কানাডীয় চিত্রী-লেখক এমিলি কারের রচনাসম্ভার

কানাডীয় খ্যাতনামা চিত্রকর এমিলি কারের (১৮৭১-১৯৪৫) বয়স যখন সত্তরের কোঠায় তখন তিনি প্রথমবারের মতো হার্টঅ্যাটাকে আক্রান্ত হন। সালটি ছিল ১৯৩৭। এরপর থেকে ছবি আঁকার কাজটি শস্নথ হয়ে আসে। দিনের বেশির ভাগ সময় লেখালেখিতেই ব্যয় করতে শুরু করেন নন্দিত এ-শিল্পী। ১৯৪১ সালে ঠিক সত্তর বছর বয়সে এমিলির প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ক্লি ওয়াক শিরোনামের প্রথম সেই গ্রন্থ দিয়ে তিনি ছিনিয়ে নেন দেশের সর্বোচ্চ সাহিত্যস্বীকৃতি ‘গভর্নর জেনারেল সাহিত্য পুরস্কার’। বিশটি ভাষায় অনূদিত সে-গ্রন্থটি প্রকাশের পরের বছর এমিলি রচনা করেন স্মৃতিকথা বুক অব স্মল। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আরেকটি স্মৃতিকথা দ্য হাউস অব অল সর্টস। ১৯৪৫ সালে মহান এই শিল্পীর মৃত্যুর পর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো : গ্রোইং পেইন্স (১৯৪৬), পজ (১৯৫৩), দ্য হার্ট অব অ্যা পিকক (১৯৫৩) এবং হানড্রেডস অ্যান্ড থাউজেন্ডস (১৯৬৬)। এভাবেই কানাডার বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের উল্লেখযোগ্য শিল্পীদের অগ্রগণ্য এমিলি কার লেখক হিসেবেও কানাডীয় পাঠকদের কাছে হয়ে ওঠেন বন্দিত একটি নাম। ১৯৯৭ সালে কমপিস্নট রাইটিংস অব এমিলি কার শিরোনামে নয়শো পৃষ্ঠার একটি অমনিবাস প্রকাশ করে ডগলাস অ্যান্ড ম্যাকিনটায়ার নামে প্রকাশনা সংস্থা। ২০১৩ সালে সে-রচনাবলির নতুন সংস্করণ প্রমাণ করে লেখক হিসেবে এমিলির জনপ্রিয়তা।
এমিলির জন্ম ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের ভিক্টোরিয়ায়। ব্রিটিশ ঐতিহ্য-প্রভাবিত পরিবারের সন্তান এমিলি ১৮৯০ থেকে ১৮৯২ সাল পর্যন্ত সানফ্রান্সিসকোয় পড়াশোনা করেন। পরে ১৮৯৯ সালে লন্ডনে যান এবং ১৯০৫ সাল পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করেন। এরই মধ্যে শিল্পচর্চা শুরু করলেও যেহেতু তাঁর ধ্যানের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ফার্স্ট নেশনের মানুষ, এমিলি কানাডীয় শিল্পবোদ্ধাদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেননি। ভিক্টোরিয়ায় কিছুদিন শিল্পকলার শিক্ষক হিসেবে কাজ করার পর তিনি ১৯১০ সালে আবার ইউরোপে যান। প্যারিসে তাঁর অধ্যয়নের কেন্দ্রবিন্দু ছিল আধুনিক শিল্পকলা। ১৯১২ সালে ভ্যাঙ্কুভারে ফিরে তিনি জলরং ও তেলরঙের প্রধান চিত্রগুলো নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। আধুনিক শিল্পের বৈশিষ্ট্যকে শিল্পীসমাজের কাছে পরিচিত করে তুলতেও এমিলি বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিলেন পরের দেড় দশক ধরে। যদিও রূঢ় সত্য হলো, তিনি ১৯২৭ সাল পর্যন্ত কানাডীয় চিত্রকলার জগতে কখনো বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে বিবেচিত হননি।
