কলু-সমাজকেন্দ্রিক চলচ্চৈত্রিক উপন্যাস

যে -কোনো চলচ্চিত্র অধ্যয়নের সময় চলচ্চিত্রটিকে ধারাভুক্ত করার প্রয়োজন পড়ে। প্রত্যেক ধারারই কিছু নির্দিষ্ট মৌল প্রবণতা-বৈশিষ্ট্য থাকে, যেগুলো বিবেচনায় রাখলে অধ্যয়নতব্য চলচ্চিত্রটিকে অধ্যয়ন করা সহজ হয়। কাজী মোরশেদ (২৪ এপ্রিল ১৯৫০- অক্টোবর ২০১৪) পরিচালিত ঘানি দর্শনের পর মনে হয়েছে এর আখ্যান-কাঠামো ও নির্মাণশৈলীতে ইতালীয় নব্য-বাসন্তববাদী চলচ্চিত্রধারা ও ফরাসি নবতরঙ্গের কিছু বৈশিষ্ট্যের পরিচ্ছাপ বিদ্যমান। প্রথমটি গত শতকের চারের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৪৩-৫৫) শুরু হয়ে পাঁচের দশকের শেষ প্রাস্তে এসে শেষ হয়ে যায়। নব্য-বাসন্তববাদী ধারা ইতালিতে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়লেও এরই অভিঘাতে ফরাসি দেশে তা আবার নবরূপে আবির্ভূত হয় গত শতকের ছয়ের দশকে, বিশেষত ফ্রাসোয়াঁ ক্রুফো, ক্লদ শ্যাব্রল, জ্যঁ লুক গদার প্রমুখের চলচ্চিত্র নির্মিতিতে – যাকে ‘ফরাসি নবতরঙ্গ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

চলচ্চিত্র-ধারাগুলোর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, কোনো ধারাই বেশি বছর স্থায়ী হয়নি। পাঁচ-দশ বছর টিকে থেকে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। তাই বলে ধারাগুলোতে চলচ্চিত্র নির্মাণের যেসব মৌল প্রবণতা ছিল, সেগুলো মজে যায়নি। অন্য কোনো দেশে, অন্য কোনো সমাজবাসন্তবতায় নির্মিত চলচ্চিত্রে সে-ধারাগুলোর কোনো কোনো মৌল বৈশিষ্ট্য ফিরে ফিরে এসেছে। ঘানিতে যেমন ইতালীয় নব্য-বাসন্তববাদী ও ফরাসি নবতরঙ্গের কিছু বৈশিষ্ট্য ফিরে এসেছে বলে আমার ধারণা। এই ধারণাকে পরখ করার জন্য চলচ্চিত্রটিকে পাঁচটি দিক থেকে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন এর আখ্যানের বৈশিষ্ট্যটি কী রকম; এর অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলো তথা এর দৃশ্যমাত্রা, শব্দমাত্রা, সম্পাদনাগত মাত্রাগুলো কীভাবে সংগঠিত হয়েছে এবং এর তাৎপর্যগতমাত্রার দিকগুলোতে নির্মাতা কোন ধরনের বক্তব্যের প্রবাহ সৃষ্টি করেছেন।

আখ্যানের বৈশিষ্ট্য

ঘানিতে কলু-সমাজের একেবারেই বাসন্তবচিত্র বিদ্যমান। নব্য-বাসন্তববাদী চলচ্চিত্রধারা যে-ধাঁচের কাহিনির প্রস্তাব করে, এর কাহিনি-কাঠামো তার সঙ্গে যায়। এর আখ্যান কোনো গল্প বা উপন্যাস থেকে নেওয়া নয়। এটি সম্পূর্ণভাবে বাসন্তব একটি ঘটনার সঙ্গে কাজী মোরশেদের নিজের কল্পনার মিশেলে সৃষ্ট। বাসন্তব ঘটনাটি সম্পর্কে তিনি একুশে টিভিতে প্রচারিত একটি প্রতিবেদন থেকে অবগত হন। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছিল ময়মনসিংহের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের ঘটনা। সেই গ্রামে কলু সম্প্রদায়ের এলাকার এক বাড়িতে ঘানি টানে গরুর বদলে সেই বাড়ির বউরা এবং এই কাজের জন্য একই ব্যক্তি একের পর এক বিয়ে করে। তাদের যুক্তি ছিল, গরু কিনতে অনেক টাকা লাগে, কিন্তু বিয়ের জন্য লাগে না। তাই বিয়ে করে এনে ঘানি টানানোর কাজটা বউদের দিয়েই করায়। এতে যা রোজগার হয় তা দিয়ে ওরাও খায়, বউরাও খায়। এই প্রতিবেদনটিই চলচ্চিত্র পরিচালক কাজী মোরশেদকে ঘানির আখ্যান রচনায় অনুপ্রাণিত করে।

২০০৪-০৫ অর্থবছরে ঘানি সরকারি অনুদান পায়। বাংলাদেশের একটি বৃহৎ শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী কলু-সম্প্রদায়। সময়ের বিবর্তনে এবং যান্ত্রিক আগ্রাসনে এ-সম্প্রদায় আজ বিলুপ্তির পথে। বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এমনি এক কলু-সমাজের সুখ-দুঃখ আর আনন্দ-বেদনা নিয়ে রচিত হয়েছে এই চলচ্চিত্রের আখ্যান। আখ্যানটি এরকম :

