ওলগা তোকারচুক : বিশ্বাসঘাতক ও দেশপ্রেমিক

ততক্ষণে পৃথিবী জেনে গেছে, ২০১৯-এ ঘোষিত হলেও ২০১৮ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন পোলিশ কথাসাহিত্যিক ওলগা তোকারচুক। কিন্তু পোল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন শুধু বলেছে, একজন পোলিশ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য পর্দায় ছবিটা দেখানো হলেও নাম বলা হয়নি। বার্তোস বিলিনস্কি লিখেছেন : ‘আমি দ্রম্নত ওয়ারশর উদারপন্থি সংবাদপত্র গেজেটা বিবর্কজার সম্পাদকীয় কক্ষে ছুটে গিয়ে টেলিভিশন খুলে বুঝতে চেষ্টা করি, সরকারি টেলিভিশন ব্যাপারটাকে কেমন করে সামাল দিচ্ছে। আগের সব নোবেল-বিজেতা মাদা মম্যারি কুরি থেকে শুরু করে বিসস্নাভা শিমবোর্স্কা সবাই পোল্যান্ডের গর্বের উৎস। কিন্তু তোকারচুক তো পোল্যান্ডের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনানুষ্ঠানিক কালো তালিকাভুক্ত আর এ-কারণেই পুরস্কার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশনের সম্পাদকরা তাঁর নাম নিতে সাহস পাচ্ছিলেন না।’
ক্ষমতাসীন ল’ অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান, যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের চেয়েও ক্ষমতাশালী, ঘোষণা করেছেন – পোল্যান্ডের নব্য সাংস্কৃতিক এলিটরা দেশের শত্রম্নর জন্য কাজ করে না। শত্রম্নদের মধ্যে রয়েছেন ওলগা তোকারচুক। কারণ, তিনি পার্টি লাইনে হাঁটেন না। পোল্যান্ডকে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে যে-আদর্শ ঘোষিত, তিনি তাও মানেন না। বরং তিনি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেশের পুরনো জখমগুলো রক্তাক্ত করে তুলছেন, পোল্যান্ডের ইতিহাসের কালো ও অমানবিক অধ্যায়গুলোকে তাঁর লেখায় জীবন্ত করে তুলছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তারা যে স্বদেশি ইহুদিদের নাৎসি নির্যাতনের মুখে ঠেলে দিয়েছে সে-কথাও বলছেন। ওলগা পোলিশ বীরত্বের মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিচ্ছেন। আর তিনি বলছেন, ‘পোল্যান্ডকে সত্যের মুখোমুখি হতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, ইতিহাসের মোকাবিলা আমাদের করতে হবে, সেসব ভয়ংকর বিষয়কে আড়াল না করে আমাদের সত্যের পুনর্লিখন করতে হবে।’
নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার দুদিন পর পোলিশ টিভি শোতে অতিথি হিসেবে সংস্কৃতিমন্ত্রী এসে বললেন, তিনি তোকারচুকের বই পড়তে চেষ্টা করেছেন; কিন্তু কখনো শেষ করতে পারেননি। নয়া পোল্যান্ড গড়ার উদ্যোগ হিসেবে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে আইন করে গণমাধ্যমের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব সরকার গ্রহণ করে; অ-পোলিশ কিংবা আনুগত্য নেই – এমন সিল মেরে ২০০ সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়। এ সময় ওলগার নোবেল বিজয় সরকারের জন্য বিব্রতকর। কোনো একটি গণমাধ্যমের প্রতিনিধি টেলিভিশনে সংস্কৃতিমন্ত্রীকে পেয়ে গেলে তাঁর কথার প্যাঁচে তিনি তিক্ত বটিকা সেবনের মতো বলে ওঠেন, ওলগা তোকারচুককে অভিনন্দন জানাচ্ছেন।
