একালের শেখভ অ্যালিস মুনরোর সাক্ষাৎকার

ভূমিকা ও অনুবাদ : আন্দালিব রাশদী

সিনথিয়া ওজিক অ্যালিস মুনরোকে বলেছেন একালের শেখভ। তিনি সাড়া দিয়েছেন এই বলে যে, সাহিত্যে শেক্সপিয়রের প্রভাব যেমন অস্বীকার করা যায় না, শেখভের বেলাতেও ঠিক তাই। তিনি তন্নতন্ন করে শেখভ পড়েছেন। যদি তাঁর কাছ থেকে কিছু আহরণ করে থাকেন, সেজন্য গৌরবই বোধ করেছেন, অস্বস্তি নয়।

ছোটগল্পের ঘোর দুর্দিনে অ্যালিস মুনরো ছোটগল্পের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। গল্পকারদের জন্য এ এক পরমোৎসব।

অ্যালিস মুনরোর কয়েকটি সাক্ষাৎকারের খন্ড-খন্ড অংশের অনুবাদ জোড়া দিয়ে এ-লেখাটি গ্রথিত হয়েছে। সাক্ষাৎকারগুলো প্যারিস রিভিউ, নিউ ইয়র্কার, নিউ ইয়র্ক টাইমস, আটলান্টিক, ভার্জিনিয়া কোয়ার্টারলি রিভিউতে প্রকাশিত।

প্যারিস রিভিউর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জিন ম্যাককুলাক এবং মোনা সিম্পসন, ১৯৯৪-র শরৎ সংখ্যায় প্রকাশিত।

অনূদিত এই মিশ্র রচনাটির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের ঠিক শতবর্ষ পর নোবেল সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত হওয়া কানাডার গল্পকার এবং সাহিত্যে প্রথম কানাডিয়ান নোবেল বিজয়ী অ্যালিস মুনরোকে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে।

 

প্যারিস রিভিউ থেকে (১৯৯৪)

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : যে-বাড়িতে আপনি বেড়ে উঠেছেন আজ সকালে আমরা তা দেখতে গিয়েছিলাম। আপনার শৈশবের পুরোটাই কি এখানে কেটেছে?

 

akaler sekhob aliceঅ্যালিস মুনরো : হ্যাঁ। আমার বাবা মৃত্যু পর্যন্ত এই খামারবাড়িতে বসবাস করতেন। এটা ছিল শেয়াল আর বেজির খামার, যদিও এখন তা অনেক বদলে গেছে। এখন এই খামারবাড়ি টোটাল ইন্ডালজেন্স নামের এক বিউটি পার্লার। পেছনের দিকটাতে বিউটি পার্লার, আমাদের রান্নাঘরটাকে ওরা গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : আপনি কি তখন থেকেই এখানে?

মুনরো : তা নয়। তাহলে আমি বসার ঘরটা দেখতে বলতাম। এতে আমার বাবার হাতের তৈরি ফায়ারপ্লেসটা দেখাতে চাইতাম। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়েছে বিউটি পার্লারের ভেতরে ঢুকে একবার ম্যানিকিউর করিয়ে আসি।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : আমরা লক্ষ করেছি, খামারের পাশের মাঠে পড়ে আছে একটি উড়োজাহাজ আর তখনই আপনার গল্প ‘হোয়াইট ডাম্প’ আর ‘হাউ আই মেট মাই হাজব্যান্ডে’র কথা মনে পড়ল।

মুনরো : হ্যাঁ, আসলে এই জায়গাটা একসময় এয়ারপোর্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই খামারের মালিকের উড়োজাহাজ চালানোর সখ ছিল, আর তাঁর নিজেরও একটা ছিল। খামারের কাজে তাঁর আগ্রহ ছিল না, তিনি শেষ পর্যন্ত ফ্লাইট ইন্সট্রাক্টর  হলেন। তিনি এখনো জীবিত। সম্পূর্ণ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষটি আমার জানা সবচেয়ে সুদর্শন মানুষ। পঁচাত্তর বছর বয়সে প্রশিক্ষণের কাজ থেকে অবসর নেন। অবসরের তিন মাসের মধ্যে কোনো এক অভিযানে গিয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে ফেরেন। গুহার বাদুরদের সংস্পর্শে এ-রোগের সংক্রমণ হয়।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : একবার প্রকাশিত হওয়ার পর আপনি কি তার ওপর আবার কলম চালান? যদ্দুর মনে হয়, মৃত্যুর আগে মার্শেল প্রুস্ত তাঁর রিমেমব্র্যান্স অব থিংগস পাস্ট গ্রন্থের প্রথম খন্ডটির পুনর্লিখন করেছিলেন।

মুনরো : হ্যাঁ। সাধারণ ও সহজবোধ্য রচনা হেনরি জেমস পুনরায় লিখে তা ধোঁয়াটে এবং কঠিন করে তুলেছেন। আমি সম্প্রতি বেস্ট আমেরিকান শর্ট স্টোরিজ ১৯৯১-এর অন্তর্ভুক্ত গল্প ‘ক্যারিড অ্যাওয়ে’ পুনর্লিখন করেছি। গল্পটা কেমন জানার জন্য আমি এই সংকলন থেকে এটা আবার পড়লাম আর এর মধ্যে ভারাক্রান্ত একটি অনুচ্ছেদ পেয়ে গেলাম। ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুচ্ছেদ। হতে পারে তা দুটি বাক্যের। আমি প্রথমে কলম হাতে নিয়ে সংকলনের মার্জিনে এটা আবার লিখলাম। বই আকারে প্রকাশকালে যাতে কখনো প্রশ্ন উঠলে জবাব দেওয়া যায় সেজন্যই প্রকাশিত সংকলনের মার্জিনে লিখেছি। এরকম স্তরে আমি প্রায়ই পরিমার্জন করেছি – কাজটা যে ভুল হয়েছে তা পরে বোঝা গেছে, কারণ সংশোধন করার সময় আমার মধ্যে গল্প লেখার সময়কার ছন্দটি তো ছিল না। এ-কাজের জন্য যতোটা শ্রম দেওয়া দরকার ছিল তা না করে আমি লেখার একটি ছোট অংশকে কেবল দেখছি। শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে আমি যতোটা শ্রম দেওয়া উচিত ছিল তা না দিয়ে গল্পটা এনেছি আর যখন গল্পটা আবার পড়ছি মনে হচ্ছে, একটা কিছু চাপিয়ে দিয়েছি। এ-ধরনের কাজের পরিণতি সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। তবে আমার কাছে এর জবাব হচ্ছে, লেখালেখিতে এ-ধরনের আচরণ না করাই ভালো। শিশুর বড় হওয়া নিয়ে আপনি যেমন করেন একপর্যায়ে আপনাকে বলতে হবে, থাক – এটা আর আমার  নয়।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : আপনি উল্লেখ করেছেন, আপনার কাজটি যখন এগোতে থাকে সে অবস্থায় বন্ধুদের তা দেখান না।

মুনরো : আমার কাজ যখন এগোয় আমি কাউকেই কিছু দেখাই না।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : আপনার সম্পাদকের ওপর কতটা নির্ভর করেন?

