এপিকধর্মী একটি উপন্যাস

মহি মুহাম্মদ

 

একলব্য

হরিশংকর জলদাস

অন্যপ্রকাশ

ঢাকা, ২০১৬

৪৫০ টাকা

 

একলব্যের কাহিনির উৎস মহাভারত।

মহাভারতের কাহিনি নিয়ে এপারে আর কেউ উপন্যাস রচনা করেছেন কিনা তা আমার জানা নেই। সে হিসাবে একলব্যই প্রথম। অর্থাৎ এপারে মহাভারতের কাহিনি নিয়ে উপন্যাস রচনা একলব্যের মধ্যে দিয়ে শুরু হলো। হরিশংকর জলদাস (১৯৫৫) বিষয়ধর্মী উপন্যাস রচনায় সিদ্ধহস্ত। এর আগেও তিনি এর যথার্থ প্রমাণ রেখেছেন। যার ফলে আমরা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি জলপুত্র (২০০৮), দহনকাল (২০১০), কসবি (২০১১), রামগোলাম (২০১২) ও মোহনার (২০১৩) মতো উপন্যাস। এবার তিনি লিখলেন – একলব্য (২০১৬)।

এতে চবিবশটি চ্যাপ্টার রয়েছে। প্রতিটি চ্যাপ্টার শুরু হয়েছে কবিতা দিয়ে। এ কবিতাগুলো অধিকাংশ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। কিছু নেওয়া হয়েছে মহাভারত থেকে। আর কয়েকটির রচয়িতা লেখক নিজে। তবে উপন্যাসের কোথাও কবিতার উৎস সম্পর্কে জানান দেওয়া হয়নি। প্রতিটি চ্যাপ্টারের বিষয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে কবিতা যোগ করা হয়েছে। মহাভারতে খুব স্বল্প স্থান জুড়ে রয়েছে নিষাদপুত্র একলব্যের কথা। সেখানে দেখা যায়, নিষাদপুত্র ধনুর্বিদ্যা শেখার জন্য আর্য ধনুর্বিদ আচার্য দ্রোণের কাছে যায়। কিন্তু নিচু জাতের নিষাদপুত্রকে দ্রোণাচার্য শিক্ষা দিতে অস্বীকৃতি জানান। সেই ছোট্ট কাহিনিটির একটি পূর্ণাবয়ব দিয়েছেন ঔপন্যাসিক হরিশংকর জলদাস। বিন্দু থেকে সিন্ধু সৃষ্টির এই কঠোর শ্রম দিয়েছেন। যার ফলে বাংলা সাহিত্যের পাঠক একটি ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাস পেল। প্রামিত্মক সমাজের প্রতিনিধি একলব্য। তার মধ্যে নিষ্ঠা আছে। আছে ধৈর্য। সে সাহসী যোদ্ধা। ঔপন্যাসিক শ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে তাকে নতুন রূপে নির্মাণ করেছেন।

 

দুই

হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য নাম।

দ্রোণের চরণে আসি করিল প্রণাম \

যোড়হাত করি বলে বিনয় বচন।

শিক্ষাহেতু আইলাম তোমার সদন \

দ্রোণ বলিলেন তুই হোস্ নীচ জাতি।

তোরে শিক্ষা করাইলে হইবে অখ্যাতি \

: আদি পবর্ব, মহাভারত।

কাশীরাম দাসের মহাভারত থেকে নেওয়া কতিপয় পঙ্ক্তি ভূমিকায় উলেস্নখ করা হয়েছে।

উপন্যাসের শুরুতেই আমরা দেখি এক উজ্জ্বল, আলোকিত সকালে একলব্য পিতা হিরণ্যধনুর কাছে বিদায় নিতে এসেছে। মুগ্ধকর বর্ণনায় একলব্যের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় সম্পন্ন হয়। আমরা দেখতে পাই একলব্য পিতার কাছে অনুমতি চাইতে এসেছে তার মনোবাসনা পূর্ণ করবে বলে।

সকাল। উজ্জ্বল, আলোকিত।

‘বাবা, আপনি যতই নিষেধ করেন,  আমি মানব না।’

চমকে উঠলেন হিরণ্যধনু। বললেন, ‘মানবে না! কেন মানবে না আমার নিষেধ!’

