কলকাতার ছাপাই ছবি

এস এম সাইফুল ইসলাম
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ভারতবর্ষের কলকাতায় একটি সুদূরপ্রসারী ঘটনার সূত্রপাত হয়, যা ছাপাই ছবির উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বাংলা মুদ্রণশিল্পের যে সূচনা হয়েছিল, এতে ১৮১৬ সাল থেকে একটি নতুন মাধ্যম সংযোজিত হয়। এই সময়ে আনন্দমঙ্গল নামে প্রকাশিত বাংলা বইয়ে প্রথম কাঠখোদাই ও এনগ্রেভিং মাধ্যমে চিত্র বা ইলা

এচিং ১৯৩৬, সুভাষ রায়
এচিং ১৯৩৬, সুভাষ রায়

স্ট্রেশন ব্যবহৃত হয়। এরপর থেকে বাংলা বইকে আকর্ষণীয় করার জন্য সচিত্রকরণের কদর বহুগুণ বেড়ে যায়। বাংলায় প্রাচীনকাল থেকে কর্মকার, স্বর্ণকার প্রমুখ কৌলিক বৃত্তিধারী শিল্পীদের অস্তিত্ব দেখা যায়। বংশপরম্পরায় লব্ধ কারিগরি নৈপুণ্যে এই স্বর্ণকার, কর্মকারগণ বৃত্তিগত কারণে নকশা-অঙ্কনে পারঙ্গম ছিলেন। ছেনি, হাতুড়ি দিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নকশা কাটার নৈপুণ্য নিয়ে তাঁদের বংশধরগণ ক্রমে হয়ে উঠেছিলেন কলকাতার প্রাথমিক বুক-ইলাস্ট্রেটর। এর একটি প্রধান কারণ শনাক্ত করা যায়। ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট বাংলার ঐতিহ্যগত শিল্পসমূহ যখন একের পর এক ধ্বংসের পথে, তখন নতুন বৃত্তির অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কারণেই বাংলার গ্রামগঞ্জের লোকশিল্পী এই স্বর্ণকার, কর্মকারগণ ছাপাই ছবি অঙ্কনে এগিয়ে আসেন। বৃত্তিগত কারণে এসব শিল্পী ও কারিগর সমাজে অন্ত্যজ বিবেচিত হতেন এবং তাঁদের নির্মিত ছাপাই ছবিকে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা হতো। তৎকালীন শিক্ষিত সমাজ এই ছাপাই ছবিকে ‘বটতলার-ছবি’ বলে নিন্দা করতেন।
বটতলার ছাপাই ছবির শিল্পীরা কাঠখোদাইকে রেখাচিত্র হিসেবে দেখেছিলেন। মূলত আবহমান বাংলার লোকচিত্রকলার রৈখিক বৈশিষ্ট্যই এই শিল্পীরা ছাপাই ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন। বটতলার ছাপাই ছবি উঁচুদরের শিল্পরসে সমৃদ্ধ ছিল না, তবে নিঃসন্দেহে এর একটি ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যিক গুরুত্ব আছে। ঐতিহ্যিক কাঠখোদাইয়ের প্রচলিত ধারাকে ভেঙে দিয়ে গত শতাব্দীতে বেশ কয়েকজন মেধাবী চিত্রকর তাঁদের সৃজনশীল মমতার দ্বারা একটি নতুন মাত্রার উৎকৃষ্ট ধারা তৈরি করেছিলেন। কলকাতা আর্ট স্কুলের এই ছাত্রদের মধ্যে সফিউদ্দীন আহমেদ, সোমনাথ হোর, সত্যেন ঘোষাল, আদিনাথ মুখার্জি, মুরলীধর টালি ও হরেন দাস ছাপাই ছবির জগতে এবং সৃজনে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন। ভারতবর্ষের ছাপাই ছবির ইতিহাসে বিশেষত কাঠখোদাইয়ের ক্ষেত্রে উল্লিখিত এই কয়েকজন শিল্পীর ভূমিকা অপরিসীম।
