কাজুও ইশিগুরো নাগাসাকি থেকে স্টকহোম

ইশিগুরোর নাম ছিল না কোথাও

নোবেল জুয়াড়ি ল্যাডব্রোকের পূর্বাভাস পরপর চার বছর ভীষণ মার খেল। ঔপন্যাসিক প্যাত্রিক মোদিয়ানো, অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিক স্ফেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচ, রকস্টার বব ডিলান কিংবা সর্বশেষ ২০১৭-এর বিজয়ী কাজুও ইশিগুরো কেউই সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে উপস্থাপিত হননি। স্পেকুলেটররা ইশিগুরোর ওপর বাজি ধরেননি, তাঁর নাম সম্ভাব্য বিজয়ীর কোনো ধরনের তালিকাতেই ছিল না।

ল্যাডব্রোক তালিকার প্রথম দশজন : কেনিয়ার নগুই ওয়া থিয়েঙ্গো, জাপানের হারুকি মুরাকামি, কানাডার মার্গারেট অ্যাটউড, চীনের ইয়ান লিয়াঙ্কে, দক্ষিণ কোরিয়ার কো উন, ইতালির ক্লদিও মার্গিস, ইসরায়েলের অ্যামোস ওজ, স্পেনের হাভিয়ার মারিয়াস, সিরিয়ার আদুনিস, আমেরিকার ডন ডিলিলেস্না।

ইসমাইল কাদারে, ফিলিপ রথ, মিলান কুন্ডেরা, জন ফসে পিটার নাদাস, নুরুদ্দিন ফারাহ, পিটার ক্যারে, লিডিয়া ডেভিস, জুলিয়ান বার্নস, সালমান রুশদি এবং সুখ্যাত আরো অনেকেই ছিলেন। কাজুও ইশিগুরো তালিকায় ছিলেন না, নোবেল পুরস্কার ঘিরে যে অক্টোবর গসিপ, তাতেও না।

২০১৫-তে বেলারুশ সাংবাদিক এবং ২০১৬-তে আমেরিকান রকস্টারকে পুরস্কার দেওয়ার পর নোবেল কমিটি আর সাহিত্যে ফিরবে কি না, সে-আলোচনাও কেউ কেউ করেছেন এবং নোবেল পুরস্কারের জন্য একটি ‘অবলিগেটরি মিউজিশিয়ান ক্যাটেগরি’ তালিকাও উপস্থাপিত হয়েছে। তার শীর্ষে রয়েছেন : আমেরিকান রকমাস্টার ব্রম্নস স্প্রিঙ্গস্টিন, তারপর অস্ট্রেলিয়ান নিক কেইভ, পোস্ট-বব ডিলান ধারার আমেরিকান র‌্যাপার কেনি ওয়েস্ট, আমেরিকান আইকন প্যাটি স্মিথ, কানাডিয়ান নায়ক-গীতিকার জনি মিশেল, নেইল ইয়াঙ্গ, আমেরিকান র‌্যাপার কেন্ড্রিক লামার, উইলি নেলসন এবং আমেরিকার নব্য-ডিলান স্টিভ ফরবের্ট।

নোবেল কমিটিকে নিয়ে ঠাট্টা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, সাহিত্যের পুরস্কারটি কোনো ধর্মপ্রচারকও পেয়ে যেতে পারেন বলে মন্তব্য করা হয়।

অ্যালেক্স শেপার্ড ২০১৬-তে নিউ রিপাবলিকে লিখেছিলেন : নোবেল আর যিনিই পান, বব ডিলান যে পাবেন না, এটা আমি নিশ্চিত।

সুইডিশ অ্যাকাডেমি তাঁর কথা তাঁকে গিলিয়ে ছেড়েছে। ২০১৭-এর নোবেল প্রাইজ কারা পাবেন না, অ্যালেক্স এবার এর একটি তালিকা সরবরাহ করেছিলেন :

* জাপানি ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামি

* ইসরায়েলি ঔপন্যাসিক অ্যামোস ওজ

* ইতালিয়ান লেখক ক্লদিও মার্গিস

* সিরিয়ান কবি আদুনিস

* আর্জেন্টাইন লেখক সিজার আইরা

* ইসরায়েলি ঔপন্যাসিক আব্রাহাম যশুয়া

* অস্ট্রিয়ান ঔপন্যাসিক পিটার হ্যানকি

* হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক পিটার নাদাস

* পোলিশ কবি অ্যাডাম জাগায়েভস্কি

* ইসরায়েলি ঔপন্যাসিক ডেভিড গ্রসম্যান

* চেক-ফ্রেঞ্চ ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরা

* স্প্যানিশ ঔপন্যাসিক এনরিক ভিলা-মাতাস

* ইন্দো-কানাডিয়ান ঔপন্যাসিক রোহিলতন মিস্ত্রি।

অ্যালেক্স শেপার্ড আরো লিখেছেন, অবিশ্বাস্য ও হাস্যকর মনে হলেও বব ডিলানের নোবেল ফিলিপ রথের সম্ভাবনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিয়েছে (রথ নাকি প্রতিবছর অক্টোবরে তাঁর এজেন্টের অফিসে সুইডেনের ফোনের অপেক্ষায় বসে থাকেন)। নোবেল আপাতত পাচ্ছেন না জয়েস ক্যারোশ ওটস, টমাস পিনশন, ডন ডিলিলেস্না, লিডিয়া ডেভিস কিংবা নরম্যান ম্যাক্কার্থি। অ্যালেক্স নাম ধরে ব্রিটিশদের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন – জন ব্যানভিল, জুলিয়ান বার্নস, সালমান রুশদি, টম স্টপার্ড, হিলারি ম্যানটেন, কম টইবিন,  অ্যালান হোলিংহার্স্ট কেউই পাচ্ছেন না।

যদিও ইংরেজি লিখিয়ে কাউকে দেওয়া হয় তা হলে অস্ট্রেলিয়ান কেউ একজন পাবেন : লেস মারে, পিটার ক্যারে, ডেভিড মালুফ ও জেরাল্ড মারনান। কোথাও কাজুও ইশিগুরোর উলেস্নখ নেই।

সুইডিশ অ্যাকাডেমির স্থায়ী সচিব পদে সারা দানিউস যোগদান করার পরবর্তী দুবছর অসনাতন অসাহিত্যিক (২০১৫-তে সাংবাদিক এবং ২০১৬-তে রকস্টার) নোবেল বিজয়ী হওয়ায় সাহিত্যবিশ্ব ক্ষুব্ধই ছিল। থিয়েঙ্গো, কুন্ডেরা, আদুনিস, কো উন কিংবা অ্যামোস ওজকে পুরস্কৃত করে একাডেমি এই ক্ষতে ভালো একটা তালি লাগাতে পারত, তা হয়নি। তবু ভালো একজন পুরোদস্তুর সাহিত্যিক পুরস্কৃত হয়েছেন – জাপানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ কথাসাহিত্যিক কাজুও ইশিগুরো।

 

সজারু না শেয়াল

নোবেল সাইটেশনে কিছু বিমূর্ত কথকতা ঢুপিয়ে পুরস্কারের যৌক্তিকীকরণের রেওয়াজ রয়েছে। কাজুও ইশিগুরোর বেলায় যে-কথাগুলো লেখা হয়েছে, বাংলায় ভাষান্তরিত হলে তা অনেকটা এমন দাঁড়ায় : ‘যিনি তাঁর মহান আবেগময় শক্তিমন্ত উপন্যাসে বিশ্বের সঙ্গে আমাদের মায়াবী চেতনার অতলের সম্পর্ককে উন্মোচিত করেছেন।’