মুনরো : নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় লেখা দেওয়ার পর আমি সিরিয়াস ধরনের সম্পাদনার অভিজ্ঞতা লাভ করি। এর আগে যা পেয়েছি তাকে মোটামুটিভাবে কপি এডিটিং বলা চলে, সঙ্গে সামান্য পরামর্শ – বেশি কিছু নয়। সম্পাদনায় কী কী ঘটতে পারে তা নিয়ে সম্পাদক আর আমার মধ্যে একটি সমঝোতা থাকতে হবে। যে-সম্পাদক মনে করবেন উইলিয়াম ম্যাক্সওয়েলের গল্পগুলোতে কিছু করার নেই, তিনি আমার কোনো কাজে আসবেন না। তার অত্যন্ত প্রখর দৃষ্টি থাকতে হবে যেন লেখার মধ্যে আমি নিজেকে প্রতারণা করতে না পারি। আমার প্রথম সম্পাদক নিউ ইয়র্কার পত্রিকার  চিফ ম্যাগগ্রাথ অত্যন্ত  চমৎকার। আমি যেভাবে কাজটা করতে চাই সেই গভীরতা নিয়ে কেউ যখন আমার কাজটিকে দেখতে পারে, আমাকে বিস্মিত হতে হয়। একসঙ্গে আমাদের বেশি কাজ করা হয়নি। কিন্তু প্রায় তিনি আমাকে অনেক ধরনের নির্দেশনা দিতেন। ‘দ্য টার্কি সিজন’ নামে আমার একটি গল্প তিনি মনোনীত করেছেন, আমাকে দিয়ে আবার পুনর্লিখনও করিয়েছেন। আমি ভেবেছি, তিনি পুনর্লিখিত গল্পটি ছাপাবেন। কিন্তু তা করেননি। তিনি বলেছেন, নতুন গল্পটির অনেক ভালো দিক আছে, কিন্তু পুরনোটিই বেশি ভালো।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : আপনি কি সব সময়ই লিখতেন?

মুনরো : ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ার সময় থেকে।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : কলেজ পর্যন্ত পৌঁছতেই কি আপনি সিরিয়াস লেখক হয়ে ওঠেন?

মুনরো : হ্যাঁ। আমার অন্যকিছু করার সুযোগ হয়নি। কারণ আমার টাকা ছিল না। আমি জানতাম আমার মাত্র দুবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হবে, কারণ তখনকার বৃত্তির মেয়াদ ছিল দুবছরই। এই চমৎকার সময়টি আমার জীবনের ছোট একটি অবকাশকালও। শৈশব থেকেই আমি বাড়ির দায়িত্ব পালন করে এসেছি – বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র সেই সময়টাতেই আমাকে বাড়ির কাজ করতে হয়নি।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : ঠিক দুবছর পরই আপনি বিয়ে করেন?

মুনরো : বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বছরই আমি বিয়ে করি। তখন আমার বয়স কুড়ি। আমরা ভ্যাঙ্কুভার চলে যাই। সেটাই ছিল আমাদের বিয়ের একটি বড়ো অভিযান – এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া। যতোটা দূরে চলে যাওয়া সম্ভব, আমরা ততোদূর গিয়ে গ্রামে বসবাস করেছি। আমার বয়স কুড়ি, আমার স্বামীর  বাইশ। আমরা খুব দ্রুত আমাদের মধ্যবিত্ত অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হই। একটি বাড়ি ও সন্তান নেওয়ার কথা ভাবতে থাকি। দ্রুত তা বাস্তবায়ন করি। যখন আমার প্রথম সন্তান জন্ম নেয়, আমার বয়স একুশ।

 

আত্মজৈবনিক ছোটগল্প

অ্যালিস মুনরোর আত্মজৈবনিক গল্পগ্রন্থ ডিয়ার লাইফ। এ-বইটির প্রকাশনা উপলক্ষে ডেবোরা ট্রিজম্যানের সাক্ষাৎকারের একটি অংশ (২০ নভেম্বর, ২০১২ প্রকাশিত)।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : বিয়ে ও মাতৃত্বের ফাঁদে বন্দি তরুণী ও যুবতীদের নিয়ে আপনি অনেক লিখেছেন, জীবনের কাছে আরো বেশি প্রত্যাশা নিয়ে তারা ছিটকে পড়েছে, আপনিও কম বয়সে বিয়ে করেছেন, মধ্য কুড়িতে দুই কন্যার জননী হয়েছেন। স্ত্রী ও মা হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং লেখকের স্বপ্ন পালনে ভারসাম্য রক্ষা করা আপনার জন্য কতোটা কঠিন ছিল?

