কবির বিপন্নতা : অশ্রুময়ীর শব

সনৎকুমার সাহা

অশ্রুময়ীর শব
মোহাম্মদ রফিক

প্রথমা প্রকাশন
ঢাকা, ২০১১

১০০ টাকা

একটা সময় ছিল, যখন মনে করা হতো, কবিতা লিখতে পারা এক বিরল প্রতিভা। সবাই পারে না; কিন্তু আকর্ষণ করতে পারে সবাইকে। বাল্মীকির কবি হবার কাহিনি অনেকের জানা। ক্রৌঞ্চ-বধের শোক থেকে যে-বাক্যস্রোত তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, তা তাঁর মনে হয় শ্লোক। ছন্দোবদ্ধ ও চরণবদ্ধ পদ। অর্থ ও ব্যঞ্জনাময়। মোহিনী মায়া তাঁর। ভাবলোক তার অন্যতে ছড়ায়। সংবেদনা জাগায়। অনেকখানি জুড়ে থাকে পরিবেদনা। ক্রৌঞ্চ-বধে তার শুরু। সমাপ্তি নেই তার কোনো। কারণ, জীবন ওইরকমই। খেয়াল করার, বাল্মীকির ওই আদি পদযুগলে অন্ত্যমিল নেই। কিন্তু সুসম্বন্ধ ছন্দ আছে –
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকবধীঃ কামমোহিতম
দস্যু রত্নাকরের জীবনচর্চায় এমন ভাব জাগার কোনো কারণ ছিল না। নিজের অজান্তেই তাঁর ভেতরে তা একটু একটু করে জমাট বাঁধে। ক্রৌঞ্চ-বধ তার উৎসমুখ খুলে দেয়। কিন্তু ভাবও তো বায়ুভূত নয়। নিরবলম্বও থাকে না। তার একটা আধার চাই। কাহিনির আধার। কাহিনি ওই ভাবটাকে ধরে রাখে। হয়তো বিস্তারও দেয়। কিন্তু সবটা কবিতা হয় কদাচিৎ। আমরা যারা পড়ি, তারা এ নিয়ে নালিশ জানাই না। কাহিনির টান কবিতার অভাব ভুলিয়ে রাখে। এলিয়ট যাকে বলেছেন, অবজেকটিভ কো-রিলেটিভ, কাহিনি তার ভূমিকা নেয়।
মানুষ কিন্তু মজে। এই মানুষ একা-একা, ছাড়া-ছাড়া নয়। আপন জায়গা-জমি-প্রকৃতি-পরিবেশ নিয়ে একটা ভাষা যাদের এক সুতোয় বাঁধে, তাদের মনের তারে ওই কবিতা ঝংকার তুলতে চায়। পারলে মানুষ সাড়া দেয়। কবিতা বাঁচে। ততদিন, যতদিন ওই মানুষেরা তাকে নিয়ে বাঁচে। নয়তো তা হারিয়ে যায়।
শুধু মহাকাব্যে-কথাকাব্যে নয়, পরের যুগের কবিতাতেও এই ধারা সচল থাকে। হয়তো কাহিনির দাপট কমে আসে। কবির ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বর বস্ত্তর নির্বিকারত্বকে ছাপিয়ে যায়; কিন্তু ভাবকল্পনার সমগ্রতা উবে যায় না। তার একটা ছবি, হতে পারে, সমন্বিত ছবি, পাঠকের অনুকম্পা চায়। যদিও কবির নিজস্ব কল্পনা ও চিন্তা-প্রতিভার নির্যাস, তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে। দিকনির্দেশও করে। যেমন, ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথের ‘শা-জাহান’ কবিতা। ‘জীবনেরে কে রাখিতে পারে!/ আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে।’ বা ‘স্মৃতিভারে আমি পড়ে আছি ভারমুক্ত সে এখানে নাই।’ – এই রকম কটি অমর পঙ্ক্তিমালায় মূল কথাটি এখানে ধরা আছে। এগুলো কোনো বস্ত্তগত তথ্য নয়। কবিচেতনায় তথ্যের ভাবগত সত্য; কিন্তু শুধু ওই সত্য দিয়ে কবিতা পুরো হয় না। এক সর্বাঙ্গীণ কল্পপ্রতিমার আশ্রয় তাকে নিতে হয়।