ওই বছর অটোয়ার জাতীয় জাদুঘর এবং জাতীয় চিত্রশালার দুই কর্মকর্তা ভ্যাঙ্কুভার ভ্রমণকালে এমিলির শিল্পকর্মের সঙ্গে পরিচিত হন। অটোয়ায় সে-বছরের নভেম্বরে আয়োজিতব্য শিল্পপ্রদর্শনীর জন্যে তাঁর কিছু চিত্রকর্মও তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে যান। শিল্পীকেও তাঁরা আমন্ত্রণ জানান সশরীরে অংশগ্রহণের জন্যে। সে-প্রদর্শনীতেই এমিলির সঙ্গে সংযোগ ঘটে সেকালের কানাডার খ্যাতনামা শিল্পীদের, যাঁরা পরিচিত ছিলেন ‘গ্রম্নপ সেভেন’ নামে। ওই শিল্পীরা এমিলিকে সাদরে গ্রহণ করেন। এমিলি কারের শিল্পকর্ম নিয়ে শুরু হয় শংসা রচনা। চলতে থাকে আলোচনা-পর্যালোচনা। আদিবাসী জীবন ও তাঁদের প্রতিবেশকে আশ্রয় করে সৃজিত এমিলির শিল্পকর্ম চলে আসে প্রথম সারিতে। অবজ্ঞাত এমিলির শিল্পকর্ম এত বেশি উচ্চ মর্যাদায় আসীন হয় যে, তাঁর মৃত্যুর সাত দশক পরে তাঁর আঁকা ছবি ‘দ্য ক্রেজি স্টেয়ারস’ বিক্রি হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন ডলারে। কোনো কানাডীয় নারী চিত্রকরের আঁকা এটিই সর্বোচ্চ মূল্যের ছবি। ১৯২৮-৩০ সালের মধ্যে আঁকা এই ছবি ছাড়াও তাঁর অনেক ছবি যেমন ‘থান্ডার বার্ড’, ‘বস্নানডেন হারভার’, ‘ইন্ডিয়ান চার্চ’, ‘জুনোকুয়া অব দ্য ক্যাট ভিলেজ’, ‘টোটেম অ্যান্ড ফরেস্ট’ ইত্যাদি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত কয়েকটি ছবির নাম। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ছবিগুলোর অধিকাংশই তিনি এঁকেছিলেন উনিশশো বিশ ও ত্রিশের দশকে।
এমিলি কারের জীবন এত বেশি উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী এবং উৎসাহব্যঞ্জক যে, তাঁকে নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য জীবনীগ্রন্থ। তাঁর চেনাজানার অনেকেই এমিলিকে নিয়ে স্মৃতিগ্রন্থও প্রকাশ করেছেন। ক্যারল পিয়ারসনের এমিলি কার : অ্যাজ আই নিউ হার সকল বিবেচনাতেই অসামান্য এক রচনা। সাত বছরের ক্যারল খ্যাতিহীন শিল্পী এমিলিকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ১৯১৬ সালে। পরের আড়াই দশক ধরে এমিলি-ক্যারল সম্পর্ক ছিল মাতা-পুত্রীর মতো। এমিলির মৃত্যুর এক দশক পরে ক্যারল কাছ-থেকে-দেখা এমিলির কথা লিখেছেন এই গ্রন্থে। মমতাময়ী এক শিল্পীর ব্যক্তিগত বোধ এবং জীবনাচরণের অমূল্য এক দলিল ক্যারলের এই বই। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত গ্রন্থটির নতুন একটি সংস্করণ এসেছে ২০১৬ সালে।
২০০০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি কেইট ব্রেইডের (জন্ম ১৯৪৭) জীবনীগ্রন্থ এমিলি কার : রিবেল আর্টিস্ট। এ-প্রসঙ্গে স্মরণ করতে চাই, জীবনীগ্রন্থটি প্রকাশের আগে ক্যালগেরির এই কবি অদ্ভুত এক গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত সে-গ্রন্থটির নাম ছিল ইনওয়ার্ড টু দ্য বোনস : জর্জিয়া ও’কিফস’স জার্নি উইথ এমিলি কার। সে-গ্রন্থের ৫১ অংশটির কয়েকটি পঙ্ক্তি এমন :
She is poor. I see now why
She paints with house paints and brown paper.
She is a landlady, taxed
To the limits of a temper as short as mine
By the trivia of house guests.
