কবিতার স্থাপত্যরীতি

সরকার আবদুল মান্নান

কবিতার একটি বহিরঙ্গ গড়ন আছে। এই গড়নটি আমাদের পরিচিত। খুব শৈশবে পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে আমরা কবিতার সঙ্গে পরিচিত হই। পঙ্ক্তিবিন্যাস আর শব্দ ও ছন্দের সমন্বয়ে কবিতার একটি বিশেষ গড়ন আমাদের মনে-মননে ও চেতনায় বেশ স্থায়ী হয়ে যায়। আমরা বুঝতে পারি, কবিতা গদ্যের মতো নয়। মার্জিন জুড়ে কবিতা লেখা হয় না। অর্থাৎ কবিতা দেখতে গল্প, উপন্যাস বা প্রবন্ধের মতো নয়। এখন যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন, কবিতা কী? তাহলে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, কবিতার আবার সংজ্ঞা কী? যা দেখতে কবিতার মতো তা-ই কবিতা। যেমন, একটি প্রাণী যদি হাঁটে বেড়ালের মতো, যদি ডাকে মিঁউ-মিঁউ করে বেড়ালের মতো এবং দেখতেও ঠিক বেড়ালের মতো হয়, তবে প্রাণীটি যে বেড়াল, সে-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকে না। কবিতাও ঠিক তেমনি – যা দেখতে কবিতার মতো তা-ই কবিতা। প্রাচীন যুগ থেকে আজ অবধি কবিতার দেহগড়নে অনেক পরিবর্তন এসেছে। গদ্যকবিতার প্রচলন শুরু হয়েছে সেই কবে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে; তারপর গদ্যকবিতার মধ্যেও কত পরিবর্তন এসেছে। তবু কবিতা যে কবিতাই, এবং এর যে নিজস্ব গড়ন আছে, তা কবিতা-পাঠক মাত্রই বুঝতে পারেন।

কবিতার এই পরিচয়ে কবিগণ এবং কবিতার রসবেত্তাগণ সন্তুষ্ট হবেন না নিশ্চয়ই। বলবেন, বহিরঙ্গের এই পরিচয়েই কবিতা চেনা যায়? নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে শব্দ পুরে দিলেই কবিতা হবে? আর ভেতরকাঠামো! তার কী হবে? বোধ, বোধের বিচিত্র মাত্রা যে জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ভাষাকে আশ্রয় করে একটি সংগঠন লাভ করে, তার কী হবে? অবশ্য এই প্রশ্নের সিংহভাগ আধুনিককালের – প্রাচীন বা মধ্যযুগের নয়। ধর্মাশ্রয়ী বা উদ্দেশ্যপ্রধান কবিতার ভেতর-কাঠামোর         বিস্তৃতি বিপুল হওয়ার সুযোগ থাকে না। কেননা, কাব্যভাষা তার নির্দিষ্ট অর্থের সীমা অতিক্রম করে যাওয়ার শক্তি পায় না। ফলে প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিতা শব্দার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ শিল্পে রূপায়িত হয়েছিল। এই শিল্পের সংজ্ঞা হয়, ব্যাকরণগত বিধিবিধান হয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিতায় তা ছিলও – ব্যাকরণ ছিল, বিধিবিধান ছিল। সংস্কৃত ভাষার রসশাস্ত্র ও টীকা-টিপ্পনিগুলো তার প্রমাণ। কিন্তু আধুনিককালে এসে কবিতার ভেতর-কাঠামোই নৈয়ায়িক হয়ে ওঠে, বহিরঙ্গ নিমিত্ত মাত্র। এখনো গদ্যের মতো মার্জিন ভরে কবিতা খুব একটা লেখা হয় না, কিংবা দু-একটি কবিতা মার্জিন ভরে লিখলেও সেটি যে গদ্য নয়, কবিতাই, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবু কবিতার সেই পুরনো বহিরঙ্গ নেই আর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্যকবিতার বহিরঙ্গেরও কবিতার মতো দেখতে একটি অঙ্গ ছিল। অতিসম্প্রতি তাও নেই। অর্থাৎ বেড়ালকে বেড়াল বলার যে-নিশ্চয়তা আছে, এখন সে-নিশ্চয়তা নিয়ে কবিতাকে কবিতা বলা যাবে না। এর মানে হলো, আমাদের মনে-মননে-চেতনায় কবিতার যে গড়ন স্থায়ী হয়ে আছে, এখন সেখানেও ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেই প্রাক্তন আদিকল্পের বিচারে এখন কবিতা চেনা কতকটা দুরূহ হয়ে উঠেছে।

 