মুনরো : গৃহকর্ম কিংবা সন্তান কখনো আমাকে পেছনে টানেনি। আমি সারাজীবনই ঘরের কাজ করেছি। খোলামেলা বিধানটাই এমন ছিল যে, নারী লেখালেখির মতো অদ্ভুত কাজ করবে, এটা মানা যায় না, সম্ভবত সে নারী উপেক্ষিতও হয়। আমি অবশ্য ভালো বন্ধু খুঁজে পেয়েছি – সেসব নারী বন্ধুরা ছিল কৌতুকপ্রবণ, গোপনে বইপত্র পড়তো – তাদের সঙ্গে আমার ভালো সময় কেটেছে।

আমার সমস্যা ছিল লেখা নিয়েই। আমার কাছে প্রায় সবসময়ই আমার নিজের লেখা ভালো মনে হয়নি। অপ্রত্যাশিত এক শিক্ষানবিশকালের মধ্য দিয়ে আমাকে এগোতে হলো। আমার ভাগ্য, সে-সময় চিৎকার উঠেছে আমাদের কানাডিয়ান সাহিত্য কোথায়? টরন্টোর কেউ কেউ আমার এই অস্বস্তিকর নৈবেদ্যের ওপর দৃষ্টিপাত করেছেন এবং আমার সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : আপনার গল্পগ্রন্থ ডিয়ার লাইফের চারটি রচনাকে আপনি বলেছেন ঠিক গল্প নয় – এর অনুভূতি আত্মজৈবনিক, ভাবনাটা যদিও কখনো কখনো সেরকম নয়। (ডিয়ার লাইফের একটি রচনা নিউ ইয়র্কারে স্মৃতিকথা হিসেবেই প্রকাশিত হয়েছে, গল্প নয়) । এই লেখগুলোর প্রায় সবই স্বপ্নের মতোন – খন্ড খন্ড, আধেক স্মরণে আসা স্মৃতিচিত্র, শৈশবের আধেক বোঝা, আধেক অজ্ঞাত মুহূর্তের সমাবেশ ঘটেছে এসব রচনায়। এগুলো কি সেই সময়কার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ বিষয় থেকে তুলে এনেছেন?

মুনরো : আমি কখনো ডায়েরি লিখিনি। আমি অনেক বিষয় মনে রেখেছি। আমি প্রায় সব মানুষের চেয়ে বেশি আত্মকেন্দ্রিক।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : চারটি লেখাতেই আপনার মায়ের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ১৯৯৪ সালে প্যারিস রিভিউকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন, আপনার জীবনে মা ছিলেন একেবারে কেন্দ্রীয় সত্তা। এখনো কি তাই মনে করেন?

মুনরো : এখনো মা-ই আমার জীবনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবনটা ছিল বিষাদাচ্ছন্ন ও অন্যায্য; কিন্তু ততোটাই সাহসী ছিলেন। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন আমাকেই রবিবাসরীয় স্কুলের আবৃত্তিকার বালিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন – সাত-আট বছর বয়স থেকেই লড়াই থেকে দূরে রেখেছেন।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : আমি অবাক হয়েছি আপনি যখন বলছেন, নিজের জীবন সম্পর্কে যা কিছু বলার এটাই ‘প্রথম ও শেষকথা’। এখন মনে হচ্ছে, আপনার অনেক গল্পেই শৈশবের উপাদান আর বাবা-মার কথা উঠে এসেছে। ২০০৬ সালে প্রকাশিত দ্য ভিউ ফ্রম ক্যাসল রক কি আপনার পারিবারিক ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করেই রচিত নয়?

