কথাসাহিত্যের জল-হাওয়া

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর

কথার সাহিত্য হয়, সাহিত্যেরও কথা হয়; এর আবার জল-হাওয়াও থাকে। কথা সে তো ভাবের মাধ্যম; এমনকি আনন্দ-ক্রোধ-লজ্জা-ঘৃণা, জীবন আদান-প্রদানেরও মাধ্যম। কথা যখন থাকে তখনো মানবজীবনের বিকাশ বা ক্ষয় থাকে, যখন কথা ছিল না বা থাকে না, নির্জনতা দিয়েই অনেককিছু মাপা যেত, তখনো তাতে জীবন ছিল। কথার জীবন থাকে, কথ্যগল্প হয়। মুদ্রিত কথায় তো সাহিত্য থাকেই। তার নামই এই জমানায় কথাসাহিত্য। সেই তো জীবনের জল বা হাওয়া – না দেখার মতো, বা দেখার মতো উপাদান। তবে তা সর্বত্রগামী। যেন তাতে ঈশ্বরত্ব থাকে। ঈশ্বর তো অদৃশ্যের ভেতর নিজের অস্তিত্ব জারি রেখে চলেছে। তবে জল প্রায়ই দেখা গেলেও কথ্যশিল্পে তা বিমূর্ত থাকে। জল তখন জীবনবাস্তবতার অংশ। কিংবা জলকে আমরা কথ্যশিল্পের জোগানদার বলে মেনে নেব – জলবিহীন জীবন অচল। সেই জলই আবার আমাদের এই দেশটার সীমানা নির্ণয় করে দিচ্ছে – নদীই যেন এ-জনপদের আরেক জননী। কিন্তু এই শিল্পের হাওয়া হিসেবে কাকে আমরা ধরতে চাই? যা মুগ্ধ করে, অনুরণনে শরিক হয়, ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্র সম্পর্কীয় বিষয়-আশয় সম্পর্কে কথাশিল্পীকে ভাবায়, নাড়ায়, সরায় – তা-ই হাওয়ারূপে আমরা মেনে নিলাম।
কথ্যশিল্পের এই জল-হাওয়া ইতিহাসে থাকে, বিভিন্ন মতভেদে থাকে; থাকে ঐতিহ্যে, ধর্মে, সংস্কারে। আমরা যখন ইতিহাসের কথা বলব, তখনই রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, এমনকি বিরাষ্ট্রীয় অবস্থার নানা কথকতা আমাদের ভাবনায়, বোধে, প্রেরণায় আসা-যাওয়া করবে। ব্যক্তি-পরিবার-রাষ্ট্র ইত্যাকার নানাবিধ প্রতিষ্ঠান আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যে-জীবন রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার ইচ্ছাকে জাগ্রত করতে পারে, তা-ই রাষ্ট্র নামের প্রতিষ্ঠানটি জিইয়ে রাখে। আমরা যে-ধরনের প্রতিষ্ঠান কর্তৃক শাসিত হচ্ছি, তা-ই রাজনৈতিক সংগঠন দ্বারা চালিত। সে-অনুপাতে ভাষা ও ভাষা-ব্যবস্থাপনা নিজেদের ক্ষমতাকে প্রসার-প্রকাশ করে। কথাশিল্পী সে-অবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেন, কিংবা মোকাবিলা করেন। তিনি খাপ খাইয়ে নেবেন, নাকি মোকাবিলা করবেন, তাতেই তার জল-হাওয়ার মৌলতা প্রকাশ পাবে। তার মানে একজন কথাশিল্পী তার শব্দ, চিহ্ন, বাক্যসহযোগে তার পছন্দীয় জল-হাওয়ায় রচনা করতে থাকেন। তিনি সমাজবাদ, নৈরাজ্যবাদ, অস্তিত্ববাদ, উদাহরণবাদ, বৈরাগ্যবাদ (!), নিরন্তর আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা, উত্তর-উপনিবেশবাদ, কাঠামোবাদ বা উত্তর-কাঠামোবাদ, নাকি পুঁজিবাদের বাহক হবেন, সেটা তার মনোজাগতিকতার বিষয়। একসময় সাম্যবাদকেই প্রগতিশীলতার চূড়ান্ত রূপ বলে অনেকেই বিশ্বাস করতেন। এখনো তা করেন, তবে তার ভেতর আরও অনেক কথা, কথার বিভিন্ন বাঁক এসে যাচ্ছে। এটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে যে, জগতের যাবতীয় একনায়কতন্ত্রই একসময় জনসংস্কৃতির বিকাশকে চেপে ধরে। শিল্পসংস্কৃতির বিকাশ শুধু অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তির ভেতর দিয়ে ঘটবে কি-না, এ-প্রশ্ন থেকেই যায়। মতবাদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত শাসন সৃজনশীলতার ওপর হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। একটা রাষ্ট্রে একধরনের সমাজকাঠামো তো থাকে না। এই যেমন, পাহাড়ি বা অন্যসব আদিবাসীর সামাজিক বিন্যাস তো এক হয় না। সংস্কার এক নয়। তাহলে সেখানে রণনীতির ধরনটা সমতলের মতো কী করে হবে? পাহাড়ের জীবন, মুগ্ধতা, সরসতা, নীরসতা তো এক হয় না। নৈরাজ্যবাদ শ্রেণির বিলোপ চায়, শ্রেণিসংগ্রাম চায়, ব্যক্তির সৃজনশীলতা, স্বতঃস্ফূর্ত উপার্জনকে সাপোর্ট করে। কিন্তু এর মাধ্যমে রাজনৈতিক বিকাশের ধরনটা কেমন হবে? প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে এর মেলবন্ধন বা বিরোধটা কী ধরনের হতে পারে, তা কিন্তু আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। এতে রাষ্ট্রের বিলোপ কাম্য, কিন্তু তার প্রসেস কী? অস্তিত্ববাদও জীবনের বিকাশ, জীবনকে স্বাধীনভাবে চেনানোর পথ দেখায়; কিন্তু তাতে হিরোইজম-মিলিটারিজম, এমনকি ফ্যাসিজম ডেভেলপ করার চান্স থাকে কি না ভেবে দেখার বিষয়। মানুষের জৈবিকতা, প্রকৃতি-পরিবেশ ইত্যাদির সঙ্গে তার স্বাধীন সম্পর্ক, সৃষ্টিকর্তার প্রতি উদাসীনতা প্রকাশে উদাহরণবাদ একটা মজার অবস্থানে আছে! এতে আর যা-ই হোক, সৃষ্টিশীলতার