নিমতলী গ্রামের কলুপাড়ার একটি পরিবারকে ঘিরে আখ্যান আবর্তিত হয়। একটি পরিবারের কর্তা আফসু। তার ছেলে কুদ্দুস ঢাকা শহরে শাকসবজি বিক্রি করে। প্রতি সপ্তাহে একবার গ্রামে এসে মা-বাবাকে দেখে যায়। আফসুর স্ত্রী সালেহা বহু কষ্টে সংসারটার হাল ধরে রেখেছে। আফসু আর সালেহার স্বপ্ন আটাশির বন্যায় যে-ঘানি তারা হারিয়েছে, কুদ্দুস গ্রামে ফিরে সেই ঘানি আবার বসাবে। কুদ্দুস বিয়ে করবে, বাড়িতে নতুন বউ আসবে ইত্যাদি। আফসুর ছোট ভাই শামসু। আটাশির বন্যায় তার ঘানিটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তার স্ত্রী রোকেয়ার ভাই অনুগ্রহ করে একটা ঘানি আর বলদ কিনে দেওয়ায় আজ তার সংসারটা কোনোভাবে ঘানি ঠেলে চলেছে। শামসুর একমাত্র ছেলে বজলু। দিন-রাত এই ঘানির পেছনেই লেগে থাকে। শামসু মনেপ্রাণে চায়, কুদ্দুস ঢাকার পাট চুকিয়ে গ্রামে চলে আসুক। আরেকটা ঘানি বসাক। তাহলে একই বাড়িতে দুটো ঘানি চলবে। তখনই ঢাকা থেকে লাশ হয়ে ফেরে কুদ্দুস। হরতালের সময় কারা যেন বোমা মেরেছিল। আর সেখানে তার লাশ পড়ে গিয়েছিল। কুদ্দুসের মতো একটা নিরীহ ছেলেকে কেন এভাবে জীবন দিতে হলো তা বুঝতে পারে না আফসু, বুঝতে পারে না কলুপাড়ার কেউই। বজলু অন্য গ্রামের ময়না নামে একটা মেয়েকে পছন্দ করে। হঠাৎ করেই ময়নার একটা বিয়ের প্রস্তাব আসে। ময়নাকে যে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় সে বয়সে ময়নার বাবার চেয়েও বড়। ময়না ছুটে আসে বজলুর কাছে। বজলু ময়নাকে আশ্বসন্ত করে যে, একটা ব্যবস্থা সে করবেই। সুদে টাকা ধার করে বজলু ময়নাকে বউ করে ঘরে তুলে আনে। তারপর থেকে ওদের দিন ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই বজলুদের ঘানির বলদটা চুরি হয়ে যাওয়ায় ঘানি টানা বন্ধ হয়ে যায়। বজলু নতুন একটা বলদ কেনার জন্য অর্থ সংগ্রহে বাড়ির বাইরে বের হয়। তার বাবা শামসু উপায় না দেখে নতুন বউ ময়নাকে এক রাতেই কলুর বলদ বানিয়ে ফেলে। বজলু ফিরে এসে সবকিছু জানতে পেরে মা-বাবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। কিন্তু বলদ কেনার টাকা জোগাড় করতে না পেরে নিজেই কলুর বলদ হয়ে ঘানি টানে, এ-দৃশ্য দেখে তার সাহায্যে এগিয়ে আসে ময়না। দুজনে মিলে টেনে চলে ঘানি। এগিয়ে চলে মানুষের বাঁচার আকাঙক্ষা-সংবলিত সম্মিলিত যাত্রা। এভাবেই শেষ হয় ঘানির আখ্যান।

নবতরঙ্গের প্রবক্তারা অন্যের উপন্যাস-গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের বদলে স্বকল্পিত থিম-গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তাব করেছেন এবং সে-পথেই তাদের চলচ্চিত্রকর্ম সৃষ্টি করেছেন। ঘানির আখ্যানও নব্য বাসন্তবতা ও নবতরঙ্গ-প্রস্তাবিত বৈশিষ্ট্য মেনে রচিত। তবে নির্দিষ্ট কোনো ধারা অনুসরণ করে যে কাজী মোরশেদ তাঁর আখ্যানটি দাঁড় করিয়েছেন তা নয় – এটা তার অজাস্তেই ঘটেছে। এখন আখ্যানের বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করার প্রশ্ন উঠাতেই সমবৈশিষ্ট্যপূর্ণ গল্প-ধারার নজির খুঁজতে হচ্ছে। খুঁজতে গিয়ে ঘানির আখ্যানের চরিত্রের সঙ্গে নব্য-বাসন্তববাদী ও নবতরঙ্গ চলচ্চিত্র-আন্দোলনের আখ্যানের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। দেখা গেছে, নব্য-বাসন্তববাদের কিছু উপষঙ্গ এর আখ্যানভাগে রয়েছে। এতে স্টার্ক রিয়েলিটি, হার্শ-ক্রুড রিয়েলিটি, ‘বাসন্তবভাঙা বাসন্তব’ বিদ্যমান।

ধ্রুপদী বাসন্তববাদ ঘানির আখ্যানে প্রাধান্য পায়নি। কারণ শুধু বাসন্তববাদকে সম্বল করে শিল্প হয় না, বাসন্তববাদের প্রবল বন্ধন ভেঙে বের হতে না পারলে কোনো কর্ম শিল্প-পদবাচ্য হয়ে ওঠে না। কাজী মোরশেদ বাসন্তব ভাঙার চেষ্টাই ঘানিতে করেছেন। তাই পাশের বাড়ির ভাবি কে? বা কুদ্দুস মারা যাওয়ার পর তার বাবা আফসুর সংসার কীভাবে চলে তা চলচ্চিত্রকার আখ্যানে স্পষ্ট করেন না। বস্ত্তত আখ্যানে বাসন্তবতার পুনরুৎপাদন করেননি কাজী মোরশেদ – বাসন্তবতার সৃষ্টিশীল ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। আখ্যানকে কাহিনির মায়াবী মোড়কে ঢেকে দেননি। বরং নিজ ঘরে বন্দি ইরানের চলচ্চিত্রকার জাফর পানাহির মতো সংসার, সমাজ, রাষ্ট্রে শ্রম ও নারীর অধসন্তন অবস্থানকে তুলে ধরেছেন। তাছাড়া চলচ্চিত্রে সমাজবাসন্তবতার যথাযথ প্রতিফলন মানে নারী-চরিত্রের বিশ্বসন্ত উপস্থাপনা – ঘানিতে সে-উপস্থাপনা দেখা যায়।

এ-আখ্যানে একটি দরিদ্র কলু-পরিবারের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ-আশা-আকাঙক্ষা-সংকট ঘূর্ণায়মান ঘানির সঙ্গে প্রতীকাবদ্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে যান্ত্রিক ঘানির আগ্রাসনে বিলীয়মান একটি সম্প্রদায়ের বাসন্তব অবস্থার চলচ্চৈত্রিক উপস্থাপনও ঘটেছে। তাতে আখ্যানটি শুধু ব্যষ্টিগত সন্তরের না-হয়ে সমষ্টিগত সন্তরের হয়ে উঠেছে; কাজী মোরশেদের আশা-সঞ্চারী সংগ্রামী জীবন-ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছে; সমসন্ত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও যে সামষ্টিক জীবনপ্রবাহকে এগিয়ে নিতে হবে, সেই অগ্রসরমানতার স্পৃহা প্রকাশিত হয়েছে; গ্রামীণ সমাজবাসন্তবতায় মানুষের মধ্যকার মানবিক সম্পর্ক-ব্যবস্থার দিকগুলো পিতা-পুত্র-মাতা-পুত্রবধূ-প্রতিবেশী – সবার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। সম্পর্ক-ব্যবস্থায় চিড় দেখা দিলেও এগিয়ে যেতে হলে যে সম্মিলিত যাত্রার বিকল্প নেই, এ-কথাই ব্যক্ত হয়েছে চলচ্চিত্রটিতে। রাজনৈতিক বাসন্তবতার প্রকাশও ঘটেছে ঢাকায় হরতালের সময় বোমার আঘাতে কুদ্দুসের মৃত্যু-প্রসঙ্গে। এ সূত্রে বলা চলে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাসন্তবতার দিকটিও এই চলচ্চিত্রে এনেছেন কাজী মোরশেদ।