তবে মুশকিল বাধে, যখন এটা রেওয়াজে দাঁড়িয়ে যায়। কবিতা তখন রসাত্মক বাক্যের ছন্দোবদ্ধ ধারাবাহিক নির্মাণে কোনো একটা ঘটনা বা ভাব ব্যবহার করে পূর্ণতা খোঁজে। ওই নির্মাণটাই প্রধান হয়ে ওঠে। তাতে অলংকারের আতিশয্যে চাপা পড়ে কবিতার প্রাণ সংজ্ঞা হারালে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
তারপরেও, বিশেষ করে অল্পবয়সে, কবি হওয়ার শখ অনেকের জাগে। ছন্দ-যতি-মিলের স্বভাবজাত অশিক্ষিতপটুতা নিয়েই তারা পদ্য লেখায় হাত পাকাতে চায়। কেউ মনে-মনে, কেউ বা খাতা-কলম নিয়ে; কবিতা কিন্তু বেশির ভাগ ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। শুধুই কারিগরি কুশলতায় কবিতা হয় না। যদিও তার প্রয়োজন উপেক্ষা করার নয়। চাই আরো চৈতন্যের গভীরে স্বপ্ন-কল্পনার ও শব্দ-মায়ার সম্মিলন। চাই ভাবনা-প্রতিমার জাগরণ। খুব কমই তাতে সিদ্ধি লাভ ঘটে। এই সিদ্ধিও অচঞ্চল নয়। মেধার রাজ্যে কখনো-সখনো সঠিক রসায়ন হয়, আবার হারিয়ে যায়। এসব এমনকি যখন ছকে ফেলে কবিতা লেখাই চল, অথবা, কাহিনির রসময় রূপই কেবল পেতে চাওয়া, তখনো।
জায়গাটা আরো কঠিন হয়ে যায়, যখন এগুলোও বাহুল্য হয়ে পড়ে। কোনো কাহিনির বা কোনো অনুভবের সরল বিস্তারে পাঠকের কাছে পরিপূর্ণভাবে বোধগম্য হওয়ার শর্ত মানতে কবিতা আর রাজি থাকে না। সে হতে চায় নিখাদ কবিতা, এবং, আর কিছু নয়। চিত্রকল্পনা ও প্রতীক তার অবলম্বন, প্রত্যক্ষের অন্তরালে যে প্রকৃত বাস্তব, সেখানে তার চোখ, তাকে ধরবার চেষ্টা পরোক্ষ বার্তায়, যেহেতু সরাসরি যা দেখি, তা খন্ডিত অথবা বিকৃত, ‘মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ’ই বলা যেতে পারে তাকে। কবিতার এই সত্য হয়ে ওঠা মানে মসৃণতার আপাত সুভগতাকে প্রত্যাখ্যান করা, বহুমাত্রিক বাস্তবতার বিহবলতাকে স্বীকার করা। হয়তো তা ছাড়া-ছাড়া, হয়তো বা বহুমূলীয়-বহুরূপী।