কবিতা-সংগঠন

কোনো কিছু বানাতে গেলে সমগোত্রীয় ও ভিন্নগোত্রীয় বিচিত্র উপকরণ প্রয়োজন হয়। একটি পুতুল বানাতে গেলে প্রয়োজন হয় শোলা, পাট, পাটকাঠি, বিচিত্র রং, বিচিত্র রঙের কাপড়, সুতা ও ফিতা এবং সুই, কাঁচি, আঠা, আরো কত কী। এছাড়া প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আছে নানা রকম মাপজোখ ও হিসাব-নিকাশের ব্যাপার, আছে মাত্রাবোধ ও রুচির স্বভাব, আছে সৃষ্টিশীল চিন্তার অদৃশ্য জটিল কারবার। অর্থাৎ পুরো বিষয়টি কতকটা যান্ত্রিক এবং কতকটা মানবিক। কবিতা তেমনি একটি বিষয় কবি যা নির্মাণ করেন। এজন্য বিচিত্র বিষয় নিয়ে ভাবতে হয় একজন কবিকে। শব্দ, পদ, পর্ব, পর্ববিন্যাস পঙ্ক্তি, পঙ্ক্তিবিন্যাস, স্তবক, স্তবকবিন্যাস, ছন্দ-তাল-লয়, যতিচিহ্নের ব্যবহার এবং আরো কত কী। এ সবকিছুই নির্ভর করে কবিতার বিষয়-ভাবনার ওপর, বিষয়-ভাবনার বৈচিত্র্যের ওপর। একটি দ্রুতগতির বাঘকে যদি গতিময় জীবনের অনুষঙ্গে কবিতার বিষয় করা হয়, তাহলে শব্দচয়ন থেকে শুরু করে ছন্দস্রোত ও পঙ্ক্তি-প্রলম্ব ধীরগতির হবে না, ঠাসবুনন হবে না। একটি বেদনার কবিতার সঙ্গে এই কবিতার সর্বত্র বিরাজ করার কথা তাৎপর্যময় পার্থক্য। কবি এই বোধটুকু নিয়ে ভাবনার শিল্প তৈরি করতে চান, কথার শিল্প তৈরি করতে চান। কবিতা লেখায় যিনি সিদ্ধহস্ত, বহুদিন ধরে যিনি লিখছেন এবং ভালো লিখছেন, তাঁর বিষয়ভাবনা ও কল্পনাপ্রতিভার এক জটিল মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে একটি কবিতার প্রাথমিক অবয়ব তৈরি হয়ে যায়। কিংবা দু-একটি পঙ্ক্তির অসাধারণ গুঞ্জন গোপন এক তৈরি-সূত্রে ভেতরে ঘুরপাক খায়। সেটা যে-কোনো পরিস্থিতিতে হতে পারে – আনন্দে, বেদনায়, ক্ষুব্ধতায়, আলস্যে, অভিমানে, ভালোবাসায়, বঞ্চনায়। কিংবা এমনিতেই – ভাবনার নিজস্ব গতিময়তায়। সে যে-প্রেরণাই হোক না কেন, তা হারিয়েও যেতে পারে, আবার ক্ষণিকের জন্য কিংবা চিরতরে। কবি সেই অঙ্কুরিত কবিতার কুঁড়িটুকু সময়মতো খুঁজে পেতে চান। তিনি খুঁজে পান, ঠিক যেমনটির উদ্ভব হয়েছিল কিংবা তার কাছাকাছি অন্য আলোয়, অন্য রঙে, অন্য রেখায়। অঙ্কুরোদ্গমের সেই আলোকিত আভাসটুকুর আশ্রয়ে কবি রচনা করতে চান একটি কবিতা – শাখা-পত্র-পল্লব আর ফুলে-ফলে সুশোভিত একটি পরিপূর্ণ কবিতা। কখনো সেই কবিতাটি আপনা থেকেই কবির সহজ প্রয়াসে স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে তৈরি হয়ে যায়। যেন পরিপূর্ণ আলো-বাতাসের মধ্যে চারদিকে সমানভাবে বেড়ে ওঠা একটি বৃক্ষ, দক্ষ কারিগরের তৈরি নিটোল প্রতিমা, অনন্য স্থাপত্যকর্ম কিংবা ভাস্কর্য।

কিন্তু অধিকাংশ সময়ই বিষয়টি অত সহজ নয়। কবি তাঁর ভাবনার চিত্রটিকে শব্দের মধ্যে সংস্থাপিত করতে চান। সুতরাং শব্দই তাঁর প্রথম এবং প্রধান হাতিয়ার। আর শব্দকে যে তিনি কতভাবে পরিবর্তন করেন, পরিমার্জন করেন, অদল-বদল করেন, প্রতিস্থাপন করেন, স্থান পরিবর্তন করেন তার ইয়ত্তা নেই। এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তিনি ভাবনার সর্বোত্তম ভাষিক পরিস্থিতি তৈরি করেন। একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি পদ/ অতিপর্ব/ পর্ব/ পঙ্ক্তি সুস্থিত করে নেন। এর জন্যও তিনি আশ্রয় নেন পর্ব ছোট-বড় করার, স্থান পরিবর্তন করার, পঙ্ক্তি ছোট-বড় করার, ভাঙা-গড়ার। এছাড়া যতিচিহ্ন দিয়ে বা না-দিয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব অর্থময়তাকে সন্তুষ্ট করতে চান। ভাবনার উল্লম্ফন কিংবা দূরান্বয়ের মধ্যেও তিনি কবিতাটির মধ্যে একটি ভেতরগত ঐক্য ও সংস্থাপনা রক্ষা করতে চান কিংবা ঐক্য ও সংস্থাপনার প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রত্যয় প্রবল করে তুলতে চান। এভাবে যখন পুরো কবিতাটি সৃষ্টি হয়ে যায় তখন তিনি কবিতাটি পড়েন – মনে মনে পড়েন, কখনো কখনো সশব্দে পড়ে নিজেকে শোনান। কবিতাটির ধ্বনিগত সাম্য ও প্রকটিত ছন্দ কিংবা অন্তর্গত ছন্দের যথার্থতা অনুভব করে নেন। পরিশেষে একটি কবিতা সৃষ্টি হয় এবং কবি একটি কবিতা সৃষ্টির আনন্দ উপভোগ করেন।

 