এমিলির দারিদ্র্যক্লিষ্ট সে-জীবনের বেদনা ফুটে উঠেছে কেইটের এই পঙ্ক্তিগুলোতে।
শিল্পী ও লেখক এমিলি কারকে নিয়ে, তাঁর শিল্পীসত্তা এবং লেখকজীবন নিয়ে যে বিপুলসংখ্যক গ্রন্থ কানাডায় প্রকাশিত হয়েছে সেটি নিয়ে বিসত্মারিত আলাপ রীতিমতো এক গবেষণার বিষয়। তবে মানতেই হবে, বিশ্ব-শিল্পকলার প্রেক্ষাপটে রচিত মিস্টিক্যাল ল্যান্ডস্কেপস : ফ্রম ভিনসেন্ট ভ্যান গগ টু এমিলি কার এক অসামান্য প্রয়াস। আর্ট গ্যালারি অব অন্টারিওর উদ্যোগে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল একই সঙ্গে মিউনিখ, লন্ডন ও নিউইয়র্ক শহর থেকে। এমন একটি শিরোনাম দেখার আগে সাধারণভাবে একজন পাঠকের কল্পনায় বিশ্বপর্যায়ের শিল্পকলায় কানাডার এমিলির স্থান বুঝে নিতে কষ্ট হয়। ২০০৬ সালে কানাডার ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি শুধু এমিলির চিত্রাবলি এবং সেসবের মূল্যায়ন নিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশো পৃষ্ঠার এক নান্দনিক প্রকাশনা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করে। তবে কানাডার নারীশিল্পীদের সামগ্রিক বিচারকে বুঝতে এ. কে. প্রকাশের ইনডিপেন্ডেন্ট স্পিরিট : আর্লি কানাডিয়ান উইমেন আর্টিস্টস একটি মূল্যবান সংযোজন। ডরিস শ্যাডবল্ট-রচিত এমিলি কার (১৯৯০) গ্রন্থটিও মহান এই শিল্পীকে বুঝতে মূল্যবান সহায়ক।
প্রথম বই ক্লি ওয়াক থেকেই এমিলির বইয়ের প্রচ্ছদ নিজের আঁকা ছবি দিয়ে করা। প্রচ্ছদে লেখকের নামে এমিলির নিজের করা হরফও ব্যবহার করা হয়েছে। বই হাতে নিতেই বোঝা যায় এটির লেখকের স্বাতন্ত্র্য। ধারাবাহিকভাবে এই ধাঁচের গ্রন্থ-প্রচ্ছদ অন্য কোনো লেখকের ক্ষেত্রেও খুব বেশি সহজলভ্য নয়। বইগুলো যেন অনেকটা সিরিজ গ্রন্থের মতো।
দ্য কমপিস্নট রাইটিংস অব এমিলি কার গ্রন্থের ১৯৯৩ সংস্করণে ক্লি ওয়াক বইয়ের একটি ভূমিকা আছে। ভূমিকাটি লিখেছিলেন ইরা ডিলওয়ার্থ। রচনাকাল মুদ্রিত হয়েছে ১৯৫১। পঁচিশ বছর আগে শিল্পী এমিলির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন ইরা। শুরুর অনুচ্ছেদের বাক্যটি এমন : ‘MY EARLIEST VIVID memories of Emily Carr go back to a period considerably more than a quarter of a century ago, to a time when she was living in Victoria, British Columbia, still largely unnoticed as an artist and, by most of those who did know her in that capacity, unappreciated or treated with ridicule and even hostility.’ (পৃ ১৭)
যে-সময়ের কথা এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে তখন কিন্তু শিল্পী এমিলি পঞ্চাশের কোঠা পার করে ফেলেছেন। একুশটি গল্পের যে-সংকলন লেখক হিসেবে ততদিনে বিপুলভাবে নন্দিত এই শিল্পীকে দেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পুরস্কারটি এনে দিয়েছিল তার প্রতিটিতেই কানাডার পশ্চিম-তীরবর্তী অঞ্চলের ফার্স্ট নেশনের মানুষ ও তাদের জীবন ভিড় করে আছে। শুধু সূচিপত্রের দিকে তাকালেও স্পষ্ট হয় এমিলির প্রথম বইয়ের বিষয়াবলি। যে-জীবনকে তিনি কাছ থেকে দেখেছিলেন, যে-জীবনের সঙ্গে মিশে ছিল তাঁর সত্তার পুরোটা, সেই জীবনকেই প্রথমে শিল্পে, পরে সাহিত্যের বিষয় করে নেন এমিলি।