এতে ভাষার যে রাজসিক আয়োজন, তা কিন্তু আর থাকে না। ধ্বনির ইন্দ্রিয়ানুভূতিতে মনের আয়নায় ‘বিশ্বছবি’ অাঁকার প্রয়াস তার গরিমা হারায়। কারণ চৈতন্যের পটভূমিও ভোল পালটায়। আগে যে তাতে ছাপ ফেলতে উচ্চকণ্ঠ হতে হতো, পরম্পরা মেনে মোটা দাগে কথা সাজাতে হতো, ছবিকে সুসমঞ্জস ও সুবোধ্য করতে হতো, এখন এসব আসলে থাকলেও অপরিহার্য আর মনে হয় না। ইশারাই ভাষার কাজ সারে। ভাবনার যোগসূত্রগুলো একে অন্যে জড়াজড়ি করে, আবার দূরান্বয়ী বার্তায় পরস্পরের সংযোগ ঘটে। ঐতিহ্যে লালিত ধ্বনি-সুষমার ধারণা কখনো কখনো খেই হারিয়ে ফেলে। ইলেকট্রন ও প্রোটনের ছোটাছুটি আমাদের অবচেতনে ভাষাতেও তার প্রতিফলন ঘটিয়ে চলে। তাতেও আমরা সচেতন হয়ে উঠি। কবিতা যেহেতু অনুভূতির অন্দরমহলে এবং নাচমহলেও ঢুকে পড়তে চায়, তাই এসব বিষয়ে উদাসীন থাকা তার সাজে না। অনেক পুরনো সাজ-বাজ তার খসে পড়ে। শুধু আন্তঃরসত্তাটুকু নিয়ে ন্যূনতম শিল্পের সজ্জায় সে ফুটে উঠতে চায়।
কথাগুলো আবার মনে হলো মোহাম্মদ রফিকের অশ্রুময়ীর শব (২০১১) কবিতার বইটি হাতে পেয়ে পড়তে গিয়ে। মনে হওয়াটা যে এই প্রথম, তা অবশ্য নয়। লক্ষণগুলো এখন অনেকটাই ব্যাপক। গা-সওয়াই বলা যেতে পারে। রফিকের আগের কবিতাগুলোতেও এমন। তবে এখানে কবিতা সব মিলিয়ে বাঁক নিয়েছে যেন বিষণ্ণতার দিকে। কিছুদিন থেকেই এটা প্রধান হয়ে উঠছিল। তার রেশ কাটেনি। এটা আমাদের ভাবায়। শুধু কবিতার উপভোগে নয়, কবির চেতনাবিশ্ব নিয়েও।
এটা ঠিক, বিষাদ কবিতায় না থাকাটা তার অপূর্ণতা। একে এড়াতে পারি না কেউ জীবনে। না ব্যক্তি, না সমাজ। জন্ম আমাদের স্বেচ্ছায় নয়, মৃত্যুর অনিবার্যতাও প্রতিরোধ্য নয়। অসংখ্য চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলে না। তার ভেতরেই বসবাস। আরো আছে আকস্মিক বিপর্যয়। আছে আশাভঙ্গের হাহাকার। এসবের অভিঘাত রফিকের কবিতায় যে আগে পড়েনি, তা নয়। তবে তার সঙ্গে মিশে থেকেছে জিজীবিষা, থেকেছে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আরো কিছুর আকাঙ্ক্ষা – বেঁচে থাকার স্বাদ। এবং সে যে আছে – জীবনের নোনা জলে তুচ্ছাতিতুচ্ছ হলেও যে মাথা তোলে – এই তার অহংকার। এখন তাঁর কবিতায় এই বোধটা যেন পরাস্ত। বিমর্ষ অপরাহ্ণের বিবর্ণ ছায়া একটু একটু করে তাকে গ্রাস করছে যেন। তবে কোনো ওপরচালাকি নেই। অন্তরের গভীরতর তল থেকে উঠে আসা অনুভবের প্রতিধ্বনিই বাজে। এবং তা নিখাদ। কিন্তু কবিতার পরম গন্তব্যে কি তা পৌঁছোয়? ব্যক্তিগত হয়েও যে দৃষ্টি নৈর্ব্যক্তিক-নিরাসক্ত তার সমস্তটা কি ধরা পড়ে? যদি না পড়ে তবে সেই অনুপাতে কবিতা তার চূড়ান্ত সিদ্ধি থেকে দূরে থেকে যায়। অবশ্য উৎকৃষ্ট কবিতা যে হয় না, তা নয়। কারণ এতেও আছে মর্ত্য মানুষের সত্যিকারের বিপন্নতা। হলোই বা তা তার জীবন-অভিজ্ঞতার ভগ্নাংশ!