পঙ্ক্তিবিন্যাস

প্রাচীনকাল থেকে কবিতায় পঙ্ক্তিবিন্যাসের একটি সরল রীতি প্রচলিত ছিল। বোধের অন্তর্গত প্রবাহকে পঙ্ক্তিবিন্যাসের ভেতর দিয়ে ফলিয়ে তোলার মতো দৃষ্টিভঙ্গি তখন ছিল না। এক দাড়ি ও দুই দাড়ি দিয়ে দিয়ে পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি লিখে যাওয়া কিংবা নিচে নিচে লিখে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল তখন। কিংবা পঙ্ক্তির প্রথমাংশ বাঁদিকে এবং বেশ কিছুটা ফাঁক রেখে দ্বিতীয়াংশ ডানদিকে লিখে পরের পূর্ণ পঙ্ক্তি লেখা হতো মাঝখানে। মূলত সংস্কৃত কাব্যসাধনার প্রাচীনতম রীতি অবলম্বনে প্রচীন ও মধ্যযুগে এবং আধুনিক যুগের প্রথমার্ধে পঙ্ক্তিবিন্যাসের এই সহজ সংগঠন অনুসরণ করা হয়েছে। প্রাচীন যুগে এবং পুরো মধ্যযুগের কবিতাগুলোকে এই দুই রীতির পঙ্ক্তিবিন্যাসে মুদ্রণ করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পান্ডুলিপিতে এই পঙ্ক্তিবিন্যাস ছিল না। হস্তলিখিত পান্ডুলিপির সেই শ্রমসাধনার যুগে পঙ্ক্তিবিন্যাসের স্বাধীনতা ভোগ করার যথেষ্ট সুযোগও ছিল না। তিনটি উদাহরণ দিই।

১.    আলিএঁ কালিএঁ বাট রুন্ধেলা।

তা দেখি কাহ্ন বিমণা ভইলা \

২.    আষাঢ় শ্রাবণ মাসে  মেঘবরিষে যেহ্ন

ঝরএ নয়নের পাণী।

৩.   লক্ষ্মী মেয়ে যারা ছিল,

তারাই এখন চড়বে ঘোড়া চড়বে ঘোড়া!

ঠাট ঠমকে চালাক চতুর

সভ্য হবে থোড়া থোড়া!!

প্রথম পঙ্ক্তিদুটি চর্যাপদ থেকে নেওয়া এবং দ্বিতীয় অংশ নেওয়া হয়েছে চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যগ্রন্থ থেকে। আর তত্ত্বীয় অংশটি আধুনিক ও মধ্যযুগের সন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের লেখা। এই তিনটি কবিতাংশের পঙ্ক্তি-সংগঠনে সামান্য বৈচিত্র্য আছে। প্রথম ও দ্বিতীয় কবিতাংশের পঙ্ক্তি-সংগঠন প্রথাগত। কবির শৈলীচেতনা বা মানস-প্রবণতার সুযোগ সেখানে নেই। কিন্তু তৃতীয় উদাহরণে ঈশ্বরগুপ্ত চতুর্থ পঙ্ক্তিটি কিছুটা ডানদিকে বাড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে নারীর সভ্য হওয়ার প্রবণতাকে কটাক্ষ করেছেন। অর্থাৎ তৃতীয় ও চতুর্থ পঙ্ক্তিকে একই মার্জিনে রেখে ঠাট্টার মধ্যে যেন ঢেউ তোলা যাচ্ছিল না। এই পঙ্ক্তিবিন্যাস কবিতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কবি শব্দ দিয়ে তাঁর ভাবনার ছবি অাঁকেন। সেই ছবি তাঁকে মুগ্ধ করে কিংবা করে না। শব্দ নামক ভাবনার সেই প্রতীকগুলোকেও তিনি এমনভাবে সাজাতে চান, যাতে মুদ্রিত কবিতার গড়নসৌষ্ঠবের ভেতর দিয়েও একটি ছবি লাভ করা যায়।

এই দায় গদ্যের নেই। প্রত্যেক গদ্যশিল্পীর নিজস্ব শিল্পবোধ ও ভাষা-স্বাতন্ত্র্যের কথা বিবেচনায় রেখেই বলা যায় যে, গল্প-উপন্যাস, নাটক বা প্রবন্ধাদির ভাবনানিচয়ের ছবি প্রতিফলিত হয় বক্তব্যে। সংলাপ ছাড়া গদ্যের বাকি অংশ লেখা হয় মার্জিন জুড়ে। ফলে লাইনের দৈর্ঘ্য নির্ভর করে মার্জিনের দৈর্ঘ্যের ওপর। সাম্প্রতিককালে ফন্ট সাইজ, লাইন স্পেস ও অনুচ্ছেদের আকার এবং অনুচ্ছেদ থেকে অনুচ্ছেদের দূরত্ব ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে গদ্যের একটি ছবি তৈরি হয়, যার মধ্যে স্বাতন্ত্র্যের তেমন কোনো সুযোগ থাকে না; কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটি কবিতা-সংগঠনকে গদ্যে সংস্থাপিত করলে বিষয়টি কেমন দাঁড়ায়?

যদি বাঁচি চার দশকের বেশি

লিখবো।

যদি বাঁচি দুই দশকের কম

লিখবো।

যদি বেঁচে যাই একটি দশক

লিখবো।

যদি বেঁচে যাই দু’চার বছর

লিখবো।

যদি বেঁচে যাই একটি বছর

লিখবো।

যদি বেঁচে যাই একমাস কাল

লিখবো।

যদি বেঁচে যাই একদিন আরো

লিখবো।

(‘ইচ্ছা’, শামসুর রাহমান)

যদি বাঁচি চার দশকের বেশি লিখব। যদি বাঁচি দুই দশকের কম লিখব। যদি বেঁচে যাই একটি দশক লিখব। যদি বেঁচে যাই দু-চার বছর লিখব। যদি বেঁচে যাই একটি বছর লিখব। যদি বেঁচে যাই একমাসকাল লিখব। যদি বেঁচে যাই একদিন, আরো লিখব।

