কবিতার মায়াবী জংশন

শিউল মনজুর
মৃত্তিকার ছাইভস্ম

কামাল আজাদ
উৎস প্রকাশন
ঢাকা, ২০১২
৭০০ টাকা

কবিতা বহুদূরের পথ। বহুদূরের পথ পাড়ি দিয়েই তবে একজন কবিকে পৌঁছতে হয় কবিতার জংশনে। যে-জংশনের স্বর্ণালি পতাকা কবিকে হাতছানি দিয়ে ডাকে, প্রলুব্ধ করে, স্বপ্ন দেখায়। এই জংশন অলৌকিক এক মায়াবী জংশন। এই আরাধ্য জংশনে সব কবিই পৌঁছতে চান। অথবা বলা যায়, সব কবিই চান তাঁর সাধনার বর্ণিল রেলগাড়িটি যেন পৌঁছে যায় সেই মায়াবী জংশনে।
আমাদের এই অঙ্গনের সুপরিচিত কবি কালাম আজাদ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বোধ করি, তাঁর কাব্য সমগ্র মৃত্তিকার ছাইভস্ম নিয়ে সেই মায়াবী জংশনের কাছাকাছি পাঠকের দরজায় গুচ্ছগুচ্ছ গোলাপের বার্তা আর সুঘ্রাণ নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।
নয়টি গ্রন্থের সর্বমোট ৬৫৮টি কবিতার সংকলন মৃত্তিকার ছাইভস্ম এ বছর উৎস প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে। মলাটবন্দি নয়টি কাব্যগ্রন্থের নাম হচ্ছে – সম্পাদক সমীপে, নগ্নতার নিজস্ব প্রতিমা, শতাব্দীর বৈশাখে আমার বর্ণমালা, সুভদ্রা গোল্লায় যাও, আত্মজ শুনে রাখো আত্মজা গুণে রাখো, সাদাসিধে পদ্য, শুভ্রতা জ্বলে ওঠো, মরমে আমার মরমিয়া এবং শাদিয়ানা পুথি।
এই নয়টি গ্রন্থের মধ্যে সম্পাদক সমীপে, নগ্নতার নিজস্ব প্রতিমা এবং শতাব্দীর বৈশাখে আমার বর্ণমালা – এই তিনটি পাণ্ডুলিপি ছাপার অক্ষরে মলাটবন্দি হয়ে প্রকাশিত হয়েছে বেশ আগে। এর মধ্যে সম্পাদক সমীপে চটি গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর সাধারণ পাঠকের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে বা বলা যায় গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘সম্পাদক সমীপে’ শিরোনামের দীর্ঘ কবিতাটি পাঠকের মধ্যে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। এ-কবিতাটি পাঠ করে অনেক বিশিষ্টজন তাঁকে অভিনন্দনে সিক্ত করেন। মূলত সম্পাদক সমীপে মাত্র দুটি কবিতার মলাটবন্দি ছোট্ট একটি গ্রন্থ। এর মধ্যে ‘সম্পাদক সমীপে’ শিরোনামের কবিতায় পাঠক খুঁজে পেয়েছেন তাঁর মননের কথা, আর্তির কথা। এ-কবিতাটির বিষয়বস্তু এবং কবির সংবেদনশীল মনের আন্তরিক আহ্বানজনিত উচ্চারণ পাঠকহৃদয়কে নাড়া দিতে সক্ষম হয়। ‘সম্পাদক সমীপে’ কবিতাটির কিছু চুম্বক অংশ এখানে উপস্থাপন করা হলো :
আট
এসো তবে চাঁদ, সূর্য, তারা হয়ে গ্রাম্য আসরে
রাহমান, মাহমুদ এসো-কবি যত-আছো আজকের।
করাল বিশাল বন্যার নখর থকে
আমাদের পুরুষেরা ক্ষীপ্র বাজের মতো
বোরো ধান এনেছে পাঞ্জায়-রমণীরা তুলেছে গোলায়।
তাই, বন্যার দেয়াল ভাঙা-যোদ্ধার সম্মানে
চিরদুঃখী পল্লিবধূর গর্বিত আনন্দের
বাণীময় নবান্ন উৎসবে
কি আছে তোমার উপহার
নাগরিক কবিবৃন্দ, রাহমান, মাহমুদ
করো, করো, হৃদয় উজাড়।

নয়
লিখো নাই কবিবৃন্দ, বোবার কবিতা
লিখো নাই চিরদুঃখী জননী বাংলার ব্যতিক্রমী আনন্দের গাঁথা
লালনের হাছনের মতো।
আনন্দের নৌকা দৌড়ে হাসো নাই –
বেদনার জলোচ্ছ্বাসে ভাসো নাই
আছে সুখে কচ্ছপ সতত
তাই তো দোয়েল হয়ে শিস দিচ্ছো সুবেশ আসরে
গ্রামের মানিস সেও কবে গেছে গ্রাম ছেড়ে
সে-ও আসবে না? মায়ের হারানো নোলক খুঁজবে না?
