একদিন অরিত্র

মে ট্রো অনড়। এসি কোচ, জানালা-দরজা বন্ধ। খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না। তাছাড়া নেমে হাঁটার উপায় তো নেই। সুড়ঙ্গের মাঝখানে স্তব্ধ। যাত্রীরা ক্ষুব্ধ। সময়ে অফিসে পৌঁছোনোর তাড়া। নানা মন্তব্য, এমনকি দরজায় লাথি, চিৎকার হইচই।

এমন প্রায়ই ঘটে। কর্তৃপক্ষ পরের দিন পত্রিকা-টিভি মাধ্যমে খবর দেয় : কারো মরণঝাঁপ, অথবা থার্ড রেল বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন, কিংবা কোনো কামরায় ধোঁয়া দেখা গেছে।

ঝোলানো হাতল ধরে দাঁড়িয়েছিল অরিত্র। বসার জায়গা পাওয়া যায় না এই ব্যস্ত সময়ে। দাঁড়িয়েই যায় প্রতিদিন। এটাই তার কাজের সময়। কাজ বলতে বিকেল পাঁচটা থেকে রাত নটা – তিন খেপ টিউশনি। এই সময়ে বিকেলের রূপসী শহরকে হারাতে হয়। বন্ধুরা অফিস-ব্যবসা সেরে শাল সোয়েটার স্যুট চড়িয়ে মোড়ের আড্ডা গুলজার করে। শীতটাও এবার জাঁকিয়ে পড়েছে। সামনের রাস্তায় এখন প্রজাপতির পাখনা মেলা। ওদের বোধহয় শীতবোধ কম। হাতকাটা বস্নাউজ, লো কাট জিন্স, বাহারি কাজের কামিজ চড়িয়ে শিখর দশনা। কেউ বা শরীরী ঢেউ তুলে অপাঙ্গী। মোড়ের বন্ধুরা ভাগাভাগি করে, ওটা আমার। ওই ফ্ল্যাট হিলের হংসীর দিকে নজর দিও না।

কেউ আপত্তি তোলে, ও আবার তোর কবে হলো। আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছে চারদিন। ওখানে নোলা বাড়িও না।

এভাবেই ওদের সান্ধ্য-বিতর্ক। নয়তো কোহলি ধোনি কুলদ্বীপ বা শাহরুখ কাজল দীপিকা, মমতা রাহুল মোদি শেষে রাতের হট কফিতে যখন চুমুক সেরে কাগজের গস্নাস ছুড়ে ফেলে অরিত্র ক্লান্তপায়ে শূন্য মনে ফেরে। তখনো দু-তিনজন দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিয়ে বলে, এই যে মাস্টারমশাই, ছাত্রীকে অ্যানাটমি শেখানো হলো! শুধু টেবলের নিচে পায়ে পা ঠেকানো, নাকি জড়িয়ে ধরে চুমুচামার বিদায়!

কেউ আবার টিটকারি দেয়, ভালো আছিস মাইরি। প্রতি বছর নতুন মাল। চালিয়ে যা। ফেঁসে যাস না যেন!

উত্তর দেয় না অরিত্র। সে জানে তার সকাল-দুপুর ঠিক এদের বিপরীত। তখন তার অবসন্ন অবসর। হঠাৎ কারো বাড়ি গেলে তাড়া করে, একদম সময় নেই। সাড়ে নটা বাজে। এক কাপ চা খেয়ে কেটে পড়। মা-দিদির উদ্দেশে – অরুকে চা দাও, বলে গামছা তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢোকে।

অথবা কেউ বলে, এখন এলি? আমি যে আয়েশাকে নিয়ে মুভি দেখতে যাচ্ছি। ফোনে অ্যাডভান্স টিকিট বস্নক করেছি। কিছু মনে করিস না।

না, কিছু মনে করে না অরিত্র। চা খেতে খেতে বন্ধুদের বাড়িতে ইংরেজি কাগজ দেখে। যোগ্যতা অনুসারে দরখাস্ত পাঠায়। ইন্টারভিউ দেয়। আজো ওয়াক ইন ইন্টারভিউ দিতে মেট্রোয় উঠেছে। একটু সোর্স আছে। মোড়ের বন্ধু প্রসিতের অফিস। ভ্যাকেন্সি তিন। পার্সোনাল অফিসারকে তেলিয়ে কথা বলতে পারলে শিকে ছিঁড়তেও পারে। তবে তিনি নাকি ওভারস্মার্ট ক্যান্ডিডেট পছন্দ করেন না। ফিটফাট নয়, একটু ক্যাজুয়াল। কবিতা লেখার বাতিক আছে তো। শক্তি চাটুজ্জের ফ্যান। এইসব তথ্য অন্বয়ই দিয়েছে।

