একটি মেয়ে

আফসার আমেদ

॥ ২৬ ॥

ফ্ল্যাটের গেটে ঢোকার মুখে সেঁজুতির দেখা রবি ব্যানার্জির সঙ্গে।
রবি ব্যানার্জি থমকে দাঁড়ায়। ‘কী ব্যাপার, তুমি এতদিন পরে, কোথায় ছিলে?’
‘এই কলকাতার বাইরে কিছুদিন কাটিয়ে এলাম।’
‘এখনই ফিরছ?’
‘এখনই, হাওড়া স্টেশন থেকে ট্যাক্সি ধরে এই নামলাম। – তো বউদি, হৃদয় আছে তো?’
‘না, ওরা তো নেই। আমার সঙ্গে আর থাকতে পারল না।’
‘তার মানে -’
‘তেমনই একা।’
‘নিজেকে একা ভাববেন না।’
‘তোমাকে খুব মিস করছিলাম এই কদিন। কেউ কেউ তোমার খোঁজ নিতে এসেছিল। ও হ্যাঁ, তোমাদের বন্ধুদের কেউ যেন রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল।’
‘কে?’ আতঙ্কিত হয় সেঁজুতি।
‘নাম বলতে পারব না, তবে দুজনের একজন মারা যায়, অন্যজন হাসপাতালে, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।’
‘কী যা-তা বলছেন!’
‘শুনলাম তো তেমন খবর। তোমাকে খবর দিতে কে যেন এসেছিল, তোমাকে মোবাইলে পাচ্ছিল না।’
‘আমি তো সিম বদলেছি।’
‘বন্ধুদের তো জানাওনি।’
‘কাউকেই না। কে মারা গেছে বলতে পারবেন?’
‘না।’
বিষণœ হয়ে ওঠে সেঁজুতি সহসা। রবি ব্যানার্জিকে ফেলে এগিয়ে যায় ফ্ল্যাটের দিকে। কে মারা গেল? তাদের কোন বন্ধু? অন্য বন্ধু আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে? অস্থির ও দ্বিধাবিড়ম্বিত পায়ে ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এগোয়। দরজা খোলে। ঝাপসা একটা গন্ধ পায় ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে। যেন মনে হয় মৃত্যুকূপ। তার কোনো বন্ধুর মৃত্যু হয়েছে, ওই মাত্র øায়ুতে ঢুকে গেছে, অতএব সে ভয়চকিত হয়ে উঠেছে। পা তার সরছে না। মেঝেয় ব্যাগ রাখে। ফ্যান চালায়; কিন্তু ধুলোর কণা ঘরের বাতাসে।
বন্ধুদের নম্বর এখন আর তার মোবাইলে নেই। স্বেচ্ছায় অদৃশ্য করতেই চেয়েছিল; কিন্তু এখন তার সংকটদশা। একজনেরও নম্বর তার চাই। পোশাক না খুলে সে ডায়েরি খোঁজে। র‌্যাকে খোঁজে, বিছানা-বালিশের তলায় খোঁজে। বন্ধুদের মোবাইল নম্বর হারিয়ে ফেলা তো দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ। নিজের অযোগ্যতার আর কত প্রমাণ দেবে সে। ডায়েরিটা পায় না। কাঁদতে ইচ্ছে করে। একসময় ডায়েরিটা পায়। নিকট-বন্ধুদের কারোরই মোবাইল নম্বর তার টোকা নেই। একমাত্র দূরের বন্ধু সান্ধ্যর নম্বরটা টোকা আছে। সে নিশ্চয় খবর জানবে। জ্বলজ্বল করছে নম্বরটা। এখনই ফোন করে জানলে বন্ধুটি মৃত হয়ে উঠবে। তাতে তার ভয়। ঘরের মধ্যে ঘামতে লাগল। অস্থির হয়ে উঠতে লাগল। পোশাক না ছেড়েই বাথরুমে যায়। চোখেমুখে জল ছেটায়। ট্রেন জার্নিতে ঘুম হয়নি। রিজার্ভেশন ছিল না, খুবই খারাপ দশায় নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ট্রেন ধরেছে।
আবার ঘরে ফিরে আসে সেঁজুতি। বারান্দার দিকের জানালা খুলে দেয়। ঘরে আলো জ্বালে। পাখাটাকে জোরে করে দেয়।
‘হ্যালো সান্ধ্য?’