মুনরো : আমি আমার টুকরো টুকরো জীব প্রায় সব লেখাতেই ব্যবহার করেছি। যেমন লিখিত হয়েছে, আমি জানিয়ে দিতে পারতাম দ্য ভিউ অব ক্যাসল রক যতোটা বলা সম্ভব আমার পরিবারেরই কাহিনি।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : আপনি যখন লিখতে শুরু করেন লেখালেখির সেই কম বয়সে আপনার পছন্দের কোন লেখকের রচনা সচেতনভাবে নিজের জন্য মডেল মনে করেছেন?

মুনরো : আমার ভক্তির মানুষ ইউডোরা ওয়েল্টি। এখনো তাই। আমি তাঁকে অনুসরণ করার চেষ্টা করবো না। তিনি অতি উত্তম এবং সম্পূর্ণভাবেই তাঁর নিজস্ব। তাঁর সর্বোত্তম গ্রন্থ আমার মতে দ্য গোল্ডেন অ্যাপলস।

 

তিনি কি নারীবাদী?

সাক্ষাৎকারী গ্রহণকারীর আবারো সেই প্রশ্ন : তিনি কেন ছোটগল্প লিখতে শুরু করলেন?

২০০১ সালে দ্য আটলান্টিকের কারা ফিনবার্গকে মুনরো বললেন : কেন আমি ছোটগল্প লিখতে পছন্দ করি? নিশ্চয়ই আমি তা লিখতে চাইনি। আমি উপন্যাসই লিখতে শুরু করেছিলাম। এখনো তা-ই। আমি উপন্যাসের ভাবনা নিয়েই শুরু করি। এমনকি উপন্যাস লিখবো বলেই এগোতে থাকি। কিন্তু এগোনোর মধ্যে কিছু একটা ঘটে যায়। ভেঙে পড়ে। আমি যেসব উপাদান নিয়ে যা লিখতে শুরু করি তার দিকে তাকাই – দেখি এটা কখনো উপন্যাস হয়ে উঠছে না। আমার বয়স যখন কম, তখন গল্প লেখাটাই আমার জন্য সুবিধাজনক ছিল। আমার নিজের তখন ছোট ছোট সন্তান, আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। কিছু গল্প লেখা হয়েছে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হতে পারে স্বয়ংক্রিয় কাপড়-ধোয়ার মেশিন চালু হওয়ার আগে। উপন্যাস লেখার যে সময় পাবো সে সুযোগ আমার ছিল না। আমি সামনের দিকে তাকিয়ে বলতে পারতাম না – এটা শেষ করতে আমার এক বছর লাগবে – কারণ প্রতি মুহূর্তেই এমন কিছু ঘটতে পারে যা আমার সকল সময় কেড়ে নেবে। কাজেই কম সময়ে লিখে শেষ করতে পারবো এমন আশা নিয়েই টুকরো টুকরো করে লিখতে শুরু করি। ফলে আমার উপাদান নিয়ে আমি সেভাবেই ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। তারপর যখন কিছুটা ফুরসত মিলতে শুরু করে শাখা-প্রশাখা ছড়ানো আমার গল্পগুলোতে হাত দিই। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও, আমি এখন পর্যন্ত উপন্যাস লিখে উঠতে পারিনি।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী : আপনার অনেক গল্পই নারীদের নিয়ে। আপনাকে নারীবাদী লেখক হিসেবে চিহ্নিত করা হলে কেমন বোধ করবেন?