মোবাইলে সময় দেখে অরিত্র। বিকল মেট্রোর ঠুকঠাক চলছে। সেও হাতে অতিরিক্ত সময় নিয়ে বেরিয়েছে। পরের স্টেশন পর্যন্ত চালানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। সেখানে নেমে বাস ধরলেই হবে। ইন্টারভিউ তিনটে থেকে শুরু। এখন সবে একটা সাতচল্লিশ। সে আজ সকাল থেকে সাধ্যমতো জীবনানন্দ শক্তি সুনীল গিলেছে। পোশাকও ঢিলেঢালা। প্যান্টের ওপর পাঞ্জাবি। মাস্টারি গাম্ভীর্য ঝেড়ে মনে একটু তেল তেল ভাব নিয়ে থাকে। কিছুতে উত্তেজিত হয় না। মনে মনে কবিতার লাইন ভাঁজে। ঠিক ঠিক মনে আসে না। গুলিয়ে যায়। তবে শব্দগুলো তরতাজা …

ঘটাংঘট শব্দে মেট্রোয় চলা শুরু করে। এসি বন্ধ। তবে এটা তো শীতের সময়।

বাইরে বাস ধরতে গিয়ে তাড়াহুড়ো। দুটো পঁচিশ। পেছনে হইহই চিৎকার, সশব্দে ব্রেকচাপা চাকা ঘসটানোর আর্তনাদ। ড্রাইভারের গালাগাল, শালা মরণের ইচ্ছা তো, আমার চাকার নিচে কেন!

ততক্ষণে অরিত্র এদিকের ফুটপাতে। অনন্ত আশায় হাঁপায়। মরিনি যখন, চাকরিটা আমার হবেই।

পাশের পথিক বলে, আজ বড় ফাঁড়া গেল আপনার। আসন্ন মৃত্যুর সঙ্গে কোনো যোগ না থাকলেও তার বারবার মনে হয়, আজ বড় শুভ দিন। তার ভাগ্য বদলে গেল। তবে এই মুহূর্তে তার একটু জল খাওয়া দরকার। ফুটপাতে সারি-সারি দোকান। খদ্দেরের ভিড়। অরিত্র বলে, একটু জল পাওয়া যাবে ভাই।

জরুর। কী খাবেন, কোলা, থামসআপ, নাকি ইসপ্রাইট? ভুল জায়গায় এসেছে অরিত্র। এরা বোতলের পানীয় ছাড়া জল বোঝে না।

 

নিজাম প্যালেসের আগেই জটলা। রাস্তার দুই পাশে ক্ষুব্ধ জনতা। লাঠি ঢাল হেলমেটে নিষ্ঠুর পুলিশ। মাঝখানে থ্যাঁতলানো দেহ-রক্ত। কারো অসহায় বাবা অথবা স্বামী রাস্তায় নিথর। তবু বেঁচে থাকা। ইন্টারভিউ – প্রায় নিশ্চিত একটা চাকরি। ফুটপাতের কিনার ঘেঁষে এগোনো। পার্ক পস্নাজা। লিফটে লম্বা লাইন। সেভেন্থ ফ্লোর।

প্রসিত আগেই সতর্ক করেছিল, আমার সঙ্গে অফিসে কথা বলবি না। দেখাও নয়। ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে যাবি। আমি খবর পাব। প্রায় তিনশো অপেক্ষমাণ। বায়োডাটা নিয়ে যাচ্ছে চাপরাশি। সবাই টিপটপ। টাই ব্রিফকেসেও বেশ কয়েকজন। অরিত্রই কেবল ঢিলেঢালা। পায়ে চটি, ঢিলে প্যান্ট, গাঢ় গেরুয়া পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ঝোলা। আড্ডায় না ইন্টারভিউতে নির্ণয় কঠিন। তবু আশার বুদ্বুদ। ক্যান্ডিডেটরা পরস্পর বলাবলি করে, ইন্টারভিউটা তো শো, ভেতরে ভেতরে লোক ঠিক করা, রাজনীতির দাদারা না থাকলে চাকরি হয় না। খুঁটি থাকা চাই … অরিত্র ভাবে, চিফ পার্সোনাল অফিসারের যে কাব্যরোগ, সেই হদিস এরা জানবে কী করে! অনেকেই সাক্ষাৎকার সেরে বাইরে আসছে। অপেক্ষমাণদের কৌতূহল, কী জিজ্ঞাসা করছে, আইকিউ, না রিটিন? কেউ আবার বেরিয়ে বলছে, সব আইওয়াশ। এতো পড়াশোনা করে এলাম, কিছুই জানতে চাইল না। দু-চার কথার পর থ্যাংক ইউ, বলে বিদায়। ফোনে নাকি খবর পাওয়া যাবে। অরিত্র জীবনানন্দ শক্তি শঙ্খ ঘোষ জয় গোস্বামী মনে মনে ভাবতে থাকে।

