কলাভবনের শতবর্ষ রবীন্দ্রনাথ-দৃশ্যকলা সম্পর্কসূত্র

এ-বছর শামিত্মনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ-প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গ কলাভবন নামের শিল্পশিক্ষা বিদ্যালয়টির শতবর্ষ, এ-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শিল্পভাবনা ও কলাভবনের স্বাতন্ত্র্য বিষয়ে কিছু আলোকপাতের প্রয়াস প্রাসঙ্গিক হতে পারে। পাঠকক্ষের বাঁধাধরা গ– আর পাশ-ফেলের নিগড়ে বাঁধা শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি রবীন্দ্রনাথের অনাস্থা তাঁর শিক্ষাভাবনার একেবারে সূচনা থেকেই দেখতে পাই। তাঁর ভাবনাকে বাস্তব চেহারাদানের প্রয়াস ধরা আছে শামিত্মনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠচিমত্মায়। শিক্ষাকে আনন্দদায়ক করার পাশাপাশি তিনি শিক্ষার সঙ্গে যোগ করতে চেয়েছেন সংস্কৃতিবান হওয়ার সাধনাকেও। বোলপুরের পারিবারিক জমির মুক্ত ও প্রাকৃতিক পরিবেশে ১৯০১ সালে স্থাপিত ব্রহ্মচর্যাশ্রম দিয়ে তাঁর শিক্ষাব্রতের সূচনাতেই
ছবি আঁকা, সংগীত ও খেলাধুলাকে ছাত্রদের জন্য আবশ্যিক বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়। রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পিত বিশ্বভারতী নামের শিক্ষায়তনের যাত্রা ১৯২১ সালে সূচিত হলেও কলাভবন নামে দৃশ্যকলা শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় ১৯১৯ সালে। কলাশিক্ষা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব ভাবনা ও নন্দলালের প্রায়োগিক কুশলতায় কলাভবন ক্রমে ক্রমে হয়ে ওঠে বিশ্বভারতীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এবং সমগ্র ভারতবর্ষে চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়ে নব্যভারতের দৃশ্যকলাচর্চার পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান।
শামিত্মনিকেতন পত্রিকার ১৯১৯-এর অগ্রহায়ণ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ‘কলাবিদ্যা’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এর সমাপ্তিবাক্যে তিনি বলেন : ‘বিশ্বভারতী যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তবে ভারতীয় সংগীত ও চিত্রকলাশিক্ষা তাহার প্রধান অঙ্গ হইবে এই আমাদের সংকল্প হউক।’ বিশ্বভারতীর কার্যক্রম কিছুটা পরে শুরু হলেও কলাভবনে শিক্ষা কার্যক্রম ওই বছরই শুরু হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষালয়ে সংগীত ও চিত্রবিদ্যা শিক্ষাদানে কেন এত আগ্রহী ছিলেন তার খানিকটা হদিস সন্ধান করা যেতে পারে। সংগীত বিষয়ে তাঁর আগ্রহ বোধগম্য, সৃষ্টিশীলতার একেবারে অঙ্কুরোদ্গমের সময় থেকে আমৃত্যু বলা যেতে পারে সংগীত ছিল তাঁর সৃজনানন্দের অন্যতম বাহন। পারিবারিক ঐতিহ্যে বালককালে চিত্রবিদ্যা আয়ত্ত করার খানিকটা দায় তাঁর ছিল বটে, তবে কৈশোর-যৌবনে তাঁর পরিপূর্ণ অভিনিবেশ অধিকার করে রাখে কবিতা-গান-নাটক। সে মুগ্ধ-মগ্নতার জগতে চিত্রকলার তেমন ঠাঁই জোটেনি।
তবে খানিকটা পারিবারিক আবহে, খানিকটা বা ব্যক্তিগত আগ্রহে ভারতবর্ষে চিত্রশিল্পের চর্চা বিষয়ে তিনি খুঁটিনাটি খোঁজ রাখতেন, ভাইপো অবনীন্দ্রনাথকে চিত্রাঙ্কনের নানা বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। পরবর্তীকালে ব্যাপক বিদেশ ভ্রমণকালে এ-অভিজ্ঞতা আরো পোক্ত হয়ে ওঠে। তবে অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো চিত্রশিল্প বিষয়েও তাঁর মত বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। ভারতের সমসাময়িক