১৯৭২ সালে এমিলি-সংক্রান্ত একটি অন্যরকম বই প্রকাশিত হয়। বইটির শিরোনাম ছিল ফ্রেশ সিইং : টু অ্যাড্রেসেস বাই এমিলি কার। এমিলি-বিশেষজ্ঞ ডরিস স্যাডবল্ট জানিয়েছেন, সংকলিত দুটি অভিভাষণের প্রথমটি হলো ১৯৩০ সালের ৪ মার্চ দেওয়া। পরেরটি ১৯৩৫ সালের। আমরা দেখতে পাই ষাটের কোঠা পেরিয়ে এমিলি প্রথম কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা দিচ্ছেন। সে-বক্তৃতার প্রসঙ্গ এজন্য টানছি যে, শিল্পীর যে দার্ঢ্যের বহিঃপ্রকাশ সেটি কিন্তু ত্রিশের দশকেই স্পষ্ট। তিনি বললেন : ‘I hate like poison to talk. Artists talk in paints – words do not come easily.’ (পৃ ৭)
শিল্পের প্রতি ভালোবাসা, কাজের প্রতি নিষ্ঠা, শিল্প ও কাজ নিয়ে চিন্তার স্পষ্টতার জন্যে এমিলি বহু প্রজন্ম ধরে স্মরিত হবেন। তিনি এক পর্যায়ে বলেন, ‘It is not my own pictures I am pleading for. They are before you to like or to dislike as you please. That is immaterial. For the joy of the artist is in the creating, the making of his pictures.’ (পৃ ২০)
এমন দ্যুতিময় কথা ছড়িয়ে আছে প্রথম দুটি বক্তৃতার লাইনে লাইনে। দ্বিতীয় বক্তৃতায় একসময় শিল্পী বলেন, ‘In preparing notes for this talk I discovered something that I was unaware of. I should not be giving the talk at all because I am only a worker, and workers should work and talkers should talk, and both had best stick to their own jobs and avoid getting mixed up.’ (পৃ ৩৩)
শিল্পীর মননে যে-চেতনা, যে-দৃঢ়তা সেটির ওপর আলোকপাত করে রাখার জন্য এমিলির বক্তৃতার প্রসঙ্গটি আলোচনা করে রাখলাম।
এমিলি কারের রচনাগুলো খুব বেশি আত্মজৈবনিক। চলার পথের মানুষগুলোকে, প্রিয় প্রাণীগুলোকে, ভালোবাসার গাছপালাকে নিয়েই তিনি রচনা করেছেন একের পর এক গ্রন্থ। প্রথম গ্রন্থ থেকেই পাঠক এমিলির এই ধারার সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করেন। আপাতভাবে সে-গ্রন্থের গল্পগুলোকে কাল্পনিক কাহিনি মনে হতে পারে, কিন্তু লেখকের জীবনের সঙ্গে সেগুলোর সংযোগ দৃঢ় হওয়ায় অনেকেই প্রথম গ্রন্থটিকে ‘জীবনকথা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। জীবনে দেখা কথাকে লেখার বিষয় করার ক্ষেত্রে এমিলির তুল্য লেখক মেলা ভার। ভার এ-কারণে যে, শুধু শুরুরটি নয়, একের পর এক সকল গ্রন্থেই এমিলি আসলে ‘জীবনকথা’ই লিখেছেন।
এমিলি কারের সততা এবং দ্বিধাহীনতা এই যে-তিনি যেমনটি তাঁর চিত্রকলায় করেছিলেন – অর্থাৎ আদিবাসী জীবনকে চিত্রায়ণ – লেখালেখিতেও তিনি সেখান থেকে সামান্যও সরেননি। প্রথম গ্রন্থের যে-শিরোনাম ক্লি ওয়াক, যেটি আমাদের ভাষায় অর্থ দেবে ‘হাস্যরত’, সেই নামকরণের ক্ষেত্রেও তিনি অপ্রতিরোধ্য ছিলেন। কিন্তু ওই যে নিজ চোখে দেখা জীবনের ছবি আঁকলেন এমিলি সেগুলোতে এত বেশি হৃদয়ের স্পর্শ ছিল, সেগুলো এত বেশি জীবনঘনিষ্ঠ ছিল এবং সেগুলোর ভাষা ও উপস্থাপনায় তিনি এত বেশি দক্ষতার পরিচয় দিলেন যে, প্রথম বই থেকেই শিল্পী এমিলি কার হয়ে উঠলেন জনপ্রিয় লেখিকা। তাঁর সে-জনপ্রিয়তা মৃত্যুর সাত দশক পরে এসে বেড়েছে বই কমেনি।
