শ্রীকৃষ্ণের নামে নাম রেখেছিলেন ঠাকুরমা – কানাইলাল বিশ্বাস। হাটে-মাঠে মানুষ অবশ্য ওকে শুধু কানাই বলেই চিনত। তবে কেন জানি এলাকায় তেমন একটা সুনাম ছিল না কানাইয়ের।

জন্মের পরপরই মা মারা গিয়েছিল কানাইয়ের। আর বয়োপ্রাপ্ত হওয়ার আগেই কলেরায় ভুগে দুদিনের ব্যবধানে মারা যায় বাবা রসিকলাল বিশ্বাস ও দিদি মালতী। সেই থেকে কানাই একা। মানুষ বৃদ্ধ ঠাকুরমার হাতে। স্কুলজীবনে পরীক্ষায় নকল করতে গিয়ে এ-অঞ্চলের অত্যন্ত কড়া হেডমাস্টার যোগেন সেনগুপ্তের হাতে দুই দুইবার ধরা পড়ায় স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল কানাইকে। তারপর ওর আর লেখাপড়া এগোয়নি। একটা ঘোর অভিমান ছিল কানাইয়ের ভগবান ও জগৎ-সংসারের প্রতি। কোনো কিছুই ওর তেমন ভালো লাগত না। তবে নিজেকে কানাই ব্যস্ত রাখত খুব। ওকে প্রায় সারাক্ষণই তহশিল অফিসের বারান্দায় বসে থাকতে দেখা যেত। সবে পাকিস্তান হয়েছে। দলে দলে হিন্দু দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম হিন্দুশূন্য হয়ে যাচ্ছে। এ-সময় সস্তায়, অনেক সময় প্রায় বিনা পয়সায়, জমি কেনাবেচার একটা হিড়িক চলছিল খুলনার দক্ষিণাঞ্চলের হিন্দুপ্রধান গ্রামগুলোতে।

দেশভাগের পর কানাইয়ের নিকট আত্মীয়স্বজনও অনেকে ভারতে চলে গেল। চলে গেল কানাইয়ের আপন কাকা, পিসতুতো ভাইয়েরাও। কিন্তু দেশ ছাড়ার কোনো তাগিদ কানাইয়ের ছিল না। বরং এই ডামাডোলের মধ্যে জমি কেনাবেচা, জাল দলিল বানানো, বা কখনো দুর্বল কোনো হিন্দু পরিবারকে হুমকি-ধমকি দিতেও দেখা যেত কানাইকে। কারণ এর মধ্যে ওই অঞ্চলের মুসলিম লীগের কয়েকজনের সঙ্গে ওর দোস্তি গড়ে উঠেছিল। ওদের সঙ্গে সখ্যের সুবাদেই একটা বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে খুলনা অঞ্চলের মুসলিম লীগের ডাকসাইটে নেতা আবদুল গফুর খানসাহেবের সঙ্গেও। গফুর খানসাহেব কানাইকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, ওকে ছোটখাটো ফাইফরমাশ করতেন, একটু-বা হয়তো স্নেহও করতেন।

মুসলিম লীগের নেতা বলে সদ্যসৃষ্ট পাকিস্তানে রীতিমতো একজন ক্ষমতাবান মানুষ ছিলেন আবদুল গফুর খান। ১৯৫৮ সালে দেশে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন এলে এ-জেলায় গফুর খানের ক্ষমতা চরমে পৌঁছল। মন্ত্রী হলেন তিনি আইয়ুবের সরকারের। প্রায়ই করাচি, রাওয়ালপিন্ডি যান। ওখান থেকে আপেল, আঙুর, আখরোট নিয়ে আসেন। কানাইও তার ভাগ পেয়েছে দু-একবার। আখরোট খেয়ে তো কানাইয়ের ঠাকুরমা এক্কেবারে তাজ্জব বনে গেলেন! ওরকম শক্ত বিচির মধ্যে এরকম সুস্বাদু ফল!