গদ্যগড়নে কবিতাটির শোচনীয় পরিণতি পাঠকমাত্রই অনুভব করছেন। যদি অর্থময়তা কিংবা অনুভব-গ্রাহ্যতার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয় তাহলে দেখা যাবে যে, গদ্যরূপে কবিতাটি সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত ও হাস্যকর। কবিতাটির মধ্যে কবির আমৃত্যু লিখে যাওয়ার যে প্রাণের তাগিদ অনুভূত হয়, সৃষ্টির প্রতি কবির যে নিষ্ঠা ও সততা অত্যন্ত সহজ কিছু স্বীকারোক্তির মধ্যে মূর্ত হয়ে ওঠে, গদ্যে তার চিহ্নমাত্র নেই। বরং গদ্য-বিবেচনার ন্যায়সূত্র মানলে, ব্যাকরণ মানলে, গদ্যের প্রতিটি বাক্য ত্রুটিপূর্ণ। ফলে অর্থময়তার নির্দিষ্টতা স্থাপিত হয়নি। আর দেখতে তা কবিতার মতো নয় নিশ্চয়ই।

কবিতায় পর্ব বা পর্ববিন্যাস, পঙ্ক্তি বা পঙ্ক্তিবিন্যাস কবির ইচ্ছার অনুবর্তী। অর্থাৎ তিনি তাঁর ভাবনার মানচিত্রকে ধরতে চান শব্দ নামক বস্ত্ত ও ভাবনানিচয়ের প্রতীকগুলোর বিন্যাসের মধ্য দিয়ে। এই বিন্যাস কতরকম হতে পারে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। পর্ব, পদ বা পঙ্ক্তির দৈর্ঘ্য নির্ধারণে কবি সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং কবি যে-কাঠামো নির্ধারণ করে দেন, তা অপরিবর্তনীয়। মুদ্রিত কোনো কবিতার কোনো পরিবর্তন আর কেউ আনতে পারেন না। স্কুলপাঠ্য কবিতার প্রথম আট বা দশ লাইন মুখস্থ লিখতে গিয়ে সেই শৈশবেই আমরা বুঝেছি যে, কবিতা অন্য জাতের জিনিস। যতিচিহ্ন যা আছে তাই রাখতে হবে, কোনো পঙ্ক্তিই আগুপিছু বা সমান করা যাবে না, যেভাবে আছে ঠিক সেভাবেই লিখতে হবে। এমনকি স্তবকবিন্যাস যদি থাকে তবে তার মধ্যকার ফাঁক যা আছে তাই রাখতে হবে। স্বরের ওঠা-নামা, স্বল্পতা-দীর্ঘতা ইত্যাকার বৈচিত্র্যসাধনের জন্য একজন কবি বিচিত্র কৌশলের আশ্রয় নেন এবং সেই কৌশল কবির সহজাত শিল্পপ্রতিভার স্বাক্ষরবাহী। শুধু তাই নয়, তাঁর ভাবনার উল্লম্ফন এবং তজ্জনিত ফাঁক-ফোকর কবিতার শরীরে এক ধরনের সচ্ছলতা নিয়ে আসে; এক ধরনের আয়েশ ও আনন্দে ভরে ওঠে অলিখিত পাতার আড়াল-আবডালগুলো। ইদানীং সেখানে রঙের পোঁচ দেওয়া হয়, অাঁকা হয় আদরের আলপনা। কিন্তু সেই অলিখিত অন্তরালগুলো শব্দপ্রতীকের অর্থময়তার বিস্তারে কৌতূহল ও বিস্ময়ের যে-পটভূমি তৈরি করে, রহস্যময়তার যে আনন্দ ও তৃষ্ণা রচনা করে – কবিতা-সংগঠনের তাৎপর্য ওখানেই।

মুদ্রিত পৃষ্ঠায় কবিতার অনেক গড়ন থাকে। তিনটি সংখ্যাকে কতভাবে সাজানো যেতে পারে, তার পরিসংখ্যানগত হিসাব আছে। কিন্তু কবিতার গড়ন এত বিচিত্র যে, এর কোনো সেট বিভাজন সম্ভব নয়। আমরা শুধু প্রতিনিধিত্বকারী কয়েকটি উদাহরণ দিতে পারি। আধুনিক যুগের কবিতার তেমন কিছু গড়ন উল্লেখ করা হলো।

১.   সর্বদা হু হু করে মন,

বিশ্ব যেন মরুর মতন;

চারি দিকে ঝালাপালা,

উঃ কি জ্বলন্ত জ্বালা!

অগ্নিকুন্ডে পতঙ্গ পতন।

(‘উপহার’, বিহারীলাল চক্রবর্তী)

 

২.   জীবন এমন ভ্রম আগে কে জানিত রে!

হ’য়ে এত লালায়িত কে ইহা যাচিত রে!

প্রভাতে অরুণোদয়,                       প্রফুল্ল যেমন হয়,

মনোহরা বসুন্ধরা, কুহেলিকা অাঁধারে।

(‘জীবন-মরীচিকা’, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)

 

৩.   এই কি মরণ?

এত দ্রুত – সহসা এমন

চিরতরে ছাড়াছাড়ি,              দেহে প্রাণে কাড়াকাড়ি,

নাই তার কোনো আয়োজন!

(‘মৃত্যু’, অক্ষয়কুমার বড়াল)

 

৪.   উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে

স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে

নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত

তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা নাড়ার দিনে

(‘আফ্রিকা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

 

৫.   কুহেলি ভেদিয়া –

জড়তা টুটিয়া

এসেছে বসন্তরাজ।

নবীন আলোকে

নবীন পুলকে

সাজিছে ধরণী আজ।

(‘সম্ভাষণ’, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী)

 

৬.   অমি কবি যত কামারের আর কাঁসারির আর ছুতোরের,

মুটে মজুরের,

– আমি কবি যত ইতরের,

(‘আমি কবি যত কামারের’, প্রেমেন্দ্র মিত্র)

 

 

