তের কথা ভাবতেই পারছিল না। না যাওয়ার ভেতরই অটল ছিল। আলম যাচ্ছে, আলমের সঙ্গে যাওয়ার ভেতর দিয়ে এক ইচ্ছাযাত্রা সে পেয়েছে। একা হলে কিছুতেই সে যেত না। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মজে থাকা আবেগ তাকে অশ্রুসিক্ত করছে। মা-বাবার জন্য হু-হু করে উঠছে মনটা। কতদিন যায়নি। মা-বাবার প্রতি কতোই নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে সে। এমনটা কি তার করা উচিত হয়েছিল? কেন এমনটা করে গেল? ভেবে পায় না সেঁজুতি। সে কি এতোই নিষ্ঠুর? নিজেকে অভিযুক্ত করে যায় যত, ততই মা-বাবার মুখটা তার মনে ভেসে ওঠে। তাদের প্রতি কত অবিচার করে গেছে। লড়াইয়ে সে তো ব্যর্থ হয়ে যায়নি। কিছু তো সে সফলতা পেয়েছে। তমোঘ্ন হারিয়ে গেল শুধু। তাছাড়া তো আর সব ঠিকমতো চলছে। যতদিন যাবে, বন্ধুরা ততো দিনে দিনে হারিয়ে যাবে। স্কুলের বন্ধুদের কি আজ সে পায়? না কলেজের? কোথায় তারা? নেই কাছে। ওরাও ওদের মতো করে আছে।
রান্না চড়ায় সেঁজুতি।
রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে আলমের উদ্দেশে বলল, ‘তুই মোবাইলটা নিয়ে নে। আমি আরেকটা কিনব। তোর তো খোয়া গেছে মোবাইল।’
পাখা পরিষ্কার করতে করতে পাশ ফিরে তাকাল আলম, ‘আমার আছে। আমার এক বন্ধু কিনে দিয়েছে।’
‘কী রে, তুই আমারটা নিবি না?’
‘থাক, তোমার আরেকটা থাক।’
সেঁজুতি ঘর জুড়ে ঘোরে। পদচারণা করে। কী যে আজ তার ভালো লাগছে! আজ মেমারির শিতলাতলায় যাবে। ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে। আনন্দটা ভেতরেই বেশি থাকছে, বাইরে প্রকাশ করতে পারছে না।
‘তাহলে তোকে ঠিকানাটা লিখে দিতে হচ্ছে না।’
আলম কিছু বলে না।
‘আমিই তোকে নিয়ে যাব। তুইও যেতে চেয়েছিলি?’
‘হ্যাঁ।’
‘দেখবি, ভালো লাগবে। স্কুল, হাসপাতাল, খেলার মাঠ, পুজোর মাঠ, স্টেশন দোকানপশারি – রিকশা চড়েই যাব। তুই শুধু সঙ্গে থাকবি, তোকে আমি নিয়ে যাব।’
‘আমি গ্রামে যাইনি।’
‘আমাদের পুকুর আছে। সাঁতার জানিস?’
‘না।’
‘আমি জানি। কত চেনাজানা মানুষ, সকলের সঙ্গে দেখা হবে।’
‘তুমি কতদিন যাওনি?’
‘অনেকদিন।’
‘তোমার ওখানে কে কে আছে?’
‘মা-বাবা, দাদা, দাদার বউ আর তাদের একটা পুচকে।’
আলম মনোযোগ দিয়ে পাখা পরিষ্কার করে।
‘কী রে, তোর হলো? যা যা স্নানে যা। আমার রান্না তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। তুই ঢোক। আমি ঢুকলে বেরোতে দেরি হবে।’ লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে আবার চলে যায় রান্নাঘরে সেঁজুতি। রান্নার কাজ দ্রুত সারতে থাকে। অবশিষ্ট চায়ের লিকারটা একটু গরম করে নেয়। মাঝে মাঝে চুমুক দেয়। সকালে দুবার চা না খেলে তার হয় না। রান্নাঘর থেকে হাঁকে সেঁজুতি, ‘কী রে, তোর হলো?’
‘যাচ্ছি দিদি, আর একটু।’
‘বেরোতে দেরি হয়ে যাবে যে।’
‘এই তো সবে সাড়ে বারোটা।’
‘তাহলে দেরি হয়নি, কিন্তু তুই দেরি করিস না।’
সুচরিতা বউদিকে কী বলবে? হয়তো বলবে, যাওয়ার সময়। রবিদার সঙ্গেও হয়তো দেখা হবে তার। ইতিমধ্যে রবিদাকে নার্সিং হোম থেকে ফিরিয়ে এনেছে সুচরিতা বউদি। যাওয়ার সময় দেখে যাবে। ফেরাটা টের পায়নি। নিঃশব্দে ফিরল হয়তো। ওরা ভালো থাকুক, আবার আগের মতো জীবনযাপন করুক। রবিদাটা বড়ো একা হয়ে পড়েছিল।
আবার চেঁচায় সেঁজুতি, ‘আলম তোমার হলো?’
‘হয়েছে।’
এরকম চেঁচাতে ভালো আগে সেঁজুতির।
আলম বাথরুমের দরজা খুলল, তার শব্দ পেল সেঁজুতি। চেঁচিয়ে উঠল, ‘ভেতরে সাবান-গামছা আছে। শ্যাম্পুও পাবে। আমার রান্না হয়ে এলো বলে? তোর নিশ্চয় খুব খিদে পেয়েছে?’
‘না, দিদি না।’
‘তবে চটপট নে। ঢোক।’
মনে মনে গান এলো, গুনগুনিয়ে উঠল। ‘গায়ে আমার পুলক লাগে…’ খুব ধীরে ধীরে গায়। বাথরুমে জল পড়ার শব্দ। বাইরে এখন বৃষ্টি হচ্ছে না। কিন্তু মেঘ করছে। হয়তো বিকেলে বৃষ্টি হবে। না হলে সন্ধ্যায়। রাতে বৃষ্টি হলে আরো ভালো হয়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনবে, মেমারিতে, তার গ্রামে, শীতলতলায়। রান্না শেষ।
ঘরে ফিরে এসে বাইরে দরজাটা খুলে ধরে। অমনি সুচরিতা বউদির মুখোমুখি। সুচরিতা বউদি এখনই তার কাছে এসেছে। সুচরিতা বউদির হাসিমুখ। ‘তুমি তো এলে না, তোমার দাদা তো এসেছে।’
‘এই তো একটু পরেই যাব। আজ তো আমি মেমারিতে যাচ্ছি।’
‘ওমা তাই, আগে তো জানাওনি?’
‘এই তো একটু আগে ঠিক হলো।’
‘তোমার বাথরুমে শব্দ হচ্ছে, কেউ কি এসেছে?’
‘হ্যাঁ ওরই সঙ্গে তো যাব।’
‘তোমার প্রেমিক?’
‘না না, ও আমার ভাই, আলম?’
‘তুমি কি মুসলমান।’
‘আরে কী বলছেন, কোনো মুসলমান আমার ভাই হতে পারে না?’
‘জানি না বাপু। তুমি কিন্তু এসো।’
‘যাওয়ার সময় দেখা করে যাব।’
‘তোমার কথা খুব বলছে।’
‘ও তাই?’ এক গাল হাসে সেঁজুতি। এই হাসিমুখ ধরে রাখা এখন তার পক্ষে খুবই সংগত ও সুখদায়ক। চমৎকার মনে ভরে রাখে সেই আনন্দ, অনুভূতি, ভালোলাগার প্রবণতা? সে কি খুব খারাপ আছে? জানে না।  (চলবে)