দার্শনিক ইশা বার্লিন লেখকদের দুটো শ্রেণিতে ভাগ করেছেন : সজারু এবং শেয়াল।

যে-লেখকের সৃষ্টিকর্ম একটি সূচক দিয়ে চিহ্নিত করা যায়, তিনি সজারু লেখক। যেমন : দস্তয়েভস্কি এবং মার্শেল প্রম্নস্ত। কিন্তু যে-লেখকের কাজকে এমন কোনো সংজ্ঞায় উপস্থাপিত করা যায় না, তিনি হচ্ছেন শেয়াল-লেখক। এ-দলে আছেন উইলিয়াম শেক্সপিয়র এবং জেমস জয়েস। কাজুও ইশিগুরোকে কোন দলে ফেলবেন, এ নিয়ে জেমস উডকে ভাবতে হয়নি, নিঃসন্দেহে ইশিগুরো শেয়াল-গোত্রের লেখক। তাঁর একটি রচনার সঙ্গে অন্যটির সামান্যতম মিলও নেই। বহুমাত্রিকতা সজারুর থাকে না, শেয়ালের থাকে, ইশিগুরোর আছে। শেয়ালের পরবর্তী দৌড়টি যে কোনদিকে হবে তা বলা যেমন মুশকিল, ইশিগুরোর পরবর্তী উপন্যাসটির বিষয় ও প্রেক্ষাপট কী হবে, নিবিড় ইশিগুরো-পর্যবেক্ষকও তা আঁচ করতে পারেন না। শেয়ালের সঙ্গে তুলনায় চাতুর্যের কিঞ্চিৎ নিন্দা থাকলেও বহুমাত্রিকতার প্রশংসাটি অনেক বড়।

 

ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার

জন্ম অন্য কোনো দেশে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইংরেজি ভাষার লেখক, ব্রিটিশ নাগরিক। যেমন সালমান রুশদি, বেন ওকরি, টিমোথি মো। গ্রাহাম সুইফট কাজুও ইশিগুরোকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনিও কি নিজেকে তাঁদের দলভুক্ত মনে করেন? তিনিও ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, জন্ম নাগাসাকিতে, জাপানি মা-বাবার সমত্মান।

ইশিগুরো বললেন, আমার অবস্থানে যিনি এবং যিনি একদা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত কোনো দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন – দুজনের পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ভারতে যার জন্ম, ভারতে লালিত, ‘মাদার কান্ট্রি’ হিসেবে ব্রিটেনের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিবিড় ও শক্তিশালী – ব্রিটেন তার কাছে আধুনিকতা, সংস্কৃতি ও শিক্ষার পীঠস্থান। ইশিগুরো এর বেশি বলেননি, জাপান কখনো ব্রিটিশ কলোনি ছিল না।

সালমান রুশদি ভারত থেকে ব্রিটেনে গিয়ে স্থিত হয়েছেন, পড়াশোনা করেছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে; টিমোথি মো-র জন্মস্থান হংকং, বিংশ শতকের শেষ প্রামেত্ম ব্রিটিশ-শাসিত ছিল; মো পড়াশোনা করেছেন অক্সফোর্ডে। আর নাইজেরিয়া প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয় ১৯৬০ সালে, এর আগে ব্রিটিশ শাসন। বেন ওকরি ব্রিটেনে এসে অ্যাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ নেন। ইশিগুরো কেন্ট ও ইস্ট অ্যাঙ্গলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের।

 

মার্গারেট অ্যাটউড ও হারুকি মুরাকামি

১৯৮৯-এর বুকার প্রাইজের শর্টলিস্টে যখন কাজুও ইশিগুরোর নাম এলো (দ্যা রিমেইন্স অব দ্য ডে উপন্যাসের জন্য), লিন্ডা রিচার্ডস তাঁকে অভিনন্দন জানালেন। তিনি ঝটপট বলে দিলেন, ক্যাটস আই  উপন্যাসের জন্য শর্টলিস্টেড অপর লেখক মার্গারেট অ্যাটউডের পুরস্কার পাওয়া উচিত। মার্গারেট পেলেন না; ইশিগুরো পেলেন।

২০১৭-এর নোবেল মার্গারেট অ্যাটউড পাচ্ছেন – এ-গুজবটিও ছড়িয়ে পড়েছিল। পেলেন ইশিগুরো। তিনি জোর দিয়ে বললেন, মার্গারেটই পেতে পারতেন। আমি তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

লেখার সাহিত্যমূল্য রয়েছে, একই সঙ্গে জনপ্রিয় – একালের সাহিত্যজগতে এ-ধরনের লেখক-তালিকার শীর্ষে বছরের পর বছর ধরে অবস্থান করছেন হারুকি মুরাকামি। ল্যাডব্রোকের বাজির শীর্ষস্থানে কয়েক বছর ধরে জাপানি হারুকি মুরাকামির নাম, ২০১৭-এর অবশ্য শীর্ষে কেনিয়ার থিয়েঙ্গো।

২০১৩-তে এলিস মুনরোর নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি যেমন মার্গারেট অ্যাটাউডের সম্ভাবনাকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে (মার্গারেটের বয়স ৭৮ বছর, মরণোত্তর নোবেল সাহিত্য পুরস্কার দেওয়ার বিধি নেই)।

২০১৭-তে জাপানি বংশোদ্ভূত কাজুও ইশিগুরোর নোবেল হারুকি মুরাকামির সম্ভাবনাকে একেবারেই সরিয়ে দিয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন।

বিষণ্ণবদনে ‘হারুকিস্ট’রা কাজুও ইশিগুরোর পুরস্কারকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং আশা করছেন, ইকিও মিশিমার মতো তিনি চিরতরে নোবেল-বঞ্চিত হবেন না।

২০১৫-এর নোবেল বিজয়ী স্ফেতালানা অ্যালেক্সিয়েভিচ তাঁর নাম ঘোষণার পরপরই বলেছেন, হারুকি মুরাকামিকে অবশ্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত। এমনকি কাজুও ইশিগুরোও মুরাকামির ভক্ত পাঠক। তিনি তাঁকে উঁচুমানের আন্তর্জাতিক লেখক মনে করেন এবং জোর দিয়ে বলেন, একালের জাপানিরা হারুকি মুরাকামির জগতে বাস করেন। জাপানিদের সম্পর্কে বৈশ্বিক মিথ যে, তারা কাগজের ঘরে বাস করে। তাদের ঘরের বাইরে চেরি ফুলের বাগান, তারা সামুরাই বংশোদ্ভূত, তারা নিজের পেটে ছুরি ঢুকিয়ে জীবন শেষ করে দেয় – এসব মুরাকামি ভেঙে দিয়েছেন।

জাপানের ভেতরে ও বাইরে হারুকিস্ট-সমাবেশ ঘটে। বাংলাদেশ  এবং ভারতেও তাঁর অনেক পাঠক সৃষ্টি হয়েছে। কলকাতায় অবশ্য ইশিগুরো বেশ পরিচিত, যতটা না তাঁর বইয়ের জন্য, তার চেয়ে বেশি তাঁর রচনাভিত্তিক কয়েকটি সিনেমার জন্য।

ক্ল্যারিসা ওন লিখেছেন : আমার সিঙ্গেলহুড থেকে শুরু করে মাদারহুড প্রতিটি স্তরেই প্রেরণা ছিল মুরাকামির বই। ইশিগুরোও বলছেন : এখনকার তিন-চারজন শ্রেষ্ঠ ও উদ্দীপক লেখকের একজন হারুকি মুরাকামি।

তবু আশঙ্কা, তিনিও সম্ভবত মিশিমার পথেই যাবেন; ইশিগুরোর নোবেল সেটাকেই হয়তো সত্য করে তুলবে, যেমন কাওয়াবাতার নোবেল করেছে মিশিমাকে।

 

মা ও নাগাসাকি

আমার মা তাঁর প্রজন্মের পুরোদস্তুর জাপানি মহিলা। তাঁর একটি বিশেষ ধরনের আচরণ-বৈশিষ্ট্য রয়েছে – আজকের যে প্রমিত-মানস সে-হিসেবে তাকে বলা চলে প্রিমিনিস্ট জাপানিজ। আমি যখন পুরনো দিনের জাপানি সিনেমা দেখি, আমি অনেক নারীকে শনাক্ত করতে পারি, যাঁদের আচরণ আমার মায়ের মতো এবং মা যেভাবে কথা বলেন তাঁরাও বলেন ঠিক একইভাবে। ঐতিহ্যগতভাবে জাপানি মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন আনুষ্ঠানিক ভাষা ব্যবহার করে; কিন্তু একালে তা পুরুষের ভাষার সঙ্গে মিলেমিশে গেলে আশির দশকে আমার মা যখন জাপান সফরে যান, তিনি বললেন, জাপানি তরুণীদের মুখে পুরুষ মানুষের ভাষা শুনে হতবাক হয়ে গেছেন।