চিত্রকলা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সুস্পষ্ট মত সম্ভবত প্রথম পাই ১৮৯৩ সালে বত্রিশ বছর বয়সে রচিত ছিন্নপত্রাবলীর পাতায়, তখনকার জনপ্রিয় চিত্রকর রবি বর্মার ছবির প্রতি মুগ্ধতার প্রকাশে। তবে এ-মত পরিবর্তিত হতে সময় লাগেনি। বিংশ শতকের সূচনাপর্বে স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ারে রবীন্দ্রনাথ নব্যবঙ্গীয় চিত্রধারার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলেও শিগগির এ-মত থেকেও সরে আসেন। ১৯১৬ সালে জাপান-ভ্রমণ তাঁকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করে আর জাপানি শিল্পে তিনি অনুভব করেন প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে শিল্পের অঙ্গাঙ্গী যোগ, সেইসঙ্গে নিজেদের অতীতচারী শিল্পচর্চার অপ্রাসঙ্গিকতা।
জাপান ও আমেরিকা ফেরত রবীন্দ্রনাথ এরপর কলকাতার সঙ্গে বাঁধন আলগা করে শামিত্মনিকেতনে তাঁর কাঙিক্ষত শিক্ষালয়টি প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দেন। কৌতূহলোদ্দীপক হলো, কলাভবন নামের শিল্পবিদ্যালয়টি স্থাপনে তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র, তখনকার সর্বভারতের সবচেয়ে খ্যাতিমান শিল্পী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনো পরামর্শ বা সাহায্য নেননি, তাঁকে নিজের প্রতিষ্ঠানে কখনো আহবানও করেননি। বরং নন্দলাল বসুকে অবনীন্দ্রনাথের কাছ থেকে কিছুটা ছিনিয়েই শামিত্মনিকেতনে নিয়ে এসেছিলেন। ১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের সূচনা থেকেই চিত্রবিদ্যাশিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের চিমত্মা বা পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার মতো শিক্ষক ছিল দুর্লভ। বেশ কিছু নিয়োগ ও বাতিলের পর ১৯১৪ সালে জ্ঞাতি-দৌহিত্র শিল্পী অসিতকুমার হালদার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন পূর্ণতা পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। কিন্তু দু-বছর পর অসিতকুমার কলকাতা আর্ট স্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দিলে ১৯১৭ সালে বিশিষ্ট শিল্পী সুরেন্দ্রনাথ কর শামিত্মনিকেতন বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সুরেন্দ্রনাথ শুধু চিত্রকলাশিক্ষায় নিযুক্ত ছিলেন তা নয়, রবীন্দ্রনাথের প্রণোদনায় হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য সমন্বিত করে শামিত্মনিকেতনে দেশীয় প্রতিবেশের উপযোগী স্থাপত্যকলার নিজস্ব ঘরানা গড়ে তোলেন। ১৯১৯ সালে কলাভবন স্থাপিত হলে রবীন্দ্রনাথের আহবানে কলকাতার ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্টের চাকরি থেকে পদত্যাগ করে শিল্পী নন্দলাল বসু প্রতিষ্ঠানটির মূল দায়িত্বে যোগ দেন। এতে প্রতিষ্ঠানটির অবয়বে যেন রবীন্দ্রনাথের আকাঙক্ষা রূপলাভ করে উঠতে শুরু করে।
রবীন্দ্রনাথের প্রণোদনায় নন্দলালের শিল্পভাবনায়ও ঘটে ব্যাপক পরিবর্তন। যে-নন্দলাল ধর্ম, পুরাণ, ইতিহাস, কাব্যের মহীয়ান দৃশ্যরূপ নির্মাণকেই শিল্পের কর্তব্য বলে ধরে নিয়েছিলেন, তিনি রবীন্দ্রনাথের সাহচর্যে এসে তাঁর চিত্রের বিষয় হিসেবে আকৃষ্ট হলেন পরিপার্শ্বের স্পন্দমান জীবনে; অতিসাধারণ কর্মজীবী মানুষ, প্রকৃতি, জীবজগৎ, এমনকি পোকামাকড় রূপায়ণে। নিত্যের মধ্যে চিরায়তের রূপানুসন্ধানের চোখ খুলে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। নন্দলালের সুযোগ্য পরিচালনায় কলাভবন হয়ে উঠল বিশ্বভারতীর সর্বপ্রধান অঙ্গ। রবীন্দ্রনাথের প্রশ্রয়ে আর নন্দলালের পরিচর্যায় বিকশিত হয়ে উঠলেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় ও রামকিঙ্কর বেইজের মতো সর্বভারতের অগ্রগণ্য চিত্রী ও ভাস্কর।
