কানাডীয় সাহিত্যের পরিচয় ও সূত্রসন্ধান

কাজী রাফি

কানাডীয় সাহিত্য বিচ্ছিন্ন ভাবনা l সুব্রত কুমার দাসl মূর্ধন্য

l ঢাকা, ২০১৯l ৪০০ টাকা

 

ইংরেজি সাহিত্যের একজন ছাত্র হিসেবে অ্যাকাডেমিক কোর্স/ পাঠ্যের সঙ্গে আমরা আমেরিকা এবং ইউরোপ মহাদেশের মহান সব কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। আমাদের নিত্যদিনের পাঠ-পঠনে আফ্রিকান সাহিত্যের কিছুটা সন্ধান পাওয়া  গেলেও ‘কানাডিয়ান সাহিত্য’কে কোনোদিনই আলাদা করে শনাক্ত করতে পারিনি। বিশ্বসাহিত্যের উন্মুক্ত প্রান্তরে, উত্তর আমেরিকা থেকে শুরু করে ইউরোপ হয়ে দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশের প্রজ্ঞাবান অধ্যাপকদের মুখে কানাডিয়ান সাহিত্যের বিস্ত‍ৃত ভা-ারের সন্ধান কেউ পেয়েছেন কিনা আমার সন্দেহ হয়। কানাডিয়ান সাহিত্য : বিচ্ছিন্ন ভাবনা গ্রন্থটি রচনার মাধ্যমে সে-অভাব এবার ঘুচালেন অধ্যাপক সুব্রত কুমার দাস। উল্লেখ করার মতো বিষয়টি হলো, গ্রন্থটি রচনার সময় তিনি এত যত্নবান হয়েছেন যে, এই গ্রন্থপাঠ শুধু সাহিত্যবোদ্ধাদের জন্য সুখপাঠ্য হবে তা নয়, গ্রন্থটি পাঠে একইভাবে আকৃষ্ট এবং উপকৃত হবেন সাধারণ পাঠককুলও। পাঁচটি বছর কানাডীয় সাহিত্য, তাদের লেখক, বায়োগ্রাফিক্যাল ইতিহাস এবং তাদের সৃষ্টিরহস্য খুঁজতে গিয়ে সুব্রত কুমার দাস সাগর সেচে মুক্তা আহরণ করেছেন।

কানাডিয়ান সাহিত্যের সূত্রপাত থেকে এর বর্তমান সময় পর্যন্ত আলোকপাত করতে লেখককে যে-পরিমাণ অধ্যয়ন এবং মগ্নতার ধ্যানে আবিষ্ট হতে হয়েছে তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। আমরা, বাংলা ভাষাভাষীরা এতদিন ইংরেজি সাহিত্যের বাইরে কানাডিয়ান সাহিত্যকে আলাদা করে দেখার মতো ভাবনায় তাড়িত হইনি। এমনকি বাংলাদেশে ল্যাটিন আমেরিকার আভিজাত্য এবং বুনিয়াদ সম্পর্কে আমাদের এখানে যত আগ্রহ এবং অধ্যয়ন, তার পাশে কানাডার সাহিত্য সত্যিই অস্তিত্বহীন। কিন্তু সুব্রত কুমার দাস আমাদের চেতনা এবং ভাবনার দিগমেত্ম বড় এক সাহিত্যজগতের সন্ধান দিলেন। একটি পত্রিকা গ্রন্থটি মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছে – ‘পূর্বে সেইন্ট জন’স, পশ্চিমে ইউওকনের বিভার ক্রিক, উত্তরে নানাভুট আর দক্ষিণে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থবাজারের দেশ আমেরিকার সীমানা দিয়ে সাজানো ভূ-মানচিত্রের নানান সংস্কৃতির নিশ্বাসে সমৃদ্ধ এই কানাডার সাহিত্য বেড়ে উঠেছে বিচিত্র সব মানবিক উপাদানে। সুব্রত দাসের এই গ্রন্থে রয়েছে কানাডীয়দের হৃদয়তাড়িত ভালোবাসার কথা।’