বিহারীলালের ‘উপহার’ কবিতায় কোনো কবিতা নেই, কিন্তু কবিতার একটি গড়ন আছে। দুটি করে পঙ্ক্তি আগুপিছু করে যে জ্যামিতিক গড়ন তৈরি করা হয়েছে তা দেখার মতো। তবে প্রথম দুটি পঙ্ক্তিতে ভাবনার একটি সূচনা নির্দেশ করে পরের পঙ্ক্তিদুটিকে একটু এগিয়ে দিয়ে ভাবনায় গতি তৈরি করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। কিন্তু কল্পনাপ্রতিভার দৈন্য এই লক্ষ্যকে মোটেই সফল হতে দেয়নি। বাহ্যিক আড়ম্বরে তাঁর কবিতা দৃষ্টিনন্দন হলেও তা প্রাণের সম্পদ হয়ে ওঠেনি কখনো। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জীবন-মরীচিকা’ কবিতার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এখানেও কবিতার দেহকে তিনি আলপনার অবয়ব দান করেছেন। চারদিকে শব্দের মালা রচনা করে মাঝখানে যে-শূন্যতাটুকু রাখা হয়েছে তাতে শব্দের আশ্রয়ে যেন তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্ম। এতে চোখ জুড়ায় বটে, কিন্তু চেতনায় কোনো আলোড়ন তৈরি হয় না। অক্ষয়কুমার বড়ালের ‘মৃত্যু’ শীর্ষক কবিতার মধ্যেও গড়নগত এই সচেতনতা লক্ষ করা যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ শীর্ষক কবিতায় পিরামিড কিংবা উলটো পিরামিড আকারের                 স্তবকগুলোতে ভাবনাকে আস্তে আস্তে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে অথবা, বিস্তৃত ভাবনার পরিসরকে ক্রমে উপসংহারের সংক্ষিপ্ততার দিকে নিয়ে আসা হয়েছে। নদীবিষয়ক রবীন্দ্রনাথের অন্য একটি কবিতার নাম ‘চঞ্চলা’। এই কবিতায় কবি পঙ্ক্তিবিন্যাসে নদীর গতি ও ঊর্মিমালার অবয়ব রচনা করতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই সংগঠনভাবনার মধ্যে তাঁর কল্পনাপ্রতিভার একটি দৃশ্যগ্রাহ্য জগৎ অনুভব করা যায়। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ‘সম্ভাষণ’ কবিতার মধ্যে বসন্তের আহবান রচিত হয়েছে এবং সেই আহবানের মধ্যে ছন্দের সিঁড়ির পর সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। পঙ্ক্তিবিন্যাসের এই সচেতনতার মধ্যে কবিতাটি দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘আমি কবি যত কামারের’ শীর্ষক কবিতাও পঙ্ক্তিবিন্যাসে সচেতনতা লক্ষণীয়। একটি দীর্ঘ পঙ্ক্তির ডানপ্রান্তের পর নিচে নিচে কয়েকটি ছোট ছোট পঙ্ক্তি দিয়ে কবি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি তাঁর মমত্বের একটি শব্দপ্রতিমা তৈরি করেছেন।

Philip Davies Roberts তাঁর  How Poetry Works গ্রন্থে ‘eye-poetry’ নামক এক ধরনের কবিতার কথা বলেছেন। এগুলোকে visual poetry বা, optic poetry-ও বলে। শব্দের মাধ্যমে ছবি অাঁকাই এই কবিতার মূল লক্ষ্য। সতেরোশো শতকে জর্জ হার্ভার্ট এ-ধরনের কবিতার চর্চা করেছেন। শব্দসজ্জার ভেতর দিয়ে তিনি পাখির ডানা, নৈবেদ্য ইত্যাদি অাঁকতেন। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে সুইজারল্যান্ড ও ব্রাজিলে পুনরায় দৃশ্য-কবিতার চর্চা শুরু হয়। এরা মূলত চিত্রকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও মুদ্রণশৈলীর প্রেরণা নিয়ে দৃশ্য কবিতার অবতারণা করেন। How Poetry Works গ্রন্থ থেকে এ-ধরনের একটি কবিতা উল্লেখ করলাম। কবিতাটির শুরুর দিকের ফন্ট সাইজ বড় এবং ক্রমে ছোট ও অাঁকাবাঁকা হয়ে হয়ে অধিকতর সরু লেজের আকার ধারণ করে শেষ হয়েছে।

 

 

 

Fury said to a

mouse, That he

met in the

house,

‘Let us

both go to

law : I will

prosecute

you. — Come,

I’ll take no

denial; We

must have a

trial : For

really this

morning I’ve

nothing

to do’.

Said the

mouse to the

cur, Such

a trial,

dear Sir

With

no jury

or judge,

would be

wasting

our

breath.’

‘I’ll be

judge, I’ll

be jury.’

Said

cunning

old fury.

‘I’ll

try the

whole

cause,

and

condemn

you

to

death.’

 

বাংলায় এ-ধরনের কবিতা চোখে পরে। কল্পনাপ্রতিভার একটি দৃশ্যগ্রাহ্য রূপ ফলিয়ে তোলার জন্যই কবিরা শব্দসজ্জার এই বিশেষ আয়োজনের আশ্রয় নেন। এখানেও কবিরা কবিতাটির দৃষ্টিনন্দনের দিকে যতটা মনোযোগী অর্থময়তার পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ ও পাঠান্তরের দিকে ততটা মনযোগী নন। শামসুর রাহমানের একটি কবিতার নাম ‘তবু’। রফিক নওশাদ-সম্পাদিত কালপুরুষে ১৯৭২ সালে কবিতাটি মুদ্রিত হয়। কবিতাটির অংশবিশেষ তুলে ধরলাম।

 

আমরা আবার বিধ্বস্ত সেতুর দুই অংশের মতো হ’য়ে যাই

আ    লা    দা

আ    লা    দা

আ          লা    দা

আ    লা    দা

 

সু    দূ    র    আ    র    আ

লা

দা

সু     দূ     র

আ   লা  দা

বি   ষ   ম

আ   লা  দা

লা

দা

 