এখানে বেশিরভাগ কবিতায় টুকরো টুকরো ছবি প্রতীক হয়ে আসে। বাচ্যার্থ একটা আড়াল। অথবা শুধুই ইংগিত। ঘটনার নয়। অনুভবের। হয়তো অনুভবের পেছনে রয়েছে কোনো বিধ্বংসী কান্ডের বিপর্যয়। তা কেবল অনুমানের বিষয়। কবিতা তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দাঁড়াতে চায়। তাতে প্রতীক বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে। এবং একটি আরেকটিকে টানে। অথবা একাই একশ হয়ে থাকে। প্রতিটি কবিতা পূর্ণতা পায়। এতটুকু বেশি বা কম নয়। তাই বাচালতার ঠাঁই নেই কোথাও। চৈতন্যে অস্থিরতার ঝড় নির্মাণকলার কঠিন শৃঙ্খলে বাঁধা থাকে। উবে যায় না। তার সংহত কম্পন পাঠকের মনেও সঞ্চারিত হয়। কবিতায় আজ এমনটিই আরাধ্য। রফিকের মুন্শিয়ানা এতে শিখরস্পর্শী। কোনো ভারী শব্দ নেই; অথচ প্রতিটির কাঁধে বিপুল ব্যর্থতার অথবা অচরিতার্থ আকাঙ্ক্ষার ভার। বেমানান মনে হয় না এতটুকু। তাতেই সার্থকতা ফুটে ওঠে কবিতার।
কথাগুলো যাচাই করতে এবার তাঁর কবিতার দিকেই সরাসরি তাকাই। পড়া হলে প্রত্যেকে নিজের নিজের মতো বিচার করবেন। তার আগে বলে রাখি, আমার মনে হয়েছে যে, বেপরোয়া ডাকাবুকো ভাবমূর্তি – তাই বলে বেহিসেবি বা বিশৃঙ্খল নয়, কবিতায় সব সময়েই তাঁর সংযমের সাধনা – তাঁকে যৌবনে প্রসিদ্ধি দিয়েছিল, তা তিনি এখানে নিজেই ভেঙেছেন। এ-ই প্রথম নয়। জীবনের অনুকম্পাহীন অকিঞ্চিৎকরতার গ্লানি ও নিঃশব্দ আর্তি তাঁর কবিতায় অপ্রতিরোধ্য সংগতি পাচ্ছে কিছুদিন থেকেই। এখানে মূল্যবিচার অনর্থক। ‘প্রতিদিন আমি, হে জীবনস্বামী, দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।’ – এ-ও কি তা-ই নয়?