স্বরাজ প্রতিষ্ঠার একটা তুমুল সম্ভাবনা হয়তো থাকে। ভাবের মাধ্যমে মননবিকাশের একটা আলোচিত বিষয় বৈরাগ্যবাদে থাকতে পারে। বৈরাগ্য চৈতন্যের ভেতর দিয়ে নিজের ভাবকে কার্যকরভাবে প্রকাশ করার একটা ব্যবস্থা এখানে আছে। নিরন্তর আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা, উত্তর-উপনিবেশবাদ, কাঠামোবাদ বা উত্তর-কাঠামোবাদ ইত্যাদি পুঁজির স্বাধীন বিকাশের সহায়ক কি-না, তা তীব্রভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে। করপোরেট মিডিয়া আর রুরাল ইকোনমিকে নিয়ন্ত্রণবাদী এনজিও কার্যক্রমের সঙ্গে কথাশিল্পের জল-হাওয়া কেমন বিবেচনা রাখবে, তাও একটা বিবেচনার বিষয় বইকি। ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথাশিল্পের এই জল-হাওয়া কী আচরণ করবে, তা এখনকার অতি দরকারি এক বিষয়।
আমাদের এ জনপদখোদিত জল-হাওয়া কখনো কি শান্ত-অচঞ্চল-নির্মল ছিল? তা কি থাকার কোনো সিস্টেম আছে? রাষ্ট্রের ইতিহাস তা বলে না। ধর্মের নামে যে-জনপদ আলাদা এক রাজনৈতিক-স্থাপত্যের রূপ নেয়, সেখানে দেখা গেল ধর্মটা আসলে মুখোশ – এর নামে শোষণ-নিপীড়ন-পেষণই মুখ্য কাজ। তাই তো কখনো ভাষার লড়াইয়ে, কখনো জাতীয়তার লড়াইয়ে এ-জনপদ শামিল হয়েছে। কিন্তু এই জনপদের জল-হাওয়া মুক্ত হয়নি। কখনো ক্ষুব্ধতায় চিৎকারে রোদনময়তায় চারপাশ আলোড়িত, স্তম্ভিত করেছে। কিন্তু জনসংস্কৃতি বিভিন্ন বেড়াজালে পড়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে। রাষ্ট্র তার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সার্বিক মুক্তির স্বাদ পায়নি। তাই তো ভাষার নামে যে লড়াই হয়, তা মাতৃভাষার সার্বিক মুক্তির দিকে না গিয়ে রাষ্ট্রভাষার অ্যাকাডেমিক আধিপত্য বজায় থাকে। রাষ্ট্রলালিত বাংলাভাষা মাতৃভাষাসমূহের ওপর আধিপত্য জারি রাখে। একটা জনপদের মানবমুক্তির সার্বিক লড়াই, জনযুদ্ধ শেষ পর্যন্ত একটা রাষ্ট্রীয় শ্রেণির আধিপত্যের লড়াই হয়ে রয়। রাষ্ট্র এমনই ছলনা জানে, হুঙ্কার জারি রাখে। কথাক্রমেই বলতে হয়, এই জনপদ এখন যেন মৃত-পাঙাশের নির্জনতা নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, ক্ষয়ে যাচ্ছে। কত যে নিপীড়ন এর ওপর দিয়ে যাচ্ছে, কত যে লুণ্ঠন এই জনপদ দেখেছে! এখন মানুষ হারানোর গল্পে গুম, হত্যা, ক্রসফায়ার, গুপ্ত-ইতিহাস যুক্ত হচ্ছে। হায় মানুষতা, হায় তার নির্লিপ্ত অসহায় রূপ।
এই বিষয়সমূহ নিয়ে আমি ভাবি, তখন আমার পাঠস্মৃতির বিষয়কে স্মরণ না করে পারা যায় না। কোনো স্মৃতিকেই অতি একরৈখিকভাবে নির্ণয় করা মুশকিলই। স্মৃতি মূলত জীবনের সামগ্রিকতার একটা অংশ। এই যে আমার পাঠস্মৃতিকে আলাদা করে হিসাবে আনতে চাচ্ছি, তা কি কখনো হয়? হয় না। কারণ, এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে আমার বেড়ে ওঠা, বলা-না-বলা, মুদ্রিত-না-মুদ্রিত জীবনকথার সমাহার। তার স্মৃতি তো আলাদা করে কিছু দেখানোর বিষয় হয়ে যায় না। এর সঙ্গে যে-কথাটা একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে, তা হচ্ছে ব্যক্তির বেড়ে ওঠার ইতিহাস; মনোজটিলতার বিবর্তনধারার বিষয়টি এখানে প্রয়োজনীয় কথাক্রমেই আসে। অ্যাকাডেমিক কালচারকে তা থেকে একেবারেই আলাদা করা যায় না। আমরা যতই প্রতিষ্ঠানকে বাইপাস করতে চাই, এমনকি বাদ দিতে চাই, তা কিন্তু শেষতক করা যায় না। কারণ এই যে, এখন, যে-প্রক্রিয়ার ভেতর নিমজ্জিত হয়ে আমার লেখাটার একটা কিনারা করতে চাচ্ছি, তা কিন্তু এস্টাব্লি¬শমেন্টের একেবারে বাইরে থেকে সামালই দিতে পারব না।
ওই যে অ্যাকাডেমিক কালচারের কথা বলছি, তা আমার স্মৃতিতে প্রাইমারি স্কুল পেরিয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার কাল থেকেই যুক্ত হয়ে আছে বলে ধরা যায়। তখনকার পাঠস্মৃতি বলতে পড়াশোনার বাইরের যে-পাঠ বা মননচর্চা হয়, তা কিন্তু লেখাপড়ার বাইরের পঠনপাঠনের জগৎকেই নির্দেশ করে। আর আমরা বরাবরই সে-পাঠকে কথিত আউটবইচর্চা বলেই বুঝতাম। আমার মনে আছে, তখন আমরা সবে রক্তাক্ত জনযুদ্ধের ভেতর দিয়ে একটা স্বাধীন ভূখন্ড পেলাম। আমাদের স্মৃতি থেকে রক্তের নোনতা গন্ধ তখনো মিলিয়ে যায়নি; বরং সমগ্র জাতির ভেতর রক্তের এক প্ল¬াবন যেন সর্বত্রই লেগে ছিল। জনসংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে চলে। হাইস্কুলেই আমরা বিপ্ল¬বের ইশারা টের পেতাম। এত হত্যা, রক্তপাত, যুদ্ধ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভেতর দিয়ে জনবিপ্ল¬ব যেন কী এক ইশারা রেখে যায়। আমাদের পাঠস্মৃতি তখন পাঁচ মাথাওয়ালা (মার্কস, অ্যাঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সে তুং) মানবখচিত গোপন-পত্রিকা পড়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকত। প্রতিটি গ্রাম বদলে যাচ্ছে, পরিবর্তনের জন্য নিমগ্ন ব্যাকুলতা বাড়ছে। গ্রামে-গঞ্জে নাটক-যাত্রার ব্যাপকতা বেড়ে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের অস্ত্রব্যাকুল বিপ্লবী রাজনীতির প্রতি নেশা বেড়েই যাচ্ছে। ছোটদের রাজনীতি, ছোটদের অর্থনীতি, মাও সে তুংয়ের প্রবন্ধ, বিভিন্ন জায়গার কৃষক-আন্দোলন, তেভাগা-আন্দোলন, কৃষক-শ্রমিক রাজনীতির জ্বলন্ত ইতিহাসপাঠের একটা ধারাবাহিকতা খেয়াল করতাম। খেয়াল করতাম নাটক-যাত্রার ব্যাপক প্রসার ও পরিবর্তন – ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের বিপ্লবী ঘরানার যাত্রাপালা; মামুনুর রশীদ, সেলিম আল দীনদের মঞ্চনাটক ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
গ্রন্থপাঠের সঙ্গে প্রয়োজনীয়তার একটা নিবিড় প্রেম কিন্তু আছে। স্কুল-কলেজে কবিতাপাঠের কোনো বিষয় থাকলে কাব্যগ্রন্থ; গল্পের কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে গল্পগ্রন্থপাঠের বিষয়টা একধরনের সিলেকটিভনেসের ভেতর দিয়েই হয়ে যেত। অন্তত আমার বেলায় তা-ই হয়েছে। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় অত চিন্তাভাবনা করে আমার তেমন কিছু পড়া হয়নি। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে মননচর্চা ও আবেদন বাড়ে। বিশেষ করে শহীদ দিবস, বিজয় বা স্বাধীনতা দিবস, কর্নেল তাহের দিবস, অক্টোবর বিপ্লব দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন প্রকাশনার আমার ওপর প্রভাব ছিল অনেক বেশি। প্রগতিশীল সাহিত্যচর্চাকে সমুন্নত রাখা ছিল একধরনের সাধনার নাম।
এর ভেতরই কিছু রোমান্টিক ধাঁচের বইপত্রও তখন পাঠ করছি। এবং তা পড়ার জন্য ভেতরে ভেতরে একধরনের ব্যাকুলতাও টের পাচ্ছি। যার ফলে চান্স পেলেই তা সংগ্রহের তালে থাকতাম। আমি যে-স্কুলে পড়তাম, বাজিতপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, সেখানে প্রচুর বই ছিল। অন্তত তখনকার পাঠক্ষুধা নিবৃত করার জন্য যেমন আউটবই থাকার দরকার, তা কিন্তু ছিল। আমার মনে আছে, আমাদের রসিক স্যার, যিনি আর্টের ক্লাস নিতেন, তিনিই বই ইস্যু করার দায়িত্বে ছিলেন। আকবর হোসেন, শরৎচন্দ্র, ফাল্গুনী প্রমুখের বই-ই সচরাচর পড়তাম আমরা। একটা গ্রন্থ আমি পড়েছিলাম, এটির নাম ছিল তৃষ্ণা (লেখকের নাম এখনো জানি না), এত ভালো লেগেছিল যে মনে হতো, আহা নারীর ভালোবাসার কত যন্ত্রণা; এ-যন্ত্রণা যদি শেষ করে দেওয়ার মন্ত্র আমার জানা থাকত, তাহলে শেষ করতামই। আমার যদ্দুর মনে পড়ছে, এ-গ্রন্থটি পড়েই অধিক মুগ্ধতায় পড়েছিলাম। আরেকটা গ্রন্থের কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে, আর তা হচ্ছে শরৎবাবুর বিরাজ বউ। সে-বইটি ক্লাস নাইনে পড়ার সময় কত যে আমি কেঁদেছি। একটা লাইন ঠিকভাবে পড়তে পারতাম না। আমি এখনো ভাবি, আচ্ছা, একটা গ্রন্থের ভেতর কী এমন জাদু আছে যে আমাকে এভাবে কাঁদাবে! সেই কান্নার কথা মনে হলে এখনো আমার কান্না আসে। কিন্তু তা তো আর সেভাবে হওয়ার নয়। কারণ, জীবন জীবনকে অনেকভাবেই বদলে দেয়। এখন আর বিরাজ বউ পড়া হয় না; পড়তেই পারি না, কেবলই মনে হয়, জীবন তো এমন নয়। শরৎবাবু কীসব ছেলেমানুষি করেছেন! সমাজ এমন নয়, মানুষ এমন নয়, সমাজের নিয়ম এমন নয়; রাষ্ট্রকে বস্ত্তমুখরতায় এখন চিনতে শিখে গেছি। কিন্তু যে-গ্রন্থ আমার এত কান্না নিয়ে নিল, তার কী হবে? তা তো কখনো মিথ্যা নয়। বিরাজ বউয়ের কান্নার এই তালে পড়ে তার বড়দি, মেজদি, শ্রীকান্ত, দেবদাস পড়েছি। অনেকবারই পড়েছি, কিন্তু বিরাজ বউ আমার স্মৃতিতে আলাদা একটি জায়গা করে নিয়েছে। মানিকের ‘সমুদ্রের স্বাদ’ নামের গল্পটি বারবার পড়তে গেলে কান্নায় বুক ভেঙে আসে। কী যে শোভন-ব্যাকুলতা বুকের একেবারে গভীরে জমতে থাকে। হয়তো কান্না মানুষের সবল জাগতিকতার কোনো বিষয় নয়, অতিভক্তিতে মৌলস্বর খুঁজে পাওয়া যায় না, মানুষ জাগতিক অন্ধত্বের কাছে নিজেকে বিলীন করে দেয়। এমনই আরেক কান্নার স্মৃতি আছে নন্দিত নরকে পড়ার সময়ে। তাও অনেক বদলে গেছে। এখন আর তা সেভাবে টানে না।
