করোটিতে সংসার

মামুনুর রশীদ
হকভাই সবসময়ই সংসার শব্দটা আওড়াতেন। একবার চট্টগ্রামে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। পরদিন খুব সকালে তিনি চলে এলেন। আমি বলছিলাম, ‘চলুন বিকেলের দিকে যাই।’ উত্তরে বলে উঠলেন, ‘কালকে আমার ছবির প্রদর্শনী শুরু হবে।’ আমার প্রশ্ন, ‘আপনি ছবিও আঁকেন নাকি?’ হকভাইয়ের শান্ত উত্তর, ‘আমার নতুন সংসার।’ আমি হিসাব করে দেখলাম, কতগুলি সংসার পাতলেন তিনি? এক জীবনে কত সংসার গড়তে পারেন একজন শিল্পী?
হকভাইয়ের প্রথম প্রেম ছোটগল্পের সঙ্গে, কবিতার সঙ্গে, গদ্যের সঙ্গেও। তাদের সঙ্গে পরিণয়ে আবদ্ধ হলেন, সংসার পাতলেন। প্রথম সংসারে তাঁর পরিবারে পত্রিকা বা প্রেসের মানুষ, আস্তে আস্তে পাঠকরা তার মধ্যে ঢুকে পড়ে। অতপর ওইসব সদস্যের চাওয়া-পাওয়া বাড়তে থাকে। সাহিত্যের এই সংসারটাই ঠান্ডা, একাকী নৈঃশব্দ্যে, সাথি শুধু কাগজ-কলম, কিছু বই-পুস্তক। হৃৎকলমের টানে তা এগিয়ে চলে। সাদা কাগজের ওপর নিরন্তর কালির দাগ ফেলে যাওয়া। লেখার পর লেখা পৌঁছে যায় আরেক গন্তব্যে। সে-গন্তব্য খুবই রহস্যময়। অচেনা-অজানা পাঠকের কাছে ছাপার অক্ষরে পৌঁছে যাওয়া শব্দাবলি কীভাবে সমাদর পাবে তা একেবারেই অনিশ্চিত। পাঠককে সেই অনিশ্চিত লোকালয়ে পাঠিয়ে লেখকের প্রতীক্ষা করার উপায় নেই। আবার নতুন লেখা। দিনের পর দিন লেখককে লিখতে হয় কলমপেষা মজুরের মতো। মজুর – আবার বড়ই ভাবনাসমৃদ্ধ মজুর। করোটির ভেতর একের পর এক ভাবনাগুলি জমা হতে থাকে। তারপর হৃৎকলম নিয়ে বসেন লেখক, হৃদয়ে রঙের ছোঁয়া লাগে। সেও এক আনন্দময় অলৌকিক মুহূর্ত। সত্যিকার অর্থে এই অলৌকিক আনন্দের সন্ধান যাঁরা পেয়েছেন তাঁরাই নিঃশব্দচারী হতে পেরেছেন। সৈয়দ শামসুল হক সেই নিঃশব্দে নিসর্গ রচনা করে গেছেন সারাজীবন। জলেশ্বরী থেকে ইউরোপ – সব জায়গায় তাঁর এই ভ্রমণগাথা। ভ্রমণকাহিনি নয়, করোটিতে জমে থাকা অজস্র চরিত্রের সঙ্গে পরিচয়। আর তাই-ই উৎসারিত হয়েছে তাঁর গদ্যে, কাব্যে, উপন্যাসে।
নিঃশব্দ এই যাত্রাপথে আরেক পৃথিবীময় সংসার গড়ে ওঠে। সেখানে আছে কত মানুষ! হোমার, ইলিয়াড, গ্যেটে, নিতশে, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, মায়াকোভস্কি, শেলি, কিটস, বায়রন, শেক্সপিয়র, ইবসেন, তৌফিক আল হাকিম, শতবর্ষের নৈঃশব্দ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মার্কেস, কোথা এসে ধরা দেয় এরিয়েল ডর্ফমেন।
তারপর তাঁর সংসার চলচ্চিত্রের সঙ্গে। কাহিনি, চিত্রনাট্য থেকে পরিচালনা। এই সংসারেও অনেক মানুষ – চলচ্চিত্রের প্রযোজক, পরিচালক, সহকারী পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, সিনেমা হলের মালিক, প্রজেক্টর অপারেটর, হলের লাইট হাতে দর্শক আসনে বসানো মানুষ, চিত্রগ্রাহক, চলচ্চিত্র-পত্রিকার সাংবাদিক, সবশেষে ঢুকে পড়ে দর্শক হুড়মুড় করে। সেখানে বড্ড কোলাহল। সবাই গুরুত্বপূর্ণ তাঁর কাছে। কোলাহলে পূর্ণ হয়ে পড়ে এই সংসার। এইখানে বোঝা যায় তীব্র প্রেম শেক্সপিয়রের সঙ্গে। ছবি করলেন শেক্সপিয়রের কমেডি, কমেডি অব এররস অবলম্বনে ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো। বহুকাল আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অনুবাদ করেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন ভ্রান্তিবিলাস। ছবিটি করেছিলেন উর্দু ভাষায়। আশা করেছিলেন, অন্য ভাষাভাষী দর্শকের কাছেও ছবিটি ভালো লাগবে। ছবিটি তেমন ব্যবসাসফল হতে পারেনি। তারপরও তিনি চলচ্চিত্র ছেড়ে দেননি। লেগে ছিলেন নানাভাবে। গীতিকার, সংলাপ রচয়িতা, চিত্রনাট্যকার হিসেবে দীর্ঘদিন এই সংসারে জড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু একসময় ধসে পড়তে লাগল চলচ্চিত্র। সেই ধসে পড়ার কালে রইল কেবল তাঁর দীর্ঘশ্বাস।