দুই
শোকগাথা রচনা সাহিত্যের ধারায় অতি প্রাচীন ঐতিহ্য। পার্থিব বাস্তবতায় অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে আছে নশ্বরতা ও বিনষ্টি। তাই শোক ও বিলাপ অনিবার্য। ইলিয়াডে আমরা পড়েছি, হেক্টর-বধের পর পত্নী আন্দ্রোমাশের করুণ খেদ। এমনকি হেলেনেরও। প্রথা মেনে ঘটনাক্রম সাজানো। রামায়ণেও মেঘনাদ-বিনাশের পর রাবণের হাহাকার ও ক্রোধের প্রকাশ আছে। মাইকেল তাঁর মেঘনাদ বধ কাব্যে তাকে অমরত্ব দিয়েছেন। কিন্তু আজকের কবিতার ধরন গেছে পালটে। উদ্দিষ্ট মানব-মানবীর নিরেট বর্ণনা অথবা, বিলাপের আক্ষরিক বার্তা যতই হৃদয়দ্রাবী হোক, অতি আবেগে আক্রান্ত বলে সাম্প্রতিক কাব্যরুচি তাকে পরিহার করে। অথচ অনুভবের সত্যতাকে অস্বীকার করে না; তার যথোচিত প্রকাশের পথও তা খোঁজে। এবং তা ওই চিত্রকল্পনা ও প্রতীকের আড়াল থেকেই। তাতে ব্যক্তিগত আবেগে নৈর্ব্যক্তিকতার ও নিরাসক্তির ছোঁয়া লাগে। অথবা এমনও হতে পারে, ওই আবেগ ঘটনানিরপেক্ষ ও স্বয়ংসিদ্ধ, কবির মনোজগতেই তার সৃষ্টি, যদিও বাস্তবভূমিকে তা অস্বীকার করে না। তার লক্ষ্য কিন্তু সর্বসাধারণের হৃদয়াসন।
অশ্রুময়ীর শবের প্রথম কবিতাটি, ‘অনিঃশেষ’, পড়া শেষ করতে করতে এই কথাগুলো মনে হয়, কোনো এক নারী ছিল, এখন নেই, তাকে মনে করে লেখা। সবটাই কল্পনার প্রতিমা। কবির কল্পনা। বাস্তবে শুধুই শূন্যতা। তিনি নিজেও তা জানেন। তবু তাঁর অনুভবের রূপ দেন। কারণ এই অনুভবে সত্যের লক্ষণ আছে। তা সঞ্চারিত হতে পারে পাঠকের নিবিষ্ট অনুধ্যানে। তার সংবেদনার তারে ঘা লাগে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যেমনই হোক না কেন। কবিতাও বোধহয় পৌঁছুতে চায় সেইখানে। এবং তাতে কবিরও চিত্তশুদ্ধি। কবিতাটি পড়ি –
ফিরে আসা ঠিক নয়,
এই বাক্য শুধরে নিয়ে
অবশেষে সেও ফিরে এল,
ছায়ার জগৎ থেকে
ঘোর অপচ্ছায়ার প্রান্তিক
তীর্থভূমে, ইচ্ছায় অথবা
অনিচ্ছায়, সাধ করে,

নিজেও জানে না বা জানার
উপায় ছিল না কোনকালে
পদশব্দ ছুটে এলে মনে হয়,
আসে, ওই বুঝি আসে
বালুকণিকার স্মৃতি ঘিরে
একবিন্দু আলোর বর্তিকা
বিস্ফোরণ, শাড়ির অঞ্চল মোহে
কাঁটালতা ঝোপের বিস্ময়;
মরম যাতনা শেষে
উপস্থিতি অনুপস্থিতির
দুটি চোখ দুটি ওষ্ঠ,
কথকতা গোপন স্পর্শের
বা মুখ ফিরিয়ে তাকানোর
অকথিত বাণী পরম্পরা,

আলো ছুঁয়ে আছে আলো
ছায়াচ্ছন্ন জলে, মারমুখী
স্রোতে একা হাঁটছে শূন্যতায়!

