কবিতার বিষয় ও প্রকরণ-বৈচিত্র্য

আহমদ রফিক

সময়ের এক একটি বিন্দুতে দাঁড়িয়ে কবিতা আধুনিকতার টানে নিজেকে সাজিয়ে তুলতে চেষ্টা করে মূলত নতুনত্ব ও অভিনবত্বে। অবশ্য নির্দিষ্ট দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রভাব বাদ দিয়ে নয়, ‘আধুনিকতা’ শব্দটি তাই সময়-নির্ভরতার বিচারে আপেক্ষক্ষক। যুগে যুগে কালে কালে সব দেশেই এমনটি ঘটে। আধুনিকতার ক্ষেত্রে পরম বা চরম বলতে কিছু নেই।

বাংলা সাহিত্যের, বিশেষ করে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে উদাহরণ টেনে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময়ের বিচারে আধুনিক। আবার আপাত রবীন্দ্রবিরোধী বুদ্ধদেব বসু বা সমকালীন একাধিক কবিকেও বলা হয় আধুনিক। পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের বাংলা কবিতার সংকলনের বিচার ব্যাখ্যায় এমনিটাই চোখে পড়ে।

আধুনিক সাহিত্য, আধুনিক কবিতার চেহারা-চরিত্র এভাবে পালটায়; কিন্তু ‘আধুনিকতা’ শব্দটা পালটায় না। সে যুগ থেকে যুগে আধুনিকতার শিরোপা ঠিকই ধরে রাখে, উত্তর-আধুনিকতার তত্ত্বও তাকে নির্বাসনে পাঠাতে পারেনি। আমরা তাই আধুনিক কবিতা শব্দটিকে এন্তার ব্যবহার করে থাকি।

অন্যদিকে রোমান্টিকতা পেরিয়ে বস্ত্তবাদের প্রভাব সত্ত্বেও কবিতার ভুবন থেকে রোমান্টিকতার পরিপূর্ণ নির্বাসন কখনো ঘটেনি। কবিতার সূক্ষ্ম বিচারে এমনটিই দেখা যায়। তার প্রচ্ছন্ন অবস্থান। বাংলা কবিতায় এর একটি বড় উদাহরণ সুবীন্দ্রনাথ দত্ত বা বুদ্ধদেব বসুর কবিতা।

কবিতার ভুবনে সবচেয়ে বড় অঘটন বিষয় ও প্রকরণের প্রাধান্য নিয়ে দ্বন্দ্ব, যা কাল থেকে কালান্তরের সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সে-উপলক্ষক্ষ শিল্পসর্বস্বতা নিয়ে দুই বিপরীত তত্ত্বের দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্ব কবিতায় শব্দের একাধিপত্য নিয়েও, সুদূর ফরাসি দেশ থেকে বঙ্গদেশে। বাদ যায়নি এলিয়ট-পাউন্ড নিয়ে ভিন্নধারার বিতর্ক, মধ্যখানে ইয়েটস। পরবর্তী স্পেন্ডার-অডেনকে নিয়ে প্রগতিবাদীদের মাতামাতি যাদের উত্তরপুরুষে অভিনবত্বের হতাশাই হয়ে উঠেছে বড়।

এ-কালের বিদেশি আধুনিকদের, বিশেষত ইউরোপীয় কবিতার ভুবনে আধুনিকতার পুলসেরাতও কবিকে-কবিতাকে বোধিসত্ত্বের মর্যাদা দিচ্ছে না। কবিকে ঘিরে কবিতার দশক বিচার বা মাহাত্ম্য প্রচার হালে পানি পাচ্ছে না। পাচ্ছে না তত্ত্বের বিচারেও। মালার্মে বা বোদলেয়ারের আধুনিকতা খারিজ না হয়েও গৌণ হয়ে দাঁড়ায় আরাগঁ-এলুয়ার-গারোদিদের সমাজ-বাস্তবতার টানে।

তখন চলিস্নশের দশক যেন কবিতার ‘মুক্তির দশক’ নাইবা হলো শেষ বিচারে রাজনৈতিক মুক্তির দশক, অন্তত ভারতীয় উপমহাদেশে বা বঙ্গে। কবিতার তাত্ত্বিক যুগ, প্রাতিষ্ঠানিকতার যুগ পেরিয়ে এখন কি বলা যায়, দশকটি অমুক কবির বা কবিত্রয়ের বা কবি পঞ্চকের। বাংলা কবিতার কোনো বঙ্গেই তেমন কথা বলা চলে না বিশেষ করে স্বাধীন বাংলার কবিতার রাজ্যে পৌঁছে।

কবিতার মূল্যায়ন এখন সমষ্টিভাঙা, দশকভাঙা বিচারে। কোনো তত্ত্বই এ-কালের কবিদের একচেটিয়া প্রভাবে সংঘবদ্ধ বা সমষ্টিবদ্ধ করতে দেখা যাচ্ছে না, যাকে বলা যেতে পারে কবিতার মূলধারা বা মূলস্রোত। যেমন দেখা গেছে ‘একুশের কবিতা’য় বা তার দুই দশক পর ‘মুক্তিযুদ্ধের কবিতা’য়। এ-ধারার অবসান ঘটেছে দশকখানেকের মধ্যেই।