চলচ্চিত্রের আখ্যানে কোনোকিছু লয়প্রাপ্ত হলে, কারো মৃত্যু হলে বা কোনো চরিত্র আখ্যান থেকে নেই হয়ে গেলে আখ্যানে অস্থিরতা দেখা দেয়। ঘানিতে বেশ কয়েকটি এরকম ঘটনা ঘটে। যেমন কুদ্দুসের মৃত্যু হয়; ফলে আফসু স্মৃতিভ্রষ্ট হয়; বলদ চুরি যায়; পাশের বাড়ির ভাবির পিতার অসুখ হলে সে চলে যায়; বজলুর ধরা পড়ায় ঘানি পরিবারের বিপদ বাড়ে ইত্যাদি। একটিই মৃত্যু সংঘটিত হয় ঘানিতে। আফসুর একমাত্র পুত্র কুদ্দুস মারা যায় ঢাকায় মিছিলে বোমা বিস্ফোরণে। মৃত্যু আখ্যানকে এগিয়ে দেয়, ঘানিতেও তাই হয়েছে, কুদ্দুসের বাবা পুত্রশোকে মতিচ্ছিন্ন হয়েছে। কুদ্দুস এই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য ছিল। কথা ছিল সে ‘বাড়ি’ ফিরে এসে ঘানি কিনবে, বলদ কিনবে। কিন্তু তার মৃত্যু-আখ্যানে অস্থিরতার জন্ম দেয়, আবার এগিয়েও দেয়।

আখ্যানের শেষ দৃশ্যে বাসন্তবের অতিরঞ্জনের আশ্রয় নিয়ে নির্মাতা তাঁর বক্তব্য বিবৃত করেছেন – এতে তাঁর চলচ্চিত্রটি অন্য মাত্রা পেয়েছে এবং ‘অন্য চলচ্চিত্র’ হয়ে উঠেছে। বাসন্তব থেকেই শুরু, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাসন্তবের গ– অতিক্রমের মাধ্যমে চলচ্চিত্রশিল্পের অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলোকে প্রতিস্থাপন করে কাজী মোরশেদ অতিরঞ্জনের আশ্রয়ে প্রতিকায়িত করেছেন তার বক্তব্য-বিষয়কে তথা মানুষের সম্মিলিত যাত্রার অবশ্যম্ভাবিতাকে। আশাবাদের যে-অভিপ্রায় চলচ্চিত্রটিতে ব্যক্ত হয়েছে তা এর আখ্যানের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য, যা নব্য-বাসন্তববাদ ও নবতরঙ্গধারায় নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

 

দৃশ্যমাত্রা

অন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে নব্য-বাসন্তববাদ ও নবতরঙ্গধারার চলচ্চিত্রের লোকেশন-শুটিংয়ের সঙ্গে যথেষ্ট সাযুজ্য আছে। এ চলচ্চিত্রের দৃশ্যমাত্রার সবটাই লোকেশননির্ভর। লোকেশন বাছাই করার ক্ষেত্রেও নব্য-বাসন্তববাদী চলচ্চিত্রধারার প্রধান প্রবণতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে – কাহিনির সঙ্গে যায় এমন লোকেশনেই ঘটনাগুলো চিত্রায়িত হয়েছে। লোকেশন, চলচ্চিত্রে নিজেই বড় একটি চরিত্র। ঘানিতে লোকেশন একটি চরিত্র বলেই প্রতিভাত হয়েছে।

আরো ভালো হতো যদি একই ধরনের অন্য দু-একটি কলু-পরিবারের চালচিত্র এ-চলচ্চিত্রে বিধৃত হতো, সামান্য সময়ের জন্য হলেও। এই ধরনের/ ধারার চলচ্চিত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অবস্থান-অংশগ্রহণ জরুরি। এটা নব্য-বাসন্তববাদী চলচ্চিত্রধারার একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্যও বটে। কিন্তু ঘানিতে কলু-সম্প্রদায়ের একটি বড় পরিবারকে দেখা গেলেও অন্য কোনো স্থানীয় প্রতিনিধি-দৃষ্ট হয় না। হলে পরে কাহিনি-আখ্যানটি অধিকতর বিশ্বাস্য হয়ে উঠত। চরিত্রবর্গ যদি নতুন শাড়ি, গেঞ্জি, লুঙ্গি, গামছা ব্যবহার না করত, তাহলে আখ্যানটি আরো বাসন্তব হয়ে উঠত।

তবে অভিনয়কর্মে নিজ নিজ চরিত্রে প্রায় সবাই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। দৃশ্যমাত্রা সংগঠনে অভিনয় বিরাট ভূমিকা পালন করে। এই চলচ্চিত্রের অভিনয় বাসন্তবধর্মী। আঙ্গিক ও বাচিক অভিনয় দিয়ে রাইসুল ইসলাম আসাদ (শামসু), ডলি জহুর (রোকেয়া-শামসুর বউ), আরমান পারভেজ মুরাদ (বজলু), মাসুম আজিজ (আফসু), নাজনীন হাসান চুমকী (ময়না) ঘটনাখ-গুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন; তাদের মানসিক টানাপড়েন-আশা-নিরাশা-সংকট-স্বপ্নের প্রকাশ ঘটিয়েছেন; মানবিক সম্পর্কগুলোর ভাঙা-গড়ার মুহূর্তগুলো বাসন্তবানুগ করেছেন।

বিশেষ করে আফসু চরিত্রে মাসুম আজিজ তার পুত্র কুদ্দুসের মৃত্যুতে শোকার্ত পিতার বাচিক ও আঙ্গিকগত অভিনয়ে সন্তান হারানোর বেদনা-শোককে এমনভাবে প্রকাশ করেন, যা দর্শক-মননে সমান অভিঘাত তৈরি করে। পুত্রের লাশ গ্রামে এলে আফসুর মধ্যে পাগলামি দেখা দেয়, অভিনয়গুণে জীবন্ত হয়ে ওঠে চরিত্র-পরিস্থিতিটি। ক্যামেরা তখন যেভাবে প্রকৃতিতে আছড়ে পড়ে, তা চলচ্চৈত্রিক মুহূর্ত তৈরিতে দারুণ অবদান রেখেছে। আমরাও পরিচালকের চলচ্চিত্রাঙ্গিকে দখলের প্রমাণ পাই। এর রাতের সিকোয়েন্সগুলোও দারুণভাবে নির্মিত। এক্ষেত্রে বলা দরকার যে, এসব দৃশ্যে আলোক-পরিকল্পনার কাজটি যথাযথভাবে নিষ্পন্ন করা হয়েছে। চলচ্চিত্রে অন্ধকারও যে আলো দিয়ে নির্মাণ করতে হয় তা ঘানির রাতের দৃশ্যগুলো দেখলে বোঝা যায়।