মুনরো : আমি নিজে নারী, স্বাভাবিকভাবেই আমার গল্পগুলো নারীদের ঘিরে। পুরুষরা যখন পুরুষদের নিয়ে লেখেন, তাদের কি বলা হয় আমার জানা নেই। ফেমিনিস্ট – নারীবাদী মানে যে কী, অনেক সময়ই আমি তা বুঝে উঠতে পারি না। শুরুর দিকটাতে আমি অবশ্য বলতাম, বেশ তো, আমি একজন ফেমিনিস্ট। কিন্তু তার মানে যদি এই হয় যে, আমি একধরনের ফেমিনিস্ট তত্ত্বের অনুসরণ করি কিংবা সেই তত্ত্ব সম্পর্কে জানি, তাহলে বলে দিচ্ছি আমি ফেমিনিস্ট নই। এর মানে যদি এই হয় যে, নারীর অভিজ্ঞতাই গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে আমি ততোটাই ফেমিনিস্ট। আসলে সেই অভিজ্ঞতাই ফেমিনিজম – নারীবাদের ভিত্তি।

 

২০০৬ সালে দ্য গ্লোব অ্যান্ড দ্য মেইলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অ্যালিস মুনরো বলেন, ‘এখন মনে হয় আমার আর শক্তি নেই। যে আমলে নারীরা সন্তান লালনপালন ছাড়া আর তেমন কিছু করতো না, আমি তখন লিখতে শুরু করি। কাজটা খুব কঠিন এবং তা একসময় ক্লান্তি এনে দেয়। আমি এখন কিছুটা ক্লান্ত বোধ করছি। অবশ্য এটা সানন্দ ক্লান্তি। এখন অন্য যে কোনো সাধারণ মানুষের মতো হয়ে যেতে পারার অনুভূতিটা চমৎকার। অবশ্য এটাও এর মানে যে, আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো চলে গেছে। না, ঠিক তা নয়। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন আমার স্বামী, তিনিও চলে গেছেন।

 

গল্প কি স্মৃতি থেকে আসে?

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : একটি গল্পের কিংবা একটি বিশেষ চরিত্রের ধারণা আপনি কোথায় পান?

মুনরো : কখনো আমার গল্পের সূচনাটা আসে স্মৃতি থেকে, কিংবা কোনো ছোট্ট কাহিনি থেকে; কিন্তু তা লেখার মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত রচিত গল্পে তা আর খুঁজেই পাওয়া যায় না। যেমন ধরুন আপনার স্মৃতিতে যতোই অভিজাত ও সুরুচিসম্পন্ন পোশাকে আবৃত একজন মহিলা ট্রেন থেকে নামছেন যে তার পরিবার বাধ্য হয়ে তাকে নামিয়ে আনতে গেছে। এই মহিলা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার পর চিকিৎসা শেষে ফিরছেন। স্টেশনে এসেছেন স্বামী, স্বামীর মা এবং মায়ের নার্স। স্বামীটি যে এই নার্সেরই সঙ্গে প্রেমে হাবুডুব খাচ্ছে তিনি নিজেও তা জানেন না। এই তো শুরু – কেমন করে এটা ঘটলো? আমি জানি না।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী : আপনার লেখার অভ্যাসটা কেমন – আপনি কি কম্পিউটার ব্যবহার করেন? আপনি কি প্রতিদিন লেখেন? সকালে, না রাতে? একটা গল্প শেষ করতে কতোটা সময় লাগে?

মুনরো : আমি এক বছর ধরে কম্পিউটার ব্যবহার করছি (১৯৯৮-তে নেওয়া সাক্ষাৎকার)। প্রযুক্তির নতুনতম উপহারগুলো গ্রহণ করতে আমি দেরি করে ফেলেছি। আমার বাড়িতে এখনো মাইক্রোওয়েভ ওভেন নেই। একটি বা দুটি খসড়া আমি হাতেই করি। তারপর কি-বোর্ডে যাই। শুরু থেকে শেষ – প্রকাশের জন্য একটি গল্প তৈরি করতে দুমাস লেগে যেতে পারে, তবে এমনটা কমই ঘটেছে। সাধারণত ছয় থেকে আট মাস লাগে – অনেক পরিবর্তন, গল্পের গতিপথ বদল, অনেক উদ্দেশ্যহীন কাটাকাটি কিছু হতাশা – সবই আছে। কোনো কারণে অসম্ভব না হলে আমি প্রতিদিনই লিখি। ঘুম থেকে জেগে উঠে কফি বানিয়ে লিখতে বসে যাই। বাস্তব জীবনের চিৎকার আমাকে স্পর্শ করার আগে দু-তিন ঘণ্টা কাজে লাগাই।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : কোন কোন লেখক আপনাকে প্রভাবিত করেছেন এবং কার কার লেখা আপনি পড়তে পছন্দ করেন?

