এক দ্বিমাত্রিক সম্পর্কের বলয়

সৈয়দা আইরিন জামান

 

একজন ত্যাগী সন্ন্যাসী ও অন্যজন সংসারী রাজা – শতাব্দীর দুজন অবিস্মরণীয় প্রদীপ্ত পুরুষকে একই বলয়ে অধিভুক্ত করেছেন অধ্যাপক মুকুল বন্দ্যোপাধ্যায়। বিষয়টি আরোপিত নয়, স্বতঃপ্রণোদিত।

আলোচ্য গ্রন্থটির নাম সন্ন্যাসী ও রাজা – স্বামী বিবেকানন্দ ও মহারাজা অজিত সিংহ। সন্ন্যাসী হলেন ক্রান্তদর্শী এক যুগপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ আর রাজা হলেন ভারতের রাজস্থানের খেতড়ীর মহারাজা অজিত সিংহ। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, সারদা মা, স্বামী বিবেকানন্দ এবং ভগিনী নিবেদিতাকে নিয়ে বিগত একশ বছরে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এরপরও ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত সন্ন্যাসী ও রাজা গ্রন্থটি হাতে নেওয়ার আগ পর্যন্ত পাঠকের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয় যে, কত অজানা প্রদেশ তাঁর আয়ত্তের বাইরে রয়ে গেছে! পাঠক হিসেবে আমিও সেই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। সাধারণভাবে আমরা জানি যে, ১৮৯৩-এর ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার শিকাগোয় অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে স্বামীজির বিশ্বজয়ের কথা আর সেই বিশ্বজয়ের সঙ্গে খেতড়ীর রাজার আর্থিক ও হার্দিক সহযোগিতার বিষয়টি। স্বামী বিবেকানন্দের বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে বক্তৃতা-প্রদান এবং সেই সুযোগ-উত্তীর্ণ ঘটনাকে অবলম্বন করে সমগ্র ভারতবর্ষের আত্মআবিষ্কার আমাদের জানা। কিন্তু ওই মঞ্চ অবধি স্বামীজিকে পৌঁছে দেওয়ার কাজে যে-মানুষটি ছিলেন আত্মনিবেদিত সেই খেতড়ীর মহারাজা অজিত সিংহ বাঙালির কাছে বিস্মৃত অধ্যায়। অথচ স্বামীজির বিদেশে বসবাসকালে ভারতে তাঁর ঠিকানা হয়ে উঠেছিল খেতড়ী। এমনকি যে রামকৃষ্ণ মিশনের মহৎ সেবাধর্মে আজ সমগ্র বিশ্ব বিমোহিত তারও শুভ সূচনা ঘটেছিল রাজস্থানের ওই মরু শহর থেকেই। যে-সুশোভিত পোশাকে আমরা স্বামীজিকে দেখতে অভ্যস্ত তার পরিকল্পনা ও প্রস্ত্ততকরণ – সেই মহারাজারই অবদান। আমেরিকা প্রবাসে বিবেকানন্দ যখনই কোনো সমস্যায় পড়েছেন তখনই সাধ্যাতীত তৎপরতায় এগিয়ে এসেছেন মহারাজা অজিত সিংহ। পরবর্তীকালেও স্বামীজি পাশে পেয়েছেন এই ভক্ত সুহৃদটিকে। ভুবনেশ্বরী দেবীকে আজীবন মাসোহারা বাবদ একশ টাকা প্রদান থেকে শুরু করে গুরুভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ, ভূপেন্দ্রনাথের অভিভাবকত্ব এবং প্রয়োজনে তাঁদের শিক্ষার অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান সর্বত্রই অবদান অজিত সিংহের।

অধ্যাপক মুকুল বন্দ্যোপাধ্যায় অশেষ পরিশ্রম ও অপরিসীম নিষ্ঠায় স্বামী বিবেকানন্দ ও মহারাজা অজিত সিংহকে নিয়ে এই গবেষণাধর্মী গ্রন্থটি রচনা করেছেন।

শ্রীমতী বন্দ্যোপাধ্যায় ৪০৪ পৃষ্ঠার সুবৃহৎ গ্রন্থে ৩৩টি অধ্যায়ে স্বামীজির পরিব্রাজক-জীবন ও খেতড়ীর মহারাজার সঙ্গে তাঁর হার্দিক পর্বের পরম্পরার পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস তুলে ধরেছেন অনাড়ম্বর সুন্দর এক ভাষায়। গ্রন্থের প্রারম্ভে লেখক বলেছেন : ‘শ্রীরামকৃষ্ণ যিশুখ্রিষ্ট হলে বিবেকানন্দ তাঁর সেন্ট পল। অবতার পুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের প্রয়োজন ছিল এক প্রচারক শিষ্যের। বিবেকানন্দ ছিলেন তাঁর গুরুসত্তার পরিপূরক শক্তি। সেভাবেই বলা যায় মহারাজা অজিত সিংহ ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের সেন্ট পল। মহারাজা অজিত সিংহ ছাড়া তাঁর মিশন সাফল্য পেত না। সম্ভবই ছিল না।’ – বেণীশংকর শর্মার এই উচ্চারণে আবেগ আছে, অতিশয়োক্তি নেই। লেখক উদ্ধৃত এই অংশটি বেণীশংকর শর্মার ইংরেজিতে লেখা গ্রন্থ Swami Vivekananda : A Forgotten Chapter of His Life থেকে নিয়েছেন।

