ওদুদ-চর্চার সুলুক সন্ধানে

সাইফুল আলম
কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০) বিশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি সমাজচিন্তাবিদ। বাঙালি মুসলমান সমাজের সংস্কার থেকে মুক্তি এবং নবজীবনচেতনায় উত্তরণে ওদুদের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর জীবনাদর্শ ও সাহিত্যসাধনার পথপরিক্রমা ইউরোপীয় রেনেসাঁসের আলোয় আলোকিত। বাঙালি মুসলমান সমাজের কূপমন্ডূকতা, সবল কান্ডজ্ঞানের অভাব তাঁকে সাহিত্যের সৃষ্টিশীল রচনার মননধর্মী প্রবন্ধে মনোযোগী করেছে। সত্য, কল্যাণ, মঙ্গল প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা ছিল বিবেকবান বুদ্ধিজীবীর। মননঋদ্ধ প্রাবন্ধিক হিসেবে বাংলার মুসলমান সমাজের সংস্কৃতি বিকাশের ইতিহাসে তিনি অনুসরণীয় চিন্তানায়ক। ওদুদের গল্প ও উপন্যাস সমকালে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ও সমালোচকের প্রশংসাধন্য হয়। তবে তাঁর নাট্যধর্মী রচনা ও কবিতা বিষয় ও শিল্পরীতির বিবেচনায় গুরুত্বহীন। ওদুদের মনীষা ছিল চিন্তামূলক প্রবন্ধ রচনার উপযোগী।
‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে’ তাত্ত্বিক ও কর্মীপুরুষ হিসেবে অবদানের জন্য তিনি অন্যতম পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব। কথাশিল্পী, সংগঠক, শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, চিন্তানায়ক, সাময়িকপত্র-সম্পাদক, অনুবাদক, অভিধান-প্রণেতা প্রভৃতি পরিচয়ে তাঁর অবদান স্বতন্ত্র ও তাৎপর্যময়। প্রকৃতপক্ষে তিনি মুক্তবুদ্ধির অনুসারী, যুক্তিবাদী, সমাজকল্যাণকামী, মানবতাবাদী লেখক হিসেবে সামাজিক ও সাহিত্যিক কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। ওদুদ মনে করেন, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ-বাহিত বাংলার জাগরণ থেকে বিচ্ছিন্ন নয় বাঙালি মুসলমানের জাগরণ। তাঁর কাছে বাংলার জাগরণ ছিল হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের। ঔপনিবেশিক শাসন এবং রাজনৈতিক কারণে তাঁর লালিত ‘শাশ্বত বঙ্গে’র স্বপ্ন বিপর্যস্ত হলেও থেমে থাকেনি তাঁর মুসলিম জাগরণের স্বপ্ন। বাঙালি মুসলমান সমাজের জাগরণ-স্পৃহায় তিনি ইউরোপীয় রেনেসাঁস এবং বাংলার রেনেসাঁসের শীর্ষ ব্যক্তিপ্রতিভার মূল্যায়নে আত্মনিয়োগ করেছেন। আমাদের বিদ্বৎসমাজে ওদুদের লেখক হিসেবে পরিচিতি, প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতির মূলে রয়েছে তাঁর প্রবন্ধ ও সমালোচনা। চিন্তার ক্ষেত্রে স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ওদুদের ভাষাকে ভাবগম্ভীর করলেও পরিচ্ছন্ন চিন্তার জন্য তা দুর্বোধ্য না হয়ে বরং প্রাঞ্জল হয়েছে।
বাংলাদেশে ওদুদ-চর্চার সুলুক সন্ধানে শিখাকর্মী আবদুল কাদিরের (১৯০৬-৮৪) অবদান অনস্বীকার্য। কাজী আবদুল ওদুদ (বাংলা একাডেমী, ১৯৭৬) গ্রন্থে তিনি ওদুদের জীবনকথা ও সাহিত্যপরিচিতির সূত্র ও বিবরণ লিখেছেন, যা থেকে বিস্তৃত হয়েছে ওদুদ-সংক্রান্ত আলোচনা ও গবেষণা। মোহাম্মদ মাহ্ফুজ উল্লাহ্ (জ ১৯৩৬) বুদ্ধির মুক্তি ও রেনেসাঁ আন্দোলন (ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ঢাকা, ১৯৮০) গ্রন্থে ‘মুসলিম সাহিত্যসমাজে’র কয়েকজন লেখক সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ওদুদ সম্পর্কে তাঁর আলোচনাটি ছিল অপূর্ণ ও বিতর্ক উদ্রেককারী। সাঈদ-উর রহমান (জ ১৯৪৮)-সম্পাদিত ওদুদ-চর্চা (একাডেমিক পাবলিশার্স, ঢাকা, ১৯৮২) গ্রন্থে বাংলাদেশে ওদুদ-চর্চার স্বরূপ প্রকাশিত হলেও বস্ত্তনিষ্ঠ মূল্যায়নের অভিনবতা পরিলক্ষিত হয়নি। ওদুদ-চর্চা সংকলনের প্রাবন্ধিক হলেন কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০৪-২০০২), এসএনকিউ জুলফিকার আলী (১৯০১-অজ্ঞাত), আবুল ফজল (১৯০৩-৮৩), আবদুল হক (১৯১৮-৯৭), আহমদ শরীফ (১৯২১-৯৯), সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (জ ১৯৩৬), বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (জ ১৯৩৬), বশীর আল্ হেলাল (জ ১৯৩৬), আনিসুজ্জামান (জন্ম ১৯৩৭), ওয়াকিল আহমদ (জ ১৯৪১), নাজমা জেসমিন চৌধুরী (১৯৪০-৮৯), সাঈদ-উর রহমান (জ ১৯৪৮)। সংকলনে উল্লিখিত প্রবন্ধ ছাড়াও আরো প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে আবুল ফজল, আবদুল হক, আহমদ শরীফ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বশীর আল্ হেলাল, আনিসুজ্জামান, ওয়াকিল আহমদ স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ওদুদ-চর্চা করেছেন, যা অপূর্ণাঙ্গ ও খন্ডিত হলেও তাৎপর্যপূর্ণ। খোন্দকার সিরাজুল হক (জ ১৯৪১) মুসলিম সাহিত্য-সমাজ : সমাজচিন্তা ও সাহিত্যকর্ম (বাংলা একাডেমী, ১৯৮৪) গ্রন্থে ব্যাপক অনুসন্ধানের মাধ্যমে মুসলিম সাহিত্য সমাজের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় দিয়েছেন। গবেষণাকর্মের ব্যাপক পরিধির কারণে ওদুদের সমাজচিন্তা ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ আলোচনার সুযোগ সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। তবে তিনি কাজী আবদুল ওদুদ (বাংলা একাডেমী, ১৯৮৭) জীবনীগ্রন্থে ব্যাপক ক্ষেত্র অনুসন্ধানের মাধ্যমে ওদুদের প্রামাণ্য জীবনকথা ও পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যকর্মের পরিচয় তুলে ধরেন। এ-গ্রন্থটি ওদুদচর্চার অপরিহার্য উপাদান। রশীদ আল ফারুকী-সম্পাদিত কাজী আবদুল ওদুদ প্রসঙ্গ (বাংলাদেশ সাহিত্য পরিষদ, চট্টগ্রাম, ১৯৮৭) গ্রন্থটি বিক্ষিপ্ত ও অসম্পূর্ণ। রফিক কায়সার তিন পুরুষের রাজনীতি (ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৮৭) গ্রন্থের ‘ওদুদনামা’ প্রবন্ধে ওদুদের সীমাবদ্ধতা সন্ধান করেছেন। ভাবাদর্শ ও জীবনযাপনের সমন্বয়হীনতার জন্যই ওদুদ সংস্কারক হওয়ার সম্ভাবনা সত্ত্বেও হয়েছেন আত্মনির্বাসিত লেখক। রফিক কায়সারের এ-মন্তব্য বিতর্কমূলক হলেও মূল্যবান ও বিচারসাপেক্ষে গ্রহণ-উপযোগী। কাজী আবদুল ওদুদের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের প্রস্ত্ততির জন্য লোকায়ত পত্রিকার দ্বাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, অক্টোবর ১৯৯৩-তে আবেদন জানানো হয় ‘কাজী আবদুল ওদুদের জন্মশতবার্ষিকী পালন করুন’। ওদুদের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে লোকায়তের একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সে-পরিকল্পনা আজো বাস্তবায়িত হয়নি। তবে এ-আবেদনে কেবল দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক জনকণ্ঠ সাড়া দেয়। দৈনিক সংবাদের ২৮ এপ্রিল ১৯৯৪ সংখ্যায় প্রকাশিত আজিজুল কাদেরের ‘কাজী আবদুল ওদুদের সমাজ ও স্বদেশ চিন্তা’ এবং স্বরোচিষ সরকারের ‘কাজী আবদুল ওদুদের ধর্মনিরপেক্ষতা’ প্রবন্ধ দুটো তাৎপর্যপূর্ণ। দৈনিক জনকণ্ঠের ২৯ এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধ দুটো হলো মুস্তাফা নূরউল ইসলাম-রচিত ‘মুক্তবুদ্ধির কণ্ঠস্বর কাজী আবদুল ওদুদ স্মরণে’ এবং আবুল কাসেম ফজলুল হক-রচিত ‘চিন্তানায়ক কাজী আবদুল ওদুদ’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগে টিএসসি মিলনায়তনে প্রফেসর ড. সন্জীদা খাতুনের সভাপতিত্বে সীমিত আকারে জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগেই কাজী আবদুল ওদুদ স্মরণে বিশেষ বক্তৃতামালায় আনিসুজ্জামান ‘কাজী আবদুল ওদুদ : মন ও মনন’, খোন্দকার সিরাজুল হক ‘বাংলার রেনেসাঁস ও কাজী আবদুল ওদুদ’, আহমদ শরীফ ‘ভিন্ন দৃষ্টিতে