কবি জুলফিকার মতিন : অনুভববেদ্য কবিতার রূপকার

মোস্তফা তারিকুল আহসান

ইদানীং বাংলাদেশে কবিতার ক্ষেত্রে যেসব প্রপঞ্চ লক্ষ করা যায়, তাতে নিঃসন্দেহ হয়ে বলা চলে যে, আমরা সত্যিকার কবিতা থেকে পিছিয়ে পড়ছি। ভালো কবিতা লেখা হচ্ছে না, তা নয়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কবিতা তার স্থির লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না। অথচ প্রচুর কবিতা লেখা হচ্ছে, অজস্র কবিতার বই বের হচ্ছে। সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঋদ্ধ এ-শাখাকে আমরা ব্যবহার করছি হালকাভাবে। আরো মজার ব্যাপার হলো, যাঁরা গভীর অর্থে কবিতাকে নিয়ে ভাবেন বা গভীরভাবে কবিতা লিখতে পারেন, সেই কবিরা প্রদীপের আলোয় আলোকিত হচ্ছেন না। বাঙালি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি, জীবনবোধ, ইতিহাসবোধ, স্বাধিকার চেতনা, ভাষিক ঋদ্ধতাকে অন্বিষ্ট করে ক্ল্যাসিক ধারার নান্দনিক কবিতা লেখার যে-ধারা তৈরি হয়েছিল তা থেকে আমরা সরে যাচ্ছি ক্রমশ। যদিও পরিবর্তনকে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে কোনো দোষ নেই, বরং সেটাই বাঞ্ছনীয়, তবু শেষ পর্যন্ত কবিতাকে তো কবিতা হয়ে উঠতে হবে, সে-বিষয়ে দ্বিমত থাকার কথা নয় কারোই। যাঁরা ষাট বা সত্তর থেকে লিখছেন, তাঁরা যে সবাই মূল পথে আছেন তেমন দাবি করার যৌক্তিকতা নেই। তবে এই ছোট্ট, নিখুঁত এবং নিপুণ শিল্পকর্মের বা সৃষ্টিযজ্ঞের পথ যে কুসুমাস্তীর্ণ নয়, সেটা সবাই স্বীকার করবেন।

পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকের বাংলাদেশের কবিতার যে-ধারা তা যেমন ঐশ্বর্যশালী,  তেমনি বৈচিত্র্যপূর্ণ। ষাটেই কবি জুলফিকার মতিনের উত্থান এবং তাঁর বিকাশপর্ব ধরা চলে সত্তরের দশক। স্বাধীনতার দীপ্র চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি মূলত কবিতার পথে চলতে শুরু করেন, সে-গমন বেশ বেগবান, দীপ্ত ও গভীরবোধজাত অভীপ্সা থেকে উৎসারিত। কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তিতে তিনি তাঁর নিজস্ব চেতনার কথা, অনুভূতির কথা, প্রগাঢ় উপলব্ধির কথা উচ্চারণ করেন একটি সাবলীল ও ক্লাসিক ভঙ্গিতে। শৈশব থেকে আজন্ম কবিতার কুসুমে পেলবিত এবং একই সঙ্গে স্বাধীনতা ও প্রগতির চেতনায় ভাস্বর এই কবি গভীরভাবে নিজস্ব প্রকরণ-কৌশল আত্মীকরণ করে কবিতার জগৎ তৈরি করেন। একটি দ্রোহ চেতনা সবসময় প্রতিভাত হয় তাঁর কবিতায়, যদিও বাইরে থেকে দেখলে তাকে রোমান্টিক মনে হবে কখনো কখনো। কবি জুলফিকার মতিন তাঁর সমসাময়িক সব কবির থেকে আলাদা হয়ে যান তাঁর নিজস্ব উচ্চারণে, যেখানে ব্যক্তি-অনুভূতির প্রাখর্যে সমাজ-সংস্কৃতি, জীবনাচার ও বহমান বাঙালির চৈতন্য গভীর দ্যুতি ছড়ায় উপযুক্ত শব্দযোগে-ছন্দদোলায়। বাম রাজনৈতিক আদর্শকে প্রাণে লালন করে এদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের জন্য যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাঁর কাব্যসত্তা গঠিত হয়েছে শক্ত ভিতের ওপর। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জীবনাভিজ্ঞতার আলো, অভিজ্ঞান ও গভীর অনুশীলন। স্বাধীনতার আগে থেকে তাঁর অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়েছে তরুণ ও শৈশবকালে রচিত কবিতায় (এসবের বেশিরভাগ ছাপা হলেও গ্রন্থভুক্ত হয়নি) এবং পরবর্তীকালের বাস্তবতাকে তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে স্বৈরশাসকদের দুঃশাসন ও পরবর্তীকালের ভূলুণ্ঠিত গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতা তাঁকে অবিরাম চঞ্চল করেছে, আশাহত করেছে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের এই অবনমনকে কবি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত করে কবিতার মালমশলা সংগ্রহ করেছেন। যেহেতেু শিল্পের নিপুণ কৌশলের কাছে আজীবন দায়বদ্ধ তিনি, সে-কারণে তাঁর প্রায় প্রতিটি পঙ্ক্তি উত্তীর্ণ-চরণে রূপান্তরিত হয়েছে। একজন পাঠক যখন তাঁর কাব্যগুলো ধারাবাহিকভাবে পাঠ করবেন, তখন দেখতে পাবেন বাংলাদেশের ধারাবাহিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দলিলকে কবিতার সূক্ষ্ম আদলে পরিপাটি করে তুলেছেন তিনি। সামাজিক ও রাজনৈতিক অনাচারের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার  বিরুদ্ধে তিনি কথা বললেও তা কখনো স্লোগান হয়ে ওঠেনি। এইখানে কবি জুলফিকার মতিনের নিজস্বতা। তিনি দ্রোহী, তিনি প্রেমিক, সমাজ-পর্যবেক্ষক এবং একই সঙ্গে কবি। সেটা তিনি কখনো ভুলে যান না। ভাষার নিপুণ ভঙ্গি, আলঙ্করিক সুষমা, শ্লেষ ও সাবলীল উপস্থাপনা তাঁকে আলাদাভাবে চিনিয়ে দেয়।

মুক্তিযুদ্ধের পরপরই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম কবিতার বই স্বৈরিণী স্বদেশ তুই। নাম থেকে বোঝা যায়, দেশকে ভালোবেসে যুদ্ধে যাওয়ার পর তিনি আশাহত হয়েছিলেন এবং একই সঙ্গে অভিমানের সুরে বিপন্ন স্বদেশকে দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, সে-কারণে মাতৃভূমিকে তিনি স্বৈরিণী বলেছেন। নাট্যকাব্যের আদলে রচিত এ-কাব্যে মূলত যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের ছবি ফুটে উঠেছে। স্বপক্ষ ভাষণ, নান্দিপাঠ, কোরাস, স্বদেশ, আগন্তুক, বণিক ইত্যাদি চরিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের হৃদয়কে তিনি ভাষ্যরূপ দিয়েছেন নানাভাবে।

কোরাসের মুখ দিয়ে কবি বলছেন :

বিশ্বাস করি না তোকে স্বদেশ স্বৈরিণী
বীর্যবস্ত্ত বিদেশীর বিলাস বাসরে
নিজেকে মগ্ন রেখে সন্তানের কথা
বেমালুম ভুলে গিয়ে দিয়েছিলি তুলে
যখন এসেছে যে তাকেই নীরবে
সমগ্র দেহখানি ঐশ্বর্যে ভরা।
এতটুকু দ্বিধা তোর জাগেনি ক মনে
জন্মাবধি ওপরের বাহুলগ্না হয়ে
রক্ষিতা স্বদেশ তুই মনহরণের
মুক্তোমালা নিয়ে কণ্ঠে বহুমূল্যবান
আভরণ সজ্জায় ছেনালী হাসিতে
বারবার ডেকে এনেছিস কাকে…

