কবিতা ও কথার মর্মভেদী আলো

কালীকৃষ্ণ গুহ

‘নিজের তৈরি গহবরের উপর দিয়েই এখন আমার হাঁটা’

গত চল্লিশ বছর ধরে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে নিয়ে একটি নিবন্ধ লেখার কথা – বলা যায় একটি শ্রদ্ধাপত্র রচনার কথা – ভেবে এসেছি, কিন্তু কাজটি করে ওঠা যাচ্ছিল না। কেন যাচ্ছিল না, তা বোঝাও কঠিন; বাধা একটা ভেতর থেকেই তৈরি হয়ে আসছিল আর বাইরে থেকেও যথেষ্ট আহবান ছিল না। অলোকরঞ্জনতুল্য একজন দিগন্তস্পর্শী মেধার কবিকে নিয়ে – যাঁর লেখার অজস্রতায় মিশে গেছে বহু ধ্যান ও লৌকিক বিবরণ, নির্মাণশৈলীর বহু চমৎকৃতি, জ্ঞান ও অনুভূতির বহু মুক্তবন্ধ প্রতিবেদন, বহু প্রতিবাদ ও অভিনন্দন, বহু শ্লেষ ও তির্যকতায় শায়িত কথার বিস্তার – অর্থাৎ এমন একজন মহাজন পদকর্তাকে নিয়ে কিছু লিখে ফেলতে যে আস্থা ও মনোযোগ দরকার তা গড়ে উঠছিল না। এটাই ছিল ভেতরের দিকের বাধা। আর যে-ধরনের বাধ্যবাধকতা ছাড়া আমরা একটিও গদ্য-পঙ্ক্তি রচনা করিনি, সেরকম কোনো বাধ্যবাধকতা তৈরি হচ্ছিল না বাইরের দিক থেকে। সম্প্রতি এসেছে সেই আহবান, যাকে বাধ্যবাধকতা হিসেবেই ব্যাখ্যা করে নিচ্ছি, যদিও বাইরের ও ভেতরের শীত শরীরমনে এ-মুহূর্তে জোড় বেঁধে আছে। ‘বয়সোচিত/ শীত\/ এল আমার/ আর\/ তোমার পাশে/ হাসে\/ কী সুন্দর/ ঘর’ – তরুণ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের এই পঙ্ক্তিগুলি বহুবার উচ্চারণ করে আনন্দের আলস্যে মিশিয়ে দিয়েছি একদিন, কিন্তু আজ এসব মর্মে এসে লাগে। তবু, অরচিত একটি লেখাই লিখব, এই মনোভাব নিয়ে বাক্যগঠন করতে শুরু করলাম, পাঠক।

 দুই

গত শতকের ষাটের দশকের শুরুর দিকে অলোকরঞ্জনকে যখন প্রথম দেখি, তখন মনে হয়েছিল : তিনি বাংলা কবিতার তরুণ দেবতা, আর এঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে আমাদের। তাঁর কথা শুনে মনে হয়েছিল, তাঁর কণ্ঠস্বর শুনে যেতে হবে। তখন কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে একালের বাংলাভাষার কাব্যপুরাণ যৌবনবাউল। বইটির নাম উচ্চারণ করতে করতেই কেটে যায় কবিতাভাবনার অনেকটা সময়। কেন যৌবনবাউল? যৌবনই কি বাউল? যৌবন রূপ বাউল? অর্থ খুঁজতে গিয়ে ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। অর্থের নিশ্চয়তায় ঠিক পৌঁছনো হয় না, তবে অনিশ্চয়তার দক্ষিণের বাতাস লাগিয়ে ভাবা যায় যে, যৌবন ও বাউল পরস্পরের সঙ্গে মিশে যেতে চায় – প্রত্যেক যুবকের মধ্যেই থাকে একজন বাউলের পরিসর – একজন মনের মানুষকে খুঁজে নেবার পরিসর, আত্মজিজ্ঞাসার দিগন্তবিস্তৃত একটা পরিসর। পন্ডিত ও স্বনামধন্য অধ্যাপক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত যে একজন ‘ভাবের মানুষ’ – যেমন বাউলদের বাচনে পেয়েছি – তা যেন ওই বইয়ের শিরোনাম থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া এই বইয়ের ভূমিকা হিসেবে যে-কবিতাটি ছাপা হয়েছে, যা ‘বিভাগ কবিতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল কাব্যগ্রন্থের একটি প্রায়-অনিবার্য গঠনশৈলী হিসেবে, তা অপ্রত্যাশিত কয়েকটি শপথবাক্য, যা উচ্চারণ করে একজন কবি জগৎসভায় প্রবেশ করছেন!

এই কবিতার অতিবিখ্যাত শেষ পঙ্ক্তিকটি নতুন পাঠকদের জন্য উদ্ধৃত করে দিতে হবে :

ধরিত্রীর নীবিবন্ধে     জগৎ যদি মহানন্দে

অন্ধ, আমি প্রহরী যন্ত্রণা,

মানুষ গেলে নামের খনি,      আমার পরে এই ধরণী

সঙ্গোপনে অলোকরঞ্জনা \

এখানে এসে একজন দুঃসাহসী (সৎসাহসী?) প্রকৃতিপ্রেমিক অলোকরঞ্জনকে পেয়ে আমরা বাস্তবিক অবাক হয়ে গেলাম। ‘আমার পরে এই ধরণী/ সঙ্গোপনে অলোকরঞ্জনা’, এই পঙ্ক্তির রচয়িতার সঙ্গে দেখা হওয়া তো কম কথা ছিল না! আজ এ-কথা খুব সরলভাবেই বলতে পারি যে, সারাজীবনই তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকেছি, যদিও, সত্য এই, তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপচারীর সুযোগ খুব বেশি গ্রহণ করিনি। জানি, তাঁর খুব কাছে গিয়েছিল যারা তাদের কেউ কেউ এই ‘যৌবনবাউল সূর্যে’র আগুনে পুড়ে গেছে। আমরা তাঁর অনুপস্থিতির দিকেই তাকিয়ে থেকেছি বলা যায়। আর তিনি তো রক্তাক্ত ঝরোখা প্রকাশের পর এদেশ ছেড়ে চলেই গেলেন! এ নিয়ে আমরা অনেক নিষ্ফল স্বগতোক্তি করেছি একসময়। পরে মনে হয়েছে, এই বিশ্বে বসবাস করাটাই বড়ো কথা – তা সে যাদবপুর হোক বা হাইডেলবার্গ। ‘এই ধরণী সঙ্গোপনে আলোকরঞ্জনা।’ বস্ত্তত আজ এ-কথা ভাবতে আনন্দ হয় যে, তিনি ভারতবর্ষের সাহিত্যের দূত হিসেবে, বাংলাসাহিত্যের তথা রবীন্দ্রসাহিত্যের অনুবাদক ও ব্যাখ্যাতা তথা শিক্ষক হিসেবে সারাজীবন কাজ করে গেছেন আর সেইসঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে – বিশেষত জার্মান সাহিত্যের সঙ্গে – আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এই কাজের মূল্য অপরিসীম। এই প্রসঙ্গটি আজ আমাদের আলোচ্য নয়, তবু এই উল্লেখটুকু রাখতে হলো শুধু এই কথাটা কিছু জোর দিয়ে বলার জন্য যে, অলোকরঞ্জনের দেশত্যাগ ছিল শেষ পর্যন্ত দেশের মঙ্গলের জন্যই। দেশের মঙ্গলচিন্তা করে অলোকরঞ্জন দেশত্যাগ করেছিলেন, এ-কথা অবশ্যই বলতে চাইছি না আমরা, কিন্তু তিনি যে তাঁর কাজের পরিসর বিপুলভাবে বাড়াতে পেরেছেন বাইরে গিয়ে, সে-বিষয়ে সন্দেহ করার কোনো কারণ আমরা দেখতে পাইনি। অলোকরঞ্জন একটি মুহূর্তও আলস্যে কাটিয়ে দেবার মানুষ নন। কাজের মধ্যে, কাজের স্বপ্নের মধ্যে, কাজের উচ্চাকাঙ্ক্ষার মধ্যে জীবন কাটান তিনি। আমরা জানি, সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত নামের গ্রন্থটির নির্মাণ ঘটেছিল প্রধানত তাঁর হাতে, যা বিশ্বকবিতার সম্ভার নিয়ে এসেছিল আমাদের জন্য, যখন অলোকরঞ্জন যথেষ্ট তরুণ।