প্রসঙ্গক্রমে কয়েকটি দৃশ্যমাত্রার কথা বলা যায় : পুত্রবধূ ময়নাকে ঘানি টানানোর কাজে লাগানোর পূর্বমুহূর্তে আসাদের মধ্যে যে-দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, তার পেছনে লুকানো পিতৃহৃদয়ের স্নেহের প্রকাশ ঘটে তার দ্বিধান্বিত সংলাপ-প্রক্ষেপণ ও চোখের উদাস-শূন্য চাহনিতে। পারিবারিক সম্পর্কের অবনতির যন্ত্রণা আসাদের তৈরি কিছু নিঃশব্দ মুহূর্তের ভেতর দিয়ে বাঙ্ময় হয়েছে। রোকেয়ার চরিত্রে ডলি জহুর নিম্নণ ও উচ্চৈঃস্বরিক অভিনয়ের মাধ্যমে কলুজীবনের অভাবজনিত ক্ষুদ্রতার যেমন প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তেমনি চিরন্তন মাতৃরূপের প্রকাশও ঘটিয়েছেন।

শেষ দৃশ্যে ময়নার ঘানি টানা, তার অভিব্যক্তি, পরের ক্লোজ শটে তেলের ফোঁটা পড়ার দৃশ্য, সঙ্গে হামিংয়ের ব্যবহার, সবকিছুর একত্র বন্ধনে যে-বেদনাঘন মুহূর্তের চলচ্চৈত্রিক বর্ণনা পাওয়া যায়, তা ধ্রম্নপদী উপন্যাসের কোনো প্যারা পড়ার অনুভব তৈরি করে। বাবা ও ছেলে যখন শর্ষের দানার বস্তা কাঁধে নিয়ে ঘরের দাওয়ায় ফিরে আসে, তখন ক্যামেরা ক্রেনে বসানো, ক্রেন ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসে, দৃশ্যের মাত্রিক ব্যবহার করে যে-পরিবেশ রচনা করেছেন চলচ্চিত্রকার, তা অক্ষরভিত্তিক শিল্পমাধ্যম উপন্যাসে মনে হয় না সম্ভব। এখানেই চলচ্চিত্রকলার শক্তি ও সামর্থ্য নিহিত।

সংলাপ, অঙ্গভঙ্গি, চলাফেরা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিকে সম্বল করে যাঁরা অভিনয়কর্মটি সম্পন্ন করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই চরিত্র হিসেবে বিশ্বাস্য হয়ে উঠেছে এবং স্থানীয়/ সম্প্রদায়গত ভিত্তি পেয়ে গেছে; কেউ কেউ পায়নি কারণ চরিত্রটি আরোপিত মনে হয়েছে। এ-সূত্রে পরান নামে বাউল চরিত্রটির কথা বলা যায়।

ফোকাস দৃশ্যমাত্রার একটি উপাদান। কয়েকটি দৃশ্যে ফোকাসের ক্ষেত্রে সমস্যা লক্ষণীয় – একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে আউট অব ফোকাসে থেকে গেছে বজলুর মা রোকেয়া। ডেপ্থ অব ফিল্ড তৈরি করে সবাইকে ফোকাসে রাখা যেত – ডিপ ফোকাস ব্যবহার করলে রোকেয়া ফোকাসের বাইরে থেকে যেত না। রোকেয়ার মেকআপেও সমস্যা ছিল –  প্রথমদিকে কালো চেহারা – শেষের কয়েকটা দৃশ্যে ফর্সা। বিষয়টি দৃশ্যমাত্রায় অনন্বয় তৈরি করে। শট ডিভিশন আখ্যান অনুবর্তী। প্রথমদিকে দৃশ্য সংগঠনের ক্ষেত্রে মিডলং শট বেশি – কাট্ কম। তবে শটের দৈর্ঘ্য কোথাও কোথাও একটু বেশি মনে হয়েছে, বিশেষ করে দাদি, বজলু ও গরু-সংবলিত দৃশ্যটির কথা বলা যায়।

স্বপ্নদৃশ্য সংগঠনে নির্মাতা চলচ্চিত্রবোধের পরিচয় রেখেছেন : ময়না দেখছে বজলু নতুন বলদ নিয়ে বাড়ি ফিরছে – ঘুম ভাঙে গ্রামবাসীর কোলাহলে – ঘর থেকে বের হয়ে দেখে বজলুকে বেঁধে নিয়ে আসা হয়েছে – স্বপ্ন আর বাসন্তবের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। বৈপরীত্য তৈরি হয় চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে। বজলুর হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়, তাকে মাফ করে দেওয়া হয় – কিন্তু বাবা বলে যে, তুই গলায় দড়ি দিয়ে মরলি না কেন। সবাই চলে গেলে বজলু দড়ির দিকে এগিয়েও যায় গলায় ফাঁস দেবে বলে – একটু করে এগোয়, ক্যামেরাও একটু এগোয় – দৃশ্যের সংগঠনটি একেবারে বাসন্তব – দড়ি হাতে নেওয়ার সময় হঠাৎ ঘানিটি বাতাসে নড়ে ওঠে – ক্যাঁচ শব্দ হয় – বজলু ঘানির দিকে তাকায় – তার মধ্যে আন্তহননের যে-আশা জেগেছিল, তা এক মুহূর্তেই মিইয়ে যায় – বদলে ঘানিকে পুঁজি করে বেঁচে থাকার সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত রাখতে চায়। কোনোরকমে শরীর টেনে নিয়ে ঘানির কাছে যায় – বিশাল এক পাথরখ- ঘানিতে চাপিয়ে ঘানি টানতে থাকে – এক সময় পড়ে যায় – ময়না সে-দৃশ্য দেখে দৌড়ে এসে তাকে ওঠায় – উঠেই বজলু আবার ঘানি টানতে শুরু করে – ময়নাও তার সঙ্গে ঘানি টানতে লেগে যায়। চোখের জল পড়ে, কাট শটে ঘানি থেকে তেলের ফোঁটা পড়া দেখানো হয়, সাউন্ড ট্র্যাকে ঘণ্টাধ্বনি, সংগীতখ- আর হামিং দিয়ে অসাধারণ একটি মানবিক ও সিনেম্যাটিক মুহূর্ত তৈরি করেন কাজী মোরশেদ। তিনি আশার পুনরুজ্জীবন ঘটান শেষ দৃশ্যে চলচ্চিত্রকলার অভ্যন্তরীণ উপকরণগুলো দিয়ে; লিখে ফেলেন চলচ্চৈত্রিক একটি উপন্যাস।

আবার কাট – বজলু আর ময়নার একত্রে ঘানি টানার স্পৃহা দেখে আফসু লাঠি আঁকড়ে ধরে। ক্যামেরা তখন লো অ্যাঙ্গেলে এবং সে-লাঠিতে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় – ওই অবস্থাতেই শটটি ফ্রিজ হয়ে যায়। মানুষই তাকে প্রাণিত করে, শক্তি জোগায় সোজা হয়ে দাঁড়ানোর। শেষ দৃশ্যে নতুন করে বাঁচার আশায় লাঠিতে ভর দিয়ে শামসু নুয়ে-পড়া কুঁজো শরীরকে সোজা করে দাঁড়িয়ে যাওয়ার মধ্যেও আশাবাদের প্রকাশ ঘটিয়েছেন নির্মাতা। মানুষের সম্মিলিত যাত্রার প্রয়োজনীয়তার বক্তব্য রেখেই শেষ হয় ঘানি