স্বামীজি খেতড়ীতে প্রথম এসেছিলেন ১৮৯১ সালে, যখন তিনি গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের দেহাবসানের (১৬ আগস্ট ১৮৮৯) তিন বছর পর পরিব্রাজকরূপে তাবৎ ভারতবর্ষ সফর করেন। সেই সময়ে তাঁর নিবিড় সখ্য হয় খেতড়ীর মহারাজা অজিত সিংহের সঙ্গে। সেই বন্ধুত্ব অক্ষুনণ ছিল মহারাজার মৃত্যুর আগপর্যন্ত (১৮ জানুয়ারি ১৯০১)। স্বামীজি তাঁর এই অকৃত্রিম বন্ধু ও অদ্বিতীয় ভক্তের মৃত্যুতে দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত হয়েছিলেন।

এ-গ্রন্থে যতটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র স্বামীজি, ততটাই মর্যাদার আসন অলংকৃত করে  আছেন মহারাজা অজিত সিংহ, খেতড়ীর নরেশ। স্বামীজির ভাষায় : ‘পৃথিবীতে যা কিছু করতে পেরেছি তা আপনার সাহায্যেই সম্ভব হল। আপনি আমাকে নিদারুণ দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলেন। জগতের সম্মুখীন হবার সুযোগ দিলেন।’ আবার অন্যত্র বলেছেন, ‘আমি এবং আপনি পরস্পরের পরিপূরক। আমরা দু’জন একত্র মহৎকর্ম করবার জন্য জন্মগ্রহণ করেছি।’ বিবিদিষানন্দ থেকে সচ্চিদানন্দ হয়ে বিবেকানন্দ নামে স্বামীজির যে মহাযাত্রা এবং উত্তরণ তার পথনির্দেশনা তো মহারাজা অজিত সিংহেরই। মহারাজা অজিত সিংহ ও তাঁর প্রধানমন্ত্রী দুজনেই স্বামীজির কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। সেই নিরিখে স্বামীজি ও মহারাজার মধ্যে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক। কিন্তু স্বামীজি মহারাজাকে পরম বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

স্বামীজি বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে যোগদানের আগে এবং পরে দুই পর্বে দীর্ঘ সময় খেতড়ীতে থেকেছেন। খেতড়ীকে কেন্দ্র করে তিনি প্রায় সমগ্র রাজস্থান পর্যটন করেছেন। খেতড়ীতে প্রথমবার এসে স্বামীজি সর্বশ্রেষ্ঠ বৈয়াকরণের শিষ্য হয়ে পতঞ্জলির পাঠ শেষ করেছিলেন।

গুরু ও শিষ্য উভয়ই ছিলেন সংগীতপ্রেমী, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিবিধ স্তরে অনুসন্ধিৎসু এবং অতীত ইতিহাস সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল। প্রাচীন স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যশিল্পে আগ্রহী। তাই উভয়ে ভিন্ন বলয়ের পথিক হয়েও এতটা হৃদয়ের কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন। উল্লেখ্য, মহারাজা অজিত সিংহ ছিলেন প্রজাদরদি সুশাসক। প্রগতিমনস্কতা ছিল তাঁর মননের অন্তস্তলের স্বর্ণফসল। তাই অবলীলায় কালাপানি পার হয়ে তিনি পৌঁছে যান মহারানি ভিক্টোরিয়ার আহূত সম্মাননা সভায়।