অমিয় চক্রবর্তীকে স্বভাবতই অলোকরঞ্জনের একজন স্বল্পবাক পূর্বসূরি হিসেবে ভাবতে ইচ্ছে হয়। শেষ জীবনের একটি বইয়ের ভূমিকায় অমিয় চক্রবর্তী লিখেছিলেন – ‘নিজেকে জড়িয়ে থাকা শিল্পীর পক্ষে শাস্তি; ছড়িয়ে যাওয়া ছাড়িয়ে চলাই তার ধর্ম। মাঠের পথে, জাহাজ-নৌকোর ঘাটে, প্লেনের উচ্চ হাওয়ায় ঘুরেছি, বাড়ি ফিরেছি। স্তরে স্তরে লোকালয়ের দান অন্তরজীবনে পূর্ণ হলো। আজ বেলাশেষে সেই পরিক্রমা একটি মাত্র মৃৎরেখায় পরিণত। ওপরে আকাশ, পাশে দিগন্ত। মাটি, ধরণি, বসুন্ধরা যে-নামেই হোক, ভূমিস্পর্শ অভিযানই আমার স্বপ্রকাশ, তার অন্য ভাষা নেই, ভাষ্য নেই। সংসারে একটি মৃন্ময়ী বাসা বেঁধেছিলাম সেই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা।’ অমিয় চক্রবর্তীর এই অসাধারণ আত্মমূল্যায়নের উদ্ভাসিত সন্ন্যাস আমরা অলোকরঞ্জনের জন্য প্রযোজ্য ভাবতে চাই। অলোকরঞ্জনও বাড়ি ফিরে আসেন বছরে দুবার-তিনবার প্রায় বালকের অভিমান ও আবেগ নিয়ে। আমরা তাঁর উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি, দুই-ই সানন্দে গ্রহণ করে চলেছি। তাঁর পরিক্রমাও শেষ পর্যন্ত একটিমাত্র মৃৎরেখায় পরিণত হবার, যে-রেখা বৈশ্বিক, সার্বত্রিক। এই পরিণতির পরাবাস্তবতা খুঁজতে হয় শুধু অনুভূতির স্তরে, অন্য কোথাও তা পাবার নয়। তার ফলিত রূপ পাই তাঁর কাব্যে।

 তিন

অলোকরঞ্জন তাঁর বাল্যকালের কিছুটা অংশ সাঁওতাল পরগনার রিখিয়ায় তাঁর পিতামহের সান্নিধ্যে কাটিয়ে শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে আসেন। ‘এক নদীতে দুবার স্নান করা যায় না’, গ্রিক দার্শনিকের এই শিক্ষা নেন পিতামহের কাছ থেকে। সেখান থেকে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠগ্রহণ সমাপ্ত করেন। এইভাবে বাল্যকাল ও  কৈশোর কাটিয়ে তিনি যে-মর্মলোক বহন করে আনলেন, সেখানে স্থায়ী আসনে রইলেন পিতামহ-পিতামহী, মাতামহ-মাতামহী, মা-বাবা-ভাই-বোনের পরিবার, বন্ধু-প্রতিবেশীরা সমস্ত সম্পর্কের বিস্তার ও আনন্দ এবং ঈশ্বর। রইল শান্তিনিকেতন, রবীন্দ্রপ্রসঙ্গের রৌদ্রস্নান, ক্ষিতিমোহন সেন বা ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর মতো ব্যক্তিত্বের ঘের। তাঁর কবিতায় রইলেন সবাই, যখন আধুনিকতার টানে নিরীশ্বর মানুষের ভাষ্য জেগে উঠেছিল, বিপুল বিস্তার নিয়ে, জীবনানন্দ-পরবর্তী বাংলা কবিতায়। তিনি তাঁর ঈশ্বরকে জানালেন, ‘বন্ধুরা বিদ্রূপ করে তোমাকে বিশ্বাস করি বলে’, এবং ঈশ্বরের সঙ্গে বোঝাপড়ায় নামলেন :

এখনো তোমাকে যদি বাহুডোরে বুকের ভিতরে

না পাই, আমাকে যদি অবিশ্বাসে দুই পায়ে দলে

চলে যাও, তাহলে ঈশ্বর

বন্ধুরা তোমাকে যেন ব্যঙ্গ করে, নিরীশ্বর বলে।

এতে একটা কম্পন ঘটে গেল বলা যায়। তাঁর তরুণ অনুগামীদের অনেকেই ঈশ্বরের পথ খুঁজে পেতে ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। পাশাপাশি মায়ের কথা লিখলেন তিনি :

আনম্র প্রণতি আঁকি।

উঁচু নিচু জীবনের টিলা

যতদূর দেখা যায়, অথবা না যায়,

সবার শিখর জুড়ে স্বাভিমুখী আরতি সাজায়

যৌবনবাউল সূর্য, উৎসলীনা সবিতার লীলা

দেখবে বলে পূর্বাচল প্রতীক্ষার আগুন রাঙায়।

‘মায়ের জন্মদিনে’ কবিতায় তিনি আরো বললেন, ‘আমার আকাশ তুমি বারোমাস আমার আঙিনা।’ সহসা যেন বাংলা কবিতার আধুনিকতার তাত্ত্বিক ভিত্তিপ্রস্তর অংশত ভেঙে পড়ল। পাশাপাশি আলোক সরকার লিখলেন, ‘ঈশ্বর, আমিও তোমার মতো নন্দিত, উদ্ভাসিত একটি দিঘির’ এবং ‘মাগো আমার খেলার পুতুল হারিয়ে গেছে/ সমস্ত ঘর এখন একলার।’ ঈশ্বর এবং মা এলেন এঁদের কবিতায়। শঙ্খ ঘোষও জানালেন যে, পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বাড়ি থেকে বেরোতে হয়! ‘পা ছুঁয়ে যে প্রণাম করি সে কি কেবল দিনযাপনের নিশান?’ এই প্রশ্নের মুখোমুখি শঙ্খ দাঁড় করালেন আমাদের। এখানে প্রত্যক্ষত কোনো ঈশ্বর নেই। আছেন মা-বাবা, তাঁদের ঘিরে পারিবারিক জীবন। গড়ে উঠল বাংলা কবিতার আত্মভুক নিঃসঙ্গতায় লালিত আধুনিকতার ধারার পাশাপাশি নতুন একটি ধারা যার কেন্দ্রীয় বার্তাটি, যেমন বুঝেছি, বিচ্ছিন্নতাই শেষ কথা নয়, সবাই সবার সঙ্গে যুক্ত আছে। অলোকরঞ্জন সরাসরি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যুক্ত করলেন নিজেকে এই অমোঘ বাক্যটি উচ্চারণ করে, ‘রবীন্দ্রনাথ মৌরি পাহাড়, জলপ্রপাত আমি’; এবং পরের পঙ্ক্তি তিনটিতে লিখলেন, ‘দুঃখ তো আর বলি না ইনিয়ে-বিনিয়ে,/ কবিতায় বাঁচে প্রজ্ঞাশাসিত অসুস্থ পাগলামি/ রোদ্দুরে যাই, রোদ্দুরে যাই মিলিয়ে।’ কবিতায় কী বাঁচে তা জানালেন তিনি। বাঁচে ‘প্রজ্ঞাশাসিত অসুস্থ পাগলামি’। এই কথন থেকে আমরা অলোকরঞ্জনের কবিতা বোঝার একটি তত্ত্বই যেন পেয়ে গেলাম। বস্ত্তত, বলতেই হবে তাঁর কবিতা মেধার খেলার ‘পাগলামিতে’ ভর্তি এবং তা প্রজ্ঞাশাসিত। অলোকরঞ্জনের কবিতার ‘পাগলামির’ একটি অমোঘ নমুনা হিসেবে নিচের কবিতাটি রাখতে চাই – একটি শ্রেষ্ঠ বাংলা কবিতার উদাহরণ তা অবশ্যই :