বলা বাহুল্য, এই পঙ্ক্তিগুলোতে কবির অভিমান তীব্রভাবে প্রকাশিত। এটি যে স্বদেশের প্রতি গাঢ় অনুরাগের প্রকাশ তা বোধ করি নতুন করে ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বারবার বিদেশি শাসন আর অত্যাচারে বিপর্যস্ত স্বদেশকে নারী হিসেবে কল্পনা করে কবি তাকে নানাভাবে উপস্থাপন করেছেন। নাটকীয় এই উপস্থাপনায় কবিতার শরীর ও বিষয়বস্ত্তকে নতুনভাবে আমরা চিনতে পারি।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অজস্র সমস্যা ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা অনুষঙ্গ তাঁর কবিতায় ধরা পড়ে। এখানে যদিও কবির ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ অনুপস্থিত, তবে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধেও অন্যতম সৈনিকের কাছে দেশমাতৃকা যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা তাঁর প্রথম কাব্য থেকেই বোঝা যায়। পরবর্তীকালে তিনি স্বদেশকে বিষয়বস্ত্ত করেছেন, তবে সেখানে স্বদেশ একমাত্র বিষয় হিসেবে থাকেনি বরং ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অন্বিষ্টতায় চিন্ময় এক জগতে কবির প্রবেশ ঘটেছে। এই সংবাদ এই একুশে আবার স্বাধীনতা, স্বদেশ, একুশ – এসবকে কবিতার বিষয় করে তুলেছেন এবং সেখানেও  বিপন্ন স্বদেশ তাঁর অন্যতম অনুষঙ্গ। দেশ যখন দাঁড়াতে পারছে না নিজের স্বাধীনতার মন্ত্রে – স্বাধীনতার শত্রু, পরাজিত পাকিস্তানপন্থী ও সামরিক শক্তি এবং তাদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কবি চরণ রচনা করেন : ‘এই সংবাদ পৌঁছেই দাও গ্রামে :/ শত্রু সমুখে মৌলবাদের – পুঁজিবাদী শোষণের -/ প্রতিক্রিয়ায় গড়া শক্তিরা সুচতুর কৌশলে/ মুখের ভাষাকে নির্মূল করে অবয়বহীন ইচ্ছেগুলোকে/ নির্মম কারাগারে/ করছে বন্দী/ কোনদিনও যাতে জীবিকার গোলাঘরে/ শোষণের বোঝা কতো ভারী হলো/ চিৎকারে চিৎকারে/ আকাশে বাতাসে ছাপিয়ে না ওঠে/ বিদ্রোহী প্রতিবাদ/ আগুনের ফুল কোনদিনও যাতে ফুটতে না পারে এই/ বাংলার শোষিতগণের ঘরে/ শহরে মিছিলে প্রতিরোধ বাণী তোলো তার/ মৃত্যু-তোরণে প্রাণের মূল্যে রক্ত-মিনার গড়ে।’ বস্ত্তত কবিতায় সবসময় স্বদেশ নিয়ে থাকেননি তিনি। এই কাব্যেই তিনি এ-প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে ফিরে যান, ফিরে যান নিজের গহনে, যেটা তাঁর প্রকৃত কবিতার জগৎ। ‘বিস্মৃতি’ নামক কবিতায় কবি লিখছেন : ‘তোমাকে ভুলতে গিয়ে মনে পড়ে সম্ভ্রম যৌবনের কথা/ হরিৎ গোলাপি ফুল নিতে গিয়ে শোণিতের প্রপাত ধারায়/ প্রতিদিন চিঠি আসে, পোস্টম্যান দেয় না আমাকে;/ সেখানে কি লেখা থাকে পরিপূর্ণ জীবনের বোধে/ পিতার আশ্রয় ভাঙে – সংসার – বোনের মমতা/ ভিক্ষুকের মতো চায় মানবিক বৃক্ষের ফল।’ রোমান্টিকতা থেকে কখনো কবি দূরে ছিলেন না এবং সেই রোমান্টিকতার সুর যে ধ্রুপদ ভঙ্গিকে আয়ত্ত করে চলে, সেটা পাঠক বুঝে নেয় প্রতিটি চরণে। শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে কিংবা তারপর তাঁর কাব্যগঠনে খুব বেশি হেরফের আমরা লক্ষ করি না, বরং ক্রমবর্ধমান হয়ে ওঠে তাঁর আকাঙ্ক্ষার বিচিত্র প্রকাশ, নৈঃশব্দ্য শিশিরের মতো তার প্রপাতকে তিনি ছবির মতো অাঁকেন শব্দরাজি দিয়ে। ‘যৌবন’ নামক কবিতায় কবি তাঁর ফেলে আসা যৌবনের স্মৃতিময়তাকে এঁকেছেন নান্দনিক কুশলতায় : ‘যৌবন তো একবার দল মেলেছিল/ বৃক্ষের পাতার সাথে মেলামেশা/ করেছিল বেশ/ নদীর স্রোতের সাথে গাঢ় স্বরে কিছু মৌলিক ধ্বনি/ নাড়ি ছেঁড়া আর্তনাদে দিয়েছিল ভাসিয়ে ভাসিয়ে/ কেবল বৃক্ষ নয় পত্র নয় পুষ্প নয়/ আকাশের চন্দ্রও নয়/ মানুষের ঘ্রাণ মেখে পথে বের হয়েছিল/ পরম পুলকে/ সেই সব আত্মীয়তা আজো মুছে নাই।’

বস্ত্তত বাংলাদেশের সাময়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক পটপরিবর্তন কবির মানসে যে ঢেউ তুলেছে তার অভিক্ষেপ পরোক্ষভাবে তাঁর কবিতায় আমরা লক্ষ করি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড, জিয়াউর রহমান-এরশাদের সামরিক শাসন এবং এর প্রতিক্রিয়াজাত ভাবাবেগ কবি জুলফিকার মতিনের কবিতায় যেভাবে প্রকাশিত তাকে এককথায় অসাধারণ বলা যায়। কারণ কবি বাস্তবতাকে বিষয় করেছেন ঠিকই, তবে তাকে কবিতার পেলবিত ও গভীর তাৎপর্যময় আবহে উপস্থাপন করেছেন। বোঝা যায়, কবিতার স্পন্দিত-নান্দনিক অথচ মুখরিত এবং হৃদয়ের উৎসমুখে প্রবাহিত শব্দরাজি নিয়ে তিনি অবিরাম অনুশীলন করেছেন, অথবা এসব তিনি স্বভাবজাত হিসেবে পেয়েছেন। আমরা লক্ষ না করে পারি না সাধারণ বিষয়কে তিনি কল্পনা ও পারিপার্শ্বিকতার মিশেলে অসামান্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বাস্তবতাকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে তাঁর সচেতনতাকে পাঠক বা অন্য কবিরা লক্ষ করতে পারেন। আর সম্ভবত এখানেই কবি জুলফিকার মতিনের শক্তি ও সম্ভাবনার জমিন। ১৯৭৬ সালের ৪ মে কবি নিজের চারপাশের অসহ্য অধুনাকে বর্ণনা করেছেন ‘পঁচিশে বৈশাখ, সাক্ষাৎকারের প্রতিবেদন’ নামক কবিতায় : ‘আমার চারপাশে অসংখ্য নিঃশ্বাস পড়ছিল/ প্রজ্বলিত ক্রোধবহ্নির মত/ সান্ধ্য সব দৈনিকে লেখা ছিল রাত বারোটার পর ভাষণের কথা/ নিঃশব্দ শহীদ মিনার থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি নৈরাশ্যেও হিমাতুর বোঝা টেনে চলছিল/ তরুণীর ব্যাগে রাখা কনডোমে কোন কাজ হয়নি/ অস্বাভাবিক অপারেশন দেখে আমি শিউরে উঠেছিলাম… আমাকে বাধ্য হয়ে বলতে হল/ কিছু কিছু পরিচিত লোকের মৃতদেহ মাড়িয়ে আমাকে আসতে হয়েছে।/ তিনি অন্যান্য খবর জানতে চাইলেন, যেমন,/ জুলফিকার মতিন কেমন লিখছে/ আমি বললাম, ট্রাশ। বর্বর মধুসূদন যে রকম করে/ অনাঘ্রাতা কুমুর সর্বনাশ করেছিল/ সেও তেমনি/ শিল্প সাহিত্যের গায়ে কোদাল চালিয়ে আপনার কাছে বৃষ্টিপাত চায়। তিনি আর কোন কথা না বলে হাত বাড়ালেন/ সেই হাত মৃত্যুর মত ঠান্ডা, দর্শনের মত অবিবেচক,/ সত্যের মত অন্ধ।’ (‘ঘামের ওজন কত ভারী’) এখানে সময়কে তিনি বর্ণনা করেছেন, যে-সময় মানবতাকে ধারণ করে না, বিপর্যস্ত জীবনের যাতনাকে অন্যদের মাঝে চারিয়ে দিতে তিনি নিজেকে চরিত্র হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। ঘামের ওজন কত ভারী কাব্যে মূলত সাধারণ মানুষের অসহায় জীবনের ছায়াছবি তৈরি করেছেন। স্বৈরশাসক এরশাদের সময় রচিত অজস্র কবিতার কিছু এ-কাব্যে গ্রন্থিত হয়েছে। দ্রোহের আগুনে সেসব কবিতা উত্তপ্ত বাক্যবলয় তৈরি করে বটে তবে শ্লেষের রসে তা কাব্যময় হয়ে ওঠে। অনেক কবি এরশাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও এরশাদের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন, সে-প্রসঙ্গে বাম ঘরানার এই কবি আরেক বামপন্থী কবিকে তিরস্কারের সুরে লিখেছেন : ‘ক’দিনই তো জীবন/ তারপরেই মৃত্যু/ তার চেয়ে এই ভালো রাজার আতিথ্য/ গণবিরোধী হলে কি হয়/ ফাইভ স্টার হোটেলের বিলাস প্রমোদতরীতে ভ্রমণ/ … সরকারী কবিদের পতিতালয়ে আপনার এই আগমন/ ইতিহাসে নিশ্চয় লেখা থাকবে। রবীন্দ্রনাথও একবার মুসোলিনীর নিমন্ত্রণে ইতালী গেছিলেন (কি হাস্যকার তুলনা!)/ আপনি কি সে কথা ভেবে সান্ত্বনা খুঁজছেন?’ এ-কাব্যের প্রায় সমস্ত কবিতাতেই এরশাদ আমলের ভয়াবহ সময়কে আমরা নানা অনুষঙ্গে উপস্থাপিত হতে দেখি, কখনো ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে, কখনোবা সামাজিক নানা অন্তর্ঘাতের আদলে। এক স্থানে কবি লিখেছেন : ‘ঘুমন্ত রাতের শিয়র জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে/ চুলছাঁটা ধাতব মানুষ/ স্তন্যহীন মাতার চারপাশে ঘিরে ভারী বুটের শব্দ।… পুনর্ভবা নদী তীরে উদাস বালুচরে পাঁক খাওয়া গাঙচিল/ একটি মাত্র গুলির আঘাতেই সঙ্গীহীন হয় দারুণ ব্যথায়/ বারুদের গন্ধে ভরে তৃতীয় বিশ্বের দেশ/ অস্থির আর্তনাদে দুচোখ টিপে ধরলেই সেই/ দৃষ্টিহীন পৃথিবীতে ক্রমে তারা এসে জিজ্ঞেস করে,/ কেমন আছি?’