আণবিক বোমা যখন পড়ে আমার মা তখন নাগাসাকিতে, তাঁর বয়সটা তখন বয়ঃসন্ধির শেষভাগে। বোমার কারণে তাঁদের বাড়িটা বিকৃত আকার ধারণ করেছিল, যখন বৃষ্টি নামল চারদিক থেকে, যখন পানি চুইয়ে পড়তে শুরু করল, ক্ষতিটা কেমন হয়েছে আঁচ করা গেল। চার ভাইবোন, বাবা-মা – এঁদের মধ্যে একমাত্র আমার মা-ই বোমা পড়ার পর আঘাত পেয়েছিলেন। একটা উড়ন্ত ধ্বংসাবশেষ এসে তাঁকে আঘাত করে। বাড়িতে একাই তাঁকে আঘাত থেকে সেরে ওঠার অপেক্ষায় রয়ে যেতে হয়েছে, আর সবাই শহরের বিভিন্ন স্থানে বোমাবিধ্বস্ত মানুষের সহায়তায় বেরিয়ে পড়েছেন। কিন্তু মা বলেন, যখন যুদ্ধের কথা তাঁর মনে পড়ে, তাঁর মনে হয় আণবিক বোমা তাঁকে সবচেয়ে বেশি সন্ত্রস্ত করেনি। মা যে-ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন, সেখানে ভূগর্ভস্থ ট্রেঞ্চে থাকার কথা তাঁর মনে পড়ে। অন্ধকারে সবাইকে লাইন ধরে নিচে নামিয়ে দেওয়া হতো, বোমাটা পড়ত ঠিক তাঁদের মাথার ওপর, সবাই ভাবত, এখনই তাঁদের মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে।

 

বাবার অ্যানালগ মেশিন

বাবার কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেন, বাবা সনাতন জাপানিদের মতো নন, কারণ তিনি বেড়ে উঠেছেন সাংহাইতে। তাঁর মধ্যে চায়নিজ বৈশিষ্ট্য ছিল, খারাপ কিছু ঘটলে তাঁর মুখে হাসি ফুটত।

বাবার সঙ্গেই সপরিবারে ইংল্যান্ডযাত্রা। বাবা ডক্টর শিজু ইশিগুরো নাগাসাকিভিত্তিক সমুদ্রবিজ্ঞানী, ইলেকট্রনিক অ্যানালগ মেশিনের উন্নয়ন ঘটেছে তাঁর হাতে; আবহাওয়া ও সমুদ্রবিষয়ক উপাত্ত এই মেশিনে সিগন্যালে পরিণত হয়ে সমুদ্রঝড়ের তীব্রতা, ঢেউয়ের উচ্চতা, উপকূলে সম্ভাব্য আঘাতের স্থান নির্ধারণ করে দিত। ডক্টর ইশিগুরো দুবছরের জন্য এসেছিলেন। শেষ পর্যন্ত স্বদেশে আর ফিরে যাওয়া হয়নি।

ওয়ারড্রোব আকৃতির বাবার মেশিনটা ডিজিটাল কম্পিউটারের কাছে মার খেয়ে গেছে। বাবার সঙ্গে মিলের প্রধান জায়গাটি কসমোপলিটান দৃষ্টিভঙ্গি। বাবা কারো সহায়তা ছাড়া একা একা কাজ করতেন, ঔপন্যাসিক ইশিগুরোও তাই – আমাদের দুজনের কারো সাহায্যের দরকার হয়নি। ২০০৭ সালে বাবার মৃত্যুর পর তাঁর অতিশয় মেশিনটার ঠাঁই হয় বাড়ির গ্যারেজে। বিজ্ঞান-জাদুঘর যন্ত্রটি নিয়ে গেছে, এতে মা খুব ভারমুক্ত হয়েছেন। মা পুরোপুরি জাপানিই রয়ে গেছেন, বদলাননি। তিনি স্বীকার করেছেন, তাঁর কথ্য-জাপানি ভাষাটা বড্ড বাজে। ভাষাটা ভালো করে শেখার আগেই তো ইংলিশ পরিবেশে জীবন শুরু। তারপরও একমাত্র জাপানি ভাষাতেই বাবা মার সঙ্গে কথা বলেন।

 

ইশিগুরোর আলমা মেটার

কাজুও ইশিগুরোর নোবেল পুরস্কার তাঁর ৯১ বছর বয়স্ক কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক তেরুকো তানাকাকেও জাগিয়ে তুলেছে। তিনি তাঁর ছাত্রের খবর রাখতেন। ১৯৮৯ সালে বুকার প্রাইজ পাওয়ার পর তিনি ইশিগুরোর দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে পড়তে শুরু করেন। কিন্তু কঠিন মনে হয়, একটি পাতা বারবার পড়তে হয়েছে তাঁকে।

ইশিগুরোর স্নাতক কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ইংরেজির অধ্যাপক ওয়েন্ডি পার্কিন্স গর্বিত, কারণ তাঁদের ছাত্র পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লেখকদের সারিতে; দর্শন বিভাগের গ্রায়েম ফর্বস বলেন, দর্শন পড়ে কী হবে এ-প্রশ্ন যাঁরা জিজ্ঞেস করেন, তাঁদের প্রশ্নের জবাব দেয় কাজুও ইশিগুরোর বই – আমাদের কাঁদায়, হাসায়, গভীর চিমত্মায় নিমগ্ন করে, কখনো সবগুলো একই সঙ্গে।

ইশিগুরোর স্নাতকোত্তর পাঠ ইস্ট অ্যাঙ্গলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃজনশীল লেখালেখি বিভাগে। এই বিভাগের ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ইশিগুরো লিখেছেন : সেই শরতে (১৯৭৯ সালের) আমি একটি স্যুটকেস, একটি গিটার, একটি পোর্টেবল ওলিভেটি, টাইপরাইটার নিয়ে নরফকে বাক্সটনে হাজির হই – ছোট্ট গ্রাম, একটি পুরনো ওয়াটার মিল, চারদিকে সমতল শস্যখামার। আমি এখানে এসেছি। কারণ আমাকে এক বছরের জন্য ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাঙ্গলিয়ার স্নাতকোত্তর সৃজনশীল লেখালেখি বিভাগে পড়াশোনা করার জন্য গ্রহণ করা হয়েছে।

তখন কোর্সের লেখক-প্রশিক্ষক ছিলেন অ্যাঞ্জেলা কার্টার ও রয় ব্র্যাডবাবি। অধ্যাপক জন কুকও পড়াতেন। তিনি মনে করেন, জাপানিজ ও ইংলিশ দুটি সংস্কৃতির স্মরণীয় কল্পপ্রবণ সংশেস্নষে তাঁর লেখা সাহিত্যে বিশেষ ছাপ রেখে গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডেভিড রিচার্ডসন, কোনো ছাত্র তাঁর প্রতিষ্ঠানকে এর চেয়ে বেশি গর্বিত করতে পারে না।

 

আধুনিক উপন্যাসে রাক্ষস ও খোক্কস কেন?