‘কে?’
‘তুই কোথায় রে সান্ধ্য, আমি সেঁজুতি বলছি।’
‘কোথায় ছিলি এতদিন? মোবাইলের সুইচ অফ?’
‘কলকাতার বাইরে। কার কী হয়েছে?’
‘তুই কিছুই জানিস না?’
‘কী হয়েছে আগে বল।’
‘প্রহরদা হাসপাতালে। একটা পা বাদ দিতে হলো। হেড ইনজুরিটা অল্প, তাই বেঁচে গেল।’
‘মারা গেল কে?’
‘কে আবার, নীরজা।’
‘মানে? কী বলছিস কী, এ হতে পারে না।’
‘স্পট ডেথ।’
‘অসম্ভব।’
‘সব হয় রে। তুই আয় প্রহরদাকে দেখে যা। আমরা সব হাসপাতালে আছি।’
‘এসব আমি মানতে পারছি না।’
‘প্রহরদা আমরিতে ভরতি আছে, চারতলায়। গতকাল অপারেশন হয়েছে। জ্ঞান আছে, কথা বলা বারণ। সবাই এসেছিল, তুই শুধু আসিসনি।’
‘আমি যাব না। প্রহরকে ওভাবে দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কেন এমনটা হলো?’
‘এটা অ্যাকসিডেন্ট। একটা ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওদের বাইকে ধাক্কা মারে।’
‘পরম কেথায়?’
‘আমার সঙ্গেই, হাসপাতালে।’
‘নীরজা মারা যাবে কেন?’
‘আবার পাগলামি শুরু করেছিস।’
‘আমি হাসপাতালে যেতে পারব না, বুঝলি?’
‘না, বুঝিনি।’
‘আমি খুব অসুস্থ।’
‘রাখ, আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ছি।’
সান্ধ্য ফোনটা কেটে দেয়।
সেঁজুতি নিঃসাড় হয়ে পড়ে থাকে বিছানায়। নিজেই নিজের হৃদস্পন্দন শোনে, গোনে। তার হতভম্ব দশা কাটছে না। প্রহর মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে? সে কেন কলকাতার বাইরে থাকল? নীরজার ওপর সে অভিমান করেছিল। অভিমান করে বন্ধুদের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। সেই নীরজা এখন আর নেই? এই বাস্তবটা মেনে নিতে পারছে না সে। কেন মেমারি গেল সে, কেন ঝালং গেল? তার এই পরিভ্রমণ তো বৃথা পণ্ডশ্রম হয়েছে। তমোঘœ হারিয়ে গেছে, ফুরিয়ে গেছে। যারা ছিল, তাদের অবহেলা করেছে। সে একজন অপরাধী।
অতএব বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগল সেঁজুতি।
দরজায় ঠকঠক।
হয়তো রবি ব্যানার্জি এসেছে।
সেঁজুতি কান্নার শব্দ তোলে।
‘কী হলো, কে মারা গেল?’ রবি ব্যানার্জিই।
ঘরে ঢুকে এসেছে রবি ব্যানার্জি।
‘আসুন।’ উঠে বসে সেঁজুতি। দুই করতলে মুখ লুকিয়ে ফেলে।
‘আরে কাঁদলে হবে! কে মারা গেছে।’
সেঁজুতি করতল সরায়। ‘আমাদের বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু। নীরজা মারা গেল। প্রহরের প্রেমিকা। প্রহরের একটা পা কাটা গেছে। গতকালই অপারেশন হয়েছে। কিন্তু আমি হাসপাতালে যাব না। আমি এসব নিতে পারব না।’
রবি ব্যানার্জি সেঁজুতির মাথায় হাত রাখে। ‘ঠিক আছে, তুমি না হয় যাবে। কান্নাকাটি বন্ধ করো।’
‘আমি কি ইচ্ছে করে কাঁদছি!’
‘কতদূর থেকে তুমি এলে? নিশ্চয় অনেক জার্নি করে।’
‘হ্যাঁ জলঢাকা থেকে। গতকাল সকালে রওনা দিয়েছিলাম।’
‘তাহলে তো ক্লান্ত। খেয়েছ কিছু?’