যেহেতু একেবারে বিশুদ্ধ-অজপাড়াগাঁয়ে আমার স্কুল-কলেজ জীবন, তাতে কথিত ক্ল্যাসিক সাহিত্য আমার তখন পড়া হয়নি। সাহিত্যের পড়াশোনাটা সিরিয়াসলি আমার শুরু হয় মেডিক্যালে পড়ার সময়। তবে তাও অনেক বাধাগ্রস্ত হতো। কারণ, মেডিক্যাল কলেজের সেই কঠিন রূপ-রসহীন পড়ার বাইরে কথিত আউট বই পড়া, একেবারে প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। তবে তখন আমার নেশা ছিল কাব্য, গল্প আর উপন্যাস পড়ার দিকে। আমি অমুক-তমুকের কাছ থেকে বই ধারকর্জ করে পড়ার চেয়ে বরাবর নিজে কলেক্ট করার দিকেই মনোযোগী ছিলাম। আরেকটা বাতিক আমার ছিল, এখনো তা আছে, পুরনো বই আমি তেমন কিনতাম না। আমার অনেক লেখকবন্ধু এখনো ফুটপাত থেকে দেদার বই কিনছে। আমি কিন্তু তা তেমন পারি না। তবে এও ঠিক, আমার যে ফুটপাত থেকে বই একেবারেই ক্রয় করা হয়নি, তাও নয়। তবে তা উল্লেখযোগ্য কিছু নয়।
একটা বিষয় আমি লক্ষ করেছি যে, আমার ভেতর নানা ধরনের খেয়ালিপনা কিন্তু আছে। কিন্তু কোনো খেয়ালই আমার মনোজগতে চিরস্থায়ী আসন গাড়তে পারেনি। এর ব্যতিক্রম হচ্ছে, পাঠ গ্রহণের তুমুল তৃষ্ণা। এখনো পাঠই আমার চরম সঙ্গী। সে-পাঠের রকমফের হয়েছে, চরিত্র বদলেছে, কখনো সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, কখনো বা ব্লগ-ওয়েব ম্যাগাজিন-ফেসবুকে মজেছি। কিন্তু গ্রন্থপাঠের আলাদা আমেজ আমার ভেতর সদা লালন করি, এখনো করব।
এখন এ-প্রশ্ন আসতেই পারে, আমি লেখার ধারাবাহিকতা কীভাবে রক্ষা করব? কে আমাকে সে-কাজটি করিয়ে নেবে। বা, আমিই কেন এর জন্য একটা চেষ্টাচরিত্রের ভেতর থাকি? আসলে মানুষ মানুষ বলেই সে তার সভ্যতা নির্মাণ করতে চায়, সে-সভ্যতাকে বহনও করতে চায়। মানুষ আসলে সর্বদা একটা সাজানোর প্রক্রিয়ায় থাকে। কে কোথায় কতটুকু থাকবে, তা তার ব্যক্তিত্বই নির্ধারণ করে দেবে। এই যে আমি পাঠজনিত একটা প্রক্রিয়ার ভেতর থাকি, আমি এভাবে থাকতে পছন্দ করি, তা কিন্তু এক লহমায় নির্ধারিত হয়ে যায় না। তা ক্রমাগত এক প্রক্রিয়ার ব্যাপার, মনোবিবর্তনের ব্যাপার। মানুষের সংস্কৃতির ভেতরই এই বিবর্তন ক্রিয়াটি চলে। আমি যেভাবে নিজেকে জারি রাখতে চাই, যেভাবে জারি রাখতে পারি, সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবারের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া আমার চলে; এবং এভাবে চালাতে চালাতে একটা অবস্থানে আমি নিজেকে আবিষ্কার করি, তাই তো আমার বিবর্তন ক্রিয়া, নাকি? আমার সে-চলমানতায় গ্রন্থই অনেক কিছু করে দেয়। এবং গ্রন্থসকল তা করতে পারে বলেই তাদের সঙ্গে আমার এত মাখামাখি। এই আচানক প্রাণময়তার সঙ্গে আমার মাখামাখি তাই আমার স্মৃতির অনেকটুকু জুড়ে থাকবে – তাই তো স্বাভাবিক?
এ-প্রশ্ন আসতেই পারে, গ্রন্থপাঠের এমনকী আছে যে তা জারি রাখতে হবে? এর উত্তর দেওয়া হয়তো মুশকিল। তবে আমার এ-বিশ্বাস আছে যে, আমাকে আমার শুদ্ধতার জন্য, নিজেকে চেনার জন্য, সে-চেনাটাকে একটা স্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্য বা রূপ দেওয়ার চেষ্টা করার জন্য গ্রন্থপাঠের বিকল্প কিছু নেই। অন্তত আমার কাছে মনে হয়। কাজেই এটি আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, পাঠস্মৃতিই আমার কাছে অতিপ্রয়োজনীয় একটা স্মৃতি, যার বিকল্প কিছু হতে পারে না।
এবার আবার আসা যাক কথাশিল্পবিষয়ক কথকতায়। আমরা স্মরণ করতে চাই, কথাযোগে যেমন সাহিত্য হয়, তেমনি সাহিত্যেরও কথা হয় – এই একটা জায়গায় এসবের পারস্পরিক লেনদেন আছে। একের ভেতর অন্যের জায়গা-জমিন, ভাব-অনুভাব দেখার (সেই কথাসৃজনের কাল থেকে) জীবনের সামগ্রিকতায় ভর করে আছে। সে-কালটি তবে কখন থেকে শুরু হলো, তা পরখ করতে গিয়ে বলা যায়, মানুষ যখন উঁচুজাতের বাঁদর থেকে তার জন্মখোলস ভাঙতে ভাঙতে নিচুস্তরের মানবে নিজেদের অবস্থান বুঝতে থাকে, তখন থেকেই কথার সৃজনতা শুরু। শুরুতেই এই শুরুর আরেক শুরু আছে, কারণ মানুষ তো সাপের বাচ্চা নয় যে জন্মের পরপরই শরীর থেকে পিচ্ছিল জীবনরস মুক্ত করতে করতেই স্বাবলম্বী সাপ হয়ে যাবে। মানুষকে ইশারায় তার কথাবার্তা শুরু করতে হয়। তারপর তার কলবে কথা জমা করে, সেই কথার উৎপাদন হয়, সেই উৎপাদনে ভর করে তার কথা তার মতো করেই সৃজিত হতে থাকে। কথার মাধ্যমেই তার জীবনকাহিনি শুরু হয়। কথাযোগে আমাদের এসব পরিচিত সাহিত্যচর্চা মুদ্রণব্যবস্থাকে ভর করে হয়।