আসলে হোমারের অডেসি এবং ইলিয়াড আমার বিশেষ পছন্দের। বিভিন্ন অনুবাদকের হাতে অনূদিত হোমারের বইদুটো আমি নিয়মিত পড়ে থাকি। স্টিফেন মিশেলের সম্প্রতি অনূদিত দুটো বই আমি কেবল পড়ে শেষ করেছি। এমনিতে পুরনো গ্রিক রচনা আমার প্রিয় উপভোগ্য পাঠ – ইউরিপিডিস, এস্কিলাস – যেখানে খুব আন্তরিকভাবে মামুলি কায়দায় ঈশ্বর-ঈশ্বরীদের আবির্ভাব ঘটে। মানুষ নিজেই যখন স্মরণীয় কাজের স্বাক্ষর রাখতে পারে, সেখানে তাদের নির্দিষ্ট কারো হস্তক্ষেপে মানুষ বিস্মিত হয় না, এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও না – যেমন ইলিয়াডে গা-ঝাড়া দিয়ে বলছে, আমি তো শালাকে শেষ করে দিতে পারতাম যদি না মাঝখানে এথিনা হস্তক্ষেপ করত এবং তাকে সরিয়ে নিয়ে যেত। মামুলি ও নিত্যকার ব্যাপারে ঈশ্বর ও অতিপ্রাকৃত শক্তির সহ-অবস্থিতির বিষয়টি আমার ভালো লেগেছে।

শৈশবে আমিও বহু সামুরাই কাহিনি ও গল্প শুনে বেড়ে উঠেছি – কেবল লোকগল্প নয়, সামুরাইদের তুলে ধরা বড় বড় কাহিনিও। আমার কথা হয়তো সরলীকৃত মনে হতে পারে – বহু জাপানি সামুরাই গল্প, যা আজগুবি কাহিনি, সহজে এবং স্বাভাবিকভাবে এখনো বিরাজ করছে – এটা তেমন কঠিন কিছু নয়। একজন সামুরাই শহরে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন শহরের লোকজন তাকে বলল, ‘ওই সেতুর ওপারে আমাদের সমস্যা – প্রেতাত্মার আসর আছে। ওরা মাঝেমাঝে দেখা দিয়ে মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে, তুমি আমাদের জন্য একটা কিছু করো।’ তখন সামুরাই বলল, ‘বেশ তাহলে আমাকে একবেলা বিনেপয়সায় খাওয়াও। দেখি কী করতে পারি।’

কেবল লোককথায় নয়, জাপানি গল্পে সামুরাইর উপস্থিতি সনাতন ও স্বাভাবিক। তুলনামূলকভাবে আধুনিক – অষ্টাদশ, ঊনবিংশ শতকের লেখাতেও সামুরাইদের ঠাঁই হয়েছে। সেই ল্যান্ডস্কেপে জাপানি লোকগল্পে যাকে বলা হয় ‘অত্রি’ – সেই দানব ও রাক্ষসের সহ-অসিত্মত্ব রয়েছে, সেখানে শেয়াল তাৎক্ষণিক আকৃতি বদলে ফেলতে পারে… এখনো আমার কাছে খুবই স্বাভাবিক বিষয়। যখন আমার দ্য বেরিড জায়ান্ট উপন্যাসটি প্রকাশিত হলো, আমি অবাক হয়ে দেখলাম বইটি নিয়ে বেশ বিতর্ক হচ্ছে – এটি কোন ধরনের বই, আধুনিক ফ্যান্টাসি গোত্রের, নাকি অন্য কিছু? বেশ বিতর্ক হোক, আমার বইয়ের জন্য এ-ধরনের উপাদান আমার দরকার ছিল।

 

দুঃস্মৃতির অবলেপন ও পুনর্জাগরণ

নববইয়ের দশকে যুগোসস্নাভিয়ায় যা ঘটেছে তাতে আমি ভয়ংকর বিচলিত। আমরা স্নায়ুযুদ্ধের ভেতর বেড়ে উঠেছি, আতঙ্কে থেকেছি কখন না আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আণবিক অস্ত্রের লড়াই বেধে যায়। যখন স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটল, যখন বার্লিন দেয়াল ভেঙে পড়ল, তখন মনে হলো আমরা সত্যিই একটা ভালো সময়ের মধ্যে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, সত্যি কিছু সময়ের জন্য আশাবাদের সত্যিকার অনুভূতি বিরাজ করল।

তারপর যুগোসস্নাভিয়ায় যা ঘটল তা ভয়াবহ – স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে আমরা আবার ঠিক ইউরোপের ভেতরেই  কনসেনট্রেশন ক্যাম্প দেখলাম, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ দেখলাম – তা ঘটল এমন একটি দেশে, যেখানে আমরা হিচহাইকিং করতে কিংবা ব্যাকপ্যাকার হিসেবে ছুটি কাটাতে গিয়েছ। আমরা স্রেব্রেনিকা হত্যাযজ্ঞ দেখেছি – দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে জঘন্য হত্যাযজ্ঞ, একটি জাতিগোষ্ঠী অন্য একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে চলেছে – বড্ড বিচলিত করা ঘটনা ইউরোপের কেন্দ্রে আমাদের দেখতে হয়েছে। এর পরপরই ঘটল রুয়ান্ডার গণহত্যা।

এ-ঘটনাগুলোর ভীষণ প্রভাব পড়েছে আমার ওপর – আমি অবাক হই একটি দেশ এভাবে কেমন করে বিস্ফোরিত হয়? কেমন করে তা রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়। এটা আরো বেশি বিচলিত করে কারণ এই মানুষগুলো একসঙ্গে একই গ্রামে একই শহরে বসবাস করেছে, এক পরিবার পাশের পরিবারের বাচ্চার বেবিসিটিং করেছে, তাদের ঘরে কীভাবে আগুন লাগায়, কীভাবে তাদের গলায় ফাঁস দেয়।

একটা ব্যাপার এখানে উঠে এসেছে, এ-স্মৃতি সবার ভেতরে চাপা পড়ে আছে। আগে যা ঘটেছে তা ভুলে যেতে মানুষ হয়তো সম্মত হয়েছে, কিন্তু যুদ্ধ বাধাতে কিংবা ঘৃণা ছড়াতে যখনই কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এ-স্মৃতিতে নাড়া দিয়েছে মানুষ ভাবতে শুরু করেছে, ‘আমি তো মনে করেছিলাম রাস্তার ওপারের লোকগুলো ভালো, কিন্তু আগে তারা যে ভয়ংকর ঘটনা ঘটিয়েছে – আমরা এখনই যদি একটা কিছু না করি ওরা আবার কিছু একটা করে বসতে পারে।’

নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডেরও তো একই অবস্থা। প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিকরাও ধর্মীয় আচার, মৌসুমি যাত্রা, প্রাচীন যুদ্ধ ও প্রাচীন সহিংসতা টেনে এনেছে – কেবল আধুনিককালের ঘৃণার আগুনে তেল ঢালতে। সে-কারণেই আমি পুরনো ফ্যাশনের গল্প তৈরি করেছি – সেখানে জাদুমন্ত্রবলে মানুষের স্মৃতিকে দমিত করা হয়েছে। একালে স্মৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে গণমাধ্যমের প্রচারণা। আমাদের মতো একটি দেশে কেবল অতীতের দিকে তাকিয়েই তো কাজ করতে পারি না – জনমুখী বিনোদনের জন্য অতীত নিয়ে যে-লেখা হয়, জাদুঘর সৃষ্টি করা হয়, রাজকীয় দিবস পালন করা হয় – একটি বিশেষ বয়সগাষ্ঠী যারা অতীতের এসব ঘটনার ওপর আস্থাশীল তাদের ওপর এসবের বেশ প্রভাব পড়ে।

 

উপন্যাসই অন্তর্গত সত্তার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ

কাজুও ইশিগুরো মনে করেন মানুষের সচেতনতা এবং গভীর অন্তর্গত সত্তার কথা বলার অনবদ্য মাধ্যম হচ্ছে উপন্যাস, অন্য কোনো মাধ্যম নয়। তাঁর কথা :

হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি। আমি ভালো করেই অনুভব করি যখন আমি উপন্যাস লিখি আমাকে এমন একটা অভিজ্ঞতা উপহার দিতে হবে, যা সিনেমা কিংবা টেলিভিশনের পর্দার সামনে বসে দেখা সম্ভব নয় – যা পর্দা ঠিকভাবে উঠিয়ে আনতে পারবে না। আমি সবসময়ই বই পড়ি এবং মনে করি এটাই সঠিক কাজ – পাঁচ-ছ ঘণ্টা একটানা উপন্যাস পড়ার যে-অভিজ্ঞতা আর ভালো কোনো টিভি সিরিয়ালের ৪০ মিনিটের একটি এপিসোড দেখার অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম – এই বলে আমি পাঠকদের সমালোচনা করতে পারি না।… আমার লেখার বেলায় আমি মনে করি, মানুষের অন্তর্গত জগতের কথা উপন্যাসে যেভাবে সহজে তুলতে পারব, চলচ্চিত্র নির্মাতা হলে সেভাবে তা করতে পারতাম না। আমি নিশ্চিত, মেধাবী চলচ্চিত্র-নির্মাতা আমাকে ভুল প্রমাণ করতে পারেন এবং বলতে পারেন চলচ্চিত্রের টেকনিক তা পুরোপুরি দেখাতে সমর্থ – কিন্তু আমার সহজাত প্রবৃত্তি বলে উপন্যাসই মানুষের গভীর ভেতর তুলে ধরতে অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম।