‘এসব শুনে কেউ খেতে পারে?’
‘খাবে কী, বাজার তো করোনি। – আমার কাজের মেয়ে একগাদা রান্না করে ফ্রিজে রেখে গেছে, মাসশাশুড়ির শরীর খারাপ, আমতলা গেছে। চলো আগে কফি খেয়ে নাও, গরম করলেই খেতে পারবে।’
সেঁজুতি কোনো কথা বলল না।
‘কী হলো।’
একটু শান্ত হয়েছে সেঁজুতি। রবিদাকে এখন তার আশ্রয় মনে হলো। নীরজার মৃত্যু আর প্রহরের অ্যাকসিডেন্টের খবরের আঘাতে সে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল। অদ্ভুত একা ও অসহায় লাগছিল তার। রবিদা এসে দাঁড়াতে একটু সাহস পায়। চারপাশের অনিশ্চতার ভয় তাকে ঘিরে ধরেছিল। যেন তার পায়ের তলায় মাটি সরে গেছে। মেমারি নেই, ঝালং নেই। মা বাবা দাদা বউদি নেই, নেই তমোঘœও। নেই প্রহর নীরজা পরসরা। প্রহর তার কত ভালো বন্ধু, সে বাঁচবে তো? বাঁচলেও কীভাবে বাঁচবে? নীরজা নেই? নীরজা ছাড়া প্রহরের কী হবে?
‘আমি কফি বানাচ্ছি, তুমি চলে এসো চটপট।’
‘না যাবেন না, আমাকে একা রেকে যাবেন না। আমিও আপনার সঙ্গে যাচ্ছি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।’ বিছানা থেকে নামে সেঁজুতি।
‘পোশাক বদলাবে না?’
‘পরে।’ থরথর করে কাঁপে সেঁজুতি।
রবি তাকে ধমকায়, ‘কী, করছ কী। যে বেঁচে আছে, তাকে বাঁচাও।’
‘হ্যাঁ, প্রহরকে বাঁচানো খুব জরুরি।’
‘তুমিও কি প্রহরকে ভালোবাসো?’
‘তা তো জানি না। এসব কথা আসছে কেন?’
‘তাহলে তোমার দায়িত্ব আরো বাড়ত।’
‘আমাকে আপনি ধরে ধরে নিয়ে যাবেন?’
‘না, তুমি একা একা যাবে। তোমার কিছুই হয়নি। বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়।’
‘আমাকে যে খুব একা লাগছে যে!’
‘একা কেন, তোমার অন্য বন্ধুরা সব আছে।’
‘এখন এখানে নেই।’
‘আমি তো আছি।’
‘হ্যাঁ আপনি আছেন।’
‘আমি কি তোমার বন্ধু নই?’
‘হ্যাঁ বন্ধুই তো, প্রয়োজনীয় বন্ধু।’
‘এখন সকাল দশটা, øানটা আমার ওখানেই করো।’
‘আমার øান নেই, খাওয়া-দাওয়া নেই, কিছু নেই।’
‘চলো।’
ঘরে তালা দিয়ে রবি ব্যানার্জির পিছু পিছু যেতে থাকে সেঁজুতি। রবি ব্যানার্জি সিঁড়ি ধরে উঠে যাচ্ছে, পিছু পিছু চলেছে সেঁজুতি। খুব ভালো লাগল রবিকে। রবি মানুষ হিসেবে মন্দ নয়। একজন সজ্জন ব্যক্তি। দরজার সামনে গিয়ে বলল, ‘রবিদা, আমার কী হবে?’
‘কী চাইছ তুমি?’
‘আমি খুব বিপদে আছি।’
‘বিপদ কিছুই নয়।’
সোফায় বসিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে যায় রবি ব্যানার্জি।
বনবন করে পাখা চলছিল।
চোখ বোজে সেঁজুতি। তার পরেই চমকে ওঠে। ‘কোথায় রবিদা।’
রবি ব্যানার্জি রান্নাঘর থেকে বলল, ‘চুপ করে বসে থাকো।’
সেঁজুতি চুপ করে বসে থেকেও চুপ করে বসে থাকতে পারছে না। চোখ বুজেছে। সোফার গায়ে এলিয়ে দিয়েছে শরীর। কিন্তু শরীরের চেয়ে মন বড়ো অস্থির। পাগলদশা তার। কিছুতেই তিষ্টোতে পারছে না।
রবি কফি আনল, ‘খাও।’
সেঁজুতি কফির কাপ হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘কী হবে?’
রবি ধমকে বলল, ‘খাও।’
সেঁজুতি খেতে শুরু করে দিলো। স্বাদ পেল। একটা আরাম দশার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।
রবি বলল, ‘কেমন লাগছে?’
‘বেশ।’
‘ভাত খেয়ে নিলে আরো ভালো লাগবে।’
‘আমার খুব খিদে।’
‘খাবার তো আছে, খাও। আমি গরম করে দিচ্ছি। তুমি প্রয়োজনমতো নিয়ে নেবে।’
‘কী মাছ আছে।’
‘অন্যরকম।’
‘কী মাছ?’
‘অদ্ভুত মাছ। আড় মাছ।’
‘তাই?’
‘গরম করছি। তুমি কফিটা আগে খাও।’
‘তারপর?’
‘তারপর ঘুমোবে।’
‘ঘুমোবো।’
‘ঘুমোবে।’
‘তারপর?’
‘তুমি হাসপাতালে যাবে।’
‘না, যাব না।’
‘আমি দিতে যাব।’
‘তাহলে যাব।’
‘তোমার কি খুব দুঃখ?’
‘না।’
‘তোমাকে কি কেউ কেউ কষ্ট দিয়েছে?’
‘না।’
‘তুমি কি একা?’
‘না।’
‘কিন্তু তুমি তো দেখছি খুব আহত।’
‘আহতই তো।’
‘কে আহত করল?’
‘আমি নিজে নিজেই আহত হয়েছি।’
রবি ব্যানার্জি উঠে গিয়ে ঘরের জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দেয়। তারপর ফিরে এসে বলল, ‘খাবার গরম করতে রান্নাঘরে যাচ্ছি।’
সেঁজুতি বলল, ‘না, যাবেন না, এখানে বসুন।’
‘এখানে আমার কোনো কাজ নেই।’
‘আছে, আমার সঙ্গে কথা বলার।’
‘কী কথা।’
‘মানে সঙ্গ দেওয়া।’
‘কথা ও সঙ্গ দেওয়ার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে না। তোমার খিদে পেয়েছে, তুমি এখন খাবে। আমি খাবার গরম করতে যাব।’
‘যাও।’
রবি পাশ থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।
সেঁজুতির ঘুম এসেছে। ঘুমিয়ে পড়তে চাইল। স্বপ্নের ঝলক এলো চোখে ও মনে। ঘুমের মধ্যে স্তিমিত হয়ে গেল নিজে। এক মরুভূমির নির্জন পথে হেঁটে চলেছে সে। দেবদূতরা তার সঙ্গে হেঁটে চলেছে। তাঁরা যাবে স্বর্গে। সেও তাঁদের সঙ্গে যাবে। অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য। আকাশ নীল আর ধূসর মরুভূমি। মরুভূমি ঢেউ-খেলানো। ওখানে তমোঘœ নেই। বন্ধুরা কেউ নেই। শুধু প্রহর একপায়ে হেঁটে চলেছে। প্রহরের খুব কষ্ট।
রবি এলো।
সেঁজুতির তন্দ্রা ভেঙে যায়।
একটা তোয়ালে দেয় রবি। ‘যাও, øান করে নাও।’
সেঁজুতির øান করতে খুব ইচ্ছে করল। ছুটে গেল সে বাথরুমে। এই বাথরুমটা খুব লোভনীয়। কেননা, প্রশস্ত। কেননা আরশোলা নেই। কলগুলো ভালো। শাওয়ার ঠিকঠাক কাজ করে।
পোশাক ছেড়ে এখন সেঁজুতি শাওয়ারের তলায় শান্তমনে দাঁড়িয়ে আছে, জলের আদর খাচ্ছে। আহ্। বেশ আরাম। প্রাণভরে সে এখন øান করতে থাকে। সব দুর্ঘটনা এখন তাকে ভুলে যেতে হবে। ভুলে যেতে চায়ও সে। সেই আনন্দে সে এখন øান করছে। অনেকক্ষণ সে øান করল। তারপর চুল ও সারাশরীর মুছে নিলো। পোশাক পরে বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে।
টেবিলে গরম খাবার তৈরি।
খেতে বসল। সুস্বাদু খাবার। আলু পোস্ত, ডাল, লাউচিংড়ি আর আড় মাছের কালিয়া। খেতে খেতে বুঝল, তার খুব খিদে পেয়েছিল। খিদের জন্য সব চমৎকার লাগছে। রবিদার কাজের মেয়ে রান্না ভালোই করে। ফ্রিজে ছিল বলে নষ্ট হয়নি। গরম করতেই  ঠিকঠাক স্বাদ পাচ্ছে, যেন এখনকার রান্না।
‘তুমি আরো একটু ভাত নাও।’
‘আমি নিচ্ছি।’
‘মাছ কিন্তু অনেক আছে।’
‘মাছটা ব্যাপক।’
‘আরো খাও।’
‘আপনি খেলেন না?’