মহারাজা অজিত সিংহের জীবনচর্যা, সর্বোপরি স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিস্তারিত বিবরণ এই গ্রন্থের বিশেষ সম্পদ। সেই সঙ্গে রয়েছে খেতড়ী রাজ্যের অতীত থেকে বর্তমান অভিযাত্রার এক আনুপূর্বিক রেখচিত্র। মহারাজার পারিবারিক সদস্যদের ঘটনাময় জীবনের নানা অভিঘাত, এমনকি রাজবংশের ট্রাজিক পরিসমাপ্তি, কোনো আখ্যান থেকেই পাঠককে বঞ্চিত করেননি লেখক। উপরন্তু ‘খেতড়ী ও নেহেরু পরিবারে’র মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অধ্যায় রচনার জন্য লেখক তিন বছর ধরে বারবার খেতড়ী ও রাজস্থানের বিসত্মীর্ণ অঞ্চলে স্বামীজির পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঘুরে বেড়িয়েছেন। নানা সরকারি মহাফেজখানায় সংরক্ষিত বিবেকানন্দ-সম্পর্কিত বহু দলিল-দস্তাবেজ সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘ওয়াকিয়াতনামা’ (Waquate Register) – খেতড়ীর মহারাজার রোজনামচা। কেমন ছিল সেই দিনলিপি? রাজস্থানি কথ্যভাষায় লেখা সেই দিনলিপির বাংলা অনুবাদ :

‘পৃষ্ঠা ১২৬ : ৬ জুন ১৮৯১ শনিবার (মিতি জেঠ বাদী ১৪, সম্বত ১৯৪৭) মোকাম (স্থান) আবু : শ্রীশ্রী হুজুর ভোর পাঁচটায় উঠে হাতমুখ ধুলেন। সাতটায় প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে অনেকগুলি বাড়ি পরিদর্শন করলেন। ৯টায় এসে চিঠিপত্র লিখলেন। দশটায় সাধু বিবেকানন্দজী এলেন। (এই প্রথম বিবেকানন্দ নামটি উলিস্নখিত হচ্ছে) সাড়ে দশটায় আহার সেরে সাধুজীর সঙ্গে সংস্কৃত এবং ইংরেজিতে বার্তালাপ করলেন। ১টায় বিশ্রাম করতে গেলেন।’

এই বিশাল ইতিহাস-তন্তু বয়নের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে উঠেছে বহু অপ্রকাশিত চিঠি, খেতড়ী রাজ্যের অসংখ্য সরকারি নথি, সর্বোপরি লেখকের সশরীর খেতড়ী পরিভ্রমণ। বহু ফটোগ্রাফ গ্রন্থের মূল্য বাড়িয়েছে। ক্ষক্ষত্র-সমীক্ষা যে কত নিবিড় হতে পারে তার সার্থক উদাহরণ এ-গ্রন্থ। তথ্য নিয়ে কাজ করতে করতে তার কতটা গভীরে প্রবেশ করা যায় এবং তথ্যকে সত্যের আসনে উপস্থাপন কীভাবে করা যায় তাও এ-গ্রন্থের কাছে শিক্ষণীয়। উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা যায় ‘স্বামীজী – ময়নাবাঈ’ আখ্যান এবং ‘নৈনিতালে মহারাজার আতিথ্য’ অধ্যায়।

এ-গ্রন্থের আরেকটি দুর্লভ সম্পদ হলো, লেখক যেসব দলিল-দস্তাবেজ সংগ্রহ করেছেন তার গুরুত্বপূর্ণ সবকিছুই জেরক্স করে তিনি পরিশিষ্ট অংশে সংলগ্ন করেছেন। সেখানে আমরা স্বামীজি, মহারাজা, মহেন্দ্রনাথ দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ ব্যক্তির মূল চিঠি এমনকি ১৯৯৪ সালের ১১ মার্চ দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে রামকৃষ্ণদেবের জন্মোৎসব পালনের জন্য খেতড়ীর মহারাজাকে আমন্ত্রণ ইত্যাদি তথ্যও পাই। রীতিমতো দুর্লভ অভিজ্ঞতা। আসমুদ্র হিমাচলব্যাপী কাহিনির বিসত্মীর্ণ প্রেক্ষাপট এবং অসংখ্য চরিত্রের অভূতপূর্ব সমাবেশ অত্যন্ত প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে লেখকের মনোজ্ঞ গদ্যে।

সিগনেট প্রেসকে নিশ্চিতভাবে অভিনন্দন জানাতে হয় গ্রন্থটির সার্বিক দৃষ্টিনন্দন উপস্থাপন এবং নিরলংকৃত অনন্য প্রচ্ছদের জন্য। বিশেষত প্রচ্ছদে ব্যবহৃত সুষম রঙের বিন্যাস মেধা ও মননকে শান্তি ও তৃপ্তি দেয়।

সার্বিকভাবে এই গ্রন্থপাঠ এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভক্তি আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ সৈনিক অজিত সিংহকে যথার্থরূপে জানতে ও বুঝতে হলে এ-গ্রন্থের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোনো পথ থাকে না। বাংলা ভাষায় এ-কাজটি এতদিন পর্যন্ত আর কেউ করেননি। সেদিক থেকে এই গ্রন্থ এক ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার স্বাক্ষর হয়ে উঠেছে।