 

শব্দমাত্রা

সংলাপ শব্দমাত্রার প্রধান উপাদান। ঘানির সংলাপ বাসন্তবঘেঁষা। পরিমাণেও কম। সংলাপ ঘানির অন্যতম সম্পদ। দৃশ্য দিয়ে যা বলা সম্ভব হয়েছে সেখানে সংলাপ রাখা হয়নি। আখ্যানকে এগিয়ে নেওয়া, চরিত্রের মানসিকতা প্রকাশ করা, কলু-সমাজের ঐতিহ্য, গ্রামীণ প্রতিবেশে মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক-ব্যবস্থা ও চলচ্চিত্রটির বক্তব্যের প্রবাহকে সম্মুখবর্তী করার জন্য যতটুকু সংলাপ দরকার ততটুকুই রাখা হয়েছে। কিছু সংলাপে অতীত প্রসঙ্গ নির্মিত হয়েছে। আফসুর কথায় প্রকাশ পায় আটানববইয়ের বন্যায় ঘানি-বলদ সব নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ, রোজ শনিবার যে পুত্র কুদ্দুসের জন্য সে মনুর দোকানে বসে অপেক্ষা করে – এমন বেশকিছু সংলাপে অতীত নির্মিত হয়েছে। শিল্পধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে অতীতকে সংলাপে বিধৃত না-করলেই ভালো, এতে চলচ্চিত্রটি ঝুলে যায়।

ঘানিতে সংলাপ আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে : সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে তার আগাম আভাস দিয়েছে। এই প্রবণতা এপিকধর্মী সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে দেখতে পাই। উদাহরণ হিসেবে ঈদিপাসের কথা স্মরণ করতে পারি; মেঘে ঢাকা তারার কথা ভাবতে পারি –  উভয় সৃষ্টিতেই চরিত্র/ চরিত্রবর্গ কোন ধরনের পরিণতি পেতে যাচ্ছে, তার ইঙ্গিত করা হয়েছে, সংলাপের হেঁয়ালি ও চাতুর্যপূর্ণ ব্যবহারে। ঘানিতেও বজলু যখন ময়নাকে বলছে : ‘বিয়ার পর বুঝবি কাজ কারে কয়’ –  তখন সামনে যে তাকে কঠিন কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ময়না, নিজেও একবার বলে : ‘আমারে একদিন ঘানিতে ঘুরাইবা।’ ‘ঘানি টানলে কেমন লাগে’ তাও জানতে চায়। বজলু তখন বলে : ‘যখন ঘানিতে উঠবি তখন বুঝবি।’ অন্যত্র আনোয়ার হোসেন (পরান) কথা প্রসঙ্গে রানী সরকারকে বলে : জন্ম নিলে একদিন মরতে হবে তা সবাই জানে তবে কবে মরব তা কেউ জানে না। এর পরের দৃশ্যেই কুদ্দুসের মৃত্যুসংবাদ ও লাশ আসে গাঁয়ে।

সংলাপে নির্মাতা সমাজ-সংসারে নারীর অধসন্তনতার প্রসঙ্গ এনেছেন। রোকেয়া বলে যে, সে সংসারের ঘানি গত পঁচিশ বছর ধরে অর্থাৎ এই কলু-পরিবারে বউ হয়ে আসার পর থেকেই টানছে, তখন তাতে কলু-সমাজের নিষ্ঠুর বাসন্তবতারই প্রতিফলন ঘটে। বস্ত্তত সংলাপ এ-চলচ্চিত্রে বাসন্তব প্রসঙ্গের অনুষঙ্গে রচিত। চলচ্চিত্রে সংলাপের দায়িত্ব বহুবিধ : কাহিনিকে এগিয়ে নেওয়া, কাহিনি-কাঠামোর প্রধান ও অপ্রধান দ্বন্দ্বগুলোকে সম্মুখবর্তী করা, চরিত্রের মনসন্তত্ত্ব উন্মোচন করা ইত্যাদি। আবার সংলাপহীন মুহূর্তও চলচ্চিত্রকারকে তৈরি করতে হয়, প্রধানত চলচ্চিত্র-পরিসরে ‘মানবিক মুহূর্ত’ সৃষ্টির জন্য। ‘নীরবতা’ তৈরি করেই চলচ্চিত্রে ওইসব বেদনাঘন মুহূর্ত তৈরি করতে হয়। ঘানিতে এরকম বেশ কয়েকটি মুহূর্ত চলচ্চিত্রকার তৈরি করেছেন।

প্রধানত সংলাপ দিয়েই চলচ্চিত্রকার কলু-সমাজের বাসন্তবতার সামগ্রিক দিক স্পষ্ট করেছেন। ঘানির সংলাপগুলো বিশেস্নষণ করলে দেখতে পাব যে, এর সংলাপগুলো একদিকে যেমন চরিত্রবর্গকে সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে কলু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান জ্বলন্ত ও অসহনীয় দ্বন্দ্বগুলোকে প্রকাশ করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে সংলাপের জন্মই হয় চরিত্রবর্গ সমাজবাসন্তবতায় যে-দ্বন্দ্বগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে, সেসব দ্বন্দ্বের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের ফলে। ঘানির সংলাপে অনেক সস্ন্যাং ব্যবহৃত হয়েছে, যা আখ্যানকে বাসন্তবভিত্তি দিয়েছে। তবে কুদ্দুসের লাশ যখন গ্রামে আনা হয় – তখন সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো – কিন্তু সাউন্ড ট্র্যাকে কাদের যেন কথা শোনা যায়! দৃশ্যের সঙ্গে তা বেমানান লেগেছে। কারণ উপস্থিত সবাই যে স্থির! কারা কথা বলছে তাহলে?