বেলা সাড়ে পাঁচ। এখনো হাঁপাতে হাঁপাতে কয়েকজন ভিড় বাড়ায়। ভেতরে যাওয়া-আসা চলতে থাকে। এ কী, আরো একজন ভেতর থেকে বেরিয়ে চলে যায় না। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে! বাইরে তো মাত্র আঠারোটা মিউজিক্যাল চেয়ার। কিন্তু অরিত্রর চিমন্তা, তিনটে ভ্যাকেন্সির দুজন দেয়ালে লম্বমান। বাকি মাত্র এক। অরিত্রর ডাক আসার আগেই যদি … অরিত্র হালদার? ডাক পাওয়া মাত্র অরিত্র প্রায় লাফ দিয়ে ভেতরে ঢোকে। নমস্কারে দুই হাত তুলে বলে, শুভ সন্ধ্যা।

ও-প্রামেত্ম চার আক্রমণোদ্যত বাঘের একজন মুখে প্রসন্ন প্রশ্রয়, বসুন।

তিনিই বোধহয় কবিতাপ্রেমী চিফ। স্যুট-টাই, টাই-পিন – ফিটফাট। বাকি তিন বাঘের মধ্যে একজনের কাঁচাপাকা গোঁফ, কেউ ফ্রেঞ্চকাট, কেউ যত্নলালিত দাড়িতে যিশুখ্রিষ্ট। বায়োডাটায় নজর, কপি মেলানো, লাল পেনের দাগ টানার পর প্রশ্নের ঝড়। শেষে কবিতাপ্রেমীর নিরীহ আদেশ, প্লিজ ওয়েট আউটসাইড। ইউ মে বি কলড ব্যাক।

তাহলে এতো জীবনানন্দ সুনীল শক্তি … এত মুখস্থ … কবিতার বই হাতড়ানো বেকার! একটা লাইনও কেউ জানতে চাইল না। প্রসিত কি ভুল খবর দিলো! আজ টিউশনি কামাই হলো। হোক। আর সে পরোয়া করে না। ছুটি নেই, বন্ধ ধর্মঘট নেই, জলে-ডোবা কলকাতা

 

অচল হলেও তার হাজিরা বাধ্যতামূলক। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বকর-বকর। তবু মা-বাপরা খুশি নয়। যদি আর একটু সময় বাড়াতে পারেন স্যার, … অথচ টাকার বেলায় দু-হাজার। আজকাল কাজের মেয়েদের মাইনে সাড়ে তিন-চার হাজার। তার ওপর পুজোয় বোনাস, নতুন শাড়ি-বস্নাউজ, বাড়তি কাজে বকশিস। তারপর তাদের ট্রেন বাস ফেল করা আছে, শরীর খারাপের ছুটি আছে। শুধু হোম টিউটরের কোনো বোনাস বকশিস ছুটি নেই। তারা যে বাড়ির ঝি-চাকরেরও অধম। আপত্তি তুললেই, অজুহাত। ছেলের তো আরো চারজন টিচার আছে। আপনার তো শুধু ম্যাথস।

যাও, এখন যাকে খুশি তাকে দিয়ে পড়াও। অরিত্র হালদার আর নেই। সে এখন সিলেকশনে থার্ডম্যান। পকেটভরা বেতন। গ্র্যাচুইটি, পিএফ, পেনশন … হিপ পকেট থেকে নোটঠাসা পার্স বের করে সেও মোড়ের আড্ডায় হাঁক দেবে, অ্যাই সহদেব, এক প্যাকেট বড় গোল্ডফ্লেক দে। কিন্তু এ কী, ওয়েটিংয়ের এক, আরো এক, তারপর আরো আরো … তাহলে অরিত্র!