 

বিপন্নতা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়

মানুষের বিপন্নতা মানুষকে ধ্বংস করে দেয় – বিপন্ন মানুষের সঙ্গে কাজ করার সময় একটার পর একটা দুর্ভাগ্যের ছবি যখন গ্যালারি ভরে ফেলে, সে-বয়সে যখন আদর্শবাদ এবং সরলতা নিয়ে মানুষ তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে যায়, গৃহহীনদের সঙ্গে কাজের সময় সে-বয়সই ছিল ইশিগুরোর। তিনি ভেবেছেন তাদের কষ্ট মোচন করতে পারবেন। তারাও ভেবেছে তাদের অবস্থা বদলে যাবে – কিন্তু সাময়িক উপশম হয়েছে মাত্র – তিনি দেখেছেন এসব মানুষের স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা নেই। তিনি লিখেছেন :

আমার বেড়ে ওঠার গঠনমূলক সময়ে আমি সমাজকর্ম করতাম – কিছু সময়ের জন্য স্কটল্যান্ডে কমিউনিটি উন্নয়নের কাজ করেছি, তারপর লন্ডনে দু-তিন বছর গৃহহীন পুনর্বাসনের কাজ। সরাসরি না হলেও এই সময়ের কাজের অভিজ্ঞতা আমার প্রথম উপন্যাসে ঢুকে পড়েছে। গৃহহীনতার বাস্তব চিত্র তুলে ধরে উপন্যাস লিখতে আমি প্রলুব্ধ হইনি। এ নিয়ে আমি অপরাধবোধ করতাম; আমি পশ্চিম লন্ডনে গৃহহীনদের হোস্টেলে কাজ করতাম।

এই বিপন্নদশায় তারা মন খুলে কথা বলে, তারা সবই ঢেলে দেয়। নিজেদের জাগিয়ে রাখতে তারা বিভিন্ন কর্মকৌশল অবলম্বন করে – পরস্পরের সঙ্গে এমনকি নিজের সঙ্গেও মিথ্যাচার করে – অনেক লোকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, যারা বারবার নিজের নাম বদলেছে – ব্যাপারটা এমন যেন তারা নতুন করে জীবনটা শুরু করতে চায়।

এক ধরনের অপরাধবোধ সবসময়ই তাঁর মধ্যে কাজ করেছে যে, তিনি তাদের কাছে এতকিছু শিখেছেন, লেখার এতসব রসদ জোগাড় করেছেন, বিনিময়ে তিনি তাদের জন্য তেমন কিছু করতে পারেননি। গদ্যটা লিখতে শুরু করার আগে আমাকে অনেক কিছু জানতে হতো; আমি কী লিখছি তার একটি অখ- ধারণা আমার চাই।

কিন্তু এই অখ- ধারণাটি যে পেলেন তা কেমন করে বুঝবেন? দু-তিনটি বাক্যে তা প্রকাশ করতে সমর্থ হবেন – অনেকটা তাঁর সৃষ্ট সারাংশের মতো – এর উত্তেজনা ও আবেগ তিনি অনুভব করতে সমর্থ – এখানেই তাঁর প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু।

কাজুও ইশিগুরোর নেভার লেট মি গো লেখার সময় ভেতর থেকে তাগিদ পেলেন লেখাটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে – এটি তাঁর লেখক-জীবনের ২৩তম বর্ষে ছ-নম্বর উপন্যাস। তাড়াতাড়ি লেখার ব্যাপারটা অন্য কোনো উপন্যাসের বেলায় ঘটেনি। তিনি কখনো বইয়ের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে দৃষ্টি দেননি, চেয়েছেন যা লিখবেন তা যেন ভিন্ন কিছু হয়।

 

মিলিয়নিয়ার লেখক না অভুক্ত-লেখক

২০০৫ সালেই জার্মান স্কিগেল অনলাইনের সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী তাঁকে বললেন : ইংরেজি ভাষায় আপনার দশ লাখের মতো বই বিক্রি হয়েছে, তার ওপর ২৮টি ভাষায় আপনি অনূদিত হয়েছেন।

ইশিগুরো বললেন, আমি এ-সংখ্যার ঠিক হিসাব রাখি না, তবে এটা সত্য, যাদের বই বেশি বিক্রি হয় এবং যাদের বই কম বিক্রি হয় তাদের মধ্যে ব্যবধানটা বিশাল। এমনকি খুবই সুখ্যাত লেখক, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী – বইয়ের বিক্রি খুবই কম। কাজেই একজন লেখক যে কোন ধরনের জীবনযাপন করেন তা আঁচ করা কঠিন। লেখক মিলিয়নিয়ার হতে পারেন আবার অভুক্তও থাকতে পারেন। গত ১০-১৫ বছরে ইংরেজি ভাষার লেখকদের পক্ষে বিশ্ববাজারে কর্তৃত্ব করা সম্ভবপর হয়ে উঠেছে।

 

কাহিনির পুনরাবৃত্তি নয়

কাজুও ইশিগুরোর কোনো উপন্যাসই পুনরাবৃত্তি নয় – আবার কোনো উপন্যাসের বর্ধিত অংশ নয়, কিংবা সেখান থেকে উদ্ভূতও নয়। প্রতিটিই স্বতন্ত্র উপন্যাস। দ্য বেরিড জায়ান্ট রচনা করতে দীর্ঘ সময় নিয়েছেন, অনেক গবেষণা করেছেন, অনেক বইপত্র পড়েছেন। তবে যখন লিখতে বসে যান তখন যেসব বই পড়েন লেখার সঙ্গে সেসব বইয়ের সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন :

যখন লিখতে থাকি, তখন আমার ফিকশনের জগৎটাকে অটুট রাখতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। আমি যে-জগৎ নিয়ে কাজ করছি সে-জগৎকে প্রভাবিত করতে পারে এমন সবকিছু আমি সচেতনভাবে এড়িয়ে চলি। যেমন – দ্য বেরিড জায়ান্ট লেখার সময় আমি গেমস অব থ্রোনসের একটি এপিসোডও দেখিনি। সবটাই আমি যখন লেখায় গভীর নিমগ্ন তখনকার কথা, আমি ভেবেছি – এরকম কিছু যদি আমি দেখি, আমি উপন্যাসের দৃশ্যটাকে যেভাবে কল্পনা করছি তা হয়তো পালটে যেতে পারে।

 

পরিকল্পনার স্তর এবং লেখার স্তর

দুটোই সম্পূর্ণ আলাদা। আমি যখন আমার প্রকল্পের পরিকল্পনা করি সক্রিয়ভাবে নতুন আইডিয়ার সন্ধান করি, বিসত্মৃত পড়াশোনা করি। পরিকল্পনায় অনেক সময় নিই। সেদিক দিয়ে আমি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত লেখক; আমি অনেক লেখককে জানি, যারা শূন্য ক্যানভাসে কাজ শুরু করে দেন, আমি কখনো তা করতে পারিনি। তারা আগে ক্যানভাস পূর্ণ করেন তারপর যা রসদ পেলেন তা ঘেঁটে এর ওপর কাজ করেন। এমনকি আমার লেখক-জীবনের শুরুতে যদিও খানিকটা বেপরোয়া ছিলাম – কথা বলি তা একটি ‘কল্পিত সেটিং’ মাত্র। আমি যখন দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে লিখি – যে-বইটিকে মানুষ ভীষণ রকম ইংলিশ নভেল হিসেবে গ্রহণ করেছে, সেই ইংল্যান্ডও আমার কল্পনায় গড়া ইংল্যান্ড।

 

দুর্ভাগ্য মেনে নেওয়ার সামর্থ্য

ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চল তো সুন্দর ও উপভোগ্য; কিন্তু দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডের ইংলিশ কান্ট্রিসাইড শীতল, ধূসর এবং ভয়ংকর বিষণ্ণ। উপন্যাসটিও মন খারাপ করিয়ে দেওয়া একটি রচনা – মানুষের বিপন্নদশা নিয়ে লেখা।

ইশিগুরো বলেন : আমাকে স্বীকার করতেই হবে এই ব্যাপারটি আমার সব বইয়েই ঘটেছে। দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডের (প্রধান চরিত্র) বাটলার নিজেকে
কোথাও ঠিকভাবে মানানসই মনে করতে পারছে না – ইংল্যান্ডের ইতিহাসে না, নাৎসি জার্মানিতেও না। সে কেবল মেনে নিচ্ছে কিছুটা গর্ব ও সম্মান উদ্ধার করার চেষ্টা করছে। উপন্যাসটি লেখার সময় শুরু থেকেই আমি জানি আমি দাসত্বে বন্দি শোষিত শ্রেণিকে নিয়ে লিখছি না, যারা পরে বিদ্রোহ করবে – আমার বিষয় মানুষের আত্মার জয়গান করা নয়, আমার আগ্রহ ছিল নির্মম ভাগ্য মেনে নেওয়ার সামর্থ্য মানুষের কতটা, তা দেখা।

 

অচ্ছুত এশীয় বালক!