আবার হঠাৎ করেই এসে যান শুধু সুদূরের শব্দমালার সংসারে। বিবিসি। শব্দের পর শব্দ নির্মাণ করে পাঠিয়ে দেন দূর-দূরান্তে। সে এক উত্তেজনাকর কাজ। বিবিসির সংবাদকক্ষেই হঠাৎ করে টের পান, করোটিতে এসে গেছে নাটক। রংপুর থেকে বহুদূরে লন্ডনে কানে বাজে হৃদয় থেকে উৎসারিত গ্রামীণ মানুষের পায়ের শব্দ, বুকের শব্দ, শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে রূপ নেয় এক নাট্যভাষা। লিখে ফেলেন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। তখন এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে চলছে যুদ্ধ। ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, লাওস। ধ্বংস, আত্মাহুতি, বিজয়, পরাজয়ের ধ্বনি থেকে শব্দ বেরিয়ে আসে হৃৎকলমের টানে।
সত্তরের দশকের শেষে চলে আসেন দেশে। উপহার দেন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় এবং প্রবেশ ঘটে নাটকের সংসারে। এরপর এই সংসারটা বড় হতে থাকে যখন নূরলদীন ধরা দেয় তাঁর কলমে। পরপর বেশকিছু নাটক যুদ্ধ এবং যুদ্ধ, এখানে এখন। আগেই বলেছি, বিশ্বসাহিত্যের প্রতি তাঁর সমান ঝোঁক। কবিদের কাছে বিশ্বকবি শেক্সপিয়র। শেক্সপিয়রের জুলিয়াস সিজারকে বাংলায় সাজান তিনি, আবার আসে ম্যাকবেথ। বাংলা সাহিত্যে ম্যাকবেথের অনুবাদ অন্যতম কীর্তি তাঁর। এর মধ্যে প্রায় মৌলিক নাটক হয়ে দাঁড়ায় মুখোশ। কতটা তিনি ডর্ফম্যানের নাটক রেখেছিলেন তা বলা যাবে না, কারণ মূল নাটকটি পড়িনি এবং প্রয়োজনও মনে করিনি। মৃত্যুর আগে অসুস্থ অবস্থায় হ্যামলেটের অনুবাদও তিনি শেষ করেন। সত্তরের দশক থেকে মৃত্যু অবধি তাঁর করোটির ভেতর নাটকের সংসারটি একেবারে রমরমা। দর্শক অপেক্ষমাণ থাকে সৈয়দ শামসুল হকের নাটক দেখার জন্যে। সাম্প্রতিককালে লেখেন নারীগণ, ইতিহাসের জীর্ণ পাতা থেকে জীবন্ত সব চরিত্র। এর মধ্যে আবার এসে গেছে রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে নিয়েও নাটক।
বাংলা নাটক নিয়ে তাঁর একটি আক্ষেপের কথা তিনি বলেছেন। বাংলা নাটকে ব্যক্তির সংকট এবং যন্ত্রণা যথার্থই অনুপস্থিত বলে তিনি মনে করতেন। সেই দীনবন্ধু মিত্র, মাইকেল, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় থেকে আজ অবধি বাংলা নাটকে ব্যাপকভাবে জনতার উপস্থিতি, এমনকি রবীন্দ্রনাথেও। নাটক তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে জনতার কণ্ঠস্বর। দ্রোহ, বঞ্চনা, মানুষের জীবনসংগ্রাম যেভাবে জায়গা পেয়েছে, তেমন করে ব্যক্তিমানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব জায়গা পায়নি। তিনি কথাটা বলেই থেমে থাকেননি। লিখেছেন ঈর্ষা। মাত্র কয়েকটি সংলাপের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা নাটক। শব্দ এবং সংলাপের ওপর কতটা মুন্শিয়ানা থাকলে এটা সম্ভব! যে-কোনো কবির ওপরই বিশ্বকবি শেক্সপিয়রের একটা প্রভাব থাকে। নাটক রচনা করতে গিয়ে তিনি কাব্যের চর্চাকে যেমন উপস্থিত করেছেন, তেমনি অবলীলায় মনোলোগ রচনা করেছেন। তাই সংলাপ গদ্যে রচিত হলেও কাব্যিক ব্যঞ্জনা অনুপস্থিত থাকেনি।