যুদ্ধ সন্ত্রাস, নষ্ট রাজনীতি আর সামরিক শাসনের অবৈধ আস্ফালনে ব্যক্তিজীবন যখন বিপন্ন তখন কোন কবি প্রেমিকার শাড়ির অাঁচলে রোমান্টিকতার গন্ধ খুঁজে ফেরে? কবি জুলফিকার মতিন রোমান্টিকতাকে তবু পরিত্যাগ করেননি, বরং এই অসহ্য অমানবিক বাস্তবতাকে নতুন রোমান্টিকতার ঘেরাটোপে বন্দি করেছেন। এর অঙ্গে রয়েছে রোমান্টিকতার চাদর আর ভেতরে রয়েছে বাস্তবতার করুণ অনল প্রবাহ। এছাড়া তো কবির আর কোনো উপায় নেই। কারণ নারী-প্রেম-ভালোবাসা এসব বিষয়ে কবিতা লেখার কোনো কারণ তিনি খুঁজে পান না। তাই ক্লাসিক ভঙ্গিতে লিখে চলেন ‘…একলক্ষ জোয়াল কাঁধে একলক্ষ ষাঁড়ের সাথে মানুষের খেলাধুলা সামান্য ছিল/ সামান্যই ছিল তার বুকের বৃষ্টিতে ভেজা অঙ্গনে কনকচাঁপা রাত্রির নিষাদ/ চাঁদমারি শেষ করে রেশমী বস্ত্র পিঠে হয়ে যেত ফেরারী আসামী/ দূর বনান্তের রেখা যেখানে মিলেছে এসে রুক্ষ মৃত্তিকার/ চৌচির রণাঙ্গনে … একলক্ষ ষাঁড়ের সাথে একলক্ষ মানুষের সামান্য খেলাধুলা শুরু হয়েছিল/ শুরু হয়েছিল তার ঊরুদেশ কর্ষণ আবক্ষ অনাবৃত পাথরের/ মেদ থেকে মাখন বানানো/ নদীর মাছের কাছে সংহারক পিতার ঔরস/ মরুতে বায়ুতে রাখে জ্যামুক্ত শোণিতাক্ত বাণ/ আকাশের সখি ছিল কোকিলে কোকিলে সব শৈশব পুড়ে যেত বেলীফুল/ মালা হাতে দাঁড়ালে পুরুষ/ লিখে দিত সঙ্গীহীন গানে গানে জ্বালাময়ী নিষিক্ত প্রহর ভর’ (‘একলক্ষ’, কোন লক্ষ্যে হে নিষাদ)। নিজের ব্যক্তিগত অনুভবের জায়গাতে তিনি যে-পদ রচনা করেন তাতে মিশে থাকে তাড়নাজাত অভীপ্সা, যেন কবির মনে অবিরাম প্রসন্ন বাতাস খেলা করে, চঞ্চল মেঘ তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়, ব্যস্ততার জন্য প্রেমিকাকে সময় দিতে পারেন না। এসব সাময়িক উত্তেজনার মতো শোনালেও তাকে কবি প্রগাঢ় আস্তরণে ঢেকে দিতে পারেন, সে-শক্তি তাঁর রয়েছে, ভাষার সংকেতে আলাদা নির্বেদে পাঠকের আনন্দলোককে ভরিয়ে তোলার সব জোগাড়যন্ত্র তিনি করেন নিপুণ শিল্পীর মতো। কবিতা সত্যিকার অর্থে কবিতা হয়ে ওঠার যে প্রকরণ-কৌশল ও বুদ্ধিবোধের খেলা তাকে তিনি আয়াসের মধ্যে পেয়ে যান। এই কবিতার কয়েকটি চরণ লক্ষ করলে বোঝা যাবে এই বাক্যবলয়ের সারবত্তা : ‘ফের যদি ডাক দাও, কি করে ফিরবো বল আমি/ আমারতো ছুটি নেই, কাজ নিয়ে পড়ে আছি মেধাবী নিয়মে/ ঘণ্টা বাজে থেকে থেকে, ইস্টিশানে ট্রেন/ এক্ষুনি ছেড়ে যাবে/ নীলিমায় প্রসন্ন ভোরের সুরভি/ বার বার ঘুরে আসে চাঁদ, সূর্য হননের ক্রোধে বঙ্কিম হয়/ উপল রাতের কোলে ‘- জল  পড়ে পাতা নড়ে -’ কচি কলাপাতা/ ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঝরে যায়/ কে রাখবে ধরে?’ (‘আমার সময় নেই’, কোন লক্ষ্যে হে নিষাদ)।

সত্যিকার কবি প্রেম থেকে বিচ্যুত থাকতে পারেন না, পারেন না নারীর ভালোবাসা বা প্রকৃতির গাঢ় ভালোলাগার আলিঙ্গন থেকে বিমুক্ত হতে। কারণ প্রেম সেই হৃদয়ের জানালা খুলে দেয়, যে-হৃদয় কবির মতো অসীম কল্পনা করতে পারে, তার পাখায় ভর দিয়ে চলতে পারে, এই সব অনুষঙ্গ তাকে কবি করে তোলে। কবি জুলফিকার মতিন প্রেমকে অস্বীকার করেননি তবে সামূহিক বাস্তবতায় প্রেমকে জীবনের একমাত্র পাথেয় করতে কুণ্ঠা বোধ করেছেন কখনো কখনো। যেমন একটি কবিতায় তিনি কৈশোর-যৌবনের প্রেম-অনুরাগকে ফ্যান্টাসি বলেছেন। এরকম সাতটি কবিতার নাম তিনি দিয়েছেন ‘ফ্যান্টাসি’। একটি কবিতায় কবি লিখছেন : ‘তুমি ফিরছ কলেজ থেকে/ ঘর্মাক্ত লাবণ্য তোমার মুখে/ পাখিরা বসতবাটি বানিয়ে চঞ্চুতে চঞ্চুর ঘ্রাণ মেখে নিচ্ছে/ এ নির্বিকার উদাসীনতা তোমার সর্বাঙ্গে/ তুমি কিছুই জড়িয়ে নিচ্ছ না/ না রোদ না বাতাস।/ আমি ভাবছিলাম, তুমি তোমার বইখাতাগুলো/ ছড়িয়ে দেবে ধূলিতে/ হৃদয় ছাড়া মানুষের সঙ্গে নেবার আর কি থাকে?/ যে আঙ্গুলে কলম জড়াও, তা তুলে ধরবে সমুখে/ যেন আমাকে আমার নিয়তি দেখাচ্ছ।’ (‘ফ্যান্টাসি-২’, দুঃখ ভোলার দীর্ঘশ্বাস) অবশ্য দুঃখ ভোলার দীর্ঘশ্বাস কাব্যের মূলসুর অন্য। সাতচল্লিশের দেশভাগ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পরবর্তীকালে এদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর যে-ভয়াবহ অত্যাচার শুরু হয় সে-কারণে স্বজন ছেড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এদেশে ছাড়তে বাধ্য হয়। কারো বন্ধু, খেলার সাথি, কারো বাবা, কারো মাকে ফেলে, ভিটেমাটি ছেড়ে, যাবতীয় স্নেহমায়ার বন্ধন ছেড়ে যারা ভারতে চলে গিয়েছিল তাদের ভোলা সহজ নয়। সেই স্মৃতি কবিকে তাড়িত করে, তার শৈশবের খেলার সাথিরা আজ কোথা তিনি জানেন না। বাঙালির জীবনের এক চরম মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস এটি। কবি লিখেছেন : ‘মানুষের সংসারে তখন হাতি ও ব্যাঘ্রের  লড়াই/ মাইন পোঁতা মাটির ওপরে আকাশে হাজার হাজার/ বোমারু বিমান/ বাচ্চুর মা বলতেন, এই ভদ্রাসন একদিন/ ছেড়ে যেতে হবে।/ আমরা তখন হিন্দু জানি না মুসলমান জানি না/ কেবল জানতাম বর্ণঘুঘুর বাসায় ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোতে/ আর কতদিন বাকি/ …তারপর একদিন ইতিহাস তুলে ধরল দেয়াল/ তার কালো ঘোড়া বাচ্চুকে পিঠে করে নিয়ে গেল/ দূর কোন তেপান্তরের মাঠে/ নক্ষত্রখচিত রাতে এখনো সেই দুঃখ ভোলার দীর্ঘশ্বাস/ প্রাজ্ঞ জীবনের তীরে মাঝে মধ্যে দুআঙুলে ম্যাজিক দেখায়।’

