কবি যখন শিল্পীর ভূমিকায়

কবিতা লিখতে লিখতে ছবি আঁকতে ধরেছেন অনেকেই। আবার উলটোটাও করেছেন কেউ কেউ। ভাষায় যা অবর্ণনীয় তাকে চোখের সামনে তুলে আনতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই ভাবনা থেকে পরিণত বয়সে এসে তিনি চিত্রকলার প্রেমে মজেছিলেন। মানুষের মনের অন্ধকারকে ছবিতে তুলে এনেছেন তিনি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছবি আঁকার পাশাপাশি ছোট ও বড়দের জন্য লিখেছেন। লেখাজোখার পাশাপাশি ভালোবেসে ছবি আঁকতেন স্পেনের কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। তাঁর আঁকা কর্তিত হাতের গোড়া বেয়ে চুইয়ে পড়া রক্ত যেন অসুস্থ সময়ের আর্তিকেই তুলে ধরে। সত্যজিৎ রায়, পূর্ণেন্দুপত্রী আঁকায়-লেখায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আমাদের কাইয়ুম চৌধুরী ও রফিকুন নবী অজস্র এঁকেছেন আবার দু-হাতে লিখেছেন কবিতা, ছড়া, ভ্রমণ, স্মৃতিকথাসহ নানাকিছু। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক পরিণত বয়সে ছবি এঁকেছেন, ভাস্কর্য গড়েছেন। এই তালিকায় নিজের নাম লেখালেন কবি শামসেত তাবরেজী।
‘মুহূর্তমা’ শিরোনামে তাঁর আঁকা চিত্রকর্মের একটি প্রদর্শনী করলেন ঢাকার লালমাটিয়ায় দ্বীপ গ্যালারিতে। একই নামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ আছে। মুহূর্তমা মানে – মুহূর্তের অনুভূতি। কবিতায় শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে কবি যে-রূপ বর্ণনা করেন, সে-রূপ রঙে আঁকলে তা কেমন দেখতে হয়, দর্শক এর খানিকটা উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছেন কবির ছবির প্রদর্শনীতে।
শামসেত তাবরেজী আশির দশকের একজন আলোচিত কবি। তাঁর কবিতায় সময়, সমাজবাস্তবতা ও ইতিহাসের চলমানতা থমকে দাঁড়ায় তাঁর সমালোচনামূলক তির্যক শ্লেষে। এমনতরো কবিতা লিখতে লিখতে একসময় তাঁর মনে হলো – বাক্যচর্চা আর কাব্যচর্চায় মনের ভেতরের সব আলো-আঁধারি আসে না। তাকে ধরতে গেলে চিত্রপট লাগবে। কবিতায় যা বলেন, তাকে আরো স্পষ্টতা দিতে কিংবা নিজের মনের ভেতরের ক্ষরণ ও বিচিত্র অনুভূতিকে প্রকাশ করতে তিনি ছবি আঁকতে শুরু করেছেন। ছবিতে তাঁর কবিতার ভেতরে ব্যবহৃত নানা বিষয়ের সমালোচনা ও শ্লেষের দেখা পাই আমরা।
ছোটবেলায় টাঙ্গাইলে আমরা কয়েকজন সহপাঠী একসঙ্গে আঁকাআঁকি করতাম। নিজেদের আঁকা ও লেখা দিয়ে স্কুলের দেয়াল পত্রিকা বের করেছি আমরা। আমাদের এ-দলে তাবরেজী যুক্ত হয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে। তাবরেজী লিখতেন, দাগাদাগি করতেন বাঁহাতে। শুনেছি – মায়ের কাছে তাঁর কবিতা ও আঁকার হাতেখড়ি। ১৯৭৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মানে ভর্তি হলেও বছরদুয়েক পর পাস কোর্সে স্নাতক সম্পন্ন করে এক সওদাগরি অফিসে কাজ নেন। পরে ভাগ্যান্বেষণে তিনি আরব দেশে কয়েক বছর কাটিয়ে নববইয়ের দশকে দেশে ফিরে আসেন। সময়ের দীর্ঘ পরিক্রমায় মাথাভর্তি কোঁকড়া-ঝাঁকড়া চুলের সেই ছেলেটির অবয়ব ও বেশবাস আমূল বদলে গেছে!
