কবিতা ও প্রতিবাদের ভাষা

মনজুরুল হক

সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই যুদ্ধ মানুষের চিরসঙ্গী। ধর্মযুদ্ধ, গোলাপের যুদ্ধ, মসলার যুদ্ধ, শতবর্ষের যুদ্ধ, পরিত্রাণের যুদ্ধ, সভ্যতার সংঘাত – এমন কত নামেই না আমরা যুদ্ধ করে চলেছি সভ্যতার সেই সূচনাকাল থেকে। প্রতিটি যুদ্ধে অগণিত প্রাণহানি আর সম্পদের ঢালাও অপচয় আমাদের বিবেককে সাময়িকভাবে নাড়া দিয়ে গেলেও অল্পতেই আমরা আবারও ভুলে যাই সেই শিক্ষা এবং নতুন করে লিপ্ত হই ধ্বংসের খেলায়। বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে তান্ডব-ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আসা দুটি বিশ্বযুদ্ধ থেকেও কোনো শিক্ষাই আমরা লাভ করিনি। এ-কারণেই সর্বগ্রাসী দুটি বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি মানুষের মন থেকে হারিয়ে না যেতেই আবারো শুরু হয়ে গিয়েছিল এমন এক যুদ্ধের প্রস্ত্ততি, যার বিধ্বংসী ক্ষমতা বিশ্বের অস্তিত্বকে এখন পর্যন্ত করে তুলছে সংকটাপন্ন।

অন্যদিকে আবার সংকটময় এই বিশ্বে সাজ সাজ রব তুলে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্ত্ততি থেকে বাদ থাকেনি বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রই। নাগরিকদের জন্য দুবেলা অন্নের সংস্থান করতে না পারা দেশও অভুক্ত থেকে হলেও গড়ে তুলছে অস্ত্রের ভান্ডার, তৈরি হচ্ছে না খেয়ে থাকতে হলেও অন্যকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার প্রস্ত্ততি গ্রহণে। পাকিস্তানের এক খলনায়ক তো একসময় দম্ভের সঙ্গেই বলেছিলেন, ঘাস খেয়ে দিনযাপন করতে হলেও আণবিক বোমার মালিক তার দেশকে অবশ্যই হতে হবে। বিংশ শতাব্দীর সবচাইতে বলদসুলভ উক্তি হিসেবে এটাকে নিঃসন্দেহে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। আণবিক বোমার মালিক সে-দেশ অবশ্যই হয়ে উঠেছে। তবে এতটাই চরম মূল্য দেশটিকে দিতে হয়েছে যে,  মানুষের ক্ষুধা-মুক্তি আর নিরাপদ দিনযাপন নিশ্চিত করতে এখন পর্যন্ত হিমশিম খেতে হচ্ছে দেশের একালের নেতাদের।

বিশ্বজুড়ে যুদ্ধপ্রস্ত্ততির এই সাজ সাজ রবের মুখে কিছুদিন আগে পর্যন্তও একমাত্র ব্যতিক্রমী রাষ্ট্র ছিল জাপান। জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সংবিধানে যুদ্ধ পরিহারের পরিষ্কার অঙ্গীকার যুক্ত থাকায় অনেকটা অন্তত মুখরক্ষার খাতিরে হলেও দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সরাসরি যুদ্ধপ্রস্ত্ততি এড়িয়ে চলতে হয়েছে। তবে এ-কথা তো আমাদের অজানা নয় যে, একটি দেশ কেবল তখনই সাজ সাজ রব তুলে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নিতে শুরু করে, যখন দেশটির অর্থনীতিকে কঠিন অবস্থার মুখে এসে দাঁড়াতে হয়। গত শতাব্দীর দুটি বিশ্বযুদ্ধের সূচনা তো সেরকম অর্থনৈতিক সংকট থেকেই। এর আগের আর পরের সবরকম যুদ্ধের হিসাব-নিকাশের পেছনেও আছে অন্যের সম্পদে ভাগ বসানোর মধ্য দিয়ে নিজের পকেট ভারী করে নেওয়ার বাসনা। অল্প কিছুদিন আগের যে-ইরাকযুদ্ধ এখন পর্যন্ত পুরো অঞ্চলকে প্রায় পঙ্গু করে রাখছে, তার পেছনেও তো আছে অর্থনীতির লাভ-ক্ষতির সুনির্দিষ্ট হিসাব-নিকাশ।