বাংলাদেশের কবিতা এখন ব্যক্তিবৃত্তে আবদ্ধ এবং তা বিচ্ছিন্ন কাব্যব্যক্তিত্বের প্রকাশে। তত্ত্ব এখন আর প্রভাবশালী কাব্য-প্রকল্প নয়। উত্তর-আধুনিকতা নিয়ে এখন আর আগের মতো ততটা মাতামাতি নেই, যদিও কেউ কেউ এর মহিমা প্রচারে পিছিয়ে নেই। তবু এর পিছিয়ে পড়ার কারণটি অন্যত্র।

হয়তো এ-কালের কাব্যগুণসম্পন্ন সৃষ্টিতে যারা মগ্ন তাদের মধ্যে এমন প্রত্যয় জন্মেছে যে, কালবিচারে কালান্তরে আধুনিকতা মাত্রই তো উত্তর-আধুনিকতার (পোস্ট-মডার্নিজমের) ফসল। আধুনিকতা পেরিয়ে সময়ান্তরে (এক সময়কার দশকান্তরে) নব্য আধুনিকতা, যার নাম উত্তর-আধুনিকতা। এর ওপর তত্ত্ব চাপিয়ে উত্তর-আধুনিকতার পতাকা ওড়ালেই কি তা অতি-আধুনিক হয়ে যায়? কাব্যের আধুনিকতা বরাবরই কালান্তরের আধুনিকতা, কবিতার চরিত্রবদল নিয়ে আধুনিকতা, তাকে উত্তর বা দক্ষিণ, ডান বা বাম যাই বলি না কেন।

 

দুই

কবিতার বিচারে আমি ওপরে উলিস্নখিত ধারণায় বিশ্বাসী, তাই কবিতার বিচারে বা উপভোগে শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদদের সময় পেরিয়ে, আবুল হাসান ও নির্মলেন্দুদের পেরিয়ে বাংলাদেশি কবিদের বিচ্ছিন্ন সৃষ্টির নিজস্বতা বুঝে নিতে আমার কষ্ট হয় না, অসুবিধা হয় না। যে-আগ্রহ নিয়ে আবু হাসান শাহরিয়ারের কাব্য পাঠ, ভিন্নমাত্রায় সেই আগ্রহ নিয়ে বিমল গুহ বা গোলাম কিবরিয়া পিনুর কাব্যরসাস্বাদ, ততোধিক ভিন্ন চারিত্র্যে মুনীর সিরাজ কিংবা বিপরীত ধারায় সাজ্জাদ আরেফিন বা পিয়াস মজিদের কাব্য পাঠ। বাদ যায় না অরুণ সেন বা খালেদ হোসাইন, সুলতান বা জামিল আখতার বানু।

বর্তমান বাংলাদেশের কবিতাভুবনের বাস্তবতায় রাজনৈতিক মতাদর্শ কিছুসংখ্যক ব্যতিক্রম বাদে প্রভাব-বিসত্মারী শক্তি নয়। একই কথা খাটে শিল্পসর্বস্বতার ক্ষেত্রে। এখানেও হয়তো দু-চারজন ব্যতিক্রমীকে দেখা যাবে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কবিতা বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট ব্যক্তিক বৃত্তে বাঁধা। সেখানে সবাই নিজ নিজ ধারায় আধুনিক।

অথবা ‘আধুনিকতা’ শব্দটিকে উড়িয়ে দিলেও কোনো ক্ষতি নেই। কারণ প্রত্যেক কবিই তার সমকাল ও সামাজিক পরিবেশকে ধারণ করেই আধুনিক। তাকে তাই আত্মপরিচয়ে আধুনিকতার নামাবলি গায়ে চড়াতে হবে কেন। সে তো তার কালসমৃদ্ধ উপলব্ধি ও সমাজনির্ভর অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপট মাথায় রেখেই অনুভূতির তাড়নায় কবিতা লিখবে। সেখানে সমকাল ও সমাজজীবন তার পৃষ্ঠপোষক।

কবিতার আদর্শ, কবিতা লেখার প্রেরণা সম্পর্কে কাউকে কাউকে লিখতে দেখি, ‘কবিতা কোনো ইজমের দাসত্ব করবে না।’ হ্যাঁ, কবি ও কবিতার সৃষ্টিধারা কারো নিয়ন্ত্রণ মেনে চলে না। তেমনি সে বৈদগ্ধ্য বা এস্টাবিস্নশমেন্টেরও ধার ধারে না। আধুনিকতা, অনাধুনিকতা বা উত্তর-আধুনিকতার মতো শব্দগুলো কবিতার রাজ্যে অর্থহীন। কবিতা অনুভূতির চাপে প্রকাশ পায়, শৈল্পিক ক্যাথার্সিস ঘটিয়ে জন্ম নেয়। তবু কবির চৈতন্যে একটি শিল্পাদর্শ তো থাকেই, যা কবি থেকে কবিতে অর্থাৎ পরস্পর থেকে ভিন্ন।