তুমি যে বলেছিলে গোধূলি হলে

সহজ হবে তুমি আমার মতো,

নৌকো হবে সব পথের কাঁটা,

কীর্তিনাশা হবে নমিতা নদী!

গোধূলি হলো।

 

তুমি যে বলেছিলে রাত্রি হলে

মুখোশ খুলে দেবে বিভোরবিভা

অহংকার ভুলে অরুন্ধতী

বশিষ্ঠের কোলে মূর্ছা যাবে।

রাত্রি হলো\

‘একটি কথার মৃত্যুবার্ষিকী’তে নামের এই কবিতাটিতে যে ছন্দ, যুক্তি ও ভাবের মিশ্রণ ঘটালেন তরুণ অলোকরঞ্জন তা হয়তো ছিল বাস্তবিক, একই সঙ্গে প্রজ্ঞা ও পাগলামি-শাসিত। অন্যথায় এরকম উচ্চতায় পৌঁছানোর যেন কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। এই কবিতায় ‘তুমি’ কে? নিশ্চয় সে নিজেরই একটি অপর-সত্তা, যার বহু কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে! কিন্তু অলোকরঞ্জনের মতো প্রজ্ঞাবান কবিকে কোনো ব্যাখ্যার সীমায় দাঁড় করিয়ে রাখা যায় না বেশিক্ষণ, বেশিদিন। ঈশ্বরবিশ্বাসী মাতৃভক্ত পারিবারিক ভালোবাসায় লালিত কবি হিসেবে তাঁর স্থান নির্ধারণ করে দেওয়ার মধ্যে স্বস্তি পাওয়ার কোনো উপায় নেই। সমস্ত নির্ধারণ ছাপিয়ে ওঠে তাঁর প্রাণপ্রবাহের বেগ ও অনিশ্চয়তা। চারপাশের পুরো সমাজটাকেই তিনি দেখে নেন শিল্পের বিশুদ্ধতার তত্ত্বকে মাটিতে শুইয়ে রেখে। দেখেন আত্মনিহত প্রেমিক-প্রেমিকাকে :

আত্মনিহত দুটি মৃতদেহ

রাঢ়ভগবতীপুরে

দুপুরবেলায় পৌঁছিয়ে গেল

নদীর উজান ঘুরে।

একটি পুরুষ তার চোখে খুব আক্রোশ, রুক্ষতা :

অন্যটি নারী, তার চোখেমুখে অটুট স্বর্ণলতা।

‘নারীশ্বরী’ নামের এ-কবিতাটি জানা ছিল না এমন কোনো কবিতা-পাঠকই বোধহয় ষাটের দশকে ছিলেন না; আর ‘অন্যটি নারী, তার চোখেমুখে অটুট স্বর্ণলতা’ ছিল প্রত্যেকের কণ্ঠস্থ। ঈশ্বরের পাশে এলেন বেশ্যা যিনি পুরোহিততন্ত্র ভাঙবেন : বুদ্ধমন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে/ এক বেশ্যা ঢুকে যায় পিছন-দুয়ার ঠেলে/ দাঁড়ায় বুদ্ধের ঠিক পাশে। আমরা জানি, অলোকরঞ্জনের মধ্যে পুরোহিততন্ত্রবিরোধী – বস্ত্তত প্রতিষ্ঠানবিরোধী – মনোভাব চিরদিনই জাগ্রত। তিনি অবশ্য প্রতিষ্ঠান এড়িয়ে চলেননি, বরং তার মুখোমুখি হয়েছেন – তা সে ঈশ্বর রাষ্ট্র দল বা বাণিজ্যকুমিরের বেশে সাহিত্যপ্রতিষ্ঠান, যাই হোক। বস্ত্তত একসময় এমন সন্দেহ হয়েছে যে, তিনি কি ঈশ্বরকে মানেন বাস্তবিক? এইরকম সন্দেহ থেকে তাঁর ভক্তদের কেউ কেউ তাঁদের নির্বাক ও মর্মাহত জীবন আরো বেশি করে ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে গেছেন। তিনি রাজাকে বলতে পারতেন : তোমার পোশাক কোথায়? এক অর্থে তিনি ‘অনাচারী’, অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত একজন স্বাধীন মননের/ ব্যক্তি-মানুষ, কিন্তু সবকিছুর সঙ্গে জড়িত, যেমন ইতিমধ্যেই বোঝাতে চেয়েছি। তিনি লিখতে পেরেছেন, ‘ঈশ্বরের সঙ্গে এক বিছানায় শুলে/ অনাচারী নাম যদি রটে তো রটুক’; তিনি পুরোহিতকে বলতে পারেন :

‘কি বোঝ তুমি, ঈশ্বরের ভাড়াটে সন্ন্যাসী?’

একটি ‘শবযাত্রা’ কবিতায় তিনি বললেন যে, শবযাত্রার অন্তিম শয্যার শাদা আবরণী তুলে ফেলে কেউ যদি ভিতরে তাকায় তাহলে দেখতে পাবে, ‘একদল কান্নাকীর্তনীয়া জলজ্যান্ত লোক/ ঈশ্বরের ডাকনাম কাদায় লুটিয়ে চলে যায়/ আমি বলে দিতে পারি ওরাই ছয়টি মৃতদেহ\’ ‘কান্নাকীর্তনীয়াদের’ আমরা মৃতদেহ ছাড়া কী ভাবতে পারি? কিন্তু ঈশ্বর স্বয়ং মৃত কিনা সে-প্রশ্নটিও মনে হয় অব্যাহতি দেয়নি তাঁকে। মনে হয় রবীন্দ্রনাথ বা অমিয় চক্রবর্তীর মতোই তিনি শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের দিক থেকে অনেক আগেই মন তুলে নিয়েছেন।

 চার

তত্ত্বের কথা বা দৃষ্টিভঙ্গি তথা দর্শনের কথা কিছু বলতেই হয় একজন কবিকে চিনে নেওয়ার স্বার্থে। কিন্তু এও যেন একরকম কান্নাকীর্তনীয়ার ভূমিকায় নামা। আমরা বরং সে-জায়গাটি থেকে সরে এসে দেখতে চাইতে পারি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতার সৌন্দর্য। বহুকাল পর তাঁর কবিতাসমগ্রের পাতা ওলটাতে গিয়ে মুহুর্মুহু চমকে উঠছিলাম। ভাবছিলাম, তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলির বাইরেও কত যে কবিতা রয়ে গেছে, যা সার্থক কবিতার উদাহরণ হিসেবে থেকে যাবে! কয়েকটি কবিতা বা কবিতাংশ পড়া যাক।

কী বলতে হবে কী করে বলতে হবে

রৌদ্র যখন মুদ্রিত নীল নভে

পঞ্চপাপড়ি সূর্য ওখানে যদি

ঘন আশ্লেষে উদ্যত, দ্রৌপদী

মেঘ যদি কাঁপে লজ্জিত গৌরবে,

কী বলতে হবে, কী করে বলতে হবে?