চলমান নদীর স্রোতের মতো স্বাভাবিক গতিপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে, ‘সম্পাদক সমীপে’ শিরোনামের কবিতাটির পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং এটিও সত্যি কবিতার বিষয়বস্তুতে রয়েছে নতুনত্ব ও শব্দচয়নের ক্ষেত্রে একজন দক্ষ কারিগরের ভূমিকা আমরা প্রত্যক্ষ করি। নির্দ্বিধায় বলা যায়, ‘সম্পাদক সমীপে’ একটি প্রাণময়-প্রাণস্পর্শী সফল কবিতা।
সম্পাদক সমীপে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই প্রকাশিত হয় নগ্নতার নিজস্ব প্রতিমা গ্রন্থটি। ৩৪টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত এই গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতার ভেতর দিয়ে যুবক মনের আকাক্সক্ষা প্রকাশিত হতে দেখি। সম্পাদক সমীপের মধ্যে যে আর্তি শুনেছি তা এখানে অনুপস্থিত। তবে চিরন্তন প্রেমের এবং মানবীয় শরীরবন্দনায় ব্যক্তিমানসের চাওয়া-পাওয়া প্রাধান্য পেলেও শিল্পসত্তায় কবিতাগুলো হীরকের মতো উজ্জ্বল। ‘ভ্রষ্ট লগ্নে পুরুষ প্লেবয় দেখে/ নারী হয় প্লেমেট নগ্নিকা/ জ্যোৎস্নার ধারক নয়, চাঁদ হয়/ মৃতশীলা পাহাড়ের চূড়া।’ শব্দের ব্যঞ্জনায় জীবনের একটি বিশেষ সময় এখানে উচ্চারিত হয়েছে। জীবনের এই অনুশীলন কম-বেশি সবাই করে। কবিতাটির শিরোনাম ‘নগ্নতার নিজস্ব প্রতিমা’ (পৃ ৩৫)।
অথবা, ‘অনন্তর তুমি যে আমার প্রিয় মানুষের/ একখানি ছোট্ট শরীরে/ এতগুলো মহাকাব্য গ্রন্থিত করেছো/ আমি যে তা সাত জীবনেও/ পড়ে নিতে পারবো না – ঈশ্বর/ হে আমার ঈশ্বর।’ কবিতাটির শিরোনাম ‘শরীরী কাব্যের জন্যে’ (পৃ ৩৭)। ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ, প্রিয়তমার শরীর নিয়ে এমন সহজপাঠ পাঠকের মনে আনন্দের হিন্দোল জাগায়। পাঠক কবিতার ভেতর খুঁজে নেয় তার নিজস্ব নগ্নতার ছায়া। বলতেই হয় কবিতাটি অসাধারণ। দুর্দান্ত সাহসী উচ্চারণ। ৬৫৮টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত মৃত্তিকার ছাইভস্ম গ্রন্থটিতে এরকম স্পর্শনীয় কবিতা রয়েছে অসংখ্য। তবে মৃত্তিকার ছাইভস্ম কাব্যগ্রন্থের সব কবিতাই যে পাঠকের অন্তর ছুঁয়ে যাবে বা ভালো লাগবে অথবা সব কবিতা যে আলোচনার দাবি রাখে তা নয়। একজন কবিকে পাঠকের হৃদয়ে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখতে অল্পকটি কবিতাই যথেষ্ট। কবি কামাল আজাদকে পাঠকের অন্দরমহলে আলোকিত করে রাখতে পারে এরকম সম্ভাব্য কবিতাগুলো নিুরূপ হতে পারে :
কবিতার শিরোনাম    পৃষ্ঠা    গ্রন্থের নাম
১.    সম্পাদক সমীপে    ১৫    সম্পাদক সমীপে
২.    সমর্পিত বিদ্রোহ    ৫২    নগ্নতার নিজস্ব প্রতিমা
৩.    কৌমার্থের খানদানি খন্দকে     ৬৩    নগ্নতার নিজস্ব প্রতিমা
৪.    এবার দাঁড়াও ফিরে    ৭০    নগ্নতার নিজস্ব প্রতিমা
৫.    উষ্টামারি    ৮২    শতাব্দীর বৈশাখে আমার                 বর্ণমালা
৬.    তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য আবেদন ৮৫    সুভভ্রা গোল্লায় যাও
৭.    ফেনসিডিল জন্মায় কোথায়    ৯২    সুভভ্রা গোল্লায় যাও
৮.    সুখের ফ্যাক্টরী    ৯৭    সুভভ্রা গোল্লায় যাও
৯.    ওয়াক থু    ১৫৩    সুভভ্রা গোল্লায় যাও