মন্ত্রী হওয়ার পর আবদুল গফুর খান নিজের নামটা আরেকটু আলংকারিক করলেন। পশ্চিম পাকিস্তানি সামন্ত নেতাদের মতো নিজের নামের আগেও আরেকটা ‘খান’ যোগ করলেন। ফলে ওর নাম এখন থেকে হলো ‘খান আবদুল গফুর খান’। দুর্মুখেরা অবশ্য ঠাট্টা করে বলত ‘আগে খান, পিছে খান/ মধ্যিখানে গফুর খান’। এখানে অবশ্য ‘খান’ বলতে তারা মূলত খাওয়াটাকে বোঝাত। কারণ গফুর খানের বদনাম ছিল হিন্দুদের ফেলে যাওয়া বড় বড় বাড়ি দখলে নেওয়া বা ‘খেয়ে ফেলার’। কখনো রাষ্ট্রক্ষমতার জোরে, কখনো ওর পোষা বিহারি গুন্ডাদের দিয়ে স্রেফ ভয় দেখিয়ে। এ ছিল এক অফুরন্ত ক্ষুধা! আর এ-কাজে গফুর খানের এক ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠল যেন কানাই। অবশ্য ওর মুরুবিবর মতোই কানাইও এর মধ্যে নিজের নামটা কিছুটা পালটেছে। কেবল কানাইলাল বিশ্বাসের বদলে ও এখন নিজের নাম লেখে ‘শ্রীকানাইলাল বিশ্বাস’। প্রথমদিকে শুধু হিন্দুদের বাড়ি, জমি, দিঘি, এসব দখলের ঝোঁক থাকলেও গফুর খান যত বৃদ্ধ হতে থাকলেন হঠাৎ করে হিন্দু নারীদের প্রতি ওর আকর্ষণ যেন বেড়ে যেতে থাকল। এ-বয়সে এ-আগ্রহটা যতটা শারীরিক তার চেয়ে বোধহয় মানসিকই বেশি ছিল। কারণটাও এক অব্যাখ্যাত ও জটিল মনোজাগতিক কারণ। ফলে গফুর খানের এই ক্ষুধাও কখনো মিটত না। আর এ-ব্যাপারে খান আবদুল গফুর খানের প্রধান সহায়ক ছিল কানাই। খুলনা শহরের কোন গ্রামে কোন সুন্দরী হিন্দু বিধবা বা স্বামী-পরিত্যক্ত নারী আছে, সেসব খবর কানাই কেবল যে গফুর খানের কাছে পৌঁছে দিত তাই-ই নয়, কখনো ভয় দেখিয়ে, বা অর্থলোভে, সেসব নারীর কাউকে কাউকে রাতে গফুর খানের সার্কিট হাউস রোডের বড় বাড়িটাতে নিয়েও আসত।

এসব কথা কানাঘুষায় জানতে পেরে ঠাকুরমা একদিন ক্ষেপে গিয়ে বললেন : ‘ও কানাই, এমন অধম্মোর কাজ করিসনে বাপ। ভগবান সইবে না! স্বজাতির ক্ষতি করিসনে।’ কানাই চেতে উঠে বলেছিল : ‘ক্যান? শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনরে কয় নাই স্বজাতিরে মারতি। আমার নামডা তো তুমিই রাহিছিলে, না কি?’ বৃদ্ধ ঠাকুরমা মুখটা করুণ করে ঠাকুরঘরের দিকে চলে গেলেন।

তবে কানাই যে কারো উপকার করত না, তা নয়। এ-অঞ্চলে সবাই গফুর খানের সঙ্গে কানাইয়ের নিকট-সম্পর্কের কথাটা জানত। ফলে কোনো হিন্দুপরিবার বড় কোনো বিপদে পড়লে কানাইয়ের দ্বারস্থ হতো। কি থানায়, কি তহশিল অফিসে, কানাইয়ের উপস্থিতিতে, এমনকি নামেও, কাজটা অনেক সময় সহজ হয়ে যেত। তার জন্যে অবশ্য কানাইকে কিছু টাকা-পয়সা দিতে হতো। কিন্তু গ্রামের গরিব মানুষগুলোও জানত এ-দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হচ্ছে ‘ফেল কড়ি মাখ তেল’। ফলে কাজ উদ্ধার হলে, বা না হলেও, কানাইকে কিছু পয়সাকড়ি দিতে তারা তেমন একটা আপত্তি করত না। কিন্তু সমস্যা হতো, কানাই যখন বাড়ির বউ-ঝিদের খোঁজ করত। বাড়িতে সোমত্থ মেয়ে কয়টা, বিধবা বোন আছে কি-না, কানাইয়ের এসব প্রশ্নে মানুষ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠত। ফলে সাধারণ গেরস্তরা খুব বড় বিপদে না পড়লে সহজে কানাইয়ের কাছে ঘেঁষত না। এবং আড়ালে ওকে নানা রকম গালি দিত।