লন্ডনে জন্মগ্রহণকারী কানাডার অভিবাসী কবি রবার্ট সার্ভিস সম্পর্কে এই প্রথম এ-গ্রন্থ আমাকে দারুণ সব রোমাঞ্চকর তথ্য  দেয়। একুশ বছর বয়সে এই কবি ভ্যাঙ্কুভারে আসেন। যে-পত্রিকায় রবার্ট কবিতা লিখতেন, সেই পত্রিকার সম্পাদক একদিন কবিকে বললেন,

Give us something about our own bit of earth … there’s a rich pay streak waiting for someone to work.

মজার ব্যাপার হলো, সম্পাদকের কথা শুনে বাড়ি হাঁটতে হাঁটতে তিনি একটি পানশালা অতিক্রম করেন এবং কবিতার গল্পটি তাঁর মাথায় ঘুরতে থাকে। কোন গল্প? ১৮৯৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে কানাডার ইউকন অঞ্চলে স্বর্ণের খনি আবিষ্কৃত হয়। উদ্বেলিত হয় উত্তর আমেরিকা, এমনকি ইউরোপও। লোকবসতিহীন বরফাচ্ছাদিত ছোট্ট এই এলাকা ভরে যায় লক্ষাধিক মানুষে। একে কেন্দ্র করেই সম্পাদকের সেই বিট অব আর্থ আবিষ্কারে মগ্ন হলেন কবি। গল্পের ছলে কবিতা অথবা কবিতার ছলে তিনি আবিষ্কার করলেন এক কালজয়ী গল্প, যে-গল্পের ট্র্যাজিক নায়ক ড্যান ম্যাকগ্রিউ। সোনা খুঁজে ফেরা মানুষ ড্যান সন্ধ্যার পর বারের পেছনে বসে পান করছিল। আর দেখছিল তাঁর প্রেমাস্পদ লোও নামের নারীটিকে। রবার্টের ভাষায় –

Back of the bar, in a solo game, sat Dangerous
                                              Dan McGrew,

And watching his luck was his light-o’-love,
                        the lady that’s known as Lou.

এ-সময় বারে ঢুকল অচেনা এক পুরুষ। অস্বাভাবিক আচরণ তার। নিভে গেল পানশালার বাতি। গুলির শব্দ হলো কয়েকবার। আলো জ্বললে দেখা গেল ম্যাকগ্রিউ আর অচেনা আগন্তুক দুজনেই মৃত। কিন্তু রবার্টের সৃষ্ট পরের দৃশ্যকল্পে পাঠক চমকে যান যখন লোও নামের সেই নারী, ম্যাকগ্রিউয়ের প্রেমাস্পদ, ম্যাকের পকেট  থেকে সোনার থলেটা নিয়ে সটকে পড়ে। স্বর্ণের খনি এলাকার একটা চিত্র আঁকতে গিয়ে রবার্ট বস্ত্তত আঁকলেন মানুষের চিরন্তন প্রবৃত্তিকে। এই
গল্প-কবিতা কবি রবার্ট সার্ভিসকে করে তোলে তুমুল জনপ্রিয়। তাঁর জনপ্রিয়তা এতই তুঙ্গে উঠেছিল যে, ১৯২১ সালে যখন কবিতাটিকে সিনেমা বানানোর প্রস্তাবে তিনি সম্মত হন, তখনই তিনি পেয়েছিলেন পাঁচ হাজার ডলারের একটা চেক!