বর্ণবাদ ব্রিটেনে বরাবরই ছিল। এশীয় বালক বাবা-মার সঙ্গে গিলফোর্ডে থাকতেন, পুরোটাই ইংরেজদের বসতি। কাজুও ইশিগুরো যে-স্কুলে পড়তেন তিনি ছিলেন একমাত্র নন-ইংলিশ। তিনি কি বর্ণবাদের শিকার হননি? তাকে অচ্ছুত মনে করেনি?

ইশিগুরোর জবাব : মোটেও তা নয়। আমি বরং বেশ জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলাম। স্থানীয় চার্চের সংগীত দলের আমি ছিলাম নেতা আর আমি সবাইকে চিনতাম। সেদিক দিয়ে ব্রিটিশরা বেশ মজার। কোনো কোনো স্তরে তারা বর্ণবাদী বলে অভিযুক্ত হয়েছে, কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে তারা বেশ খোলামেলা। বহুসংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র হয়ে-ওঠার আগেই আমি ব্রিটেনে বেড়ে উঠেছি। কাজেই অনেকভাবে আমি আমার সেই ইংল্যান্ডের ব্যাপারে স্মৃতিকাতর, যা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আমার শৈশবের ইংল্যান্ড আসলে গায়েব। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে পরবর্তীকালে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ সম্পর্কে ব্রিটিশদের মন্দ-অনুভূতি জন্মে, কিন্তু আমি যখন বালক এরকম কিছু ছিল না।

ইশিগুরো স্মৃতিকাতরতার কথা বললেও এমনকি ইংল্যান্ডের প্রেক্ষাপটে রচিত তাঁর উপন্যাস দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে ততটা ইংলিশ নয়। কিন্তু কেন?

তাঁর জবাব : আমি আসলে ইংল্যান্ড নিয়ে কখনো উপন্যাস লিখতে চাইনি। আমি অনেক লেখকের কথা জানি, যাঁরা ব্রিটিশ সমাজের উষ্ণতা কতটা প্রতিফলিত হয়েছে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন আর আমার বেলায় আমি যে ইংল্যান্ডের।

 

কার বই কার প্রভাব

সমকালীন ফিকশন, না ঊনবিংশ শতকের লেখা, নাকি দুটোর মিশ্রণ? ইশিগুরোর সাফ জবাব : সততার সঙ্গে বলতে গেলে আমি খুব বেশি পড়ি না। আমি যখন লিখি তখন উপন্যাস পড়া পছন্দ করি না, নন-ফিকশন পড়ি। আমি উপন্যাস পড়ি না, কারণ এটা ছোঁয়াচে ধরনের – স্টাইলের দিক দিয়ে যেমন, বিষয় ও পরিবেশের দিক থেকেও তেমনি। আমি যখন পড়ি আমার ওপর তার বড্ড বেশি চাপ পড়তে থাকে, আমার ভেতর ঢুকে পড়তে থাকে, আমার লেখাকে তখন বারবার পরীক্ষা করে এসব সাময়িক সৃষ্টি বাদ দিতে হয়; যেমন কনরাড পড়ছি – দেখা গেল আমি সে-নির্দেশনায়ই এগোচ্ছি। আমার চেনাজানা অনেকেই যতটা পড়াশোনা করে আমি তা করি না, তাদের অনেকেই আমার পছন্দের – আর যদি প্রভাবের কথা জিজ্ঞেস করেন, কার প্রভাব আমি ঠিক অবহিত নই।

আসলেই তাঁর ওপর কার প্রভাব। তাঁর উপন্যাস পড়ে আমেরিকান সমালোচক লিখেছেন, তাঁর উপন্যাস ফ্রাৎজ কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেট ধাঁচের। এ-সম্পর্কে ইশিগুরোর কথা : আমেরিকান সমালোচক বলতে চেয়েছেন তাঁর নেভার লেট মি গো উপন্যাস কাফকা কিংবা বেকেটের লেখার মতো বেশি বিমূর্ত। তিনি ঠিকই বলেছেন – আমার গোটা লেখক-জীবন আমি মানুষকে উৎসাহিত করেছি তারা যেন আমার উপন্যাস মেটাফোরিক্যাল লেভেল – আলংকারিক পর্যায়ে বিবেচনা করেন। ধরা যাক, সলবেলো সেটিং – আমি সেটিং নিয়ে কমই চিন্তিত। সেটিং আমার কাছে কেবল উপন্যাসের একটি কৌশলমাত্র। এর কথা আমি ভাবি সবার শেষে। প্রভাব প্রসঙ্গে জানান, যখন বয়স কম ছিল দস্তয়েভস্কি, তলস্তয় এবং শেখভ পড়েছেন। কোনো কোনো ইংরেজ লেখকের লেখাও। তবে জাপানি কোনো লেখক নন। তবে পঞ্চাশের দশকের জাপানি চলচ্চিত্র-নির্মাতা ইয়াসুজিরো ওজু কিংবা আকিরা কুরোসাওয়ার অনেক প্রভাব আমার ওপর; সিনেমার, বইয়ের নয়। অনুবাদে যখন জাপানি বই পড়ি আমাকে তা হতবুদ্ধি করে তোলে। তবে কেবল হারুকি মুরাকামির উপন্যাস পড়ে আমি জাপানি উপন্যাস বুঝতে এবং মেলাতে পারছি। হারুকি মুরাকামি একজন আন্তর্জাতিক লেখক।

মুরাকামিতে কি ব্রিটিশ ও আমেরিকান পপ সংস্কৃতির মিশেল? – জাপান তো সেরকমই। বলেন : কুড়ি বছর আগে আমি কুরোসাওয়ার বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলাম, তিনি ঠিক এ-কথাই বলেছেন। একজন তাকে প্রশ্ন করেন, আপনি শেক্সপিয়র অবলম্বনে কোনো ছবি বানান – সেটা তো আন্তর্জাতিক বিষয়। তিনি জবাব দেন, না এটাই স্বাভাবিক। কারণ তিনি শেক্সপিয়র, ফরাসি ও রুশ লেখকদের সঙ্গে বড় হয়েছেন। সনাতন জাপানি সেরকমই। টোকিও গেলে এটা স্পষ্ট হবে, সেখানে জনপ্রিয় সংস্কৃতি ও জাপানি ঐতিহ্যের সংস্কৃতির চমৎকার মিশেল। তাঁর লেখায় কার প্রভাব – বহুবার এ-প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে কাজুও ইশিগুরোকে। তাঁর জবাব :  দস্তয়েভস্কি আমার খুব পছন্দের; কিন্তু আমার ওপর তাঁর প্রভাব রয়েছে এটা মনে করা ঠিক হবে না। আমি জানি, অনেকেই মনে করেন আমার ওপর হেনরি জেমস এবং জেন অস্টেনের প্রভাব অথচ দুজনের কারো লেখাই আমার পছন্দ নয়।