কবি জুলফিকার মতিন স্বাধীনতা-পরবর্তী কালকে দৃশ্যমান করেছেন নিজস্ব অভিজ্ঞতার স্বরূপে; সেখান যুদ্ধ, যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের বাস্তবতা, নারী-প্রেম, সাধারণ মানুষ – এসব প্রসঙ্গকে তিনি গভীর অনুধ্যানসহ নতুন দ্যোতনা দিয়ে পরিস্ফুট করেছেন। কবিতার শরীরে তাঁর চিন্তা-আবেগ-দর্শন এবং নিজস্ব কাব্যিক প্রকরণকে অন্বিষ্ট করেছেন বিষয়বস্ত্তর প্রয়োজনে। তিনি কখনো ভুলে যেতে পারেন না তিনি যুদ্ধফেরত সৈনিক কিংবা প্রেমিকার কাছে কত প্রিয় অথবা দ্বিধা তাঁকে সবসময় বিচলিত করে। সত্তর-পরবর্তীকালে রচিত তাঁর সব কবিতায় তাই স্বদেশ যেমন প্রবলভাবে উপস্থিত, তেমনি প্রেম-দ্রোহ উপস্থিত অনিবার্য প্রত্যয় হিসেবে। স্বদেশের নেতিবাচক সামাজিক-রাজনৈতিক পটপরিবর্তন কবিকে ব্যথিত করে, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয় যখন ভূলুণ্ঠিত হয় তখন তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তবে সব দ্রোহ সব ক্ষিপ্ততাকে তিনি শিল্পিত করে তোলেন অনায়াসে, ধ্রুপদী-ভঙ্গিমায়। ১৯৭২ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সময়ে তিনি অজস্র কবিতা লিখেছেন, সেগুলো তাঁর নয়টি কাব্যের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তবে নীলিমাকে চাঁদ দেব বলে এবং তাই তো সংবাদ নেই কাব্যে এই প্রসঙ্গগুলো বিশেষভাবে উচ্চকিত। ১৯৭২ সালে রচিত একটি কবিতায় তাঁর এই দ্রোহী চেতনার স্বরূপ বোঝা যায়। তিনি স্পষ্টত বিরক্ত রাজনৈতিক দল ও নেতাদের প্রতি। তবে কবি হিসেবে তিনি কী নিয়ে উৎকণ্ঠিত তাও বলেন স্পষ্ট করে : ‘নেতার কি করণীয়?/ নেতার কি বক্তব্য?/ ভাই-বন্ধু-পরিজন, কিছুই বুঝি না আমি তার/ আমি শুধু জানি এই বাংলায়/ কিশোরীর ঊরু যদি নগ্ন হয় সন্ধ্যার বিলাস বিতানে/ তবে আমি কোনদিন কবিতা লিখব না’। (‘শব্দাবলী কবিতার’, নীলিমাকে চাঁদ দেব বলে) এই কাব্যে অন্যত্র তিনি লিখছেন : ‘বুকের পাঁজর খুলে মানচিত্র দেখাল সে দীপ্র যাদুকর/ সম্মোহনী দন্ড তার নাচাল আকাশে/ অসম্ভব পদ্ম সব সুরম্য মঞ্চ ঘিরে প্রস্ফুটিত করে দিতে চেয়ে/ অনায়াস আয়োজনে বাঁশিতে তুলল সুর/  মেঘ বৃষ্টি এশাকার প্রপাতের মত/ নীরক্ত আঙুল দিল অলৌকিক তেজকণা/ বোধহীন পতঙ্গেও প্রায়/ বিরল কপোল ছুঁয়ে কারো কারো যুবকেরা দ্রুত পায়ে মুহূর্তে উধাও/ মতর্ক অ্যামবুশে; লোকালয় উথাল পাথাল/ সমুদয় উচ্চাশা হিরণ্ময় স্নানার্থী রোদের/ সবুজ পোষাক পরে হেঁটে যায় স্বছন্দ গতি/ স্বপ্ন শুধু জেগে থাকে বানার উষ্ণ অনুভবে’। (‘কেউ কিছু বলতে পারে না’) আবার এই কবি তাঁর প্রেমিকাকে ফিরিয়ে দিতে চান না, হয়তো পারেন না, কারণ জীবনের সরসতার বা ধনাত্মক সবকিছু তিনি পেয়েছেন নারীর কাছে। তাই রণে পরাজিত বা ভীতু না হয়েও তিনি বলতে পারেন : ‘ভালোবাসার বৃত্ত থেকে বেরতে পারি না/ সমস্ত অ্যামুনিশান আমি তোমার কাছে জমা রাখতে চেয়ে/ শৈশবের নদীকে ডেকে বলেছিলাম/ আমাকে কিছু কিছু মানবিক অস্ত্র দাও/ অলৌকিক জেটিতে আমি চনেদ্রর জলযান দেখে মুগ্ধ হতে পারি ভেবে/ নিসর্গ আমার রৌদ্রাস্ত্র তুলে দিয়েছিল।’ (‘স্বভাব’)

কবি জুলফিকার মতিন কাব্যজগৎ নির্মাণকল্পে সচেতন সব সময়, সে-সচেতনতা তাঁর স্বভাব-শক্তি ও সম্ভাবনার পরিচয় বহন করে প্রতিনিয়ত। মানবজীবনকে দেখার যে বীক্ষণ বা অভিজ্ঞতা তাকে তিনি কবিতার বিষয় করে তুলেছেন গভীর ও নির্মোহভাবে – তাঁর অনুভববেদ্য প্রগাঢ় উচ্চারণ প্রবহমান মানবমননকে যেমন উদ্দীপ্ত করে, তেমনি বাঙালি হিসেবেও আলাদা ভাবনার অর্গল খুলে দেয়। জীবনের সঙ্গে লীন উদ্দীপ্ত কোরক অনুভবসজ্জাকে তিনি নিজস্ব মন্ডনক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেন, সেখানে তাঁর শব্দবোধ ও নিপুণ প্রকরণসজ্জা কবিতাকে আলাদা প্রাণ দান করে। আমরা লক্ষ করব, সাময়িক জীবনযাপন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়কে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিনি যেমন গভীরভাবে কবিতার পঙ্ক্তিতে ধারণ করেন, তেমনি ব্যক্তির চিন্ময় প্রসিদ্ধি, প্রগাঢ় ব্যঞ্জনাকে তিনি অন্বিষ্ট করেন। ফলে ব্যক্তির রাগ দুঃখ ক্ষোভ সংবেদ নেতিবোধ সদর্থক বোধ হাহাকার সবই তাঁকে আক্রান্ত করে, তবে বিকার যে কবিতা নয়, সেটা তিনি জানেন, ফলে নিজের গরল তিনি কবিতার পঙ্ক্তিতে ছড়িয়ে দিতে চান না। বাংলাদেশের অনেক প্রসিদ্ধ কবির বেলায় আমরা দেখেছি এসবের অজস্র উদাহরণ। জুলফিকার মতিন দৃশ্যত অন্য সকলের চেয়ে আলাদা হয়ে যান তাঁর স্বতন্ত্র বোধ-চিন্তা-দর্শন ও প্রয়োগরীতির কারণে। একটি দৃঢ়-ঘনপিনদ্ধ শব্দ-ছন্দ গঠন তাঁর আয়ত্তাধীন, ফলে তিনি পৌঁছে যেতে পারেন কাব্যে সেই স্বর্ণদ্বীপে, যেখানে তিনি একক অদ্বিতীয়। জীবনের সারসত্তা নিয়ে কবি ভাবেন, জীবনের লক্ষ নিয়ে তিনি ভাবেন, খুব হতাশ না হলেও মানবিক বিপর্যয় তাঁকে ভাবায়, তবে তিনি তাকে কবিতার সরসতা দিয়ে ভরিয়ে তোলেন সব সময়। দু-একটি উদাহরণ দিয়ে এই বিষয়টি স্পষ্ট করা যাক :