‘আপনার নিষেধ আমার বাসনা পূরণের অন্তরায়।’

‘বাসনা পূরণের অন্তরায়! আমার সাবধানবাণী তোমার বাসনা পূরণের অন্তরায়! তুমি এসব কী বলছ একলব্য?’ চিত্তচাঞ্চল্যে হিরণ্যধনুর কণ্ঠ বুজে এলো।

(একলব্য, পৃ ৯)

কাহিনির শুরু হয়েছে এভাবে। কিন্তু হিরণ্যধনু পুত্র একলব্যকে কিছুতেই ছাড়তে রাজি নন। কারণ দ্রোণাচার্য নিষাদপুত্র একলব্যকে কোনোদিন অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দেবে না। কিন্তু একরোখা একলব্য কিছুতেই বারণ শুনবে না।

হিরণ্যধনু জানে, আর্যরা শূদ্রদের অবজ্ঞা করে। পুত্র একলব্যকে আর্য নৃপতি লালিত ব্রাহ্মণ দ্রোণাচার্য কিছুতেই অস্ত্রশিক্ষা দেবে না। তাদের মনোভাব অহংকারে পূর্ণ। রামায়ণে ব্রাহ্মণ বাল্মীকি রাবণকে বীভৎসভাবে এঁকেছেন। রাবণকে রিরংসাপরায়ণ হিংস্র একজন রাজা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু রামের ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে কোনো সংশয় প্রকাশ করেননি। রাম যদি ন্যায়পরায়ণ হতেন তবে নিরপরাধ বালীকে হত্যা করতেন না। অপাপবিদ্ধা সীতাকে গর্ভবতী অবস্থায় চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে বনবাসে পাঠাতেন না। এমনকি শাস্ত্রজ্ঞ শম্বুক মুনিকেও হত্যা করতেন না। – এইসব কারণে পিতা হিরণ্যধনু পুত্র একলব্যকে ব্রাহ্মণের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতে যেতে দিতে চান না।

কিন্তু যুক্তি দেখিয়ে হিরণ্যধনুর পিতা অনোমদর্শী ব্যাখ্যা দিলেন :

‘আর্যরা এদেশে বহিরাগত। যাযাবর তারা। ঊষর দেশ থেকে তারা এই ভারতবর্ষে এসেছে। এ দেশের শস্যশ্যামল রূপ দেখে, ফুলে ফুলে পূর্ণ মাঠ দেখে, জলপূর্ণ নদী দেখে উৎফুল্ল হয়েছে তারা। উলস্নাস একটু সিত্মমিত হয়ে এলে তারা বুঝেছে – এ ফসল, এ উর্বর জমি, এ নদী, বৃক্ষ-অরণ্য তো তাদের নয়। এগুলোর মালিক তো এ দেশেরই আদিবাসী। সুতরাং ওদের মেরেকেটে এগুলো দখল কর। হিংস্রতা দেখিয়ে, বর্বরতার আশ্রয় নিয়ে নগর-ফসলি মাঠ নিজেদের অধিকারে আনো। এটা সত্য যে, ভারতবর্ষের আদিবাসীরা যুদ্ধে তেমন দক্ষ নয়। প্রতিবেশী রাজাদের সঙ্গে ছোটখাটো যুদ্ধ ছাড়া তো বড় কোনো যুদ্ধ তাদের করতে হয়নি। আর্যরা ঘোড়াকে পোষ মানিয়ে নিজেদের বাহন করেছে। নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কার করেছে। অসি চালনায় অত্যন্ত দক্ষ তারা। আমরা নিষাদ। আমাদের বিশ^াস ছিল, তীর চালনায় নিষাদরা বুঝি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু আর্যদের সঙ্গে সমরে লিপ্ত হয়ে বুঝেছি, তীর চালনায় অতুলনীয় দক্ষ তারা। তারাই শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ।’               (একলব্য, পৃ ১৪)

তিনি আরো বললেন, তীর চালনায় প্রকৃত বিদ্যে ওদের অহংকার। এটা ওদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। বর্তমানে ভারতবর্ষে দ্রোণাচার্যের চেয়ে বড় কোনো অস্ত্রগুরু নেই। তাই একলব্য যদি তাঁর কাছ থেকে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে পারে তাতে নিষাদপক্ষের লাভ। একলব্য নিষাদদের মধ্যে এসে সেই ধনুর্বিদ্যা ছড়িয়ে দিতে পারবে। নিষাদরাও অস্ত্রবিদ্যায় আর্যদের সমকক্ষ হয়ে উঠবে।