এই যে স্বতঃস্ফূর্ত ‘লাইফ-স্কেচ’ রচনা সেটি কিন্তু এমিলি কারের জীবনে আমরা দেখতে পাই একের পর এক। বুক অব স্মল, দ্য হাউস অব অল সর্টস, গ্রোইং পেইনস, দ্য হার্ট অব অ্যা পিকক – সবকটি কিন্তু একই ধাঁচের রচনা। মাঝে ভিন্নতা এনেছিল পজ গ্রন্থটি। কেননা, সেটির প্রথম সংস্করণে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা অলংকরণে ভরা ছিল। কমপিস্নট রাইটিংস অব এমিলি কারে যদিও আঁকাগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়নি। মোটামুটি এক হাজার পৃষ্ঠা জুড়ে এমিলির এই স্কেচ-রচনা। সেখানে জোর করে গল্পের খোলস দেওয়ার চেষ্টা নেই। উপস্থাপনের ভঙ্গিতেই রয়েছে অনন্য এক সরলতা। কিন্তু সরল সে-কথাভঙ্গির মধ্যে রয়েছে গল্পের আবেশ। আর সে-কারণেই এমিলি কারের রচনা পাঠককে আকর্ষণ করে, মুগ্ধ করে, এবং পরিসমাপ্তিতে পাঠককে ঋদ্ধ করে।
শিল্পী এমিলির মৃত্যুর দুই দশক পর প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর দিনলিপির প্রথম সংস্করণ। হানড্রেডস অ্যান্ড থাউজ্যান্ডস শিরোনামের সে-গ্রন্থের উপশিরোনাম ছিল ‘দ্য জার্নালস অব এমিলি কার’। প্রায় সাড়ে চারশো পৃষ্ঠার সে-জার্নালে আমরা পেয়েছি ১৯২৭ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত সময়কে। বিন্যস্ত করা হয়েছে মোট
১৪টি ভাগে। আগ্রহী পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে ১৯২৭ সাল হলো সেই মাহেন্দ্র-বছর যখন খেটে-খাওয়া, দারিদ্র্যক্লিষ্ট এক নারী, শিল্পপ্রাণ এক নারীসত্তার স্বীকৃতি জুটছে। অচ্ছুৎ এক শিল্পকর্মী হয়ে উঠছেন পত্রিকার শিরোনাম। দারিদ্র্যকে যিনি বিদায় জানাচ্ছেন ফুল ও মাল্য হাতে। শিল্পী ও লেখক এমিলি কারের জীবনের ওই অভিঘাতগুলো বুঝতে সে-সময়ে রচিত দিনলিপিটি ভীষণ প্রয়োজনীয় এক উপাত্ত।
২০০৩ সালে দ্য আননোন জার্নালস অব এমিলি কার অ্যান্ড আদার রাইটিংস প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটিতে এমিলির লেখা ডায়েরির অপ্রকাশিত কিছু অংশ রয়েছে। রয়েছে যোগাযোগের কিছু দলিলপত্রও। ‘লেকচার অন টোটেম’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ
বক্তৃতার সন্ধান রয়েছে সেখানে। ২০০৭ সালে নতুন আরো একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। অ্যান লি সুইটজার-সম্পাদিত সে-গ্রন্থের নাম দিস অ্যান্ড দ্যাট : দ্য লস্ট স্টোরিজ অব এমিলি কার। সে-গ্রন্থের ভূমিকা পার হয়ে মূল অংশে ঢুকলে একটি নতুন চমক পাঠকের দৃষ্টিতে পড়বে। লেখা রয়েছে : ‘দিস অ্যান্ড দ্যাট : অর দ্য রিয়াল ‘হানড্রেডস অ্যান্ড থাউজ্যান্ডস’। মূল হানড্রেডস অ্যান্ড থাউজ্যান্ডস দিনলিপিতে আমরা দেখেছিলাম সন-তারিখ ক্রম অনুযায়ী লেখাগুলোকে সাজানো। দিস অ্যান্ড দ্যাটে দেখতে পাচ্ছি নতুন নতুন শিরোনামে রয়েছে লেখাগুলো। এ-গ্রন্থের ভূমিকায় এমিলি লিখেছেন : ‘There is no sequence to my Hundreds and Thousands’ (পৃ ১০)