সঙ্গে সঙ্গে সরকার-নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমও নতুন নোবেল বিজয়ীকে অভিনন্দন জানাতে শুরু করে। অভিনন্দনের মধ্যেও পোল্যান্ডে অনেকের কাছেই তিনি চিহ্নিত হয়ে আছেন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে।
ওলগা তোকারচুক তাঁর উপন্যাসে জাতীয়তাবাদ তথা পোলিশ জাতীয়তাবাদের অহমসর্বস্ব ধারণাটি ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। মিথ্যা ও অলঙ্কারসর্বস্ব বাগাড়ম্বরের ওপর জাতীয়তার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় না, তাছাড়া এ-ধারণা এখন অর্থহীনও।
নিবন্ধটি ওলগা তোকারচুকের কয়েকটি সাক্ষাৎকার ও জীবনকথার ওপর ভিত্তি করে রচিত।
ওলগা তোকারচুকের জন্ম ২৯ জানুয়ারি ১৯৬২ সালে পোল্যান্ডের লোয়ার সিলেসিয়ার উত্তরের একটি গ্রামে; বাবা-মায়ের দুই কন্যাসন্তানের জ্যেষ্ঠ। একটি ছোট সংখ্যালঘু জার্মান সম্প্রদায় সেখানে রয়ে গেছে। পাশাপাশিভাবে থাকার জন্য তাঁদের কেউ কেউ নিজেদের পোলিশ দাবি করেন, কেউ বিয়ের সূত্র স্থাপন করেন। শৈশবের তোকারচুককে দেখভাল করতেন একজন জার্মান আয়া। বাবা-মা গ্রামের হাইস্কুলে কাজ করতেন, এটি ছিল কৃষক শ্রেণিকে শিক্ষিত করে তোলার আন্দোলনের অংশ। স্কুলচত্বরেই পরিবারটি থাকত, সে-সময়কার সুখস্মৃতি মনে করেন ওলগা তোকারচুক। বাবা ছিলেন স্কুলের লাইব্রেরিয়ান, মেয়ের একটা বড় সময় বাবার সঙ্গেই কাটত, হাতের কাছে যা পাচ্ছেন পড়ছেন – কবিতা, অ্যাপুলোনিয়াসের গল্প, জুলে ভার্ন, বিশ্বকোষ – সবই।
শৈশবেই তিনি বুঝতে পারলেন
পৃথিবীর অধিকাংশটাই তাঁর জন্য রুদ্ধ। ‘যা কিছু কৌতূহলের, মজার – সবই পোল্যান্ডের বাইরে। মিউজিক, আর্টফিল্ম, হিপ্পি, মিক জ্যাগার – সবই। এমনকি এখান থেকে পালানোর স্বপ্ন দেখাও অসম্ভব ব্যাপার। আমি সেই বয়ঃসন্ধিক্ষণে বুঝতে পেরেছি, এই ফাঁদের মধ্যেই আমাকে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে।’
১৯৮০-র শরতে তিনি ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, মনোবিজ্ঞান পড়বেন। মহাযুদ্ধের সময় ক্যাম্পাসটা ছিল জার্মান সৈন্যদের ব্যারাক। ইহুদি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার ধ্বংসাবশেষের কাছেই ছিল তাঁর ডরমিটরি। ১৯৪৪-এ নাৎসিরা শহরটাকে যেরকম পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করেছে, সে-চিহ্ন তখনো আছে। বড় রাসত্মা মাঝেমধ্যেই বিচ্ছিন্ন। তিনি যখন দ্বিতীয় বর্ষে, দেশজুড়ে বিক্ষোভ দমন করতে সরকার সামরিক আইন জারি করে। এমনকি এখনো হোটেলের লবিতে বসে তোকারচুক সে-সময়ের কথা মনে করে অাঁতকে ওঠেন : ‘প্রাদেশিক অঞ্চল থেকে উঠে আসা একটি মেয়ের জন্য এ বড় কঠিন অভিজ্ঞতা – দেখার মতো কোনো পণ্য দোকানে নেই, তাকভর্তি ভিনেগার আর বাটা শর্ষে। চারদিকে হতাশা, মানুষও ভীষণ হতাশাবাদী হয়ে পড়ে। আমি কখনো বিশ্বাস করতে পারিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে খানখান হয়ে যাবে।’