সেই হলো শুরু, জীবনযাপন, ভাবনা, এমনকি নিজের অস্তিত্ব আবিষ্কারের এক-একটা পন্থা এক-একজন করতে থাকেন। কথাসাহিত্যিকগণ এভাবে নিজেকে দেখেন, অপরকে দেখান, নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীও হয়তো হয়ে ওঠেন। তাদের চর্চার ভেতর সময় একটা বড় ফ্যাক্টর, নিজেকে নির্মাণ যেমন একটা বিষয় আবার নিজের ভেতর লালন করা নিজের ট্যাবুকে ভেঙে ফের আবিষ্কারের বিষয়টাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই যেমন, বঙ্কিম প্রথমত, দ্বিতীয়ত এবং শেষত নিজের চোখে নিজেকে দেখাটা সাঙ্গ করতে পারেননি। তিনি যে রোমান্টিকতা আবিষ্কার করেছেন, দুর্গেশনন্দিনীতে নিজেকে উজাড় দেখানোর বিষয়টা শুরু করেছিলেন, ধর্মীয় যৌথত্ব নির্মাণের হুলস্থূল বিষয়টি শুরু করতে চাইলেন, তাতে তিনি ধীরে ধীরে নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী, এমনকি প্রতিস্পর্শী হয়ে ওঠেন। দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুন্ডলা, বিষবৃক্ষের বঙ্কিম আর আনন্দমঠ-সীতারামের বঙ্কিম এক নন। তিনি উপনিবেশ-লালিত আধুনিকতা থেকে নিজেকে মুক্ত করেননি। তাঁর আয়কৃত আধুনিকতা ইউরোপিয়ান আধুনিকতা থেকে ধারকর্জ করেই হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছে। এইখানে আমরা প্যারিচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলালের কথা স্মরণে আনতে চাই। এটি আমাদের বাংলাদেশের এক দরকারি উপন্যাস। তা শুধু উপন্যাসজগতের প্রথমদিককার উপন্যাস বলেই নয়, বরং এটি ভাষাপ্রকাশের ক্ষমতা বা ব্যাকুলতার জন্যই আলাদা করে মনে রাখতে হবে। এর ভেতর যে লৌকিক ভাষার রূপটি ছিল তা যদি বিকাশ লাভ করত, তাহলে আমাদের আধুনিকতা অনেক স্বতঃস্ফূর্ত মানবিকতার নিশানা হয়ে থাকত। কিন্তু বঙ্কিম-ঘরানার আধুনিকতার বলিষ্ঠতায় তার বিকাশই হলো না! রবিঠাকুর একেবারে বঙ্কিম-প্রযোজিত ওই টাইপের আধুনিকতায় নিজেকে অবগাহন করাননি। প্রতি-আধুনিকতাও তিনি নির্মাণ করতে পারলেন না। তিনি গোরার মাধ্যমে যে-আধুনিকতার সগর্ব বীজ ধারণ করতে পারতেন, তা ইউরোপিয়ান কালচারের প্রতি ছায়াছায়া মোহ আর ব্রাহ্মধর্মের প্রবল টানে শেষ পর্যন্ত একেশ্বরবাদী ছায়াময় আধুনিকতার কাছেই নিজেকে সঁপে দেওয়া হলো। শরৎবাবু তাঁর চোখে গ্রামকে যেমন দেখেছেন, তেমনি এর পীড়ন, জমিদারি পেষণ কখনো কখনো দেখেছেন; পিসি-মাসি-দিদি ধরনের মমতাময়ী নির্মোহ চরিত্র এঁকেছেন তিনি। তার কাছে সামাজিক শোষণ-পেষণ কোনো রাজনৈতিক স্বচ্ছতা নিয়ে আসেনি। যার ফলে তার চরিত্রসমূহ, বিশেষত মমতাময়ী নারীকুলের কোনো তীব্র-তীক্ষ্ণ দ্বন্দ্ব নেই, চরিত্রের তেমন বিকাশও নেই। মনে হয়, কথিত নির্ভেজাল মায়া দ্বারাই জগতের যাবতীয় শোক-তাপ-লজ্জা-ঘৃণাকে ওভারকাম করা সম্ভব। সতীনাথ ভাদুড়ী, সুবোধ ঘোষ, জগদীশ গুপ্তরা মানুষকে একেবারে গভীর সংবেদনশীল জায়গা থেকে আলাদা করে আবিষ্কারের প্রয়াস পেয়েছেন। তাদের মানুষজন রক্তমাংসমুখর যন্ত্রণা, ত্যাগ, হুঙ্কার, ভালোলাগা নিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যের আলাদা চেহারা উন্মোচন করেছেন। শিল্পের ইন্টারনাল পাওয়ার তারা সন্ধান করতে পেরেছেন। কথাসাহিত্যের আধুনিকতার প্রকৃত মোচড়টা তারাই প্রকাশ্য রূপে আনতে পারেন। তাদের ধারাবাহিক রূপের প্রধান সারথি হয়ে আছেন কমলকুমার, অমিয়ভূষণ, সন্দীপন, দীপেন্দ্রনাথ, মাহমুদুল হক, সেলিনা হোসেন, সুচরিত চৌধুরী, রশীদ করীম, মইনুল আহসান সাবের, মনিরা কায়েস, কাজল শাহনেওয়াজ, সেলিম মোরশেদ, ওয়াসি আহমেদ, নাসরিন জাহান, হুমায়ূন মালিক, শাহাদুজ্জামান প্রমুখ। এই দিক থেকে মানিক একেবারে আলাদা – তিনি একটা ধারার প্রতিনিধি হয়ে আছেন আর তা হচ্ছে, মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের ধারা। ইলিয়াস, হাসান, কায়েস, মঞ্জু সরকার, শহিদুল জহীর, মামুন, মহীবুল, ইমতিয়াররা হচ্ছেন তার সরাসরি প্রতিনিধি।
এখানে প্রথমোক্ত ধারাটির অনেকেই শিল্পত্বকে একটা যথার্থ মেজাজ হিসেবে দেখছেন, মানবিক বোধকে এস্টাব্লিস্ট করছেন। তাদের কাছে শিল্পের বিষয়টা আলাদা এক সাধনার বিষয়। অর্থনৈতিক উপরিকাঠামো যেখানে দ্বিতীয় ধারার লেখকরা সাধন-ভজন করছেন, সেখানে প্রথমোক্ত দলটি শিল্পের সাধনাকেই মুখ্য করতে সমর্থ হয়েছেন। তবে ষাট-সত্তর-আশির দশক ছিল মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের একেবারে গণজোয়ারের মতোই বিশাল এক ব্যাপার। এখন তা বদলাচ্ছে, মানবিক মূল্যবোধ, অস্তিত্ব, নিজের ঈশ্বরত্ব নির্মাণের প্রয়াস যেন আলাদা আলাদা মেজাজ নিয়ে তাদের ভিন্ন ভিন্ন সাহিত্যিক চরিত্র নির্মাণ করতে পারছেন; বা, এই সাধনায় কেউ কেউ আছেন।