কাজী আবদুল ওদুদ’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন। এ প্রবণতা থেকে মনে হতে পারে, ওদুদ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে অজ্ঞাতজন, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কাছে নিঃসঙ্গ বুদ্ধিজীবী। বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ ওদুদের দুষ্প্রাপ্য ও দুর্লভ রচনাবলি প্রকাশের মাধ্যমে ওই ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। আবদুল হক-সম্পাদিত কাজী আবদুল ওদুদ রচনাবলির প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৮৮ ও ১৯৯০ সালে। নুরুল আমিন-সম্পাদিত কাজী আবদুল ওদুদ রচনাবলির তৃতীয় খন্ড প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। খোন্দকার সিরাজুল হক-সম্পাদিত কাজী আবদুল ওদুদ রচনাবলির চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ খন্ড প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৯৩, ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে। প্রকৃতপক্ষে ওদুদের রচনাবলি ওদুদ-চর্চার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছে। ১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমী আয়োজিত অমর একুশের অনুষ্ঠানমালায় ‘শতবর্ষের আলোকে কাজী আবদুল ওদুদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ পাঠ করেন আবুল কাশেম ফজলুল হক এবং আলোচক ছিলেন রফিক উল্লাহ খান। মিহির মুসাকী (জ ১৯৬৭) কাজী আবদুল ওদুদের জীবনজিজ্ঞাসা ও সাহিত্যাদর্শ (বাংলা একাডেমী, ১৯৯৭) গ্রন্থে আলোচনা করেছেন তাঁর সাহিত্যাদর্শ, রাজনীতিক ভাবনা, ধর্ম ও সমাজ-সংস্কার চিন্তা। তিনি বাংলার জাগরণ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে ওদুদের দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করেছেন। এ-আলোচনা তাৎপর্যপূর্ণ হলেও ওদুদের সামগ্রিক বিচারের ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ। সারোয়ার জাহান-সম্পাদিত বঙ্কিম বিভূতি ওদুদ (বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯৯) গ্রন্থে ওদুদবিষয়ক দুটো প্রবন্ধ আছে। শহিদুল ইসলাম ‘কাজী আবদুল ওদুদ রচনাবলি : একটি পর্যালোচনা’ প্রবন্ধে ওদুদ মানসের পরিচয় সন্ধান করেছেন। জুলফিকার মতিন ‘কাজী আবদুল ওদুদ’ প্রবন্ধে ওদুদ কেন আধুনিক বাঙালি মুসলমান তার স্বরূপ সন্ধানকে জরুরি মনে করেছেন। আবুল আহসান চৌধুরী-সংকলিত ও সম্পাদিত কাজী আবদুল ওদুদের পত্রাবলী (ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৯) গ্রন্থে ব্যক্তিসত্তা, সাহিত্যিক কর্মিসত্তা ও সমাজচিন্তাবিদ হিসেবে ওদুদকে অন্তরঙ্গ অবলোকনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আহমদ নূরুল ইসলাম দীর্ঘকাল ওদুদচর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। ব্যাপক অনুসন্ধানের জন্য তাঁর দেওয়া তথ্যসূত্র গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে তাঁর রচিত ও অনূদিত সাহিত্যতত্ত্ব ও অন্যান্য প্রবন্ধ (জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০২) গ্রন্থের ওদুদ সংক্রান্ত প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০০৬ সালে বাংলা একাডেমী-আয়োজিত অনুষ্ঠানমালার মূল বিষয় ছিল বিশ শতকের চিন্তাধারা। এতে ‘বিশ শতকের চিন্তাধারা : কাজী আবদুল ওদুদ’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন জীনাত ইমতিয়াজ আলী। নুরুল আমিন (জ ১৯৫০) কাজী আবদুল ওদুদের রচনা ও বাঙালি মুসলমান সমাজ (বাংলা একাডেমী, ২০০৮) গ্রন্থে ওদুদের সমগ্র রচনার ভিত্তিতে বাঙালি মুসলমান সমাজ প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করেছেন। এ-কারণেই ওদুদের সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার বদলে সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা গুরুত্ব পেয়েছে। ওদুদের সমগ্র রচনার অনুসন্ধান ও তার ভিত্তিতে বাঙালি মুসলমান সমাজের অবস্থান বিশ্লেষণের জন্য তাঁর আলোচনা পূর্ণাঙ্গ হলেও নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা না থাকার জন্য তা অপূর্ণ থেকে গেছে। মৎ-রচিত কাজী আবদুল ওদুদ : জীবনদর্শন ও সাহিত্যসাধনা (অপ্রকাশিত অভিসন্দর্ভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১০) শীর্ষক অভিসন্দর্ভে ওদুদের পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যসাধনা আলোচিত হয়নি। তবে জীবনদর্শন মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যেসব রচনা তাৎপর্যপূর্ণ তা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। ওদুদের সাহিত্যসাধনার সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার পাশাপাশি নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে ওদুদ ছিলেন অনেকটা আত্মনির্বাসিত সাহিত্যসাধক। ওদুদ সম্পর্কে এ-বিস্মৃতি পীড়াদায়ক। ওখানে ওদুদকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধের সংখ্যা নগণ্য। দেশ, ৩৭শ বর্ষ, ৩৫শ সংখ্যা, ১২ আষাঢ়, ১৩৭৭ সংখ্যায় ওদুদ সম্পর্কে দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ‘জীবন দার্শনিক ওদুদ’ প্রবন্ধটি লেখেন অন্নদাশঙ্কর রায়। মুজফ্ফর আহমদ-রচিত প্রবন্ধটি ছিল ‘কাজী আবদুল ওদুদ’। ওদুদের জীবনাদর্শ উন্মোচনে অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখাটি তাৎপর্যপূর্ণ। মুজফ্ফর আহমদ স্মৃতিচারণের মাধ্যমে ওদুদকে শনাক্ত করতে চেয়েছেন। ১৯৯৩ সালে কলকাতার আবর্ত পত্রিকার পক্ষ থেকে জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের জন্য আবেদন জানানো হয়। সে আবেদনে সাড়া দিয়ে আনন্দবাজারপত্রিকার রবিবাসরীয় ৮ আগস্ট ১৯৯৩ সংখ্যায় দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ‘যাঁর মন্ত্র ছিল বুদ্ধির মুক্তি’ প্রবন্ধটির রচয়িতা চতুরঙ্গের সম্পাদক আবদুর রাউফ। ‘প্রবল ঝড়ের মুখেও দিশা হারাননি তিনি’ প্রবন্ধটির রচয়িতা রেনেসাঁস-গবেষক শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়। আবদুর রাউফ পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান প্রজন্মের মুসলমানদের মধ্যে ওদুদচর্চার মাধ্যমে অক্লান্ত অনুসন্ধিৎসা ও গভীর রসপিপাসার জাগ্রত হোক, সে-কামনা ব্যক্ত করেছেন। শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় বাঙালি মুসলমানের পুনর্জাগরণধর্মী মানসিকতা কীভাবে আধুনিকতার পথ ধরে সম্মুখগামী হবে এবং সাংস্কৃতিক সংকট থেকে উদ্ধার পাবে তার স্বরূপটি ওদুদের জীবনভাবনা ও সাহিত্যকর্ম অনুষঙ্গে চিহ্নিত করেছেন। ওদুদের জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে আবর্ত পত্রিকার উদ্যোগে প্রকাশিত হয় কাজী আবদুল ওদুদ স্মৃতি ও সত্তা (আবর্ত, পান্ডুলিপি, ১৯৯৪)। এ-গ্রন্থে পশ্চিমবঙ্গে ওদুদচর্চার বাস্তব পরিস্থিতি ব্যক্ত হয়েছে। নিদারুণ ঔদাসীন্যের মাঝেও অন্নদাশঙ্কর রায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, নুরুল আমিন, স্বরোচিষ সরকার, মিহির মুসাকীর প্রবন্ধগুলো বাংলাদেশের ওদুদচর্চাবিষয়ক গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রণয়কৃষ্ণ গোস্বামী, আবু আতাহার, আবদুল জববারের প্রবন্ধগুলো স্মৃতিচারণমূলক। স্বরাজ সেনগুপ্ত, আবদুর রাকিব, জাহিরুল হাসান, মুঞ্জুষ দাশগুপ্ত, আজহার উদ্দিন খান, তরুণ স্যানালের প্রবন্ধ গুরুত্বপূর্ণ হলেও অপূর্ণাঙ্গ ও খন্ডিত। তরুণ মুখোপাধ্যায় লিখিত কাজী আবদুল ওদুদ (কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ১৯৯৫) জীবনীগ্রন্থে সংক্ষিপ্ত জীবনকথা, আনুষঙ্গিক তথ্যাদি ও ব্যাপক গ্রন্থের তালিকা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় কাজী আবদুল ওদুদ (কলকাতা, আকাদেমি পত্রিকা, ১৯৯৫) প্রবন্ধে ওদুদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কৃতিত্ব তাঁর জীবনাদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যায়ন করেছেন। জাহিরুল হাসান কাজী আবদুল ওদুদ (নতুন দিল্লি, সাহিত্য অকাদেমি, ১৯৯৭) জীবনীগ্রন্থে ওদুদের প্রাসঙ্গিকতা ও সাহিত্যসাধনার গুরুত্ব মূল্যায়নে গবেষকনিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। ওদুদের জন্মশতবর্ষ পালনে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণের পর থেকেই তিনি ওদুদচর্চায় অনেকটা ব্রত পালনের মতোই নিয়োজিত আছেন। শিবনারায়ণ রায় A new Renaissance and Allied Essays (Calcutta, Minerva Associates Limited, 1998) গ্রন্থের ‘The sikha (1927-32) : A Note on the Bengali Muslim Intelligentsia in search of Modernity’ প্রবন্ধে বাঙালি মুসলমান সমাজে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারে ‘শিখা গোষ্ঠীর’ অবদানের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। ‘শিখা গোষ্ঠী’র সঞ্চালকের ভূমিকা ছিল ওদুদের। উত্তম কুমার রায় কাজী আবদুল ওদুদ : জীবন ও সাহিত্যকর্ম (অপ্রকাশিত অভিসন্দর্ভর্, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০৯) শীর্ষক অভিসন্দর্ভে ওদুদের সাহিত্যকর্ম মূল্যায়ন করেছেন।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে গবেষণাকর্মে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ও কাজী আবদুল ওদুদের অবদানের প্রসঙ্গ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে। ১৯৯৭ সালে কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ থেকে শাহাদাত এইচ খান The Freedom of Intellect Movement in Bengali Muslim Thought : 1926-38 (The Edwin Mellen Press, Lewiston) শীর্ষক গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেছেন। এ গবেষণায় আলোচিত হয়েছে ওদুদ, হুসেনের জীবন ও কর্মকান্ড ওদুদ মানসগঠনে প্রভাবসঞ্চারী ব্যক্তিত্বের ভূমিকা, মুসলিম সাহিত্যসমাজের সাংগঠনিক তৎপরতা, অসাম্প্রদায়িক ভারতীয় জাতীয়তার ভিত্তি ‘সৃষ্টিধর্ম’ সম্পর্কে ওদুদ ও হুসেনের ব্যাখ্যা, পূর্বপাকিস্তানি বাঙালি বুদ্ধিজীবীর ওপর বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রভাব, বাংলাদেশের সংবিধানে অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণের ক্ষেত্রে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রভাব। এ গবেষণাকর্মের মূল্যায়নের ধারা বিশ্লেষণমূলক। মোস্তাক আহমাদ দীন কাজী আবদুল ওদুদের মননবিশ্ব (অপ্রকাশিত অভিসন্দর্ভ, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০৯) শীর্ষক অভিসন্দর্ভে তিনি ওদুদের উদারমানবতাবাদী, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক জীবনচেতনার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানববিদ্যা ও সমাজবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে বাংলা, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে বাংলাদেশ সম্পর্কিত যে-বিষয়গুলো পড়ানো হয়, সেখানে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ ও ‘শিখা গোষ্ঠী’র প্রসঙ্গ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়। আমাদের প্রগতিশীল চিন্তাধারার ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ইতিহাস মূল্যায়ন করতে হলে ফিরে তাকাতে হবে ওদুদের মনীষার দিকে। 