১৯৮৫-তে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর তোকারচুক তাঁর সঙ্গী এক মনোবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীকে বিয়ে করেন এবং তাঁরা রোক্লর অনতিদূরে বাস করতে থাকেন। তিনি ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে প্রশিক্ষণ নেন, একই সঙ্গে মাদক ও অ্যালকোহল আসক্ত নিরাময়ের জ্ঞানও অর্জন করেন। ক’বছরের মধ্যে তিনি আগ্রহ হারান। বলেন, ‘আমি নিজেই এতটা অস্বাভাবিক সংবেদনশীলতাসম্পন্ন যে, আমার পক্ষে থেরাপিস্ট হওয়া সম্ভব নয়।’
তিনি একটি পাসপোর্ট জোগাড় করে ক’মাসের জন্য লন্ডন চলে গেলেন, সেখানে ইংরেজি পড়লেন, টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের কাজ করলেন : কারখানায় অ্যান্টেনা সংযোজন, বিলাসবহুল হোটেলে ক্লিনার। আর বইয়ের দোকানে সময় কাটাতেন ফেমিনিস্ট থিওরি পড়ে – যার দেখা তিনি কখনো পোল্যান্ডে পাননি।
তোকারচুকের প্রথমদিককার একটি গল্প ‘দ্য হোটেল ক্যাপিটাল’ – হোটেলের শয়নকক্ষের পরিচারিকার দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা – যাদের রুম ও বিছানা সে পরিষ্কার করছে, তাদের নিজেদের জিনিসপত্রের ওপর ভিত্তি করে সে গল্প সৃষ্টি করে চলেছে। ‘যতবার আমি হোটেলে এসেছি আমার মনে হয়েছে এই পরিচারিকারা আমার মতো মানুষ। তারা আমাকে নিয়ে, হোটেল রুমটা কেমন ল-ভ- করে এসেছি তা নিয়ে গল্প লিখতে পারে।’
পোল্যান্ডে ফেরার পর এই দম্পতির একটি ছেলে হয়, তিনি আন্তরিকভাবে লিখতে শুরু করেন। তিনিই মনোবিজ্ঞানের প্রশিক্ষককে কৃতিত্ব দেন – একই সঙ্গে যে বহুবিধ বাস্তবতা বিরাজ করতে পারে, তিনি তা তখনই জানতে পারেন। তাঁর প্রথমদিককার একটি চিকিৎসাবিষয়ক অভিজ্ঞতার সঙ্গে জড়িত আপন দু’ভাই তাদের পরিবারের গতিময়তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিবরণী দিয়ে যায়। ‘সেখানেই আমার লেখার প্রথম ধাপের সূচনা। লিখতে হলে কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে কোন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিতে বাস্তবতাকে দেখা হয়েছে সেদিকে নজর দিতে হবে।’
সপ্তদশ শতকের ফ্রান্সের দর্শনভিত্তিক কাহিনি ও বিশের দশকের পোলিশ রোক্লর এক মানসিক রোগীর জীবন নিয়ে প্রথম উপন্যাসটি লেখেন। কিন্তু তিনি পরিচিতি লাভ করেন ১৯৯৬-তে প্রকাশিত তৃতীয় উপন্যাস দ্য প্রাইমেভাল অ্যান্ড আদার টাইমস-এর মাধ্যমে। শৈশবে পিতামহী তাঁকে যে-গল্প শুনিয়েছেন তার ওপর ভিত্তি করে জাদুবাস্তবতার আশ্রয় নিয়ে বিংশ শতকের একটি পোলিশ গ্রামে দুটি পরিবারের কাহিনি – যার পুরোটা জুড়ে রয়েছে পোলিশ ও ইহুদিদের বিভিন্ন ধরনের মিথস্ক্রিয়া।
সে-সময় চেকোসেস্নাভাক সীমান্তে লোয়ার সিলেসিয়ায় ক্লোদজকো উপত্যকার প্রেমে পড়েন এবং সেখানে একটি কাঠের বাড়ি কেনেন। এখানকার ইতিহাস ও