 

এখন সাড়ে সাতটা। ইন্টারভিউ বোর্ড ছাড়া অফিস ফাঁকা। প্রসিতকেও দেখা যাচ্ছে না। কাচের দরজায় চোখ রেখেও সে খেয়াল রাখতে পারল না, প্রসিত কখন বেরোল! নাকি অন্য কোনো ঘরে। সে না থাকলে অরিত্র ইন্টারভিউর রেজাল্ট জানবে কেমন করে! অরিত্রর ডাক আসে। বেয়ারা অন্য ঘরে নিয়ে যায়। চিফ পার্সোনালের চেম্বার। অদূরে তাঁর তন্বী সিল্ক শাড়িতে সেজে থাকা পিএ। পদ্মডাঁটার মতো হিলহিলে। রঙেও পদ্মফুল। কিন্তু ওদিকে নজর অপরাধ হতে পারে। ঘরে ঢোকার আগে নেমপেস্নট দেখেছে অরিত্র। আই.বি সান্যাল। নজর তার দিকেই রেখে অরিত্র আবার নমস্কার জানায়। অবশ্য শুভরাত্রি বলা যায় না। তবে অবাক হয়ে দেখে, চিফের স্যুট থেকে টাইপিন এখনো একচুল নড়েনি। আবার তিনি সরল বাংলায় বলেন, বসুন। আপনার হবিতে লিখেছেন, কবিতা।

অরিত্র ছলকে ওঠে, একটু চর্চা করি।

প্রিয় কবি?

জীবনানন্দ দাশ।

কেন?

এমন শব্দ চয়ন, … চুল তার বিদিশার নিশা … মুখ শ্রাবসত্মীর কারুকার্য … পাখির নীড়ের মতো চোখ, কিংবা দূরতর দ্বীপ বিকেলের নক্ষত্রের কাছে … দারুচিনি দ্বীপ … ধানসিড়ি নদী …

শক্তি চট্টোপাধ্যায় পড়েন না?

তিনি তো আমাদের সময়ের কবি। কী তীক্ষন তির্যক ভাষা … আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে। এটাই তো আমাদের গহন বেদনার কথা!

ছায়া মারীচের বন?

হ্যাঁ। হৃদয়ে আমার গন্ধের মৃদু ভার, … আবার দেখুন হৃদয়পুরে জটিলতার চলিতেছিল খেলা, … কিংবা আঁখির আঠায় ভালোবাসার বাঘ জড়িয়ে যায় … কখনো দাপটে বলে, টাকা দাও, নাহলে ভাঙচুর হবে, ধ্বংস হবে মহাফেজখানা … অথচ সংসারে সন্ন্যাসী লোকটা … মদ্যপায়ী ভেতো … এবং আগুনে পুড়ে গেল লোকটা … কবি ও কাঙাল।

সুনীল গাঙ্গুলি?

এই দর্পিত আবির্ভাব আর কোথায়! ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর পা রেখে দাঁড়ানো …

আপনি শিক্ষকতা করেন?

না। বেমালুম মিথ্যে বলে অরিত্র।

কবিতা লেখেন?

বললাম তো, চর্চা করি।

ছাপা হয়?

কখনো-সখনো।

কাব্যগ্রন্থ আছে?

না। কবিদের দুর্দশা তো জানেন। পকেট মানি বাঁচিয়ে … অনর্গল মিথ্যা বলে যায় অরিত্র। আরো বলে, আপনার ব্যস্ত সময়ের মাঝে আপনিও যে কবিতা অনুরাগী অনুমান করতে পারি …

সুন্দর কিছু সময় কাটল আপনার সঙ্গে। আরো কিছু শোনার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বাইরে আরো কয়েকজন …