পৃথিবীর কোথাও কি সারসত্তা বলে কিছু আছে?
আপাত নিধনহীন জীবনের ধ্বংসযজ্ঞ ইন্দ্রপ্রস্থে বিপন্ন অর্জুন
ছোট ঘর, মনোরমা, কিংবা কিছু তুলো রাখা ফুল
শ্রেয়তর সংশয় – কোথাও সবিতা নেই – পুণ্যময় ধুলো
লুপ্ত কোন সভ্যতার মত; শুধু বোধ
(‘ঝাড়লণ্ঠন’, তাইতো সংবাদ নেই)
২. অভ্যাসে বারুদ মেশে, হে আমার প্রিয় বান্ধব,
মানবের দুঃখ দেখে প্রকৃতির বিধূরা বসন
কতকাল ধুয়ে দেবে চোখের নদীতে?
প্রিয় ও সত্যের মত আর পৃথিবীতে দুঃখ আছে নাকি?
মৃত্তিকা মাতার মত এমন বিরহ কেউ পারবে না দিতে
না পাওয়ার চাঁদেও রাতে পদাতিকা অভিসারিকার
দারুণ দুঃখ থাকে প্রাকৃতিক নির্জ্ঞানতার।
(‘হে মানব’, তাইতো সংবাদ নেই)

১৯৮৩ সালে লেখা ‘নিজের সামনে আমি’ কবিতায় কবি লিখেছেন, ‘দুঃখের খাপ খুলে এই তরবারি আমি ধরেছি ললাটে/ কোন স্বপ্ন বুকে ধরে আজও তারা বসে থাকে নির্দয় শীতের উঠানে।/ কার কার সন্তাপে অক্ষিগোলক থেকে ভেসে ওঠে শুভ্র গোলক রাজহাঁস/ নির্বাসন দন্ড নিয়ে সুন্দরবনের চির গভীর হরিৎ/ আত্মদহনের চিতা নির্বিকার জ্বেলে বসে থাকে।/ নিজের সামনে আমি/ পরস্পরের কাছে পরস্পর মুখোমুখি কেউটে ছোবলে/ ঋত্বিকের পাপ থেকে দেয়ালে দেয়ালে শুধু ইতিহাস লেখে।’ স্পষ্টত কবি সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহতার সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের অসহায়তাকে শ্লে­ষের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। নিজের অসামর্থ্য হয়তো নিজের নয়, পারিপার্শিবকতার দ্বারা রচিত, দুঃখ হয়তো নিজের অর্জিত নয়, তবু কবিকে এসব বহন করতে হয়। নিজেকে নিজের চিনে নেবার আয়োজন করে চলতে হয়। আরো আগে ১৯৭৭-এ কবি লিখেছেন আরো গভীর প্রত্যয়দীপ্ত কবিতা, যেখানে নিজের আকাঙ্ক্ষার বা ক্ষমতার কথা বলেছেন তিনি। কিছুটা অনুতাপ সেখানে মিশে আছে কিংবা কিছুটা নেতি, তবে এক শাশ্বতবোধ এবং বোধজাত অধীরতা কবিকে উন্মুখ করে তোলে, ‘আমাকে মূল্য দিলেই আমি অমূল্য হতে পারি/ প্রেম দিলে পোষমানা সাহেবী বিড়াল,/ ভোরের কুয়াশা দিলে চাদর বিছান মাঠে/ শিশুদের জন্ম দিতে পারি/ না নিষাদ না জনক এরকম কিছুতেই নয়/ মাঝামাঝি শুয়ে থাকা পৃথিবীর শুরু থেকে/ শেষতক বয়ে যাওয়া লবণ পানিতে,/ বিদীর্ণ হৃদয় আমি ধুয়ে দিলে/ কি আমাকে দিতে পার বল?’ কবির সৃষ্টিশীল সত্তা যা সৃষ্টি করতে পারত তাকে  না বোঝার জন্য, কবির অনুভূতির সজ্জাকে উপলব্ধি না করার জন্য কবি কষ্ট পান, কবি অভিমান করেন। তাঁর দুঃখ বা কষ্ট হয়তো থাকে তবে তার চেয়ে বেশি হয়ে ওঠে কবির চঞ্চল হৃদয়ের আনন্দানুভূতির মৃত্যুর জন্য কষ্ট। এ-কষ্ট অবশ্যই একজন শিল্পীর কষ্ট কিংবা তীব্র অভিমান – ‘আমারই বোঝার ভুল আমারই পাবার ভুল/ না, না, এরকম ভুল কিছু নয়,/ যা হবার পৃথিবীতে একবারই হয়।’

প্রবহমান মানবজীবনের সারসত্তা কী তা নিয়ে কবি নিজস্ব জিজ্ঞাসা লিখে ফেলেন কবিতার চরণে চরণে, কখনো জীবনের নানা অনুষঙ্গকে ব্যাখ্যা দেন নিজস্ব বয়ানে। হতে পারে সে-ব্যাখ্যা আমাদের প্রচলিত জ্ঞানকে তোয়াক্কা করে না, তবু সে-ব্যাখ্যা কবির অন্তর্জাত, গভীর মর্মদহনে নিষিক্ত। তাকে অস্বীকার করার উপায় থাকে না। কারণ কবি আগেই পৌঁছে যান এক চিন্ময় জগতে, যেখানে সত্য বা জীবনের নতুন নতুন ব্যাখ্যা তৈরি হয় কবির নিজস্ব অভিজ্ঞান দিয়ে। কবির এই অনুভববেদ্য জগতের সঙ্গে আমাদের খুব কমই পরিচয় থাকে। কারণ কবি যেভাবে নিজেকে অনুভূতির রজ্জুপথে নিয়ে যান সাধারণের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। তবে যে-রং কবি তৈরি করেন তাতে পাঠক আলো দেখতে পান, এক আনন্দধারা তাকে আপ্লুত করতে পারে, বিষয়টির ভেতরে সঠিকভাবে প্রবেশ না করেই। কবি কীভাবে বস্ত্তর ওপরে আলো ফেলছেন, কীভাবে বিষয়কে নতুন ঘনত্বে উপস্থাপন করছেন, তা হয়তো পাঠক জানতে পারেন না সবসময়। তবে একটা আলো এবং এর রং যে জীবনকে চঞ্চল করে তোলে তা বোঝেন। ‘মানুষের কথা’ কবিতায় কবি জুলফিকার মতিন জীবনের নতুন গান শোনান যার স্বরলিপিও তাঁর তৈরি করা – ‘জন্ম সত্য নয়/ মৃত্যু সত্য নয়/ যৌবন বার্ধক্য জরা কোন কিছু চিরস্থায়ী নয়,/ কেবল রয়েছে দেখি অনিত্য প্রলয়,/ বৈনাশিক কালচক্র সর্বভুক বিধাতার মতো। … অনেকেই এ কাহিনী বলেছিল আমার আগেও/ আমি জানি সে বাসনা কোনদিনও  মানুষের পুরবার নয়/ তৃষ্ণা মেটানোর/ এমন তো প্রবাহিত নেই আত্মার ভেতর/ যা রয়েছে তা তো ধ্বংসের বীজ,/ পোড়ায় শস্যক্ষেত লোকালয় নিভৃত বিতান,/ ভস্মীভূত বসুন্ধরা ভাবে বসে বিমর্ষ চোখে,/ তারই সাথে শোক বয়/ তার ভাষা দেবতারা শেখেনি কখনও।’