প্রথম ও দ্বিতীয় স্তবকে কর্তা ও কর্ম এমন অবলীলায় জায়গা বদল করে যে, আমরা প্রায় খেয়ালই করি না। কিন্তু মনের আয়নায় ছবিতে প্রতীকায়িত বাস্তবের দুটো মুখ পরপর ভেসে ওঠে। তাতে ধরা পড়ে ‘ঘোর অপচ্ছায়ার প্রান্তিক তীর্থভূমি’, ‘শাড়ির অঞ্চল মোহে কাঁটালতা ঝোপের বিস্ময়’ বা, ‘মুখ ফিরিয়ে তাকানোর অকথিত বাণী পরম্পরা’। সবই কিন্তু ‘বালুকণিকার স্মৃতি ঘিরে একবিন্দু আলোর বর্তিকা বিস্ফোরণ।’ কারণ শেষ বিচারে এই অসহায় মেনে নেওয়া, – ‘মারমুখী স্রোতে একা হাঁটছে শূন্যতায়।’ কবির কৃতিত্ব, এখানে অনুভবে বিপ্রতীপের অনায়াস যোজনায় ওই ‘শূন্যতায়’ জীবনলীলা শরীরী হয়ে ওঠে। অতিকথন ও অতিনাটকীয়তা সম্পূর্ণ এড়িয়ে শুদ্ধ কবিতা হয়েই এই পঙ্ক্তিমালা আমাদের অভিভূত করে। তাকে পবিত্র মনে হয়। একই ভাবনার, ও, একই মেজাজের আরেকটি কবিতা, ‘মাটির কাফন’। এখানেও সেই নারীর প্রত্যাবর্তনের কল্পমায়া –
– তুমি তবে ফিরেছিলে প্রান্তর মাড়িয়ে,
সাঁঝের সুবাস বেয়ে বিষকাঁটারির বনঝোপ;
বলে যাও, ভাষা কোন বাধা নয়, চিন-পরিচয়ে
সূত্রধার তার চেয়ে অধিক বাঙ্ময়, ওই ভস্মের অগ্নিতে
নিভে আসা চোখের ইশারা, ক্ষণিকের স্পর্শ, ঈষৎ মন্থর;

তারপরেই ব্যর্থ আক্ষেপে শেষ হয় কবিতা –
তবু, যদি না-ই খোলে, ওপারে যাওয়ার কানাগলি,
পদশব্দ, হিমশ্বাস, তবে কার মাটির কাফন।
আমাদের মনে পড়ে যায় বারবার শোনা এই সুভাষিত পদ : ‘ডাস্ট দাও আর্ট, টু ডাস্ট রিটানেস্ট।’ ‘ডাস্ট’ তো শুধু ধুলোমাটি নয়, ‘ধুলোর সংসার এই মাটি।’ তাতেই লীন হয়ে যাওয়া – ‘মাটির কাফনে’ পরিণত হওয়া, অথচ ওই মাটি থেকেই চিরবিচ্ছেদ। এখানেও বৈপরীত্য তীব্র করে চেতনায় শরাঘাত।’
‘এসেছিলে তবু আস নাই’ – এই বোধ ছেয়ে আছে বইটির আনাচে-কানাচে। তবে তা শুধু ব্যক্তির নয়, সমষ্টিরও, যদিও কখনো কখনো প্রতীক ব্যক্তির। তা আবার রূপান্তরিত হয় ‘ছিলে’, কিন্তু ‘আজ নেই’, বা ‘আছো’, কিন্তু ‘নেই’তে। তার বিষাদের ‘করুণ রঙিন পথ’ অাঁকা হয় গভীর নির্লিপ্ত টানে কোথাও একটি পুরো কবিতায়, কোথাও বা তার শিরায় শিরায়। যেমন, ‘বিবেক’ কবিতাটি পড়ি –
আব্দুল জববার হয়ে গেলেন মৃত্তিকা,
বিষ্ণুপদ বসু ছাই; ছাই-মৃত্তিকার
মাঝামাঝি কাষ্ঠ, আর ভেদ-অভেদের
দীপ্যমান অগ্নিশিখা; পোড়ায়, কিন্তু যে
দাহ না দিয়েও উপড়ে ফেলে বাস্ত্তভিটে,
ঘর-পইঠা টুকরো টুকরো করে গোটা একটা মানচিত্র
তবুও মেটে না ক্ষুধা, মিটবারও নয়;
তাই বলি, বেঁচে থাক খন্ডিত মস্তক!