(‘কী বলতে হবে, কী করে বলতে হবে’, যৌবনবাউল)

 

তবু কি আমার কথা বুঝেছিলে, বেনেবউ পাখি?

যদি বুঝতে পারতে

নারী হতে।

 

আমাকে বুঝতে পারা এতই সহজ?

কারুকেই বোঝা যায় নাকি!

 

শুধু বহে যায় বেলা, ঈশ্বর নিখোঁজ;

কিংবা বুঝি এ-দুঃখ পোশাকি,

না-হলে কী করে আজো বেঁচে আছি রোজ

বেনেবউ পাখি!

(‘দুঃখ’, নিষিদ্ধ কোজাগরী)

 

অবরুদ্ধ অপরাহ্ণে আমি

একা।

বাগানে সংসার করে দোপাটি, সংসারে

স্বামীটি নেই, দোপাটি ফুল একা

নক্শা আঁকে ঘাসে।

পরস্ত্রী দোপাটি, আমার পাশে

একা \

    (‘পরকীয়া’, রক্তাক্ত ঝরোখা)

 স্বপ্নে কাল তোমায় ডাকলাম :

‘এ-জন্মের শহর ছেড়ে যাব,

এ-জন্মের শহর ছেড়ে পাব

তোমায় – তুমি গ্রামের মেয়ে – আর

হারানো সেই গ্রামকে পাব, যার

দু’অক্ষর নাম।’

 

আমার কথা শুনল গ্রহতারা;

আমার কথা শুনল তুমি ছাড়া

সবাই, তাই সম্মিলিত তারা

তন্দ্রাতুরা তোমার চোখে চেয়ে

আমার নামে অন্ধকার ছেয়ে

নিভিয়ে দিয়ে আমার কথাকলি

সরিয়ে নিয়ে তোমার নামাবলী

করল জড়ো নিবিড় ঘনযাম,

মেঘ বাজাল অমোঘ মল্লার,

হারাল সেই হারানো গ্রাম, যার

দু’অক্ষর নাম!

  (‘স্বপ্নপ্রয়াণ’, রক্তাক্ত ঝরোখা)

 

বাটিকে-আঁকা আকাশে দিনশেষে

তুমি আমার প্রিয়,

রয়েছে যারা তোমার পরিবেশে

তারাও ঈশ্বরীয়;

তোমাকে সব দিলাম ভালোবেসে

তুমি ওদের দিয়ো।

বাটিকে-আঁকা তোমার মুখে মেশে

বিষম রাত্রিও\

            (‘২৪’, রক্তাক্ত ঝরোখা)

 

বোবা নয়, তবু একটি কথাও শুনিনি, অথবা

আমিও তো নই বোবা

অথচ একটি কথাও বলিনি, শুধু একবার

শিরীষের ছায়া বেঁকে গেল যেই, গৃহকর্তার

শর্ত না মেনে দুজনে সেদিকে তাকিয়েছিলাম।

কেউ কি জানেন ও-মহাপাপের যথাযথ নাম?

                        (‘১৬’, রক্তাক্ত ঝরোখা)

 

দাসী বলেছিল হাঁটুর উপরে সল্তে রেখে :

‘তারা ঝরে গেলে দিদিমণি, তুমি পথে যেয়ো না,

দিদিমণি, তুমি পথে নামলেই দেখতে পাবে

পুরুষের মতো একটি পুরুষ (এ নয় তাদের

গোষ্ঠীভুক্ত যাদের ঘাড়ের সকল মাথা

ভেঙে দিয়ে তুমি আলতা পরেছ পরক্ষণে;

এ নয় তাদের দলের একটি মেয়েলি ছেলে

যার বরাদ্দ টিনের পাত্রে আলুনি রুটি)।

এই পুরুষের আরো দুটি নাম – একটি জীবন,

অন্য নামটি মৃত্যু সে কথা স্মরণে রেখ;

(‘দাসী বলেছিল’, নিষিদ্ধ কোজাগরী)

 

পাখিটার মাতৃভাষা চেয়ে থাকা,

ত্রিজগৎ রুষ্ট যখন ভ্রুকুঞ্চিত

পাতাহীন শিউলি ডালে একলা-একা

পাখিটির মাতৃভাষা চেয়ে থাকা

           (‘একা’, রুদ্রাক্ষের ঋতু)

 

না কোনো অতিরিক্ত পুরাণ নয়,

কবিতা এখন

নিজেই নিজের পুরাণ

 

আর তাই এই মুহূর্ত

যখন তুমি আমার কথার উপরে মাথা রেখে শুয়ে আছো

নিজেই নিজের পুরাণ

 

অথবা পুরাণ নিজে

প্রত্নপ্রবণ বাণিজ্য থেকে সরে এসে

নিজেই নিজের মুহূর্ত\

(‘এই মুহূর্ত’, ছৌ কাবুকির মুখোশ)

 

বিদ্যুতের হঠাৎ অভাবে

অজিতেশ (ক্রেয়ন) কেয়া (আন্তিগোনে) সংলাপ থামিয়ে দিয়ে

নগরপ্রান্তরে এক অন্ধকার মাপে

‘কেন এত অন্ধকার’ ‘আরো কতক্ষণ এই অন্ধকার’

একাকার দর্শকসত্তার

জিজ্ঞাসার মাঝখানে কারা যেন মঞ্চে উঠে গিয়ে

জ্বেলে দিল কয়েকটি মোম, তার সংক্ষিপ্ত আগুনে

ক্রেয়নের উত্তরীয় জ্বলে যায়, অগ্নিকান্ডে ঘৃতের আহুতি

আন্তিগোনে\

(‘আন্তিগোনে মঞ্চ : কলকাতা’, গিলোটিনে আলপনা)

 

তিতির শিকার করে অস্তাহ্নে নিষাদরুদ্র যায়।

তিন যুগ পরে দেখা, প্রথমে তো চিনতেই পারিনি,

তাছাড়া আরেক ডৌল ডান হাতে ইস্পাতের বালা,

যাকে সে করেছে খুন তার কাছে রয়েছে অ-ঋণী –

মৃত তিমিরের মুখে মেলে ধরে নৈবেদ্য নিরালা;

তাকে তিরস্কার করে সূর্যাস্তের রাগতরঙ্গিণী

 

সহসা নিষাদরুদ্র নুয়ে পড়ে নমঃশূদ্রতায়!

(‘ভারতবর্ষকে নিয়ে’, ঝরছে কথা আতস কাঁচে)

 

সে কেন সাক্ষাৎকার নিতে আসে?

আকাশে আনন্দ যেই, সুবাতাসে

নৌকোও উড়াল দেয়, সে সময়ে

সে কেন সাক্ষাৎকার নিতে আসে?

