কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন

কবিতা পরিষদের মাধ্যমেই আমার তাঁর সঙ্গে পরিচয়। এবং প্রথম দিন থেকেই তাঁর অমায়িক ব্যবহার, ভদ্রতা, সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি এবং কবিতার প্রতি তাঁর আনুগত্য আমাকে আকর্ষণ করেছে। তিনি ছিলেন আমাদের একজন প্রিয় মানুষ। সদাহাস্য তাঁর চেহারা এখনো আমার চোখের পাতায় ভাসে। আমার চেয়ে অনুজ তিনি। কীভাবে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন? এই শোক তো সহজে কাটিয়ে ওঠার নয়।
আমি মাত্র কদিন আগে হাসপাতালে তাঁর কেবিনে বসে গল্প করেছি। তাঁর মেডিক্যাল বোর্ডে অংশ নিয়েছি। তখন তো তাঁকে দেখে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়নি যে, তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন।
সত্য বড় নির্মম। আর সেই সত্য আমাদের জানান দিচ্ছে, তিনি আর ইহজগতে নেই। আমাদের সকলকে শোকসাগরে ভাসিয়ে তিনি বিদায় নিয়েছেন।
প্রতিবছর কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠানে তাঁকে আমরা আর মঞ্চে চোখে দেখব না Ñ এর মতো কষ্ট আর কী হতে পারে। তবে আমার ব্যক্তিগত শোকপ্রবাহে তো এটাই নির্মম সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে যে, কবি রবিউল হুসাইন আর নেই। সৈয়দ শামসুল হকের সেই অনুজ প্রিয় কবিটি আর ইহজগতে নেই, যাঁকে তিনি তাঁর জলেশ্বরীর দিনপত্রীর ভেতরে বড় স্নেহের সঙ্গে লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
কবি রবিউল হুসাইনকে এককথায় মূল্যায়ন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি ষাটের দশকের হাংরি বা ক্ষুধার্ত জেনারেশনের প্রতিভূ ছিলেন। ষাটের সেই জেনারেশন, যখন পৃথিবীব্যাপী তরুণরা বিদ্রোহ করেছিল প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তারা সাম্রাজ্যবাদিতাকে, আগ্রাসনকে, যুদ্ধকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল, তারা অনেকে ইচ্ছা করে নিজের ওপরও নানাবিধ আত্মধ্বংসাত্মক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিল। বেঁচে থাকার মূল্যবোধকে তারা নানা আঙ্গিকে প্রকাশ করতে চেয়েছিল। এবং তার ঢেউ এসে লেগেছিল সুদূর এই বাংলাদেশেও। তারও আগে আমাদের দেশে ভাষা-আন্দোলন হয়েছিল। সেই আন্দোলনে আমরা জাতিগতভাবে প্রতিবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। মাতৃভূমি স্বদেশের প্রতি আমরা নতুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখার অনুপ্রেরণা অনুভব করেছিলাম। আমরা শেকড়ের সন্ধানে মনোযোগী হয়েছিলাম।
এরপর আসে একাত্তর। এই একাত্তর আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখায় এবং সেই স্বাধীনতার জন্যে আমাদের রক্ত দিতে আহ্বান জানায়। এবং আমরা অবশেষে স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের অধিবাসী হওয়ার গৌরব অর্জন করি।
কবি রবিউল হুসাইন এই সবকিছুর কালের সাক্ষী, যা তাঁর কবিতাকে দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি মনোযোগী করে তুলেছিল। তাঁর কবিতায় প্রেমের কোনো ইলিবিলি নেই; কিন্তু আছে জীবনঘনিষ্ঠ দর্শনের কিছু উপাদান, জীবনের অন্বেষা, এবং বিষাদক্লিষ্টতা, যা মানবজীবনকে জিজ্ঞাসু করে তুলতে পারঙ্গম। উপমায়, প্রতীকে, চিত্রকল্পে তাঁর কবিতা আর দশজনের কবিতার চেয়ে তাই ভিন্ন।
রোমান্টিকতাকে পরিহার করে তিনি মানুষের জীবনকে বাস্তবতার আয়নায় প্রতিফলিত করেছিলেন। সেখানে মানুষের আশা, আশাভঙ্গ, বিষণœতা, জীবনের অসার মূল্যবোধকে কবিতার মাধ্যমে অপরূপভাবে রূপায়িত করার চেষ্টা করেছিলেন।
তিনি এই সমাজ, এই মানুষ এবং মানুষের যাবতীয় মূল্যবোধকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন এবং স্বাতন্ত্র্যবোধে নিজেকে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন।
তাঁর গভীর সাইকির ভেতর নিজের মাতৃভূমির প্রতি প্রেম, সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল।
মৃদুভাষী রবিউল কখনো সোচ্চার ছিলেন না; কিন্তু তিনি তাঁর আদর্শ থেকে, জীবনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোনোদিন বিচ্যুত হননি।
ব্যক্তিগত লোভ-লালসা বা খ্যাতির প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না। তিনি ছিলেন নিজের আপন ভুবনে ভাবুক একজন মানুষ। নিজেকে প্রায় তিনি নিকটজনদের সমুখে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে চলতেন। একবার তিনি কুড়িগ্রামে গিয়েছিলেন সৈয়দ শামসুল হকের সমাধিস্থলটি পরিদর্শন করতে, যেহেতু সেখানে একটি স্মৃতি কমপ্লেক্স তোলার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার এবং কবি রবিউল হুসাইন ছিলেন তার স্থপতি।
সেখানে স্থানীয় একজন অ্যাডভোকেটের বাসায় নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন তিনি। আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম। খাবার টেবিলে গরুর মাংস দেখে তিনি সেটি সরিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা লক্ষ করে অ্যাডভোকেট সাহেব উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠেছিলেন, ‘ওকি রবিউলভাই? গরুর মাংস সরিয়ে দিচ্ছেন কেন? এখানকার গরুর মাংস খুব সুস্বাদু।’
তাঁর কথা শুনে কবি রবিউল হুসাইন বলে উঠেছিলেন, ‘আমি নিজের স্বজাতির মাংস খাই না!’
তাঁর সে-কথা শুনে আমরা সকলে সচকিত হয়ে উঠলে রবিউল হেসে বলে উঠেছিলেন, ‘আরে বোঝো না কেন, আমি নিজেই তো একটা গরু! আমি আবার গরুর মাংস খাবো কী করে?’
সেই মানুষটি অকস্মাৎ বাংলার সাহিত্যভুবন থেকে অন্তর্হিত হলেন দেখে আমরা বড় বেদনাক্লিষ্ট হয়েছি। তবে প্রকৃতির নিয়ম মেনে আমাদের সকলকে একদিন চলে যেতে হবে। কবি রবিউল হুসাইন বেঁচে থাকবেন তাঁর কবিতার মাধ্যমে, বাংলাদেশের পাঠকের হৃদয়ে তাঁর স্থান থাকবে চিরজাগ্রত, অমলিন।
তিনি যখন তাঁর কবিতায় উচ্চারণ করেন,
কী এমন প্রত্যাশা যে আসতেই হবে প্রতিবার
না এসেও তো আসা যায় মনে মনে
আশা যায় আশা আসে বারংবার
আসা যায় আসার আশায় বসা যায় সিংহাসনে।
বাংলার কবি রবিউল হুসাইন তাঁর কবিতার পাঠকের কাছে ‘না এসেও তো আসা যায় মনে মনে’ হয়ে প্রতিভাসিত হয়ে থাকবেন।