পছন্দের লেখক নয় – তার বাইরে কোনো নির্দিষ্ট সময়ের কোনো পাঠ লেখককে অনেক বেশি প্রভাবিত করতে পারে বলে আমি মনে করি। এমন কিছু পাঠ ও চিমত্মা আমার সঙ্গে রয়ে যায়। আমার লেখায় উঠে আসে। আমি মার্শেল প্রম্নসেত্মর প্রথম খ–র বেশি পড়িনি; আমি ‘কমব্রে’ বা ‘মোয়ানস ওয়ে’র বেশি যাইনি – ‘কমব্রে’ সত্যি বলতে খুব ভোঁতা, এগুলো যায় না – কিন্তু প্রায় ষাট পৃষ্ঠার মুখবন্ধ ওভারচার আমার প্রথম উপন্যাস ও দ্বিতীয়টির অন্তর্বর্তীকালে পড়েছি। আমি মনে করি, আমার ওপর এর ভীষণ প্রভাব পড়েছে।… আমি কখনো কখনো আমার আগের উপন্যাসগুলোর দিকে তাকাই। প্রথম উপন্যাসটি স্ক্রিপ্টের মতো, একটি দৃশ্যের পর আর একটি দৃশ্য। আমার দ্বিতীয় উপন্যাস অ্যান আর্টিস্ট অব দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড সে-তুলনায় অনেক তরল কাঠামোর। এতে কাহিনি ফিরে আসছে, মিলিয়ে যাচ্ছে, শূন্যতা পূরণ করছে, কোনো বিষয়কে স্পর্শ করে বিসত্মৃত হয়েছে – আমি মনে করি, আমার শৈলী ও পদ্ধতির এটাই আসল কথা – আমি এরকম ভান করতে পারি না, সাধারণভাবে প্রম্নস্তই বড় প্রভাব – বরং বড় লেখক নন এমন অনেকের প্রভাব আমি নিজের জন্য তুলে নিই। সমকালীন লেখকরা যারা আমার ওপর প্রভাব রেখেছেন বলে মনে করছেন, আমাকে বলতে হবে আমি আসলে তা অবহিত নই – এটা অন্যরা খুঁজে বের করতে চেষ্টা করুক। সত্যি বলতে, আমি প্রচুর পড়াশোনা করি না। যখন আমি লিখি উপন্যাস পড়াটা পছন্দ করি না। আমি পড়ি নন-ফিকশন। আমি উপন্যাস পড়ি না, কারণ এটা রোগের মতো – কখনো শৈলী, কখনো এমনকি থিম এবং পরিবেশও সংক্রমিত হয়। একদিক থেকে বলা যায় বিশেষ করে আমি যখন পড়ি, তখন খুব প্রভাবপ্রবণ হয়ে যাই। আমি টের পাই তা আমার মধ্যে চলে আসছে – এ-কারণে আগে আমাকে বহুবার আমার লেখা পরীক্ষা করে এ-ধরনের উঠে আসা বিষয় বাদ দিতে হয়েছে – এটা একটা সাময়িক প্রচ্ছন্নতা, কনরাড কিংবা অন্য কারো লেখা যখন পড়ছি আমিও বেশ প্রলুব্ধ হচ্ছি এবং হঠাৎ দেখা যায় সেদিকে ঝুঁকে পড়ছি। সে-কারণে আমার চেনাজানা পছন্দের মানুষেরা যতটা পড়ে আমি তা করি না। তারপরও প্রভাবের কথা এলে বলব আমি ঠিক সেগুলো সম্পর্কে অবহিত নই।

তবু নোবেল ঘোষণার পর নোবেল সাইটেশনের ভূমিকা টেনে কেউ কেউ বলছেন, ইশিগুরো হচ্ছেন অস্টেন, কাফকা ও প্রম্নসেত্মর একটি ককটেল।

 

ভবিষ্যতের ‘সেটিং’য়ে উপন্যাস

পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি গ্রামীণ ইংল্যান্ডে বসবাস করা ভিন্নধাঁচের একদল শিক্ষার্থীকে নিয়ে টুকরো টুকরো গল্প লিখে চলেছেন। এই শিক্ষার্থীরা যে আসলে কারা, তাঁর জানা নেই। তিনি কেবল জানেন তাদের বসবাস একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত খামারবাড়িতে। তারা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মতো বইপত্র নিয়ে তর্কবিতর্ক করে, মাঝেমাঝে তাঁদের রচনা লিখতে হয়। প্রেমে পড়ে ছ্যাঁকা খায়, কিন্তু তাদের কোনো কলেজ ক্যাম্পাস বা শিক্ষকের দেখা নেই। লেখক জানেন এই তরুণদের ভাগ্যে অদ্ভুত একটা কিছু আছে; কিন্তু তা যে কী এটা লেখকের জানা নেই। নববইয়ের দশকের শুরু থেকেই তাদের নিয়ে গল্প লিখছেন, এর বাইরে যাননি। তিনি উপন্যাস লিখতে চাইছেন – ভিন্ন ধরনের একটি উপন্যাস। একবার তিনি রেডিওতে বায়োটেকনোলজির অগ্রগতি নিয়ে একটি আলোচনা (তিনি সাধারণত বিজ্ঞানবিষয়ক আলোচনা শোনেন না) শুনলেন আর এখানেই পেয়ে গেলেন সেই শিক্ষার্থীদের নিয়ে গল্প লেখার কাঠামো; তিনি আরো দেখলেন গল্প লেখার সহজ ও মৌল উপাদান হচ্ছে মানুষের অবস্থার বিপন্নতা। তিনি বললেন : আমি কখনো ভবিষ্যৎকে প্রেক্ষাপট করে গল্প লিখতে প্রলুব্ধ হইনি।

 

সব ক্যাথলিকের পাঠ্য ইশিগুরো!

কাজুও ইশিগুরো মোটেও ধর্মপ্রাণ চার্চ-নিবেদিত মানুষ নন। এমনকি তাঁর লেখাতেও ধর্মের বিশেষ করে খ্রিষ্টধর্মের ক্যাথলিক ধারার গুণগান কোথাও নেই। কিন্তু এটা মিথ্যা নয়, জাপান থেকে ইংল্যান্ডের সারে কাউন্টির গিল্ডফোর্ডে বাবা-মার সঙ্গে বসবাস করা সদ্য গিটার হাতে তুলে নেওয়া বালক ইশিগুরো স্থানীয় ক্যাথলিক চার্চ কয়ার সংগীত দলের নেতা হয়ে উঠলেন।

ন্যাশনাল ক্যাথলিক রেজিস্টার ইশিগুরো নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির পরপরই (৭ অক্টোবর ২০১৭) লিখে দিলো ইশিগুরোর নোবেল পুরস্কার লাভে কেন সব ক্যাথলিকের করতালি দেওয়া উচিত। কারণ তাঁর লেখায় ক্যাথলিক পাঠকরা তাদের আত্মার সংকটের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবেন, যেখানে ইশিগুরোর চরিত্রগুলো স্বচ্ছতার জন্য নিরন্তর লড়াই করছে, ক্ষণিক পদস্খলনে ভালো মানুষকে কেমন করে বছরের পর বছর ধরে খেসারত দিয়ে যেতে হচ্ছে, সম্পর্কের টানাপড়েনে আত্মা কেমন করে জর্জরিত হচ্ছে।

ন্যাশনাল ক্যাথলিক রেজিস্টার তার দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে, নেভার লেট মি গো অ্যালোন এবং দ্য বেরিড জায়ান্ট উপন্যাসের প্রশংসা করেছে। দ্য বেরিড জায়ান্টকে বলেছে স্পিরিচুয়াল পিলগ্রিমেজ – আত্মিক তীর্থ।

 

ক্রিয়েটিভ রাইটিং কোর্স করা প্রথম নোবেল বিজয়ী

ভাষাসাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করেছেন তাঁদের কেউ কেউ নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সৃজনশীল লেখার কোর্স করে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া তো দূরের কথা, ভালো লেখক হয়েছেন এমন দু-একটার বেশি নাম বলা যাবে না। কোর্স না করলেও হয়তো লেখক হিসেবে তাঁরা আত্মপ্রকাশ করতেন। হয়তো ইশিগুরোও করতেন। ক্রিয়েটিভ রাইটিং কোর্স নিয়ে এমনিতেই লেখকরা হাসিঠাট্টা করে থাকেন। ভারতীয়-ব্রিটিশ লেখক হানিফ কুরেশিও এর কট্টর সমালোচক।