মুনরো : আমি যখন তরুণ ছিলাম তখন ইউডোরা ওয়েল্টি, কার্সন ম্যাককুলার্স, ক্যাথরিন অ্যান পোর্টার, ফ্ল্যানেরি ও’কনোর, জেমস এজি। তারপর জন আপডাইক, জন শিভার, জয়েস ক্যারোল ওয়টস, পিটার টেয়লর এবং বিশেষ করে এবং চিরদিনের জন্য উইলিয়াম ম্যাক্সওয়েল। আরো আছেন উইলিয়াম ট্রেভর, এডনা ও’ব্রিন এবং রিচার্ড ফোর্ড। আমি বলবো, তাঁরা আমাকে প্রভাবিত করেছেন। ডজন ডজন লেখকের রচনা আমি পড়তে পছন্দ করি। আমার সর্বশেষ আবিষ্কার একজন ডাচ লেখক সিজ নোটবুম। এরকম তালিকা তৈরি আমার পছন্দের কাজ নয়, কারণ কিছুক্ষণ পর দেখা যাবে আমার জন্য বিস্ময়কর এমন একজন লেখকের নাম আমি বাদ দিয়েছি, তখন দেয়ালে মাথা ঠুকতে হবে। সেজন্যই যাঁদের লেখা আমাকে প্রভাবিত করেছে তাঁদের নাম বলেছি, যাঁদের লেখা আমাকে আনন্দ দিয়েছে তাঁদের কথা বলিনি।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : সিনথিয়া ওজিক আপনার সম্পর্কে বলেছেন ‘আমাদের শেখভ’। এই তুলনা আপনার কেমন লাগে?

মুনরো : সম্প্রতি আমি শেখভের লেখাগুলো আবার পড়েছি। সে অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে নতজানু হওয়ার। শেখভ যেহেতু আমাদের সকলকেই প্রভাবিত করেছেন, আমি প্রভাবক হিসেবে তাঁকে দাবি করিনি। শেক্সপিয়রের রচনার মতো তাঁর লেখা জীবনের ওপর সবচেয়ে যথার্থ আলোকসম্পাত করেছে – এর জন্য প্রাণপণ চেষ্টার কোনো প্রয়োজন নেই, ব্যক্তিত্ব বিসর্জনের ব্যাপার নেই। অবশ্যই, এ তুলনা আমি কেন পছন্দ করবো না!

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : আপনার লেখায় আপনার স্মৃতির ভূমিকা সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন।

মুনরো : আমি যখন লিখতে শুরু করি, তরুণ লেখক হিসেবে আমার গল্পগুলোর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো সম্পর্কই ছিল না, আমার গল্প ও চরিত্রগুলো অনেকটা দক্ষিণাঞ্চলীয় ধরনের ছিল। অস্বাভাবিক, নিঃসঙ্গ ও বেমানান। সেসব চরিত্রের জীবন সরলরেখায় প্রকাশ করা যেতো। আমি তিরিশের কোটায় না পৌঁছা পর্যন্ত জীবনের অতীত নিয়ে অনুসন্ধানমূলক গল্প লিখতে পারিনি।