এতটুকু কবিতা; কিন্তু মানতেই হয়, এ বহুমাত্রিক। বাস্তবে মানুষী সম্পর্ক-সম্বন্ধের গভীরে এর চোখ। আমরা যাকে আজকাল কায়দা করে বলি, ‘ডায়াস্পোরা’ বা ‘উত্তর-উপনিবেশকতা’ তার দিকেও কি এর ইংগিত? ইতিবাচক নয় অবশ্যই। শেষে যে তিক্ত কষায় উচ্চারণ, ‘বেঁচে থাক খন্ডিত মস্তক!’ সে কি তবে এই প্রবল চরকি টানের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ? ভিন্ন ভাবনা থাকাও বিচিত্র নয়। তবে এ-কবিতা নিশ্চিত। টান যদিও আবেগের দিকে নয়, মননের দিকে।
এই রকম আরেক কবিতা ‘দেশ-দেশান্তর’। একটু বেশি স্পষ্টই যেন। সে-অনুপাতে এর আবিষ্ট করার ক্ষমতা আমার কাছে মনে হয়, তুলনায় কম। বিষয়মাহাত্ম্য কম নয় যদিও। অভিঘাত তার প্রত্যক্ষ জীবনযাপনে ঘরে ঘরে ছড়ায়। কবির উচ্চারণে পাই –

আসে, যায়, বেসামাল স্রোতের প্রকৃতি,
বাঁধে ঘর, জনপদ, তিমির বিলাসে,
তাই বলে থামে না তীরের যাত্রা, ছায়া-ছায়া
ধস, দেশান্তর, ঠেলে, উজিয়ে জোয়ার,
পথ, দিক-নির্দেশনা, জাতি, রাষ্ট্র, স্বপ্ন,
পারাপার, পারাবার, হিসাব নিকাশ;
তারপরেই শেষ দুই চরণে জেগে ওঠে কবিতা; তবে একটু যেন আকস্মিক –
পরিত্যক্ত একখন্ড বেভুল চাঙড়,
তোমার হৃদয় আজ বেশুমার বান!
কোনো কোনো কবিতায় একটু-আধটু আত্মকরুণার দিকে ঝোঁক ধরা পড়ে। যেমন, ‘ভরে নিই ভিক্ষাপাত্র’ (‘ভর-ভরন্ত’), ‘তুমি কেগা, তোমার কী দায়’ (‘কী দায়’), ‘ধরে আছি ভাঙা পাত্রখানি’ (‘পোড়ামন’)। তবে আন্তরিকতায় অভাব নেই কোথাও; এবং কবিতার মূল জায়গা থেকে বিচ্যুতি ঘটে কদাচিৎ। সেখানে তিনি অর্জুনের মতোই লক্ষ্য ভেদে অচঞ্চল। একবার নয়, বারবার। অন্য কোনো দৃশ্যমায়া বা শব্দমায়া, যত মনোহরই হোক, তাকে প্রলুব্ধ করে না। স্থির থাকেন তিনি তাঁর ‘তপের আসনে’।
এরই এক পরিশুদ্ধ ও সার্থক প্রকাশ, আমার কাছে, তাঁর ‘হেমবাসন্তী’ কবিতাটি। আদি অকৃত্রিম প্রকৃতি জগতের সারাৎসার, যা তাঁর অভিজ্ঞতার পটে অবিমোচ্য রঙে অাঁকা আর তাঁর মনোজগতের দুঃসহ পরিবেদনা, দুইয়ে মিলে যে বিড়ম্বিত অনুভবের রূপ, তাকে তিনি কবিতায় ছেঁকে তোলেন। বাস্তব পরাবাস্তবে মেশে। অসংগতির ছাপ থাকে না কোথাও। কবিতার শাসনই সেখানে চূড়ান্ত। নমুনা বোঝাতে শুরুর কিছুটা বাদ দিয়ে পড়ি –
শাল-মহুয়ার