তাঁর শিক্ষালয়টির নাম বিশ্বভারতী স্থির করার পেছনে ভারতবর্ষের সঙ্গে গোটা বিশ্বের প্রাণের যোগই যে রবীন্দ্রনাথের আকাঙিক্ষত ছিল, সেটি উল্লেখ না করলেও চলে। কলাভবনেও তাঁর প্রয়াস ছিল মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে সমকালীন জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন প্রাচীন ভারতশিল্পের অন্ধ অনুবর্তন নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের প্রাচীন ও আধুনিক শিল্পধারার সঙ্গে পরিচিত হয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংশ্লেষে একটি সমকালীন ও প্রাসঙ্গিক আধুনিক ভারতীয় দৃশ্যশিল্পের রূপ নির্মাণ। এর কান্ডারি হিসেবে তিনি নন্দলাল ছাড়া আর কাউকে উপযুক্ত মনে করেননি। এজন্য তিনি নিজের বইপত্র ও বিভিন্ন উপায়ে সংগ্রহ দ্বারা কলাভবনে গড়ে তোলেন তৎকালীন ভারতবর্ষের সমৃদ্ধতম পাঠাগার, নিজে উদ্যমী হয়ে গড়েন শিল্পের সংগ্রহশালা, লোকশিল্পের নিদর্শনভান্ডার, নন্দলাল ও তাঁর শিষ্যদের সম্পৃক্ত করেন বিশ্বভারতীর সকল সম্মেলক কর্মকা–র শৈল্পিক রূপায়ণে, কলাভবনের পাশাপাশি কারুশিল্পের প্রসার-ভাবনায় প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীনিকেতন।
কলাভবনকে পূর্ব-পশ্চিমের শিল্পধারার সত্যিকার চর্চাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ ভিয়েনা থেকে শিল্প-ইতিহাস বিশেষজ্ঞ স্টেলা ক্রামরিশকে কলাভবনে যোগদান করতে আমন্ত্রণ জানান। ওইসময় ভারতের কোনো বেসরকারি শিক্ষালয়ে এটি ছিল অভাবিত ঘটনা। ক্রামরিশের সস্নাইডসহ আধুনিক য়ুরোপীয় শিল্পকলাবিষয়ক বক্তৃতাগুলো কলাভবনের সকল ছাত্র-শিক্ষকের জন্য আবশ্যকীয় ঘোষণা করা হয় এবং এসব
বক্তৃতায় প্রায়শ রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের পৃষ্ঠপোষকতায় কলাভবন হয়ে ওঠে যে-কোনো সুযোগে দেশি-বিদেশি চিত্রকর, কারুশিল্পী, সমাজকর্মী বা বক্তার খ-কালীন শিক্ষকতার ক্ষেত্র। এর ধারাবাহিকতায় আসেন ফরাসি চিত্রশিল্পী অঁদ্রে কার্পেলেস, তাঁর বোন শিল্পতাত্ত্বিক সুজান কার্পেলেস, চার্লস ফ্রিয়র অ্যান্ড্রুজ, হাঙ্গেরীয় শিল্পী লিজা ফন পট, মূর্তিকলার শিক্ষক মার্গারেট মিলওয়র্ড, ব্যার্গমেন প্রমুখ। অঁদ্রে কার্পেলেস শেখান য়ুরোপীয় ভিত্তিচিত্র রচনপদ্ধতি ও তেলরঙে চিত্রাঙ্কন আর কাঠখোদাই চিত্র, মার্গারেট মিলওয়র্ড ও লিজা ফন পট শিক্ষা দেন পশ্চিমা পদ্ধতিতে মূর্তিরচনা। প্রায়-লুপ্ত ভারতীয় পদ্ধতির ভিত্তিচিত্র শেখানোর জন্য জয়পুর থেকে আনা হয় কারিগর, ঐতিহ্যিক রীতির তিববতীয় তন্খা চিত্র অঙ্কন শেখানোর জন্য আসেন একজন তিববতি শিল্পী, ঢালাই কাজের জন্য বীরভূম থেকে কারিগর, চীনা রীতির চিত্রাঙ্কন শেখানোর জন্য চীন থেকে আসেন ইয়াউ উয়ান শান। ভাবতে অবাক লাগে, বিশ্বভারতীর চরম অর্থাভাব ও কৃচ্ছ্রের যুগে কী করে সম্ভব হয়েছিল এত বড় কর্মযজ্ঞ। রবীন্দ্রনাথের অনমনীয় সংকল্প আর নন্দলালের নেতৃত্বের গুণ ছাড়া সকলের মধ্যে এ-উদ্দীপনা সৃষ্টি সম্ভব ছিল না। শামিত্মনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নপূরণের কর্মযজ্ঞে নন্দলাল ছিলেন তাঁর প্রধান সহায়। তাঁর নেতৃত্বে কলাভবন হয়ে ওঠে বিশ্বভারতীর মুকুটের উজ্জ্বলতম পালক। শিক্ষক হিসেবে ছাত্রের সৃজনশীলতার বিকাশকে তিনি নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন। পুরো বিশ্বভারতীতে তিনি ছিলেন সর্বজনীন মাস্টারমশাই। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রামকিঙ্কর বেইজ, দিনকর কৌশিক, সুধীররঞ্জন খাস্তগীর, শঙ্খ চৌধুরী, কে. জি. সুব্রহ্মণ্যন, জয়া আপ্পাস্বামী, কৃষ্ণ রেড্ডি, সত্যজিৎ রায় প্রমুখ খ্যাতিমান তাঁদের স্বকীয়তা অর্জনের পথে নন্দলালের প্রণোদনার ঋণ স্বীকার করেছেন। সত্যজিৎ রায় বলেছেন, নন্দলালের শিক্ষা ছাড়া তিনি পথের পাঁচালী বানাতে পারতেন না।