সম্প্রতি গ্যালারি কায়া কলকাতার ছাপাই ছবি নিয়ে একটি বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করে (২৪ নভেম্বর-৪ ডিসেম্বর ২০১২)। ‘ছাপাই ছবি-১’ শীর্ষক এ-প্রদর্শনীতে কলকাতার খ্যাতিমান ছয়জন প্রবীণ ও নবীন শিল্পীর ৫২টি ছাপাই ছবি স্থান পেয়েছে। শিল্পীরা হলেন – হরেন দাস, অমিতাভ ব্যানার্জি, সুহাস রায়, চন্দন দাস, অতীন বসাক ও জয়ন্ত লস্কর।
শিল্পী হরেন দাস (১৯২১-৯৩) কাঠখোদাইয়ের জন্য গত শতাব্দীর চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে কলারসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন। তাঁর কাঠখোদাইয়ে আলোছায়ার বিন্যাস ও পরিপ্রেক্ষিতের নির্মাণকুশলতার জন্য তিনি খ্যাতি লাভ করেন, ছাপাই ছবিতে তিনি গ্রামীণ জীবনের নানাদিক, পল্লীবাংলার নিসর্গ ও গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনকে প্রতিভাত করেছেন। এসব ছবিতে বাস্তবের অনুপুঙ্খ চিত্রায়ণ ও শিল্পের করণকৌশলগত দক্ষতা চমৎকার প্রতিফলিত হয়েছে। হরেন দাসের কাঠখোদাইয়ের মূল শক্তি হলো দক্ষ ড্রইং ও নরুনের জুতসই ব্যবহার। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সরু ও পুরু রেখা কাঠের পাত্রে খোদাই করে যথাযথ চিত্র ফুটিয়ে তোলা নরুন প্রয়োগের দক্ষতাবিহীন একেবারেই অসম্ভব। হরেন দাসের ছবিতে এই দক্ষতা, শিল্পগুণ ও পরিশীলিত বোধ সহজেই অনুধাবন করা যায়। তাঁর চিত্রে পল্লীবাংলার নানা অনুষঙ্গ দর্শকের মাঝে একপ্রকার মনোগত সংবেদন সৃষ্টি করে, যা ছবির অন্য একটি বড় গুণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
গ্যালারি কায়ায় প্রদর্শিত হরেন দাসের বহুল পরিচিত কাঠখোদাই ‘বৃষ্টি শেষে’, ‘জলের ধারা’ ও ‘ঝঞ্ঝাটপূর্ণ অবতরণ’ শীর্ষক চিত্রগুলো বিশেষ তাৎপর্যবাহী। এছাড়া এচিং মাধ্যমে আঁকা ‘রামলীলা’ ও ‘সুখীযুগল’ শীর্ষক চিত্র দুটো উল্লেখযোগ্য। ‘রামলীলা’ চিত্রটির বর্ণনা দেওয়া যেতে পারে। এই ছবিতে খুব স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে গ্রামবাংলার একটি চিরায়ত অনুষঙ্গ যাত্রাপালার দৃশ্য। গ্রামে শামিয়ানা টানানো মঞ্চে যাত্রাপালা চলছে, অভিনয়ে মুখর নিপুণ কুশীলব। আকাশের আল্ট্রামেরিন নীল ও অন্ধকারে ছাওয়া আবহ জানিয়ে দেয় রাত অনেক বেড়েছে। যাত্রামঞ্চের উন্মুক্ত চারিদিক ঘিরে উৎসুক গ্রামবাসী দর্শকের ভিড়। ছবির মধ্যভাগে হ্যাজাক বাতির আলোয় ঝলমল করছে মঞ্চ, কুশীলব ও দর্শক, যা অনেকটা রেমব্রান্টের অপার্থিব আলোর মতো। এই ছবির আবেগময় রূপ ও নস্টালজিক অনুভূতি গভীরভাবে মন ছুঁয়ে যায়। হরেন দাসের ছাপাই ছবিতে আবহমান গ্রামবাংলার বিবিধ বিষয় ও অনুষঙ্গ যেভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিস্ফুট হয়েছে, তা শুধু অনুপম সৌন্দর্যই উন্মোচন করে না, যুগপৎ দালিলিক গুরুত্বও বহন করে।