আমি যখন আমার অতীত নিয়ে লিখতে শুরু করি আমি শৈশব নিয়ে লিখেছি। বর্তমান নিয়ে আমি প্রায়শ তেমন কোনো গল্প লিখি না। আমার গল্পে কেউ ই-মেইল পায় না, কারণ আমিও ই-মেইল পাই না। আমি আমার এখনকার ব্যাপারটা জানি না – এখন থেকে পাঁচ বছর আগে পর্যন্ত সময়েরও না। কাহিনিকে কিছুটা প্রজ্বলিত করতে আমাকে আরো অতীতে প্রবেশ করতে হয়। আমি প্রায়ই ১৯৬০ দশকের কথা লিখি। তখন আমি একজন যুবতী। আমার রানওয়ে গ্রন্থের গল্প ‘ট্রেসপাসেস’ ১৯৬০ দশক থেকে বেরিয়ে এসেছে। সেখানে গল্পের বাবা চরিত্রটির একটি স্বপ্ন আছে, সে-সময়কার পরিভাষা তাতে রয়েছে – গল্পটি সম্ভবত ১৯৮০ দশকের প্রেক্ষাপটে স্থাপন করা হয়েছে।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : আপনার গল্পের চরিত্র বড়ো বেশি ঝুঁকি নিয়ে থাকে।

মুনরো : হ্যাঁ, আমি যখন গল্প লিখি, আমি ঠিক এভাবে চিন্তা করি না যে, এই মানুষগুলো ঝুঁকি নেবে। লেখার সময় এটা হয়তো আমার নজরেই আসে না। তবে আমার নিজের জন্য লেখার এটা একটা বিষয়। আমি দেখতে চাই মানুষকে তাদের জীবনের কোনো পর্বে, যেখানে তাদের কোনো একটা সিদ্ধান্ত হচ্ছে। তারপর যেমন ধরা যাক, মেয়েটি কী করতে চায় তার একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, তখন একটি চরিত্র খুঁজে বের করে কেন সে তা করতে পারবে না। এটা তাকে অবাক করে দেয়।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : …কম বয়সেই আপনি লেখক হতে চেয়েছেন, সেই পথই ধরেছেন। সময়ের সঙ্গে আপনি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। কাজেই মানুষের এমন কিছু তাড়না রয়েছে যা কখনো দমে যায় না।

মুনরো : তা সত্যি। তবে ব্যাপারটা আমার পরিবারেই ছিল। মৃত্যুর আগে আমার বাবা একটি বই লিখে গেছেন – অগ্রগামী জীবন নিয়ে একটি উপন্যাস। সারাজীবন তিনি একজন কঠোর পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন, তিনি দু-তিন বছর হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছেন, মেধাবীও ছিলেন। কিন্তু অনেক কম বয়সেই তাঁকে কৃষিতে জীবিকা নির্বাহ করার জন্য নেমে পড়তে হয়; কিন্তু জীবনের শেষ বছর সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁকে একটি বই লিখতে হবে। তিনি তাই করলেন। তাঁর লেখা খুবই ভালো। উপন্যাসটি সনাতন ধাঁচের, কিন্তু ভাষার জন্য তার যে অনুভব, যা অন্যদের রপ্ত করতে হয়, এর পুরোটাই সেখানে ছিল।

 

উপন্যাসের ক্ষতিপূরণ ছোটগল্পে

অ্যালিস মুনরো নিউ ইয়র্কারকে এক বছর আগে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন : বছরের পর বছর ধরে আমি ভেবেছি ছোটগল্প হচ্ছে উপন্যাসে হাত দেওয়ার আগ পর্যন্ত হাত পাকানোর চর্চা। তারপর দেখলাম আমি এ পর্যন্তই পারি। কাজেই আমি এরই মোকাবিলা করলাম। আমার ধারণা, সে ক্ষতিপূরণের জন্যই আমি গল্পের ভেতর এতোটা জড়িয়ে পড়েছি।

তাঁর কাছে স্মৃতি হচ্ছে নিজেকে নিজের গল্পগুলো শোনানো আর অন্যদের শোনানো একটু ভিন্নভাবে।