সংস্কৃতি তাঁকে আকৃষ্ট করে। তাঁদের বাড়ির পাশেই ছিল একটি চার্চ এবং সেইন্ট ভিলগেফোর্টিসের একটি মূর্তি। এই সেইন্টের কাহিনি নিয়ে আসেন তাঁর চতুর্থ উপন্যাস হাউজ অব ডে, হাউজ অব দ্য নাইটে। তরুণী ভিলগেফোর্টিস নান হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কনভেন্টে চলে এসেছিলেন। কিন্তু বাবা তাকে সেখান থেকে অপহরণ করিয়ে নিয়ে আসে এবং বিয়ে করতে সম্মতি জানাতে বাধ্য করে। তরুণী যিশুখ্রিষ্টের কাছে প্রার্থনা করে – তার চেহারা এমন বিকর্ষক করে দেওয়া হোক, যাতে পাত্র নিজেই পিছিয়ে যায়। মেয়ের নিষ্ঠা ও ঈশ্বরভক্তির প্রকৃত রূপ তার বাবার দেখা হয়নি। তরুণীর প্রার্থনা মঞ্জুর হয়। ধীরে ধীরে তার শরীরে পৌরুষের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠতে থাকে – তার এমন দাড়ি গজায় যে, দেখতে তাকে যিশুখ্রিষ্টের মতো মনে হয়। মেয়েকে পরিবর্তিত মানুষ হিসেবে দেখে বাবা এতটাই ক্ষিপ্ত হয় যে, তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আর চার্চ তাকে মর্যাদা দিয়ে সন্তর আসনে বসায়।

সাহিত্য আসলে একটিই
আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, সাহিত্যের কোনো সীমান্ত নেই। সাহিত্য একটিই, বিভিন্ন ভাষাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সে-কারণেই অনুবাদক খুব গুরুত্বপূর্ণ আর বিভিন্ন ভাষার মধ্যে ভঙ্গুর সংযোজক হিসেবে কাজ করে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সাহিত্য আসলে একটিই। আমি যখন কখনো চীনের একটি বই পড়ি, আমি অনুধাবন করতে পারি এর মধ্যে ব্যক্তিগত এমন কিছু রয়েছে যা আমাকে আলোড়িত করছে। সেটাই আমার জন্য বিস্ময়। আমাদের চেতনে-অবচেতনে এমন কিছু রয়েছে যা সবার জন্য সাধারণ, সবার মধ্যেই আছে আর তা-ই সৃষ্টি করে সাহিত্য। ভাষা ও সংস্কৃতির বিবেচনায় আমি একজন পোলিশ লেখক, কিন্তু আমি নিজেকে একজন বৈশ্বিক লেখকই বিবেচনা করে থাকি।

পোলিশ সাহিত্যে মেসিয়ানিজম
সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান সাহিত্যের সঙ্গে ইউরোপের অন্যান্য অংশের তফাৎ কোথায় – একটি অবশ্যই পাঠকের বিনোদনের জন্য, অন্যটি নৈতিক উদ্দেশ্যে সমাজের ভ্রামিত্ম ও অসংগতি বিশ্লেষণের জন্য লিখিত? তোকারচুকের জবাব : ‘অস্ট্রিয়ান সাহিত্যের বেলায় এটা অবশ্যই সত্য। এটা খুব যন্ত্রণাদায়ক – ড্রিল দিয়ে আপনার শরীর ছিদ্র করা হবে এবং আপনি সে-ব্যথা অনুভব করবেন। এটি সম্ভবত সেই মনোসমীক্ষণের কারণেই, যার বীজ সেন্ট্রাল ইউরোপে নিহিত। এ-ধরনের বিষয়কে যদি সেনট্রাল ইউরোপিয়ান সাহিত্য বলা হয় – এটা আরো গভীরের, অন্ধকারের – মানুষের কালো দিকটার ওপর আলোকসম্পাতের মতো। সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান সাহিত্যের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ইহুদি উত্তরাধিকার। আমাদের এখনকার সমাজ ও সংস্কৃতিতেও তা বিরাজ করছে। পোলিশ মেসিয়ানিজমের (মানব জাতির উদ্ধারের জন্য কারো আবির্ভাব ঘটবে – ইহুদিদের এই প্রত্যাশাবাদ) কথা ধরা যাক; পোলিশ পরিচিতি প্রতিষ্ঠার রোমান্টিক ধারণা যা স্ববিরোধী, পোলিশ পরিচিতি প্রতিষ্ঠার জন্য ইহুদি ভাবধারা গ্রহণ করে পরে ইহুদিদের বাদ দিয়ে দেওয়া। পোলিশ সাহিত্যে ইহুদি উপস্থিতি সুফলই বয়ে এনেছে।’

পৃথিবীর এখন কী হাল?