তাতে অবশ্য কানাইয়ের কিছু যেত-আসত না। কারণ থানা, তহশিল অফিস বা সরকারি কোনো অফিসে গেলেই কানাই ওর ক্ষমতার ধারটা টের পেত। এমনকি, ও যখন সাইকেলে বা হেঁটে গ্রামের পথ দিয়ে যেত, সে-সময় লোকজন ওকে যেভাবে ‘কানাইবাবু’ বলে ডাকত, মাথা ঝুঁকিয়ে নমস্কার করত, তাতে কানাইয়ের মনটা এক বিজাতীয় আনন্দে ভরে উঠত। মনে মনে বলত : ‘দ্যাখ, ব্যাটারা দ্যাখ! নমো বলে তো এদ্দিন গেরাহ্য করতিস না, এখন দ্যাখ এক নমোর কত ক্ষ্যামতা!’

সেদিক থেকে কানাইয়ের দিনকাল ভালোই চলছিল। নিজের জন্যেও বেশকিছু জমিজমা করেছিল। ওর বিয়ের জন্যে পাত্রীও খোঁজা হচ্ছিল। কিন্তু ওর এসব দুর্নামের কারণে ওর বিয়ের সম্পর্ক দু-তিনবার কিছুটা এগোলেও শেষমেশ মেয়েপক্ষ বাতিল করে দিত। সেসব পরিবারকে অবশ্য কানাই শুধু গ্রামছাড়া নয়, দেশছাড়াও করেছিল! ও জানত, ওর এখন যা ক্ষমতা ও ধনসম্পত্তি, তাতে ভালো ঘরের একটা মেয়ে বউ হিসেবে একসময় ও ঠিকই জুটিয়ে নিতে পারবে। ফলে ঠাকুরমা মাঝে মাঝে ওর এত বয়সেও আইবুড়ো থাকার ব্যাপারে ইঙ্গিত করে নাকিসুরে কান্নাকাটি করলেও কানাই তা নিয়ে তেমন দুর্ভাবনা করত না।

গ্রামে বাস করে, ফলে গ্রামে যাত্রাপালা বা কীর্তন হলে, বা গ্রাম্যসালিশ বসলে, কানাই সেসবে অংশ নিত বটে, তবে ওর মন পড়ে রইত খুলনা শহরে গফুর খানের বাড়ির আসরে। বিশাল বাড়িটা আগে ছিল খুলনার এক পুরনো হিন্দু জমিদারের। পাকিস্তান হওয়ার পর জমিদার পরিবারটি ভারতে চলে গেলে গফুর খান এ-বাড়িটা দখলে নেয়। লোকমুখে অবশ্য বাড়িটা এখন ‘গফুর সাহেবের বাড়ি’ নামেই পরিচিত হয়ে গেছে। তো এ-বাড়ির আসরগুলোতে গফুর খান যেরকম তুচ্ছভাবে ডিসি-এসপি এসব হোমরা-চোমরাদের সম্পর্কে কথা বলতেন, যেরকম সহজে কোনো থানার দারোগাকে একদিনের নোটিশে দুর্গম কোনো জায়গায় বদলি করে দিতেন, ক্ষমতার এসব প্রকাশ দেখতে কানাইয়ের বেশ ভালো লাগত। আর সে নিজে যে এসব ক্ষমতার, ভগ্নাংশ হলেও, অংশীদার হতে পেরেছে ভেবে খুবই আত্মপ্রসাদ অনুভব করত।