 

তার প্রশ্নগুলি খুব দীর্ঘায়িত,

উত্তর দেবার ছলে দিগ্বলয়

সরে যাই, জলাবর্তে, আত্মজয়ে –

যেমন ‘অতিথি’ গল্পে তারাপদ\

(‘অতিথি’, ঝরছে কথা আতস কাঁচে)

 

তাঁর প্রথম জীবনের বিভিন্ন বই থেকে দ্রুত নির্বাচনে তুলে নিয়েছি এই কবিতাগুলি। যৌবনবাউল প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে, ঝরছে কথা আতস কাঁচে ১৯৮৫-তে। এরপর তাঁর আরো অনেক বই বেরিয়েছে; কিন্তু একসঙ্গে সবগুলি নিয়ে কথা বলা উচিত নয়। বস্ত্তত একটি-দুটি বই নিয়েই রচিত হতে পারে, এক-একটি অতি দীর্ঘ প্রবন্ধ, যা নিশ্চয় ভবিষ্যতের গবেষকরা করবেন। ইতিমধ্যেই এই কাজ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। এই কয়েকটি মাত্র কবিতার পাঠ যদি কোনো পাঠক গ্রহণ করতে পারেন, তাহলে তাঁর বিস্ময়ের অঞ্চল যথেষ্ট সম্প্রসারিত হবে। ‘কী বলতে হবে, কী করে বলতে হবে’, এই প্রশ্নটিই একজন লেখকের তথা কথকের প্রথম প্রশ্ন। কিন্তু এর বিশেষ একটা নিয়ম নেই। প্রত্যেককেই নিজের জন্য নিজের নিয়ম অর্থাৎ নিজস্ব বিষয় বা লিখনভঙ্গিমা আবিষ্কার করে নিতে হয়। অলোকরঞ্জনের পথ বিরোধাভাসের পথ, যা সরলজটিল, প্রত্যাশিত-অপ্রত্যাশিতের মিশ্রপথ, কখনো নির্বিকার, কখনো বেদনাগ্রাহ্য, মননশীলতায় দীর্ণ। তিনি কত যে শব্দবন্ধ তৈরি করলেন তা ভাবতে অবাক হয়ে যেতে হয়। ‘ঘন আশ্লেষে উদ্যত দ্রৌপদী’ লিখতে পারলেন তিনি। লিখতে পারলেন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে-নেওয়া বেনেবউ পাখি বা দোপাটি ফুলের কথা। এলো শহরজীবনের গ্লানির কথা; এলো প্রিয়ার কথা যার বাটিকে-আঁকা মুখের সঙ্গে মিশে যায় বিষম রাত্রি; এলো নীরবতায় যাপিত প্রেমের কথা; এলো কবিতার অবস্থানের কথা (‘কবিতা এখন, নিজেই নিজের পুরাণ’); এলো প্রসঙ্গক্রমে এই শহরের নাট্যজগতের কথা, যা অনেক দৈবদুর্বিপাক অতিক্রম করে প্রবাহিত; এলো চিরকালীন ভারতবর্ষের একটি নিহিত প্রান্তিক খন্ডদৃশ্য (‘সহসা নিষাদরুদ্র নুয়ে পড়ে নমঃশূদ্রতায়’-এর মতো বাক্য লিখলেন তিনি); এলো পাঠকের অমসৃণ প্রশ্ন থেকে সুসময়ের আনন্দে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার কথা।

 

পাঁচ

ছন্দে অলোকরঞ্জন বলা যায় জন্মসিদ্ধ। ছন্দ নিয়ে তাঁর অনায়াস খেলার মধ্যে মাঝে মাঝে এতটাই ধুলো ওড়ে যে দর্শকের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, যেন উস্তাদ আলি আকবরের সৃষ্টিছাড়া তানকারী-লয়কারীর অতিকথন চলতে থাকে। শ্লেষ বিদ্রূপ কখনো কখনো পেয়ে বসে তাঁকে –  এতটাই, যে, মূল প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত কবিত্ব বা বেদনার কেন্দ্রটি খুঁজে পেতে পাঠককে দিশেহারা হয়ে পড়তে হয়। তবু, আমাদের অভিজ্ঞতা এই যে, অলোকরঞ্জনের এমন একটি কবিতাও পড়িনি, যা কোনো-না-কোনোভাবে উল্লেখযোগ্য মনে হয়নি। অনেক সময় শুধু গঠনশৈলীই হয়ে উঠেছে কবিতা। কখনো একটি আপাততুচ্ছ অবলোকন চমৎকৃত করেছে। আজো অলোকরঞ্জনের কবিতা পড়ি শিক্ষার্থীর মন নিয়ে। এই মন নিয়েই অলোকরঞ্জনের কবিতা পড়তে হয়, অন্যথায় অনেক পাঠ-ই ব্যর্থ হতে বাধ্য। এই ব্যর্থতায় ক্ষতি পাঠকের, কবির নয়।

অপ্রত্যাশিতের মধ্যে যে সংঘাত ও নাট্য, যে-বিরোধাভাস, সেখানেই খুঁজতে হয় অলোকরঞ্জনের কবিতার বৈশিষ্ট্য। তিনি প্রজ্ঞাবানের স্থিরতায় তথা স্থবিরতায় নিশ্চিন্ত থেকে বাক্য উচ্চারণ করে যাননি। বরং প্রজ্ঞাবানের অস্থিরতায় নানা প্রশ্নে আলোড়িত থেকেছেন। তাঁর কবিতায় প্রবাহিত থেকেছে একটি নাট্যধারা, যেখানে প্রশ্নকণ্টকিত নায়কের স্বগতোক্তি শুনতে পেয়েছি আমরা। কত-যে অপ্রত্যাশিত সংঘাত, কত-যে নাটক, কত ভাষা-ব্যবহারের ইন্দ্রজাল! ‘অভুক্ত দেবতার অর্ঘ্যের আপেল চিরে রক্ত/ আমি সইতে পারছি না।’ এভাবে শুরু হয়ে একটি কবিতা এখানে পৌঁছয়, ‘…এক কুমারীর ক্রোড়ে/ রক্তে-ভেসে-যাওয়া সেই নৈবেদ্য সাজিয়ে চেয়ে থাকি,/ গোধূলির বিন্ধ্যাচলে আমাদের অকৃতার্থতা কি/ অর্ঘ্য ও দেবতা মিলে আমাদের শতাব্দীর পাখি?’। এইরকম পঙ্ক্তি যে-মন থেকে উৎসারিত, সেই মনের গতির কথা ভাবলে অবাক হতে হয়। অবাক হতে হয় যখন তিনি অনায়াসে লিখে ফেলেন এরকম সব পঙ্ক্তি : ‘আমাদের চুম্বনে জেগে ওঠে প্রার্থনা, আর তক্ষুনি/ মুন্ডিতকেশ যত পুরোহিত/ ঐতরেয় ভৎর্সনা জুড়ে দেয়’, অথবা ‘এই মুহূর্তে যে-মানুষটি চলে যাচ্ছে আমি তাকে মন্ত্রের ভিতরে তুলে নিলাম।’ বা ‘কে আমায় চেনে বল? এই বৃক্ষতলে/ সিঁদুর পরাতে গিয়ে আমি যদি অকস্মাৎ মরি,/ কার সাধ্য যে আমায় বলবে বিধবা?/ বরং আরো তখন তোমার শরীরে রক্তজবা।’ বা, ভাবা যাক, এই পঙ্ক্তিগুলির মধ্যে নিহিত নাট্যের কথা, ‘তারা দেবী, তোমার মন্দির কেন অত তীব্র উদারায় বেঁধেছে?/ তোমার মন্দির কোন জৈনদেবতার তানপুরা?/ পরক্ষণে, উত্তর না পেয়ে, দেখ খুব তুষার জমেছে/ চত্বরে, তুষারে খুব ধাতুমূর্তি ঢেকে দিতে জানে,/ তুষারে তোমার মুখ সুলতার মতন দেখাল।’ সুলতা ও তারাদেবীর মুখ পরস্পরের সঙ্গে মিশে গেল – দুজনেই রহস্যময়ী অসম্মত রমণী। দুজনের সঙ্গেই নিঃসঙ্গের বোঝাপড়ার সূত্র ধরে এগোতে এগোতে কবিতাটি হয়ে ওঠে অতলস্পর্শী। এই পর্যায়ের শেষ একটি উদাহরণ হতে পারে ‘জবাবদিহির টিলার’ অনবদ্য বিভাবকবিতাটি :