আধুনিক মানুষের মনোজগতের একটি মর্মন্তুদ অনুভূতি হলো বিচ্ছিন্নতাবোধ। একাকিত্বের যন্ত্রণা নিয়ে কবিতা লিখেননি আধুনিক যুগে এমন কবির সংখ্যা বিরল। ‘তবু’ শীর্ষক কবিতার মধ্যে কবির এই যন্ত্রণার পরিচয় আছে। বোধের তীব্রতার মধ্যে সেই যন্ত্রণার ছবি এঁকে কবি মুগ্ধ নন। তিনি মুদ্রণশৈলীর মধ্যেও নিয়ে এসেছেন তাঁর সেই যন্ত্রণার চিত্র।

 

হুমায়ুন আজাদের একটি কবিতার নাম ‘ইঁদুরের লেজ’। কবিতাটির মধ্যে লেজের গড়ন ভালো হয়নি। কিন্তু ইঁদুরের লেজের প্রতিমা বুঝতে অসুবিধা হয় না। পুরো কবিতাটি তুলে না-ধরলে লেজের ধারণা স্পষ্ট হবে না। কবিতাটি এই :

 

বিলেত থেকে একটি ইঁদুর ঠোঁটে মাখা মিষ্টি সিঁদুর, বললো এসে

মুচকি হেসে চুলের ফাঁকে আস্তে কেশে,

আমাকে কি চিনতে পারো?

চিনতে আমি পারি তারে, দেখে –

ছিলাম লেকের পারে : মুখখানা তার

শুক্রবারে, পা-দুখানা রোববারে।

ইঁদুর সে খুব রূপবতী গায়ের চামড়া

দুধেল অতি, হাসলে ঠিক সোনার

মতো জ্যোৎস্না বেরোয় শতোশতো

জানি আমি জানি নিজে, পাশ

করেছে ক্যামব্রিজে একটা ভীষণ

পরীক্ষাতে শনিবার সন্ধ্যা –

রাতে। বলি আমি তারে ডেকে,

এসেছো তুমি বিলেত থেকে কী

কারণে? ঝিলিক দিয়ে রঙিন

অতি হাসলো একটু রূপবতী,

বললো, আমি আ-সি-য়া-ছি

বাংলাড্যাশে অ-পা-রে-শ-নে!

লেজটি যদি ছাঁটতে পারি

তা হলে তো সারিসারি

জুটবে রাজা। এসেছি

তাই বাংলাদেশে।

চমক শেষে চক্ষু

মেলে দেখি

আমি, রূপ –

বতী গেছে

আমার

সামনে

তার

লেজটি

ফে

লে।

 

 

কবিতার এই মুদ্রণগত স্ক্যাচ কতটা তাৎপর্যময় তার কোনো মূল্যায়ন আজ অবধি হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় যে, এসব বাহ্যিক কারুকার্যময় কবিতা শিল্পবিচারে মানোত্তীর্ণ হয় না। মূলত দৃষ্টিগ্রাহ্য কবিতার উদ্ভবও হয়েছিল শব্দ দিয়ে ছবি অাঁকার জন্য। এক্ষেত্রে কবিতাটি মুখ্য নয় – ছবিটিই মুখ্য। কিন্তু এ-কথা সব ক্ষেত্রে যথার্থ নয়। পর্ব, পঙ্ক্তি, চরণ বা স্তবকবিন্যাসে বৈচিত্র্যপূর্ণ অনেক কবিতা আছে যা শুধু দৃষ্টিনন্দনই নয়, অধিকন্তু কাব্যমূল্যেও অসাধারণ। সমতল, অসমতল, অাঁকাবাঁকা, ঢেউ, সিঁড়ি, ঘূর্ণায়মান, ছাড়া ছাড়া, গাঢ়বদ্ধ, গদ্যগড়ন ইত্যাদি নানা আকারের কবিতা হতে পরে। এসব গড়নের ভেতর দিয়ে এক ধরনের আবেদন তৈরি করার প্রয়াস সব কবির মধ্যেই থাকে। কিন্তু কাব্যগ্রন্থে মুদ্রিত মুদ্রণশৈলীসর্বস্ব শব্দের সমাহার পাঠক বা শ্রোতার হৃদয়ে কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে না-পারলে তাকে কবিতাপদবাচ্যে অভিষিক্ত করা যাবে না।

 

কবিতার বিষয়-আশয়

আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর পথের শেষ কোথায় শীর্ষক গ্রন্থে কবিতাকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। শ্রেণি তিনটি হলো : পারমার্থিক, সামাজিক ও সাশ্রয়ী। প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিতা মূলত পারমার্থিক। কিন্তু সেই পারমার্থিকতা বিচিত্র রূপে-রসে-বোধ-বুধীতে এখনো কবিতার বিষয় হচ্ছে। চর্যাপদে আমরা দেখেছি, এই পারমার্থিকতাই মুখ্য। মধ্যযুগে এসে আমরা স্পষ্টতই লক্ষ করি যে, কতগুলো সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে শত শত বছর ধরে কাব্যচর্চা চলছিল। মূলত ধর্মসাধনার অনুষঙ্গে অসংখ্য কবি নামে-বেনামে রচনা করেছেন মঙ্গলকাব্য, পদাবলি সাহিত্য, প্রণয়োপাখ্যান। তখন সমাজে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ছিল না। যূথবদ্ধ জীবনের ধর্মভিত্তিক আখ্যান রচনা করাই তখন ছিল কবিদের দায়িত্ব। অধিকাংশ সময় রাজরাজড়াদের পৃষ্ঠপোষকতায় কবিগণ অসাধারণ নিষ্ঠা, সততা, একাগ্রতা ও বিস্ময়কর শ্রমের ভেতর দিয়ে কাব্যসাধনা করে যেতেন। বিষয় নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা ছিল না বললেই চলে। অধিকাংশ সময় পূর্বতনদের অনুস্মরণে অভিন্ন উত্তরসাধনাই ছিল কবিদের দায়িত্ব। বিষয় ওই একই – পারমার্থিকতা। সেই অভিন্ন বিষয় কখনো কখনো ব্যক্তিকবির রচনাশৈলীর উৎকর্ষে অসাধারণ হয়ে উঠত। শুধু ওই রচনাশৈলীর মধ্যেই আমরা পেয়ে যাই কবির স্বাতন্ত্র্যের পরিচয়। অবশ্য এই যূথবদ্ধ জীবন, অনুক্রমণের জীবন, আত্মীয়তান্ত্রিকতার জীবন ভারতবর্ষীয় জীবনজিজ্ঞাসা ও জীবনদর্শনের অপরিহার্য ঐতিহ্য।