জাপানের অর্থনীতির স্বাস্থ্য প্রায় দুই যুগ ধরে খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। নববইয়ের দশকের শুরুর দিকে অর্থনীতির কৃত্রিম বুদ্বুদ ফেটে পড়ার পর থেকে শুরু হওয়া পতনশীল ধারা ধীরে দেশটিকে নামিয়ে এনেছে আকাশচুম্বী অবস্থান থেকে মাটির কাছাকাছি। ফলে অর্থনীতির পতনমুখী ধারার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যাবলি – যেমন বেকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, বড় শহরগুলোতে গৃহহীন মানুষের বাক্স-বাড়ি সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়ে-ওঠা, বেতন কাঠামোয় স্থিতাবস্থা দেখা দেওয়া, খন্ডকালীন সময়ের কর্মীদের ওপর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক নির্ভরশীলতা এবং সামাজিক অবক্ষয়ের নানারকম দিক ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে-ওঠা – এর সবই এখন জাপানের সমাজে সহজেই চোখে পড়ছে। বিগত কয়েকটি সরকারের নেওয়া নানারকম পদক্ষেপও পারেনি দেশকে সেই সংকটের চক্র থেকে বের করে আনতে।

জাপানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বছরদুয়েক আগে ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলার যে প্রতিশ্রুতির কথা নাগরিকদের শুনিয়েছিলেন, তার বাস্তব কোনোরকম প্রতিফলন দৈনন্দিন জীবনে এখনো দেখা যাচ্ছে না। ফলে প্রধানমন্ত্রী নিজেই এখন বরং দৃষ্টি একটু অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বায়বীয় শত্রুর আগমনের সম্ভাবনার বিষয়টি জনগণের সামনে তুলে ধরে অদৃশ্য সেই শত্রুর সম্ভাব্য হামলার মুখে নাগরিক জীবন রক্ষার তথাকথিত  দেশপ্রেমী দায়িত্ব পালনে অনেক বেশি করে নিয়োজিত হচ্ছেন। এর ফলে আমরা এখন দেখছি যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়বরণ করে নেওয়ার প্রায় সাত দশক পর আবারো যুদ্ধসাজে সজ্জিত হচ্ছে জাপান।

 

দুই

জাপানের ক্ষমতাসীন জোট এবং প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে দেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার যে-উদ্যোগ সংবিধানের ব্যাখ্যা বদলের সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে নিয়েছেন, জাপানে অনেকেই সেটাকে             যুদ্ধ-প্রস্ত্ততির পাঁয়তারা হিসেবে গণ্য করছেন এবং সরকারের সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানাতে রাজপথে নেমে এসেছেন। সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষমতাসীন জোটের মধ্যে আলোচনা আর দেন-দরবার চলতে থাকার শেষ দিনগুলোতে, অর্থাৎ জুনের শেষ সপ্তাহের পুরো সময় জুড়ে, প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের সামনের সড়ক হয়ে উঠেছিল যেন প্রতিবাদ-সমাবেশের তীর্থভূমি। হাজারো জনতা সেখানে জড়ো হয়ে কেন তারা সরকারি উদ্যোগের বিরোধিতা করছেন, সে-বার্তা দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। জনতার সেই কাতারে অতীতে একসময় যুদ্ধের ভয়াবহতার অভিজ্ঞতা হওয়া বৃদ্ধদের পাশাপাশি তরুণদের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া দেশের অন্যান্য অনেক শহরেও সেই দিনগুলোতে দিনভর চলছিল  বিক্ষোভ-সমাবেশ।

তবে দলবেঁধে পথে নেমে আসা এরকম প্রতিবাদকারীদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী মানুষটি ছিলেন স্যুট-কোট গায়ে চাপিয়ে একা জনতার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে যাওয়া মধ্যবয়সী এক পুরুষ, জাপানের রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা শিনজুকু স্টেশনের বাইরের পথচারী পারাপারের সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে নিজের দেহে পেট্রোল ঢেলে আত্মাহুতির চেষ্টা যিনি চালিয়েছিলেন। পুলিশ অবশ্য অগ্নিদগ্ধ সেই ব্যক্তিকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং এরপর থেকে তাঁকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কিছুদিন ধরে চলতে থাকে নানারকম কানাঘুষা আর ফিসফাস।