আর আমার কোনো নিসর্গ নেই, মানুষজন যখন ঘুমিয়ে পড়ে/ আপাতমৃত লোকালয়ের মধ্য দিয়ে যেতে-যেতে অনুভব করি/ অনন্ত নিসর্গের আস্বাদ যেন দেবদারুর দূতীরা ঢেলে দেয় আমার/ মুখে অমৃত আঃ আমার ঘুম পায় আর দুদিকে খাটিয়া/ পেতে ঘুমিয়ে থাকে কাতারে-কাতারে নরনারী তাদের/ মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাবার পথটাই আজ আমার নিসর্গ

মনে হবে, প্রাচীন কোনো গ্রিক-ট্র্যাজেডির নায়কের সলিলোকি শুনতে পেলাম এই গদ্যভাষায়। নিসর্গ-হারানো কবিকে দমবন্ধ-করা শহরতলির ঘুমন্ত মানুষের সারির মধ্যে খুঁজে পেতে হয় নিসর্গ। নিসর্গ তো পেতেই হবে।

 

ছয়

তিরিশের কবিদের মননশীলতার ধারায় নিজেকে স্থাপন করে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত নিরন্তর অনুসন্ধান করে গেছেন কবিতার স্বরূপ। তাঁর অনুসন্ধানের অঞ্চলে ঢুকে গেছে কবিতা-সম্পর্কিত সমস্ত প্রসঙ্গ সমস্ত প্রশ্ন – রবীন্দ্রনাথসহ বাংলা কবিতার বিপুল অঞ্চল, গ্যেঁটে, জার্মান-কবিতাসহ বিশ্বকবিতা। যেন একটা কেন্দ্রীয় আত্মজিজ্ঞাসাই সম্প্রসারিত হয়ে আকার নিয়েছে তাঁর রচিত বিপুলসংখ্যক প্রবন্ধে। শুনেছি চার শতাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি, যার কোনো তুলনা পাওয়া যাবে না হয়তো। তাঁর অবলোকনের কিছু বিদ্যুৎ আমরা পাঠকের সামনে রাখতে পারি। তাঁর প্রথম জীবনে প্রকাশিত স্থির বিষয়ের দিকে বই থেকে কথা শুরু করা যায়। ‘আধুনিকতা’র প্রশ্নটি নিয়ে একসময় রবীন্দ্রোত্তর (আহা, রবীন্দ্রনাথ আত্মবিদ্রূপে বলতেন : রবীন্দ্রধুত্তোর!) বাঙালি কবিরা খুবই চিন্তিত ছিলেন অনিবার্য কারণেই। অলোকরঞ্জন বলেছেন, ‘প্রাচীন কাব্যের মূলসূত্র রচয়িতার আত্মবিলুপ্তি এবং পরবর্তী কবিতার উপপাদ্য অভিমানী অহং।’ কথাটা এলিয়টের কাছ থেকে বিষ্ণু দে-র মাধ্যমে আমাদের কাছে এসেছিল উলটো পথে। আধুনিক কবিদের অন্যতম গুরু এলিয়ট সাহেব বিষয়সমাধির ধ্রুপদীআনার পক্ষে কথা বলেছিলেন, অর্থাৎ অহংকে বিসর্জন দেওয়ার কথা বলেছিলেন। আসলে আমরা দুরকমই দেখেছি – অভিমানী অহংয়ের পতাকা-উত্তোলন এবং অহং-বিসর্জন। অর্থাৎ এই সূত্র থেকে বাস্তবিকই কিছু ব্যাখ্যা করা যায় কিনা তা আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। অন্য একটি প্রবন্ধে অলোকরঞ্জন একটি কথা বলছেন যা নিয়েও আমাদের আলোড়িত থাকতে হবে, ‘ভাষা এবং শব্দ এক নয়। ভাষার মধ্যে ধ্বনি আছে অনেকখানি জায়গা জুড়ে। তা না হলে অর্থহীন বৈদিক স্তোভধ্বনি ওই মর্যাদা পেত না। ব্রজবুলির মতো আবেগনিয়ন্ত্রিত ব্যাকরণবিস্মৃত ভাষা পেতাম না আমরা। আধুনিক কবিতার শব্দই সমগ্র ভাষাকে কোনার্ককিন্নরীর চিবুকে ক্ষোদিত করে তুলে ধরেছে। অনন্ত শূন্যের দিকে মালার্মে শাদা কাগজ মেলে রেখেছিলেন, ভাষার ভাষা পরম শব্দকে অভ্যর্থনা করে নেবেন বলে।’ ভাষা এবং শব্দের এই দ্বিত্বের কথা ভেবে দেখবার সুযোগ এলো। এ ভাব ও ভাষার দ্বিত্ব নয়। বিশেষভাবে লক্ষ করার ‘ভাষার ভাষা পরম শব্দ’ বাক্যবন্ধটি।

সাধারণভাবে কবি ও কবিতার অবস্থান বিষয়ে অলোকরঞ্জনের বহু মূল্যবান কথা ছড়িয়ে রয়েছে, যা আমরা অনেকেই আলস্যবশত খেয়াল করিনি তেমনভাবে। ‘কবিতার মুখচ্ছদ’ নামের নিবন্ধে তিনি লিখছেন, ‘আধুনিক কবি যে মুখচ্ছদ ব্যবহার করেন তার পিছনে বর্ণাঢ্য ও জটিল অতীত রয়েছে। প্রাক-প্রস্তর গুহামানব একদিন মুখোশ পরে প্রতিদ্বন্দ্বী জন্তুকে ভয় দেখিয়েছিল।… কমলে-কঠিনে মেলানো বিচিত্র এই ভয় দেখানোর পদ্ধতি বিচিত্রতর হলো পৃথিবীতে যখন কৃষিযুগ এল, পশুপালনের ছন্দ মানুষের করায়ত্ত হলো। কিন্তু তখনো অবিজিত নিয়তির সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া বাকি।… অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেদিন সরল কৃষক-অভিনেতা ব্যবহার করেছিল মৃত পুরুষের প্রেতাত্মার প্রতিকৃতি অথবা জন্তুর মুখোশ।’ আজকের আধুনিক কবি ও সভ্যতার সূচনার যুগের কৃষকের বাঁচার বা সৃষ্টির যে সাযুজ্য, তাকে লক্ষ করতে হবে আমাদের। অলোকরঞ্জন জানাচ্ছেন, ‘আধুনিক কবি বিজয়ী ও বিজিত, দুটি ভূমিকাই গ্রহণ করেছেন।’ অনতিক্রম্য এই কথন। আধুনিকতার প্রসঙ্গ আরো একটু টেনে এনে অলোকরঞ্জন বলেছেন, ‘আজ আমরা ভাবের আধুনিকতায় বীতস্পৃহ। পক্ষান্তরে রূপের আধুনিকতাই এই মুহূর্তে উপাস্য।’ পাঠকের মনে পড়বে প্রবীণ রবীন্দ্রনাথ এইরকম একটা কথা বলেছিলেন তাঁর নিজের গান সম্বন্ধে : এখনকার গান ভাব বাৎলাকর নয়, রূপ সৃষ্টির। কীভাবে রূপ ও ভাবকে আলাদা আলাদা আসন পেতে দিতে হবে সে-বিষয়ে শিল্প-ভাবুকদের মাথা ঘামানো শেষ হবে না বুঝতে পারি। ভাবতে ভালো লাগছে যে, যিনি আধুনিকতা নিয়ে বিস্তর মাথা ঘামিয়েছেন তিনিই একটি প্রস্তাবে বলেছেন, ‘আধুনিক কবিতার ‘আধুনিক’ লেবেলটি খারিজ করে দিলে কিছু উত্তেজনা শান্ত হতে পারে। অতঃপর আধুনিক কবিতা বলতে সেই শিল্পঘটনা বুঝবো যা ইতিমধ্যেই চিরায়ত কবিতার অন্তর্গত হয়ে গিয়েছে।’ কিন্তু ‘আধুনিক’ কবিতাকে বিদায় জানাবার জন্য যে ‘উত্তরাধুনিকতা এসে’ টাস্ টাস্ প্রজ্ঞা বলছে তার কী হবে, এই প্রশ্নটি অলোকরঞ্জনের কাছে রাখা থাক। তবে, বলতেই হবে, অলোকরঞ্জন নিজে ‘আধুনিক’ শব্দটি কবিতার বিশেষণ হিসেবে ভুলতে পারেননি। শিল্পকে চেনার একটা উপায়, যেমন অলোকরঞ্জন বহু পূর্বসূরির কথার সূত্র ধরে জানিয়েছেন, কারুকৃতিকে বোঝা ও তাকে তার প্রাপ্য মূল্য দেওয়া। তিনি বলেছেন, ‘কারুকৃতিকেই আমরা ধ্রুপদী বলি।’ এই অবস্থানেই যেন সুধীন্দ্রনাথের মাথা তুলে দাঁড়ানো! সেখানে ‘আলুথালু কাব্যময়তা নয়, বাঙ্ময় বিদগ্ধ মুখমন্ডল উদ্ভাসিত।’ অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার আলোচনাসূত্রে তিনি জানিয়েছেন, ‘আমাদের বহির্দেহলিতে আপাততুচ্ছ যা-কিছু ঘটছে সেই অনুপুঙ্খের লহরীকে কবিতায় ভরে তুলতে পারলে শিল্পীর মুক্তি।’ তিনি জানান, ‘কবিতাকে স্বপ্নসুদূর ময়ূর সিংহাসনে আরূঢ় রাখবার পক্ষপাতী আমি অবশ্যই নই।… কবিতা প্রিয়জনের জন্য নৈবেদ্য – কোনো কালেই জনপ্রিয় ছিল না অন্তত যথার্থ কবিতা।’ বিষ্ণু দে-র একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যও লিখে রাখার মতো, ‘নাম রেখেছি কোমলগান্ধার, যার অন্তর্গত স্তর ক্লান্তি নেই, পুনর্জন্মের মতো তাৎপর্যময় কবিতাসংগ্রহ।’ এই আশ্চর্য কথাটার যদি অর্থ করতেই হয় তাহলে তা হয়তো এই যে, বইটি বাংলা কবিতার পাঠকের জন্য সমস্ত অতীত নিয়ে জেগে উঠেছে।