এখন ব্যক্তিবিশেষের কবিতা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কবিতার এই প্রয়োজনীয় গৌরচন্দ্রিকা বা ভূমিকা, তার শেষ কথা হচ্ছে, বহুউচ্চারিত একটি চিরন্তন সত্য, ‘পৃথিবীতে কবিতার মৃত্যু নেই’। কারণ পৃথিবীতে যতদিন মানুষ আছে, তাদের মন আছে, মনে জোয়ার-ভাটার খেলা আছে, প্রেম আছে, প্রকৃতি আছে, ততদিন কবিতাও আছে। অর্থাৎ কবিতার জন্মও এক অবিসংবাদী সত্য। কারণ কবিতা হচ্ছে ‘অনুভূতিসঞ্জাত এক রূপময় ভাবশিল্প’।

 

তিন

এই প্রেক্ষাপটে আমিনুল ইসলামের কবিতা নিয়ে কিছু কথা বলা। সত্যি বলতে কি এ-বয়সে আর একালীন নবীন সব কবির কবিতা পড়া হয়ে ওঠে না, হাতের নাগালে না আসার কারণে। সে হিসাবে, কবুল করছি, আমিনুল ইসলামের কবিতা আমার জন্য এই প্রথম পাঠ। তাঁর কবিতাসমগ্র কিছুটা সময় নিয়ে পড়তে হয়েছে। কারণ এ ‘সমগ্র’ বা সংগ্রহে রয়েছে দশটি কবিতা গ্রন্থের অন্তর্ভুক্তি। পৃষ্ঠা সংখ্যা চারশত।

প্রথম পাঠেই আমিনুল ইসলামের কবিতার যে বহিরঙ্গ-বৈশিষ্ট্য আকর্ষণ করেছে তা হলো কবিতার বিষয়বৈচিত্র্য। সেটা নিঃসন্দেহে পরিবেশ প্রভাবনির্ভর। কবি তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন এ-বইয়ের ভূমিকায়। অভিজ্ঞতাই তো কবিতা সৃষ্টির প্রেক্ষাপট তৈরি করে, সেই সঙ্গে রয়েছে কবিতার এক চিরন্তন বিষয় প্রেম, যা নানা আধারে নানা মহিমায় দীপ্ত। এক্ষেত্রে কবিদের জন্য সর্বাধিক আকর্ষণীয় মানব-মানবী তথা নরনারী প্রেম। তারপরই স্বদেশ ও প্রকৃতি প্রেম, যা দেশকালের ভেদ মানে না।

কবি আমিনুল ইসলামের কবিতায় একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বহুমাত্রিক প্রেম, বিশেষ করে নরনারী প্রেমের বিচিত্রভাষ্য। এই ভাষাবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কবির নিজস্ব বক্তব্য হচ্ছে, ‘আমি প্রেমের ভিতর দিয়ে জীবন ও জগৎকে দেখার চেষ্টা করে আসছি’। জীবন ও জগৎকে শৈল্পিক চোখে দেখা ও জানার পরিণামেই তো কবিতার জন্ম। সে-জন্মের সঙ্গে রয়েছে যেমন আনন্দ, তেমনি যন্ত্রণাবোধ।

সে-যন্ত্রণার বহুবিচিত্র রূপ, গভীর থেকে গভীরতর তার দগ্ধ অনুভূতি। আছে বিষাদ, আশা-হতাশা, আছে নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব বোধের অসাধারণত্ব, থাকে এক বহুবর্ণিল স্বপ্ন। সে-স্বপ্ন যেমন সীমাহীন ভালোবাসার ও নতুন পৃথিবী গড়ার, তেমনি তাতে থাকে অপূর্ণতার বেদনা, থাকে মৃত্যুকে নিয়ে নানা অনুভূতির প্রকাশ। কবিতা প্রসঙ্গে যেমন সত্য ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্তভাবনাহীন’, তেমনি সত্য ‘জীবন-মৃত্যুর পরে তুহিন দৃষ্টি মেলে ঘোড়াসওয়ার চলে।’ রবীন্দ্রনাথ থেকে ইয়েটস। কিন্তু নারীকে নিয়ে শৈল্পিক ব্যবচ্ছেদে বাঙালি কবি থেকে ফরাসি কবি বোদলেয়ার একই ধারায়, উৎকর্ষে যদিবা পার্থক্য থাকে : ‘আমি তোরে ভালবাসি আছি মাংসসহ’, তবে সে
নারী-মূল্যায়নের চরমরূপ বোদলেয়ারের ‘শব প্রতিকৃতি’ যেখানে পুঁজ-ক্লেদ-পূতিগন্ধের ধ্বস্ত দেহপ্রতিমাই লাবণ্যময়ীর স্থান দখল করে। ভাগ্যিস বাংলাদেশি কবিকুল এমন দু-একজন অগ্রজকে অগ্রাহ্য করে প্রেমের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়-স্বরূপ ও ইন্দ্রিয়াতীত – দুইকে মান্য করেও ভিন্নমাত্রার আপন উপলব্ধিতে প্রকাশিত।