আধুনিক যুগের সূচনালগ্ন থেকেই শুরু হয় বিষয়ভাবনার বৈচিত্র্য। সেই বৈচিত্র্যের স্বরূপে আজ অবধি যেসব পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নির্ধারণ করা যাবে না। দৃষ্টিভঙ্গির স্থূলতা থেকে শুরু করে ক্রমে সূক্ষ্ম হতে হতে আজ অধিকাংশ কবিতার সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়বস্ত্ত চিহ্নিত করাই প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ঈশ্বর গুপ্ত কবিতার আঙ্গিকে অস্থির সময়ের বহিরঙ্গের পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। কতকগুলো স্থূল বিষয়কে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে তাঁর ব্যঙ্গবিদ্রূপ ও রসিকতার জগৎ। পৌষ-পার্বণে পিঠাপুলি খেয়ে পেটের পীড়ায় কষ্ট পাওয়া, নববর্ষে মদ্যমাংস খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া, চালের দরদাম, রান্নাঘরে নারীর দুর্গতি, নীলের দাদন, হোটেলখানা, তপসে মাছ, নারীশিক্ষার স্বরূপ, স্বাদেশিকতা, বাবুসমাজ এবং সেই সমাজের বিচিত্র অসঙ্গতি তাঁর কবিতার বিষয়। মোটা দাগে অবশ্যই সামাজিক। সুনির্দিষ্ট এই বিষয়ভাবনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পর্যন্ত কমবেশি সব কবির মধ্যেই ছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, বিহারিলাল চক্রবর্তী, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, গোবিন্দ্রচন্দ্র দাস, কায়কোবাদ, অক্ষয়কুমার বড়াল প্রমুখ কবি স্পষ্ট কতগুলো বিষয় নিয়ে কাব্যচর্চা করেছেন। এই কবিতাগুলোও সামাজিক কবিতরই অন্তর্গত। অবশ্য এ-সময়ে মধুসূদনের কিছু গীতিকবিতা এবং গগন হরকরা ও হাছন রাজার কিছু কবিতায় বস্ত্ত ও ঘটনানিরপেক্ষ ভাবনার পরিচয় মেলে। এবং এখান থেকেই স্থূল বিষয়নির্ভরতার বাইরে কবিগণ ব্যক্তিকবির ভাবনানিচয়ের কতগুলো স্পষ্ট-অস্পষ্ট চিহ্নকে কবিতার বিষয় করে তোলেন। আবু সয়ীদ আইয়ুব এ-ধারার কবিতাকে বলেছেন সাশ্রয়ী।

ঈশ্বরগুপ্তের কবিতাকে কবিতা বলেই বিবেচনা করা হতো না। ফলে তপসে মাছ নিয়ে ঈশ্বরগুপ্ত যে-কবিতা লিখেছেন কবিতার বিষয় বিবেচনায় তা হিসেবে রাখা হয়নি। ফলে কবিতার বিষয় বিবেচনায় মহত্ত্বের প্রশ্ন উঠেছিল। কুক্কুট (মোরগ) নিয়ে কবিতা লেখা যায় এ-ধারণা এক সময় রবীন্দ্রনাথেরও ছিল না। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং কুক্কুট নিয়ে অসাধারণ কবিতা লিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অবাক করে দেন। পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বুঝেছেন, কবিতার জন্য নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নেই। ‘ছেঁড়া কাগজের ঝুড়ি’, ‘শালিক’, ‘গোয়ালিনী’, ‘স্যাকরা’, ‘পাখির ভোজ’, ‘বেজি’, ‘আম গাছ’, ‘কাঁচা আম’ ইত্যাদি শিরোনামে অকাব্যিক বিষয় নিয়ে তিনি অসাধারণ কবিতা লিখেছেন। ‘শালিক’ শীর্ষক কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি উল্লেখ করি।