গানও কোনো কোনো নব্য-বাসন্তববাদী চলচ্চিত্রধারার চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। ঘানিতেও গান ব্যবহৃত হয়েছে। বাউলাঙ্গের ‘আমি যারে হারায়েছি, তারে কি আর পাবো জীবনে’ গানটি কাহিনি-পরিসরে মানিয়ে গেছে। পরানের গাওয়া গানটি দিয়ে মন্তাজ-ঢংয়ে আখ্যানের সব চরিত্রকে দেখানো হয়, শূন্য চুলাও দেখানো হয় – টাইম ল্যাপসিংয়ের বিষয়টিও গানের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। তবে শুদ্ধ বা প্রমিত ভাষায় রচিত ‘চন্দ্র সূর্য যত তারা’ শীর্ষক গানটি কলু-সমাজের বাসন্তব অবস্থার সঙ্গে বেমানান মনে হয়েছে। বজলুর বিয়ের সময় আবহসংগীত হিসেবে ‘মালকা বানুর দেশে’ শীর্ষক অতিপরিচিত গানটির সুরের ব্যবহারও ক্লিশে মনে হয়েছে। কলু-সমাজ হাজার বছরের পুরনো – খুঁজলে এদের মধ্যে প্রচলিত পুরনো বিয়ের গান পাওয়া যেত। তাহলে আখ্যানটি আরো স্থানীয় ভিত্তি পেত।

ঘানির আবহসংগীত ঘটনাখ–র মুড অনুযায়ী সৃষ্ট। শেখ সাদী খান প্রাচ্যদেশীয় শাস্ত্রীয় সংগীত ও পাশ্চাত্যের যন্ত্রানুষঙ্গে আবহসংগীত রচনা করে চরিত্র ও ঘটনার দুঃখবোধ-আনন্দানুভূতি-বিষণ্ণতা-প্রাপ্তিযোগের সুখানুভূতি প্রকাশ করেছেন, যা দর্শকের পক্ষে চলচ্চিত্রটি সম্যকভাবে আস্বাদনের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে ওঠে। সরোদ ও বাঁশি সংযোগে ময়না ও বজলুর মনোবেদনার প্রকাশ ঘটে, এতে দৃশ্যমাত্রা পোয়াতি হয়। ময়নার কাঁধে ঘানির জোয়াল তুলে দেওয়ার প্রাক্কালে কি-বোর্ড ও হামিংয়ের যুগলবন্দিতে সৃষ্ট সংগীতখ-টি ময়নার অন্তর্গত ক্রন্দনরূপে দর্শকের মধ্যে সংক্রমিত হয়, তাদের মন বেদনায় আপস্নুত হয়। আবার শেষের দিকে বজলুকে ঘানির জোয়াল তুলে নিতে দেখে ময়নাও যখন জোয়াল টানায় সঙ্গী হয়, তখন ভায়োলিন ও বাদ্য-যন্ত্রানুষঙ্গে যে অর্কেস্ট্রার জন্ম হয় তা বজলু ও ময়নার যুগপৎ শব্দহীন কান্না ও চিৎকার হয়ে ওঠে। চরিত্রদ্বয়ের কষ্ট তখন দর্শকের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। ঘানিও তখন একটি চলচ্চৈত্রিক উপন্যাসে পরিণত হয়।

এ-চলচ্চিত্রে চরিত্রের জন্য আলাদা টিউন তৈরি করা হয়েছে। আফসুর ছেলের প্রসঙ্গ এলেই তার জন্য নির্মিত সংগীতখ-টি বাজে। তবে তার বাবা তার মৃত্যুর পর যখন ঘাটে বসে তার অপেক্ষা করে তখন ‘মাঝি বাইয়া যাওরে’ গানটির মুখটা শোনানো হয়, বদলে যদি ছেলের জন্য করা সংগীতখ-টি বাজত তাহলে মৃত ছেলেটি আবার আখ্যানে উপস্থিত হতো। দর্শকের মনও অভিঘাতে ভরে যেত। বাবার মৃত ছেলের জন্য অপেক্ষার সময় কুদ্দুসের জন্য পৃথকভাবে তৈরি করা সংগীতখ- না শোনানো হলেও এটি অন্য সময় তার অনুপস্থিতিতে সাউন্ড ট্র্যাকে বাজে, তখন তা তার উপস্থিতি জানান দেয় বইকি।

শব্দমাত্রার আবশ্যক উপাদান হিসেবে পারিপার্শ্বিক শব্দরাজি এই চলচ্চিত্রে যত্ন নিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। কাক, শেয়াল ও ঝিঁঝির ডাক, পাখির কিচিরমিচির ঘটনাখ-কে বাসন্তব করে তুলেছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, ঘানির শব্দমাত্রার জন্য নির্মাতার একটি সচেতন ভাবনা ক্রিয়াশীল ছিল।

 

সম্পাদনাগতমাত্রা

চলচ্চিত্রে আখ্যানের ঘটনাখ-গুলো প্রকাশ পায় দৃশ্য (ভিজ্যুয়াল ইমেজ) ও শব্দমাত্রার (সাউন্ড ইমেজ) উপাদানগুলোর সমন্বয়ে। বস্ত্তত ভিজ্যুয়াল ও সাউন্ড ইমেজগুলো দিয়েই নির্মাতা সিনেম্যাটিক টেক্সটটিকে দাঁড় করান। এই দুটি ইমেজকে একত্রে জোড়া দিয়ে তথা সম্পাদনাকর্মের মাধ্যমেই নির্মাতা টেক্সট তথা আখ্যানটিকে বোধগম্যভাবে দর্শকের সামনে উপস্থিত করেন। প্রতিটি ইমেজ      প্রকৃতপক্ষে একেকটি শট। এই শটগুলোকে জোড়া দেওয়ার মাধ্যমেই নির্মিতব্য চলচ্চিত্রটি অবয়বপ্রাপ্ত হয়, একটি কাঠামো অর্জন করে। বলা যায়, ক্যামেরার মাধ্যমে গৃহীত শটগুলোকে তাদের মধ্যকার সময়, স্থান ও ঘটনাগত ঐক্য বজায় রেখে কেটে কেটে পরপর সংস্থাপনের প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই সম্পাদক চলচ্চিত্রের পূর্ণাঙ্গ আখ্যানটি প্রস্ত্তত করেন। এ-কাজটি ঘানিতে সুচারুভাবেই সম্পন্ন করেছেন সাইফুল ইসলাম। ফলে এটি একটি বাসন্তববাদী চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে। তবে শুধু বাসন্তবের সন্তরেই থেকে যায়নি, সমালোচনামুখী হয়ে উঠেছে। কলু-সমাজের বাসন্তব অবস্থার চলচ্চৈত্রিক উপস্থাপনের মাধ্যমে দর্শকদের একটা সামাজিক সংকটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যা নব্য-বাসন্তববাদী ও নবতরঙ্গধারাভুক্ত চলচ্চিত্রের প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য।

চলচ্চিত্রের অভ্যন্তরীণ উপকরণগুলোর (দৃশ্য, শব্দ ও সম্পাদনা) সুষম বিন্যাস না ঘটলে তা শিল্প-চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে না। নকসীকাঁথায় এই সুষম বিন্যাসের উপস্থিতি প্রবল। তাই নকসীকাঁথার গড়ন আমাদের দর্শনেন্দ্রিয়কে নান্দনিক তৃপ্তি দেয় – যেমনভাবে গানের ক্ষেত্রে তাল-লয়ের উচ্চাঙ্গের সুরসংগীত আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয়কে আনন্দ দেয়। চলচ্চিত্রের গড়নেও এই সুষমতা, সংগতি থাকা দরকার। যার কিছুটা ঘানিতে আছে বলেই তা আমাদের নান্দনিক তৃপ্তি দিয়েছে। তবে ঘানি পরিপূর্ণভাবে শিল্প-চলচ্চিত্র হয়ে ওঠেনি। আনোয়ার হোসেন কর্তৃক বাউল গানটির সংস্থাপন অস্বাভাবিক ঠেকেছে; স্টকটিউনের ব্যবহারও দর্শকের মনকে চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরিয়ে নেয় কখনো কখনো।