পৃথিবী এখন দুভাগে বিভক্ত। কিছু মানুষ মনে করেন, সবচেয়ে ভালো হতো যদি আমাদের ফেলে আসা পদচিহ্নগুলো উদ্ধার করা যেত। ঐতিহ্য নামের পুরনো মূল্যবোধ পুনরুদ্ধারই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অন্যরা মনে করেন, না, এটাই যথেষ্ট নয়। আমাদের ভিন্নভাবে পৃথিবীটাকে সৃষ্টি করতে হবে। পুরনো ধারণা গ্রহটিকে ধ্বংস করে ফেলছে, বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, অনেক ধরনের অসমতা সৃষ্টি করেছে। আমরা এখন উত্তরণের জন্য জবাব খুঁজছি। এই প্রশ্নটি লেখকের জন্য নয়। পোপকে কিংবা বিশিষ্ট দার্শনিকদের এ-প্রশ্ন করা যেতে পারে। আমি গল্প বলি এবং সততার সঙ্গে তা বলতে চেষ্টা করি, যাতে মানুষ আগ্রহী হয় এবং উপভোগ করে। তারপরও যেন পাঠকের ভাবনা প্রসারিত হয়, পাঠক অস্থির হয়ে ওঠেন এবং এতদিন যা নিশ্চিত বলে জেনেছেন তাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করতে পারেন।

সীমান্তের মোহ
ওলগা তোকারচুক বাস করেন চেক সীমান্ত থেকে ২০০ মিটার দূরে সাইলেসিয়াতে। এই জায়গাটির একাংশ পড়েছে পোল্যান্ডে, একাংশ চেক রিপাবলিকে এবং একাংশ জার্মানিতে।
‘সীমান্তের ধারণাটি আমার কাছে সবসময়ই মোহনীয়। আমার উপন্যাস হাউজ অব ডে, হাউজ অব নাইট সীমান্তের সমীক্ষা ও কাহিনি, কারণ আমি বুঝি সীমান্ত সবসময়ই দুটি জিনিসের মাঝখান – যেমন দিন ও রাতের সন্ধিক্ষণে ভোর অনেক বেশি কৌতূহলোদ্দীপক। … চলমান সীমান্তের ধারণাটি আমার পরিবারে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত। ভাবতে পারেন, আমার দাদির জন্ম লভোভে, যা এখন ইউক্রেনের লভিভ। একই জায়গায় বসবাস করেও তাঁর নাগরিকত্ব বদলে গেছে তিনবার! তিনি অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান, রুশ এবং পোলিশ। একজন ফরাসি, একজন রুশ, একজন ইংরেজকে সাধারণত তার জাতির অস্তিত্বের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় না। তাদের জাতীয়সংগীত ঐশ্বর্য ও অনন্তের কথা বলে। অন্যদিকে পোলিশ জাতীয়সংগীত শুরু হয়েছে ভিন্ন ধরনের পঙ্ক্তি দিয়ে – ‘পোল্যান্ড এখনো ধ্বংস হয়ে যায়নি।’ এই অস্তিত্ব-সংকটের মধ্যেই সাহিত্যের নতুন সম্ভাবনা জাগ্রত হয়, জাদুবাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার জন্ম হয়, কাফকা থেকে ক্রাসনাহোরকাই এবং তোকারচুকের জন্ম হয়। সীমান্ত এখন দ্রবীভূত হয়ে যেতে চায়; যা ভেঙে গেছে তা হয়তো আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো যাবে না; সম্পূর্ণতার আকাঙক্ষা, অতীত ও ভবিষ্যৎ পাশ কাটিয়ে মানুষ প্রবেশ করে বিশ্বের বহমান আধুনিকতায়।
স্কটল্যান্ডে লেখকদের একটি ওয়ার্কশপে এসে অনুষ্ঠানস্থলে ষষ্ঠদশ শতকের কিছু আসবাবপত্র দেখে ওলগা তোকারচুক বিস্মিত হন। এ-ধরনের স্থায়ী বাস্তবতা পোল্যান্ডে কখনো ছিল না। ইউরোপের প্রধান করিডোর পোল্যান্ডকে বরাবর যুদ্ধের সামাল দিতে হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে শহর ও শহরতলির ঘরবাড়ি। এ-ধরনের পুরোনো আসবাব দেখতে হলে একমাত্র গন্তব্য জাদুঘর।

জাতিগত বিশুদ্ধতার মিথ