শালিখটার কী হলো তাই ভাবি।

একলা কেন থাকে দলছাড়া।

প্রথমদিন দেখেছিলেম শিমুল গাছের তলায়,

আমার বাগানে,

মনে হলো একটু যেন খুঁড়িয়ে চলছে।

তার পরে ঐ রোজ সকালে দেখি –

সঙ্গীহারা, বেড়ায় পোকা শিকার করে।

প্রতিদিন দেখা সামান্য একটি পাখি শালিক। এই সামান্য প্রাণীটিকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি বেদনার জগৎ তৈরি করেছেন, একটি অপরিসীম মমত্বের জগতের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। গদ্যের অতি সহজ-সুন্দর কাব্যভাষার আশ্রয়ে তিনি স্পর্শ করতে চেয়েছেন করুণা-অন্তপ্রাণ মানবজীবনের চিরায়ত স্বভাবকে। এই কবিতা সাশ্রয়ী – ব্যক্তিগত অনুভাবনার কাব্যরূপ। সুতরাং কবিতার বিষয় কী হবে, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। প্রেমের কবিতা, দ্রোহের কবিতা, প্রকৃতির কবিতা, দেশপ্রেমের কবিতা, নগরজীবনের কবিতা, গ্রামজীবনের কবিতা, আশার কবিতা, নৈরাশ্যের কবিতা, নিঃসঙ্গতার কবিতা, যন্ত্রণার কবিতা ­- এমন বহু বিষয় নিয়ে কবিতা হতে পারে। আবার স্পষ্টভাবে বিষয় উল্লেখ করা সম্ভব নয় এমন মনোজাগতিক বিষয় নিয়েও কবিতা রচিত হতে পারে। তিরিশের দশকের পর থেকে কবিতার বিষয় বস্ত্তনিচয় ও ঘটনাপুঞ্জকে অতিক্রম করে চেতনার অসমবায়ী ও আপাত অনন্বয়ে উপনীত হয়। তখন থেকেই  কবিতার বিষয় অনিকেত, উন্মূল। সাম্প্রতিককালে কবিতার এই উন্মূলতা অনেক বেশি স্পষ্ট। এর জন্য অনেক কবিতা দুর্বোধ্যতাদোষে দুষ্টও হয়েছে। বিষ্ণু দে-র উর্বশী ও আর্টেমিস শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ সালে আর চোরাবালি বেরোয় ১৯৩৭ সালে। সে-সময়ে চোরাবালি সম্পর্কে কামাক্ষীপ্রসাধ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন :

এ-বইয়ের প্রকৃত সমালোচনা লেখা আমার পক্ষে একেবারেই সহজ নয়। সেরকম পান্ডিত্য তো দূরের কথা, এ’র অনেক কবিতা বুঝতে পারার মতো লেখাপড়াও আমার নেই। তবে প্রকৃত যা’ কাব্যসংগীতের সঙ্গে বোধ করি তার তুলনা করা যেতে পারে : যে গানে প্রাণ আছে পাকা ওস্তাদকে তা’ যেমন মুগ্ধ করবে, প্রায় তেমনি করবে অনেক জটিলতা থাকা সত্ত্বেও গান সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ আনাড়িকে। ভালো কবিতা ও ভালো গান মনের এক অতীন্দ্রিয়র রাজ্যে অনুভূতির ঝড় তোলে, তা বোঝার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম ডিগ্রী বা ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীতে অনেক পুঁথি-পড়া বিদ্যের প্রয়োজন হয় না। এবং এই ভালো-লাগাটাই কাব্যের মূল কথা : কবিতা যদি ভালো লাগে সেখানেই তা’র চরম সার্থকতা – না-ই বা বোঝা গেল তার অনেক কথার মানে, অনেক ঐতিহাসিক-পৌরাণিক ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত।

কবিতার ক্ষেত্রে ‘মানে’ না-বুঝেও আনন্দিত হতে কোনো বাধা নেই। এর অর্থ হলো, কবিতার বিষয়বস্ত্ত স্পষ্ট না-বুঝতে পারা কবিতার জন্য হানিকর কিছু নয়। এই ধারণা আধুনিককালের। মধুসূদন দত্ত তাঁর কবিতায় প্রচুর তৎসম শব্দ ব্যবহার করেছেন। সেসব তৎসম শব্দের অর্থ বুঝলে তাঁর কবিতা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাও তদ্রূপ। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে প্রমুখ কবির অনেক কবিতার শব্দের অর্থবাচকতা অর্থাৎ পুরাণ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে ইঙ্গিত বুঝতে পারলেও কবিতাটির বিষয় নিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নাও হতে পারে। এ-প্রসঙ্গে জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতা স্মরণযোগ্য। সাতটি তারার তিমির শীর্ষক কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কবিতাটির নাম ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য’।

কয়েকটি নারী যেন ঈশ্বরীর মতো;

পুরুষ তাদের : কৃতকর্ম নবীন;

খোঁপার ভিতরে চুলে : নরকের নবজাত মেঘ,

পায়ের ভঙ্গির নিচে হঙ্কঙের তৃণ।

 

সেখানে গোপন জল ম্লান হ’য়ে হীরে হয় ফের,

পাতাদের উৎসরণে কোন শব্দ নাই;

তবু তারা টের পায় কামানের স্থবির গর্জনে

বিনষ্ট হতেছে সাংহাই।

 

সেইখানে যূথচারী কয়েকটি নারী

ঘনিষ্ঠ চাঁদের নিচে চোখ আর চুলের সংকেতে

মেধাবিনী – দেশ আর বিদেশের পুরুষেরা

যুদ্ধ আর বাণিজ্যের রক্তে আর উঠিবে না মেতে

 

প্রগাঢ় চুম্বন কবে টানিতেছে তাহাদের

তুলোর বালিশে মাথা রেখে আর মানবীয় ঘুমে

স্বাদ নেই – এই নিচু পৃথিবীর মাঠের তরঙ্গ দিয়ে

ওই চূর্ণ ভূখন্ডের বাতাসে – বরুণে

ক্রূর পথ নিয়ে যায় হরীতকী বনে – জ্যোৎস্নায়।

এই কবিতা নিয়ে বিপরীতধর্মী অনেক আলোচনা হয়েছে, তর্কবিতর্ক হয়েছে, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি কেউই। আধুনিক কবিতার যে রহস্যময়তা ও উল্লম্ফনের জগৎ এবং অনুক্রম ভেঙে দেওয়ার যে-প্রবণতা তার মধ্যে নিহিত আছে এর গঠনগত অনিবার্যতার ন্যায়সূত্র। এই প্রবণতা সাম্প্রতিককালের কবিতার  অন্তর্জগৎ ও বহির্কাঠামো সংগঠনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, যার অনন্য স্বরূপ-চারিত্র্য নিয়ে গবেষণার সুযোগ আছে।