বিবিসি রেডিও যখন তরুণ সদ্যস্নাতক ইশিগুরোর লেখা নাটক প্রত্যাখ্যান করে, তিনি আকস্মিকভাবে খবরের কাগজে ইস্ট অ্যাঙ্গলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়েটিভ কোর্সের বিজ্ঞাপন দেখলেন। কোর্সটি চালান বিখ্যাত লেখক রয় ব্র্যাডবারি। তিনি সেখানে যোগ দিলেন এবং শিক্ষক হিসেবে পেলেন অ্যাঞ্জেলা কার্টারকে।

হানিফ কুরেশির ঠাট্টা নিয়ে বলেছেন, তাঁর কথায় সত্যের কিছু উপাদান তো রয়েছেই। ক্রিয়েটিভ রাইটিং ইন্ডাস্ট্রিতে মান নির্ধারণী তারকা কিংবা ডাবল কিংবা অন্যকিছু থাকা দরকার। এ-মুহূর্তে সৃজনশীল লেখালেখির ব্যবসাটা ওয়াইল্ড ওয়েস্টের মতো। কেউ টাকা জমিয়ে কোর্স করতে যাবে। উপন্যাস কিংবা কবিতা নিয়ে নসিহত করবেন এমন একজন শিক্ষক যার কোনো উপন্যাস বা কবিতা প্রকাশিত হয়নি। লন্ডনের এমন একটা খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সের কথা আমি জানি, যেখানে ফিকশনের শিক্ষকের কোনো উপন্যাস এ-পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। আমি আরো জানি, তিনি কোনোদিন উপন্যাস লেখেনওনি। যিনি সাঁতার জানেন না, তাকে অলিম্পিক সাঁতার দলের কোচ নিয়োজিত করা কিংবা গানের সমালোচককে পিয়ানো শেখানোর দায়িত্ব দেওয়া যেমন, যেহেতু অনেক বই পড়েছেন কিংবা যেহেতু ইংরেজি সাহিত্যের পণ্ডিত তাঁকে লেখা শেখানোর দায়িত্ব দেওয়ার মধ্যে তফাত নেই। এটা একটা অসম্ভব কাজ। তবে আমার ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রে সৃজনশীল লেখার স্কুলগুলো অনেক পরিপক্ব। সমকালীন সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখকরা আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ান। অবসরগ্রহণের আগে পর্যন্ত টনি মরিসন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন।

 

ইশিগুরোর সিনেমা

কাজুও ইশিগুরোর সঙ্গে সিনেমার সম্পর্কটা অনেকদিনের এবং বেশ ঘনিষ্ঠ। ১৯৮৯-তে প্রকাশিত উপন্যাস দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে পর্দায় আনতে এগিয়ে এলেন জেমস আইভরি। সঙ্গে প্রযোজক ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইসমাইল মার্চেন্ট; তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন আরো দুজন প্রযোজক – মাইন নিকোলস এবং জন কোল। বাজেট ১৫ মিলিয়ন ডলার। অভিনয় করলেন অ্যান্থনি কুইন, এমা থম্পসন, ক্রিস্টোফার রিভ, পিটার ভন এবং হিউগ্রান্টের মতো নামিদামি তারকা। ১৩৪ মিনিটের ছবি, পরিবেশন করল কলম্বিয়া পিকচার্স। সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য বিষয়, এ-কাহিনির চিত্রনাট্য যাঁরা লিখেছেন তাঁদের একজন ২০০৫ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী হ্যারল্ড পিন্টার। অন্যজনও খ্যাতিমান সাহিত্যিক রুথ প্রাওয়ার জাভালা। রুথও বুকার বিজয়ী ঔপন্যাসিক এবং একসময় ভারতেও ছিলেন। রুথ জার্মান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ, ইশিগুরোও যে জাপানি বংশোদ্ভূত। পরিচালক সিনেমার কাহিনিতে কিছু পরিবর্তন আনায় হ্যারল্ড পিন্টার তাঁর নাম ক্রেডিট লাইনে দিতে চাননি। তাই হয়েছে। তবে এটাও সবার জানা যে, হ্যারল্ড পিন্টার-এর সঙ্গে আছেন।

২০০৩-এ মুক্তি পেয়েছে দ্য স্যাভেস্ট মিউজিক ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। পরিচালক গাই ম্যাডিন। প্রধান চরিত্রে ইসাবেলা রোসেলিনি, মার্ক ম্যাককিনে, মারিয়া দ্য ম্যাদিরস ও ডেভিড ফক্স।

সাড়া জাগিয়েছে তাঁর নেভার লেট মি গো এবং দ্য হোয়াইট কাউন্টেস

 

আমরা অমর নই

কাজুও ইশিগুরোর স্বীকারোক্তি -লেখক হিসেবে তিনি শস্নথগতির, একটি উপন্যাস লিখতে কয়েক বছর লেগে যায়। ২০১৫-তে ডেনভারস লাইটহাউস রাইটার্স ওয়ার্কশপে বলেন, তাঁর পক্ষে হয়তো আর কয়েকটা উপন্যাস লেখা সম্ভব হতে পারে। তাঁর কথা : আমরা অমর নই, আমরা সীমিত সময়ের জন্য এখানে : কাউন্টডাউন শুরু হয়ে যায়।

 

পাদটীকা : ১

পরিচিতি : কাজুও ইশিগুরোর জন্ম ৮ নভেম্বর ১৯৫৪, জাপানের নাগাসাকিতে। মা সনাতন জাপানি নারী, বাবা সাংহাইয়ে বেড়ে ওঠা উচ্চশিক্ষিত সমুদ্রবিজ্ঞানী।

১৯৬০-এ ইংল্যান্ডে আগমন; গিল্ডফোর্ডের দুটো স্কুলে পড়াশোনা, স্থানীয় চার্চের গানের দলের প্রধান; কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, ইস্ট অ্যাঙ্গলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়েটিভ রাইটিং কোর্সের স্নাতকোত্তর। কর্মজীবনের শুরু স্কটল্যান্ড ও লন্ডনের গৃহহীনদের নিয়ে। স্ত্রী সে-সময়কার সহকর্মী স্কটিশ মেয়ে লোর্না ম্যাকডুগাল। ১৯৮২-তে প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ অ্যা পেইল ভিউ অব হিলসের জন্য উইনিফ্রেড হল্টবি মেমোরিয়াল প্রাইজ পান। দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে ১৯৮৯-তে তাঁকে এনে দেয় বুকার প্রাইজ। ২০১৭-তে নোবেল পুরস্কার। কাজুও ইশিগুরো শিল্পী হতে চেয়েছিলেন    বব ডিলানের মতো রকস্টার; হতে পারেননি। স্মরণীয় কিছু গানের তিনি গীতিকার। এখনো দিনের কোনো না সময় হাতে গিটার তুলে নেন, প্রিয় কোনো সুর তোলেন।

নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি ইশিগুরোকেও বিস্মিত করেছে। এতদিন তিনি ছিলেন নিম্ন-মূল্যায়িত লেখকদের একজন। তিনি যোগ্যতমদের একজন বলেই সুইডিশ অ্যাকাডেমি তাঁকে বেছে নিয়েছে।

 

পাদটীকা : ২

কাজুও ইশিগুরোর রচনা

উপন্যাস :

A Pale View of Hills (1982)

An Artist of the Floating World (1986)

The Remains of the Day (1989)

The Unconsoled (1995)

When We Were Orphans (2000)

Never Let Me Go (2005)

The Buried Giant (2015)

চিত্রনাট্য :

A Profile of Arthur J. Mason (1984)

The Gourmet (1987)

The Saddest Music in the World (2003)

The White Countess (2005)

ছোটগল্প/ উপন্যাসিকা)

The Summer After the War (1983)

A Family Supper (1983)

A Village After Dark (2001)

Nocturnes : Five Stories of Music and Nightfall (2009)

চলচ্চিত্র/ নাট্যরূপ

The Remains of the Day

The White Countess

Never Let Me Go

গান

The Ice Hotel, Waiter Oh Waiter, I Wish I Could go Travelling again, Breakfast on the Morning Tram, The Changing Lights, The Summer We Crossed Europe. r