 সাত

অলোকরঞ্জন তাঁর ত্রিগীত-পর্ব পার হয়ে এসে –  যৌবনবাউল-নিষিদ্ধ কোজাগরী রক্তাক্ত ঝরোখা পার হয়ে এসে – বলাকার  গতিতে পৌঁছে বিশ্ববাসী হলেন। সারা পৃথিবীর শরণার্থীদের সঙ্গে মিশে গেলেন তিনি আর যে-কোনো শরণার্থীর মতো প্রতিবাদই যেন হয়ে উঠল তাঁর ধর্ম। কবির কোনো বিশুদ্ধ অবস্থানে বা তথাকথিত বিশুদ্ধ কবিতার অবস্থানে তিনি আটকে রইলেন না, যে-অবস্থানের একমাত্র লক্ষ্য হয়তো কাব্যসৌন্দর্য। তিনি জানালেন, ‘এখন শিকড়িত মানুষ যত তার চেয়েও শরণার্থী মানুষ সারা পৃথিবীতে অনেক বেশি।’ এই সূত্রে আরো জানালেন, ‘আজ বিহারে যে মিশনারি নানদের বর্বরভাবে হত্যা করা হচ্ছে, সে-ঘটনাতে মুখ ফিরিয়ে যদি কোনো কবি কলেজ স্ট্রিটের প্রেসে লিরিক কবিতাগুলো ছাপতে চলে যান, তাহলে আমার মনে হয় লেখালিখি বন্ধ করে দেওয়াই ভালো। প্রতিবেশকে জানতে চান না এমন কবির কাছে আমি আজ যাব না।’ ২০০৩ সালে এই কথা বলার ১৭ বছর আগে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কবিতাকে দেখি দূরান্বয়ের শিল্প হিসেবে।… এক স্থানের সঙ্গে আরেক কালের একটা মায়াবী দূরত্ব কবিতায় তৈরি হয়। আমি এভাবে কবিতাকে দেখি যে, কবিতা কোনো অতীন্দ্রিয় কিছু নয় – কবিতায় সমস্তরকম সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক, দার্শনিক বর্গগুলিকে নিয়ে কবির ছিনিমিনি খেলার অধিকার আছে।’ বস্ত্তত শিকড়িত অলোকরঞ্জন আর শরণার্থী অলোকরঞ্জন উভয়েই চেতনার আধারে পাওয়া বর্গগুলি নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন – শুধু শিকড়চেতনা এবং শরণার্থীচেতনা দুটি ভিন্ন পর্বে সঞ্চালনশক্তির জায়গা নিয়েছে। অলোকরঞ্জনকে স্থাপন করার মতো সমতল খুঁজে পাওয়া বেশ অসুবিধা হয়ে পড়ে, এই বক্তব্যে নিশ্চল এক স্বপ্রতিষ্ঠ কবি ও কাব্যজিজ্ঞাসুকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম যে, ভিন্ন ভিন্ন সমতলে রেখে বুঝতে হবে তাঁকে – অভিমানী ও নৈর্ব্যক্তিক, আত্মমুগ্ধ ও নৈতিক বিহবলতায় কাতর, মহাস্থবির জাতক ও উত্তরীয়হীন যাযাবরের ভিন্ন ভিন্ন সমতলে। এমনকি যাঁকে সব থেকে বেশি রাবীন্দ্রিক ঘরানায় লালিত কবি বলে মনে হয়েছে তিনি কী অনায়াসে বলে দিতে পারেন, ‘রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা আমার অসহ্য লাগে। রবীন্দ্রনাথের কিছু গানও আমার একেবারেই ভালো লাগে না।’ এসব কথা তিনি সবই বলেছিলেন অবশ্য প্রশ্নের উত্তরে। আমি প্রশ্নকর্তা হলে ‘একেবারেই ভালো-না-লাগা’ গানের তালিকা জানতে চাইতাম, কেননা, তন্নতন্ন করে খুঁজেও আমার নিজের এই তালিকায় তিন-চারটির বেশি গান রাখতে পারিনি। বস্ত্তত বিপুল গুণগ্রাহিতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সত্য বলতে গিয়ে তাঁর সংকোচ হয় না বিশেষ। তিনি যেমন মানুষের সংসারের কোলাহলের কেন্দ্রে বসবাস করে প্রতিবাদের কবিতা লেখেন তেমন জানান, ‘কবির অজ্ঞাতবাস কবিতালেখার শর্ত।’ এ-প্রসঙ্গে তাঁর আরো একটা কথা শুনে নেওয়া যাক, ‘কবি যখন লিখবেন, তখন তাঁর মুখটা নামানো থাকবে বুকের কাছে, ওখানে যেন একটা পেসমেকার আছে। জীবন ও মৃত্যুর খুব মাঝখান থেকে তিনি লিখবেন, ঝুঁকে পড়ে। এবং তিনি লিখবেন মানুষেরই জন্য। নইলে তিনি কবিতা লিখতেন না। কবিতা আজ সুবোধ্য হতে পারে না।’