সংবিধানের ব্যাখ্যা-বদলের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের সমর্থক হিসেবে পরিচিত সংবাদপত্র ও রেডিও-টেলিভিশন সেই ব্যক্তির পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে তাঁকে আখ্যায়িত করেছে এমন একজন বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ হিসেবে, জনজীবন বিঘ্নিত করে নিজের দিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট করতেই নিজ দেহে যিনি আগুন লাগিয়েছিলেন। তবে হিসাবটি যে ঠিক ততটা সাদা-কালো নয়, দেহে অগ্নিসংযোগের আগে রাখা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ও একটি কবিতার অংশবিশেষ আবৃত্তি করার মধ্য দিয়ে পরিষ্কারভাবে সেদিন তিনি তা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন।

খুবই সংক্ষিপ্ত এক ভাষণে তিনি সেদিন যা বলতে চেয়েছিলেন তা হলো, জাপানের সংবিধানের নবম ধারার কল্যাণেই দেশের নাগরিকরা গত প্রায় সত্তর বছর ধরে বিরতিহীনভাবে শান্তির সুফল ভোগ করে আসছেন, যা হচ্ছে সাম্প্রতিক ইতিহাসের বিরল এক ঘটনা। ফলে যুদ্ধ আর সংঘাত এড়িয়ে যেতে হলে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটাও তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তাঁর সেই বক্তব্যে।

প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে সংবিধানের সেই মৌলিক চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে জাপানকে আবারো যুদ্ধের পথে নিয়ে যাচ্ছেন উল্লেখ করে নিজের গায়ে আগুন লাগানোর আগে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের খুবই পরিচিত ও জনপ্রিয় জাপানি কবি আকিকো ইওসানোর একটি কবিতার কয়েকটি ছত্র তিনি সমবেত জনতার সামনে পড়ে শোনান। এরপরই নিজের গায়ে আগুন লাগালে পুলিশ ও দমকল বাহিনীর একটি দল সেখানে উপস্থিত হয়ে অগ্নিদগ্ধ সেই ব্যক্তিকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়।

 

তিন

জাপানের সেই বিদগ্ধ মহিলা কবি আকিকো ইওসানো ‘নিজের জীবন তুমি দিও না বিসর্জন’ – এই শিরোনামের সেই কবিতাটি লিখেছিলেন ১৯০৪ সালে রুশ-জাপান যুদ্ধ শুরু হওয়ার অল্প কিছুদিন আগে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে কবির আর্তি সেখানে ফুটে উঠলেও উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার সর্বগ্রাসী প্রভাবে যুদ্ধের জয়গান প্রতিধ্বনিত হতে থাকা সেই সময়ে যুদ্ধবিরোধী বার্তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে গণ্য করা হতে পারে, সে-আশঙ্কায় আকিকো ইওসানো পরে এর ব্যাখ্যা করেছিলেন আপনজনকে হারানোর আশঙ্কা থেকে  দেখা দেওয়া নিজের একান্ত ব্যক্তিগত উদ্বেগের প্রতিফলন ফুটে ওঠা কবিতা হিসেবে।

রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপানের জয়কে দেশের অনেকেই সে-সময়  দেখেছিলেন এমন চমকপ্রদ এক সাফল্য হিসেবে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জাপানের জন্য যা সম্মান আর সম্ভ্রম নিয়ে এসেছিল। ফলে অসংখ্য যে-প্রাণহানির মধ্যে দিয়ে সেদিনের সেই বিজয় সম্ভব হয়েছিল, যুদ্ধের বেদনাদায়ক সে-দিকটি সাফল্যের ডামাডোলে ঢাকা পড়ে যায় এবং অনেকটা যেন ‘দেশপ্রেমিক যুদ্ধ’ হিসেবে দেখা সেই যুদ্ধের সমালোচনা করার কারণে আকিকো ইওসানো সাময়িকভাবে হয়ে পড়েন কিছুটা একঘরে।

তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের শোচনীয় পরাজয় কবির সেই প্রায় ভুলিয়ে দেওয়া কবিতাকে আবারো বসিয়ে দিয়েছে জাপানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধবিরোধী কাব্যের আসনে, কবিতার  যেরকম ব্যাখ্যা আজো অপরিবর্তিত থেকে গেছে। ফলে দেশকে আবারো সমরসজ্জায় প্রস্ত্তত করার উদ্দেশ্য নিয়ে সংবিধানের নতুন যে-ব্যাখ্যা প্রদানের প্রস্ত্ততি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে নিচ্ছেন, সেটার প্রতিবাদ জানাতে সেদিনের নিঃসঙ্গ বিক্ষোভকারী আকিকো ইওসানোর কবিতাকেই সবচেয়ে জুতসই মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।

আকিকো ইওসানোর কবিতায় সেনাদলে যোগ দিয়ে ছোট ভাইয়ের যুদ্ধ-যাত্রা করা নিয়ে মনের গভীরে দেখা দেওয়া আশঙ্কা আর আকুলতার প্রতিফলন ফুটে উঠলেও যুদ্ধের সর্বগ্রাসী ভয়াবহতা সম্পর্কে সাবধানবাণীও উচ্চারিত হয়েছিল। আর সেখানেই আছে কবিতার মধ্যে দিয়ে কবির ছড়িয়ে দেওয়া শান্তির বাণী, যা যুদ্ধের উন্মাদনায় বিভোর জাতিকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিল, কেন যুদ্ধে       জয়-পরাজয় আদৌ কোনো নির্ধারক মানদন্ড নয়, যার মধ্যে দিয়ে সাফল্য-ব্যর্থতার ছবি পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠতে পারে। বরং কবির চোখে যুদ্ধের দিকে আলোকপাত করে ধ্বংস আর প্রাণহানিকে আকিকো ইওসানো দেখেছিলেন অর্থহীন এমন এক বালখিল্য হিসেবে, যেখানে লাভের ঘর সবসময়ই থেকে যায় শূন্য।

আকিকো ইওসানোর জন্ম ১৮৭৯ সালে পশ্চিম জাপানের ওসাকার পার্শ্ববর্তী সাকাই শহরে। বণিক পরিবারে জন্ম হলেও হাইস্কুলের ছাত্রী থাকা অবস্থায় কাব্যের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন এবং সে-সময়ের উল্লেখযোগ্য বেশকিছু সাহিত্যসাময়িকীতে নিজের কবিতা তিনি প্রকাশ করতে শুরু করেন। একজন নারীর চোখে দেখা বাস্তব জীবনের প্রতিফলন এবং প্রেম আর কামনার খোলামেলা আবেদন ফুটে ওঠা তাঁর কাব্য অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে জাপানের অগ্রবর্তী মহিলা কবি হিসেবে তিনি লাভ করেন স্বীকৃত আসন। কাব্যে ফুটে ওঠা প্রেমের বন্দনার মতোই আকিকো ইওসানোর ব্যক্তিগত জীবনও ছিল প্রেম আর সম্ভোগের মিশ্রণে পরিপূর্ণ এক জীবন।

নারী হিসেবে জন্ম হয়েছিল বলে জাপানি সমাজে নারীর সনাতনী ধারণার মধ্যে নিজেকে তিনি সীমিত রাখেননি, বরং হয়ে উঠেছিলেন ১৯২০-এর দশকে প্রথা ভেঙে বের হয়ে আসা জাপানি নারীদের অগ্রবর্তী ব্যক্তিত্ব হিসেবে। ১৯২০ আর ১৯৩০-এর দশকে জাপানের নারী অধিকার আন্দোলন বিকশিত হওয়ার মুখে তিনি ছিলেন সেই আন্দোলনের সবচেয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। একই সঙ্গে সেই সময়ের বিভিন্ন রচনায় সমরবাদের পথে জাপানের ক্রমশ অগ্রসর হওয়া নিয়ে গভীর উদ্বেগ তিনি প্রকাশ করেন। ফলে সমরবাদ জাপানে শেকড়  গেড়ে বসে যেতে শুরু করার মুখে প্রশাসনের চোখে তিনি ক্রমশই হয়ে উঠেছিলেন অন্য দলের মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার মুখে ১৯৪২ সালে ৬৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন জাপানের এই অগ্রবর্তী চেতনার নারীকবি।