সেখানে কবির হাতে গড়ে ওঠে নিজস্ব শব্দভাণ্ডার অথবা বলা উচিত শব্দ-ব্যবহারের নিজস্ব ভিন্নতা, কারো মতে অভিনবত্ব। তেমনি উঠে আসে অনুভূতির সজ্জিত প্রকাশে বা প্রকরণগত আকর্ষণে তৈরি চিত্রকল্প, যা স্থানিক তাৎপর্যে অর্থবান। তেমনি থাকে কিছু বহুদৃষ্ট উপমা বা প্রতীকের ব্যবহার; তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে মহিমময় প্রেমের প্রতিফলন ঘটে রৌদ্রতাপে বিবর্ণ বাস্তবতায়। এমনটিও এ-কালের সাম্প্রতিক কবিদের কলমে প্রেমের বিড়ম্বনা।

উলিস্নখিত কথাগুলো কমবেশি খাটে আমিনুল ইসলামের কবিতার ক্ষেত্রে। বাদ থাকে না ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মৃতি, বিশেষত লোকজ সংস্কৃতি ও লোকজীবনের পারম্পর্য সমাজজীবনের শ্রেণির ভেদাভেদের পরিপ্রেক্ষেতে। মানবীপ্রেমের অপেক্ষাতেও আমিনুল ইসলামের কবিতায় বড় হয়ে ওঠে গন্তব্যহীন উদার বিসত্মারে মুক্তি, যে-মুক্তি নদীমাতৃক বাংলাদেশের শিকড়ছেঁড়া ভালোবাসা এবং তার রংফেরা আকাশ-মেঘের বা বর্ষণের বাইরে নয়।

বাইরে নয় বিশ্বমানবিকতা, যা সাধারণ বিশ্ববোধের অংশ। সে-বিশ্ববোধে জীবন এক বড় আধেয়। স্বদেশে বিদেশে সে জীবনবোধ ‘মানুষ’ নামক শব্দটিকে কেন্দ্র করে, যে-মানুষ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষ। এ-বৈশিষ্ট্য অগ্রজসৃষ্ট বাংলা কবিতার বৈশিষ্ট্য। তার প্রকার ভেদসহ। আর এ-ভেদ বা ভিন্নতা কবিমাত্রকেই নিজগুণে চিনিয়ে দেয়।

কিন্তু সব ছাড়িয়ে ‘ভালোবাসা’ তার নানামাত্রিক চরিত্র নিয়ে ধরা দেয়; কিন্তু এক রৌদ্রতাপময় রুক্ষ বাস্তবতায়। তা সত্ত্বেও এ-ভালোবাসার আকাঙক্ষা ‘নিপাতনে সিদ্ধ’ এতো বেহিসেবি ধন হয়ে ওঠার। অগ্রজদের কেউ কেউ, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল-জীবনানন্দ এ ‘বেহিসাবী ধন’-এর টানে কখনো কখনো বেসামাল হয়েছেন। প্রথমজন তো তার আকাঙক্ষার নারীকে বহুবর্ণে, বহুরূপে চিত্রিত করে গভীর আবেগে লিখতে পেরেছেন –

তুমি হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন

তাই হঠাৎ পাওয়ায় চমকে উঠে মন।

হয়তো মনে মনে এমন আশংকাও জেগে থাকে ‘কখন হারাই ভাবি সারাক্ষণ’। এই পাওয়া না-পাওয়ার হিসেবি খেরোখাতায় আমিনুল ইসলামের ভালোবাসা জীবনের বাস্তবতায় কখনো অপরপক্ষে ‘সেভিং অ্যাকাউন্টে’র প্রতীকে ধরা থাকে; কিন্তু সেখানে বিপরীতটাও সত্য যে, হিসাবটা আসলে ‘বেহিসাবী’ চরিত্রের।

প্রেম বা ভালোবাসার মতো আবেগ আকুলতার ভরাগাঙকে বিচিত্র রঙে এঁকেছেন আমিনুল ইসলাম, তাকে করেছেন বিচিত্রগামী। সেই প্রেম-ভালোবাসা কখনো ‘নান্দনিক শ্রমে’ গড়া হয়েও ‘অন্ধরাতে অন্তরঙ্গ চাঁদ’-এর মতো হৃদয়ের তাপে এক উষ্ণ সত্য। তাই হারানো ধনকে ‘আড়চোখে খুঁজে ফেরা’ জীবনের এক চিরন্তন সত্য, ট্র্যাজিক সত্য হয়ে দাঁড়ায় আমিনুল ইসলামের রচনায়।