গ্রন্থটির আলোচনা করতে গিয়ে তা থেকে একজন কবির লম্বা আখ্যান তুলে ধরলাম এই কারণে যে, সুব্রত কুমার দাস তাঁর কানাডীয় সাহিত্য : বিচ্ছিন্ন ভাবনায় শুধু কানাডার সাহিত্যের গুণগত মান
খুঁজে  ফেরেননি, তিনি কানাডীয় সাহিত্যজীবীদের জীবন, তাঁদের ভাবনা-প্রেরণার উৎসমূলও খুঁজেছেন। আমাদের যেমন তিনি পরিচয় করিয়ে  দেন কানাডীয় সাহিত্যের সৃষ্টিপথের সঙ্গে, একই সঙ্গে তিনি উন্মোচন করেছেন সেই সাহিত্যের ভূগোল-কৃষ্টি-ইতিহাস।

এ রীতিমতো এক গবেষণা বলা যায়। আমি নিশ্চিত কানাডীয় সাহিত্য নিয়ে, লেখকদের জীবন এবং কাজ নিয়ে এতো চুলচেরা আদ্যোপান্ত একই গ্রন্থে সন্নিবেশের ঘটনা খোদ কানাডায় বেশি পাওয়া যাবে না। এখানেই গ্রন্থটির বিশেষত্ব এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি বাংলা ভাষাভাষীদের, বিশেষত সাহিত্যিকদের, এমন এক অনন্য জগতের সন্ধান দিলেন, যা তাঁদের কানাডার সাহিত্যের প্রতি আগ্রহান্বিতই শুধু করে তুলবে না, বরং তা পাঠ করে তারা নতুনতর আরো এক দিগন্তরেখার সন্ধান পাবেন। যে-দিগমেত্ম দৃষ্টি রেখে একজন লেখক অথবা কবির ভাবনা হয়ে উঠবে আরো সুদূরপ্রসারী।

সুব্রত কুমার দাসের এই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রায় অনভ্যসত্ম অভিবাসী মানুষের করুণ জীবনযাপনের মর্মন্তুদ বেদনার কথা। গ্রন্থটিতে হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রায় বসবাসের যাতনা তুলে ধরতে, উষ্ণতার বন্দনা করতে গিয়ে লেখক জুতসইভাবে গোল্ডরাশের কবি রবার্ট সার্ভিসের কবিতার শোকগাথার দিকে নজর দিয়েছেন। রবার্ট সার্ভিসের ‘দ্য ক্রিমেশন অব স্যাম ম্যাকগি’ কবিতায় কবি খনিশ্রমিক স্যামের
শেষকৃত্যে যখন চিতা জ্বলে ওঠে, তখন ফার্নেসের দরজা খুলে তাকে দেখতে গেলে স্যামের লাশ স্মিত হেসে কবিকে বলে, ‘দয়া করে দরজা বন্ধ করো। আমি এখানে ভালোই আছি। তোমাদের বাইরে ঠান্ডার মধ্যে ছেড়ে এসে আমি এখন ভিতরের উষ্ণতার ছোঁয়ায় আছি। আমি শঙ্কিত এই ভেবে  যে, বাইরে এত বাতাস আর শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে তোমরা নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবে না।’