১০.    শুদ্ধ আদিমতা    ১৫২    সুভভ্রা গোল্লায় যাও
১১.    সে নাকী ঈশ্বর হতে চায়    ১৭১    সুভভ্রা গোল্লায় যাও
১২.    স্বপ্নের কাছে    ১৭৫    সুভভ্রা গোল্লায় যাও
১৩.    ইনফিনিট; চেতনার ধারাভাষ্য    ১৮৫    আত্মজ শুনে রাখো
১৪.    নতুন সহস্রাব্দে বলি    ২৪০    সাদাসিধে পদ্য
১৫.    শুভ্রতা জ্বলে ওঠো    ৩০৩    শুভ্রতা জ্বলে ওঠো
১৬.    মানুষ তৃপ্ত হবে না    ৩২৩    শুভ্রতা জ্বলে ওঠো
১৭.    ওরা ও আমি    ৩৪৯    শুভ্রতা জ্বলে ওঠো
১৮.    এ ঝড়ের শেষ নেই    ৩৫৪    শুভ্রতা জ্বলে ওঠো
১৯.    আবিদ ফায়সালকে    ৩৭৫    শুভ্রতা জ্বলে ওঠো
২০.    ফেরার পালা    ৩৮৯    শুভ্রতা জ্বলে ওঠো
উল্লিখিত কবিতাগুলো ছাড়াও তাঁকে মূল্যায়িত করার মতো আরো অসংখ্য কবিতা রয়েছে। তবে তাঁর কাব্যশক্তি নির্ণয়ে উল্লিখিত কবিতাগুলো বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। এ ছাড়া তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ সুভদ্রা গোল্লায় যাও, শুভ্রতা জ্বলে ওঠো এবং সাদাসিধে পদ্যের মধ্যে চার শতাধিক কবিতা রয়েছে। এই তিনটি কাব্যগ্রন্থ পৃথকভাবে আলোচনার দাবি রাখে। তবে ৪৮০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা পাঠ করে কালাম আজাদের কবিতার দুটি বৈশিষ্ট্য সাদাচোখে ধরা পড়ে। তাঁর কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানুষ, মাটি ও সমা; অন্যটি সোজাসাপটা বা নিরেট উচ্চারণ। এরকম বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় আমাদের দেশের সুপরিচিত কবি ওমর আলীর কবিতায়। আবার মার্কিনি কবি গিনসবার্গের কবিতায়ও এমন ধাঁচ খুঁজে পাওয়া যায়। মূলত সাদামনের কবিরাই এমন উচ্চারণ করতে পারেন। অর্থাৎ তাঁদের কবিতা মেদহীন, তবে অর্থময় কাব্যের সমষ্টিতে উজ্জ্বল। এই সাদামনের কবি মৃত্তিকার ছাইভস্ম কাব্যসংগ্রহের শুরুতেই তাঁর কিছু নিজের কথা বলেছেন, এখানেও তাঁর সাদা মনের ছোঁয়া আমরা লক্ষ করি। কিছু অংশ উপস্থাপন করা হলো :
এই সংগ্রহের নাম হতে পারতো শিল্পহীন শব্দলোক, কিংবা জীবনের খুদকুড়ো। কেউ কেউ বললেন, একটি শিল্পকর্মকে শিল্পহীন বলার মধ্যে একজাতের অহংই প্রকাশ পায়। তাই তরুণদের কশাঘাতের ভয়ে এর নাম মৃত্তিকার ছাইভস্ম। শপথ করে বলছি – এখানে শিল্পের চেয়ে বক্তব্যেরই প্রাধান্য; যা সমালোচিত হতেই পারে। তা হোক, সৃষ্টিশীল বিদগ্ধজনের সমালোচনা সে-ও খুব কম মানুষের ভাগ্যে জোটে।
তাঁর এ-সারল্য উচ্চারণের ভেতর আমরা একজন সংবেদনশীল মানুষের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করি। তাঁর এই বলার মধ্য দিয়ে সাদামনের মানুষের ব্যক্তিত্বই প্রকাশ পেয়েছে। তাই যা-ই বলেন না কেন, প্রকৃতপক্ষে মৃত্তিকার ছাইভস্ম গ্রন্থের ভেতর দিয়ে কবি কামাল আজাদ নির্মাণ করেছেন তাঁর মায়াবী জংশনের ঠিকানা। আমরা তাঁর এই নয়টি গ্রন্থের কবিতা সংগ্রহ মৃত্তিকার ছাইভস্ম পাঠ করতে করতে ঘুরে বেড়াবো তাঁর জংশনের লাল-নীল বাতির আলোয়। আর মাঝেমধ্যে বিদ্যুচ্চমকের মতো চমকিত হয়ে বলব, বাহ্ চমৎকার লাইন, চমৎকার সৃষ্টি, কাউকে হয়তো শুনিয়ে বলব, একটি চমৎকার কবিতা পড়লাম। বলার অপেক্ষা রাখে না, কবিকে দীর্ঘজীবী করে রাখবে কবিতার পাঠক মহলে মৃত্তিকার ছাইভস্ম।