সনেট কাঠামোয় রচিত তাঁর পারম্পর্যময় ছয়টি পদাবলি কবিতা ভালোবাসার উদ্দেশে নিবেদিত। তবে তা চ–দাসী পদাবলি নয়। কারণ সময়টা তো একুশ শতক। তাই প্রণয়ী আবেগ বা ভালোবাসার স্নিগ্ধতায় জায়গা করে নিয়ে জীবনযাত্রা এক আটপৌরে চিত্রচারিত্র্য। তবু পদাবলিমন এর মধ্যে গুটিকয় প্রকরণ-সিদ্ধ পঙ্ক্তির জন্ম দিয়েছে। তাতে আবার বৈপরীত্য ও অভিনবত্ব সৃষ্টি করেছে;

নদীর শরীরে আজ বাসা বাঁধে জলাশয়-সুখ

প্রেম কি যে কি অপ্রেম-এ দ্বিধায় পেয়েছে রাজত্ব।

চতুর্থ-সংখ্যক পদাবলি সনেটটিকে আমার অসাধারণ মনে হয়েছে আটপৌরে শব্দ ব্যবহারের মধ্যেই :

এ কোন্ বাতাস বলো … ফাগুনে হলুদ ইস্তেহার

বোঝে নাকো ঘাসফুল এ কেমন অকালের ভাও।

… … …

তবুও প্রাণের ঘাঁটি এ আমার লখিন্দর-কায়া

বেহালাদুপুর তুমি অক্সিজেনে মেখে ধূপছায়া।

ষষ্ঠ পদাবলিও একইরকম তাৎপর্যপূর্ণ বাক্যবন্ধের ব্যঞ্জনায় ভাবগভীর। তেমনি ব্যতিক্রমী উপমা-প্রসাদে সমৃদ্ধ।

এছাড়া একুশ শতকের পৃথিবীতে প্রেম যে পুরাতনী আবেগ বা আত্মদানের মহিমায় ধন্য নয়, এমন বাস্তবতার প্রকাশ এ-কালের অনেক কবিতায় দৃশ্যমান। আমিনুল ইসলামের কবিতায়ও প্রেমের বিপ্রতীপ রূপ ধরা পড়েছে।

প্রেম নয় আর সোনার মোহর

প্রেম পুরনো আধুলি

কুড়িয়ে নিয়ে হাসে আকাশ

রাঙিয়ে সাঁঝের গোধূলি।

এ-পর্যায়ে কোনো কবিতাপাঠকের হয়তো জীবনানন্দ দাশের কথা মনে আসতে পারে। কিন্তু সে-সাদৃশ্য বহিরাঙ্গের। এ-কালের গভীর ও ব্যাপক সামাজিক অবক্ষয়ের প্রভাব ভালোবাসার অঙ্গনে কতটা দাগ কেটেছে সে বিচার-ব্যাখ্যাই এ-সময়কার কবির মনোজগতের পরিবর্তনটা বুঝিয়ে দেবে। এখানে সম্পর্কের বন্ধনে বিশ্বাসের দিকটা শিথিল হয়ে পড়েছে। সজল উর্বরতার পরিবর্তে দেখা দিচ্ছে মরুভূমির রুক্ষতা। কবির এ-জাতীয় প্রতিক্রিয়া তাই স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এলিয়টকে
না-টেনেই একথা সত্য।

মুক্তস্বাধীন সুস্থ ভালোবাসার আকাশটাই যেন আর ধরা দিচ্ছে না, আপন হয়ে উঠছে না। সে যেন এক দূরের আকাশ। বাণিজ্যিক বিশ্বে ভালোবাসা হয়ে উঠেছে এক কৃত্রিম সম্পর্ক, ‘কাঁটাতারের বেড়ায়’ পৃথিবী হয়ে উঠেছে বহু বিভক্ত, ভালোবাসার স্বচ্ছন্দ বিহার অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমন যন্ত্রণার্ত উপলব্ধি কবি আমিনুল ইসলামের। তাই প্রেম এখন ‘আড়াল আকাশের অরুন্ধতী’।

প্রেমের বহুমাত্রিক আলেখ্য রচনার চিত্রকর কবি আমিনুল ইসলাম বাংলাদেশের কবিতার বাগানে ফুলচাষি হিসেবে খ্যাতির পালক পরারই তো কথা। প্রেম নিয়ে কাটাছেঁড়া, আনন্দ-আক্ষেপ তার কবিতাসমগ্র গ্রন্থটির প্রধান সুর। সেখানে মাঝেমধ্যে দেখা মেলে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বা জীবনানন্দ দাশের হঠাৎ হাওয়া, কদাচিৎ বাক্যবন্ধ, কখনো প্রচ্ছন্ন ছন্দধ্বনির আড়ালে। কিন্তু ঐতিহ্য তাঁকে গ্রাস করে না। নিজস্ব অভিনবত্ব নিয়ে তাঁর কবিতার প্রকাশ।