এসব কথা নিয়ে তর্ক উঠতে পারে, তবু বিরোধাভাসে ভরা এসব কথার কিনারে শেষ পর্যন্ত নির্বাক দাঁড়াতে হয় আমাদের। শেষ পর্যন্ত তাঁর কথার মর্মভেদী আলো গ্রহণ করতে হয়। এরকমই বিরোধাভাসে উজ্জ্বল একটি কথা, ‘ছন্দ একেবারেই জানেন না এমন কাউকে কবি বলে মেনে নিতে আমার একটু অসুবিধে আছে, যদি না তাঁর লেখায় বাকছন্দ থাকে। আর যে-কবিতায় ছন্দটাকে আলাদা করে দেখা যাচ্ছে, সেই কবিতাকে আমরা আর গ্রহণ করি না আজকাল।’ এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ে একটি সাক্ষাৎকারে অলোকরঞ্জন বলেছিলেন, ‘দুই নৌকোয় পা দিয়ে চলার যে বিপজ্জনক ভারসাম্য, এটা আমার একটা প্রিয় মনস্তত্ত্ব।’ তিনি জানেন, ‘পরিপ্রশ্ন ছাড়া প্রণতির কোনো অর্থ নেই।’, এই জেনে তিনি পূর্বসূরিদের প্রতি পরিপ্রশ্নের পাশাপাশি প্রণতি স্থাপন করেছেন। তিনি তাঁর সমকালীন কবিদের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করতে গিয়ে কোনোরকম শীর্ণতার পরিচয় দেননি। আর তা করতে গিয়ে তাঁকে বিশেষ দ্বিধান্বিতও হতে হয়নি যেহেতু তাঁর সমকালে বাস্তবিকই অসাধারণ কয়েকজন কবিকে পেয়েছি আমরা যাঁদের প্রতি মুগ্ধতাই স্বাভাবিক। তিনি কবিতার একটা সুসময়ের কথা বলেছেন যখন বিষ্ণু দে-র হেঁটে যামিনী রায়ের বাড়িতে যেতে দেখে মনে হতো ‘রাজার রাজা যাচ্ছেন মহর্ষির কাছে।’

যে-প্রশ্নটি আমাদের মনে ফিরে আসে তা এই, অলোকরঞ্জনের ঈশ্বরবিশ্বাস কোথায় গিয়ে দাঁড়াল! রবীন্দ্রনাথও, আমরা জানি, ‘মানবিক ভূমা’র কথা বলেছিলেন শেষপর্যন্ত। ‘পূজা’ পর্যায়ের কোনো গান আর লেখেননি শেষ কয়েক বছর।

একসময় বৌদ্ধধর্মকে অলোকরঞ্জনের কবিতার সব থেকে উপযোগী ধর্ম মনে হয়েছে। তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের কথাও ভেবেছেন। ‘নির্বাণের মতো কবিতার ধারণা পৃথিবীতে আর নেই’, এই কথা মনে হয়েছে তাঁর। আমাদের মনে রাখতে হবে, নির্বাণের মধ্যে ঈশ্বরের কোনো স্থান নেই; এ হলো শূন্যতার সাধনা, আত্মদীপ হয়ে অনন্তের সঙ্গে মিলিত হবার সাধনা। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, ‘ঈশ্বর আমাদের জীবনে একটা জরুরি সংযোজন।’ বলেছেন, ‘আমার ঈশ্বরবিশ্বাস একটা কনসট্রাক্ট, তারপর আমার নিজস্ব কনসট্রাক্ট আমি করতে চেয়েছি।’ ২০০৬ সালে গৃহীত ওই সাক্ষাৎকারেই বলেছেন, ‘পরে একসময় মনে হলো ঈশ্বর নেই, একটা স্বপ্ন আছে।’ ঈশ্বরবিশ্বাস অলোকরঞ্জনকে ছেড়ে গেছে কিনা সে-বিষয়ে আমাদের জোর দিয়ে কিছু বলার নেই, শুধু বলতে পারি, একজন মুক্ত মনের অধিকার নিয়ে তিনি বিশ্বভ্রমণ করে চলেছেন যেখানে ঈশ্বরবিশ্বাস একটা কনসট্রাক্ট – একটা নির্মাণ বা একটা বিনির্মিত স্বপ্ন মাত্র!

আমাদের শেষ প্রশ্নটি, কীভাবে কবিতাকে শেষ পর্যন্ত সংজ্ঞায়িত করেছেন তিনি। এ-বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করতে গেলে ভুল হবে। আমি প্রচুর কবিতা পড়ি, পড়ে বুঝতে পারি, এটা কবিতা, এটা কবিতা নয়। এখানে আমার আডোর্নোর কথা মনে পড়ছে, যিনি বলেছিলেন, এমন একটা মুহূর্ত থাকবে যেটা নেই। এটা হয়তো কবিতার একটা চমৎকার সংজ্ঞা হতে পারে।’ মনে পড়বে থাকার মধ্যে না-থাকার একটা কথা তাঁর সহযাত্রী কবি আলোক সরকারও বহুবার বলেছেন সাম্প্রতিককালে।

বহুকথিত বিশুদ্ধ কবিতার ধারণার বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছেন তিনি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কবিতার যে-সংজ্ঞাটি উপস্থাপিত করলেন তাকেই আমরা বিশুদ্ধ কবিতার সংজ্ঞা বলে ভাবতে চাই। এই সংজ্ঞায় প্রেম প্রতিবাদ প্রণাম সবই স্থান পেতে পারে। এই সঙ্গে বলা যায় যে, সুধীন্দ্রনাথ বিষ্ণু দে-র ধারায় তিনি যে অসামান্য গদ্য রচনা করে রেখেছেন আমাদের জন্য তাঁর অন্তর্গত প্রতিটি প্রস্তাব মনোযোগ দাবি করে। তাঁর রচিত অগণিত শব্দবন্ধ নিরন্তর চমৎকৃত করেছে আমাদের।

 আট

ভাবতে অবাক লাগে যে, আজো, আশি বছরের পূর্তি-মুহূর্তেও, তাঁর মধ্যে খুব বেশি নিরাশাকরোজ্জ্বলতা খুঁজে পাই না আমরা, আজো তিনি ক্লান্তিহীনভাবে কর্মময়, সতর্ক সমস্তরকম ক্ষয়ক্ষতি বহন করার পরেও সহাস্য, কৌতুকপ্রবণ, অভিমানী, কথা-বলার আনন্দে বিহবল। আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছি আজো – লক্ষ করছি তাঁর স্থিরতা, তাঁর চঞ্চলতা, তাঁর জ্ঞান আর শব্দ-অর্থ-ধ্বনি-ছন্দ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা।

আমাদের এই অসহায় লিখন শেষ হোক তাঁর একটি উত্থানপর্বের কবিতাপাঠ দিয়ে, যে-পাঠের পর আজো নির্বাক হয়ে যেতে হয় :

 

নির্বাসন

আমি যত গ্রাম দেখি

মনে হয়

মায়ের শৈশব।

আমি যত গ্রামে যত মুক্তক পাহাড়শ্রেণী দেখি

মনে হয়

প্রিয়ার শৈশব।

পাহাড়ের হৃদয়ে যতো নীলচে হলুদ ঝর্ণা দেখি

মনে হয়

দেশগাঁয়ে ছিল কিন্তু ছেড়ে আসা প্রতিটি মানুষ।

ঝর্ণার পাশেই নদী, নদীর শিয়রে

বাঁশের সাঁকোর অভিমান

যেই দেখি, মনে হয়

নোয়াখালী, শীর্ণ সেতু, আর সে-নাছোড় ভগবান\

 নয়

আজ দূর থেকে বিপুল বিস্ময় নিয়ে দেখি, নিজের তৈরি গহবরের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। এ হলো একজন অন্তিম কবির যাত্রাপথ।