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষের অনুভবকে সংশিস্নষ্ট করে নির্মিত একটা সাহিত্য, যা ‘ক্যানলিট’ সাহিত্য নামে আজ
বিশ্বে পরিচিত, তাকে ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে সুব্রত আবিষ্কার করেন সাহিত্যের সৃষ্ট চরিত্রের প্রেম-ভালোবাসা। তাদের জন্ম-জনন,
ক্ষুধা-পিপাসা, প্রেম-অপ্রেমের নস্টালজিয়া। গ্রন্থটি পাঠ করে আমরা জানতে পারি খনিশ্রমিকের স্বল্প সময়ের অনুভব, জঙ্গলজীবন, গৃহকর্মীর সতীত্ব রক্ষায় আদালতের নিষ্ঠার চিত্র, প্যালেস্টাইনি শিশুদের কান্নার নিনাদ। বিশ্বের সকল প্রান্ত একই সঙ্গে কানাডীয় সাহিত্যে যেন মূর্ত হয়ে ওঠে। অ্যালান কুর্দ ও সিরীয় শরণার্থীদের জীবনকথা নিয়ে রচিত দ্য বয় অন দ্য বিচ গ্রন্থের লেখক টিমা কুর্দি থেকে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী (এবং স্বামীসহ কানাডার কুইবেকে আগমনকারী) কিংবদন্তি লেখক সুজানা মোদি, চিত্রী লেখক এমিলি কারের রচনাসম্ভার থেকে ফরাসিভাষী লেখক গ্যাব্রিয়েল রয় হয়ে শ্রীলংকা, চীনা লেখক, কে নেই এই গ্রন্থে! আছেন কানাডীয় আধুনিক কবিতার পুরোধা আরভিং লেইটন, চে গুয়েভারার আদর্শ বুকে ধারণ করা কানাডার কবিতায় প্রাণ সঞ্চার করা মিল্টন অ্যাকর্ন, আইরিশ লেখক ক্যারল শিল্ডস, দুশো গ্রন্থের ফরাসি অনুবাদক শিলা ফিসম্যান। সংগীতস্রষ্টা কবি লিওনার্দো কোহেন, এজরা পাউন্ডের ভক্ত গজল রচনাকারী ফিলিস ওয়েব, এঁরাও এসেছেন সুব্রত দাসের রচনায়। বাংলাদেশে ১৯৭০ সালে যে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল তাও উঠে এসেছে বাংলাদেশের লেখক আরিফ আনোয়ারের স্টর্ম উপন্যাসের প্রসঙ্গ আলোচনায়। আরিফ আনোয়ার ছাড়াও সুবিশাল কানাডার সাহিত্যভা-ারে রয়েছেন বেশকিছু বাংলা ভাষাভাষী কানাডীয় সাহিত্যিক। তাঁরা হলেন – বাংলাদেশের দয়ালী ইসলাম, লাবণী ইসলাম, ভারতের অর্জুন বসু, আয়েশা চ্যাটার্জী, ভারতী মুখার্জী, সব্যসাচী নাগ। কানাডীয় আটাশজন লেখকের তথ্য, তাঁদের সাহিত্যিক জীবন এবং কর্ম নিয়ে সৃষ্ট এ-গ্রন্থ আমাদের কানাডার মনুষ্যজীবনকে আরো নিবিড়ভাবে বুঝতে সাহায্য করবে, এ নিশ্চিত করে বলা যায়।

এমন এক অভিবাসী দেশে পৃথিবীর সকল প্রান্তর যেন একসঙ্গে তাদের রহস্যময়, মায়াভরা, কুহেলিকার অনিত্য জীবন একসঙ্গে প্রতিধ্বনিত করে; কানাডা একাই হয়ে ওঠে এই মহাবিশ্বে এমন এক জগৎ, যেখানে এই পৃথিবীকে সে প্রতিনিধিতব করে। মোস্তাফিজ কারগরের দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে মূর্ধন্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটির মূল্য চারশো টাকা। একজন প্রাবন্ধিক এবং সাহিত্য-গবেষকের পাঁচ বছরের মেধা-শ্রমই শুধু নয়, বরং গ্রন্থটি রচনা করতে তাঁকে ব্যয় করতে হয়েছে হাজার হাজার শ্রমঘণ্টা এবং নিজের পকেটের শত শত ডলারও (বইটির প্রাক্কথনে লেখক তাঁর এই অভিযাত্রার কাহিনিও গল্পচ্ছলে আমাদের জানান)। গেস্নারিয়া জিন্সের এক কাপ কফির মূল্যের অর্ধেক টাকায় এমন শ্রমসাধ্য, প্রবল নিষ্ঠায় নির্মিত এক ভুবনকে কিনতে পারা যায় – এ আমার কাছে বিস্ময়ের। আমি প্রত্যাশা করি, গ্রন্থটি আমাদের
চিন্তা-চেতনা এবং মননের ভূমিকে কর্ষণ করতে পৌঁছে যাবে অগণিত পাঠকের কাছে। সুব্রত কুমার দাসকে আবারো অভিনন্দন এবং অভিবাদন।