অনোমদর্শীর এ-কথার পর আর কোনো বাধা রইল না। একলব্য রওয়ানা হলো হসিত্মনাপুরের দিকে। তারপর একলব্য পাহাড়-অরণ্য ডিঙাতে লাগল। সঙ্গে যে রাজসৈন্য ছিল কৌশলে তাদের বিদায় জানাল। একলব্য কারো সঙ্গে হসিত্মনাপুর যেতে চায় না। নিজেই হসিত্মনাপুর পৌঁছবে সে। রাত হলে সে মুনি-ঋষিদের আশ্রমে রাত কাটায়। এভাবে সে  পথ পরিক্রমণ করতে লাগল। শা–ল্য মুনির আশ্রমে একলব্য আশ্রয় পেয়েছিল। সেখান থেকে পথে বেরিয়ে সে দেখতে পেল আগুনের লেলিহান শিখা। নাকে এলো লতাপাতা পোড়ার গন্ধ। দ্রম্নত পায়ে একলব্য এগিয়ে গেল। সে দেখতে পেল একটি আশ্রম দাউ-দাউ করে জ্বলছে। উঠানে জিনিসপত্র ছড়ানো-ছিটানো। কয়েকজন ঋষির মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে। আর আশ্রমের চতুর্দিকে একদল নিষাদ উলস্নাস করছে। একলব্য ব্যাপারটি বুঝতে পেরে শক্ত হাতে নিষাদদের দমন করল। নিষাদদের হয়ে ঋষি জৈমিনীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল। তার পর ঋষির আশ্রম নির্মাণ করতে সহযোগিতা করল।

 

তিন

নিষাদপুত্র একলব্য। সে ধনুর্বর।  গুরুর পদবাচ্যে অপমানিত হয়েও সে বিফল হয়নি। কঠোর সাধনা ও অধ্যবসায়ের ফল  সে লাভ করেছে। একরোখা, গোঁয়ার একলব্য তার চেষ্টায় উত্তীর্ণ হয়েছে। উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই বহু পাহাড়-অরণ্য পেরিয়ে সে যখন হসিত্মনাপুর আচার্যের অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষণ আশ্রমে গিয়ে পৌঁছল তখন সবাই তাকে দেখে বিস্মিত হলো। যদিও সে তীর ছুড়ে সবার নজর কেড়েছিল। কিন্তু দ্রোণাচার্য তাতেও  তাকে শিক্ষার্থী হিসেবে নিতে সম্মত হলেন না। একলব্য নিষাদ। সে অনার্য। সে আর্যদের সঙ্গে বসে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করতে পারে না। মার্জিত, শীলিত একদল আর্যসন্তানের সঙ্গে একজন কালো দেহের অনার্য সন্তান পাঠ নিতে পারে না। আচার্যের মধ্যে জাতিবিদ্বেষ প্রচুর। এই শ্রেণিবৈষম্যবোধ দ্রোণের মধ্যে প্রকট বিধায় তিনি একলব্যকে বলেন – ‘হীনবংশে তোমার জন্ম। নীচ জাতি তুমি। অপাঙ্ক্তেয় কোনো জনগোষ্ঠীর সন্তানকে আমি অস্ত্রশিক্ষা দিই না।’

বিফল মনোরথে ফিরে যায় একলব্য। কিন্তু সে ফিরে না নিজ রাজ্যে। সে গভীর অরণ্যে দ্রোণের মূর্তি গড়ে সাধনা চালায়। একপর্যায়ে সে উত্তীর্ণ হয়। দ্রোণের চাইতেও অনেকাংশে  বেশি কৌশল রপ্ত করল। অর্জুন যখন জানতে পারল একলব্য তার চেয়েও অনেক বেশি কুশলী ধনুর্বিদ তখন সে মনঃক্ষুণ্ণ হলো। এবং দ্রোণকে সে একলব্যের বিষয়টি দেখাতে গভীর সেই অরণ্যে নিয়ে গেল। একলব্য গুরুকে দেখে অভিভূত হলো। কিন্তু দ্রোণ কিছুতেই একলব্যকে শিষ্যের মর্যাদা দিলেন না। বরং না শিখিয়েও তার কাছ থেকে গুরুদক্ষিণা চেয়ে বসলেন। এই গুরুদক্ষিণার পেছনে অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব বহাল রাখার চিন্তাও যেন রয়েছে। না হলে কোনো গুরু শিষ্যের জীবন সংকটাপন্ন করে তার গুরুদক্ষিণা আদায় করতে পারেন না। আচার্য দ্রোণ তাই করলেন। তিনি একলব্যের ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল চেয়ে বসলেন। গোঁয়ার একলব্য দ্রোণের চালাকি বুঝল না। গুরুদক্ষিণা দিলে যদি গুরুর স্বীকৃতি মেলে তাই সে দিয়ে দিলো তার ডান হাতের বৃদ্ধ আঙুল।