কিছু ত্রম্নটি সত্ত্বেও ঘানি যে একটি সৎ, শুদ্ধ ও নির্মল চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে, তার কৃতিত্ব বা অথরশিপের দাবিদার শুধু কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনাকারী নয়, এর ক্যামেরা-সঞ্চালক হাসান আহমেদ; এর সম্পাদক সাইফুল ইসলাম; এর আবহসংগীতকার শেখ সাদী খান; এর অভিনয়শিল্পীবর্গ – সবার। কারণ চলচ্চিত্রকলা একটি যৌথ শিল্পমাধ্যম।

 

তাৎপর্যগতমাত্রা

ঘানির চিত্রনাট্য এর বড় সম্পদ। সংলাপ, দৃশ্যের ধারাবাহিকতা, শট ও দৃশ্যগুলোর বিভাজন, দৃশ্য সংস্থাপন, সিকোয়েন্সের অগ্রগমন, দৃশ্যসজ্জার যাবতীয় উপকরণ, লোকেশন নির্বাচন – সবকিছুই, বোঝা যায়, শুটিংপূর্ব পর্যায়ে তথা চিত্রনাট্য রচনার সময়ই কাজী মোরশেদ সম্পন্ন করেছিলেন। সেজন্যই চলচ্চিত্র ভাষায় ঘানির আখ্যান, তাৎপর্যগুলোকে শিল্পসম্মতভাবে চলচ্চিত্রের কারিগরি দিকগুলোর ব্যবহারে তিনি প্রকাশ করতে পেরেছেন। কলু-সমাজের বাসন্তবজীবনের ঘটমান সত্যকে শিল্পসত্যে পরিণত করার দক্ষতায় তিনি তার পরিচালকবৃত্তির পরিচয় দিয়েছেন। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যায় : যেমন – আফসুর সন্তান হারিয়ে মনুর দোকানে বসে খেয়াঘাটের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃতপুত্রের জন্য অপেক্ষা করা এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে একটু অপ্রকৃতিস্থ হওয়া; ময়নার গয়না বিক্রি করে ধলাচানকে ফেরত আনা; বজলু নতুন বলদ নিয়ে আসছে, এরকম একটি স্বপ্নদৃশ্য ময়নার ঘুমঘোরের সুযোগে তৈরি করা – সবই কাজী মোরশেদের চিত্রনাট্য তৈরির দক্ষতার প্রমাণ। বজলু গরু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর মার খেয়ে বাড়ি আসা এবং তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সৃষ্টিতে মোরশেদ যেভাবে ক্যামেরাকে ব্যবহার করেছেন, তা তার সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞার স্মারক। বলতে ইচ্ছা করছে, কাজী মোরশেদ প্রকৃতপ্রস্তাবে কলুজীবনের দুঃখ-কষ্ট ও সংগ্রামকে উপজীব্য করে উপন্যাস রচনা করেছেন – কলমের বদলে, ক্যামেরার মাধ্যমে। যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গেই চলচ্চিত্রকলার যে তিনটি সাংগঠনিক উপাদান : দৃশ্য, শব্দ ও সম্পাদনা – তাদের একত্র গ্রন্থনা ও শৈল্পিক বিন্যাসের মাধ্যমে তিনি চলচ্চৈত্রিক উপন্যাসটি রচনা করেছেন। ১৩টি ক্ষেত্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রে সংলাপ দিয়েও নানা তাৎপর্য তৈরি করা হয়েছে। যেমন কলু-সমাজে বউ আর বলদ যে সমার্থক তা বেপারির সংলাপে স্থাপন করা হয়েছে। বিয়ের সময় বজলু এক বেপারির কাছ থেকে দশ হাজার টাকা সুদে নেয়, কিন্তু ফেরত দিতে না-পারায় বেপারি ঘানির বলদটা নিয়ে যায়। নেওয়ার সময় বলে : তোর বউরে না, আমি ওই বলদটা নিয়া গেলাম।

আশা নির্মাণ, আশাভঙ্গ, আশার পুনরুত্থান/ পুনর্নির্মাণ – ঘানি চলচ্চিত্রে এই প্রক্রিয়াটা ঘানির মতোই ঘূর্ণায়মান। কুদ্দুস বাড়ি ফিরে আসবে, ঘানি কিনবে, বলদ কিনবে, বিয়ে করবে – আশার নির্মাণ হয় আফসুর পরিবারে। আশাভঙ্গ হয় কুদ্দুসের মৃত্যুতে। বজলু আর ময়নার ঘানি টানা দেখে আফসুর মজে যাওয়া, মিইয়ে যাওয়া আশা পুনরায় জন্ম নেয় তার অন্তরে। এ-জন্যই প্রায় কুঁজো আফসু শেষ দৃশ্যে লাঠিতে ভর দিয়ে কষ্ট করে হলেও সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এই আশাবাদের সংক্রমণ ঘটে দর্শকের মনে।

শেষ দৃশ্যে চলচ্চিত্রটিতে কোনো ভাববাদী সমাধান নয়, বস্ত্তবাদী সমাধান দেওয়া হয়েছে। শরীর, যা একাধারে জড় ও চৈতন্য – তা দিয়েই জীবন টেনে নিতে হবে। ‘শ্রম’ ছাড়া মুক্তি নেই, কারণ শ্রমিকতাই যে মানবীয়তা। এ-চলচ্চিত্রে এ-কথাই ব্যক্ত হয়েছে। ঘানি মানবীয়তার এক দলিলই বটে। ঘানি একটি বস্ত্তবাদী চলচ্চিত্র।

ঘানিতে উৎপাদনের উপকরণ, উৎপাদন সম্পর্ক, উৎপাদন ব্যবস্থা – এসবের উপস্থিতি প্রবল। সব মিলিয়ে কলু-সমাজের চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য-শ্রেণিবৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। যে উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে কলুরা বাস করে সেখানে উৎপাদনের উপকরণগুলোর মধ্যে ঘানি ও বলদ প্রধান। উৎপাদনের উপকরণগুলো নিজেদের করে নিতে হবে – শুধু ঘানি বা বলদ নয়, বৃহত্তর স্বার্থে সমাজ-রাষ্ট্রের সব উৎপাদনের করণকৌশল নিজেদের (জনগণের) করতে না পারলে সমাজে শোষণ চলতেই থাকবে। বিশেষ একটি ঘটনাকে ‘নির্বিশেষ’ একটি চরিত্র দান করে নির্মাতা যেন এ-বক্তব্যই রাখতে চেয়েছেন। তাই শুধু গ্রাম নয়,  শহর ও রাজনীতি প্রসঙ্গও তিনি এ-কারণে এনেছেন চলচ্চিত্রটিতে।