শিল্পী অমিতাভ ব্যানার্জির (১৯২৮) ছাপাই ছবিতে দেশজ ঐতিহ্য, ইতিহাস ও মনোজাগতিক বোধের দেখা মেলে, বিষয় ও অনুষঙ্গের বিন্যাস তাঁর ছবিতে একটি বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। বস্তুত এচিং মাধ্যমে অঙ্কিত ছবির বিষয় ও শৈলী শিল্পীর স্বতন্ত্র চিত্রভাষা নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। অমিতাভ ব্যানার্জির ছাপাই ছবির গীতল জগতে একপ্রকার বিষণœ অনুভূতি ও চিন্তার খোরাক আছে, যা ছবির মূলসুর হিসেবে প্রতীয়মান হয়। ‘স্মৃতিকথা’,  ‘শিরোনামহীন’, ‘হারানো গৌরব’, ‘বনফুল’ ও ‘সন্ন্যাসী’ শীর্ষক এচিং চিত্রগুলো বোধকরি সে-বিবেচনার আওতায় আনা যায়।
কলকাতায় ষাটের দশকের খ্যাতিমান চিত্রীদের মধ্যে শিল্পী সুহাস রায়ের (১৯৩৬) ছাপাই ছবি শিল্পানুরাগীদের বিশেষ মনোযোগ অর্জন করেছে। তাঁর ছবি বস্তুত রোমান্টিক। ব্যক্তিগত আবেগ, অনুভূতি ও দৃশ্যমান জগৎকে তিনি পরাবাস্তব ও কল্পিতরূপে চিত্রে বিম্বিত করেন। ফলে চিত্রের বিষয় ও অনুষঙ্গ পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও স্বপ্ন ও সত্যের বিরোধপূর্ণ শূন্যতায় উপনীত হয়। সুহাস রায়ের ছবিতে মুখাবয়ব, বৃক্ষ, নারী-পুরুষ ত্রিভুজাকৃতির গড়ন ইত্যাদি অনুষঙ্গ ওই শূন্যতায় আদৃত থাকে।
শিল্পী চন্দন দাস (১৯৫৭) তাঁর সৃজনে একটি স্বতন্ত্র পথ নির্মাণ করেছেন। পিতা খ্যাতিমান শিল্পী হরেন দাসের কাছেই তিনি শিখেছেন শিল্পের করণকৌশল ও সৃজনের বিবিধ পাঠ। তাঁর ছবির বিষয় ও অনুষঙ্গ পরিপার্শ্ব থেকে নেওয়া। জীবনের গভীরতর বোধ, অনুভূতি ও পরিপার্শ্বের বাস্তবতায় বিস্মিত তাঁর ছবি নানাদিক থেকে তাৎপর্যময়।
চন্দন দাসের ছবিতে বাস্তবানুগ, আধা বিমূর্ত ও বিমূর্ত রীতির বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রতিভাত হয়। তাঁর চিত্রভাষা যুগপৎ আবেগময় ও বুদ্ধিদীপ্ত। নানাবিধ নিরীক্ষা ও সাধনার মধ্য দিয়ে নির্মিত তাঁর চিত্রভাষা, যা প্রদর্শনীর কাজেও প্রতীয়মান হয়েছে। ‘প্রাচীন মোটরগাড়ি ও জেব্রা ক্রসিং’, ‘সোনালী বলয়’, ‘অবসরপ্রাপ্ত’, ‘কাগজের বাঘ’, ‘পরিবার’ শীর্ষক চিত্রসমূহে ছাপাই ছবির গুণগত মান ও উৎকৃষ্ট চিত্রশৈলীর দেখা মিলেছে। চন্দন দাসের ছবির অন্তর্গত নান্দনিক বোধ ও পরিশীলিত রূপ আমাদের চমৎকৃত করে।