মোহ ছিঁড়ে
উত্থানে-পতনে
কাঠ-ঠোকরার
তীক্ষ্ণ ঠোঁটে
হিমানী বল্কল ফুঁড়ে
ডাল-পালাদের
তীর্থভূমি
বেয়ে
বয়ে গেছে নদী
যেখানে উদ্ধার
জলে – মৃত্তিকায়
স্রোতে
নিঃস্বতার বায়ুতে উত্তাপে
চাপে
আবেগে মন্থনে
ভাঙনের
সারিসারি সফেদ-সফেন
দাঁত
সূর্যকান্তি চন্দ্রবোড়া
হাসি
গিলে খাবে।
এ-কবিতা শুধুই ধ্বনিনির্ভর নয়, একই সঙ্গে মনননির্ভর – চেতনায় যে-ছবি অাঁকে, নির্ভরতা তার ওপর। এবং এর নির্মাণকলাও সেখানে একটি ভূমিকা রাখে।
এখনকার কবিতা রচনায় তাঁর মনোজগতের ছবি একটা ফুটে ওঠে এখানে ‘একটি কবিতার খোঁজে’ কবিতায়। এটা যে তাঁর সব কবিতার বেলায় খাটে এমনটি আমার মনে হয় না। কিন্তু অশ্রুময়ীর শবে এ-স্বীকারোক্তি যথার্থ। অবশ্য মেজাজ বাদ দিয়ে কবিতা নির্মাণের যে সাধারণ প্রয়াস, তার বর্ণনায় বোধহয় অতিশয়োক্তি নেই। তাঁর সব কবিতার বেলাতেই তা ওই রকম। দৃষ্টিভঙ্গির তফাতে ছবির চেহারা বদলে যায়। এই কবিতায় প্রথমেই যখন তিনি জানান, ‘প্রতিটি পঙ্ক্তির গায়ে-গায়ে কিছু অপরাধ কিছু/ অভিশাপ লেগে আছে’ – তখন তা নিতান্তই তাঁর নিজের কথা। কিন্তু যখন তিনি প্রক্রিয়াটির চিত্রকল্পনা রচনা করেন –
নুলো হাত, খোঁড়া পা, ছড়ানো কঙ্কালের হাড়ে হাড়ে
আগুনের ভস্মরেখা,
মাটি-কোদালের নির্ণিমেষ মর্মহীন গাথা, চক্ষু থেকে
ছিটকে পড়া একবিন্দু ধোঁয়া;
প্রতিটি মাচান ঘিরে এক একটি বিষস্নিগ্ধ সর্পপুষ্পলতা,
তীরতীক্ষ্ণ নিষিক্ত চুম্বন;
এই তো, এই তো পাঁজরের খাঁজ উপড়ে
উঠে আসে ঢেউ,
কপট, নিরেট, অকাতর!
তখন তাঁর অভিজ্ঞতার অভ্যন্তরীণ যোগসূত্রগুলো এখানে যেমন-যেমন ধরা পড়েছে, তেমন তেমন, মনে হয় সব কবিই স্বীকার করে নেবেন। তবে অনুভবের স্বরূপটি সবার একই না-ও হতে পারে। উৎসমূলে উপাদানরাশির আবির্ভাব একই রকম হলেও দেখবার চোখ আদিকার বাল্মীকির দৃষ্টি থেকে বদলে গেছে অনেক। বদলে গেছে বাস্তবতায় প্রত্যক্ষের চেহারা। ছিন্নভিন্ন ছড়ানো-ছিটানো তার রূপ।
অশ্রুময়ীর শবের মূল সুর বিষাদের ও বিপন্নতার। তা মিথ্যা নয়। জীবনই তার কারিগর। তবে জীবন আরো কিছু চায়, আরো কিছু দেয়। নির্মোহ দূরত্বে থেকে কবিকে তাদের দিকেও দৃষ্টি দিতে হয়। ‘নিখিল ধরা’ যদি তাকে ‘বঞ্চনা’ করে, তবু। এটা তার কপাল-লিখন।