বস্ত্তবাদী চলচ্চিত্রের কাজ হচ্ছে সমাজের যে থাক্ প্রচরিত্ররা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়, সেই থাক্ সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান করা। কোনো ব্যক্তির কষ্ট বা সংগ্রামকে বড় করে দেখা হয়নি ঘানিতে। একটি কলু পরিবারের সবার কষ্ট এবং কষ্টকে জয় করার কথা বলা হয়েছে এতে। উৎপাদনের উপকরণগুলো উৎপাদকদের হাতে না থাকলে কী হয় তার ব্যাখ্যা ঘানিতে পাওয়া যায়। এই চলচ্চিত্রে যে-চরিত্রবর্গ রয়েছে তাদের মধ্যকার আমত্মঃসম্পর্ক বিশেস্নষণ করলে কলু-সম্প্রদায় সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। একটি সম্প্রদায়, একটি সমাজ হচ্ছে কতগুলো সম্পর্ক-ব্যবস্থার যোগফল। সবশেষে বলা যায়, শুরুতে নব্য-বাসন্তববাদ ও নবতরঙ্গের যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা বলা   হয়েছিল যেমন প্রামাণ্যবাসন্তবতা, ডিটেলস্, আমত্মঃমানবিক সম্পর্ক, মানব-পরিবারের চিত্রায়ণ, মানবিক আশাবাদের প্রকাশ প্রভৃতি ঘানিতে এসবের সবই দেখতে পাওয়া গেছে। আর এসবের মধ্যেই এ-চলচ্চিত্রের তাৎপর্যগত মাত্রাটির সর্বোচ্চ গুরুত্ব নিহিত।

 

 

তথ্যনির্দেশ ও টীকা

১. ঘানি (The Cycle) : কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাটক ও পরিচালনা – কাজী মোরশেদ। সময়কাল : ১০৯ মিনিট। অভিনয় – রাইসুল ইসলাম আসাদ, ডলি জহুর, রাণী সরকার, মাসুম আজিজ, নার্গিস, আনোয়ার হোসেন, সিরাজ হায়দার, রীনা রহমান, নাজনীন হাসান চুমকি, আরমান পারভেজ মুরাদ, খালেদ মাহমুদ প্রমুখ। ক্যামেরা-সঞ্চালক – হাসান আহমেদ। সম্পাদনা – সাইফুল ইসলাম। সংগীত পরিচালনা – শেখ সাদী খান। প্রযোজনা – কাজী মোরশেদ ও ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড। মুক্তি : ২০০৬।

২. কলু : তেলবীজ থেকে ভোজ্যতেল উৎপাদনে নিয়োজিত পেশাজীবী সম্প্রদায়।… ‘কলু’ শব্দটি দেশজ। হিন্দিতে বলে ‘কোলহু’।… কলু শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘তৈল ব্যবসায়ী হিন্দু ও মুসলিম জাতি বিশেষ’।… কলুদের পেশা এখন হুমকির মুখে। যেসব এলাকায় যান্ত্রিক ঘানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে তারা তাদের পেশা টিকিয়ে রাখতে পারেনি।… ইতোমধ্যে সারাদেশ থেকে হাজার হাজার কাঠের ঘানিগাছ উঠে গেছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই বা যান্ত্রিক ঘানি নেই এমনসব জায়গায় কলুদের পেশা এখনো কোনোক্রমে টিকে আছে।

আমজাদ হোসেন, বাংলাপিডিয়া, দ্বিতীয় খ-, সম্পাদক : সিরাজুল ইসলাম, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, পৃ ২১০-২১২

৩. ঘানি : সরিষা, তিল, রেড়ি এবং পাকা নারকেলের শাঁস থেকে পিষে তেল বের করে আনার ঐতিহ্যবাহী যন্ত্র। ঘানির উপরিভাগে রয়েছে বালতিসদৃশ ধারণপাত্রসহ কাঠের একটি কাঠামো। তেল উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত কাঁচামাল অল্প পরিমাণে এই ধারণপাত্রের মধ্যে ঢেলে দেওয়া হয়। ঘানিতে ঢেলে দেওয়ার পর তা পেষানো হলে তা থেকে ধারাক্রমে একটি গ্রহণকারী অংশে তেল গড়িয়ে পড়ে। ঘানি ঘোরানোর জন্য যান্ত্রিক মোটরের পরিবর্তে পশুশক্তি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই উদ্দেশে সবচেয়ে সুবিধাজনক হচ্ছে ঘোড়া ও বলদের ব্যবহার। ঘানি ঘোরানোর জন্য একটিমাত্র পশু ব্যবহার করা হয়। পশুটির চোখের দুপাশে বাঁশের পাতলা পাতার তৈরি দুটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধক জুড়ে দেওয়া হয়। পশুটিকে বৃত্তাকার পথে শুধু সামনের দিকে চলমান রাখার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবেই এ-ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। ঘানি থেকে ধাতুনির্মিত একটি নির্গমপথ বেয়ে তেল বেরিয়ে আসে এবং নিচে রক্ষিত একটি ধারণপাত্রে পতিত হয়। ঘানির অন্য একটি ভিন্নপথে বেরিয়ে আসা খৈল চওড়া মুখবিশিষ্ট একটি পাত্রে সংগ্রহ করা হয়। তেল সম্পূর্ণ বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত খৈল বারবার পেষা হয়ে থাকে। হিন্দু তেল পেষণকারীরা তফসিলি বর্ণভুক্ত। এই পেশায় নিয়োজিত মুসলমানদের অবস্থানও সমাজের নিম্নসন্তরে। হিন্দুদের মধ্যে এটি একটি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পেশা, কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে এ-পেশা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত নয়। এই পেশায় নিয়োজিত লোকদের কলু নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।

 – কেএমএ আজিজ, বাংলাপিডিয়া, তৃতীয় খ-, সম্পাদক : সিরাজুল ইসলাম, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, পৃ ২৫৩-২৫৪

৪. এই রচনায় ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০০৬’ উপলক্ষে তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত স্মরণিকার কিছু শংসাবচন ও ২০০৮ সালে আনন্দধারায় প্রকাশিত, আরিফ খান-লিখিত ‘ঘানি : কাজী মোরশেদের অসামান্য চলচ্চিত্র’ থেকে কিছু বিবেচনা ব্যবহৃত হয়েছে। লেখক সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। উল্লেখ্য, স্মরণিকায় ব্যবহৃত চলচ্চিত্রকলার ফিজিক্যাল প্রপার্টিজ-সংক্রান্ত প্রায় সব কথাই মৎ-প্রণীত চলচ্চিত্রকলার রূপরূপান্তর শীর্ষক গ্রন্থ থেকে নেওয়া, যদিও তা কোথাও স্বীকার করা হয়নি। r