শিল্পী অতীন বসাক (১৯৬৬) নব্বইয়ের দশক থেকেই ছাপাই ছবির বিবিধ নিরীক্ষা ও সম্ভাবনার পথে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক চিত্রভাষা ইতিমধ্যে কলারসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছে। ছবিতে জীবনঘনিষ্ঠ বিষয় ও অনুষঙ্গের বিন্যাসে তিনি যে-জগৎ নির্মাণ করেছেন, তা শিল্পীর দক্ষতা ও চিত্রশৈলীর গুণে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। একটি চিত্রে বিষয় বা ডিসকোর্স যদি প্রয়োজনীয় দক্ষতার মধ্য দিয়ে প্রতিভাত হয় এবং শিল্পগুণে সমৃদ্ধ থাকে, তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় তা দর্শকহৃদয় ছুঁয়ে যাবে। অতীন বসাকের ছবি অনুধাবনে আমরা এরূপ অভিজ্ঞতা লাভ করি। তাঁর কাজে নগরজীবনের জটিলতা, মনোজাগতিক সংকট ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বেদনাদায়ক অস্তিত্ব বিষয়ক ভাবনা বিম্বিত হয়েছে।
‘রূপান্তর’ শীর্ষক সিরিজ চিত্রে আমরা প্রত্যক্ষ করি নিঃসঙ্গ এক সঙের বিবিধ অভিব্যক্তি ও তার পরিপার্শ্ব। নগরজীবনে প্রতিটি মানুষই যেন একেকজন দক্ষ অভিনেতা। করপোরেট সংস্কৃতি যেন সবাইকে হাস্যোদ্দীপক সঙে পরিণত করেছে।
নিখুঁত অভিনয় ও মুখোশের আড়ালে ব্যক্তিমনের হাহাকার রয়ে যায় অদৃশ্য ও অপ্রকাশিত। এ যেন আমাদের সামাজিক ও দৈনন্দিন জীবনের এক প্রতীকী চিত্র। অতীন বসাকের ছবিতে সমকালীন বাস্তবতা অর্থময় হয়ে উঠেছে।
তরুণ শিল্পী জয়ন্ত লস্কর (১৯৭৫) সাম্প্রতিক সময়ে ছাপাই ছবির জগতে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর কাজে সূক্ষ্ম বোধ ও গভীরতর চিন্তার প্রতিফলন হয়েছে। নারী-পুরুষের প্রেম, নিঃসঙ্গতাজাত হতাশা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের বিবিধ উপলব্ধি তাঁর চিত্রে উপজীব্য হয়েছে। এচিং মাধ্যমে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উন্মোচন করেছেন বিষয় ও অনুষঙ্গের অন্তর্গত রূপ, ‘লোকান্তরিত’ শীর্ষক সিরিজ চিত্রে মানব-মানবীর প্রেম, বিরহ ও বিয়োগাত্মক পরিণতির এক মর্মন্তুদ গল্প বিম্বিত হয়েছে। ‘শক্তিবর্ধক পেস্ট্রি’ শীর্ষক চিত্রে লক্ষ করা যায় জনৈক যুবকের কয়েক টুকরো পেস্ট্রি কাটার দৃশ্য। পুরো পটভূমিজুড়ে রয়েছে ভারতের অসংখ্য কাগুজে নোট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী ও স্বামী বিবেকানন্দের প্রতিকৃতি সংবলিত এই নোটগুলো ছবিতে বুদ্ধিদীপ্ত আমেজ তৈরি করেছে। জয়ন্ত লস্করের ছবির রোমান্টিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ সম্ভাবনাময়।
বিগত ষাট বছরে কলকাতার আধুনিক ছাপাই ছবির গতি ও প্রকৃতি বহুভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। নিত্য-নতুন কৌশল উদ্ভাবন, বিবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে ছাপাই ছবিতে অনেক সম্ভাবনাময় শৈল্পিক উপাদান সংযোজিত হয়েছে। সময়ের সঙ্গে বিষয়বৈচিত্র্য ও আঙ্গিকগত পরিবর্তনও চোখে পড়ার মতো, ছাপচিত্রীদের জন্য এ সবকিছু আশাব্যঞ্জকভাবে আগামীর পথ নির্মাণ করছে।