‘লালপদ্মের রঙে রাঙা সেদিন জরিপকাল’ যদি পূর্বপাঠের পাতা উলটায় স্মৃতির টানে, ছন্দের টানে এই বলে ‘প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস’ তাহলে কি একেবারেই ভুল বলা হবে। কারো বিচারে হয়তোবা। কিংবা জীবনানন্দীয় রহস্যময়তার ‘অর্থ নয়, বিত্ত নয়’ ইত্যাদি বাক্যবন্ধ? বাংলা কবিতার বলিষ্ঠ পুরুষসিংহ নজরুলের উদ্দেশে একটি কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গও করেছেন আমিনুল ইসলাম। এসবই ঐতিহ্যের টানে, শেকড়ের প্রতি ভালোবাসার মুগ্ধতায়। এমনটিই তো হওয়া উচিত – স্বীকৃতি, আত্তীকরণ, কিন্তু আপন স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে।

শেষ কথা আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতা আপন বৈচিত্র্যে ও স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর। সেখানে উপমা, প্রতীক ও চিত্রকল্প যেমন ভূখ–প্রকৃতি-সমাজনির্ভর, তেমনি তাতে রয়েছে আধুনিকতার মৌ-ঘ্রাণ। গুরুচণ্ডালী সেখানে ত্রম্নটি নয়, বরং তাতে লেগে থাকে মাটির মমতা, লোকায়ত স্মৃতি। আর সে-চর্চায় কখনো ‘সম্রাট ভাঁড়’ সাজে, আর চণ্ডাল দেখা দেয় বাদশাহী সাজে।

এ-লেখা আমিনুল ইসলামের কবিতাসমগ্রের একমাত্রিক কিছু কথার সমাহার; সে-মাত্রাটি হলো প্রেম। এ-গ্রন্থের বাকি বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে গেলে মহাভারত না হোক, আরেকটি বই লেখা হতে পারে। তাই এখানে বিরতি। তবে একটি কথা বলতেই হয়, রাজনীতি নিয়ে বিরাগ সত্ত্বেও সমাজ-রাজনীতির তীক্ষনভাষ্য এখানে অনুপস্থিত থাকতে পারিনি। একালের স্বদেশ-বিদেশ পরিক্রমায় আর কথিত বিশ্বায়নের বিদ্ঘুটে যুগে ‘আইন অমান্য’ কবিকে না টেনে পারিনি। সে-‘আনন্দে’ও তাঁর নানামাত্রিক বিষয় নিয়ে পঙ্ক্তি রচনা। সেখানে ‘পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি’ বাঙালি সংস্কৃতির রূপকারকে স্মরণ করে। বাদ যায় না নদী, বৃক্ষ, লোককাহিনি নিয়ে অনবদ্য পঙ্ক্তি রচনা। আমি চাই মহানন্দার সঙ্গে যুক্ত হোক তিসত্মা পুনর্ভবা করতোয়ার ট্র্যাজেডি। তন্ত্রমন্ত্র থেকে দূরে থেকেও চর্যার বাস্তবতা কি ভোলা যায়? আমরাও ভুলতে চাইনি কবি আমিনুল ইসলামকে। এতকাল কেন এ বইটি অ-পড়া রয়ে গেল সে এক দুঃখ।

কথাশেষের পরও কখনো কখনো কথা থাকে। আমিনুল ইসলামের কবিতাসমগ্রে প্রেমের নান্দীপাঠের মধ্যেই কাব্যমনস্ক পাঠকের জন্য আকর্ষণ কবির নিজস্ব, প্রচলিত পরিচিতির বাইরে ব্যবহৃত নতুন ধারার শব্দ, বাক্যবন্ধ, কখনো দীর্ঘছত্রের উপমাঋদ্ধ শৈল্পিক সৌন্দর্য।

‘নারদ বাতাস’ বাংলাদেশি নবীন পাঠকের চিত্তে সাড়া না জাগালেও ‘প্রস্ফুটিত দুপুর’ অভিনবত্বের প্রকাশে তাকে টানবেই, বিশেষ করে যখন কবি লেখেন

প্রভাতী পাহাড়ে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে ঝর্ণা

চারপাশে কুয়াশারঙের ছায়া…

হাতের তালুতে সূর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সময়

অর্থ-আবৃত পৈথানে …

তখন তা শব্দচিত্রের অভিনবত্বে আধুনিক চেতনার কবিতাপাঠককে মুগ্ধ করারই কথা।

এ-ধরনের নবীন বাক্যবন্ধ বা শব্দচিত্ররূপ চারশো পৃষ্ঠার সর্বত্র ছড়ানো। তাই কত আর উদ্ধৃতি? তবু এমনসব উপমা-চিত্ররূপের মধ্যে যখন

নদীবর্তী বটের গোড়ায় দীর্ঘ হেলান দিয়ে বসে আছে

উৎসব;

কিংবা

এলোচুলে দীনেশচন্দ্রের আঙুল হয়ে বিলি কাটে না

নতুন দিনের হাওয়া

তখন নয়া প্রজন্মের ঐতিহ্য উদাসীনতার কাব্যপাঠ আমাদের মনে করিয়ে দেয় আবহমান বাংলার ‘গজা খাজা ও পিঠা’র পাশাপাশি ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়ার স্মৃতিতে প্রাণমন উচাটন হওয়ার কথা।

আগেই বলেছি, গোটা কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি পাতায় এ-জাতীয় কবিতায় প্রকরণিক অভিনবত্বের প্রকাশ। ‘কীর্তনখোলার ঢেউ’ রাজপথ সজল করে দিয়ে যায় কবিতার নবশব্দভাষ্যে। বেহুলা ও মুক্তিযোদ্ধা পাশাপাশি হাঁটে। যেমন হাঁটে কবিতার নান্দনিকতার পাশে রাজনীতির ক্ষুব্ধ পাঠ বা ঐতিহ্যস্মৃতি। বৃক্ষপরিক্রমাশেষে পরিস্থিতি বিচারে ‘কচুক্ষেতের হাসি’ আমাকে অবাক করে না। বরং ‘জিঞ্জিরা’ কবিতাটিতে এ-কালের মনীশ ঘটককে দেখি। সত্যি বলতে কি, ‘সত্যের জানাজায়’-এ কবিকে আবিষ্কার করি ‘কালিগ্রাম পরগরণা’র ‘পতিসর’-এ এবং অনুরূপ নানা স্থানে, নানা অভিনব বাক্যবন্ধে নাগর নদী থেকে ‘মহানন্দা’র ঐতিহ্যস্রোতে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে গ্রামবাংলার পথে পথে পদচিহ্ন এঁকে, লালন-গগন জসীম মানিকের স্মৃতিধুলোমাখা হাতে এ-কবির পঙ্ক্তিমালার যাত্রা বিড়ম্বিত বিশ্বের পথে তির্যক বাক্যের প্রসাদ নিয়ে ‘তোরা কি নিবি আয়’ এমন উচ্চারণে। নদী-মাঠ-বৃক্ষ-মানুষ নিয়ে তাঁর যাত্রা ভবিষ্যতে আরো সমৃদ্ধি অর্জন করবে বলে আমার বিশ্বাস। r

 

 

‘আজ অনুচ্চ পাহাড়ের মতো একটা সকাল/ ঢুকে পড়েছে জানলা দিয়ে… আমি তার উপত্যকা থেকে নামতে নামতে ভেড়ার দেশে হারিয়ে যাই…’ এরকম অনুভবের ভেতর দিয়ে যাত্রা – প্রবীর চক্রবর্তীর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ আমি এবং ফা-হিয়েন কাব্যগ্রন্থের, এভাবে ভাবা যায়। কবি তাঁর ‘এ মানবজনম’ নামক কবিতায় অবলীলায় লিখে রাখেন-

 

আমার গায়ে কেউ দাগ দিয়ে লিখে রাখে

লাল-নীল চাকা চাকা দাগ!

 

দূরে তোমার বিছানায় নীল আলো খেলা করে

ঝলমল করে ওঠে দাগ

দীর্ঘ লাইন ধরে আমি হাঁটতে থাকি…

 

কার সঙ্গে হাঁটতে থাকেন কবি? পরিব্রাজক ফা-হিয়েনের সঙ্গে? তেমনি মনে করেন তিনি। না হলে কেন তিনি লিখবেন-

 

পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এক একদিন

মাঝদুপুরে হেঁটে আসেন ফা-হিয়েন

পাহাড়ের থেকে উঁচু একপিঠ পুঁথি।

 

শুধু তাই নয়। তিনি লেখেন-‘আমরা দুজন তথাগতকে সামনে রেখে/ তরজমা সেরে নিতে পারি’… গুপ্তযুগের এই পরিব্রাজকের সঙ্গে কবির এই মানসভ্রমণ আমাদের শুধু কৌতূহলের কারণ নয়, হয়ে ওঠে আগ্রহেরও বিষয়। ভ্রামণিকের জায়গা থেকে তাঁকে দেখতে থাকি। ভাবি, কেন তিনি লেখেন, আমার ভেতর একজন খুনি বসে থাকে। তিনি লেখেন, আমার ভেতরে সেই খুনি অনিদ্রায় উঠে বসে। তিনি লেখেন, বসমেত্ম আমাকে কেউ গুমখুন করে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত তিনি লেখেন-

 

সেই আততায়ী দেখে নিচ্ছে সব-

রোদ, দরদর করে বেয়ে নামা ঘাম,

কর্কটরোগের পাশে শুয়ে থাকা চোখ-

আমি আর কোনোদিন লামা হতে পারব না

কেননা কাঁটাঝোপ পেরিয়ে

মাথায় কালো কাপড় বেঁধে কোথায় যেন

সে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে…

 