‘পরে খাব।’
‘আপনার সব খাবার খেয়ে নিচ্ছি।’
‘বেশ।’
‘আপনি রাগ করছেন?’
‘না।’
‘কদিন ভালো খাওয়া হয়নি।’
‘আরে খাও খাও।’
‘কদিন ভালো ছিলাম না।’
‘সে তো দেখছি।’
‘একটু হুইস্কি খেয়ে নিতে পারতে, ভালো ঘুম হতো।’
‘এমনিতেই ঘুম ঠেসে ধরেছে।’
‘ঘুমোও।’
‘আমি এখানেই ঘুমোব।’
‘ঘুমোও।’
‘আমাকে কিন্তু ঘুম থেকে তুলবেন না, আমি নিজে থেকে উঠব।’
‘ঠিক আছে। হাসপাতালে যাবে না?’
‘তারপর ভাবব।’
‘ঠিক আছে।’
‘আর খেতে পারছি না।’
‘রেখে দাও, আমি ফেলে দেবো।’
‘আপনার অসুবিধে করছি?’
‘তা কেন?’
‘আপনি এত ভালো মানুষ কেন?’
কোনো কথা বলে না রবি ব্যানার্জি।
সেঁজুতি বেসিনে গিয়ে হাত ধোয়।
অন্য বন্ধ ঘরটা খুলে দিয়েছে রবি।
ব্যাকুল হৃদয়ে সেদিকে তাকায় সেঁজুতি। রবি ব্যানার্জির সঙ্গে আর কথায় যেতে পারছে না। সবকিছু অবান্তর মনে হচ্ছে তার। কৃতজ্ঞতা ভুলে যাচ্ছে। সে শুয়ে পড়বে, ঘুমিয়ে পড়বে শুধু। রবির সঙ্গে কথা না বলে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। আর বিছানার মাঝখানে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। রবি ঘরে এসে তার ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে গেল। ফিরে যাওয়ার পথে ঘরের দরজাটা আবজে দিয়ে গেল। চোখ মেলে সব দেখল সেঁজুতি। কোনো কথায় যেতে পারল না, তার কোনো কথা নেই। সব কথা হারিয়ে গেছে।
চোখ বুজল; কিন্তু ঘুম এলো না। মনে অস্থিরতা, ঝিলিমিলি। কিন্তু স্বপ্ন এসে জুটতে লাগল। নিদ্রাহীনতার ভেতর স্বপ্নরা ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে, তাদের কিছুতেই রোধ করতে পারছে না। ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে উঠবে সেঁজুতি, ক্রমশ অবশ হয়ে উঠবে তার মস্তিষ্ক ও শরীর।
ঘরের জানালায় পরদা টানা। ছায়াময়তা, আর ঠান্ডা এক পরিবেশ। তার ভেতর শান্তই হয়ে গেল সে। শান্তই হতে চেয়েছিল। কোনো আলোর বিন্দু কোথাও নেই। এক অন্ধকারময়তা তার মনের চারপাশে, শরীরের চারপাশে, চোখের চারপাশে। তার ভেতর সে শুধু শুয়ে আছে। (চলবে)