আমরা ইলিয়াসের গল্প-উপন্যাস পাঠ করতে করতে অন্তত এ-কথাটা স্বীকার করতে বাধ্য হব যে, তিনি তার সাহিত্য সাধনায় যান্ত্রিক মার্কসিজমের প্রতি আস্থা রাখেননি। মানুষের অন্তরের বহু স্তর, জৈবিক বিন্যাস, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, এমনকি ভাষার নানান কৌশল প্রয়োগ করেছেন। তার খোয়ারির সঙ্গে দোজখের ওম বা অন্য ঘরে অন্য স্বরের সঙ্গে জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জালকে এককাতারে দেখা সমীচীন নয়। তেমনি তার চিলেকোঠার সেপাই আর খোয়াবনামাকে এককাতারে রাখা যায় না। মানুষকে প্রকাশের নানান ভঙ্গি, ভাষার বহুস্তরিক বিন্যাসকে আমরা এক করতে পারি না। খোয়াবনামা অনেক বেশি শৈল্পিক মাধুর্যের দাবিদার। ভাষাতে আছে জল-কাদা-হাওয়ার চমৎকার দাপট। এখানে শ্রেণি অর্থবাদী উপরিকাঠামো দ্বারা সরাসরি নিয়ন্ত্রিত নয়। যার ফলে খোয়াবনামা বহু অর্থে বহু কিছু প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছে। এত মানুষ, এত কোলাহল, এত জৈবিকতা, ভাষার এত মধুময় জান্তব প্রকাশ আর কোথাও দেখা যায় না। একই কথা খাটে দেবেশ রায়ের তিস্তাপুরাণ আর তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্তের বেলায়। তিস্তাপুরাণ তার চরিত্রের বিন্যাসে, ভাষার মাটিলগ্নতায়, লেখক-নির্মিত সত্যপ্রকাশের প্রাবল্যে আলাদা এক জায়গা করে দিয়েছে। আমরা এই ক্ষেত্রে বিষাদ সিন্ধুর কথা স্মরণ করতে চাই। এখানে লেখক একই উপন্যাসে নানান চরিত্র ধারণ করেছেন। তার বিহবলতা, সত্যনিষ্ঠতা, এমনকি ধার্মিকতা উপন্যাসের মৌলিক চরিত্রকেই হতচকিত করে রেখেছে। এর শুরুতে মনে হবে, মুসলমান সম্প্রদায়কে নিয়ে তিনি জীবনের নানান স্তর, জীবনের সত্যনিষ্ঠ এক স্তর নির্মাণ করবেন। বাঙালি মুসলমান একটা যথার্থ কাব্যিকতার অংশীদার হবে। ভাষায় যত বঙ্কিমপ্রভাব আর ইউরোপিয়ান আধুনিকতার দেশজ রূপ প্রকাশ পাক, এই লেখক মুসলমান সম্প্রদায় শুধু নয়, বাংলাভাষার জন্য নবতর প্রাণের প্লাবন বইয়ে দেবেন। কিন্তু অচিরেই তিনি মুসলমান পুঁথিওয়ালাদের রূপ-অতিকথন দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন। সনাতন ধর্মের দেবকুলের মতোই মুসলমান চরিত্রে ক্রমাগত ঐশ্বরিক আকর্ষণ আয় করতে শুরু করেছেন তিনি। অলৌকিকতার জান্তব প্রকাশে তার আস্থা প্রকাশ পেতে থাকল। এর ভেতরই চরিত্রের ভেতর রক্তমাংসময় মাদকতাও প্রকাশ করছেন। কিন্তু তিনি উপন্যাসটির ফিনিশিংয়ে এসে একেবারে চরিত্রের ভেতর ধর্মের জয়গান প্রয়োগ করাতে দেওয়ানা হয়ে গেলেন। যার ফলে বেশ গোছানো একটা কাজ বহু তালের এক প্রকাশমুখর মিশ্র শিল্প হয়ে থাকল। আরেকটা উপন্যাসের নাম এখানে উল্লেখ করতে চাই, নবারুণ ভট্টাচার্যের হারবার্ট। এটিতে সত্তর দশকের অস্ত্রবাজ মুক্তির লড়াই যেন আমার কাছে আলাদা একটা অদ্ভুত মাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়। এর ভাষাভঙ্গি, সমাজের প্রতি ক্রোধ, একটা রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা আমায় দারুণ মুগ্ধ, তাপিত, জারিত, এমনকি ক্ষুব্ধও করে।
একেকটা সময় আবার একেকজন ঔপন্যাসিকের মাধ্যমে তার অবস্থান প্রকাশ করতে সমর্থ হন। দেশভাগের ফলে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শওকত ওসমান প্রমুখ যদি সৃষ্টি হয়ে থাকেন, বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন সৃষ্টি করেছে জহির রায়হানকে। ষাট-সত্তরের দশকের সশস্ত্র বামদ্রোহ সৃষ্টি করেছে ইলিয়াস-হাসান-কায়েসকে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর যার চরম বিকাশ হয়েছে, তিনি হচ্ছেন আহমদ ছফা; তার পরবর্তী সময়ের সামাজিক ক্রোধ, হতাশা, লড়াই-সংগ্রাম বানিয়েছে সুশান্ত-মঞ্জু-জহির-মামুনকে। এরা এক-একটা সময়কে রিপ্রেজেন্ট করতে সমর্থ হচ্ছেন।
সাহিত্য সম্পর্কে এই যে কয়েকজন সম্পর্কে আমি কথা বললাম, এ-কথাগুলো আমাকে বলার অধিকার কে দিয়েছে? আমি তো লেখক-বিশ্লেষণের কোনো ওহি নাজেল হওয়া কামেল নই। আমি এটা বলতেই কেন যাব? আমি কি সময়ের পাহারাদার? তাহলে এই যে কথাবার্তায় নিজেকে জড়িয়ে ফেললাম, এটি কে মানবে, না-মানবেই কে? এখানেই একজন লেখকের সঙ্গে একজন পাঠকের চূড়ান্ত বোঝাপড়ার পালা চলে আসে। একজন লেখক কখন লিখে থাকেন? কে তাকে লিখতে বলছে বা বাধ্য করছে? কিছু না লিখলে কী হয়। তিনি যখন কিছু লিখে থাকেন, তখন কি একাই লিখে থাকেন! কথাক্রমে বলতেই হয়, এই যে একাত্তরের ৭ মার্চ শেখ মুজিব রেসকোর্স ময়দানে স্মরণীয় ভাষণটি দিলেন – তা কি একাই বহন করছেন? একাই এত কথা বলছেন! এ যদি সত্য বলে ধরে নিতে হয়, তার সঙ্গে যে সাড়ে সাত কোটি মানুষ আছেন, তারা তাহলে কিছুই না? এখানেই জনসংস্কৃতির বিশাল একটা ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে। মানুষ কখনো একা একা কিছু করতে পারে না। মানুষ তার সত্তার অংশীদার হয়ে সব কথাই বহু কথার সমন্বয় থেকেই বলে! একজন লেখকও একা একা কথা বলেন না। তিনি সমাজে, রাষ্ট্রে, এমনকি তার নিজের কথাগুলো তার মতো করে প্রকাশ করছেন মাত্র। আমি বলতে চাচ্ছি, তার যে সৃজনশীলতা, ঈশ্বরত্ব, সৃষ্টিময়তা এর সঙ্গে বহু মানুষ থাকেন। লেখক একজন কম্পোজিটর মাত্র। তিনি সৃষ্টিমুখর নকলবাজও বটে! একজন পাঠক বা আলোচক যখন কথা বলেন, তখন তিনিও একা একা কথা বলেন না; বা কথা দ্বারা শাসিত হন না। এরও অংশীদার সবাই। তাহলে একজন আলোচক বা আলোচকের বাহাদুরিটা কোথায়? বহু জনের ভেতর দিয়ে বহু জনের হয়ে বহু মতের ভেতর দিয়ে একা একা প্রকাশ করার ঈশ্বরত্বই তার বাহাদুরি। এখানেই সৃজনশীলতার মাধুর্য প্রকাশিত।