পরিচ্ছন্ন রক্ত বা বিশুদ্ধ রক্ত বলে কিছু নেই। আমরা ইউরোপের কেন্দ্রে বাস করছি, ইউরোপের করিডোরে – জাতিগতভাবে বিশুদ্ধ রক্তের অধিকারী হওয়া অসম্ভব ব্যাপার।
ওলগা তোকারচুকের ড্রাইভ ইয়োর প্লাউ ওভার দ্য বোনস অব দ্য ডেড-এর চলচ্চিত্ররূপ যখন বার্লিন উৎসবে প্রদর্শিত হয়, পোল্যান্ডে রক্ষণশীল গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া, ‘এটি খ্রিষ্টানবিরোধী, পরিবেশ-সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী একটি কাজ।’ তাঁর দ্য বুকস অব জ্যাকব উপন্যাসটির বিক্রির আধিক্য তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছে আধুনিক পোল্যান্ডের ‘এক জাতিভিত্তিক’ অতিজাতীয়তাবাদী অবস্থান নেই। অবচেতনেও পোলিশরা বহুজাতিক ও বহুভাষী পোল্যান্ডের ব্যাপারেই আগ্রহী।

কবিতার তোকারচুক
ওলগা তোকারচুকের শুরুটা কবিতা দিয়ে হলেও তাঁর স্বস্তির জায়গাটি গদ্যে। তিনি কবিতা থেকে খুব দূরে সরে আসেননি। তাঁকে ইউরোপিয়ান ‘পোয়েট অব ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ডে’র জুরিবোর্ডের সদস্য করা হলে তিনি কি প্রচুর কবিতা পড়েন – জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি বললেন, ‘যদিও কবিতা কদাচিৎ পড়ি, জুরি হিসেবে আমি বাড়তি কিছু যোগ করতে পারব। আমি মনে করি, ভালো কবিতার ভাষা বৈশ্বিক যা এমনকি সাধারণ মানুষকেও নিস্পৃহ থাকতে দেয় না, গভীরভাবে আলোড়িত করে। আমি আমার অনুভূতিকে অনুসরণ করি, শব্দের প্রতি আমার সাধারণ সংবেদনশীলতা রয়েছে, যা সকল গদ্যলেখকেরই আছে। আমি বিশ্বাস করি, যখন লেখাটা শক্তিশালী এবং সুলিখিত, তখন এটা গদ্য বা পদ্য তাতে কিছু এসে-যায় না!’
ওলগা তোকারচুকের প্রথম বইটি কাব্যগ্রন্থ – সিটিজ ইন মিরর, তাহলে কবিতা ছাড়লেন কেন? কিংবা আবার কি কবিতায় ফিরে আসবেন?
কবিদের অনেক সম্মান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সময়ের ঘাটতি ছিল বলে কবিতা লিখতাম। কিন্তু যখনই সময় বের করতে শিখে গেলাম গদ্য এবং গল্পের শক্তি আমার স্বাভাবিক সত্তা হয়ে ওঠে। আমি কবি চেশোয়াভ মিয়োশের সঙ্গে একমত নই
যখন তিনি বলেন, ‘ওয়াগানভর্তি গদ্যের চেয়ে/ কবিতার একটি পঙ্ক্তি বেশি ভার বইতে পারে।’ বরং বলব, একটি ভালো উপন্যাসের ওজন হাজার ভলিউম কবিতার চেয়ে বেশি!’
ইউরোপের অপর নামই স্বাধীনতা।
পৃথিবীর আর কোনো ফ্রিডমের এত ব্যাখ্যা নেই; এই স্বাধীনতা সাহিত্যের ওপরও খবরদারি করে। বলা যায়, এটা ইউরোপের বাতিক। রাজনীতি, অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির লাগাতার বদলে যাওয়া স্বাধীনতার ধারণাটিকেও পরিবর্তিত করে। এখন এর মানে কেবল রাজনৈতিক গুরুত্বের নয়, সামাজিকও; অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে উঠে আসছে স্বাধীনতা। তোকারচুক বলেন, ‘সর্বত্র উপস্থিত গণমাধ্যম, ইন্টারনেট এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার আলোকে একে দেখতে হবে। কবিরা লেখকদের চেয়ে ওপরে তাঁদের মাথা তুলতে পারেন, তাঁরা স্বাধীনতার কথা বেশি বলতে পারবেন!’