আকিকো ইওসানোর যে-কবিতার কয়েকটি লাইন শিনজুকুতে  আত্মাহুতির প্রস্ত্ততি নেওয়া জাপানি পুরুষ সেদিন আবৃত্তি করেছিলেন, সেই কবিতাটিও সেইসঙ্গে তাঁর লেখা ক্ষুদ্র কয়েকটি কাব্যের অনুবাদ এখানে সংযোজন করা হলো কবির কাব্যধারা সম্পর্কে ধারণা পেতে পাঠকদের তা সাহায্য করবে সে-আশায়।

 

নিজের জীবন তুমি দিও না বিসর্জন

 

তোমার জন্য কাঁদছি আমি, ছোট ভাইটি আমার

বুঝতে কি পারছো না, এই জীবন তুমি দিও না বিসর্জন,

সেই তুমি, সবার পরে জন্ম যার

বাবা-মা’র বিশেষ ভালোবাসা যে তোমাকেই ঘিরে

পিতার পক্ষে সম্ভব কি সন্তানের হাতে তলোয়ার তুলে দেয়া

শিখিয়ে দেয়া তাদের অন্যকে খুন করার মন্ত্র

বুঝিয়ে দেয়া কীভাবে করতে হয় খুন আর কীভাবে মৃত্যুকে করে

নিতে হয় বরণ?

এই শিক্ষার মধ্যে দিয়েই কি চবিবশ বছরে তোমার পদার্পণ?

 

ছোট ভাইটি আমার, মৃত্যুকে তুমি করো না বরণ।

এই কি সম্ভব, মহানুভব সম্রাট

যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রতিহত না করে বরং

রক্তস্রোত বইয়ে দিতে

এবং বন্য পশুর মতো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে মানুষকে

করেন উদ্বুদ্ধ,

করুণ সেই মৃত্যুকে গৌরব আখ্যায়িত করে?

ঐশ্বরিক করুণায় ভরা সম্রাটের যদি থাকে মহান এক হৃদয়

কোন সে চিন্তা যা এখন করছে সেখানে খেলা?

 

চেপে ধরো আমার এই স্তন,

ছিঁড়ে ফেল রহস্যের পর্দা,

একটি ফুল ফুটে আছে সেখানে,

রক্তিম আর সুগন্ধভরা।

 

নিজেকে আমি সঁপে দিতে পারি তার হাতে

তার স্বপ্নে

কানে কানে আবৃত্তি করে

তারই নিজের লেখা কবিতা, সে যখন ঘুমায় আমার পাশে।

 

চলার পথের কথা না তুলে,

কী আছে এরপর তা না ভেবে,

নাম কিংবা খ্যাতিকে প্রশ্ন না করে,

এখানে, প্রিয়তম আমার,

আমরা তাকিয়ে একজন আরেকজনের দিকে।

 

এই হেমন্তের হবে সমাপ্তি।

কিছুই চিরদিনের নয়।

ভাগ্য করে নিয়ন্ত্রণ জীবন আমাদের।

আমার এই স্তনে বুলিয়ে দাও

তোমার কঠিন হাত।

 

তুমি এসেছিলে সাগরজলের কাছ থেকে,

এক রাতের প্রেমের দেবতা আমার।

রেশমি সজ্জায়

যে-কাব্য তুমি করেছো রোপণ,

দয়া করে তা রেখে দিও গোপন।

 

চুপি চুপি গিয়েছি আমি

মন্দিরের ঘণ্টার কাছে

তার অভিসারে,

তবে কেটে গেলে কুয়াশা

নিজেকে খুঁজে পাই নিঃসঙ্গ আমি।

 

আমার ভেতরে

স্বচ্ছ এক ঝরনা

উপচে পড়ে আর হয়ে ওঠে কর্দমাক্ত।

পাপের সন্তান তুমি,

আমিও যে তাই।