লেখকের সঙ্গে একজন আলোচকের সম্পর্কও এখানে, দ্বন্দ্বও এখানেই। একটা লেখা প্রকাশিত হলে তা আর লেখকের একার থাকে না। বহু জন তাতে শরিক হন। একক সৃজনশীলতার গহবর থেকে বহুস্বর খলখল করে তার সাক্ষ্য হতে থাকেন। এমনকি পুনর্নির্মাণের দায়ভারও তিনি বহন করেন। এটাই একজন পাঠকের কাজ। কাজেই একজন পাঠককে লেখকের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাবার কোনো কারণ দেখি না। একজন গাছ অন্যজন পরগাছা, একজন বৃক্ষ অন্যজন তার ছায়া, এভাবে দেখার পক্ষপাতী আমি নই।
তবে আলোচনাসাহিত্যে আবার নানা রকমফের আমরা দেখি। পাঠকের এই অবজারভেশনকে আমি অন্তত তিন ভাগে ভাগ করতে চাই – ১. হ্যাঁ-কথক, ২. না-কথক, ৩. নিপুণ কথক। একটা শ্রেণি আছে – হ্যাঁ যথেষ্ট ভালো হয়েছে, অন্য পক্ষ যতই শিল্পমুখর সৃজনে ব্রত হোক, একে বাজে বলতেই হবে। এর ভেতরই আরেকটা ধরন আছে, যারা যাহা মনে তাহাই প্রকাশ করবেন। এখানেই পাঠক বা আলোচকের সৃজনশীলতা প্রকাশ পায়। তবে একজন লেখকের সঙ্গে একজন পাঠকের ক্যাচাল নানাভাবেই হতে পারে। ধরা যাক, আহমদ ছফার ওঙ্কার একটা পুরোমাত্রায় রাজনীতিনির্ভর উপন্যাস। উপন্যাসটির স্রষ্টা আসলে শুধু আহমদ ছফা নন, ঊনসত্তরের তামাম নিপীড়িত বাঙালিই এর চরিত্র। এখানে একটা জান্তব উপমা প্রকাশ পেয়েছে বলে আমার মনে হয়। মেয়েটি যে বোবা অবস্থা থেকে হঠাৎ রক্তছিঁড়ে কথা বলতে পারল, তা আসলে লড়াইয়ের বিজয় – বিজয় মানুষের। এ হচ্ছে সংগ্রামের চলমানতার এক প্রতীক। এখন আমার কথা হচ্ছে, ছফা কি সেভাবে ভাবতেন? আরেকজন হয়তো বলবেন, এটা তো গাঁজাখুরি গল্প (এমন বলতেও শুনেছি আমি), একটা জনমভর বোবা মেয়ে কথা বলবে কীভাবে? মেডিক্যাল সায়েন্স কি তা মানবে? ছফার একজন কেনান আলীর উত্থান পতন থেকে কিছু কথা বলা যেতেই পারে। এতে ঊনসত্তরের গভর্নরের বাসা, তখনকার রাজনীতি, মাজার-সংস্কৃতি ইত্যাদি বেশ সহজিয়া রূপে কাহিনি বলার মতোই ছফা বলে গেছেন। আমি যেটা মনে করি, কথারও বিভিন্ন তল থাকে, ভাষার বিভিন্ন নড়াচড়া থাকে। এখানে লেখক কাহিনি বলার মতোই ওপরতল ধরে কিছু কাহিনি-উপকাহিনি বলে গেছেন। গল্পের নিপুণ প্রয়োগ, সাংকেতিকতা, জাদুময়তা ও অন্তর্গত চেতনার কিছুই নেই এখানে। কিন্তু কেউ কেউ বলেন, সে-সময়টা এতে দারুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এভাবেই তর্ক তৈরি হয়। বহু পথ, বহু মতের এদেশটা তো রামকৃষ্ণও আবিষ্কার করতে পারেননি। কলির দেবতা (!) যেখানে বিফল হলো, মানুষ সেখানে কী আর করবে? কেউ বলবেন শহীদুল জহির, ব্রাত্য রাইসু বা এবাদুর রহমান তো প্রমিত বাংলায় চেনেন না, তারা আবার লেখক হলেন কী করে। হুমায়ূন মালিক যেভাবে সমাপিকা ক্রিয়া হজম করে যান, তার তো বাক্যই পূর্ণ হয় না। সুবিমল মিশ্র বা কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর যেভাবে একই ধরনের বাক্যে, মেজাজের কথা বলে বিভিন্ন চিহ্ন আয় করেন, লালন করেন; তাদের এই কেরদানির কী মাজেজা থাকতে পারে! এভাবেই আলোচনার বিভিন্ন ডালপালা গজায়। লেখক তার সৃজনশীলতার যন্ত্রণা নিয়ে থাকেন, আর আলোচক আজীবনের ট্রাডিশনের কাছে নিজের পিওরিটির সন্ধান করতে থাকেন। উষ্ণ-আবহাওয়ার এদেশে সবখানেই গরমের এক লেনদেন যেন হওয়াই লাগে। কত যে আবেগ এখানে, লেখকদের আবেগ, মর্যাদা, লাঠিয়ালগিরি তো আরো বেশি। একটা বিষয় একেবারে তীব্র সত্য যে, আমাদের এই পূর্ববঙ্গের লেখককুল সর্বদাই সমালোচনার ব্যাপারে একেবারে লাঠিহস্ত, বিরূপ আলোচনা তারা শ্রবণের বিন্দুমাত্র বাসনা রাখেন না। আবেগের এদেশে ভক্তির প্রাবল্যে, নির্দয়তার ত্রাসে অধিকাংশ লেখকই নিজের সৃষ্টিশীলতাকে জগতের সেরা কর্ম মনে করেন। অভাব, অনটন, কষ্টাকষ্টির এ-বাংলাদেশে তাদের ন্যূনতম সহনশীলতা যে কবে হবে? আরো অনেক আলোচকই চড়া স্বরের বেহুদা খোঁচাখুঁচি খুব পছন্দ করেন। লেখার শৈল্পিক অবস্থা দেখার বিষয়টা বদলে অনেকেই ফ্ল্যাপ দেখেন, বা লেখকের সঙ্গে খানিক বাতচিত করে তাদের আবিষ্কারের জায়গাটি দায়সারা গোছের কতিপয় বাক্যযোগে ভরাট করেন মাত্র। তাতে লেখার পুনঃসৃজন হয়ে যায় বহুদূরের এক সাধনা।