কানাইয়ের দাপট বেশ ভালোই চলছিল বলা যায়। কিন্তু বাদ সাধল সত্তরের নির্বাচনে যখন শেখ মুজিবের দল বিরাটভাবে নির্বাচনে জয়ী হলো এবং খান আবদুল গফুর খান নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন। তবে তারপরেও মরা-হাতি-লাখ-টাকার পুরনো নিয়মে গফুর খানের সামাজিক প্রতিপত্তি, দখল-করা হিন্দু উকিল বা জমিদারদের বড় বড় সব বাড়ি ও সম্পত্তি ঠিকই বজায় রইল। আর একটা জিনিস যে কেবল বজায়ই রইল তা নয়, বয়সের সঙ্গে যেন তা আরো বাড়তে থাকল। আর তা হচ্ছে হিন্দু নারীদের প্রতি তার সুতীব্র আগ্রহ। বৃদ্ধ গফুর খানের জন্যে হিন্দু নারী সরবরাহের কাজটা কানাইয়ের তাই বেড়েই চলল। একবার তো এমন হলো যে উপযুক্ত তেমন কাউকে না পেয়ে দৌলতপুরের পতিতালয় থেকে খোদেজা নামে এক মুসলিম পতিতাকে শাঁখা-সিঁদুর পরিয়ে ও গফুর খানের ঘরে পাঠিয়েছিল। একটা সুবিধা ছিল যে বয়সের কারণে গফুর খান চোখে ইদানীং কিছুটা কম দেখতেন এবং ওসব রাতে মদ্যপান একটু বেশি করতেন বলে সঙ্গিনীর সবকিছু তেমনভাবে দেখতেও পেতেন না। অবশ্য তার জন্যে খোদেজাকে বেশ বড় অংকের অর্থ দিতে হয়েছিল কানাইকে। তবে কানাই সেটা ওর পেশাগত খেসারত হিসেবেই মেনে নিয়েছিল।

তবে অবস্থাটা একেবারেই পালটে গেল যখন ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পর যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিশাল এক কনভয় খুলনায় এসে পড়ল। এবং শুধু এসেই পড়ল না, স্থানীয় বিহারিদের সহায়তায় খুলনা শহর ও আশেপাশের অঞ্চলে ব্যাপক হারে বাঙালিদের হত্যা করতে শুরু করল। আর হিন্দু হলে তো কোনোই রক্ষা নেই! কানাইয়ের নিজের গ্রাম ও আশপাশের গ্রামগুলো থেকে দলে দলে হিন্দু পরিবার তখন নৌকায় বা হেঁটে, কাঁধে, মাথায় নানা রকম বাক্স, পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে ভারতের পথে রওনা হলো। হঠাৎ করেই কানাই অনুভব করল ক্ষমতার যে তৃপ্তিদায়ক আবহটা ও ওর চারপাশে এতদিন অনুভব করে এসেছে তা যেন কিছুটা ফিকে হয়ে আসছে। লোকজনও তার দিকে কেমন যেন আড়চোখে তাকাচ্ছে। এমনকি, ওদের ডুমুরিয়া বাজারের মুদিদোকানদার মোবারক তো একদিন বলেই বসল : ‘দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ মানুষ হচ্ছে হিন্দু রাজাকার।’ অন্য সময় হলে এ-কথার জন্যে মোবারককে খুব চড়া মূল্যই দিতে হতো। কিন্তু এখন যখন থানা-পুলিশ, ইউনিয়ন বোর্ড, তহশিল অফিস কোথাও কোনো কাজ হচ্ছে না এবং সবকিছুই এক ভাঙনের মুখে, নিজের স্বজাতির লোকেরাও সব দলে দলে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে, তখন কানাই যেন কিছুটা অসহায়ই বোধ করা শুরু করল। আর এ-সময়ে ওর প্রথমেই যার কথা মনে এলো, তিনি হচ্ছেন ওর এতদিনের মুরুবিব এবং ওর সকল ক্ষমতার উৎস খান আবদুল গফুর খানের কথা।