হ্যাঁ হ্যাঁ। অবশ্যই। আমারও খুব ভালো লাগল আপনাকে। উঠি এখন। নমস্কার।

হাত তুলে নমস্কারের ভঙ্গিতে তিনি বলেন, চর্চাটা ছাড়বেন না।

বুকভরা আশা নিয়ে বেরিয়ে আসে অরিত্র। প্রসিতের খবর নেওয়া নিষিদ্ধ। চেষ্টাও করে না। প্রথম বাস পেতেই উঠে পড়ে। ঠাসা ভিড়। তবু অরিত্রর ভালো লাগছে। ঢেপসা, রংজ্বলা সোয়েটারে গা ঘেঁষে দাঁড়ানো মানুষটা নির্বিকার। উৎকট গন্ধ। তবু সরে আসছে না অরিত্র। এমনকি পা মাড়িয়ে যে পৃথুল মহিলা বাস থেকে নামল, ভালো লাগছে তাকেও। ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটে শীত লাগে। সিগন্যাল আটকে থাকাও বিরক্তিকর মনে হচ্ছে না। আপন পুলকে রড ধরে বাসের দুলুনিতে টাল খায়। নিজের স্টপে নামে। ক্যাজুয়াল পোশাকের পাঞ্জাবি ভেদ করে ঠান্ডা কাতর করে। কান ঢাকা টুপি পকেট থেকে বের করে কানের দিকে টান দেয়। সোজা মোড়ের আড্ডায়। আড্ডার আসর তখন ভাঙাহাট। নিতান্তই পাড়ার কয়েকজন। যেমন জয়ন্ত। সারাদিনে আড্ডা ছাড়া কাজ নেই। বাবা তিনতলা বাড়ি রেখে গেছে। তিনতলায় তিনখানা ঘর রেখে সব ভাড়া। সে ওঠে সবার শেষে। সকালেও বেলা দেড়টা পর্যন্ত মোড়ে। মাঝে মাঝে বউ-মেয়ে নিয়ে বেড়াতে যায়। অর্জুনও পাড়ার ছেলে। পোস্ট অফিসে চাকরি করে। বিকেলে নাকি মাথা ঝিমঝিম করে। আড্ডা তার টনিক। বিতোষ কম্পিউটার মেকানিক। তার রোজের রোজগার হাজার আড়াই। তবে কিপ্টে, টাকা জমায়।

অরিত্রকে দেখে তারা আগ্রহী হয়। প্রসিত তার ইন্টারভিউর ব্যাপার বন্ধুমহলে আগেই ছড়িয়েছে। বেঞ্চে বসার আগেই প্রশ্ন, কেমন হলো রে?

প্রসিত এলে জানতে পারব।

সে-ব্যাটা আজ এতো দেরি করছে কেন?

লোক নেবে তিনজন। প্রার্থী তিন হাজার।

ন-টা তো বাজে। আর কি সে এদিকে আসবে?

দেখি।

তারা আবার পুরনো চর্চায় ফিরে যায়। তেতো এবং জোলো। চটকাতে চটকাতে বিরক্তি ছড়ায়। অরিত্র বলে, তোদের অন্য বিষয় নেই! সাহিত্য শিল্প, দেশ সমাজ …

আমরা কি সমাজের মাস্টারমশাই, বলে হা-হা করে হাসে জয়ন্ত।

বাকি দুজনও সায় দেয়। অরিত্রর ঘেন্না লাগে। উঠে আসার ইচ্ছা হয়। পারে না। এরাই তো বন্ধু। সাহায্য করে। প্রয়োজনে টাকা ধার দেয়। বিপদে পাশে দাঁড়ায়। চাকরির হদিস দেয়। তার মঙ্গল কামনা করে।

কাঁপুনি বাড়ে। ঠান্ডার তীব্রতা বাড়ে। বিতোষ উঠে যায়। অর্জুন সিগারেট কিনে বাড়ির পথে। অরিত্রর আজ সিঞ্চিতার কাছে যাওয়া হলো না। বলেছিল, ফলাফল নিজে এসে জানিয়ে যাবে। সিঞ্চিতা অরিত্রর ঘোলাটে জীবনের টুকরো আকাশ। তার প্রিয় ছাত্রী। পাশ করার পরেও সম্পর্ক থেকে গেছে। দিনে দিনে সম্পর্কে রঙের রামধনু ছড়িয়েছে দুজনে। স্বপ্ন দেখে, দুজনের মধ্যে কারো একটা চাকরি হলেই তারা সংসার গড়বে।

জয়ন্ত তাড়া দেয়, কী রে উঠবি তো? প্রসিত হয়তো বাড়ি চলে গেছে। রাত্রে সে তো আবার জলচর।

তুই যা। আমি আর একটু বসি।

জয়ন্ত চলে গেলে অরিত্র মোবাইলে কন্ট্রাক্ট নাম্বার হাতড়ায়। ওদিকে রাগী উত্তর, তুই এতো কবিতা মারাতে গেলি কেন। যা করছিস কর। এক খাঁচায় দুটো সিংহ থাকে! লাইন কেটে যায়।

রাস্তা ফাঁকা। দুরন্ত বেগে গাড়ি ছুটে যায়। আলোর নিচে কুয়াশা জমাট। অরিত্র বসেই থাকে। এটা যেন তার দেশ নয়। মুখস্থ করা লাইনটা মনে আসে : পৃথিবীকে মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়।