দারিদ্র্য নিয়ে জৈবিক ব্যবসামুখর এ-কালে, করপোরেট পুঁজিসমীপে নিত্যনমিত থাকার এ-কালে সাহিত্য তার কাজটি কীভাবে করবে, করতে পারবে? এ-কাল হচ্ছে সামাজিক ব্যবসার কাছে, এনজিওর কাছে, সুশীল সমাজের সঙ্গে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার কাল। সাহিত্য সৃজন হোক আর তা নিয়ে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া হোক, এর রিমোট কন্ট্রোল আর নিজের কাছে রাখার ক্ষমতা বা তাগিদ যেন ক্রমে ক্ষয়েই যাচ্ছে! সাহিত্য এখন এলিটত্ব সন্ধানে ব্যস্ত, শেরাটন হোটেলে তার বিচরণ বোঝা যায়; কলকাতা, হিল্লি-দিল্লি করে, লন্ডন-নিউইয়র্ক-মন্ট্রিল চষে বেড়ায়। এখন ইন্টারনেটের এ-কালে লেখক নিজেই প্রকাশক-আলোচক-প্রচারক। ওয়েবসাইটের ম্যাগাজিন তাকে এতই তুখোড় প্রচারক করে তুলছে যে, তার লেখার তাৎক্ষণিক প্রকাশ-প্রচার-প্রসার না হলে যে চলছে না! সাহিত্যের সাধন-ভজন-নিমগ্নতার কালক্রমেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। কোনো তথ্য, তত্ত্ব, রেফারেন্স, এমনকি যৌগিকতা নির্মাণের জন্য তুমুল পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই, কম্পিউটারই দেদার তা সাপ্লাই করছে। অত সময় কোথায় যথার্থ যে ব্যাখ্যা, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপময়তার স্নিগ্ধ গন্ধ নেওয়ার। এই ধরনের সাহিত্যও এখন ওয়ান-টাইম-ব্যান্ডেজের মতোই হয়ে যাচ্ছে! সাহিত্যে এখন জেদাজেদির কাল চলছে – যা কিছু হোক, আমার জয় চাই – এমনই একটা ব্যাপার কিন্তু আছে। একটা রুমে বসে, কম্পিউটারে ইন্টারনেট অন করত যত বোঝাপড়া তা এখন ওয়েবসাইট ম্যাগাজিন, ফেসবুক, ব্লগের সঙ্গে। এখানে কথার লেনদেন হয়, তথ্য-বিনিময়ও হয়। এখানে চলে তর্ক-বিতর্ক। নিজেকে শীর্ষে রাখার, তাৎক্ষণিক মতামত প্রকাশের একটা প্রবণতা এখানে জারি থাকে। একটা কি-বোর্ড সামগ্রিক ব্যক্তিত্বের নিয়ন্ত্রক হয়ে যাচ্ছে। এখন কারো কারো কাছে শিল্প-সংস্কৃতির লেনদেন মানেই একধরনের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা। মতবিনিময়ের ভেতর দিয়ে অনেক দরকারি কথা-চালাচালি হয়। তখন তা নিয়ে মগ্নতার চাষবাস আর হয় না। এতে এ-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একধরনের ক্রিটিসিজম বর্তমান থাকে; কিন্তু নিমগ্ন চেতনার ফলে যে সাহিত্যময়তার প্রকাশ ঘটে, তা ক্রমেই একধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। পরিশ্রমলব্ধ কাজের নেশাটা বদলে যাচ্ছে।
সাহিত্য নিয়ে কথা বলার ঝামেলাও কম নয়। একজন শিল্পের সাধক তো অন্যজন জীবনবাদিতা থেকে একচুল এদিক-সেদিক করা-টরা একেবারে বরদাস্ত করবেন না। উত্তর-আধুনিক সাহিত্যসাধনার বিচার করতে বসলেন উত্তর-কাঠামোবাদী, আধুনিকতাবাদীর সঙ্গে কাইজাফ্যাসাদ হতে পারে উত্তর-ঔপনিবেশিকের। কথা এখানেই শেষ নয়, সাহিত্যে হাসিনা-খালেদা আছে, আছে পুলিশ-মিলিটারি, ভাষা বনাম ধর্মানুসারীর বুর্জোয়াসুলভ লাফালাফি আছে। সব কথার মূল কথা, এখানে বিশুদ্ধবাদিতার সঙ্গে বস্ত্তবাদিতার লড়াই-সংগ্রাম একেবারে ফরজ। সাহিত্যের এই লিডারশিপের বাসনা বরাবরই লক্ষ করা যায়। এ লড়াই, ঝগড়া, কাইজা স্বীকার করে নিয়েই কথাশিল্পের সাধনার কাজটি চালিয়ে না-যাওয়া ছাড়া উপায় নাই। এভাবেই দ্বন্দ্ব নিত্য বহমান এক ক্রিয়া হিসেবে বিরাজ করে। একটা লেখা তখনই নতুন জীবন পায়, জীবনে জীবন মিলে যখন মাধুর্যে আলাদা জগৎ তৈরি করে। মানুষের মৌলিক বিশুদ্ধতার প্রকাশ, মানবিক গণতন্ত্রের বিকাশ একটা বড় বিষয়। বেহুদা মানবিক লিডারশিপের স্থলে নমিত, অবদমিত নিম্নবর্গীয় মানুষের মানবিক চৈতন্যের বিকাশ দরকার। কথাসাহিত্য এভাবেই নতুন কথনের ভেতর তার সৃজনমুখরতার উন্মেষ ঘটায়।
শিল্পের স্বতঃস্ফূর্ত মানবিক বিকাশ প্রয়োজন; নিজেকে, পরকে, পরের পরকে বারবার আবিষ্কারের বিষয় থাকে। শিল্পের ঈশ্বরত্ব কায়েমের বিষয়টিও বাদ দেওয়া যায় না। মনোজাগতিকতার উত্থান, ভাবের স্বাধীন বিকাশ, প্রকৃতি-পরিবেশ ইত্যাদি মিলে মানুষকে স্বাধীনভাবে চলার পথ নির্মাণ জরুরি। কোনো ঈশ্বরপ্রেরিত ওহি এই সময়ের মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, কারণ তার ওহি তাকেই নির্মাণ করতে হবে। কথাশিল্পের জল-হাওয়ায় মুক্তস্বাধীন চৈতন্যের লালন অতীব প্রয়োজন। নিজের আয়নাকে নিজেই ভাঙার মতো তাকদ থাকতে হয়। কথাশিল্পের গড়নপেটন সম্পর্কেও একই কথা খাটে – তাতে নতুন নতুন জল-হাওয়ার সংযোজন-বিয়োজন প্রয়োজন। এ তো জীবন আবিষ্কারের বিষয়, বারবার গুছিয়ে ফের ভাঙচুর করারও বিষয়। এভাবেই কথাশিল্পের জল-হাওয়ার আলাদা আলাদা জগৎ সৃজিত হবে।