কবি কখনো ভাবেন যে, তাঁর চোখের মধ্যে গাঁথা রয়েছে পৃথিবীর অমানবিকতার ইতিহাস; টুকরো টুকরো ছবি, কিংবা ইতিহাসের পথ ধরে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আজ অবধি তিনি পরিক্রমণ করে চলেছেন একা। তবে নষ্ট জ্যোৎস্নার ইতিহাসই হয়তো সত্য, বেদনার কালো রং হয়তো মর্মস্পর্শী এবং সে-কারণেই কবিকে তা স্পর্শ করে। অমাময় ইতিহাসের নদীতে ভাসবার সময়  কবি কাউকে খুঁজে পান না সাথি হিসেবে। তবে সময় আর ইতিহাস তাঁকে নতুন নতুন বোধের কাছে নিয়ে যায়, যা মানবজীবনের আকুতি আর দীর্ঘশ্বাসকে প্রতিভাত করে। প্রাচীন পৃথিবীর মানুষ কিংবা তাদের ধারাবাহিক জীবন-পরিক্রমা যার অংশত হয়তো কবি জানেন, তবে তার গাঢ় আস্তরণ কবিকে আক্রান্ত করে এবং তিনি জানেন, এই অমানবিকতার ইতিহাসের শেষ নেই, দ্রোপদীর শাড়ির মতো তার দৈর্ঘ্য নেই, শুধু বিস্তারিত হয়। কবি এই সব নিয়ে পঙ্ক্তি রচনা করেন, ‘অনেকাংশে রোদ ছিল : বিষণ্ণ বাদুড় ছিল চোখের ভেতরে,/ আর ছিল হিরোশিমা,/ মাত্র কদিন আগে কথা দিয়েছিলে,/ প্রবল প্ল­াবনে সব ভেসে যাওয়া স্রোতের ভেতরে/ তৃণ গুল্ম লতাপাতা প্রবল শৈবালদাম,/ অনেকেই সঙ্গী ছিল সেই বিসর্জনে।/ ঘুরে বেড়ানোর এক প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে চেয়ে আছে মার্কোপোলো,/ হাসছে দেয়ালে।’ (‘বিসর্পিল’)

১৯৭৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সময়কালে লেখা কবিতা নিয়ে কার চরণচিহ্ন ধরে কাব্যের মূলসুর যে কবির ইতিহাস-পরিক্রমণ তা বোঝা যায় এর কবিতা পড়লে। তবে মাঝে মাঝে তিনি অন্য পথে গেছেন, অন্যরকম কিছু অনুভবের কাছে নিজেকে মেলে ধরেছেন। তিনি সময় বা কালের গভীর পর্যবেক্ষক, মানবজন্ম পরিবর্তনসূত্রকে তিনি গ্রথিত করার চেষ্টা করেছেন তাঁর মতো করে, জীবনের সঙ্গে গাঢ়ভাবে লীন অনুষঙ্গকে তিনি ইতিহাসের কার্যকরণসূত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছেন। হতে পারে তাঁর সব বক্তব্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, তবে তাতে কবির কিছু আসে-যায় না বা কবিতার কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হয় না। কারণ কবির প্রতীতি বা অনুভবের রং এমন প্রগাঢ় যে, তা অনিবার্য এক বোধের জগতে নিয়ে যায়, যাকে শুধু ন্যায়-অন্যায় সত্যাসত্যের প্রচল দিকটা দিয়ে বিচার করা যায় না। এটা ঠিক যে, কবি জুলফিকার মতিন সচেতন কবি, রোমান্সের চেয়ে বুদ্ধির দীপ্তি তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ, শুধু কথার পিঠে কথা বসানো কিংবা বাক্যবলয়ের মধ্যে সামান্য মোচড় দিয়ে তিনি কবিতা লিখতে চাননি বরং জীবনের গভীর সত্যকে অনুসন্ধান করে তার সঙ্গে নিজের উপলব্ধিকে যুক্ত করেছেন। নিঃসন্দেহে তিনি ক্লাসিক ধারার কবি, হয়তো সুধীন দত্ত তাঁর প্রিয় কবি। তবু সে-ক্লাসিক ভঙ্গির মধ্যে কবির অনুভবের তীক্ষ্ণতা যেমন চোখে পড়ে আবার মানবের সাধারণ আনুভূতিক সৌন্দর্যও তিনি নিপুণভাবে অাঁকেন। যে-পথ দিয়ে এতদিন চলেছেন তা মিলিয়ে নিয়েছেন ইতিহাস পরম্পরায়। জীবনের বাঁকে বাঁকে যে-লক্ষণ ধরা পড়ে, নদীর সেই চরা-বালিতে ইতিহাস তার নখ বসিয়ে যায়। এশিয়ার অন্যতম ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধকে তিনি সামনে এনেছেন, সেই বালক নালক যে জীবনপ্রবাহ দেখেছে তার রূপ কেমন, এতদূর কীভাবে এসেছে সে, ধীরপায়ে  সে এগিয়ে চলেছিল পৃথিবীর পথে, তার চরণচিহ্ন রয়ে গেছে। কোনো কোনো নালকের বেলায় যেমন এই গল্প সত্য, তেমনি সব মানবের যাপিত জীবনও রেখে গেছে পৃথিবীতে স্মরণচিহ্ন, সে-গল্পও সত্য। কবি জুলফিকার মতিন আমাদের সেই শাশ্বত বোধের কাছে নিয়ে যান, সেই জিজ্ঞাসার কাছে দাঁড় করিয়ে দেন, যা জীবনের জন্য অমোঘ; চঞ্চলা বা বিপুলা পৃথিবীর কাছে কিংবা মানবজীবনের কাছে আমরা কী পাঠ নিই, কী পাঠ রাখি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জন্য? শুধু কি হাহাশ্বাস? নাকি দীর্ঘনিশ্বাস? কবি অবশ্য আমাদের হতাশার দিকে ধাবিত করেন খানিকটা, তবে এভাবে আরো নিয়ে যান জীবনের কাছাকাছি – কিছু স্মৃতিবিস্মৃতি, জীবনব্যপ্ত কিছু অাঁধার, কিছু জিজ্ঞাসা কিছু বিহবলতা, কিছু আকাঙ্ক্ষার রোদ, জমানো ক্রোধ বা অভিমানের কাছাকাছি।

পৃথিবীতে কবির আকাঙ্ক্ষার বস্ত্ত বা প্রসঙ্গ কিংবা অনুভূতির সূক্ষ্ম জগৎ তাঁকে হয়তো ব্যাপৃত রাখে অথবা তিনি সেই অমরাবতীর জগতের স্বপ্ন দেখেন। বাস্তব বা অবাস্তবের জগতের মধ্যে কবি একটা ব্যবধান তৈরি করে চলেন সচেতনভাবে। পারিপার্শ্বিকতাকেও কবি ব্যবহার করেন।  এই কবি এতটা কল্পনার জগতের নন, তবে তিনি তাঁর বক্তব্যকে পরিস্ফুট করতে কল্পনার শক্তিকে কাজে লাগান  উপমা-উৎপ্রেক্ষা খুঁজতে। স্বভাবকবির মতো তিনি প্রচলধারার কবিতাও লেখেন, যদিও তাঁর মূলসূত্র হলো জীবনের গভীরে ফিরে যাওয়া বা পাঠককে গভীর অনুভবের সাগরে অবগাহন করানো। পারিপার্শ্বিকতা বা দৈনন্দিন জীবনের নানা খুঁটিনাটি বিষয় ও চরিত্র কবি ব্যবহার করেন কখনো কখনো, তা আপাতভাবে সরাসরি মনে হলেও বাস্তবে তা নয়। কারণ এই সব প্রসঙ্গ বা চরিত্রকে তিনি ব্যবহার করেন তাঁর বক্তব্যকে রূপকল্প হিসেবে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার জন্য। একটি বিষয় জুলফিকার মতিনের কবিতার বেলায় স্পষ্ট বোঝা যায় যে, কবিতাকে কবিতা করে তোলার জন্য তিনি কখনো কষ্ট কল্পনার আশ্রয় নেননি। বরং তিনি খুব অনায়াস ভঙ্গিতে পেয়ে যান কবিতার চিত্রকল্প, অনুষঙ্গ কিংবা গভীর অনুভববেদ্য পঙ্ক্তি। যে-পর্যায়ে পৌঁছে গেলে একজন কবির নতুন বিষয়ের জন্য হা-পিত্যেশ করতে হয় না, নতুন অভিব্যক্তির জন্য চিন্তিত হতে হয় না, কবি জুলফিকার মতিন সেই উচ্চতায় পৌঁছে গেছেন। বালক বা কিশোর বয়স থেকে তাঁর অভিজ্ঞতা পুষ্ট হয়েছে জগৎ-জীবন ও পঠন-পাঠন থেকে, অজস্রধারার চিন্তাবিভূতি কবিকে সতত চঞ্চল করেছে বারবার। তবে তিনি এর মধ্যে প্রকৃত কবিতার শরীর ও প্রাণ খুঁজে নিতে পারেন, সেই বোধ তার তৈরি হয়েছে দীর্ঘদিনের কাব্যচর্চার মাধ্যমে।

তাঁর পাশের জগৎ থেকে তিনি বিপুলভাবে গ্রহণ করেছেন উপাদান এবং তাকে কবিতার সূক্ষ্ম নরিতসু দেহে গেঁথে নিয়েছেন সচেতন শিল্পীর মতো। ‘ফেরিওয়ালা’ নামক কবিতায় ফেরিওয়ালা চরিত্রকে তিনি গ্রহণ করেছেন ভিন্ন এক মাত্রায়, নতুন অর্থদ্যোতকতায় এই দৈনন্দিন জীবনযাপন কবিতার অসাধারণ পঙ্ক্তি হয়ে উঠেছে।