কবিতাচর্চার পাশাপাশি এখন মনোনিবেশ করেছেন ছবি আঁকায়। এ-বছরের শুরু থেকে রুটিন করে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা অবধি রং-তুলি ক্যানভাস নিয়ে বসেন। জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিত্যনতুন আঁকা ছবি প্রকাশ করেছেন। এরপর গ্যালারিতে এলেন দর্শকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনে।
এবার তাবরেজীর ছবির প্রসঙ্গে আসি। তাঁর কাজ দেখে মনে হয় – শব্দরূপের মতো দ্রম্নততার সঙ্গে মুহূর্তের নানাবিধ অভিব্যক্তি তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন রঙের রূপে, রেখার নানামুখী চলাচলে। শিল্পীর তুলি চালনার গতির সঙ্গে বর্ণপ্রয়োগের গতিময়তা একাকার হয়ে আছে।
কবি নিজের ছবির বিষয় নিয়ে বলেছেন, ‘নিরাকারের আকার-ভাব আমার বিষয়বস্ত্ত। জন্ম ও ধ্বংসের ভেতর দিয়ে রূপান্তর হয়ে চলেছে জগৎ নিরবধিকাল ধরে। আমার ছবি এই ইশারাকে শিল্পমান্য করে গড়ে ওঠার আহ্লাদ করে। আমি ছবি-জ্যামিতি, সংগীত, কবিতাসমূহকে মানুষের তাবৎ দেহ-নিগূঢ়তার হয়ে-ওঠার কাব্য বলে মনে করি।’
তাঁর কাজগুলোতে বর্ণের প্রাধান্যে মেলে জ্যামিতিক ফর্মবিন্যাস। তবে কোনো কোনো কাজে বিক্ষিপ্তভাবে রং লেপনে একধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। বিমূর্ত ধারার এই ছবিগুলো সময়ের অস্থিরতার কথাও তো প্রকাশ করে। বিমূর্ত চিত্রে শিল্পী তাঁর চিমত্মা ও কল্পনা রূপারোপের ব্যাখ্যা নিজের মতো করে দিতে পারেন। এমনকি দর্শকও তার মতো ব্যাখ্যা হাজির করতে পারেন। এই নিয়ম মেনেই কবি প্রদর্শনীতে জায়গা পাওয়া তাঁর ছবির বিষয়বস্ত্ত, তাঁর চিমত্মা-চেতনা ও বক্তব্য ব্যাখ্যা করেছেন। আবার কবুল করেছেন – দর্শক তাঁর ছবির ব্যাখ্যা নিজের মতো করে দাঁড় করাতে পারেন।
তাবরেজীর চিত্রকর্ম দেখে আমার মনে হয়েছে, তাঁর কাজ বিমূর্তপ্রবণ হলেও চিত্রপটে কতক সংকেত, কিছু আভাস দর্শকদের বাস্তবতার দিকে নিয়ে আসে। যেমন – ‘মন্দির’ শিরোনামে তাঁর কাজের রেখা ও বর্ণপ্রলেপ প্রায়ান্ধকারে একটা মনিদর-অভ্যন্তরের আবছায়া রূপ অস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। তেমনি ‘হেমন্ত’ শিরোনামের কাজে পাকা ফসলের রং লেপনের ওপর কালচে রেখার অস্থির চলাচলের পর যে-অবয়বটি দাঁড়ায় সেটি আমাদের হেমন্তকালকেই মনে করিয়ে দেয়। ‘জঙ্গলে ক্লাউন’, ‘যন্ত্রদানব’, ‘আমার কফিমগ’, ‘যান্ত্রিকপর্ব’, ‘গল্পবলা’, ‘পাখি দম্পতি’ এসব চিত্রকর্ম বাস্তব অনুষঙ্গময়।
গত শতকের শেষ দুই দশকের রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বৈরশাসন প্রসঙ্গ বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে এই শিল্পীর ছবিতে। ‘টারনিস টাইম’ ও ‘ডগইয়ার্সে’ আমরা সে-সময়ের অস্থিরতা প্রত্যক্ষ করি। সেই সময়টি শিল্পীর কাছে আলো-আঁধারিময়। ‘ডগইয়ার্সে’ আলোর বিপক্ষে অন্ধকার অবয়বগুলো মানুষের দ্বৈতরূপকে কুকুর সত্তার সঙ্গে প্রতীকায়িত করেছেন। সমকালীন প্রসঙ্গ নিয়ে আঁকা ছবিতেও কবি ও চিত্রকর শামসেত তাবরেজী কালো রং বেশি ব্যবহার করেছেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলতে চান, এ-সময়টাও আলো-আঁধারিতে ভরা। ফলে কালো রং প্রয়োগ প্রধান হয়ে উঠেছে তাঁর চিত্রপটে।
তাবরেজীর ছবি আমাদের মনে নানা বিক্ষিপ্ত ভাবনার উদ্রেক করে। তাঁর আঁকায় প্রায়শ কেন্দ্রবিন্দু অনুপস্থিত থাকায় চিত্রজমিনের সবটা জুড়ে ঘুরপাক খায় আমাদের চোখ। চিত্রপটে বাকপ্রিয় কবির হাত বড় গতিময় ও অস্থির। সেই অস্থিরতা যেন দর্শককেও স্থির থাকতে দেয় না। বর্ণলেপনে কবি-শিল্পী তাঁর পছন্দের কতক রং ব্যবহার করেছেন। কম সময় নিয়ে ছবি আঁকায় চিত্রের গভীরতা সৃষ্টি যথাযথ হয়েছে বলা যাবে না। সর্বোপরি, কবির ছবিগুলোকে আমরা একপ্রকার অ্যাকশন পেইন্টিং বলতেই পারি।
২৭ জুলাই শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি শেষ হয় ৩১ আগস্ট।