তিনি জানতেন এটা ঘটবেই!
ওলগা তোকারচুক একদিন না একদিন নোবেল প্রাইজ পাবেন এটা জানতেন তাঁর লেখার ইংরেজি অনুবাদক জেনিফার ক্রফ্ট। জেনিফার নিজেও ওলগার সঙ্গে ফ্লাইটস উপন্যাসের অনুবাদক হিসেবে বুকার প্রাইজ পেয়েছেন।
‘আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলাম এটা ঘটতে যাচ্ছে। আমি সম্পাদকদেরও বলে আসছি, কেউ বিশ্বাস করেননি।’
কিন্তু জেনিফার বিশ্বাস করলেন কেন?
অনেক কারণে। যেসব বিষয়ে ওলগার উদ্বেগ তার সবই নোবেল কমিটির মূল্যবোধের অনুগামী। তিনি সবসময় নারীর সরব কণ্ঠের উদ্যাপন চেয়ে থাকেন, তিনি প্রকৃতিকে ভালোবাসেন। তিনি পরিবেশবাদী, সীমান্তের সংকটে তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ, তাঁর চমৎকার গদ্যশৈলী।
জেনিফার ইউনিভার্সিটি অব আইওয়ায় রুশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ শুরু করে শিগগির পোলিশ ভাষা বেছে নেন। তখন ওলগার ‘পেস্নয়িং অন দ্য ম্যানি ড্রাম’ গল্পের অনুবাদ করতে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েন তাঁর সব লেখার ওপর। তিনি ওলগার গদ্যের গীতিময়তার প্রতি আকৃষ্ট হন। ‘আমি যখন তাঁর উপন্যাস ফ্লাইটস-এর ‘গডজোন’ অধ্যায়টি অনুবাদ করতে শুরু করি, কাহিনি আমার চোখ অশ্রম্নতে ভরে দিয়েছে। আমি এটা নিয়ে ভাবতে থাকি – আমার দুঃস্বপ্ন শুরু হয়ে যায়। আমাকে খুব গভীরভাবে স্পর্শ করেছে এ-কাহিনি।’
ওলগার অনেক লেখার প্রেক্ষাপট সতেরো ও আঠারো শতকের ইউরোপ। কিন্তু জেনিফারের পছন্দ একাল। ওলগাকে এ-ধরনের লেখার জন্য অনেক গবেষণা করতে হয়, অনুবাদ করতে গিয়ে সেই গবেষণার কষ্টকর ভার তাঁকেও বহন করতে হয়।

একটি পাদটীকা
কিছুটা পরিহাসের মতো শোনালেও এটা সত্য, পোল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, ওলগা তোকারচুক নোবেল পুরস্কারের যে-অর্থ পাবেন তার ওপর থেকে আয়কর প্রত্যাহার করা হবে।

ওলগা তোকারচুকের বইপত্র
(ইংরেজিতে অনূদিত)

১৯৮৯ : সিটিজ ইন মিরর (একমাত্র কাব্যগ্রন্থ)
১৯৯৩ : দ্য জার্নি অব দ্য বুক-পিপল
১৯৯৬ : প্রাইমেভাল অ্যান্ড আদার স্টোরিজ
১৯৯৭ : দ্য ওয়ার্ডরোব
১৯৯৮ : হাউজ অব ডে, হাউজ অব নাইট
২০০০ : খ্রিস্টমাস টেইল
২০০০ : দ্য ডল অ্যান্ড দ্য পার্ল
২০০১ : পেস্নয়িং অন ম্যানি ড্রামস
২০০৪ : দ্য লাস্ট স্টোরিজ
২০০৬ : আন্না ইন দ্য টুম্বস অব দ্য ওয়ার্ল্ড
২০০৭ : ফ্ল্যাইটস (ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কারপ্রাপ্ত)
২০০৯ : ড্রাইভ ইয়োর প্লাউ ওভার দ্য বোনস অব দ্য ডেড
২০১২ : দ্য মোমেন্ট অব দ্য বিয়ার
২০১৪ : জ্যাকব’স স্ক্রিপচার (জার্মান নাটকে অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত)
২০১৮ : বিজার স্টোরিজ