দুপুরে দুপুরে তুমি ফেরিওয়ালা লুকোচুরি খেল,

জানালা থেকে শোনা যায় তোমার রৌদ্রাভ গলার আওয়াজ,

মাথার ওপরে গাছ ন্যাড়া মাথা, একটুকু ছায়াও পড়ে না,

…     …     …

বারবার ডেকে যাও, বারবার লুকোচুরি খেল,

সে কোন উঠোন মাড়িয়ে কখনোই অরণ্যের কাছাকাছি যেতে পারবে না

মানুষের জন্য এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই নিষিদ্ধ,

যেমন জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়া

যেমন নদীর মোহনায় গিয়ে দাঁড়ান

আতপ্ত দূরে চম্পকের সৌরভ নেয়া…

এ-কাব্যের বেশ কিছু কবিতা আছে, যেখানে কবি খানিকটা হালকা চালে এগিয়েছেন বলে আপাতভাবে মনে হয়। মাত্রাবৃত্তের হালকা দোলায় তিনি এ-জাতীয় কবিতায় গভীর কোনো বিষয়ের অবতারণা করেননি হয়তো, কিংবা জীবনের রঙিন স্বপ্নকে নিয়ে তিনি হয়তো কথকতা তৈরি করছেন বলে মনে হবে তবে কবিতাগুলো পড়তে পড়তে পাঠক এক অনির্বচনীয় আনন্দ পাবেন।

ক. আমায় তুমি ফিরিয়ে দাও শয্যাপাতা বিরল দুপুর,

ঘুরছি আমি নাচছে দুপা পেরিয়ে কোথায় যাচ্ছি সুদূর,

বুকের বসন – তাও খুলে যায় – দিচ্ছি খুলে ইচ্ছে করেই,

খুলতে আমার ভালই লাগে। ভালোবাসা? রাখব ধরে?

(‘উৎসব’)

 

খ. তোমার বাড়ি হাওয়ার গাড়ি

তোমার বাড়ি মল্লিকা রাত

খোঁপার মধ্যে খুলে ফেলা একটি তরল বিরল দুপুর

ভ্রমণ শেষে রিক্ত হাতে সেতুর সাথে কথা বলা ।

…     …     …

তোমার বাড়ি হাওয়ার গাড়ি। গণভবন। শার্সিমহল

ঘাম চেটে নেয়। কুমারিত্ব। দুপুর বেলায় ঘুম কি যাও?

উঠে শেষে দেখবে তোমার স্বপ্ন থেকে বৃহৎ বোয়াল

টেলিফোনে করছে আলাপ তোমার সাথে। জামার সাথে।

জুলফিকার মতিন তাঁর চেনাজানা পৃথিবীর একজন নির্মম সাক্ষী ও পর্যবেক্ষক। জীবনের প্রকৃত সত্য, আকাঙ্ক্ষা বা চেতনা বারবার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, কিছু সুবিধাভোগী মানুষ মর্তের এই জীবনকে কিংবা আরো ছোট্ট পরিসরে বাংলাদেশের বর্তমান জীবনকে বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে। সত্যিকার অর্থে একজন কবির জন্য এই  অসহ্য অধুনা মেনে নেওয়া কষ্টকর। এই অনুভূতি কবি ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন কবিতায় নানাভঙ্গিতে। হতে পারে এই বোধের মধ্যে সামান্য নেতিবাচক প্রবণতা আছে, তবে সে নেতি জীবনবাস্তবতাকে উপস্থাপন করে গভীরভাবে, সূক্ষ্মভাবে, কবিতার প্রসাদগুণকে ক্ষতি না করে। ‘বধ্যভূমি’ কবিতায় কবি লিখেছেন, ‘অথচ এ জীবনের দায়বদ্ধ কিছু কিছু সত্যের কাছে/ নতজানু বিচারক আপন পকেটে খোঁজে অলৌকিক বিশ্বাসের যাদু,/ পতন তো এই একদিন বেশ হয়েছিল,/ উত্থানে পূর্ব শর্তে লেখা ছিল কর্ষিত মানব জমিন,/ অসক্ষম মানুষের বাসযোগ্য পৃথিবীতে হরিৎ মালতী বীথি দিয়ে,/ প্রণয় সিক্ততার নীলিমার শ্রাবণ পূর্ণিমার শোক গাথা ভুলে যেতে দেবে না কখনও।/ এখন অগণ্য তারা নক্ষত্র সজ্জিত রাত দীপাবলী জ্বালিয়েছে বেশ,/ কোন দিন কবে যেন তারা সব কাছে এসেছিল,/ সঞ্চয়ের সরোবরে পুণ্যে ফোটা পদ্মের মূল্য বিনিময়ে,/ তারা সব বেঁচে আছে আকাশের বাগিচায় মিটিমিটি/ আলোর প্রপাত।’ (‘বধ্যভূমি’) এই কাব্যের অন্য একটি কবিতায় কবি উপলব্ধি করেছেন যে, সবকিছু আগের নিয়মে গতানুগতিকতার নির্বেদে চলছে, জীবন-প্রকৃতি, বন্ধুত্ব-শত্রুতা – সবকিছু আগের নিয়মে চলছে, বস্ত্তত পৃথিবীতে নতুন কোনো নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না, সবকিছু চলছে পুরনো নিয়মে। প্রেম-শারীরিক সম্পর্ক, যৌনতা কিংবা নারী সৌন্দর্যের চিহ্ন – সবকিছু আগের মতো আছে, সবকিছু চলছে পুরনো নিয়মে : ‘আকুলতা জড়ান বৈভব/ ধুয়ে মুছে ঝরে যায় স্তনের বোঁটায়,/ অবনত পুষ্পের সাথে মিশে যায় স্বেদ রক্ত/ মানুষের মূঢ় বিভ্রমতা।/ সকালের রোদ আসে পুরনো নিয়মে,/ যে পাথরে শুয়ে থাকে নিষ্ফল নিগূঢ় ললাট/ তার মুখোমুখি হলে/ অন্ধকারে আততায়ী আসে/  তাও বুঝি  পুরনো নিয়মে।/ কাঠ জমি চুলি­তে কয়লার কুচি,/ রমণীর স্বত্ব নিয়ে বাদ-বিসম্বাদ, ভদ্রানন বেঁচে দিয়ে কাই বাবুরা/ দীর্ঘ রুখু প্রান্তরে পাথরের চোখ মেলে রাখে।’

এইসব নেতিবোধ বা মানবিক নানা বাধা অতিক্রম করতে গিয়ে কবি কখনো বিমর্ষ হয়ে পড়েন বটে, তবে কবিতার সরলতার বাইরে তিনি কখনো থাকেন না, অনবরত তাঁর মাথায় কবিতার পঙ্ক্তি খেলা করে, চঞ্চল এক মনন নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত তিনি পাড়ি দেন সূর্যের সঙ্গে, তাকে আপাতভাবে মনে হবে বিরক্ত এই জীবন নিয়ে, তবে প্রকৃতপক্ষে তিনি অধীর-উন্মুখ হয়ে থাকেন মানুষের জন্য, মানবিক সব বোধের জন্য, পৃথিবীর যে-কোনো ঘটনার জন্য যে-কোনো পরিবর্তনের জন্য। একজন কবি কী কী গ্রহণ করেন কাব্য-উপাদান হিসেবে তা বোঝা বস্ত্ততপক্ষে কারো পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ তিনি যেভাবে জীবনকে রাঙিয়ে নেন উপলব্ধির আলোয়, অনুভূতির স্পর্শে-গন্ধে, বস্ত্ততপক্ষে সেই অভিজ্ঞতা অন্য কারো হওয়ার কথা নয়। তাই যাঁরা সহজে কবিতা লেখার চেষ্টা করেন বা স্থূল বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে চান, তাঁরা যে কবির মতো অভিজ্ঞতাযুক্ত নন সেটা স্পষ্ট এবং সে-কারণে তাদের কবিতা সত্যিকার অর্থে সেই স্তরে পৌঁছায় না যা আমাদের নতুন অনুভূতিরাজ্যে নিয়ে যায়, আমাদেরকে প্রাণিত করতে পারে। আগেই বলেছি, কবি জুলফিকার মতিন সব সময় সেই উত্তীর্ণ পঙ্ক্তির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন, যাপিত জীবনের শত বাধা সত্ত্বেও তাই তিনি লেখেন :