শিল্পী হিসেবে এমিলি কারের প্রচার আজ বিশ্বজুড়ে। তিনি এখন এক কিংবদমিত্মতে পরিণত। ২০১১ সালে ভিক্টোরিয়ার রয়াল মিউজিয়াম থেকে একটি আলাদা ধরনের বই প্রকাশিত হয়েছিল যেটি ছিল এমিলির ১৯১০ সালের মননের বহিঃপ্রকাশ। সিস্টার অ্যান্ড আই শিরোনামের সে-বইটি আসলে একটি এক্সারসাইজ বুক। ৯২ পৃষ্ঠার সেই বইটি এমিলি বানিয়েছিলেন বোনের সঙ্গে তাঁর লন্ডনযাত্রাকে ছবিতে ধরে রাখতে। নিজে আনন্দ পেতে এবং সহযাত্রী বোনকে আনন্দিত করতে তাঁর এই প্রয়াস। এক্সারসাইজ বইয়ে যেভাবে ছিল সেভাবেই পৃষ্ঠাগুলোকে স্ক্যান করে মুদ্রণ করেছে ভিক্টোরিয়ার রয়াল মিউজিয়াম। বাঁপাশে তারিখ দিয়ে সামান্য বিবরণ, ডানপাশে একটি ছবি। ছবিগুলোর মধ্যে যেন খানিকটা কৌতুক-মেশানো। ভেতরে ভেতরে একজন শিল্পী হয়ে-ওঠার, একজন লেখক
হয়ে-ওঠার যে-প্রস্ত্ততি এমিলির চলছিল সেটার প্রামাণ্য এক দলিল এই সিস্টার অ্যান্ড আই। বইয়ের ভূমিকায় ক্যাথরিন ব্রিজ জানিয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে ১৯০৭ সালে এমন আরেকটি ‘ফানি বুক’ এমিলি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য সে-এক্সারসাইজ খাতাটি পরবর্তীকালে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এমিলি কার কানাডার শিল্প-সাহিত্য জগতের এক কিংবদমিত্মর নাম। কানাডার ইতিহাসে শিল্পচর্চায় নিবেদিত নারীদের তালিকায় এমিলির নাম সর্বাগ্রে। লিঙ্গভেদ না করেও যে-বিবেচনা, সেখানেও এমিলি বহু-উচ্চার্য একটি নাম। শিল্প-জগতে এত খ্যাতিমান দ্বিতীয় মানুষ সম্ভবত কানাডায় আমরা পাইনি, যিনি লেখালেখির জগতে এমন মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁর জনপ্রিয়তার এই উত্তুঙ্গের কারণেই ভ্যাঙ্কুভারের রহস্যোপন্যাসের লেখক এরিক উইলসনের ‘লিজ অস্টেন’ রহস্য সিরিজের একটির শিরোনাম
হয়ে ওঠে দ্য এমিলি কার মিস্ট্রি। কিশোর-বয়েসিদের উপযুক্ত এই রহস্য-উপন্যাসটি পনেরো লাখ কপির বেশি বিক্রি হয়েছে দেখে ভালো লাগে। ভালো লাগার কারণ হলো, উপন্যাসের রহস্যটি কেন্দ্রীভূত হয়েছে এমিলি কারের একটি শিল্পকর্ম চুরি যাওয়া নিয়ে। কাল্পনিক এক আবহে উপন্যাসের চরিত্ররা সেখানে কথা বলে, কিন্তু তাদের আলাপে একসময় প্রসঙ্গ হয় এমিলির দৈন্যজীবন, জীবনের ক্লেশ ইত্যাদি। উচ্চারিত হয় কৃতী এই শিল্পীর শিল্পকর্মের নাম এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি।

সহায়ক গ্রন্থ
১. Fresh Seeing : Two Addresses by Emily Carr, Clarke, Irwin & Company Ltd, Toronto, 1972.
২. The Complete Writings of Emily Carr, Doris Shadbold, Douglas & Mclntyre, Vancouver, 1993.
৩. Opposite Contraries : The Unknown Journals of Emily Carr & Other Writings, Emily Carr, Douglas & Mclntyre, Vancouver, 2003.
৪. Emily Carr : As I knew Her, Carol Pearson, Touchwood Edition, Toronto, 2016.
৫. Emily Carr : Rebel Artist, Kate Braid, XYZ Publishing, Montreal, 2000.
৬. This and That : The Lost Stories of Emily Carr, edited by Ann-Lee Switzer, Ti-Jean Press, Victoria, 2007.
৭. Sister and I : From Victoria to London, Emily
Carr, Royal BC Museum, Victoria, 2011.