কবির মধ্যে যে-খুনি বসে ছিল একদিন, সে-ই কি তবে দেখে নিচ্ছে সব? মাথায় কালো কাপড় বেঁধে সে-ই কি তবে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে কবিকে? পৃথিবীর গভীরতর অসুখের ভেতর দিয়ে যাত্রা কবির। সে জিজ্ঞাসা করে ‘সুস্থতার রেসিপি’। হাসপাতালের ওয়েটিংরুমে বসে থাকেন তিনি, এই বসমেত্ম রাধাচূড়া দেখবেন বলে…। তাঁর কল্পনায়- ওষুধের গন্ধে জমে ওঠে মেঘ, তিনি দেখতে থাকেন-

কীভাবে পালটে যাচ্ছে আবহাওয়া

বিপদসীমার ওপাশে হারিয়ে যাচ্ছে হাতঘড়ি

 

তিনি দেখেন-

 

তারারাও নীচে নেমে আসে

নিষিদ্ধপাড়ার গলিতে গলিতে

বিসর্গচিহ্নের মতো একটা বিকেল

হেঁটে নয়, গড়িয়ে যেতে যেতে সন্ধ্যা নামে।

 – জিন, পরি, খোলা জানলা

 

‘বিসর্গ চিহ্নের মতো বিকেল’-লক্ষ করার মতো অনবদ্য এই চিত্রকল্পের জন্য পাঠক অপেক্ষা করেন। কবিকে অভিবাদন জানান। কবির ভ্রমণ চলতেই থাকে। কবির ব্যথার পাশে মেঘের মতো তুলো নিয়ে এগিয়ে আসে সেবিকা… কবির দুচোখে জড়িয়ে আসে ঘুম আর ‘আননোন নম্বর’ থেকে ফোন আসে… উৎকণ্ঠা নিয়ে হেঁটে যান কবি। একদিন তিনি দ্যাখেন-

 

অনিবার্যভাবে এ লেখার ভিতর ঢুকে যায় ট্রেন

অনিবার্যভাবে চিরুনিতে আটকে থাকা চুল

উড়ে বেড়াচ্ছে ঘরময়।

 

এরপর ‘অন্ধ ফেরিওয়ালা’ নামের ওই কবিতাতেই পরাবাস্তবতার এক অসামান্য পঙ্ক্তি ছিটকে আসে। কবি লেখেন – ‘ঢেউ আর চাঁদ মিলেমিশে ধাক্কা মারছে পাড়ে।’

কখনো বাস্তবতা আর কখনো পরাবাস্তবতার ভেতর কবির যাত্রা। শহর আর শহরতলি পার হয়ে গ্রামগঞ্জ পার হয়ে কোথায় যে চলে যেতে চান তিনি! কখনো তিনি লুকিয়ে ফেলতে চান তাঁর সারারাতের ভ্রমণবৃত্তান্ত। এই গস্নানি আর ক্লান্তির ভেতর তিনি শুনতে পান দূর থেকে ভেসে আসা পাখির ডাক, শুনতে পান দূর থেকে ভেসে আসা পুজোর গান…

 

কবি লিখছেন, ‘আমার কোনো ঝুলবারান্দা নেই।’ এটুকুই চাওয়া কবির। কবি লেখেন-

 

বিশ্বাসভঙ্গের মতো একটা সন্ধ্যা

ছড়িয়ে পড়ছে দূর দূরামেত্ম,

এই গাঢ় বৃষ্টি নিয়ে যাচ্ছে

আমাদের পাপস্খলন

পবিত্র হয়ে উঠছি।

 

যিনি দ্যাখেন, বিশ্বাসভঙ্গের মতো একটা সন্ধ্যা। তিনিই দেখতে পান, ‘ড্রয়িংরুমে একা একা জেগে আছে/ বনসাই বট।’-(ড্রয়িংরুম) যিনি দেখতে পান, চোখের নিচে কালো হয়ে আসা দিন…, দেখতে পান, আমাদের খানখান হয়ে যাওয়া/ খেলনাবাটির মতো একটা সূর্য-(রক্তকরবী) তিনিই দেখতে পান-‘চিলেকোঠায় শুধু তুমি আর একটা মঙ্গলঘট’ (মাঙ্গলিক)। তিনি লেখেন- … ধু-ধু উঠোনে জেগে উঠবে ভুঁইচাপা!… আমরা পায়ে পায়ে হেঁটে যাব রাজার বাড়ির দিকে (চোখ বুজে যেটুকু দেখা যায়)। আমাদের আশার কথা, শেষ পর্যন্ত কবি বুঝতে পারেন, ‘আমার অসুখ সেরে গেছে/ আমাদের অসুখ সেরে গেছে’। বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতার ভেতর কবির ভ্রমণ শেষ হয়-

 

এ মাঠে সূর্যাস্ত হয়। এক বৃদ্ধ প্রতিদিন আসে,

রোদ পোহায়, খানিক রোদ ঝোলায় ভরে রেলগাড়ি

চেপে কোথায় যেন চলে যায়… r