‘কোমরে গোঁজা টাঙ্গিটা টেনে বের করল একলব্য। তারপর উঠানের এক প্রান্তে দৃঢ় পদক্ষিপে হেঁটে গেল। কদলিবৃক্ষের নিকটেই গেল সে। একটা নবীন কদলিপত্রের অগ্রভাগ সেই টাঙ্গি দিয়ে কেটে নিল। তারপর গেল জলভর্তি কলসির কাছে। পত্রআগাটি ভালো করে ধুয়ে ফেলল। অপরিষ্কার কোনো পত্রের ওপর তো আর গুরুদক্ষিণা দেওয়া যায় না। আসেত্ম-আসেত্ম দ্রোণাচার্যের পায়ের কাছে এগিয়ে গেল একলব্য। হাঁটু গেড়ে বসল। কদলিপত্রটি পায়ের কাছে রাখল। তারপর একটানে নিজের ডানহাতের বুড়ো আঙুলটিকে কেটে ফেলল। ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। কলাপাতাটি ঘন লালরক্তে ভরে উঠল। সেই রক্তের মাঝখানে একলব্য তার কর্তিত আঙুলটি রাখল। অবিচলিত মুখ তার, স্থির চোখ। তার শরীরটি থিরথির করে কাঁপছে।

হঠাৎ হা-হা করে হেসে উঠল অর্জুন। দ্রোণাচার্য একপলকের জন্যও একলব্যের কর্তিত আঙুলটির দিকে তাকালেন না। হনহন করে উলটো দিকে হাঁটা শুরু করলেন তিনি। উঠানের মাঝখানে, সারা গায়ে সূর্যকিরণ মেখে, নিজের কর্তিত রক্তাক্ত বুড়ো আঙুলের সামনে, নির্বাক হয়ে বসে থাকল একলব্য।’ (একলব্য, পৃ ১৪৬)

আপনমনে পরের দিন একলব্য গুরুর হীন স্বার্থের কথা উপলব্ধি করতে পেরেছে। তখন সে গুরুর মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে স্বগতোক্তি করেছে –

‘আপনি মানুষ? আপনি গুরু? মানুষ তো বটেই। মানুষ না হলে গুরু হলেন কী করে? তবে আপনি সাধারণের গুরু নন। উঁচুবর্ণের গুরু আপনি। নিজে দরিদ্র হয়েও ধনীদের দিকে পক্ষপাতিত্ব আপনার। অতিসহজেই অতীতকে ভুলেছেন আপনি।’

(একলব্য, পৃ ১৫১)

এই সময় একলব্য বন্ধু হিসেবে কর্ণকে পেয়েছিল। কর্ণের প্রতি সেও ছিল অনুরক্ত। তাই পরবর্তীকালে আমরা কর্ণের সঙ্গে একলব্যকে যোগ দিতে দেখি। সে কুরুদের পক্ষে পা-বদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।

 

চার

একলব্য ছাড়াও এ উপন্যাসে আচার্য দ্রোণ, অর্জুন, কর্ণ, কৃষ্ণ, রাজা দ্রম্নপদ, ভীম, রাজা হিরণ্যধনু প্রভৃতি চরিত্র ঝিলিক দিয়ে উঠেছে। বিশেষ করে দ্রোণাচার্য, অর্জুন ও কর্ণের কথা না বললেই নয়! দ্রোণাচার্য উপন্যাসের চালিকাশক্তি। একলব্যের গন্তব্য দ্রোণাচার্যের দিকে। দ্রোণাচার্য চায় রাজা দ্রম্নপদের দম্ভ ধ্বংস করতে। ঘৃতাচি আর ভরদ্বাজের মানসিক মিলনের সন্তান দ্রোণ। শৈশবে জননীর সেণহ বঞ্চিত দ্রোণ। পিতার সেণহও তেমন করে পায়নি।