সুদীর্ঘদিন সামন্তবাদী ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে পদানত ভারতবর্ষের মানুষ স্বভাবতই সরকারবিরোধী। তাই রাষ্ট্র, সরকার, শাসক সবাই তাদের সন্দেহের বিষয়। কাজেই নাট্যমঞ্চে তারা দেখতে চায় তাদেরই আকাক্সিক্ষত একটা যুদ্ধ। সে-যুদ্ধে তারা জয়ী হতে চায়, না-হলে শাসকের প্রতি ঘৃণার উদ্রেক হোক, এটুকু তো চায়ই। নূরলদীন সেভাবেই রচিত। মানুষের পক্ষে অস্ত্রধারী যে সে-ই নায়ক। বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও। নূরলদীন তাই মানুষের স্মৃতিতে থাকে। শত শত বছর ধরে তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে যায় জনশ্রুতি হয়ে। নাটক উত্তেজনাকর। যাঁরাই নাটকের সঙ্গে যুক্ত থাকেন তাঁরা সবাই। নাটকের কুশীলবরা শুধু নন, দর্শকরাও। দর্শকরাও এই উত্তেজনাকে ভাগ করে নেন। হকভাইকেও পেয়েছিল সেই উত্তেজনায়, ঘোরে। প্রবাসে তাঁর শয্যাপাশে নাটকের লোক, ঢাকায় হাসপাতালে অগুনতি নাটকের লোকের আনাগোনা। মৃত্যুর মুহূর্তেও তাই। নাটকের লোকেরা সহজেই আপন হয়ে যায় বিষয়বুদ্ধিহীন বলে। তবে যাঁরা বিষয়বুদ্ধিও করেছেন তাঁদের মধ্যেও থাকে কিঞ্চিৎ আপনভোলা মানুষ। তাই তাঁর এই সংসারটি বড়ই কাছের, আপনার।
একটা সনাতন সংসারও ছিল। পিতা, মাতা, স্ত্রী, ভ্রাতা, ভগ্নি, সন্তান। সেই সংসারেও তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক হয়ে উঠেছিলেন তাঁর বন্ধু, লেখিকা-বন্ধু। তিনিও সংসার পেতেছেন স্বামী এবং সাহিত্যের সঙ্গে। সে-সংসারটাও বড় জ্বলজ্বলে, প্রাণবন্ত এবং সৃজনের আধার।
বৈশাখে রচিত পংক্তিমালার বিশুদ্ধ কবিটি শুধু লেখায় নয়, আড্ডায়ও অনন্য। সেই জগন্নাথ কলেজের তরুণ ছাত্রকে দেখা যায় ওয়াইজঘাটে চলচ্চিত্রকার মাহিউদ্দিন আহমেদের আড্ডায়, সদরঘাটের চিত্রালী অফিসে, বিউটি বোর্ডিংয়ে, হোটেল মিরিন্ডায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায়, মধুর ক্যান্টিনে এবং মাঝে মাঝে ঢাকা ক্লাবে। আড্ডায় কখনো মধ্যমণি আবার কখনো তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা খালেদ চৌধুরীর (প্রভু) সঙ্গে। কবিদের মধ্যে আড্ডায় আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী শহীদ কাদরী। আড্ডাও একটা বড় সংসার ছিল তাঁর। সুদূর লন্ডনে বিবিসির ক্যাফেটেরিয়ায় প্রবল আড্ডা হতো।
আমরা অবাক হয়েছি, যিনি এত আড্ডায় ব্যস্ত, তিনি এত লেখেন কী করে? লেখার একটা সংসার তিনি সযতেœ গুছিয়ে রাখেন। সেটি তিনি সাধারণত করতেন প্রত্যুষে। প্রত্যুষের সাহিত্যচর্চা ভারতীয় লেখকদের ঐতিহ্য। রবীন্দ্রনাথও তা-ই করতেন।
সৈয়দ শামসুল হকের বিশাল সাহিত্যযজ্ঞ ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। একেবারেই সম্ভব নয় তাঁর জীবনের কথা বলা। কিন্তু বিস্ময়ে হতবাক হই তাঁর করোটিতে (করোটি শব্দটি তিনি প্রায়ই ব্যবহার করতেন) কী করে এত সংসারকে ধারণ করেছেন! একটা পর্যায়ে রাজনীতিও তাঁর প্রায় সংসারে পরিণত হচ্ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরমহংসের মতো তিনি তা ছাড়িয়েও ফেলেছেন। সেটাই হয়তো হতো সবচেয়ে ভুল সংসার।
হকভাই আমাদের সঙ্গে টিনের তলোয়ার নিয়ে লড়েছেন। আজীবন তিনি থাকবেন পাদপ্রদীপের আলোয়। 