আজ শতবর্ষ পার হওয়ার পর সে-কলাভবন যে আগের মতো থাকবে না সেটি বলাই বাহুল্য। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হলে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিশ্বভারতীর আচার্য করা হয়, কিন্তু দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে কলাভবনের শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে গুরু-শিষ্যের মতের মিল হয়নি। ১৯৪৬ সালে অবনীন্দ্রনাথ পদত্যাগ করলে সরোজিনী নাইডুকে আচার্য করা হয়; কিন্তু তিনি শামিত্মনিকেতনে বাস করেননি। ১৯৫১ সালে নন্দলাল অবসর গ্রহণ করলেন। ওই বছরই বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অধিগৃহীত হয়। বলা যেতে পারে, এর মধ্য দিয়ে কলাভবনও রবীন্দ্রযুগ পার হয়ে ভিন্নতর যাত্রাপথে অগ্রসর হয়েছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবেও কলাভবন প্রায় সত্তর বছর ছুঁতে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষাসদনে বাঁধাধরা পাঠক্রম বা
ডিগ্রি-ডিপেস্নামা রাখতে চাননি। শিক্ষার বিশেষায়ণেরও (স্পেশালাইজেশন) তিনি বিরোধী ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষা হবে সর্বভাবনার সম্মেলক। কলাভবনেও নন্দলাল শিল্পকলা-শিক্ষাকে বহুমাত্রিক করতে চেয়েছেন; চেষ্টা করেছেন, ছাত্র দৃশ্যকলার নানান মাধ্যমের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে নিজের এলাকা নির্বাচন করে নেবে। কালের পরিবর্তনে নন্দলালের নিজের সময়কালেই কলাভবনকে অনেক নিয়মের আওতায় আনতে হয়েছে। আজ এটি হয়তো অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই বিশেষায়ণ ও ডিগ্রি-ডিপেস্নামার নিয়মে বাঁধা, তবু এর সব স্বাতন্ত্র্য একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে – এমন ধারণাও সঠিক নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-প্রতিষ্ঠিত শামিত্মনিকেতনের কলাভবন এখনো সর্বভারতে দৃশ্যকলা শিক্ষার একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত, এখানে শিক্ষা গ্রহণ করে ভারতে অগ্রগণ্য শিল্পী ও শিল্পবেত্তা হিসেবে অনেকেই সক্রিয় রয়েছেন।
কলাভবন ছিল ঔপনিবেশিক শিল্পশিক্ষারীতির বিরুদ্ধে বিকল্প দেশীয় শিল্পশিক্ষা, ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ ও প্রত্যুত্তর। এটি হয়তো কৌতূহল-জাগানিয়া হতে পারে যে, ১৯১৯ সালেই জার্মানির ওয়েইমারে স্থাপিত হয়েছিল বাউহাউস নামের একটি ভিন্নধর্মী শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ-বছর বাউহাউসেরও শতবর্ষ। উদ্দেশ্যের বিভিন্নতা থাকলেও প্রচলিত ব্যবস্থার বিরোধী ভাবনায় এদের সাদৃশ্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আরো উল্লেখযোগ্য হলো, ১৯২২ সালে কলকাতায় বাউহাউস শিল্পীদের একটি প্রদর্শনী হয়েছিল, যার আয়োজনে রবীন্দ্রনাথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। এটি ছিল শিল্পকলার ইতিহাসে প্রাচ্যদেশে কোনো পাশ্চাত্যশিল্পের প্রথম প্রদর্শনী। কলাভবনের শতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ প্রতিভাত হয়ে ওঠেন আরো এক নতুন তাৎপর্যে।