তবে কোনো হিন্দুর পক্ষে এখন খুলনা শহরে যাওয়া মহাবিপজ্জনক। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বা বিহারিদের সামনে পড়লে আর রক্ষা নেই। হয় গল্লামারীর ব্রিজে নিয়ে গুলি করে মারবে অথবা ভৈরব নদীর পারে ফরেস্ট ঘাটের পাটাতনে মাথা রেখে জবাই করবে। এরকম কিছু লাশ কানাই স্বচক্ষে দেখেছেও। আর যতই ও মুসলিম লীগের লোকজনের সঙ্গে ঘোরাফেরা করুক না কেন, কানাই যে হিন্দু একথা তো সবাই জানে। এদিকে গ্রামে থাকাও কানাইয়ের জন্যে ক্রমশই অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। ফলে সেদিন সন্ধ্যায় লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরে মুখটা চাদরে ঢেকে মনের ভেতরে বেশ অনেকটা সাহস সঞ্চয় করেই কানাই চলল খুলনা শহরে গফুর খানের বাড়িতে। পথে অবশ্য তেমন কোনো বিপদ ঘটেনি। পরিচিত বাড়ি, পরিচিত ঘর, সহজেই কানাই পৌঁছে গেল গফুর খানের অন্দরমহলে। বড় শোবার ঘরটা কিছুটা আধো-অন্ধকার। কারণ কয়েকদিন ধরে শহরে বিদ্যুৎ নেই। গফুর খান বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় একজন দাড়িওয়ালা লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। দরজার কাছে কানাইকে দেখে ডাকলেন : ‘ভেতরে আয় কানাই।’ এ-আহবানে খুশি হয়ে ঘরে ঢুকেই কানাই দ্রুত হড়হড় করে ওর বিপদের কথাটা জানাল। বলল, গ্রামে টেকা মুশকিল হচ্ছে। গ্রামের ছাত্র-যুবকরা ওর দিকে এখন কেমন তেরচা চোখে তাকায়। আর পেছন থেকে ওকে লক্ষ করে নানা রকম বিরূপ মন্তব্য করে। আর শহরে এলে তো
যে-কোনো সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামনে পড়ে যাবে। ও মালায়ন এটা বুঝতে পারলে ওকে কি আর ওরা বাঁচিয়ে রাখবে! কী করা উচিত ওর? গফুর খান ধৈর্য নিয়ে ওর সমস্যার কথাটা শুনলেন। কিন্তু তারপরে যা বললেন তাতে কানাই বেশ বড় রকম একটা হোঁচট খেল। গফুর খান বললেন : ‘ওই পাঞ্জাবি মিলিটারিগুলো তো আমার কথাও শোনে না রে। ওদের কাছে আমিও তো বাঙ্গালি। তুই বরং ইন্ডিয়ায় চলে যা কানাই।’ বড় আশা নিয়েই কানাই গফুর খানের কাছে এসেছিল যে মুসলিম লীগের এতবড় একজন নেতা, যিনি জেনারেল আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ছিলেন, তার কাছে ওর নিরাপত্তা মিলবে, আশ্রয় পাবে। কিন্তু কোথায় কী?

এর পরের ঘটনা বেশ সংক্ষিপ্ত। দলে দলে হিন্দু শরণার্থী তখন হেঁটে, নৌকায় চেপে, ভারতের সীমান্তের দিকে চলেছে। গ্রামে ফিরে যাওয়া ওর জন্যে আর মোটেই নিরাপদ ছিল না। কানাই তাই অপরিচিত কিছু শরণার্থীর ভিড়ের মাঝে মিশে থেকে হাঁটতে হাঁটতে বেনাপোল সীমান্ত পর্যন্ত এসে পড়ল। ওই তো, আরেকটু পরেই ইন্ডিয়া। একবার ঢুকে যেতে পারলে আর চিন্তা নেই। গোটা যশোর রোডে তখন থইথই মানুষ। স্বজন হারানো, স্বদেশ হারানো ক্ষুব্ধ মানুষের ঢল। কয়েকদিন ধরে বর্ষার কারণে গোটা রাস্তাই ভেজা ও কর্দমাক্ত। তারই মাঝে কাদা ও মানুষে মাখামাখি হয়ে ক্লান্ত হয়ে কেউ পথে বসে রয়েছে, কেউ কোনো সাহায্য পাবার অপেক্ষায় বা অজানা কিছুর প্রত্যাশায় আরো সামনে এগিয়ে চলেছে। মুখটা চাদরে আংশিক ঢাকা থাকলেও হঠাৎ ওদের অঞ্চলের পরিচিত একজনের চোখে পড়ে গিয়েছিল কানাই। ‘ওই, … কানাই যায় না!’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল লোকটা। বহু বছরের সঞ্চিত ক্ষোভ, সব হারানোর বঞ্চনা, একদা অতিউগ্র হয়ে জনতার রূপ নিয়ে যেন ঘিরে ফেলল কানাইকে। এর পরের ঘটনা আরো সংক্ষিপ্ত। প্রথমে কিল-চড়-ঘুসি, পরে হাতের কাছে আর কোনো অস্ত্র না পেয়ে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা একটা আস্ত থান ইট দিয়ে ওরা মাটিতে পড়ে যাওয়া কানাইয়ের মাথাটা থেঁতলে দিলো। নিথর হয়ে রাস্তায় পড়ে রইল কানাইয়ের রক্তাক্ত মৃতদেহটা। আর সীমান্তের কাছে যশোর রোডের কাদামাখা পিচঢালা পথে কানাইয়ের মাথার কিছু মগজ পড়ে রইল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।