ব্রাহ্মণদের কাজ বেদ-বেদাঙ্গ পাঠ করা। শাস্ত্র অনুশীলন করা। ব্রাহ্মণ ধনলোভী হয় না। অস্ত্রশিক্ষা তাদের কাজ নয়। কিন্তু দ্রোণের  ক্ষেত্রে এসব হয়ে ওঠেনি। দারিদ্রে্যর কশাঘাতে জর্জরিত দ্রোণ পরবর্তীকালে ধনলোভী হয়েছে, গ্রন্থ ত্যাগ করে অস্ত্রবিদ্যা শিখেছে। তাঁর কণ্ঠে যেসব অস্ত্রের নাম উচ্চারিত হয়েছে সেগুলো হলো – তীর, ধনুক, চক্র, জাঠি, জাঠা, গদা, শূল, ত্রিশূল, বর্শা, কুঠার, খড়গ, অসি, হল্। সেইসঙ্গে কয়েকটি বাণের নামও উলেস্নখ করা হয়েছে – নারাচ, অর্ধচন্দ্র ও ক্ষুরপাদি। এ-উপন্যাসে কয়েকটি নদীর নামও উঠে এসেছে। যেমন – গঙ্গা, সরস্বতী, কোপবতী, দৃষদ্বতী।

অর্জুন চায় দ্রোণের একমাত্র শক্তিশালী ধনুর্বর শিষ্য যোদ্ধা হতে। সে ভারত উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ হতে চায় এবং তাঁর সমকক্ষ যেন কেউ না থাকে। যুদ্ধে আমরা কর্ণকে নিরস্ত্র অবস্থায় কৃষ্ণের প্ররোচনায় মু- ছেদন করতে দেখি।
সে হিসেবে সে বীরোচিত সম্মান পায় না। এই চক্রে উপন্যাসটি পাঠযোগ্য হয়ে ওঠে। কাহিনির চক্রে সাজিয়ে ঔপন্যাসিক আমাদের শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যান।

দুর্যোধন কর্ণকে শক্তিমান বীর হিসেবে স্বীকার করেছে। অর্জুনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করায় দ্রোণের পাঠশালা ত্যাগ করেছিল কর্ণ। কর্ণ পরশুরামের কাছে গিয়েছিল অস্ত্রবিদ্যা শিখতে। দ্রোণের অস্ত্রগুরুও এই পরশুরাম। নিজ পরিচয়  গোপন রেখে সে শিখেছে গুরুর কাছে। কিন্তু পরশুরাম কর্ণের পরিচয় জানতে পেরে তাকে অভিশাপ দিয়েছে। কর্ণ ফিরে এসেছে হসিত্মনাপুরে। দ্রোণাচার্যের পাঠশালায় তখন অন্যদের শিক্ষা সমাপন হয়েছে। রঙ্গভূমিতে দ্রোণাচার্য কুরুপুত্রদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ অবলোকনের ব্যবস্থা করেছেন। কর্ণ এসে সেখানে বাগড়া দিয়েছে। সে কিছুতেই মানতে নারাজ যে একমাত্র অর্জুনই শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ। সেও পরশুরাম থেকে অস্ত্রবিদ্যা শিখে এসেছে। সেও কোনো অংশে কম নয়। অথচ গুরু দ্রোণ তার স্বার্থসিদ্ধির জন্য শুধু অর্জুনকেই শ্রেষ্ঠত্বের তকমা এঁটে দিতে চান। অর্জুনের সাহায্যে নিজের আকাঙক্ষার অনেকটা সফল করেছিলেন গুরু দ্রোণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা রক্ষা হয়নি। কন্যা  দ্রৌপদীকে অর্জুনের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে নিজের দল ভারি করেছে দ্রম্নপদ। পরবর্তীকালে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দ্রোণ পরাজিত হয়েছে। কূটচালের বেড়াজালে
কৃষ্ণও অর্জুনের সারথি হয়েছে। কৃষ্ণচরিত্রও স্বল্প পরিসরে উজ্জ্বল হয়ে ফুটেছে।

 

পাঁচ

উপন্যাসটির ভাষাশৈলী বিষয়ের অনুগামী। বেশ গুরুগম্ভীর ভাষা বিষয়কে চমৎকৃত করেছে। সংস্কৃত ও তৎসম শব্দের মেলবন্ধনে ভৌগোলিক বিবরণগুলো বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে । ছোট-ছোট বাক্যে ঔপন্যাসিক শব্দের খেলা দেখিয়েছেন এই উপন্যাসে। প্রায় পরিচ্ছেদে লেখক একটি শব্দ দিয়ে একটি বাক্য নির্মাণ করেছেন। লেখকের বর্ণনার জাদু প্রতি পরিচ্ছেদেই রং বদলেছে। শুধু যে বর্ণনায় তা নয়! তিনি তীক্ষন নজর রেখেছেন চরিত্রগুলোর সংলাপেও। তাই আমরা দেখি স্থানভেদে কখনো কখনো সংলাপও বদলে গেছে। শ্রেণি, ক্ষেত্র ও প্রসঙ্গ বুঝে বর্ণনার বিষয়টি তিনি রপ্ত করেছেন। এ অংশে একলব্যের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যোগ দেওয়ার বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে –

‘প্রতিশোধ নেওয়ার ক্রোধে এবং ঋণশোধের বাসনায় কুরুক্ষেত্রের সমরে যোগদান করেছিল একলব্য। অর্জুনের প্রতি তার দুর্দমনীয় ক্রোধ ছিল আর দ্রোণের প্রতি ছিল প্রচ- ঘৃণা। অর্জুনের হত্যা আর দ্রোণাচার্যের ধ্বংস কামনায় সে সর্বদা উন্মুক্ত ছিল। কর্ণের প্রতি ছিল তার অশেষ ঋণ। স্বার্থান্ধ অর্জুনের প্ররোচনায় দ্রোণ যখন গুরুদক্ষিণা হিসেবে তার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি কর্তন করালেন, আঙুলের দিকে মুহূর্তমাত্র না তাকিয়ে ব্রাহ্মণটি আর ক্ষত্রিয়টি যখন তার পর্ণকুটিরের আঙিনাটি ত্যাগ করে গেলেন, যখন অসহায় সে রক্তাক্ত কাটা আঙুলটির দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে ছিল, তখন এই কর্ণই এগিয়ে এসেছিলেন। পরমাত্মীয়ের মতো তার শুশ্রূষা করেছিলেন, বেঁচে থাকার প্রেরণা জুগিয়েছিলেন এই মহাবীর কর্ণ। যুদ্ধে কি কর্ণের সেই ঋণ শোধ করতে পেরেছে? যদি পেরে থাকে তবে অনেকটা তার চোখের সামনেই অর্জুন কর্ণকে নিধন করে কী করে? দূর থেকে নির্মম সেই হত্যাদৃশ্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না তার।’ (একলব্য, পৃ ১৯৩)

 

মহাভারতে একলব্য বেঁচে নেই। কৃষ্ণের দাবি, তিনিই একলব্যকে হত্যা করেছেন। আবার কেউ বলে কৃষ্ণ নয়, বলরাম একলব্যকে হত্যা করেছে। আসলে আর্যদের এটাও একটি কৌশল। নিমণবর্ণের এই সাহসী যোদ্ধাকে বাঁচিয়ে রাখা ঠিক হবে না। এটাও যেন একটা চক্রান্ত। কিন্তু একলব্য উপন্যাসে ঔপন্যাসিক একলব্যকে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখিয়ে বাঁচিয়ে রাখলেন। আমরা দেখতে পাই – সমুদ্রের মধ্যে এক নির্জন দ্বীপে প্রবঞ্চিত ক্ষুব্ধ, বিজিত একলব্য বেঁচে রইল। তার ভেতরে প্রতিশোধ-স্পৃহা। একলব্য এক অন্যরকম স্বপ্ন দেখে। কী সেই স্বপ্ন? সে স্বপ্ন দেখে ভবিষ্যতে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়ের দ্বারা ভারতবর্ষ শাসিত হবে না। সে স্বপ্ন দেখে, এই ভারতবর্ষ জাতিবর্ণ নির্বিশেষে প্রাকৃত মানুষ দ্বারাই শাসিত হবে। একুশের বইমেলায় প্রকাশিত একলব্য (২০১৬) উপন্যাসে একলব্যের পক্ষে লেখকের কিছুটা পক্ষপাত লক্ষে হয়। এবং বিষয়টি চরিত্রটিকে এক অন্যরকম মহিমা দান করেছে। মহাভারতের দুর্দমনীয় প্রান্তজন একলব্য। একলব্যকে নিয়ে এটিই প্রথম উপন্যাস। যেখানে হরিশংকর জলদাস আর্য-সমাজের পাশাপাশি ব্রাত্যজনের জীবনও সুনিপুণভাবে তুলে এনেছেন।

ঔপন্যাসিক হরিশংকর জলদাস একলব্যকে তার মানস সন্তান হিসেবেই অংকন করেছেন। এ-কথা নিঃশঙ্কচিত্তে  বলা যায় – একলব্য সবার হৃদয় জয় করবে।