একটি মাত্র কবিতার পংক্তির জন্য শুধু সারা রাত বসে বসে থাকা

বাতাসের বিরুদ্ধতা সহ্য করে এই রুক্ষ মানব জমিনে তারা

বিমূঢ় মানব

অন্তহীন প্রচাপের ঊর্ণনাভে খাটাচ্ছে তাঁবু,

এখনই গোটাতে হবে,

সমস্ত আকাশ ভেঙে মাথার ওপরে নামে নির্দয় হন্তারক জল, পুষ্পের থেঁতান বুকে হননের দুঃখ বেদনার

দূর ভ্রমণের কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই,

মায়াবী হরিণ কেটে আজ রাতে খাওয়া হবে বেশ।

(‘একটি মাত্র কবিতার’)

সাময়িক রাজনীতি আর তার অসহ্য প্রতিক্রিয়া কবিকে প্রায়শ বিচলিত করে; তিনি বিরক্ত সেটা বোঝা যায় যখন তা ধরে রাখেন নিপুণ সব শ্লে­ষের করাত। রাজনীতির নামে যে অশিষ্ট আর বেলেল্লাপনা সব সময় কবির মস্তিষ্ক উত্তেজিত করে তাকেই কবি কবিতার পঙ্ক্তি করেন খুব সাবধানে, এজন্য যে, এ জাতীয় প্রতিক্রিয়া বিবৃতি হয়ে যেতে পারে যা প্রকৃত কবিতা থেকে অনেক দূরে। এই সব বর্ণনায় কবির অভিজ্ঞতার একটা সারসংক্ষেপ (যদিও তা রূপকল্পে উদ্ভাসিত) আমার পাই যা কবিতার স্বাদ ধরে রাখে সযতনে : ‘ভুল পথে যাও তুমি/ যাদুতে রয়েছে বাঁধা সোনার বলদ।/ আষ্টেপৃষ্ঠে শৃঙ্খল,/ রগরগে মাস্তান আপাদমস্তক মুড়ে/ রিগানের পুরনো পোষাকে/ তিনটি আঙুল কেটে ব্রহ্মদত্যি বসে আছে,/ উলঙ্গবাহার নাচ জাতীয় ভাঁড়ের।/ মগজের কোষে কোষে প্রতিদিন চাইনিজ কুড়ালের ক্ষত/ দুঃখ পেতে খোলা মুখ দিয়ে রাখে,/ গোলাপী আভার গালে ড্রাকুলার দাঁত/ বলে, এই বাস্তবতা নত হও শয়তানের কাছে।’

প্রথম কাব্য থেকে কবি জুলফিকার মতিন নতুনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন অথবা বলতে হয় নতুন নতুন ভঙ্গি খুঁজে পেয়েছেন, নতুন কাব্যভূমের সন্ধান পেয়েছেন, যা তাঁর মৌলিক কাব্যশক্তিকে শনাক্ত করে। স্বাধীনতা, প্রগতি, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের দীপ্রচেতনা নিয়ে কবি জুলফিকার মতিন তৈরি করেছেন তাঁর মনন এবং তার সঙ্গে যোগ হয়েছে মানবজীবনের নানা সূক্ষ্ম অনুষঙ্গ। বিপন্ন মানবতা কিংবা মানবিকতার পক্ষে তাঁর কবিতা বরাবরই সোচ্চার আবার তিনি সমান সচেতন কবিতার সত্যিকার রূপ-গঠনে। কবিতাকে বিষয়ের সঙ্গে, প্রসঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করতে যে-চিত্রকল্প  তিনি তৈরি করেন সেখানে তাকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়। স্বৈরিণী স্বদেশ তুই থেকে কার চরণচিহ্ন ধরে এসব কাব্যে তিনি নিজস্ব কাব্যবৈশিষ্ট্য ও জগৎ তৈরি করেছেন, স্বতন্ত্র স্বর তৈরি করেছেন। তাঁর সমসাময়িক কবিরা যখন একই ঘেরাটোপে বন্দি, নতুন কোনো কাব্যরীতি তৈরি করতে ব্যর্থ, কিছু শব্দের চমক দিয়ে কবিতায় একধরনের মাদকতা তৈরি করেছেন, যার কোনো দীর্ঘস্থায়ী কাব্যমূল্য নেই, সেখানে জুলফিকার মতিন সফল। ষাটের দশক থেকে তিনি লিখে চলেছেন, সময়টা স্বদেশ নিয়ে বেশি ভাবার, সেজন্যে তিনিও স্বদেশের বিষয়কে প্রথমত গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং সেটি তাঁর সত্তায় স্থায়ী আসন করে নিয়েছিল। তবে তিনি জীবনের বিবিধ প্রপঞ্চ নিয়ে তাঁর নিজস্ব অনুভূতিকে সূক্ষ্মভাবে চারিয়ে দিয়েছেন কবিতার শরীরে। তাঁর ভঙ্গি ক্লাসিক, তবে বুদ্ধির দীপ্তি ও আবেগের যৌথ সম্মিলনে তা নতুন আলোর জগতের সন্ধান পেয়েছে। তাঁকে কষ্ট কল্পনা করতে হয়নি, তার অাঁধার পূর্ণ আছে বিবিধ উপাদানে, অপূর্ব রঙে তাঁর মানস রঙিন হয়ে ওঠে। আর কবিতার সত্যিকার অবস্থান সম্পর্কে তিনি অভিজ্ঞ এবং আপসহীন বলে তাঁর কবিতার গঠন ও সৌকর্য নিয়ে কেউ ঋণাত্বক কথা বলতে পারে না।

কার চরণচিহ্ন ধরে কাব্যেও তিনি তাঁর ধ্রুপদীভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন, গভীর এক অনুভববেদ্য জগতে নিয়ে গেছেন পাঠককে। পৃথিবীর ক্রম-অপস্রিয়মাণ জীবনচেতনাকে, তার সূক্ষ্ম সব চিহ্নকে তিনি শব্দ দিয়ে বেঁধে ফেলেছেন চমৎকারভাবে। জন্ম-জন্মান্তর থেকে তাঁর অভিজ্ঞান পুষ্ট হয়েছে যাপিতজীবনের পাঠ থেকে। সময়কে তিনি ধরে রেখেছেন  নানা রেখাচিত্রে। সভ্যতার সহজ অথচ সত্য এক রূপ যা আমরা আপাতভাবে উপলব্ধি করি না, কবি আমাদের সেই জগতে নিয়ে যান। আমরা যেন বুদ্ধের সেই বালকজীবনের পথপরিক্রমাকে মনে করি, মনে করি মানবজন্ম নিয়ে নালক যে স্বপ্ন দেখতো তা আজ কোথায়, যে-জীবন আমরা বহন করে চলেছি তার যোগসূত্র কতদূর, আমরা কি আমাদের পূর্বজন্মে সব স্মারকচিহ্ন মনে রেখেছি কিংবা সেসব স্মারককে কতটুকু মনে রেখেছি নিজের জীবনজিজ্ঞাসায়? কবি লিখেছেন : ‘কার পদচিহ্ন ধরে ধরে?/ এতদূর এসেছ, নালক?/ ও পাড়ের বাতাসে বাতাসে/ কার হৃদয়ের হাহাকার নিয়ে এসেছ?/ তুমি কি বুঝতে পারো না তোমার মানব জন্মের ঋণ/ কোন দিনও মুছে যায় না/ এই ধূলির রেণুর মাঝ থেকে?’

সত্যিকার অর্থে শিল্পের কাছে সমর্পিত এবং কাব্যবোধে অনন্য একজন কবি জুলফিকার মতিন পাঁচ দশকের ওপর কাব্যসাধনায় এক মৌলিক স্তরে পৌঁছে গেছেন। শব্দবোধের নিপুণ প্রয়োগে, বিষয়ের গভীরতায়, নিজস্ব সত্তার প্রকাশে এবং মানবজীবনের গভীর পর্যবেক্ষণজাত অভিনিবেশে কবিতার যে-ভূমি তিনি নির্মাণ করেছেন বাংলাদেশের কবিতার সামগ্রিক বিচেনায় তা অবশ্যই নতুন ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত। তাঁর সময়ে এবং বর্তমান সময়ে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি, তিনি নিজের পথ তৈরি করেছেন দীর্ঘদিনের অনুশীলনে এবং মৌলিক কবির স্বভাবজাত অভীপ্সায়। প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস বা অন্য মাধ্যমেও তিনি সফল তবে কবি হিসেবে জুলফিকার মতিন নিজের প্রতিভাকে সবচেয়ে গভীরভাবে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে। মুক্তিযুদ্ধের একজন সৈনিক এই কবির চেতনায় সবসময় উদ্দীপ্ত বাংলাদেশ এবং এর সাধারণ মানুষ। আর তিনি সমূহ মানবিক বোধকে কাব্যভাষায় বুনে দিয়েছেন আমাদের চেতনায় গভীর ব্যঞ্জনা দিয়ে।